মুস্তাফা নূরউল ইসলাম : তাঁর দায়বোধের সীমানা

বিশ্ববিদ্যালয়-পর্বে অনেকের নানা ধরনের অর্জন থাকে, আমার তেমন কোনো অর্জন নেই। কয়েকজন শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছিলাম – এই মাত্র। এঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁর নাম বলতে হয় তিনি মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। অনেক কিছুর সঙ্গে তিনি আমাদের আধুনিক কবিতাও পড়িয়েছিলেন। কবিতা কী, আধুনিকতা কী, কেন আধুনিক কবিতা  – এসবের বিস্তারে তিনি আমাদের নিয়ে যেতেন। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, তেভাগা আন্দোলন, নৌ-বিদ্রোহ, প্রগতি লেখক সংঘ – কত বিষয় নিয়েই যে আলোচনা করতেন ওই এক কবিতা পড়াতে গিয়ে। সাময়িকপত্র সম্পাদনার মানুষ ছিলেন তিনি। সে-কারণেই হয়তো বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি, কবিতা, দীনেশরঞ্জন দাশের কল্লোল, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয়ের ভাদানের কথা তাঁর আলোচনায় ঘুরেফিরে আসত। সিগনেট প্রেসের কথা বলতেন, নরেশ গুহর টুকরো কথার গল্প তাঁর মুখেই প্রথম শুনি। ক্লাসে পড়াতে এলে ছোট ছোট কাগজে নোট রাখতেন। যে-কারণে তাঁর ক্লাস লেকচার বিস্তারে গেলেও বেপথু হতো না। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো সবাই যে যার মতো স্বাধীন। সবচেয়ে স্বাধীন বোধহয় শিক্ষকরা, আরো স্পষ্ট করে বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা। সেরকম স্বাধীন অধ্যাপকদের দেখার দুর্ভাগ্যও আমাদের কারো কারো হয়েছে। এঁদেরই কেউ কেউ বছরে দু-তিনবার ক্লাসে দেখা দিয়ে আমাদের ধন্য করতেন। এদিক থেকেও মুস্তাফা স্যার ছিলেন ব্যতিক্রম। ঢাকা থেকে আসতেন, কিন্তু রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেননি, এটা ছিল বিরল ঘটনা। দায়বোধের ব্যাপারটি তাঁর মধ্যে ছিল সাংঘাতিকভাবে, দায়িত্ববোধও। খুব মনোযোগ দিয়ে আমাদের টিউটোরিয়াল খাতা দেখতেন। লাল পেনসিলে দাগ দিয়ে খাতাগুলো ফেরতও দিতেন। এই গুণটি আমাদের বিভাগের অন্যসব শিক্ষকের মধ্যে ছিল, এমনটি বলা যাবে না। ক্লাসেও পাঠক্রমের বাইরের বইপত্র পাঠের তাগিদ দিতেন। আবার অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতিকে তাচ্ছিল্য করতেন না। তিনি নিজেও তো ছিলেন ছাত্ররাজনীতি-করা একজন মানুষ। কিন্তু কজনই-বা নিজের অতীতকে মনে রাখে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর তাঁর সুর্ন্দম পত্রিকার সূত্র ধরে স্যারের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। তাঁর বাসায় নিয়মিত যেতাম। বিচিত্র বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। সাহিত্য থেকে রাজনীতি কোনো কিছুই বাদ যেত না। তিনি খুব করে চাইতেন মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকতায় আসুক। সেজন্য নিজে থেকে চেষ্টাও করতেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও তাঁর এই চেষ্টার নজির রয়েছে। হতাশাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দিতেন না। নানাভাবে চেষ্টা করতেন, ছাত্রছাত্রীরা যেন তাদের ভেতরের হতাশাকে কাটিয়ে উঠে নিজেদের পায়ে দাঁড়ায়। একজন আশাবাদী শিক্ষক ছিলেন, আশাবাদী মানুষ। তাঁকে নিয়ে এরকম বিষাদময় বিশ্লেষণ করাটা বেশ কষ্টকর। পবিত্র বাইবেলের পুরনো গ্রন্থে রয়েছে, ‘সবকিছুর একটা সময় আছে; আসমানের নীচে প্রত্যেকটি কাজেরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে – জন্মের সময় ও মরণের সময়।’ একানব্বই বছর বয়সে তিনি চলে গেলেন। তারপরও অকালপ্রয়াত শব্দটির অর্থ খুঁজতে গিয়ে হয়রান হতে হলো। কেননা, মুস্তাফা নূরউল ইসলামকে নিয়ে এরকম বিষাদের কোনোপ্রকার বিশ্লেষণ করতে আমি কোনোমতেই রাজি ছিলাম না।

 

দুই

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ছিলেন আবহমান বাংলার একজন প্রাণের সন্তান। বাংলা, বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, তার সংস্কৃতি, সেই

সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, তার ইতিহাস-ঐতিহ্য  –  এ সবকিছুতেই ছিল তাঁর সীমাহীন আগ্রহ ও চর্চার বিষয়। এ চর্চার নেপথ্যে শুধুই তাঁর অ্যাকাডেমিক স্বার্থ নয়, বরং অনেকটাই তাঁর অন্তরের তাগিদ নিহিত ছিল। ছিল দায়বোধের একটা ব্যাপার। হাজার বছরের উৎস থেকে সঞ্চারিত আত্মপরিচয়ের সন্ধানে তিনি তাঁর সমস্ত জীবন ব্যয় করেছিলেন। নিজের লেখালেখির কথা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমাকে লিখতে হবেই, এটা আমার নিয়তির নির্দেশ। না লিখে আমার অব্যাহতি নেই। তাই আমি লিখি।’ তাঁর এই লেখালেখির পটভূমি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘হঠাৎ করেই আমার লেখালেখি শুরু হয়নি। বাল্যাবধি আমি সেই পরিবেশেই লালিত হয়েছি। আমার পিতার তাঁর আমলে লেখকখ্যাতি ছিল। স্পষ্ট স্মরণ করতে পারি, আমার সেই বয়সে কলকাতায়-চট্টগ্রামে-ময়মনসিংহে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই তাঁর লেখক বন্ধুদের সমাগম ঘটত। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, ইবরাহীম খাঁ, আবদুল কাদির, আবুল ফজল, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ এনামুল হক, আবু জাফর শামসুদ্দীন প্রমুখ। সরাসরি পিতার প্রভাব এবং এই পরিবেশের প্রভাব, মনে হয়, আমার লেখক হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে।’ উত্তাল চল্লিশের প্রতি তাঁর যে-ঋণ, সেটির কথাও অকপটে স্বীকার করতেন  –  ‘তারপর তো এল চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে সক্রিয় আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগ। বাকি কাজটা করেছে তদবধি রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে অহোরাত্র একাত্ম সম্পর্ক।’ মুস্তাফা স্যারের দায়বোধের কথা বলেছি। আমাদের

মাতৃভাষা-চেতনা ও ভাষা-আন্দোলন (১৯৮৪), বাংলাদেশ : বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সন্ধানে (১৯৯০), আবহমান বাংলা (১৯৯৩), আমাদের বাঙালীত্বের চেতনার উদ্বোধন ও বিকাশ (১৯৯৪) – এসব বই সম্পাদনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর আত্মপরিচয়ের দায় যেন শোধ করতে চেয়েছেন।

 

তিন

মুসলিম বাংলা সাহিত্য : পাঠপরিক্রমা (১৯৬৫) গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন  –  ‘ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মুসলিম বাংলা সাহিত্য পাঠ করতে গিয়ে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন জাগ্রত হয়। প্রশ্নগুলো এইভাবে সাজানো যেতে পারে : বাঙালি মুসলিম মানসে আধুনিক চেতনার উন্মেষ দীর্ঘবিলম্বিত কেন? নবীন সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেনের পূর্বে মুসলিম লেখকদের সচেতন প্রয়াস অনুপস্থিত কেন? আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের সাধনাকে কী বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব? ঊনবিংশ শতকের শেষ পাদে এবং বিংশ শতকের প্রথম পাদে যে মুসলিম বাংলা সাহিত্যের সাক্ষাৎ পাই তার বাস্তব এবং সামাজিক পটভূমি কী?’ বলা যায়, সাহিত্য জীবনের প্রথম পর্বে যেসব প্রশ্ন তাঁর মনে জেগেছিল, সারাজীবন ধরেই সেসব প্রশ্নের উত্তর নানাভাবে তিনি খুঁজে গেছেন। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এ-জায়গায় ছিলেন নিরলস। তাঁর অধ্যাপনা, সাহিত্যপত্র-সম্পাদনা, গ্রন্থ-সম্পাদনা  –  সবই একসূত্রে ছিল গাঁথা। আর এসবের মধ্য দিয়ে তিনি জীবনের অর্থকে অন্বেষণ করে গেছেন। তাঁর কাছে সাহিত্য শুধুই নিছক সাহিত্য নয়, বরং তাকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে মিলিয়ে পাঠ করতে চাইতেন। ইতিহাসের প্রতিও তিনি ছিলেন দায়বদ্ধ। মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন, ‘মশাররফ হোসেনের ছিল খাঁটি ঔপন্যাসিকের প্রতিভা। তাই ‘বিষাদ-সিন্ধু’ ইতিহাসাশ্রিত হওয়া সত্ত্বেও লেখক যেন ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষায় মোটেই সতর্ক নন; গ্রন্থটি ধর্মীয় কাহিনীর আবরণে আবৃত বটে, অথচ প্রকৃতপক্ষে ধর্মগ্রন্থ নয়। আখ্যান বিকাশে, চরিত্র সৃষ্টিতে, সংলাপ রচনায় এবং রস পরিবেশনায় এ-গ্রন্থ উপন্যাসের মর্যাদা লাভ করেছে। মশাররফ হোসেনের জাগর চিত্তর বাসনা যা-ই থাকুক না কেন, মানবভাগ্যের করুণ অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অঙ্কনেই তাঁর শিল্পীসত্তা স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে।’ এরই সূত্র ধরে এজিদ চরিত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন  –  ‘বিষাদ-সিন্ধুর উপন্যাসগুণ সর্বাধিক বিকাশ লাভ করেছে এজিদ চরিত্রটিকে অবলম্বন করে। এ উপন্যাসের উজ্জ্বলতম চরিত্র এজিদ। এজিদের মনোদুঃখের সঙ্গে ‘বিষাদ-সিন্ধু’র সূত্রপাত এবং এজিদের ট্রাজিক পরিণতিতে এ-গ্রন্থের উপসংহার। এজিদই এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং কাহিনীর ক্ষমতাধর নিয়ন্তা। বলা যেতে পারে, সামগ্রিকভাবে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ এজিদেরই কাহিনী, হোসেনের ভূমিকা এখানে গৌণতর  –  কারবালা-আখ্যান উপন্যাসের হোসেন-অংশ মহররম পর্বেই সমাপ্ত।’ এই উপন্যাস ও ঔপন্যাসিক সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেছিলেন, ‘মশাররফ হোসেন কিন্তু ধর্মবুদ্ধির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে উপাখ্যান রচনা করতে বসেননি  –  ঐতিহাসিক চেতনার দ্বারা তো নয়ই। কারবালা-কাহিনীর মধ্যে নিয়তি-নিপীড়িত মানবভাগ্যের যে-করুণ লীলাখেলা প্রত্যক্ষ করে মাইকেল মধুসূদন এ বিষয় নিয়ে মহাকাব্য-রচনার প্রেরণা অনুভব করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ সেই মানবীয় প্রবল চেতনাই মশাররফ হোসেনকে বিষাদ-সিন্ধু রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে।’ এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে, আনোয়ারা উপন্যাস সম্পর্কে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছিলেন, ‘সতীর সর্বস্ব পতি সতী শুধু পতিময়/ বিধাতার প্রেম রাজ্যে সতত সতীর জয়।’  –  প্রধানত এই আদর্শকে রূপদান করার জন্যেই লেখকের সাহিত্যপ্রয়াস। এ কারণে উপন্যাসের বিচরণভূমি থেকে আদর্শবাদী লেখককে কদাপি অনুপস্থিত দেখি না। পারিবারিক, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নজিবর রহমানের কতিপয় সনাতনী ধারণা ছিল। সু এবং কু, ভালো এবং মন্দ, সৎ-অসৎ, উচিত-অনুচিত ইত্যাদি সম্পর্কিত চেতনা তাঁর অন্তরে বিশুদ্ধ ও সমাজ নিরপেক্ষভাবে বিরাজমান ছিল। এখানেই তিনি থামেননি। নজিবর রহমান সাহিত্যরতœ সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নের ধরন ছিল এরকম : ‘যুগের প্রয়োজনে ঊনবিংশ-বিংশ শতকের সন্ধিক্ষণে বাঙালি মুসলমান সমাজে সংস্কার-আন্দোলন দানা বেঁধে ছিল। সমাজ সংস্কারক নজিবর রহমান তাঁর রচনার মাধ্যমে সেই আন্দোলনের শিক্ষাকে রূপায়িত করবার প্রয়াস পেয়েছেন। বলা বাহুল্য, তাঁর প্রয়াস সার্থকতা ম-িত হয়েছে।’

 

চার

বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করতে গিয়েই তিনি বাঙালি মুসলমান-সম্পাদিত সাময়িকপত্র নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এর ফল হিসেবে আমরা পাই সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত (প্রথম খ- : ১৯৭৭, দ্বিতীয় খ- : ২০০৫)। প্রথম খ-ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর ‘এই কাজের সূত্রপাত ১৯৬১ সালে  –  তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় নিযুক্ত। তৎকালীন বিভাগীয় অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ এনামুল হকের উৎসাহে ও প্রেরণায় আমি এই গ্রন্থ রচনায় উদ্যোগী হই।’ অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুমের মতে, ‘সাময়িকপত্রের যে সংখ্যাগুলো কালের অতলে হারিয়ে যাচ্ছিল তা সংগ্রহ করে ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম … একটি মহৎ দায়িত্ব পালন করলেন।… ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় ব্রজেন্দ্রনাথ বা বিনয় ঘোষের বই যেমন দেখতেই হয়, ঠিক তেমনি বিংশ শতাব্দীর মুসলিম সমাজ নিয়ে গবেষণার কাজে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের এ গ্রন্থটিও অপরিহার্য।’ একটুও বাড়িয়ে বলেননি তিনি। প্রথম খ- প্রকাশের দীর্ঘ আটাশ বছর পর সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত গ্রন্থের দ্বিতীয় খ- প্রকাশিত হয়। এর কালপর্ব ছিল  –  ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭।  এই গ্রন্থের ‘নিবেদন’ অংশে মুস্তাফা নূরউল বলেছিলেন, ‘পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত করতে বেশ দীর্ঘ সময় লেগে গেল বটে, তবে শেষাবধি যে এ-কাজ সমাপ্ত করা গেছে, প্রাপ্তি বা অর্জন যা-ই বলি না কেন, হয়তো তা এইখানে। কতটা সার্থক হওয়া গেছে সে বিচার অতঃপর পাঠকের। নিজেকে এখন দায়মুক্ত বিবেচনা করছি।’ আবারো সেই দায়মুক্ত হওয়ার ব্যাপারটি এসে যাচ্ছে। কার কাছে দায়মুক্তি? জাতির কাছে নাকি নিজের বিবেকের কাছে? আত্মসম্মানের ব্যাপারটি তাঁর মধ্যে খুব তীক্ষèভাবে ছিল। দায়মুক্তির উৎসটি বোধকরি সেখান থেকেই মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মধ্যে প্রসারিত হয়ে উঠেছিল। এই গ্রন্থের ‘ভূমিকা’য় তিনি বিশেষভাবে এই প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, ‘বিচিত্রসব ঘাত-প্রতিঘাতের দরুন ঐ জিজ্ঞাসাটা পুনরায় জরুরি হয়ে এসেছে : আমরা ‘অগ্রে বাঙালী কি মোসলমান?’  –  … বিবেচনায় আনছি, চেতনা-অর্জনের পদযাত্রায় বাঙালি মুসলমান ইতোমধ্যে প্রাথমিক পর্ব অতিক্রম করে পরবর্তী ঠিকানায় পৌঁছেছে। সেই হেতুতেই পুনরায় কথাটা যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকান্ত থেকে ক্রমে

সচেতন বাঙালী মুসলমান মধ্যবিত্তের অভ্যুদয়। অতএব এমন সংগঠিত এবং স্পষ্ট অবয়বে জনমতের সাক্ষাৎ পেয়ে যাই।’ এই ‘সাংস্কৃতিক সংকট’ সম্পর্কে আরো খানিকটা স্পষ্ট করেই শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা যখনই তীব্র আকার ধারণ করেছে ‘আমরা বাঙালী না মুসলমান?’ এ-প্রশ্ন তখনই আনুপাতিক প্রচ-তায় মাথা তুলে এ সাংস্কৃতিক সংকটকে করে তুলেছে প্রচ-তর। এজন্যই সাম্প্রদায়িকতা যে পর্যন্ত আমাদের মানসলোকে রাজত্ব করবে সে পর্যন্ত আমরা এই সাংস্কৃতিক সংকটের হাত থেকে রেহাই পাব না। এ সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বস্তরে এবং সর্বভাবে খর্ব করা এবং উত্তীর্ণ হওয়া।’ এই উত্তীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটি মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মধ্যে বরাবরই তীব্রভাবে ছিল। আর এই যে বাঙালিত্বের চেতনায় উত্তীর্ণ হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম প্রধান অবলম্বন ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

 

পাঁচ

নজরুল, মুস্তাফা নূরউল ইসলামের কাছে ছিলেন একজন মহৎ কবি। কাকে বলি মহৎ কবি? মুস্তাফা নূরউল ইসলামের মতে, ‘কবি ভাবনায় ও কবি কর্মে যিনি মৌলিক, দেশ-কালের মর্মবাণী যাঁর রচনায় মুখর, কাব্যধারায় যিনি কালান্তরের স্রষ্টা, ইতিহাসে সে কবিকে মহত্বের মর্যাদা করে থাকে। সমকালে যিনি সূর্যপ্রতিম, তাঁর প্রতিভার

কিরণ-রশ্মিতে উত্তরকালের কাব্যালোকও আলোকিত।’ বিশেষভাবে নজরুলকে সামনে রেখেই তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন, তাতে সন্দেহ দেখি না। তাই তিনি এ-ও যোগ করতে ভোলেননি, ‘নজরুল ইসলাম মহৎ কবি বলেই তাঁর রচনায় বাংলা কাব্যের বিচিত্র ঐতিহ্য অনুসরণ সংগত এবং স্বাভাবিক। সে-কারণে বৈষ্ণব, শাক্ত, দোভাষী পুঁথির উপাদান এবং রামায়ণ-মহাভারত ও মুসলিম ইতিহাস পুরাণের উপকরণ স্বতঃস্ফূর্ত সহজতায় তাঁর কাব্যিক প্রয়োজন মিটিয়েছে।’ নজরুলের প্রতি তাঁর এই ঋণ তিনি শোধ করলেন সমকালে নজরুল ইসলাম (১৯৮৩) গ্রন্থটি সম্পাদনার মাধ্যমে। নজরুল-সাহিত্যের পাঠক ও গবেষকদের এই গ্রন্থের কাছে বারেবারেই ফিরে আসতে হয়। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম জানিয়েছিলেন,  এই গ্রন্থটির ‘মোটামুটিভাবে প্রাণ উদ্দেশ্য  –  সমকালীন প্রেক্ষাপটে নজরুল-আবিষ্কার।’

 

পাঁচ (দুই)

নজরুলের সূত্র ধরেই চলে আসে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র কথা। অধ্যাপক খোন্দকার সিরাজুল হকের মতে, ‘ঢাকায় মুসলিম-সাহিত্য-সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠা ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির ইতিহাসে একটা স্মরণীয় ঘটনা।’ এই সমাজের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন  –  সেই কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল  –  এঁদেরকে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে স্মরণ করেছেন। স্মরণ করেছেন তাঁদের সাহিত্যিক ও সামাজিক অবদানকে। তাঁর কাছে এই বুদ্ধির মুক্তির মানুষগুলো ছিলেন ‘পিতৃপুরুষ’স্বরূপ। তিনি বলেছেন, ‘পিতৃজ তাঁরা সুস্থ মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন, মানবিকত্বের প্রতিষ্ঠার সর্ববিধ প্রয়াস পেয়েছেন। এখন আমাদের ওপরে বর্তেছে পবিত্র সেই কর্মসাধনের দায়ভার।’ অন্য কারোর ওপর ভরসা না-করে সে-দায়ভারটুকু নিজের কাঁধে নিজেই সাধ্যমতো নিয়েছিলেন। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো ‘চিন্তা-চর্চা করা’। শিখা ছিল তারই মুখপত্র। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছেন, ‘আর যেমন দশটা পত্র-পত্রিকা, তদ্রƒপ নয় কিন্তু ‘শিখা’র প্রকাশনা। … প্রতিবাদে প্রতিকারে ‘একাট্টা’ মিলেছিলেন কতিপয় তাঁরা। প্রধানতই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের তরুণ শিক্ষক ছাত্র। উদ্দেশ্য  –  আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ব; সংগঠনের জোরে আমরা আগ্রাসী অন্ধকারের অবসান ঘটিয়ে আলোকের অভ্যুদয়ের নিশানায় মুক্ত জ্ঞানের চর্চা করব। দেশময় ছড়িয়ে দেব মুক্ত-বুদ্ধির সেই আলোকবর্তিকা। অতএব তাই থেকে সহজ শব্দের এই নামকরণ ‘শিখা’। পাঁচ বছরে শিখার পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল চৈত্র ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে। অনেকেরই হয়তো জানা আছে যে শিখার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল নজরুল তাঁর ‘খোশ আমদেদ’ কবিতাটি। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘শববেরাত আজ উজালা গো আঙ্গিনায় জ্বলল দীপালি।’ শিখার এই সংখ্যাগুলো ক্রমশই দুর্লভ হয়ে পড়েছিল। ‘বাংলা একাডেমি’র গ্রন্থাগারেও এর সব সংখ্যা নেই। আমাদের সৌভাগ্য যে ওই ‘বাংলা একাডেমি’ থেকেই

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় শিখা-সমগ্র। এ-ও তো তাঁর এক ধরনের দায়শোধ।

 

পাঁচ (তিন)

মুস্তাফা নূরউল ইসলামের পিতা ছিলেন সা’দত আলি আখন্দ (১৮৯৯-১৯৭১), যিনি সরকারি চাকরির পাশাপাশি লেখালেখির সাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। পিতার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমাদের পূর্ব প্রজন্মের আরেক প্রতিভূ, নাম পরিচিতিতে তিনি সা’দত আলি আখন্দ। … তাঁদের বলয়ের আর সবার মতই তিনিও জন্মেছিলেন অজ পাড়াগ্রামে। উঠে এসেছিলেন বৈচিত্র্যহীন স্থবির গ্রামীণ পরিবেশ থেকে। সম্পূর্ণত কৃষিনির্ভর, সংস্কার-কুসংস্কারে বিশ্বাসী মোল্লা-মাতব্বরশাসিত সেই জীবনধারা। … পরবর্তীকালে ‘বাঙালিত্বে’র বিশ্বাসে প্রাণিত এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত।’ তিনি এ-ও জানিয়েছেন, ‘সা’দত আলি আখন্দ

দশটা-পাঁচটা সরকারি চাকরি করতেন। কপালের ফেরে সেটা বদলির চাকরি। তিরিশ বছরের চাকরি জীবনে কখনই খানিকটা থিতু হয়ে বসতে পারেননি।’ তাঁর রচনা থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দিলে আমরা সা’দত আলি আখন্দের চিন্তা-চেতনার ধরন সম্পর্কে খানিকটা অবহিত হতে পারব। তিনি তাঁর ‘বাঙালী’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কথা এই,  –  হিন্দু পৈতে ঝুলিয়ে, ফোঁটা কেটে ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করুক, মুসলিম পাগড়ি এঁটে নামাজ পড়–ন  –  এতে ত ব্যবধানের কিছুই দেখি না। ধর্ম অন্তরের জিনিস, একান্ত নিরালায় যার সাধনার প্রয়োজন তা টেনে বাইরে নিয়ে এসে কোলাহল করতে গিয়েই আমরা যত বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে বসেছি। সহস্র বিচ্ছেদ ও ব্যবধান নিয়েও আমরা বাঙালি তরুণের মুখপানেই তাকিয়ে আছি। তাঁদের প্রাণপণ সাধনায় যুগ-যুগান্তরের বাধা-বিপত্তি কেটে যাক, ভ্রাতৃহারা ভাইকে পেয়ে এক নতুন বলে বলীয়ান তরুণ বাঙালী দুনিয়ার মজলিশে আবার আপনার আসন অধিকার করুক।’ নিজের পিতাকে শুধুই পিতা হিসেবে দেখেননি মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, তাঁকে দেখেছেন ‘বাঙালিত্বে’র বিশ্বাসে প্রাণিত এবং বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন ব্যক্তি হিসেবে। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম পিতৃদায় শোধ করতে চেয়েছেন সা’দত আলি আখন্দ রচনাবলি (২০০৯) সম্পাদনার মাধ্যমে। এমন সৌভাগ্য ক’জন পুত্রের হয়, যিনি নিজের পিতার রচনাকর্ম দায়িত্ব নিয়ে সম্পাদনা করতে পারেন! মুস্তাফা নূরউল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘আমাদের এঁরা … নিজেদেরকে ভাবতে চাইতেন তরুণ মুসলিম।’ তিনিও তাঁর পিতাকে সেই ‘তরুণ মুসলিম’ হিসেবেই আজীবন শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ প-িত চাণক্য বলেছিলেন, ‘এক শত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একজন মাত্র গুণী পুত্র অনেক ভালো। অসংখ্য তারা যে অন্ধকার দূর করতে পারে না একটি মাত্র চন্দ্রই সেই অন্ধকার দূর করে।’ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ছিলেন তেমনি একজন গুণী পিতার গুণী পুত্র।

 

ছয়

শুধুই অতীতেরই নয়, তাঁর সময়কালের মানুষগুলোর প্রতিও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন আজকের দিনে তার তুলনা মেলা ভার। তাঁর স্মৃতিকথায় (নিবেদন ইতি : উত্তরখ-, ২০০৭) আমাদের আরেক গুণিজন সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে তিনি লিখেছেন  –  ‘সেশনের সময় কখনো কখনো যেতাম সামারসেট হাউসে। পার্লামেন্টের বাঙালি মেম্বররা সাধারণত উঠতেন ওখানটায়। দুচারজন মেম্বর তাঁদেরকে আমি আমি কোনো না কোনো সূত্রে আগের থেকেই খানিকটা চিনতাম। … একবার সরদারভাই এসেছিলেন, আমাদের সরদার ফজলুল করিম। ১৯৫৪-তে প্রাদেশিক নির্বাচনের পর তিনি কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। জেলের ভেতর থেকেই। সামারসেট হাউসে তাঁর ওখানে গিয়েও দেখি সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জমায়েত বটে। তবে এ আরেক কিছিমের। পাগড়ি মাথায়, পরনে লম্বা ঝুলের ঢোলা কামিজ, ঢোলা পাজামা দীর্ঘকায় পেশোয়ারি পাঠান। সবাই সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের অনুগত কর্মী, সাগরেদ। রাজনৈতিক কারণে কারা-নির্যাতিত এক বাঙালি সরদারের সাথে এঁরা মিলতে এসেছেন। অতঃপর দেখবার মতো সে দৃশ্য। এদিকটায় ছ’ফুট/সওয়া ছ’ফুট মাপের ইয়া দশাসই জওয়ান পাঠান-নন্দন ওরা কয়েকজন, বিপরীতে বসে ছোটোখাটো কৃশকায়, মলিন অবয়বের এক বাঙালি সরদার। পোলিটিক্যাল

কথাবার্তা কিছু হল; এবং আগ্রহে শ্রদ্ধায় ওঁরা শুনে গেলেন। কী বিষম অহঙ্কার আমার, – বাঙালিদের মুল্লুকেও তাহলে সরদার জন্মায়। সরদারভাইয়ের মুখে বিনীত হাসি।’ ঠিকঠিকই মানুষ সরদার ফজলুল করিমকে তিনি তাঁর অসামান্য ভাষায় চিত্রায়িত করতে পেরেছিলেন। অনেকেই ভালোবেসে, কেউবা শ্রদ্ধার সঙ্গে সরদার ফজলুল করিমকে ‘বিনয়ের অবতার’ বলতেন। মানুষটি ছিলেনও সেরকম। এর মধ্যে দিয়ে বিনয়ী মুস্তাফা নূরউল ইসলামকেও আমরা যেন অন্যভাবে আবিষ্কার করতে সমর্থ হই।

 

সাত

আইনস্টাইন প্রায়শই বলতেন, ‘অহংভাব থেকে মানুষ কতখানি মুক্ত হয়েছে, সেই অর্থে এবং সেই মানদ-েই মূলত মানুষের সত্যকার মূল্য যাচাই হয়।’ সেই মানদণ্ডেই মুস্তাফা নূরউল ইসলাম একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই পাবেন। পিতা তো তিনিই, যিনি পুত্রকে সঠিক পথে চলবার জন্যে নিরন্তর প্রণোদিত করেন। মরিয়মপুত্র যিশু যেমন বলতেন, ‘যাহারা আমার বেহেস্তী পিতার ইচ্ছা পালন করে, তাহারাই আমার ভাই, বোন আর মা।’ যিশু ছিলেন খোদার নবি। অত দূর যাবার সামর্থ্য আমার নেই। আমি নিতান্তই দোষে-গুণে সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু, খুব স্পষ্ট করেই বলতে চাই : অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম শুধুই আমার শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার ‘পিতৃপুরুষ’স্বরূপ।