মুসলমান শিশুদের বাংলা শিক্ষার সূচনায় প্রাইমার

যাঁরা শিক্ষা বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেন আলোচ্য গ্রন্থের শিরোনামই তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তবু সখেদে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে প্রকাশিত এই বইটি তাঁদের চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। লেখক শফিউল আলম একজন শ্রমশীল, মেধাবী ও শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক। প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে ব্যাপৃত ছিলেন। তদুপরি, শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগেও কর্মরত ছিলেন। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, বিদ্যালয়পাঠ্য গ্রন্থসমূহে ভাষার ব্যবহার ও সুনির্বাচিত অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার ও পরিসংখ্যান প্রভৃতি বিষয়েও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষা ও বাংলা ভাষার বিচিত্র ভুবন নিয়ে তাঁর অনেক গ্রন্থ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আলোচ্য গ্রন্থ বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এই গ্রন্থ নিয়ে যথাপ্রাপ্য আলোচনা হয়নি।

শিরোনাম থেকেই আমরা অনুমান করে নিতে পারি, শফিউল আলম এই গ্রন্থে এমন কিছু বিষয়ের অবতারণা করছেন, যা প্রাক্-আধুনিক যুগের। এমন সময়ের শিক্ষা বা প্রারম্ভিক শিক্ষার কথা তুলছেন, যখন অখণ্ড বাংলার বাঙালি মুসলমান পরিবারের শিশু-শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বা আলাদা প্রাথমিক পাঠের জন্য ধর্ম সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রাইমার প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। ভাষা-আন্দোলনের পর সাত দশক পেরিয়ে এসেছি আমরা। তাই নেহাতই পেশাগত এবং সুনির্দিষ্ট অ্যাকাডেমিক উদ্দেশ্যে যাঁরা পড়াশোনা করেন না, (এবং স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যার বিচারে তাঁরাই গরিষ্ঠ) তাঁদের জন্য এমন এক বিষয়বস্তু বেশ চমকপ্রদ বলেই বিবেচিত হবে। প্রকৃতপক্ষে, শফিউল আলমের এই গ্রন্থের প্রথম তিনটি প্রবন্ধেই শিশু-শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষার প্রাইমার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

স্বল্পপরিচিত এই গ্রন্থটির পর্যালোচনা অন্য কোনো বিজ্ঞজন করলেই হয়তো বিচার-বিশ্লেষণ অনেক যৌক্তিক বলে বিবেচিত হতো। বর্তমানে আর প্রকাশিত হয় না, কিন্তু বছর কয়েক আগে বিশেষত উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁরা সাক্ষরতা বুলেটিন নামে একটি মাসিক পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিলেন। সরকারের শিক্ষা দফতর এই পত্রিকার বিষয়-আশয়ের খোঁজখবর করতেন। কুণ্ঠিতভাবে নিবেদন করি যে, প্রায় তিন দশক ধরে প্রকাশিত হয়েছে, এমন এক ভিন্নচারিত্রিক মাসিক পত্রিকার সার্বিক সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতো বর্তমান আলোচক। বহুদিনের পরিচিত সজ্জন বন্ধু শফিউল আলমকে প্রবলভাবে প্ররোচিত করে বাংলা প্রাইমার বিষয়ে এই তিনটিসহ আরো দুটি প্রবন্ধ আদায় করেছিলাম। গ্রন্থকার তাঁর বইয়ের প্রাক্-কথার প্রথম বাক্যেই সেই তথ্য পরিবেশন করেছেন। এমন সরল স্বীকারোক্তির কারণেই আমার জন্য এই গ্রন্থের পর্যালোচনা কিছুটা অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। বন্ধুকৃত্য শব্দটি তো বহুকাল আগে থেকেই আমাদের ভাষায় ও সমাজে প্রধানত নিন্দার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে আমার এই অনতিপরিসর আলোচনায় আমি সচেতনভাবেই নৈর্ব্যক্তিক মন্তব্য প্রদানে প্রয়াসী থাকব।

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা নিয়ে দুটি রচনায় খুবই সংগতভাবে ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অদ্যাবধি সুপরিচিত যদিও বর্তমানে প্রান্তিকভাবে ব্যবহৃত বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের বিষয়বস্তু, ভাষাশিক্ষা ভাবনা ও স্তরবিভাগ নিয়ে আলোচনা সেখানে স্থান পেয়েছিল। বর্তমান গ্রন্থে মুসলিম পরিবারের শিশুদের বাংলা শিক্ষার প্রারম্ভিক পাঠ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সন্নিবেশন, ঐতিহাসিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও তর্কালঙ্কার ও বিদ্যাসাগরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিম শিক্ষার্থীদের বাংলাভাষা শিক্ষার জন্য যে প্রাইমারের কথা নিয়ে শফিউল আলম এই গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করেছেন, সেটির রচয়িতা হলেন বিষাদ সিন্ধু খ্যাত বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪) সমসাময়িক বিখ্যাত উপন্যাসকার মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১); বইয়ের নাম – মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা, যেটির প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯০৩ ও ১৯০৬ সালে। মুসলিম শিশুদের জন্য আলাদা প্রাইমারের বিষয়টা কেন প্রাধান্য পেল, কেন তৎকালে আলোচ্য হয়ে উঠলো, একবিংশ শতকের এই দ্বিতীয় দশকে অনেকের জন্যই তা বাড়তি অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষভাবে, উল্লেখ করতে চাই যে, বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে এবং ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৫৫ সালে। এই সময়ে কয়েকজন মুসলমান লেখকও প্রাইমার রচনা করেন, কিন্তু সেগুলি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। কেন তা হয়নি, সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই এই মিতকলেবর রচনায়।

মীর মশাররফ হোসেন রচিত প্রাইমার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শফিউল আলম অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য পরিবেশন করছেন, ঐতিহাসিক দিক থেকে সেসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলমান ধর্মাবলম্বী মন্ত্রী হয়েছিলেন সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী (১৮৬০-১৯২৯)। তিনি ছিলেন আসাম ও বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য। ইংরেজি ভাষায় সবিশেষ দক্ষ জনাব চৌধুরী ১৯০০ সালে ‘মুসলমান শিক্ষা সম্মেলন’-এ মুসলমান শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা শিক্ষা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। অবশ্য ওই প্রবন্ধের ভাষা ছিল উর্দু। মজার বিষয় হলো, ওই উর্দু প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ ‘Vernacular Education in Bengal’ প্রকাশের জন্য পাঠানো হয়েছিল ভারতী পত্রিকার কার্যালয়ে। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন ওই বহুলপঠিত পত্রিকার সম্পাদক।

নবাব আলী চৌধুরীর প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতে ওই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘মুসলমান ছাত্রের বাঙ্গালা শিক্ষা’ শিরোনামে দীর্ঘ একটি পর্যালোচনা পেশ করেন। তিনি যথার্থভাবেই উল্লেখ করেছিলেন যে, বঙ্গদেশের অনেক অঞ্চলেই হিন্দুর চেয়ে মুসলিম জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে, অথচ, রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করছেন, বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জন্য যেসব পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়েছে ও প্রচলিত সেগুলি ‘হিন্দু ছাত্রদের পাঠোপযোগী করে লেখা’। কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ যা চিহ্নিত করছেন তা এরকম। সেই সময় পর্যন্ত ‘মুসলমান লেখকগণ বিশুদ্ধ বাংলা সাহিত্য রচনা ও পাঠ্যপুস্তক রচনায়’ কোনো অগ্রবর্তী ভূমিকা গ্রহণ করেননি। এমন বাস্তবতার মধ্যে নিন্দুক ব্যক্তিবর্গ সাম্প্রদায়িকতার সংগোপন সংকেত আবিষ্কার করতে পারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করছেন, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। তিনি বলেছিলেন, দেখা যাচ্ছে, ‘মুসলমান ছাত্র সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে’ এবং মুসলমান লেখকরাও দিন দিন বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনায় দক্ষ হয়ে উঠছেন। এমন বাস্তবতার নিরিখে রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়ে বলছেন, ‘মুসলমান ছাত্রদের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া পাঠ্যপুস্তক রচনার সময় আসিয়াছে।’ সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরীর বঙ্গদেশীয় মুসলিম শিক্ষার্থীদের বাংলা শিখন বিষয়ে উর্দু প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বার্থ বিষয়ে যেসব যুক্তিতর্কই উত্থাপন করা হোক না কেন, ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের অভিমত প্রকাশ নিশ্চিতভাবেই মীর মশাররফ হোসেনকে বাংলা প্রাইমার রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল।

বাংলা ভাষায় মুসলিম শিশুদের জন্য ভিন্ন রকমের প্রাইমার রচনার অবশ্যই একটা সম্প্রদায়ভিত্তিক পটভূমি ছিল। সে-কথা সংক্ষেপে কিন্তু সুস্পষ্টভাবে শফিউল আলম তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘উর্দু ভাষার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ^াস ও সংস্কৃতির কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন উচ্চবিত্ত মুসলমানগণ কী বাঙালি পরিবারে জন্ম অথবা সাধারণ পরিবার থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পরে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত, তাঁদের অনেকেই বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষাকে নিজেদের জবান বলে ভাবতে বা ঐ ভাষাতে কথা বলতেই নিজেদের জন্য গৌরববোধ করতেন।’ এই পর্যায়েই কাজী নজরুল ইসলাম-সম্পাদিত লাঙল সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি সংবাদ ভাষ্যের উল্লেখ করেছেন লেখক, যা তৎকালীন অভিজাত বাঙালি মুসলিম মানস বুঝতে সহায়তা করে।

স্যার আবদুর রহীম [ব্রিটিশ সরকার থেকে নাইট উপাধিপ্রাপ্ত, প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট, হাইকোর্টের বিচারপতি, নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য] সেদিন – জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ-এর সম্মিলনে বলেছেন, বাংলা ভাষা যদি শিক্ষার বাহন হয়, তবে বাঙালী মুসলমানদের সর্ব্বনাশ হবে। চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করে তিনি বাঙালী মুসলমানদের স্বনিয়োজিত নেতা হয়েছেন এবং যতসব অশোভন ও অবৈজ্ঞানিক জিনিসের ব্যবস্থা তিনি বাঙালী মুসলমানদের জন্য করতে আরম্ভ করেছেন।

স্যার আবদুর রহীম মুসলমানদিগকে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ভাষা শিক্ষা করতে বলেছেন। জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ-এর সম্মিলন-এ অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিরূপে আপনার অভিভাষণ তিনি উর্দুতেই পাঠ করেছেন। শুনেছি এই অভিভাষণটি তিনি নিজে উর্দু ভাষায় তৈয়ার করতে পারেননি, ইংরেজি ভাষায় লিখে কোনো বিহারী ভদ্রলোকের দ্বারা উর্দুতে তর্জমা করে নিয়েছিলেন। তার ওপরে অভিভাষণখানা ভাল মতো পাঠও করতে পারেননি। কতিপয় উর্দুভাষী ভদ্রলোক আমাদের জানিয়েছেন যে, স্যার আবদুর রহীম যখন অভিভাষণখানা পাঠ করছিলেন তখন মনে হচ্ছিল যেন কোনো ইংরেজ উর্দু পড়ছেন।

এমন সামাজিক বাস্তবতার সমান্তরালে বাঙালি শিশুদের জন্য তৎকালে প্রকাশিত বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুতে রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য হিন্দু কাহিনির বিবরণী আমরা দেখতে পাই। হিন্দু লেখকরাও তখন মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে আগত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে সংবেদনশীল ছিলেন না। লেখাপড়ায় আগে থেকেই এগিয়ে থাকা হিন্দু লেখকরা রবীন্দ্রনাথের মতো করে সমাজটাকে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই, মীর মশাররফ হোসেন যিনি প্রমিত বাংলাভাষা প্রয়োগে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তাঁর কথাসাহিত্যে, তিনিই মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা-য় লিখলেন : ‘তুমি মুসলমান।/ টুপী নাই কেন?/ খালি মাথা ছি ছি/ চাদর আর ধুতি/ হরি বাবুর নাতি/ পায়জামা চাপকান/ হয় শেখ নয় পাঠান’। বালকদের প্রতি নির্দেশনা হিসেবে তিনি লিখছেন : ‘আল্লার নাম করি তবে ফজরে উঠিবে,/ মুখ ধুয়ে অজু করে নামাজ পড়িবে।/ তারপর আমপারা হাদিস কোরান -/ যাহা যাহা পাঠ্য থাকে পড়িবে শ্রীমান।/ শেষে এই বাঙ্গালা শিক্ষা অবশ্য পড়িবে/ খোদার ফজলে দিন কায়েম থাকিবে’।

যে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম শিশুদের জন্য বাংলা শেখার সুবিধার্থে মীর মশাররফ হোসেন প্রাইমার রচনা করেছিলেন, তা ভাষা শিখনের অতিরিক্ত ‘মুসলমান’ তৈরি করতেও বিশেষভাবে প্রণোদনা জুগিয়েছিল। ওপরের উদ্ধৃতিতে তিনি কিন্তু অন্ত্যমিলের জন্য ‘শ্রীমান’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে এই শব্দটিকে অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষ বলে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু বহুকাল ধরে সকল ধর্মাবলম্বী বাঙালি নামের প্রারম্ভিক সম্ভাষণ হিসেবে ‘শ্রী’ টিকে থাকলেও পাকিস্তান সৃষ্টির কাল থেকে তা ‘সাম্প্রদায়িক’ বিবেচনায় বর্জিত হয়েছে। তবে হাদিস-কোরানের সঙ্গে [শেষে] বাংলা পড়ার নির্দেশনার মাধ্যমে মীর মশাররফকে সুনির্দিষ্টভাবেই স্যার আবদুর রহীম থেকে ভিন্নভাবে চিহ্নিত করা যায়।

অধ্যাপক শফিউল আলমের গ্রন্থটির শিরোনামে মুসলমান শিশুদের জন্য বাংলা প্রাইমার প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে বটে এবং তা পাঠকদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই বিশেষ কৌতূহল সৃষ্টি করে। কিন্তু বইটির সূচিপত্রের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, ওই প্রাইমারের বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্ব বহন করলেও, লেখক অন্যান্য কতিপয় বিষয়কে গ্রন্থভুক্ত করেছেন এবং সেই সব বিষয়ও আমাদের মনোযোগ দাবি করে। মীর মশাররফ হোসেনের পরই শিশুশিক্ষায় বাংলা প্রাইমারের আলোচনায় লেখক স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, তাঁর রচিত সহজ পাঠ এখনো শিশুশিক্ষার ভাবনামূলক বই হিসেবে আলোচিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বা এপার বাংলায় রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ-এর তেমন সমাদর কখনো দেখা যায়নি। দুই দশক আগে ওপার বাংলা বা পশ্চিমবঙ্গে শিশুশিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে সহজ পাঠ-কে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। শিক্ষাভাবুকরা সেসময় কোলাহল সৃষ্টি করেছিলেন, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের দোহাই দিয়ে রবীন্দ্রনাথের বইয়ের অসম্পূর্ণতা বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। যাই হোক, সহজ পাঠ দীর্ঘদিন ধরে পাঠ্য হিসেবে গ্রাহ্য হয়নি। কিন্তু উভয় বঙ্গেই দেখা গেছে, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বিষয়ে শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞবৃন্দ তুলনামূলকভাবে অধিক অতিথিপরায়ণ। আবার অন্যত্র দেখেছি, শফিউল আলম বিদ্যাসাগরের বর্ণ ও শব্দবয়ন, চয়ন বিষয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে নীতিমূলক কাহিনি বিষয়ে তিনি  নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ঈশপের প্রাণী চরিত্রায়নের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষারও প্রবল বিরোধী শফিউল আলম। এই গ্রন্থ আলোচনায় ওপরের কয়েকটি বাক্যও প্রাসঙ্গিক এই জন্যই যে, তা থেকে শিশুশিক্ষার ধরন নিয়ে লেখকের মনোভাব বুঝতে পারা যায়। সমাজে প্রচলিত ব্যবস্থায় শিশুশিক্ষা বিষয়ে কবিগুরুর মনোভাব বিধৃত আছে তাঁর জীবনস্মৃতি-তে। শিক্ষাদানের পদ্ধতি যে শিশু রবীন্দ্রনাথের খুবই অপছন্দ ছিল, সে-কথাও আমরা জানি।

কিন্তু যে-কথা জেনে আমরা বিস্মিত হই তা হলো, আট দশক বেঁচে থাকা কবি প্রথম সাত দশকে সাহিত্যচর্চা, জমিদারি, রাজনীতির কিছু সমসাময়িক পাঠসহ সমাজভাবনার নানা আঁকাবাঁকা পথ বিচরণ করে প্রায় শেষ দশকের আগেভাগে শিশুদের জন্য সহজ পাঠ লিখতে গিয়ে কেন শক্তিক্ষয় করলেন, তাও আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। এখানে উল্লেখ করে নিতে চাই, তিনি বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষাশিক্ষার জন্যও বেশ শ্রমনিবিড় পাঠ্যবই রচনা করেছিলেন। অনেকেই হয়তো জানেন, তবুও স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছি, অদ্যাবধি রবীন্দ্রনাথের যে অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে স্থান ধরে রেখেছে, সেই ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে’ সেই কবিতাও এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। সহজ পাঠ কতটা বৈজ্ঞানিকভাবে  রচিত বা এই বইয়ের বিভিন্ন পাঠ ভাষাশিক্ষায় শিশুদের কতটা সহায়ক, সে-বিষয়ে অনেকে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলেছেন। শফিউল আলম যথার্থভাবেই প্রবোধচন্দ্র সেনের একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন – ‘এ বইটি হচ্ছে শিক্ষার্থীর প্রথম সাহিত্য পাঠের বই।’ বর্ণ, শব্দ পরিচয় ও বাক্য গঠনের চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আনন্দদায়ক পাঠের ওপর। নন্দলাল বসুর চিত্রায়ণে সেই আনন্দ আরো পরিপুষ্ট হয়েছে। কিন্তু তারপরও যখন পড়ি, ‘অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনী গাঁয়ে/ পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে/ গঞ্জের জমিদার অঞ্জন সেন’ – তখন শুধু সাহিত্যপাঠ বা শিশুর মনে ছবির ভাষা ফুটিয়ে তোলা নয়, যুক্তবর্ণ ব্যবহারের চমৎকার উদাহরণ দেখতে পাই আমরা। চার ভাগের সহজ পাঠ-এ সংকলিত হয়েছে ভাষা শিক্ষার স্তরভিত্তিক পাঠ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতা, গান এবং উদ্ভিদ,  বিজ্ঞান, জীবনী, প্রাণিজগৎ ও সোহরাব রুস্তমের গল্প। স্বরচিত ছাড়াও অন্যান্য কয়েকজনের রচনাও সহজ পাঠ-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এর পরের প্রবন্ধেই শফিউল আলম পুনরায় মুসলমান বাঙালি শিশু, তাদের ভাষা শিক্ষা এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলা প্রাইমার ও ইসলামি পরিপ্রেক্ষিতের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কাজী নজরুল ইসলাম-রচিত মক্তব সাহিত্য শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশের সূত্রে। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও বাস্তবতা ছিল এমনই যে, ধীর গতিতে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিল এবং এই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক দিক থেকেই মুসলমান শিক্ষার্থীদের ভাষাশিক্ষার জন্য পাঠ্যবইয়ের একটা বাজার সৃষ্টি হয়েছিল। কৌতুকপ্রদ হলেও এ-কথা সত্য যে, বহু হিন্দু লেখক স্ব-নামে অথবা মুসলমান নাম ধারণ করে এই বাজারের চাহিদা মেটাতে মুসলমান শিশুদের বাংলা শিখনের জন্য প্রাইমার রচনা করেন। মক্তব সাহিত্য নামে কাজী নজরুল ইসলাম-রচিত এই প্রাইমার নিয়ে এমন একটা প্রহেলিকার এখনো সিদ্ধান্তমূলক সমাধান মেলেনি। অনেকেই এমন অভিমত জ্ঞাপন করেছেন যে, নজরুল ওই বই লেখেননি, তখন তিনি গান রচনায় বিশেষভাবে মশগুল। তাই ঝানু প্রকাশক, যিনি নজরুলের সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত, তিনি নজরুলঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিকে কাজে লাগিয়ে অন্যের রচিত বইয়ে নজরুলের নাম সংযুক্ত করতে কবিকে রাজি করিয়েছিলেন। ভাবতে বেশ লাগে যে, বাজার ব্যবস্থাপনায় সেকালেও অতি-লাভ ও অনৈতিকতার লক্ষণ ছিল।

শফিউল আলম এই প্রবন্ধে এমনসব বিচিত্র তথ্য পরিবেশন করেছেন। কিন্তু তিনি আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তিনি মুসলমান সমাজের অবস্থা, হিন্দুদের প্রতি তাদের মনোভাব, অক্ষয়কুমার দত্তের বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যগ্রন্থ চারুপাঠ, এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের শিক্ষা গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। মক্তবে  পড়ানোর জন্য  শিশুপাঠ্য গ্রন্থ রচনা, প্রকাশ ও বিপণনে কুমিল্লার এক গ্রামে, এক বালিকাকে নজরুলের বিয়ের কাহিনিও এখানে যুক্ত আছে। শফিউল আলম অবশ্য এমন মন্তব্য করেছেন, ‘তবে মক্তব সাহিত্য-এর রচয়িতা নজরুলের মক্তবের সঙ্গে পরিচয় কিশোর বয়সেই ঘটেছিল। কারণ চুরুলিয়া গ্রামের মসজিদে কিশোর নজরুল আযান দিতেন, তেমনি গ্রামের মক্তবে গরীব মুসলমান শিশুদের পড়াতেনও বটে। এই পাঠদান ছিল জীবনের জন্য, জীবিকার জন্য তার প্রথম প্রয়াস।’

নজরুল-প্রণীত মক্তব সাহিত্য-এর অন্তর্ভুক্ত সকল পাঠ উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু যা বর্তমান সময়ের পাঠক বা আলোচকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, গরিব মুসলমান শিশু, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যাদের জন্য এই পাঠ্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল এবং তৎকালীন সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও

স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছিল, সেটির বিষয়বস্তুর মধ্যে ইসলামি ধারণা অন্তর্ভুক্ত হলেও, তার মধ্যে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন এবং আধুনিককালের মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষাদানের যে-ধরনের প্রচারধর্মিতা লক্ষণীয়, মক্তব সাহিত্য-এ সে-ধরনের কোনো সংকীর্ণতার আভাস পাওয়া যায় না। সেখানে ‘হযরত মোহাম্মদের উম্মত’ পরীক্ষা শীর্ষক পাঠে ধর্মশিক্ষা নয়, নৈতিকতাই প্রাধান্য পেয়েছে। এই প্রাইমারে গ্রামের পিছিয়ে পড়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে বিভিন্ন পাঠ বিন্যস্ত করা হয়েছে; মোট ২১টি পাঠের মধ্যে কবিতা ৯, গদ্য ১২। সম্পূর্ণ বইটি পাওয়া গেলে এই প্রাইমারের মূল্যায়ন করা সহজ হতো।

তৃতীয় পাঠে নজরুল রবীন্দ্রনাথের কণিকা কাব্যগ্রন্থের ‘অকর্মার বিভ্রাট’ কবিতাটি সামান্য সম্পাদনা করে ‘আলস্যের ফল’ নামে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এমন বিষয় থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মক্তব সাহিত্য গ্রন্থ প্রণয়ন ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে মুসলিম শিশু শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলাদাভাবে তাদের ধর্মবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে কোনো বিভেদ পন্থা সৃষ্টিতে উসকানি দেওয়া হয়নি, অথচ এই একবিংশ শতকের বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার পৃথক শাখায় ভিন্নতা ও দূরত্ব রচনার জন্য সুপরিকল্পিত উদ্যোগ দৃশ্যমান। মক্তব সাহিত্য-এর বিভিন্ন পাঠের শেষে অনুশীলনী হিসেবে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আলোচনা’ ‘প্রশ্ন’ ‘বানান কর ও অর্থ বলো’ প্রভৃতি সংযোজন করা হয়েছে। বইটিতে বিভিন্ন পাঠের সংযোজন থেকে আমার নিশ্চিতভাবেই মনে হয় যে, এটির গ্রন্থকার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আলোচ্য গ্রন্থে ভাষাশিক্ষা প্রসঙ্গে আরো দুটি প্রবন্ধ রয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গ্রন্থকার বাংলাদেশের অতীত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি বিশেষভাবে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত অভিমত ও সুপারিশ পর্যালোচনা করেছেন। নিতান্তই দুঃখের বিষয় যে, স্বাধীনতা- উত্তর বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদনটি কখনো আলোর মুখ দেখেনি এবং আরো অধিক বেদনার বিষয় হলো, পরপর সরকার পরিবর্তনের অভিঘাতে কোনো শাসকগোষ্ঠীই এর প্রতি সুবিচার করেনি এবং তা স্বেচ্ছাকৃতভাবেই। অপরাজনীতি যে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া একটা স্বাধীন দেশকে কিভাবে ভুল পথে চালিত করতে পারে, তার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণই হলো এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের প্রতি সর্বাত্মক অবহেলা। শফিউল আলম সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এই দুঃসহ বেদনাকে সহ্য করেছেন।

অন্য একটি প্রবন্ধে তিনি ভাষাশিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মাতৃভাষা বাংলা এবং উপনিবেশিক শাসনের অনিবার্য উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার অবস্থান, শিক্ষা ও শিখন বিষয়ে বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য করেছেন। ভাষার এলাকা ছাড়িয়ে শফিউল আলম এর পরের প্রবন্ধে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ ও এই গৌরবময় ইতিহাসের প্রস্তুতি পর্ব এবং এই যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে শুধু আমাদের হৃদয়ের আবেগ নয়, মস্তিষ্কে বিকৃত চেতনার প্রতিফলন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। যাঁরা শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করেছেন, তাঁরা নিজেরাই নিজের চিত্তে ও মননে সার্বিক না হোক মৌলিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা ধারণ করেন, সেই প্রশ্নটা তীব্রভাবে তোলেননি গ্রন্থকার, কিন্তু তিনি যখন বলেন, ‘১৯৮১ সাল থেকে পাঠ্যপুস্তকে শ্রেণীভিত্তিক বিন্যাসে বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর বাহিরে মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং এই যুদ্ধের দীর্ঘ পটভূমি ও বিস্তার গৌণ হয়ে পড়ে’, তখন সহজেই তাঁর অভিমত সহজেই অনুমান করা যায়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং এর সঙ্গে আমাদের শাসকগোষ্ঠীর পালাবদল এবং তাঁদের ক্ষমতা লাভ, ক্ষমতায় টিকে থাকা এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতাও জড়িত।

পরের দুইটি প্রবন্ধের শিরোনাম যথাক্রমে ‘সম্ভাবনার বাংলাদেশ : শিক্ষা ও সাক্ষরতা’ এবং ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ সফল হোক’। প্রথমটি শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং উদ্যোগের লক্ষ্য ও ইতিহাস নিয়ে তথ্যনির্ভর রচনা। আর জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বিষয়ে শফিউল আলমসহ দেশ, সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে ভালো চিন্তা করেন এমন মানুষদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। পূরণ যে হয়নি তা আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

জীবনানন্দ দাশ, এক অসাধারণ কবি, আভিধানিক অর্থেই। এই গ্রন্থে তাঁর কাব্যবিষয় বা কাব্যকলা নিয়ে নয়, তাঁর শিক্ষক জীবন নিয়ে একটা আলাদা ঘরের চাবি খুলে দিয়েছেন শফিউল আলম। আরো একটা অজানা জগতের সন্ধান দিয়েছেন তিনি। মধুসূদন দত্ত, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবস্থান আমাদের সবার পরিজ্ঞাত কিন্তু এই গ্রন্থে লেখক কালোপাহাড়ি চরিত্রের এই কবি-নাট্যকারের লেখা স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করে আমাদের আলোকিত করেছেন। মুসলমান শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য আলাদা প্রাইমার রচনার বুদ্ধিবৃত্তিক কাঁসুন্দি ঘাঁটতে গিয়ে অন্যান্য প্রবন্ধের মতো আকর্ষণীয় পরিবেশনায়, নববর্ষ, নৃত্যকলা বিষয়েও লেখা আছে এই গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের ‘মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা’ এবং ‘মক্তব মাদ্রাসার বাংলা ভাষা’ শিরোনামে দুটি প্রবন্ধ পরিশিষ্ট হিসেবে যুক্ত হয়েছে। পাঠকদের জন্য তা এক বড় পাওয়া।