জলের অক্ষরে লেখা   

পর্ব : ২১

ঢাকায় ফিরে আরিয়ানা জানালো, বাকি কয়েকদিন আর বাইরে বেরোতে চায় না সে। বাসাতেই

থাকবে। এই বাসা আর আরিয়ানার বাড়ির মধুর স্মৃতি নিয়ে সে ফিরে যেতে চায়। তাই হলো। আরিয়ানা বাসার প্রতিটি রুমে ঘুরে বেড়ালো, খুঁটিয়ে দেখলো

এটা-ওটা সবকিছু – যেন নিজের স্পর্শ রেখে যেতে চায় সর্বত্র, চাচির কাছে বসে বাংলা রান্না শিখলো, বাগানে গিয়ে প্রতিটি গাছে হাত বুলিয়ে দিলো, নীলুর সমাধির কাছে গিয়ে বসে রইলো দীর্ঘ সময়, অংশু-অপলা বেড়াতে এলে তাদের পাতে
এটা-ওটা তুলে দিয়ে বাঙালি স্টাইলে আতিথেয়তা করলো। এইসব করতে করতে তার যাওয়ার দিন এসে গেল। ঋভু সবকিছু গুছিয়ে দিয়েছিল। ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, তবু নানা সূত্রে বেশ ভালো পরিমাণেই ইউরো আর ডলার কিনে মা-মেয়ের কাছে দিয়ে দিলো। আরিয়ানা নিতে চায়নি। ঋভু তখন বুঝিয়েছে – কদিন পরই তো আমি আসছি, তখন আমার কাজে লাগবে।

আরিয়ানার প্রতিটি আচরণে বোঝা যাচ্ছিল, সে আসলে চিরদিনের জন্যই বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। এখানে যে আর কখনো আসা হবে না, সে যেন তা জেনে গেছে। কথাটা ঋভুও জানে। কীভাবে জানে, তা সে বলতে পারবে না। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, যতই চিকিৎসা হোক, ওকে বাঁচানো যাবে না। তবে কিছুদিনের মধ্যে সেও ইতালি যাচ্ছে বলে এখনই চিরবিদায় দিচ্ছে না।

যাওয়ার সময় সোফিয়া বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো – তুমি কবে আসবে বাবা?

– ভিসা হলেই চলে আসবো মামণি। একদম দেরি করবো না।

– হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি এসো। যখন তোমাকে চিনতাম না তখন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু এখন মনে হয় তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।

– আমিও পারবো না মা।

আরিয়ানা বললো, তাহলে শিগগিরই দেখা হচ্ছে।

– হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। একদম ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

এই ধরনের কথা ঋভু কখনো বলে না। কিছুই ঠিক হয় না, সে জানে; কিন্তু এখন বলতে ইচ্ছে হলো।

ওরা চলে যাওয়ার পর ঋভু কিছু জরুরি কাজ সারলো। প্রতি মাসে চাচা-চাচির বাজার-খরচ এবং হাত-খরচ, করিমের বেতন, ড্রাইভারের বেতন ইত্যাদি বাবদ অংশুর অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিলো। চাচাকে বললো, তার অনুপস্থিতির সময়টাতে যে-কোনো সমস্যা হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানায়। তাকে না পেলে যেন অংশুকে খবর দেওয়া হয়। অংশুকে বললো – তোর কাঁধে সবকিছু চাপিয়ে যাচ্ছি। দেখে রাখিস। আমি কবে ফিরবো ঠিক নেই। যোগাযোগ তো থাকবেই। কোনো সমস্যা হলে জানাস।

– এত চিন্তা করিস না। সব ঠিক থাকবে।

একদিন অংশুর সঙ্গে বসে ওর প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করলো। বললো, তোর যদি টাকা লাগে তাহলে আমার শেয়ার থেকে নিস। কোনো দ্বিধা-সংকোচ করবি না।

– তুই এমনভাবে সব বলে যাচ্ছিস যেন আর কোনোদিন ফিরবি না।

– হতেও তো পারে। মানুষের জীবনের কি কোনো

ঠিক-ঠিকানা আছে? ধর, আরিয়ানা বেঁচে গেল, আমি মরে গেলাম!

– আরে ধুর। কী যে বলিস না!

– শোন, যদি মরেটরে যাই, তাহলে আমাকে এনে নীলুর পাশে রাখিস। নীলুটা একা থাকতে পারে নারে। সবসময় আমাকে ডাকে। ওকে ছেড়ে যে কীভাবে থাকবো …

অংশু কিছু বললো না। এই একটি বিষয়ে সে কখনো কিছু বলতে পারে না।

ঋভুও কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বললো – সোফিয়া যদি এখানে ফিরে আসে, তাহলে সবকিছু ওকে বুঝিয়ে দিস। আর যদি না আসে তাহলে নীলুর নামে একটা ট্রাস্ট করে আরিয়ানার বাড়ির সঙ্গে ট্যাগ করে নিস। তবে চাচা-চাচি আর করিমকে কোথাও যেতে দিস না …

– এসব শুনতে ভালো লাগছে না ঋভু, অন্য কথা বল।

অন্য কথা বলা হয় না ঋভুর। সেদিনও না, অন্য দিনও না। অংশুর সঙ্গে আড্ডার সময়ও সে খুব বেশি কথা বলে না এখন। কেমন এক অচেনা অনুভূতি হচ্ছে ইদানীং তার।

আরিয়ানা-সোফিয়া চলে যাওয়ার পর বাসাটা কেমন যেন খালি খালি লাগে। মনে হয়, সব শূন্য হয়ে গেছে। এই বাসা যে শূন্যই ছিল সবসময়, সে-কথা যেন ভুলেই গেছে সে।

একদিন অবন্তির সঙ্গেও দীর্ঘক্ষণ গল্প করলো ঋভু। আরিয়ানা   আর সোফিয়ার গল্প করলো, যদিও বললো না যে, সোফিয়া তারই মেয়ে। অপলা আর অংশুর গল্প করলো, শুভ ভাইয়ের নতুন জীবন নিয়েও অনেকক্ষণ আলাপ হলো। অবন্তি জানালো, সে সবকিছু গোছাচ্ছে দেশে ফিরে আসবে বলে। তার একটা ছোট্ট বাড়ি আছে, সেটা বিক্রি হলেই চলে আসবে। তার আগে যদি ঋভু একবার আসতে পারে, তাহলে বেশ হয়।

ঋভু এখনো অবন্তিকে জানায়নি যে, সে ইতালি যাচ্ছে। সোফিয়া যে তারই মেয়ে, তাও জানায়নি। কীভাবে জানাবে, ভেবে পাচ্ছে না। অবন্তির জন্য এই খবরটি কি খুব বেশি দুর্বহ হয়ে যাবে? বুঝতে পারছে না সে। দু-একবার বলার জন্য চেষ্টা করেও বলতে পারেনি। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে – সরাসরি নয়, চিঠি লিখে সব জানাবে। হ্যাঁ, ই-মেইল নয়, হাতে লেখা চিঠি।

ঋভু বললো, তোমার সঙ্গে অনেক কথা জমে আছে। কবে যে বলা হবে!

– এখন বলো।

– না, ফোনে বলবো না। সামনাসামনি বলতে চাই। আচ্ছা, তোমার পোস্টাল অ্যাড্রেসটা দেবে?

– পোস্টাল অ্যাড্রেস দিয়ে কী করবে?

– একটা জিনিস পাঠাবো।

– কী জিনিস?

– তা বলবো না। দেবে?

– হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তোমাকে পাঠিয়ে দেবো।

ঋভুর বিষণ্ন আর উদাস কণ্ঠ অবন্তির কান এড়ায় না। কিন্তু জানতে চায় না, কী হয়েছে ওর। অপেক্ষা করে। দীর্ঘ, অনিশ্চিত এক অপেক্ষা। ঋভু এখনো তাকে তাদের সম্ভাব্য বিয়ে প্রসঙ্গে কিছুই বলেনি।

অবন্তির ঠিকানা পাওয়ার পর ঋভু সত্যিই চিঠি লিখতে বসলো, বহুকাল পর।

প্রিয় সুসান,

এই চিঠি যখন তোমার কাছে পৌঁছবে, তখন আমি হয়তো বাংলাদেশে থাকবো না। না, বিশ্বভ্রমণে বেরোচ্ছি না, যদিও আমার অনেক দিনের সাধ ছিল – অন্তত বছরখানেকের জন্য দেশ ছাড়বো, ঘুরে বেড়াবো পৃথিবীর চেনা-অচেনা নানা দেশে। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে আমি বেশিদিন থাকতে পারি না। সেজন্য বারবার চেষ্টা করেও, একাধিকবার দেশের বাইরে গিয়েও ফিরে এসেছি মাসখানেকের মধ্যেই। কেন এই বাড়ি ছেড়ে থাকতে পারি না, তুমি তা নিশ্চয়ই বোঝো, তাই না? ঠিকই ধরেছ। নীলুর জন্য। আমি চলে গেলে ও খুব মন খারাপ করে থাকে। একা হয়ে যায় কি না! কিন্তু এবার বোধহয় একটু বেশি সময়ের জন্যই যেতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছো, কোথায় যাচ্ছি! হ্যাঁ, ইতালিতে, আরিয়ানার কাছে। তুমি তো জানোই, আরিয়ানা এসেছিল বাংলাদেশে। একা আসেনি, এসেছিল মেয়েকে নিয়ে। কিন্তু যা তুমি জানো না, তা হলো, মেয়েটা আমারও। হ্যাঁ, সোফিয়া আমার এবং আরিয়ানার সন্তান। আমি জানতাম না, আরিয়ানা কখনোই জানায়নি, ওর সঙ্গে যোগাযোগই ছিল না। জানলে নিশ্চয়ই তোমাকে জানাতাম; কিন্তু সেজন্য যাচ্ছি না। সোফিয়া কার কাছে থাকবে, বাবার কাছে না মায়ের কাছে, সেই প্রশ্ন এখনো ওঠেইনি। যাচ্ছি আরিয়ানার জন্য। আরিয়ানা ক্যান্সারে আক্রান্ত, ফোর্থ স্টেজ ক্যান্সার। অসুখটা ধরা পড়ার পর ও আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল, এমনকি ট্রিটমেন্ট শুরু করতেও রাজি হয়নি। এখন ওর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। হয়তো কোনোই লাভ হবে না। ফোর্থ স্টেজ থেকে কেউ ফিরে আসে না। আরিয়ানাও ফিরবে না। তবু যাচ্ছি, কারণ, শেষ সময়টা আমি ওর পাশে থাকতে চাই। নেপালে, আমাদের পরিচয়টা ছিল আকস্মিক, মিলনটাও তাই। মাত্র এক সপ্তাহের উদ্দাম প্রেম। তারপর হারিয়ে ফেলেছি একে অপরকে। আমি আর কোনো দায় টেনে নিইনি ঠিকই, কিন্তু আরিয়ানা বয়ে বেড়িয়েছে আমার স্মৃতি, সোফিয়ার ভেতর দিয়ে। সিঙ্গেল মাদার হিসেবে যতখানি ভোগান্তি পোহাতে হয়, তার সবই সয়েছে ও। আমি কোনো ভাগই নিইনি। অথচ আমার মেয়েটা বড় হয়েছে ওর কাছে। জানো, সোফিয়া যে কী সুন্দর বাংলা বলে! শুনলে বিশ্বাসই করবে না। অল্পবিস্তর পড়তে এবং লিখতেও পারে। কিন্তু বাংলার জন্য ওর যে ভালোবাসা, তাতে আমি নিশ্চিত, ও দ্রুতই লেখা এবং পড়াও শিখে যাবে ভালোভাবেই। 

অংশুর কাছে নিশ্চয়ই শুনেছ, ওর শিশুস্বর্গ আর বৃদ্ধনিবাসের এখন একটিই নাম, আরিয়ানার বাড়ি – আরিয়ানা’স হোম। শুনে অবাক হওনি? আমি কিন্তু ভীষণ বিস্মিত হয়েছিলাম। ও আমাকে কিছুই বলেনি, জানো! হয়তো আগে থেকে ও নিজেও ভাবেনি, আকস্মিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আরিয়ানার ক্যান্সারের খবর জানার পর। হয়তো আরিয়ানাকে খুশি করতে চেয়েছিল ও, আরিয়ানাও এত আনন্দিত হয়েছে, এত বিস্মিত, যে ওর নির্লিপ্ততার সমস্ত আবরণ খসে পড়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি অনেকদিন বাঁচতে চাই, বুড়ো বয়সে এখানে এসে থাকতে চাই। ও জানে, কখনোই ওর বুড়ো বয়স আসবে না, জানি আমিও। জানে অংশুও – আমি নিশ্চিত । কিন্তু আমার সঙ্গে অংশুর পার্থক্য হচ্ছে এই যে, আমি কখনো মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে পারি না, ও পারে। ওর সঙ্গে আমার প্রায় কোনোকিছুতেই মেলে না। সেই অর্থে বলতে গেলে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব এক আশ্চর্য ঘটনা। ও মনে করে, মানুষের জন্ম অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং এই জগতে তার একটি মিশন আছে; সবার মিশন এক রকম নয়, বলাই বাহুল্য, কার মিশন কীরকম সেটি খুঁজে নেওয়াও দায়িত্ব তারই, সেই মিশন যখন সে শেষ করে তখন তার শারীরিক মৃত্যু ঘটে। আর আমি মনে করি, মানুষের জন্ম নিতান্তই এক দুর্ঘটনা। পৃথিবীজুড়ে নারী-পুরুষ মিলিত হয় অহরহ, সব মিলনে সন্তান হয় না। এমনও নয় যে, সবসময় জন্মনিরোধক ব্যবস্থা বা সতর্কতা গ্রহণ করা হয় বলে সন্তান হয় না। জন্মনিরোধক ব্যবস্থা তো এই সেদিনের আবিষ্কার, তার আগে হাজার হাজার বছর ধরে অযুত-নিযুতবার নারী-পুরুষের মিলন হয়েছে, কিন্তু সব মিলনে সন্তান হয়নি। কোন মিলনে যে সন্তান হবে কেউ জানেও না। লাখ লাখ শুক্রাণু ছুটে যায় ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে, কোনটি যে জয়ী হবে তাও কেউ জানে না। একেবারে শুরুতেই যেখানে এত বড় অনিশ্চয়তা, সেই জন্ম পরিকল্পিত হয় কী করে? এবং পরিকল্পিত নয় বলেই মানুষের কোনো মিশনও নেই। যদি থাকতো, তাহলে মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণও তার হাতেই থাকতো। অবশ্য মানুষ নিজ হাতে নিজেকে হত্যা করতে পারে, কিন্তু সেটা তো জীবনের অবসান। জীবনের দৈর্ঘ্য সে নির্ধারণ করতে পারে না, চাইলেই বেঁচে থাকা যায় না, সেই নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এই অর্থে আমরা বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছি।

অংশুর এই প্রকল্প ওকে নতুন জীবন দিয়েছে, দিয়েছে নতুন উদ্দীপনা। যে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে সে তার আর্কিটেক্ট ফার্মটা গড়ে তুলেছে, নিম্নমধ্যবিত্ত দশা থেকে উচ্চবিত্তে পরিণত হয়েছে, স্যাঁতসেঁতে ভাড়া বাসাকে রূপান্তরিত করেছে সুদৃশ্য মনোরম অট্টালিকায়, মধ্যবিত্ত পরিবারের কুৎসিত টানাটানির জীবনকে সচ্ছল আনন্দময় জীবনে পরিণত করেছে, এরপর তো ওর ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা ছিল, অবসর নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ও নতুনভাবে শুরু করলো ভিন্ন এক জীবন। সেই প্রার্থনার কথা কি মনে পড়ে তোমার – ‘প্রভু, আমাকে দীর্ঘ জীবন নয়, বিস্তীর্ণ জীবন দাও?’ ও যেন সেই বিস্তীর্ণ জীবনের সন্ধান পেয়ে গেছে।

আমি কিছুই চাইনি জীবনের কাছ থেকে, কিছু পাইওনি। সবকিছু আমার জন্য তৈরি করাই ছিল, ওর মতো সংগ্রামও করতে হয়নি। আমাদের দুজনের চিন্তা, স্বপ্ন, কল্পনা তাই কখনো মেলেনি। তবু ও আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, সবচেয়ে আপনজন। কারণ, আমাদের শুধু একটা জায়গায় দারুণ মিল। আমরা খুব সহজে ভিন্ন মত, ভিন্ন পথ, ভিন্ন বিশ্বাস, ভিন্ন সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে পারি। হাজারটা ভিন্নতা নিয়েও পাশাপশি থাকতে আমাদের অসুবিধা হয় না, ভালোবাসতেও সমস্যা হয় না।

তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারে ওর অতি আগ্রহ আসলে আমার নিঃসঙ্গতা মোচনের চেষ্টা। তোমার যেমন দ্বিধা ছিল, ছিল আমারও। তুমি সেই দ্বিধা কাটিয়ে উঠেছ, তোমার কথা জানিয়েছ, কিন্তু আমি কিছুই জানাতে পারিনি। আজকে জানাই। আমি আসলে বিয়ের মতো ব্যাপারে আর জড়াতে চাই না। তুমি জানতে চেয়েছিলে তাই জানালাম। এখন তুমি যে-কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারো।

আরিয়ানার কাছে যাচ্ছি, কতদিন থাকবো জানি না, কী হবে তাও জানি না। কোনো পরিকল্পনা করতে পারছি না, কারণ সবই অনিশ্চিত। তবে যতদিন পরেই হোক না কেন, আমি দেশে ফিরে আসবো। নীলুর কাছে আমাকে ফিরতেই হবে। তখন হয়তো অনেকটা সময় আরিয়ানার বাড়িতেও কাটাবো। দেখবো অংশুর স্বপ্ন কতটুকু সফল হলো। দেখবো, দুস্থ-নিঃস্ব-ঘরহীন মানুষদের জন্য এই নিঃস্বার্থ সেবামূলক কর্মযজ্ঞ ওকে কোনো নতুন উপলব্ধি উপহার দিলো কি না, জীবনের ভিন্নতর কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেল কি না অংশু। এটা ওর জন্য খুব দরকার। আমার জন্যও। আমি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছি, জীবনের কোনো অর্থ নেই। ঈশ্বর বলতে যদি কেউ থাকেন, এসব জীবন নিছকই তার এক খেয়ালি খেলা অথবা প্রকাণ্ড এক ঠাট্টা। তুমি যা কিছুই করো না কেন, যত মহত্তম মানুষই হও না কেন, মৃত্যুতেই সবকিছুর সমাপ্তি ঘটে যাবে। অংশু অবশ্য আমার সঙ্গে একমত হয় না। ও মনে করে, জীবন হয়তো অর্থহীনই, কিন্তু আমরা অর্থ যুক্ত করতে পারি, নিদেনপক্ষে আরোপ করতে পারি। আর যখনই একটা অর্থ যুক্ত হয় তখনই জীবনের একটা তাৎপর্য তৈরি হয়। মৃত্যুতেই সবকিছুর অবসান হয় না। মানুষ চলে যায় কিন্তু তার প্রবাহ রয়ে যায় – ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবু মানব থেকে যায়’ – ও একবার জীবনানন্দের কবিতার পঙ্ক্তি শুনিয়ে দিয়েছিল আমাকে, এ প্রসঙ্গে। হাহাহা। অংশু আমাকে তর্কে পরাস্ত করার জন্য কবিতার আশ্রয় নিচ্ছে, তাও জীবনানন্দের, ভাবতে পারো? দুর্ভাগ্যক্রমে কবিতাটা ওকে আমিই প্রথম পড়িয়েছিলাম। ও তো কবিতাবিমুখ, বলা যায় কবিতাবিরোধী, কবিতা পড়লে নাকি মাথার ভেতরে কুয়াশার জন্ম হয়! ওকে কবিতামুখী করার জন্য জীবনানন্দ পড়ে শোনাতাম একসময়। ও ভালোবাসতো নন-ফিকশন পড়তে, ওতে নাকি মাথা পরিষ্কার হয়, জীবনানন্দ পড়ার পর এখন কবিতাও ভালোবাসে।

রাজনীতি নিয়ে একসময় তুমুল আগ্রহ ছিল ওর, তা তো জানোই। এখন আর ওসব নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। ও বলে, বাংলাদেশের রাজনীতি যে কদর্য-কুৎসিত রূপ নিয়েছে, ওসব নিয়ে ভাবলে আত্মা কলুষিত হয়ে যায়। রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা ও তাই পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু চেষ্টা ছাড়েনি। ভিন্ন ভিন্ন পথে সে তার মতো করে চেষ্টা করে যাচ্ছে। খুঁজে ফিরছে জীবনের তাৎপর্য। কিন্তু দিনশেষে ও যদি আমারই মতো দ্যাখে, জীবনের কোনো অর্থ নেই, তাৎপর্যও নেই, সেটা খুবই দুঃখজনক হবে। কোনো খেদ না নিয়ে মরতে পারাটাই জীবনের মহত্তম অর্জন বলে মনে হয় আমার। আমার কোনো চেষ্টা ছিল না, তাই কোনো খেদও নেই। ও এত চেষ্টার পরও যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করবে কীভাবে? ওর সমস্ত প্রচেষ্টা এবং স্বপ্ন যেন সফল হয়, আমি নিজেও তা চাই এবং এ-বিষয়ে সবসময় ওর পাশে থাকতে চাই। তুমিও কি থাকবে?

কী আছে আমার ভাগ্যে জানি না। আরিয়ানার কী হবে, সোফিয়া কী করবে, সবকিছুই অনিশ্চিত। তবু, খুব করে চাই, আমরা সবাই মিলে যেন অংশু আর অপলার পাশে দাঁড়াতে পারি। তোমাকে তাই আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম।      

 তোমাকে লেখার জন্য আরো কী কী যেন ভেবে রেখেছিলাম, এখন মনে পড়ছে না। আপাতত এখানেই থামি। কোনোদিন সুযোগ পেলে বাকি কথা বলবো, অথবা না-বলাই রয়ে যাবে অনেক কথা – চিরদিনের জন্য।

কেবল একটা কথা জেনে রাখো, মনেও রেখো, আমি তোমাকে ভালোবাসি সুসান, ভীষণ ভালোবসি।

ভালো থেকো।

তোমার ঋভু।

লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো ঋভু, তবু মনে হলো, কত কী যে লেখার ছিল, কিছুই হলো না। কিন্তু ফের লেখার জন্য রেখেও দিলো না। সে জানে, একবার রেখে দিলে আর কখনোই হয়ে উঠবে না, বরং যেটুকু লিখেছে সেটিই পাঠিয়ে দেওয়া যাক। বহুদিন চিঠি লেখা হয় না, কোথাও পাঠানোও হয় না, কোথায় পোস্ট অফিস আছে তাও জানে না। পরদিন তাই জিপিওতে গিয়ে চিঠি পোস্ট করে এলো ঋভু।

এক্সপ্রেস পোস্ট বলে দ্রুতই পৌঁছে গেল সেই চিঠি। পেয়ে কী যে বিস্মিত আর আনন্দিত হলো অবন্তি! কতদিন পর এমন চিঠি পেল সে! কতকাল পর! তারও ইচ্ছে হলো, ওরকম একটা চিঠি লিখতে। কিন্তু ঋভু লিখেছে, সে দেশে থাকবে না। হয়তো এতদিনে উড়ালও দিয়েছে। তাই ই-মেইলেই ছোট্ট করে উত্তর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। লিখলো :

প্রিয় ঋভু,

কতদিন পর হাতে লেখা চিঠি পেলাম! কতবার যে পড়েছি  ওটা তার হিসেব রাখিনি। অথচ শেষ পঙ্ক্তি ছাড়া কোথাও প্রেমের কথা নেই, আমাদের মধুর কোনো স্মৃতিচারণ নেই, ভালোবাসাবাসি নেই। যেন পাশে বসে অনেকক্ষণ কথা বললে, যেমন আমরা সাধারণত বলে থাকি, নানা বিষয়ে। কোনো ভণিতা নেই তোমার, ছিল না কখনো, সেটিই তোমার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। তুমি ঠিকানা চাওয়ার পর থেকে কেবল ভেবেছি, কী এমন পাঠাবে যে ঠিকানার দরকার? একবারও চিঠির কথা মনে হয়নি, জানো! চিঠিটা পড়ে তোমাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে, বুকে জড়িয়ে রাখি।

জানি না, আরিয়ানার সুস্থ না হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এত নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে! ক্যান্সার কিন্তু এখন আর আরোগ্যাতীত রোগ নয়। চিকিৎসকদের সফলতার হার কম হলেও একেবারে শূন্য নয়। পুরোপুরি না সারলেও নিয়ন্ত্রণে রেখে অনেকদিন বেঁচে থাকাও যায়। এমন তো হতেও পারে, আরিয়ানা আরো অনেকদিন বাঁচবে! যদি সেরকম কিছু হয়, ও কি বাংলাদেশে আসবে? সত্যিই থাকবে ওর নামাঙ্কিত বাড়িতে? ওকে জিজ্ঞেস করো।

পুরো চিঠি জুড়ে অংশুর কথা লিখেছ। ওকে তুমি কতটা ভালোবাসো তা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু পুরোপুরি উপলব্ধি সম্ভবত করতে পারি না। তোমার আমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করলাম। সত্যি বলতে কী, দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কেবলই ভেবেছি, আমি যেমন তোমার সঙ্গে সংসার করতে চাই, তেমনই অংশুর সঙ্গে কাজ করতে চাই। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগছে যে, আরিয়ানা সুস্থ হয়ে উঠেছে, মেয়েকে নিয়ে ও বাংলাদেশে চলে এসেছে। তুমি, আরিয়ানা, সোফিয়া, আমি, অংশু, অপলা সবাই মিলে আরিয়ানার বাড়িতে থাকতে শুরু করেছি। আমাদের চারপাশে শিশুদের কোলাহল আর প্রাজ্ঞ-অভিজ্ঞ সিনিয়র সিটিজেনদের মমতাময় উপস্থিতি। অংশু আর অপলার ছেলেমেয়ে আছে; তোমার কী সৌভাগ্য, তোমারও একটা মেয়ে আছে; আমার তো কেউ নেই। ওই শিশুদের মধ্যেই আমি আমার না-জন্মানো সন্তানদের খুঁজে নেবো। জীবনের অনেক কিছু তো দেখলাম, অনেকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলাম। শেষ সময়টা না-হয় ঘরহীন শিশুদের সঙ্গেই কাটুক। এবং তখন যদি তুমিও পাশে থাকো আমার, আর কিছুই চাওয়ার থাকবে না জীবনে। আমাদের বিয়ে-সংসার নাই-বা হলো, তবু আমি বাকি জীবন তোমার পাশে থাকতে চাই। আরিয়ানা থাকলেও, না থাকলেও।

তুমি পারলে একবার সুইজারল্যান্ড এসো। অথবা আমিও ইতালি গিয়ে তোমাদের দেখে আসতে পারি। আমাদের খুব শিগগির দেখা হবে। ইতালিতে কোথায় আছ, ঠিকানাটা জানিয়ো।

তুমি জানো, তবু বলি। আমিও তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি ঋভু। 

ভালো থেকো।

তোমার সুসান।

সুসানের উত্তর ঋভু পো বাংলাদেশে বসেই কিন্তু ফের উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না। এত তাড়াতাড়ি চিঠি পৌঁছে যাবে, সে ভাবতেই পারেনি। এদিকে সে এখনো ভিসা পায়নি। পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন, তাও বুঝতে পারছে না। অনেকগুলো দেশে গিয়েছে সে, পাসপোর্টের পাতায় পাতায় সেসব প্রমাণ, ব্যাংক স্টেটমেন্টও যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান, এই ধরনের ভিসা আবেদন দ্রুতই নিষ্পত্তি হয়। তাও দেশটা ইতালি, যদিও সে শেনজেন ভিসার জন্য আবেদন করেছে, তবু তো এত দেরি হওয়ার কথা নয়। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে বলে দিনরাত বাসাতেই থাকে ঋভু। অংশু বা অপলা এলে দেখা হয়, নইলে কথাবার্তা যেটুকু ফোনেই সারা হয়ে যায়। অবশ্য আরিয়ানা এবং সোফিয়ার সঙ্গে প্রতিদিন কথা বলে অনেকটা সময় নিয়ে। তারপরও অনেকখানি সময় বেঁচে যায়। সেই সময়টুকুতে কী যে করবে সে, ভেবে পায় না। আরিয়ানার আর সোফিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে সে, অথচ যেতে পারছে না। প্রতিটি দিনের অপেক্ষাকে মনে হচ্ছে অনন্তকালীন, যেন কোনোদিন এর শেষ হবে না।

দিন শেষ হয়, রাত আসে। রাত শেষে আবার দিন। ফের দিন ঘুরে রাত। অন্তহীন এই চক্র। দিনের বেলাটুকু তবু কী করে যেন পার হয়ে যায়, কিন্তু রাতগুলো অন্যরকম।

কোনো-কোনো রাত যেন অধিকতর নিস্তব্ধ হয়ে আসে, নীরবতা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে, হেমন্তের হিমেল হাওয়া এসে কানে কানে কী যেন বলে যায়। বইয়ের পাতা খোলা পড়ে থাকে, পড়া হয় না; লেখার ডায়েরি শূন্য পড়ে থাকে, একটা শব্দও আসে না; গানগুলো বেজে বেজে ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়, শোনা হয় না কিছুই।

কী যে গভীর শূন্যতা!

কত কথা মনে পড়ে! কারো বিষণ্ন মুখ, যে মুখটি দেখার জন্য কত অনন্তকালের অপেক্ষা; কারো ভেজা ভেজা দুটো চোখ, যে-চোখে না-বলা কথাগুলো ভিড় করে থাকে; কারো নিবিড় কণ্ঠ, যে কণ্ঠ থেকে শব্দগুলো নীরবতার মতো আলগোছে ঝরে পড়ে।

বিষণ্ন লাগে, একা লাগে।

মনে হয়, প্রকৃতির সঙ্গে কোনো বিনিময়প্রথা যদি থাকতো, তাহলে সে বলতো, তার আয়ু কেড়ে নিয়ে যেন আরিয়ানাকে দেওয়া হয়। ওর বাঁচা খুব দরকার। যতটা না ওর নিজের জন্য, তারচেয়ে বেশি সোফিয়ার জন্য। সোফিয়া গড়পরতা ইউরোপীয় মেয়েদের মতো নয়, অনেকখানি বাঙালি ধাঁচ আছে ওর ভেতরে। সম্ভবত সেজন্যই ও এত মা-ঘেঁষা। এত অল্প বয়সে মেয়েটা মাতৃহারা হোক, ঋভু তা চায় না। কিন্তু তার চাওয়া-না-চাওয়ায় কিছু যায়-আসে না, সে জানে। প্রকৃতির এত অফুরন্ত ভাণ্ডার, কারো সঙ্গে তাকে বিনিময়-প্রথায় যেতেও হয় না। ঋভুর এই সামান্য আয়ু নিয়ে আরিয়ানাকে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন তো তার নেই। অথচ এই পৃথিবীতে তার কোনো কাজই নেই, বেঁচে থাকা-না-থাকায় এমন কিছু যায়-আসেও না। তাছাড়া, সে তো কেবল বিদায় দিয়েই গেল জীবনভর, আর কত দেওয়া যায়? মাঝে-মাঝে মনে হয়, বড় দীর্ঘকাল ধরে সে বেঁচে আছে, অকারণ-অহেতুক, কবে সে বিদায় নেবে সবার কাছ থেকে? কেন মৃত্যু তার কাছে আসে না? কী যে অসহায় লাগে এসব ভাবলে! হয়তো এইসব অসহায়ত্ব দেখে প্রকৃতির মায়া হয়, হেমন্তের স্নিগ্ধ হাওয়া এসে আদর করে দিয়ে যায় তাকে, কী যেন বলতে চায় ফিসফিসিয়ে। হয়তো সময় ফুরিয়ে আসার কথা বলে, হয়তো ডেকে নিতে চায় অচেনা নিরুদ্দেশে। আর তখন, এরকম এক হাওয়ামুখর হেমন্তের রাতে নিঃশব্দে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়ার সাধ আরো তীব্র আর গভীর হয়ে ওঠে। সমাপ্ত।