মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন : নারী প্রসঙ্গ

মা হমুদুল হকের জীবন আমার বোন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস হলেও এর নায়ক-চরিত্র দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেকটা নিস্পৃহ, যুদ্ধকে সে এড়িয়ে চলতে চেয়েছে। মার্চের ১ থেকে ২৭ তারিখ পর্যন্ত দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি উদ্বেগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে জাহেদুল কবির খোকা; কিন্তু নিজে চলেছে গা বাঁচিয়ে, ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানেও যায়নি। এরই মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রেক্সে গিয়ে ফুর্তি করেছে। উপরন্তু নারী সম্পর্কে সে এক স্পর্শকাতর পুরুষ। এ-উপন্যাসে খোকাকে নানাভাবে আবর্তন করে আছে কয়েকজন নারী। গ্রন্থটির শিরোনাম যাকে নিয়ে সে খোকার পঞ্চদশী বোন রঞ্জু। নেপথ্যে আছে অকালে মরে যাওয়া দুই বোন অঞ্জু ও মঞ্জুর প্রসঙ্গ, আছে খোকার মায়ের কথাও। এর বাইরে এ-উপন্যাসজুড়ে জ্বলজ্বল করছে তিন নারী – নীলাভাবি, বেলী আর লুলু চৌধুরী। বস্ত্তত রঞ্জু আর যুদ্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিলে এই কাহিনিতে এই তিন নারীর প্রসঙ্গই মুখ্য আলোচ্যরূপে অবশিষ্ট থাকে।

দুজন চাকর ছাড়া ধানম–র বাড়িতে একই ছাদের নিচে বলতে গেলে একমাত্র আপনজন ছোটবোন রঞ্জুকে নিয়ে থাকে খোকা। মা অকালে মরেছে, বাবা রাওয়ালপি–তে কর্মরত। এছাড়া খোকাকে ঘিরে থাকে তার অকালপ্রয়াত দুই বোনের স্মৃতি, যাদের মৃত্যু ঘটেছিল জলে ডুবে :

বাঞ্ছারামপুরে মামাবাড়ির পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের শ্যাওলায় পা হড়কে পানিতে পড়ে যায় অঞ্জু, মঞ্জু নামে তাকে ধরতে; বাঁচানো যায়নি দুজনের একজনকেও। রঞ্জু যেন মামাবাড়ির সেই আশ্চর্য শান্ত তিরতিরে পুকুর যার গভীর গোপন তলদেশে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে অঞ্জু আর মঞ্জু। [পৃ ১৩]

রঞ্জু আর খোকা – এই দুই ভাইবোন পরস্পরের বেঁচে থাকার প্রেরণা। তাদের জীবনের উদ্বেগ, ভালোবাসা, নির্ভরতা পরস্পরকে ঘিরেই আবর্তন করে। দুজনের বয়সের পার্থক্য সাত বছরের হলেও সে-সম্পর্ক আড়ষ্টতাহীন, বন্ধুত্বপূর্ণ। তারা নিজেরা যখন কথা বলে সে-আলাপে থাকে স্নেহ-ভালোবাসাজাত বিচিত্র বাকসৌন্দর্য। খোকা ভীষণ বোহেমিয়ান ও স্বেচ্ছাচারী জীবনে অভ্যসত্ম। তার দিনযাপনে যেটুকু রুটিন আছে তা কেবল ওই সহোদরা রঞ্জুর দিকে তাকিয়ে। রঞ্জু স্কুল শেষ করে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে, বয়সের তুলনায় চিমত্মায় ও আচরণে অনেক পরিণত। বছর-দুই আগে মায়ের মৃত্যু তাকে ক্রমে ক্লান্ত ও দুর্বোধ্য করে তোলে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, শপিং করা, সিনেমায় যাওয়া কিছুতেই আগ্রহ নেই তার। সংসারের কাজকর্ম তদারকি করে অবসরে সে গল্প-উপন্যাস পড়ে, বাগান করার শখও আছে এই পঞ্চদশীর। রঞ্জু আর খোকার খুনসুটি, নির্ঘুম রাতে স্নেহসিক্ত কথোপকথন, পরস্পরের ভালোমন্দে তীক্ষন নজরদারি ভাইবোনের সম্পর্কের গভীরতা নির্দেশ করে। নিম্নোক্ত বর্ণনায় স্পষ্ট হয়, সহোদরার প্রতি খোকার অকৃত্রিম বাৎসল্য-জারিত মনোভাব :

খুব সাবধানে নখের ধার মারতে থাকে খোকা ফাইলিং করে। খোকার মনে হয় এই তো সেই রঞ্জু, এ আমার কতো চেনা, রুপোর তোড়াপরা ঝুমঝুমি বাজানো ছোট্টবেলার সেই রঞ্জু, মুরাদ একে চেনে না, কাব্যচর্চার ঘোড়ারোগ দিন দিন বানোয়াট করে তুলেছে তাকে। রঞ্জুর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে খোকা স্বসিত্ম পায়, সুস্থ হয়; এমন স্নিগ্ধ এমন নির্মল এমন নিষ্কলঙ্ক হতে পারে কেবল করুণাধারা।  [পৃ ১৪৫]

রঞ্জুর কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না, কোনো অভিযোগও করত না। খোকা যখন নীলাভাবির বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছিল, তখন পাক আর্মিরা অতর্কিত ঢাকা শহরে রাস্তায় রাস্তায় কামান-মর্টার নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কারফিউ জারি হয়। নিরুপায় খোকা দুদিন বন্দি থেকে যখন ধানম–র বাসায় ফিরে যায়, ততক্ষণে ত্রাসে-আতঙ্কে বাকরুদ্ধ রঞ্জু। বস্ত্তত খোকার অসতর্কতা ও খামখেয়ালিপনাই রঞ্জুকে মহাবিপত্তির দিকে নিয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও রঞ্জুকে কুমিলস্না বা বাঞ্ছারামপুর পাঠায়নি সে। যুদ্ধের মুখে বোনকে বাড়িতে একা রেখে বেরিয়েছিল আড্ডা দিতে। বাড়ি ফিরে জনস্রোতের সঙ্গে শামিল হয়ে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে রঞ্জুকে নিয়ে গাছের তলায় আশ্রয় নেয় খোকা। জ্বরে আক্রান্ত বাকশক্তিহীন রঞ্জু যখন গাছের নিচে শায়িত, তখন তুমুল ঝড় ও শিলাবৃষ্টি নামে। রঞ্জুর পরিণতি সম্পর্কে খোকার ভাষ্য :

অচৈতন্যপ্রায় রঞ্জুকে গাছতলায় শতরঞ্চির উপর ফেলে প্রাণঘাতী গুলিবৃষ্টির ভিতর হাজার হাজার নরনারীর মতো আমিও কি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়েছিলাম, ভেবে পায় না খোকা; যেন একটা দুঃস্বপ্ন। মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলতে চায় খোকা। এক লক্ষ চলিস্নশ হাজার পায়ের তলায় পড়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিল কি নিরঞ্জন রঞ্জু? [পৃ ১৫৮]

এ-উপন্যাসে খোকাকে আচ্ছন্ন করেছিল এক নারী, সে হলো নীলাভাবি। নীলাভাবি রাজীব ভাইয়ের দ্বিতীয় স্ত্রী। অসম বয়সের হলেও রাজীবের সঙ্গে নীলার বিয়ে হয়েছিল প্রেম করে। খোকা একটু ফুরসত পেলেই ছুটে যায় এই নারীর আকর্ষণে। তার দৃষ্টিতে, ‘পৃথিবীর সকল নীলাভাবীরাই এক একটি জ্বলন্ত কামকু-, ফুটন্ত টগবগে আগ্নেয়গিরি, যার নিদারুণ লাভাস্রোত পীত ধবল কালো বাদামি রাশি রাশি খোকার দগ্ধাবশেষ গড়ান খেয়ে চলে।’ [পৃ ২১] নীলাভাবির কাছে খোকা যায় এক দুর্নিবার তাড়না নিয়ে। সেখানে গিয়ে তার যেন তর সয় না। নীলাভাবি স্নান করছে জেনে বিরক্ত হয়। নীলাভাবি বেরিয়ে এসে তার জন্য শরবত দিতে চাইলে খোকার মধ্যে অস্থিরতা ও উন্নাসিকতা ফুটে ওঠে :

খোকা খচে উঠলো। বললে, ‘নিকুচি করি তোমার শরবতের, দিনটাই আজ মাঠে মারা গেল। এই এক জঞ্জালে জীব মেয়েলোক। আজ বরং চলি …

কোথায় একটু ফ্রি থাকবে, আড্ডা মেরে ঘচাং করে কেটে পড়বো, তা নয়, যত্তোসব উড়ো ঝক্কি। চুড়ি বাজিয়ে গোসল করা, শুকনো কাপড় ভাঁজ করা, চুলঝাড়া, রাবিশ রাবিশ!’ [২৪]

খোকা শরীরসর্বস্ব বলে ভালোবাসাকে মিথ্যে বলে মনে করে। নীলাভাবি যখন জানিয়েছে, সত্যিই সে খোকাকে ভালোবাসে, তখন খোকার অভিব্যক্তি :

এ কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালো খোকা; তার ধারণা ছিলো একমাত্র বইপত্রেই এইসব কথা স্থান পায়, কিংবা যখন মুদ্রণপ্রমাদ ঘটে তখন ‘বস্নাউসের বোতাম খুলতে ভালোবাসির’ স্থলে ওই কথা ছাপা হয়। [পৃ ২৯]

নীলাভাবির দ্বারা খোকার প্রথম নারীসঙ্গমের অভিজ্ঞতা হয়। এই ঘটনা সংগত কারণেই তার ভেতরটাকে অস্থির-উদ্বেল করে তুলেছিল। সেগুনবাগিচার ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোকা খুঁজছিল নিজেকে লুকানোর ও পরিত্রাণের পথ। রিকশায় একা ঘুরতে ঘুরতে আত্মগস্নানিতে ভুগেছে সে :

আমি একটা লোচ্চা, তার এইসব মনে হয়েছে, – আমার কোনো বাছবিচার নেই, আমি একটা লম্পট, কামুক, আজ আমি নীলাভাবীকে বিছানায় কাত করেছি, সবে শুরু আমার, হয়তো কালই আবার হন্যে হয়ে উঠবো, কাউকে চিত করবো। [পৃ ৮২]

‘নীলাভাবীর শরীরই পৃথিবীতে খোকার কাছে সবচেয়ে লোভনীয় বস্ত্ত।’ [১৩৬] দেশে যুদ্ধ শুরু হলে রাজীব ভাই নিরাপত্তার স্বার্থে সেই নীলাকে খোকার হাতে তুলে দিতে চেয়েছে। কিন্তু খোকা তখন ভয় পেয়েছে। তার আশঙ্কা নীলা তাকে গ্রাস করতে পারে। বস্ত্তত এই নারী তার কাছে দেহ, যোনি, সত্মনসর্বস্ব এক কামের বস্ত্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সে-কারণেই নীলা তার ভয়ের উৎস। এখানে খোকাকে মনে হয় যেন এ-কালের কৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে আমরা দেখেছিলাম রাধার শরীর জয় করার পর কৃষ্ণ তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নানা উছিলায় তার থেকে দূরে সরে যায়। আর এখানে আমরা দেখি :

‘খোকা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নারীদেহ সম্পর্কে যতো বিশেষণই প্রয়োগ করা হয়ে থাক না কেন, আসলে তা নিছক তাল তাল গোবরের মতো মাংস ছাড়া আহামরি এমন কিছু নয়।’ [পৃ ১৩৭]

এ-কথা কেন মনে হলো খোকার? এই সঙ্গম যদি তার বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে হতো তাহলে কি নারীদেহ সম্পর্কে তার এমন প্রতিক্রিয়া হতো? খোকা কি এখানে নীতিবাদী? তার সামগ্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই উক্তি বেমানান, ন্যাকামির চূড়ান্ত। নারীশরীর সম্পর্কে খোকার দৃষ্টিতে আরো কিছু উপমা : ‘ভাতের মাড় গালা মালসা, ঘরমোছা ন্যাতাকানির তাল, কিংবা জঞ্জাল ফেলার আঁস্তাকুড়, শরীর কি এর অতিরিক্ত কিছু;’ [পৃ ১৩৭]

অনিবার্যভাবে দেশে যখন যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে নীলা আবারো আকুলচিত্তে আবেদন জানায় তাকে নিয়ে যেতে। সেই আবেদনে অন্য কোনো হীন-উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। তবু খোকা ভীষণভাবে স্পষ্টভাষায় তাকে প্রত্যাখ্যান করে বলে, ‘আমি তোমার কে? আমার উপর এতো অধিকার খাটাতে চাও কেন? আমি তোমার মুটে-মজুর নই, বোঝা নিতে পারবো না।’ [পৃ ১৪৮] শঠতা, স্ববিরোধিতা আর কাপুরুষতার কারণে শেষ পর্যন্ত নীলাভাবির হাতে চড় খেতে হয়েছে খোকাকে :

‘খোকার কথা শেষ না হতেই প্রচ- একটা থাপ্পড় পড়লো তার গালে। বিছানার উপর টলে পড়লো খোকা। চোখে আঁচল চেপে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখলো নীলাভাবীকে!

এই ভালো, – গালে হাত বুলিয়ে আরাম পেল খোকা!

খুব ভালো হলো, চড়ের কথা জীবনভর যেন মনে থাকে, মনে রাখবে তো খোকা? ভাই আমার মনে রেখো।’ [পৃ ১৫০]

নীলা কি তার প্রেমিকা? তা যদি হয়ে থাকে, তাকে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করার সৎসাহস তার কাছে প্রত্যাশিত। তা যদি না হয়ে থাকে তা হলে নীলাভাবির সঙ্গে তার সম্পর্কটা আসলে কী? আমরা দেখি এই উপন্যাস নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে সমালোচকরা নানাভাবে খোকার পক্ষাবলম্বন করতে চেয়েছেন, কারণ সে তো এই উপন্যাসের নায়ক – তাকে মহৎ করে তোলাই সমালোচকের কর্তব্য। কারো মতে খোকার চরিত্রে অসিত্মত্ববাদী দর্শনের প্রভাব পড়েছে, তাই সে একটু অন্যরকম। আবার কেউ নারী সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘শুচিস্নিগ্ধ’ মনোভঙ্গি প্রত্যক্ষ করেছেন।

খোকার খালাত বোন বেলী পনেরো-ষোলো বছর বয়সী।  খোকা দেখেছে এই বয়সেই লিপস্টিকের তুখোড় সমঝদার বনে গেছে বেলী। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটা তার গুদামঘর। গুদামবোঝাই হানি-ইন-গোল্ড, টিজিং পিঙ্ক, কফি কারামেল – গুচ্ছের শেডের লিপস্টিক। ফরাসি সেন্ট আর মেকআপের সামগ্রীও তার সংগ্রহে কম নেই। তলে তলে একাধিক ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেমও করে, অর্থাৎ ইচ্ছেমতো বাঁদরনাচ নাচায়। [পৃ ৬৯] বেলী খোকাকেও উগ্রভাবে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু খোকা তাতে সাড়া না দিয়ে দূরে সরে আসে। এতে বেলী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। তাই সে খোকার অনুপস্থিতিতে তার ঘরে ঢুকে বিছানা, বই-খাতা সবকিছু এলোমেলো, ল-ভ- করে রেখে যায়। আর সে একটা কাগজে চিঠিও লিখে রেখে যায়। তাতে বলা হয় তারা বাঞ্ছারামপুর চলে যাচ্ছে। খোকা যদি না যায় তবে তার সঙ্গে বেলীর হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। বেলী তাকে অনুনয় করে যায়, সে যেন দেখা করে। আরো বলে, খোকাকে সে কিছু করতে পারেনি তাই তার বিছানাটাই এলোমেলো তছনছ করে রেখে গেল । [পৃ ১০৮]

খোকা নিজে অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করে, তার শরীরের স্বাদ নেয় অথচ বালিকা বেলী ছেলেদের সঙ্গে প্রেম করলে তাতে তার আপত্তি। বেলীর প্রতি খোকার যে আকর্ষণ নেই তা নয়। বস্ত্তত খোকার কাছে নারীর শরীর এক অগ্রগণ্য বিষয়। বেলী খোকাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে নানাভাবে কিন্তু খোকা তাতে সাড়া দেয়নি কারণ সে জানত বেলীর আরো একাধিক প্রেমিক রয়েছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় বেলীর প্রেমিকদের প্রতি সে রীতিমতো বিদ্বেষপরায়ণ। বেলীর আহবানে সাড়া না দেওয়ায় তার কোনো মহত্ত্ব ফুটে ওঠেনি। সে বেলীকে অত্যন্ত হীনদৃষ্টিতে দেখেছে। তাকে বলেছে ভ্যাম্পায়ার, বানানো হয়েছে নির্লজ্জ কামপরায়ণা। তার বিদ্বেষ চরিতার্থ করতে বন্ধুর কথার সূত্র ধরে সে মনে করেছে বেলী বেশ্যাদের নাম হয়ে থাকে। যেমন : কালা বেলী, ধওলা বেলী, শুঁটকি বেলী, ধুমসি বেলী, রাক্ষসী বেলী, খাঁদা বেলী ইত্যাদি। এক অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীর এই আচরণ অবিশ্বাস্য আরোপিত ও নির্মম। নারীদের বিষয়ে খোকা মোটেই সংযমী রুচিশীল মনোভাব দেখায়নি বা প্রকাশ করেনি। তাই মাত্র পনেরো-ষোলো বছরের এই বালিকা সম্পর্কে তার মন্তব্য :

বেড়ে লিখেছ ছুঁড়ি, বিড়বিড় করতে থাকে খোকা। একলা বিছানা, খাসা খাসা। ভিতরে একেবারে ঝুনো হয়ে গিয়েছে, শাঁস বলতে কিছু নেই, সব ফোঁপল হয়ে গিয়েছে, ফোঁপল ফোঁপল। [পৃ ১০৮-১০৯]

এই উপন্যাসে অন্য এক নারী চরিত্র লুলু চৌধুরী। রেক্সে আড্ডা মারার সময় খোকা তার বন্ধু মুরাদের বড়বোন লুলু চৌধুরীর শরীর নিয়ে কদর্য সব মন্তব্য করে। যেমন : ‘লুলু চৌধুরীর পাছাটা ঠিক যেন আধমুনে ধামা’, ‘লুলু চৌধুরীর চাহনি আর ফিক করে হাসা দিয়ে গোটা আদমজি জুট মিলটাই কেনা যায়’, ‘সেদিন স্বপ্ন দেখলাম ন্যাংটো হয়ে ঘোড়ায় চেপে সারা ঢাকা শহর টহল দিচ্ছে লুলু চৌধুরী’, ‘লুলু চৌধুরীর শাড়ি পরার স্টাইলটা মারাত্মক, মনে হয় আর দেড় সেকেন্ডের ভিতর গা থেকে সব আবরণ ঝরঝর করে খুলে পড়ে যাবে।’ যদিও প্রথমে বলা হয়েছে এই কদর্য ইয়ার্কি-ঠাট্টার বাইরে কেবল খোকা। কিন্তু খানিকবাদে খোকা নিজেই স্বীকার করেছে ‘দিন দিন আমি একটা চাঁড়াল হয়ে যাচ্ছি, চাষাভুষোর মতো যখন মুখে যা আসে তাই বলি, ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি না কোনোকিছুর; লুলু চৌধুরী যে পাড়ার খাতায় নাম লেখানো বেশ্যা নয়, তার বন্ধুর বড় বোন, এ-কথা ভালো করে ভাবা উচিৎ ছিলো।’ [পৃ ৭৫] যতই সময় গড়িয়েছে, লুলু চৌধুরীর প্রতি খোকার মনোভাবের প্রকৃত রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। মুরাদ যখন বলেছে তার বড়বোন খোকার সঙ্গে কথা বলবে তা জেনে ‘খোকার ভিতরে একটা হাইপোস্টাইল হল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।’ তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে খোকার মনে হয় নীলাভাবির সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল আছে লুলু চৌধুরীর – যে-নীলাভাবির শরীর মন্থনের সুযোগ সম্প্রতিই হয়েছিল খোকার। লুলু চৌধুরীর শরীরের প্রতি খোকার কাতরতা স্পষ্ট হয় এই বর্ণনায় :

এ্যাশট্রের উপর ঝুঁকে আধপোড়া সিগ্রেট গুঁজে দেয়ার সময় লুলু চৌধুরীর স্খলিত আঁচল মেঝের কার্পেটে ঝরে পড়ল।

একফালি আঁটো চোলির কারা যন্ত্রণায় গুমরানো সত্মনদ্বয়কে ভীষণ দুঃখিত মনে হয় খোকার। অসাধারণ লজ্জায় নিদারুণ বিস্মৃতির ভিতর জগতের এই একমাত্র উজ্জ্বল দুঃখে অঞ্জলি পূর্ণ করে চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। [ পৃ ১২৩]

অর্থাৎ যারা লুলু চৌধুরীকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করে কিংবা কামের দৃষ্টিতে দেখে খোকা সে-দলের বাইরে, এ-বক্তব্য কথার কথা মাত্র – এতে তার চরিত্রের স্ববিরোধিতাই ফুটে ওঠে। আর এমন স্ববিরোধ সৃষ্টির দায় শেষ পর্যন্ত লেখকের ওপর গিয়েই বর্তায়, হয়তো সচেতনভাবেই তিনি খোকাকে এমন বৈশিষ্ট্যে রূপদান করেছেন। অবশ্য শিল্পসাহিত্যে সাধু চরিত্র মানেই শিল্পসফল চরিত্র নয়, একইভাবে বিভ্রান্ত-স্ববিরোধী চরিত্রও আর্ট-বিচারে সার্থক বলে পরিগণিত হতে পারে।

জীবন আমার বোনে মাতা-ভগ্নির বাইরে যে তিনজন নারীকে পাই তারা দুশ্চরিত্রা শ্রেণির, অসংযমী, পুরুষকে নাচাতে পছন্দ করে। এদের সবারই শরীর ও ছলাকলা খোকাকে ভীষণভাবে তাড়িত-আপস্নুত করে। প্রশ্ন হতে পারে, এ-উপন্যাসে এই শ্রেণির তিনটি চরিত্রের এরূপ বৈশিষ্ট্য আবশ্যক ছিল কি না। তাদের উগ্র স্বভাবের বিপরীতে খোকাকে মহৎ রূপে গড়ার চেষ্টা ছিল কি লেখকের? তা যদি হয়ে থাকে তাহলে বলা যায়, সূক্ষ্ম বিচারে এই তিন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়ায় খোকার যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে কোনোভাবেই তার মহত্ত্ব ফুটে ওঠেনি। আর লেখক যদি তাকে পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্ত, স্ববিরোধী, দূরদৃষ্টিহীন চরিত্ররূপে গড়ে তুলতে চেয়ে থাকেন তবে তিনি সফল। খোকা পরিণামে বুঝতে পেরেছে তার ভুল। যুদ্ধে বোন নিহত হওয়ার পরও এক ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন হেঁয়ালিপনা স্পষ্ট খোকার মধ্যে – ‘তারপর কি কোথায় সব ঘটেছিল এখন আর মনে নেই খোকার। … কিছুই জানে না খোকা। সে শুধু চেয়েছিল রঞ্জু বেঁচে থাকুক।’ কিন্তু তাকে বাঁচানোর জন্য সঠিক সময়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সে। শেষ পর্যন্ত তার মনে হয়েছে ‘একা বেঁচে থাকার অধিকার তার বিষণ্ণ দেশ কিছুতেই দিতে পারে না রঞ্জুকে, খোকা পরে বুঝেছিলো।’

সন্দেহ নেই খোকা কেবল মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোতে নয়, আমাদের সাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী পুরুষ চরিত্র। তাকে বিশেস্নষণের ক্ষেত্রেও ভিন্নমত ও বিতর্ক পরিলক্ষেত হয়। নারী বিষয়ে তার যে-দৃষ্টিভঙ্গি তা-ও একেকজনের কলমে একেকভাবে উদ্ঘাটিত হতে পারে। কারণ খোকার অনেক ভাবনার সঙ্গেই তার কাজের সামঞ্জস্য নেই। ঔপন্যাসিক এই চরিত্রটিকে প্রকৃতপক্ষে যেভাবে নির্মাণ করেছেন, সেখান থেকে তাকে সরিয়ে এনে সমালোচকের বিচিত্র রঙে রঞ্জিত ভাষায়, প্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যে রূপদানের কোনো অর্থ হতে পারে না।