মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : নতুন অন্বেষা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা অতিক্রম করে এসেছি। বাঙালি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বে সদা সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনা আমাদের হৃদয়ে এক অবিনাশী অনুভব। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের শক্তিসঞ্চয় ও প্রেরণালাভের বিশুদ্ধ আধার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আনন্দময় লগ্নকে অধিকতর তাৎপর্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য মুক্তিযুদ্ধ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিরোনামে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া ভূইয়ার বইটি প্রকাশ করে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির আকৃতি নাতিদীর্ঘ হলেও এর প্রতিপাদ্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যগ্রন্থের তালিকায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্টতা এবং বীরত্বপূর্ণ অবদান উন্মোচিত হয়েছে এ-গ্রন্থে। পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে অনেক অজানা তথ্য ও ইতিহাস ড. কিবরিয়া তুলে ধরেছেন সাবলীল বর্ণনায়। ফলে পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।

প্রথম অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি কেমন করে রচিত হয় এর একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ই এবং ১৫ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ভারত রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশ ঔপনিবেশিক শাসন ও পরাধীনতা থেকে মুক্ত হলেও কেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষ পুনর্বার স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়, তা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ৫৪ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বললেও মাত্র ছয় শতাংশ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে চলেছে – সে-আভাস আমরা পেয়েছি। সময়টা ১৯৪৮ সাল। মাত্র কদিন আগেই জন্ম হলো পাকিস্তানের। শুরুতেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এই অন্যায্য অধিকার চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা আমাদের অধিকার রক্ষার দাবি দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লড়াই জোরদার হতে থাকে। এরই পরিণতি বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন, ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া, ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধান রচনা এবং ১৯৫৮ সালে সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করা, ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের শিক্ষানীতি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ছাত্র-আন্দোলন, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত থাকা, ১৯৬৬ সালে লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা উত্থাপন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, ১৯৭১ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া, ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা অভিযান এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার, ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালির পরিকল্পিত মুক্তিযুদ্ধের শুরু – ইতিহাসের এই ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে দিতে লেখক ঠিক এখানে এসে প্রথম অধ্যায় শেষ করেছেন। সামান্য অভিনিবেশেই ধরা পড়ে লেখক দিন-তারিখ ও সময়ের পরম্পরা সাজিয়েছেন ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ধারাবাহিকতায়। ফলে পাঠকমাত্রই বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের অনিবার্য পটভূমিকে এখানে সংক্ষিপ্তরূপে অবলোকনের সুযোগ পাবেন।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক বর্ণনা করেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। এ-অধ্যায়ে জানা যায়, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই বিশ^বিদ্যালয় গড়ে ওঠার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের ভূমিকা। বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেছিলেন – এই চমকপ্রদ তথ্য এই গ্রন্থপাঠের আগে অন্তত আমার জানা ছিল না। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রচেষ্টায় কীভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল তার এক অনুপুঙ্খ বর্ণনা এই অধ্যায়ে রয়েছে। ১৯৬৫ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি হলে একই দিনে অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র-কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁদের বীরত্বপূর্ণ অবদান ও দেশপ্রেমের বর্ণনা আছে তৃতীয় অধ্যায়ে। এই অধ্যায়ে জানা যায়, উপাচার্য ড. এ. আর. মল্লিক, আনিসুজ্জামান, আবুল ফজল, মাহমুদ শাহ কোরেশী, মোহাম্মদ আবু জাফর ও মাহবুব তালুকদারসহ অনেকেই কীভাবে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসুর প্রথম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রবের শহিদ হওয়ার বর্ণনাও এই অধ্যায়ে পাওয়া যায়।

চতুর্থ অধ্যায়ে এসে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শরণার্থী হিসেবে প্রবাসী হলে সেখানে থেকেই কীভাবে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি করেন। ড. এ. আর. মল্লিক, আনিসুজ্জামানসহ আরো অনেকেই রামগড় সীমান্ত দিয়ে আগরতলায় যান। পরবর্তী সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে তাঁরা কলকাতা পৌঁছান। সঙ্গে যান বেশ কজন শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় সেখানে তাঁরা গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’। কলকাতার বহু ব্যক্তি ও সংস্থা এগিয়ে আসে অর্থসহায়তা নিয়ে। ড. এ. আর. মল্লিকের  বর্ণনায় জানা যায়, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রাপ্ত ৬০ লাখ টাকা আনিসুজ্জামান কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’র কাছে হস্তান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধের মতো দুঃসময়ে এই অর্থসংগ্রহ ছিল অত্যন্ত এক উজ্জ্বল ঘটনা।

পঞ্চম অধ্যায়ে বিশ্লেষিত হয়েছে  মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও শরণার্থী জীবনের বর্ণনা। শরণার্থী জীবনে প্রবাসে অজানা আশঙ্কার দিনগুলিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে ভূমিকা পালন করেন, তা ছিল দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই অধ্যায়েই জানা যায়, বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে কীভাবে ৮ থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতর। থিয়েটার রোডের এই সদর দফতরে আনিসুজ্জামানকে অনেক কাজে যুক্ত হতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি তৈরি করা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কথিকা ও বুলেটিন তৈরি ছিল আনিসুজ্জামানের অন্যতম কাজ। এই কাজে পরামর্শ, সহযোগিতা এবং ইংরেজি ভাষ্য তৈরিতে সহায়তা করতেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। এই অধ্যায়ের শেষাংশে এসে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষার্থী শহিদ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।

গ্রন্থটির পরিশিষ্ট অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে দুজন শরণার্থীর চিঠি। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন এমএ শ্রেণির ছাত্র মাহবুবুল হক (পরবর্তী সময়ে বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন) আগরতলায় শরণার্থী হিসেবে অবস্থানকালে এবং ম. আ. আওয়াল শরণার্থী হিসেবে বার্মায় (মিয়ানমারে) অবস্থানকালে বিভাগের শিক্ষক শিপ্রা রক্ষিত দস্তিদারকে চিঠি লেখেন। এই চিঠি দুটিতে শরণার্থীজীবন যেমন উঠে এসেছে, তেমনি এগুলিকে ইতিহাসের দলিল হিসেবেও গ্রহণ করা যায়।

গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া পরিশ্রমী লেখক। শ্রম-স্বীকার করে যা তিনি উপস্থাপন করলেন তা পাঠককে কতটা মোহাবিষ্ট করছে এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সত্য প্রকাশে তাঁর মনোযোগ। সত্যই লেখকের অন্বিষ্ট। এই গ্রন্থে তাঁর অন্বেষণ যথার্থ হয়েছে বলেই মনে হয়।