জাদুবাস্তবতা-চিহ্নিত উপন্যাস

২০২০ সালে করোনা অতিমারি সারা পৃথিবীর মানুষকে মুখোমুখি করেছিল প্রচণ্ড মৃত্যু-আতঙ্ক, বহুমুখী সংকট ও ব্যাপক অনিশ্চয়তার। সেই পরিস্থিতিকে কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল শৈল্পিক সৃজনশীলতায় তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মার বিলাপ নামের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসে।

এই উপন্যাসের আখ্যান কেবল মনস্তাত্ত্বিক নয়, তাতে রয়েছে বাস্তবতা ও অবাস্তবতার জটিল চক্র। ১৯২০ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর – এই আট মাসের কালিক বাস্তবতার পটভূমিতে বাস্তব জীবনের সঙ্গে কল্পিত অলৌকিক জীবনের মিথস্ক্রিয়া ঘটেছে এ-উপন্যাসে।

উপন্যাসটিতে রয়েছে বেশ কিছু বাস্তব তথ্য। এসব বাস্তব তথ্যের মধ্যে রয়েছে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের হিসাব (পৃ ১৩, ২১, ২৭), চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য (পৃ ৫৬), ড. আনিসুজ্জামানের মৃত্যু (পৃ ২৩), বাতিঘর থেকে বইয়ের পার্সেল আসা (পৃ ৪৪), ডাক্তারদের জন্য আইসোলেশনে থাকার হোটেল-ব্যবস্থা প্রত্যাহার (পৃ ৫৭), ভুল খবর প্রচার করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ফেঁসে যাওয়া (পৃ ৬৫), আমেরিকা কর্তৃক অক্সফোর্ডে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি প্রদান (পৃ ৯৫), মোবাইলে কোভিড টেস্টের রিপোর্ট প্রদানের ব্যবস্থা (পৃ ১০১), ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে করোনার ভ্যাকসিন সরবরাহের সংবাদ (পৃ ১০৫), জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্য (পৃ ১৩২), শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি (১৩২), মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির করোনা আক্রান্তের সংবাদ (পৃ ১৩৭), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিনের তালিকায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিনের স্থান লাভ (পৃ ১৬০) ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প, পুতিন, কিমের মতো রাষ্ট্রনেতাদের প্রসঙ্গও এসেছে, এসব তথ্যের মাধ্যমে করোনার পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন লেখক। তবে, তথ্যবহুলতায় উপন্যাসটি কিছুটা তথ্য-ভারাক্রান্ত হয়েছে বলে মনে হয়।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির। ২০১৮ সালে তিনি প্রয়াত হন। জীবিত সামাজিক মানুষ এবং করোনা-আক্রান্ত মানুষ হিসেবে এ-উপন্যাসে করোনার বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে তাঁর মাধ্যমে। তাঁর বয়ানেই তৈরি হয়েছে কাহিনি। তাঁর মনোচোখেই পাঠক দেখতে পান করোনাকালে সর্বগ্রাসী ভাইরাসের থাবা বিস্তার এবং মারণযজ্ঞকে। সেই সঙ্গে করোনার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের দৃঢ়চিত্ত প্রয়াসকে।

উপন্যাসে শহীদুল জহিরের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে সরল, নিরীহ, পরোপকারী, দৃঢ়চেতা মানুষ হিসেবে। তাঁর জীবনবোধের ভিত্তি চীনা সহজিয়া জীবনদর্শন। এই জীবনদর্শনকে ফুটিয়ে তুলতে লেখক কাজে লাগিয়েছেন সরকার আমিন-অনূদিত চীনা দর্শন কাব্য সহজিয়া পথ গ্রন্থকে।

উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য চরিত্র করোনা ভাইরাস প্রতিনিধি করোনা সম্রাট। কাহিনির বিভিন্ন অংশে শহীদুল জহিরের সঙ্গে সে সংলাপে লিপ্ত হয়। তাদের দুজনের কথোপকথনের ভেতর দিয়ে করোনার বিস্তারের ভয়াবহতা, অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলি এবং করোনা মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের অবহেলা, উদ্বেগহীনতা, নির্লিপ্ততা ইত্যাদি উঠে আসে।

শহীদুল জহির নিজের শরীরে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ-লীলা টের পান এবং তার মোকাবিলায় করোনা সম্রাটের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে স্ত্রী-সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী থাকেন। তাঁর পরিচর্যায় থাকে দীর্ঘকালের গৃহকর্মী নাজমা। স্বল্পরেখায় লেখক নাজমা চরিত্রের আচরণগত ও বাচিক স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরেছেন।

কাহিনির সূচনায় যে শহীদুল জহিরকে আমরা পাই তা আপাতচোখে বাস্তব মনে হলেও আসলে তিনি বাস্তব নন। কারণ তিনি মৃত। অথচ তাঁর চিন্তা ও কর্মে এক ধরনের বাস্তবতার ছাপ রয়েছে। একে আমরা বলতে পারি পরাবাস্তবতা। এই পরাবাস্তব জগতের মিথস্ত্রিয়া পাওয়া যায় উপন্যাসে পরিবেশিত বাস্তব চরিত্র ও তথ্যে। বাস্তব চরিত্রের আভাস রয়েছে শহীদুল জহিরের গৃহপরিচারিকা ও আধিপত্য-পরায়ণা স্ত্রীর চরিত্রে।

এই উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র পাশের ফ্ল্যাটের কন্যাবয়সী তরুণী শারমিন। উপন্যাসে বিভ্রম ও ভ্রান্তিজালের বিস্তার ঘটেছে এই তরুণীকে নিয়ে। আত্মার বিলাপ উপন্যাসের মনোবিকলন তত্ত্বের সৃষ্টিশীল চিত্রণ পাঠক লক্ষ করেন শহীদুল জহিরের সঙ্গে শারমিনের রহস্যময় ও বিভ্রান্তিকর সম্পর্কের মধ্যে।

শারমিন এ-উপন্যাসের রহস্যে-মোড়া বিস্ময়কর চরিত্র। এই চরিত্রকে ভিত্তি করেই লেখক উপন্যাসের   আখ্যানে জাদুবাস্তবতার কুহক তৈরি করেন। বাড়ির ছাদে করোনা-আক্রান্ত শহীদুল জহিরের সঙ্গে তার দেখা হয়। জহির করোনা থেকে তাকে সাবধান হতে বলেন। পরে তিনি শারমিনের টেলিফোন পান। শারমিন তাঁকে জানায় যে, সে করোনা-আক্রান্ত। বাড়ির সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে এবং নিজের ছোঁয়া থেকে তাঁদের বাঁচাতে সে বাসা ছেড়ে এসে আংকেলের সঙ্গে থাকতে চায়। এই প্রস্তাব চরম বিব্রতকর হলেও শারমিনের পীড়াপীড়িতে তিনি তাতে সম্মত হন। এর পর থেকেই শারমিনের প্রতি তাঁর অবচেতন আকর্ষণ শুরু হয়। তিনি প্রতিমুহূর্তে প্রতীক্ষা করেন এই বুঝি শারমিন এলো। এরপর ডোরবেল বাজলেই তাঁর ভাবতে ইচ্ছে করে, শারমিন এসেছে। কিন্তু আসে পার্সেলওয়ালা, মাছওয়ালা, মুরগিওয়ালা। অবচেতন প্রতীক্ষা বাস্তবতার সামনে বিস্রস্ত হয়ে যায়।

শারমিনের সঙ্গে আপাত বাস্তব সংলাপের সূত্রে এবং দোলাচলবৃত্তির মধ্য দিয়ে শহীদুল জহিরের অবচেতন মনে সুপ্ত বাসনার বীজ থেকে চারা গজাতে শুরু করে। মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় একে বলা যায় লিবিডো। শহীদুল জহির মনোদৈহিক-চাপের শিকার হন এবং বয়স, সম্পর্কের ধরন, নৈতিকতা ইত্যাদির কারণে সুপ্ত বাসনাকে অবদমন করেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদে দেখা যায়, মনের অবচেতনে শহীদুল কথা বলেন অজানা লোকের সঙ্গে। করোনায় বাংলা একাডেমির সভাপতির মৃত্যুজনিত শূন্যপদে কাকে আনা হবে – এ নিয়ে ফোনকারীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়। পরে বোঝা যায়, টেলিফোনের ওই কথোপকথন পুরোটাই অবচেতন মানসক্রিয়া। কারণ তিনি দেখেন, তাঁর হাতে কোনো টেলিফোন সেট নেই। এভাবে অবাস্তবতার গভীরে সক্রিয় হয়ে চেতন-অবচেতন মন একাকার হয়ে যায়।

করোনাকে কেন্দ্র করে শহীদুলের চেতন-অবচেতন মনে মৃত্যুভাবনা বাস্তবতাকে আভাসিত করে। প্রসঙ্গক্রমে শহীদুল আলবেয়ার কামুর দ্য প্লেগ থেকে মৃত্যুবৎ পরিবেশ তৈরি করেন। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরার মৃত্যুরহস্য ও মৃত্যুবৎ আচ্ছন্নতার মধ্যে লিবিডো তাড়নায় মনে মনে শারমিনকে আহ্বান করেন, এসো, আমার ঘরে এসে থাকো। হোসে সারামাগোর বিখ্যাত উপন্যাস ব্লাইন্ডনেসের কথা তাঁর মনে পড়ে যায়। মনে হয়, করোনা কেবল শরীরকে ধ্বংস করায় আগ্রহী নয়, চোখের জ্যোতি ও জ্ঞানের আলোকে কেড়ে নেওয়ায়ও এই অণুজীব তৎপর।

একসময় শহীদুল জহির ঘর থেকে বের হন কোরবানির গরু কিনতে। তিনি ছিন্নমূল এক মাকে দেখেন। এক পর্যায়ে বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, কলসেন্টারের অপারেটর পদপ্রার্থী মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরা প্রত্যেকেই শারমিন নাম নিয়ে তাঁর সামনে আসে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আপাত-চেতন মনের মধ্যে অবচেতন মন ক্রিয়া করে। শহীদুল জহিরের অবচেতন মনের শারমিন আশেপাশে দেখা সব নারীর মধ্যে ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। এভাবে আত্মার বিলাপ উপন্যাস সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের পরিধি ছাপিয়ে জাদুবাস্তবতার উপন্যাস হয়ে ওঠে। এ-উপন্যাসে আপাত বাস্তবতার বিভ্রমকে ছাপিয়ে ওঠে অলৌকিকতার উপাদান। তিনি যে ঢাকা শহরে ঘোরেন তা যেন মৃত্যুর শহর। সেখানে একজন মৃত সাহিত্যামোদী মৃত শহীদুল জহিরকে চিনতে পারে।

শহীদুল জহিরকে গরুর বাজারের গো-খাদ্যের স্তূপ থেকে উদ্ধার করে তাঁর ফ্ল্যাটের ম্যানেজার মোবারক। শহীদুল অট্টহাসি দেন। মোবারক তা শুনতে পায়নি শুনে শহীদুল চমকে ওঠেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে যাওয়ার সময় শহীদুল দেখতে পান আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশবাহী গাড়ির পেছনের দরজা খুলে গেছে। কিন্তু সিএনজিচালক দেখে দরজা বন্ধই রয়েছে। এভাবে শহীদুলের মানস পরিক্রমার চেতন-অবচেতন স্তরের ভেতর দিয়ে বাস্তব-অবাস্তবের প্রহেলিকা তৈরি করেন লেখক। কবরস্থানে তাই শহীদুল লাশের ওপর লাশের স্তূপ দেখতে পান। মনের গহিনে অনেকটা স্বপ্নের মতো তিনি দুটি লাশকে পাশাপাশি দেখেন। তাঁর মনে হয়, মৃত দুজনের একজন হচ্ছেন তিনি নিজে এবং অন্যজন পাশের বাসার শারমিন। এই পর্যায়ে তাঁর আত্মা কবরে শায়িত থাকে। আর দেহ শহরে বিচরণ করে। এভাবেই আত্মার বিলাপ উপন্যাসটি হয়ে ওঠে জাদুবাস্তবতার উপন্যাস যা বিভ্রম, বিস্ময়, কুহক, অলৌকিকতার মধ্যেও এক ধরনের বাস্তবতাকে আভাসিত করে তোলে।

আত্মার বিলাপ মোট ত্রিশটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। শহীদুল জহির চরিত্রের একাকিত্ব ও তাঁর মানস পরিক্রমার ভেতর দিয়ে জাদুবাস্তবতার শৈল্পিক বুননে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।

মোহিত কামাল এ-উপন্যাসের পরতে পরতে বাস্তবতার সঙ্গে অবাস্তবতার, চেতনের সঙ্গে অবচেতনের মিথস্ক্রিয়াকে চিহ্নিত করেছেন এবং এর মাধ্যমে কাহিনিতে বিচিত্র বিস্ময়বোধের সৃষ্টি করেছেন।

সব মিলিয়ে আত্মার বিলাপ হয়ে উঠেছে করোনাকালীন জীবনবাস্তবতার ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস। করোনাকালের দেশীয়-বৈশ্বিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি তাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিমানুষের সংকটময় জীবনের চালচিত্রও ফুটে উঠেছে।