মেঘনা পাড়ের মেয়ে আমি

দেখতে দেখতে বয়স তো কম হলো না। অনেকটা পথ হেঁটেছি এই সময়কালে

পৃথিবীর পথে। অনেক কিছু দেখেছি। মিশেছি কত মানুষের সঙ্গে। কত মানুষের কত কথা, কত গল্প। স্মৃতিরা এখন প্রায়ই হানা দেয়, মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কত ছবি, কত মুখ। ফেলে আসা দিনগুলো আমাকে ভাবায়, তাড়া করে। কে যেন বলে ওঠে, অলস সময় না কাটিয়ে লিখে রাখো না, যা দেখেছো, যা ফেলে এসেছো তার যতটুকু পারো।

গত কয়েক বছর থেকেই ভাবি, কাগজ-কলম নিয়ে বসি। আবার মনে হয়, এতো সাধারণ জীবন আমার, আমার অতীত কাহিনি লিখলে কার কী এসে-যায়! আমার দেখা-জানা গল্পগুলো তো আরো অনেক মানুষের মতোই। আলাদা কী এমন লিখবো আমি যা পাঠকের মন কাড়বে কিংবা অন্য রকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে?

আবার এমনও মনে হয়, জীবনের ধন কিছুই ফেলনা নয়, অবহেলার নয়। সব মানুষের গল্পই হয়তো এক, আবার সব মানুষের গল্পই হয়তো আলাদা। এই যে মানুষে মানুষে সংযোগ, এক জীবন থেকে অন্য জীবনে জীবন যোগ, সম্প্রীতির মালা গাঁথা – এসবই তো পৃথিবীকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। মনের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই শেষ পর্যন্ত বসে গেলাম স্মৃতি -হাতড়ে কতটুকু কী উদ্ধার করতে পারি, সেই অভিযানে।

সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু আসলে নাকি আমার জন্ম আরো বছর দুয়েক আগে, ১৯৪৬-এর রায়টের আগে, এক পৌষ সংক্রান্তির দিন। বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ

ডা. বকশী, যিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেনের চিকিৎসক, আমাকে বলেছিলেন, তাঁরও জন্ম নাকি হয়েছিল কোনো এক পৌষ সংক্রান্তির দিন। ডা. বকশীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল আমার স্বামী অজয় রায়ের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের ভক্ত। সেসব অবশ্য অন্য কাহিনি। জন্মদিনের কথা প্রসঙ্গে ডা. বকশীর কথা হঠাৎই মনে হলো, তাই এটুকু বলা।

আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের এক বিশেষ কালপর্বে আমার জন্ম। ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতভাগের কিছু আগে কিংবা পরে আমি পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। তবে দাঙ্গা, ভারতভাগ, মানুষের স্থানান্তর, উদ্বাস্তু জীবন – এসব আমার শৈশবস্মৃতিতে সেভাবে না থাকলেও, পরে এসবের দীর্ঘস্থায়ী অভিঘাতের কথা জেনেছি, বুঝেছি।

বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরায় আমার জন্ম। অর্থাৎ রায়পুরার মাটিতে আমার নাড়ি পোতা। মেঘনা নদীর কাছেই ছিল আমাদের বাড়ি। তাই বলা যায়, আমি আসলে মেঘনা পাড়ের মেয়ে। একটু বড় হয়ে মেঘনায় কত স্নান করেছি, সাঁতার কেটেছি সমবয়সী আরো সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে। আমাদের নিজের বাড়ির এবং আশপাশের বাড়ির ছোটরা দল বেঁধে হইচই করতে করতে মেঘনায় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। মেঘনা তখন কিন্তু বেশ প্রমত্তাই ছিল। স্রোতধারা সবসময় শান্ত থাকতো, তা নয়। অথচ কি আশ্চর্য! আমাদের কোনো ভয়ডর ছিল না। ডুবে মরতে পারি – তেমন আশঙ্কা আমাদের অভিভাবকদের মধ্যেও খুব ছিল বলে মনে হয় না।

ভয়-শঙ্কা থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের নদীতে গিয়ে দাপাদাপি করতে বাধা দিতেন। তবে দীর্ঘ সময় নদীর জলে ভেসে-ডুবে চোখ লাল করে বাড়িতে ফিরলে মা কিংবা অন্য কারো বকুনি যে খেতে হয়নি, সেটা বলা যাবে না। শিশুকালটা আমাদের খুব বাধানিষেধের মধ্যে কাটেনি। বাড়ির বড়দের মনের উদারতার কারণে ছোটদের জীবন বিকাশের পথে তেমন অন্তরায় সৃষ্টি হয়নি।

রায়পুরা ছিল তখন আসলে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আমার বাবার নাম বিনোদ বিহারী পাল। তিনি ছিলেন এলএমএফ ডাক্তার। সবাই তাঁকে বিনু ডাক্তার বলেই জানতেন। অর্থাৎ বিনোদ বিহারীর চেয়ে বিনু ডাক্তার নামেই তিনি এলাকাবাসীর কাছে বেশি পরিচিত ছিলেন। বাবার হাতযশ ছিল ভালো। তাঁর চিকিৎসায় মানুষ রোগমুক্ত হতো। তাই তাঁর আয়-রোজগার মন্দ ছিল না। পৈতৃক সম্পত্তিও ছিল ভালোই। তারপরও বাবার আয়েই মূলত সংসার চলতো। আমাদের পরিবারে অভাব-অনটন ছিল না। বরং সচ্ছলতাই ছিল। বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই, তিন বোন। বাবা ছিলেন সবার বড়। কাকা-পিসিরা বাবাকে মান্য করতেন। বাবাই ছিলেন আসলে সবার মাথার ছাতা। বাবা তার ভাইবোনদের প্রতি ছিলেন স্নেহপরায়ণ। সবাইকে এক চোখে দেখতেন। আমার মাকে যেমন কাপড় কিনে দিতেন, কাকিমাদেরও সেই রকম কাপড়ই কিনে দিতেন। কারো প্রতি কোনো বৈষম্য ছিল না। আমার শৈশব ছিল অন্য রকম আনন্দের। আমরা নানা ধরনের খেলাধুলা করতাম। দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট ছিল তার মধ্যে অন্যতম। পুতুল খেলা, পুতুলের বিয়ে দেওয়া ছিল আমাদের কাছে এক বিশেষ আমোদের বিষয়। পুতুলের বিয়ে নিয়ে কত মজার কাণ্ডই না করতাম আমরা। এ নিয়ে মনোমালিন্য হতো, বিয়ে ভেঙেও যেতো। এসব বিবাদ-বিরোধ ছিল সাময়িক, এর কোনো স্থায়ী প্রভাব আমাদের বন্ধুদের মধ্যে পড়তো না। আমরা মিলেমিশে এক পরিবারের সদস্যের মতোই থাকতাম।

আগেই বলেছি, আমাদের পরিবারটি ছিল প্রসিদ্ধ, সম্পন্ন এবং বড়। সেই সময় আমাদের বাড়িতেই একটি দেয়ালঘড়ি ছিল। ছিল ব্যাটারিচালিত একটি রেডিও। আশেপাশের অনেক বাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে রেডিও শুনতে আসতেন বড়-ছোট, নারী-পুরুষ অনেকেই। ফলে আমাদের বাড়িটি প্রায় সারাক্ষণই জমজমাট থাকতো। বাইরের এতো মানুষের আনাগোনার কারণে আমাদের বাড়ির কাউকে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। আমাদের বাড়িতে থেকে দূর-দূরান্তের বেশকিছু ছেলে লেখাপড়া করতো।

বাড়িতে তিনবেলা রান্না হতো। বাড়ির মূল কর্ত্রী ছিলেন আমার ঠাকুরমা, সবাই যাকে বিনুর মা বলতো। ঠাকুরমার তত্ত্বাবধানে বাড়ির সব কাজকর্ম হতো। আমার মাসহ কাকিমা এবং পিসিদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেওয়া হতো। রান্নার দায়িত্ব একেক সপ্তাহে একেক জনের ওপর থাকতো। ফলে কারো ওপর বাড়তি চাপ পড়তো না। তরকারি কাটা, মাছ কাটাসহ যাবতীয় সাংসারিক কাজ বণ্টন করে দেওয়া হতো সব বউ ও মেয়েদের ওপর।

খাবার পরিবেশন করা হতো সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে। প্রথমে খেতে বসতো পুরুষ সদস্যরা। মেয়েরা খেতো পরে। কখনো কখনো হঠাৎ অতিথির আগমন ঘটলে মা-কাকিমাদের খাবারে টান পড়তো। কিন্তু এটাকে তাঁরা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে করতেন। মেয়েদের সবসময়, সব বেলায় পেটপুরে না খেলেও যেন চলে – এটাই মনে করা হতো। তখন তো আর ফ্রিজ ছিল না। তাই কোনো রাতে ভাত বেশি হলে তাতে জল দিয়ে রাখা হতো। পরদিন কেউ কেউ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান্তাভাত খেয়ে ঢেকুর তুলতো।

বাড়িতে অনেক গরু ছিল। তাই দুধও হতো পর্যাপ্ত। কখনো খাবার কম হলে মেয়েরা এক গ্লাস দুধ খাওয়া থেকে বঞ্চিত হতো না। বাড়িতেই প্রচুর সবজি হতো। মেয়েরাই এসব সবজি লাগাতো, পরিচর্যা করতো। লাউ, শিম, মিষ্টি কুমড়া কিনে খেতে হতো না। জেলেরা নানা ধরনের মাছ দিয়ে যেতো।

বাড়িতে একটি কুয়া ছিল। কুয়ার জল পান করতাম আমরা। আমার ছোটবেলায় বাড়িতে টিউবওয়েল দেখিনি। কুয়ার জল খুব স্বচ্ছ এবং ঠান্ডা ছিল। মাটির কলসিতে জল ভরে রাখা হতো। গরমের সময়ও সে-জল পান করলে প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। বাড়ির ঘরদোর, উঠান সব খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা হতো।

ছোট সময়ে দেখেছি, আমাদের এলাকায় পাড়া ভাগ করা ছিল, যেমন হিন্দুপাড়া, মুসলিমপাড়া। আবার পেশা হিসেবেও কিছু পাড়া ছিল, যেমন ধোপাপাড়া, নাপিতপাড়া, জেলেপাড়া। তবে ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন বিরোধ ছিল বলে মনে হয়নি। বরং পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে সহমর্মিতা ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই আমরা বেড়ে উঠেছি। কিন্তু তখন তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক বিভেদ লক্ষ করিনি। সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই অতিথিপরায়ণতা ছিল। মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের বন্ধুত্ব ছিল। এ-বাড়ি ও-বাড়ি আসা-যাওয়াও ছিল। দুই ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বন্ধুত্ব পাতানো হতো। কাপড়-চোপড়, আম-কাঁঠাল, দুধ বিনিময় করে বন্ধুত্ব পাতানো ছিল একটি সাধারণ ঘটনা।

আমাদের বাড়ির কাছাকাছি বড় জায়গা নিয়ে ছিল একটি আখড়া। বৈরাগী-বোষ্টমীদের বাস ছিল সেখানে। প্রায়ই সেখানে কীর্তনসহ নানা ভক্তিমূলক গানের অনুষ্ঠান হতো। বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম হতো সেখানে। কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নন, অনেক মুসলমানও সেসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। আখড়ায় ছিল সুন্দর ফুলের বাগান। শিউলি, জবা, দোলনচাঁপা, কলাবতী – কত রকমের ফুল। আমরা খুব ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই দল বেঁধে আখড়ায় গিয়ে ফুল তুলতাম। মনমোহন গোসাই নামে একজন ছিলেন আখড়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ফুল তুলতে গেলে তিনি মাঝেমাঝে আমাদের দৌড়ানি দিতেন, আবার আদরও করতেন। ওই আখড়া আমার মনে ভীষণ দাগ কেটে আছে। মনমোহন গোসাইকেও মনে মনে কত খুঁজি। এখন আর সেই আখড়া নেই। নেই বৈরাগী-বোষ্টমীরাও।

অথচ তাঁদের গলায় শোনা কিছু গান এখনো আমার কানে বাজে। দোল পূর্ণিমার সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে সিধা তুলতেন তাঁরা। ‘রাই জাগো গো রাই জাগো’ বলে বৈরাগী-বোষ্টমীদের সুরেলা কণ্ঠে গীত সেই গান মানুষকে আপ্লুত করতো। তাঁরা এভাবে যে চাল-ডাল-তেল-নুন-সবজি সংগ্রহ করতেন তা দিয়ে আখড়ায় সুস্বাদু খিচুড়ি রান্না হতো। সেই খিচুড়ি উপস্থিত সবাইকে খেতে দেওয়া হতো।

আখড়ায় বেঞ্চ পাতা ছিল। অনেক কৃষককে সেখানে বসে বিশ্রাম নিতেও দেখেছি। বাতাসা কিংবা লাল চিনি এবং কুয়ার জল দিয়ে তাদের আখড়াবাসীরা আপ্যায়নও করতেন। কী সুন্দর মায়াময় ছিল পরিবেশটা।

আমি আমার ঠাকুরমার সঙ্গে কতদিন ওই আখড়ায় গান শুনতে গিয়েছি। কখনো কখনো হারিকেন অথবা পাটখড়িতে আগুন জ্বালিয়ে রাতেও আখড়ায় কীর্তন শুনতে গিয়েছি। গানের কথা বা ভাব হয়তো কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু ওই সুর ও ধ্বনি আমার ভালো লাগতো। ঠাকুরমা এবং অন্য বড়দের দেখেছি ভক্তিভরে কীর্তন শুনে চোখের জল ফেলতেও। বেশি রাত হলে আমি ঠাকুরমার কোলে ঘুমিয়েও পড়তাম কখনো কখনো। তিনি গান শুনতেন মগ্ন হয়ে আর আমাকে তাঁর কাপড়ের আঁচল দিয়ে বাতাস করতেন। কামিনী ফুল, শিউলি ফুলের গন্ধে পুরো এলাকা ম-ম করতো। গাছের ফাঁকে ফাঁকে জোছনা ছড়িয়ে পড়তো। কী যে ভালো লাগতো ওই মায়াবী জোছনা রাত!

আমার ঠাকুরমার ছিল পাড়া বেড়ানোর অভ্যাস। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেমন সবার খোঁজখবর নিতেন, তেমনি এ-বাড়ির খবর ও-বাড়িতে চালানও করতেন। তিনি খুবই পরোপকারী ও দরদি মানুষ ছিলেন। কারো মন খারাপ দেখলে কারণ জানতে চাইতেন। অভাব-অনটন থাকলে নিজের বাড়ি থেকে চাল-ডাল পৌঁছে দিতেন। কারো বাড়ি গিয়ে হয়তো মাছ কিংবা তরিতরকারি কেটে সহযোগিতা করতেন।

শৈশবের শীতের সময়টাও ছিল মজার এবং আনন্দের। তীব্র শীতের সময় সকাল-সন্ধ্যায় আগুন পোহানো ছিল শরীর উষ্ণ করার একটি বড় উপায়। নানা ধরনের শীতবস্ত্র না থাকলেও আমাদের সবারই একটি করে চাদর ছিল। মা-কাকিমারা সেই চাদর গায়ে এমনভাবে জড়িয়ে গলার পেছনে একটি গিঁট দিয়ে দিতেন যাতে আমাদের ছোটখাটো একটি প্যাকেটের মতো লাগতো। আগুন পোহানোর সময় ওই আগুনে মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খাওয়ার কথাও মনে পড়ছে।

মা-কাকিমা-পিসিমাদের একধরনের আড্ডা হতো। অবসর সময়ে তাঁরা উঠোনে বা বারান্দায় বসে একে অপরের চুল বাঁধতেন, উকুন বাছতেন। সঙ্গে পরনিন্দা-পরচর্চাও কিছু হতো। পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ এলে গালগল্প বেশি জমে উঠতো।

দুই

পেছন ফিরে তাকালে ফেলা-আসা ছোটবেলার কত ছবি যে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, আর ভাবি, যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম সেই বালিকাবেলায়, সেই ছায়াঘেরা, মায়াঘেরা রায়পুরার বাড়িটিতে, সেই মেঘনা পাড়ে! জানি, কোনো কিছুই আর আগের মতো নেই, আমাদের বাড়িটিও নেই। মেঘনাও নেই যৌবনবতী। এখন তার বার্ধক্যকাল। জীর্ণশীর্ণ দশা।

কী করে ভূলি বর্ষায় মেঘনার বুকে সেই নৌকাবাইচের কথা। আমরা নৌকাবাইচ দেখার জন্য নদীতীরে ভিড় করতাম। হাজার হাজার মানুষ সমবেত হতো। রীতিমতো উৎসবের পরিবেশ। কত ধরনের নৌকা নিয়ে বাইচে অংশ নিতেন মানুষজন। তাঁরা বিশেষ ধরনের বর্ণালি পোশাক পরতেন। মাথায় রঙিন গামছা বেঁধে নাচে-গানে মেতে উঠতেন। কোন নৌকা কোন নৌকাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে তার জন্য চলতো কত ধরনের কসরত। নৌকাবোঝাই মানুষ, সবার হাতে যে বৈঠা থাকতো তা নয়। কেউ কেউ নানা অঙ্গভঙ্গি করে, নেচে-গেয়ে উৎসাহ দিতেন মূল প্রতিযোগীদের। তীরে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে নিজ নিজ গ্রামের প্রতিযোগী নৌকা এগিয়ে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হতো। বৈঠা হাতে যাঁরা নৌকা বাইতেন তাঁরা যেন ছন্দে ছন্দে কাজটি করতেন। এই কাজে তাঁরা ছিলেন অভিজ্ঞ, পারদর্শী। জলের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে কী যে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করা হতো, তা ভাষায় বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই।

পশ্চিমাকাশে সূর্য যখন লাল বৃত্ত এঁকে দিনের অবসান-সংকেত দিতো, তখন নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতারও সমাপ্তি ঘটতো। বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো ‘মেডেল’। মেডেলপ্রাপ্তদের উল্লাস-উচ্ছ্বাসও ছিল দেখার মতো।

ছোট-বড় সবাই মিলে আমরা উপভোগ করতাম পুরো বিষয়টি।

বর্ষায় পলো (মাছ ধরার জন্য বাঁশের তৈরি খাঁচার মতো একধরনের বিশেষ উপকরণ) দিয়ে মাছ ধরার আনন্দের কথাই বা ভুলি কেমনে! না, আমি নিজে পলো দিয়ে মাছ ধরিনি। কিন্তু কাকাদের সঙ্গী হিসেবে গিয়েছি। পলো দিয়ে জলের মধ্যে চাপ দেওয়া হতো। তারপর পলোর গোলাকার মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে আটকেপড়া মাছ ধরে খালইতে রাখা হতো। খালইতে তাজা মাছের লাফালাফি দেখে আমার খুব আনন্দ হতো। নিজেরা মাছ ধরতো তাই শুধু না, জেলেরাও নদীর রকমারি মাছ নিয়ে বাড়িতে আসতো। টাটকা মাছের সেই স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।

রায়পুরায় সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো। শুক্রবার এবং সোমবার। হাটবারও ছিল আমার মতো ছোটদের কাছে একটি বড় আগ্রহের বিষয়। নৌকায় করে কৃষক কিংবা বেপারিরা বিভিন্ন মৌসুমি ফলমূল হাটে বিক্রির জন্য আনতেন। আমরা নৌকার পেছন পেছন ছুটতাম। কেউ বা নদী সাঁতরে পণ্যবাহী নৌকার কাছে চলে যেতাম। আমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ দু-একটি বাঙ্গি, তরমুজ, কাঁঠাল, কলা কিংবা যে-সময়ের যে-ফল ছুড়ে দিতেন। আমরা সেগুলো বাড়ি পর্যন্ত না এনে পথের পাশে বসেই পরম তৃপ্তির সঙ্গে গলাধঃকরণ করতাম। দূর-দূরান্ত থেকে মহাজন-ব্যবসায়ীরা নৌকাবোঝাই করে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে হাটবারে উপস্থিত হতেন। নদীতে জল যখন কমতে থাকতো তখন গুণ টেনে নৌকা এগিয়ে নেওয়ার দৃশ্য আমার চোখে এখনো ভাসে। মোটা লম্বা দড়ির এক প্রান্ত নৌকার গলুইয়ের সঙ্গে বেঁধে আরেক প্রান্ত নিজের কাঁধের ওপর রেখে তীরঘেঁষে হেঁটে যাওয়া মানুষটির কষ্ট তখন সেভাবে বুঝিনি। এখন বুঝি, বেঁচে থাকার জন্য, জীবিকার জন্য কত রকম কাজই না মানুষকে করতে হয়, হয়েছে এবং হবে। সভ্যতার ক্রমবিকাশ তো আসলে মানুষের শ্রমেরই ফসল।

পৌষ সংক্রান্তিতে গ্রামে পিঠা-পায়েশের ধুম পড়তো। রাত জেগে বাড়ির মেয়েরা ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করতেন পিঠা তৈরির জন্য। পুলি, চিতই, পাটিশাপটা – কত রকমের পিঠা যে তৈরি করা হতো! আমরা সাতসকালে, সূর্য ওঠার আগেই স্নান সেরে এসে আগুন পোহাতে বসতাম। খড় বা গাছের ডালপালা জড়ো করে আগুনের কুণ্ডলী তৈরি হতো, আমরা চারপাশে গোলাকার হয়ে বসে শরীরে উত্তাপ নিতাম। ওদিকে মা-কাকিমা-পিসিমারা ব্যস্ত থাকতেন পিঠা তৈরিতে। প্রথমে সূর্যদেবের উদ্দেশে পিঠা নিবেদন করে তারপর দেওয়া হতো আমাদের। সেই অপেক্ষার সময়টুকুকেও তখন কত দীর্ঘ মনে হতো। পৌষ সংক্রান্তিতে তখন খুব ধুমধাম হতো। সকালে নিজের বাড়ির পিঠেপুলি খেয়ে বিকেলে আমরা বের হতাম পাড়া-পড়শিদের বাড়িতে পিঠা খেতে। কার বাড়ির কোন পিঠা বেশি স্বাদু হয়েছে, তা নিয়েও চলতো আমাদের মুখরোচক আলোচনা।

ছোটবেলায় এর-ওর বাড়ি থেকে এটা-ওটা চুরি করা আমার মতো ছোটদের একটা অভ্যাস ছিল। শিম, বেগুন বা অন্য কোনো সবজি চুরি করে আমরা আসলে বনভোজনের আয়োজন করতাম। নিজেরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে বাড়ি থেকে আনা মাটির হাঁড়ি-পাতিলে রান্না করতাম।

মাছ-মাংস নয়, সবজি কিংবা ডাল দিয়েই কত তৃপ্তিসহকারে খাওয়া হতো।

পূজা-পার্বণ গ্রামের বাড়িতে লেগেই থাকতো। তবে আমার মনে হয়, লক্ষ্মীপূজাই বাড়ি বাড়ি হতো প্রকৃত উৎসবের আমেজে। খই, মুড়ি, নাড়ু তৈরি হতো ঘরে ঘরে। লক্ষ্মীপূজার রাতে আকাশ থাকতো পরিচ্ছন্ন। পূর্ণিমার চাঁদ অকাতরে বাড়ির আঙিনাজুড়ে ঢেলে দিতো জোছনা। কী যে মনোলোভা দৃশ্য তৈরি হতো সে-রাতে।

আরেকটি জিনিস আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে। বাড়ির মা-কাকিমাদের দেখতাম রাতে আমাদের খাইয়ে-শুইয়ে দিয়ে নিজেরা স্নান করতেন এবং একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে, কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বাবা-কাকাদের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করতেন। সারাদিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে রাতে ঘরে ফিরে বউদের সজীব মুখাবয়ব দেখলে তাঁদের একটু ভালো লাগবে ভেবেই হয়তো ওই সাজগোজ বা পরিপাটি থাকার চেষ্টা। তখন সেভাবে বুঝিনি। কিন্তু এখন বিষয়টি ভাবলে আমি অবাক হই। সেকালে ঘরে ঘরে বিনোদনের উপকরণ ছিল না বললেই চলে। কিন্তু নিজেদের মতো করে ভালো থাকার, আনন্দে থাকার আয়োজনে মানুষের ত্রুটি ছিল না।

আমার বাবার এক পিসি ছিলেন। অপূর্ব সুন্দরী। যাকে বলে দুধে-আলতায় চেহারা। তখনকার রীতি অনুযায়ী অল্প বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বাল্যেই বিধবা হয়ে বাবার কাছেই তাঁর ঠাঁই হয়েছিল। আমরা তাঁকে গোসাই বলে ডাকতাম। তিনি নিরামিষভোজী ছিলেন। নিজের রান্না নিজেই করতেন। পুজোআর্চা নিয়েই তাঁর সময় কাটতো। তাঁর হাতে-মাখা-প্রসাদ ছিল অতি সুস্বাদু। ওই প্রসাদ খাওয়ার জন্য আমরা উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। তাঁর তৈরি প্রসাদে পাওয়া যেতো এক বিশেষ গন্ধ, যা মনের মধ্যে ওই ছোটবেলায়ও ভক্তিভাব জাগিয়ে তুলতো। এখন আর কোনো প্রসাদে মন-কেমন-করা তেমন গন্ধ পাই না।

গোসাইর হাতে গাছগাছালি বেশ ভালো হতো। তিনি নিজ হাতে বিভিন্ন সবজির গাছ লাগাতেন, অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সেগুলোর পরিচর্যা করতেন। ভালো ফলন হতো। তিনি তাঁর লাগানো গাছেদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁর সবকিছুই আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করতো।

মাঘ-ফাল্গুন মাসে আমাদের বাড়িতে কয়েক রাত ধরে কীর্তন হতো। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন আসতো। আসতো কীর্তনের দল। বাড়ি তখন গমগম করতো। একধরনের মিলনমেলা বসতো যেন। তখন  চায়ের তেমন প্রচলন ছিল না। সবাইকে তিনবেলা ভাতই খেতে দেওয়া হতো। মটরের ডাল, লাবড়া এবং চাটনি দিয়ে সবাই পেটপুরে খেয়ে আনন্দ-আয়োজনে শামিল হতো।

এখন পেছনের কথা মনে হলে কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই। আর ভাবি, সত্যি, তখন আমরা কী সুন্দর দিন কাটাতাম!

তিন

রায়পুরার বাড়ির কথা, মেঘনা পাড়ের কথা, শৈশবের কথা কিছুতেই এখন মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। আগেই বলেছি, আমাদের বাড়িটি ছিল অনেক বড়। কোনো দেয়াল ছিল না। বৃত্তাকার বাড়িটিতে ছিল অনেকগুলো ঘর। বড় ঘর, মেজো ঘর, ছোট ঘর – এমনসব নামের ঘরগুলোতে বাবা-কাকারা থাকতেন। আমরা ছোটরা ঠাকুরমার সঙ্গে ঘুমাতাম একটি বড় চৌকিতে ঢালা বিছানায়। ঠাকুরমার ঘরে ঘাট ছিল না। শীতের রাতে লেপ নিয়ে টানাটানি করে আমরা দুষ্টুমিতে মেতে উঠতাম। ঠাকুরমা কপট রাগ দেখাতেন। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের জন্য তাঁর হৃদয়ে স্নেহ ছিল ফল্গুধারার মতো বহমান। নানা মজার গল্প বলে তিনি আমাদের ঘুম পাড়াতেন। আমাদের সবার শোবার ঘর ছাড়াও ছিল একটি বৈঠকখানা এবং গেস্টরুম। এছাড়া ঢেঁকিঘর, রান্নাঘর, খাবারঘরও ছিল আলাদা আলাদা। বৈঠকখানায় আড্ডা হতো পাড়া-পড়শিদের। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে থাকার জায়গা হতো গেস্টরুমে। প্রায়ই কোনো-না-কোনো আত্মীয়স্বজন আসতো এবং দু-চার দিন না থেকে কেউ চলে গিয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তখনকার দিনে মানুষ খুবই অতিথিপরায়ণ ছিল। অতিথিদের ‘নারায়ণ’ মনে করে যত্নআত্তি করা হতো।

গোলাকার বাড়ির মাঝখানে ছিল উঠান। উঠানও ছিল ছোটখাটো খেলার মাঠের মতো। সেখানেই আমরা ছোট ছেলেমেয়েরা খেলতাম। দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বুড়ি ছোঁয়া, হাডুডু – ইত্যাদি খেলা ছিল আমাদের অতি পছন্দের। ‘আয় রে আমার গোলাপ ফুল, আয় রে আমার টগর ফুল’ ছড়া কেটে সঙ্গী খেলোয়াড়কে আহ্বান জানানো হতো। খেলার সময় হাসি-আনন্দের সঙ্গে একটু-আধটু ঝগড়া-বিবাদও যে হতো না, তা নয়। তবে সেটা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। বিবাদের চেয়ে মিলনটাই ছিল তখন প্রধান।

সুপুরিগাছের ঝরেপড়া ডাল দিয়েও আমরা গাড়ি বানিয়ে খেলতাম। একজন বাকলের ওপর বসলে আরেকজন পাতার  দিক ধরে টেনে নিয়ে যেতো। ওতেই আমাদের প্রচণ্ড আনন্দ হতো। ধুলোমাটি গায়ে লাগতো, কিন্তু তাতে আমরা আনন্দ করা থেকে বিরত হতাম না। কারণ মেঘনার জলে ডুবে ধুলোময়লা পরিষ্কারের অমন সুযোগ থাকতে আমরা কেন ভয়ে আনন্দ করা থেকে পিছিয়ে থাকবো!

ছোটবেলায় আমরা স্যান্ডেল পরিনি। সন্ধ্যায় কুয়োর পাড়ে গিয়ে হাত-পা ধুয়ে পায়ে খড়ম পরতাম। কাঠের তৈরি ফিতাঅলা খড়ম ছিল ছোটদের এবং মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। আবার পুরুষদের জন্য ছিল বৈলাঅলা খড়ম। খড়মের এক মাথায় একটি ছোট দণ্ডের মতো থাকতো, তাকে বলা হতো বৈলা। দু-পায়ের দু-আঙুলের ফাঁকে বৈলায় ভর করে হাঁটাচলা করতে কারো অসুবিধা হতো না।

সন্ধ্যায় গোল হয়ে হারিকেনের আলোতে আমরা পড়তে বসতাম। পড়া মানে অ আ ক খ, ১ ২ ৩ ৪। প্রহ্লাদ মাস্টার নামে একজন আমাদের পড়াতে আসতেন। হাতে থাকতো একটি বেত। আমরা দুষ্টুমি করলে কিংবা পড়া ঠিকমতো না পারলে তিনি ওই বেত দিয়ে পিঠে শপাং শপাং করে মারতেন। মারের ভয় অবশ্য আমাদের ছোটখাটো দুষ্টুমি থেকে বিরত করতে পারতো না। কেউ হয়তো কাউকে চিমটি কাটতো, আবার কেউ হয়তো পা দিয়ে গুঁতো দিতো বা আস্তে লাথি মারতো। মোটকথা একেবারে চুপচাপ বসে পড়াশোনা করা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। এছাড়া স্যারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য বাথরুম পেয়েছে বলে ঘনঘন রুমের ভেতরে গিয়ে বসে থাকতাম। স্যার হয়তো বিষয়টি বুঝতেন, তাই বেশি কিছু বলতেন না।

শীতকালে ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকতো চারপাশ। আমরা ঘুম থেকে উঠে চাদর মুড়ি দিয়ে গোল হয়ে বসে আগুন পোহাতাম। আগের দিন পাশের ক্ষেত থেকে চুরি করে সংগ্রহ করা মটরশুটি পোড়া দিয়ে মজা করে খেতাম। এছাড়া খড় দিয়ে নাড়া বা খড় দিয়ে বুড়াবুড়ির ঘর বানিয়ে তাতেও আগুন ধরিয়ে দিয়ে মিষ্টি আলু এবং বেগুন পোড়া দিয়ে খেয়েও আমরা বিমল আনন্দ অনুভব করতাম। আজ যখন একা থাকি, বিরলে বসে ভাবি, আহা, কোথায় হারিয়ে গেল বালিকাবেলার সেই সোনালি দিনগুলো!

আমাদের বাড়িতে চল না থাকলেও আশেপাশের বাড়িতে মাঘ মাসজুড়ে কুমারী মেয়েরা একধরনের ব্রত পালন করতো।  ভালো বর পাওয়ার আকাক্সক্ষায় নাকি ওই ব্রত পালন করা হতো। উঠানে বাহারি আলপনা আঁকা হতো। সকালে স্নান সেরে তারপর পুবাকাশে উদীয়মান রক্তিম নবারুণের দিকে করজোড়ে প্রার্থনা করা হতো। কী প্রার্থনা করা হতো তা অবশ্য জানা যেতো না, কারণ সেটা হতো মনে মনে।

গ্রামের মেয়েরা অনেকেই গোবর দিয়ে ঘুঁটে তৈরি করতো জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য। পাটখড়ি বা পাটকাঠিতে গোবর জড়িয়েও জ্বালানি তৈরি করতে দেখেছি অনেককে। এই কাজগুলো সাধারণত পরিবারের বয়স্ক সদস্যরাই করতেন। তাঁদের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ কম করতে হতো। সে-সময়টায় মানুষ মানুষের কষ্ট বুঝতো। পরিবারের নারী সদস্যরা মিলেমিশে কাজ করতো। কোনো বিষয়ে মতের অমিল হলেও তা বড় কলহে রূপ নিতো না।

সব মানুষের মধ্যেই ছিল অন্য রকম আন্তরিকতা। যাঁরা বুট-বাদাম বিক্রি করে সংসার চালাতেন তাঁরাও দেখেছি, কখনো কখনো আমার মতো ছোটদের কাছে পয়সা না থাকলেও পেঁয়াজকলি দিয়ে বিশেষভাবে বুট বা ছোলা মাখিয়ে খেতে দিতেন। ওই ছোলার স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে।

ছোটবেলায় মেঘনা পাড়ের বাড়িতে জোছনা রাত ছিল আমার কাছে অনেক প্রিয়। আকাশে এক ফালি চাঁদ ঝুলে থাকতো। আর আমাদের বাড়ির উঠানজুড়ে নরম আলোর মাখামাখি কী যে ভালো লাগতো ওই বয়সেই! আমি ঠাকুরমার কাছে চাঁদ পেড়ে দেওয়ার বায়না ধরতাম। ঠাকুরমা বলতেন, অতো ওপর থেকে তোকে চাঁদ পেড়ে দেবো কীভাবে? আমিই বুদ্ধি দিতাম, চঙ্গের (মই) ওপর চঙ্গ দিয়ে ওপরে উঠে আমাকে চাঁদ ধরে দাও।

এর অনেক বছর পর রাজনীতিক এবং লেখক অজয় রায়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আত্মীয়দের কেউ কেউ রসিকতা করে তখন বলেছেন, তোর খুব চাঁদ পাওয়ার সাধ ছিল। এবার তাই তুই সত্যি চাঁদের মতো উজ্জ্বল এবং কীর্তিমান এক বর পেয়েছিস।

সে অবশ্য পরের কথা। তখন আর আমি মেঘনা পাড়ের মেয়ে নই। ততোদিনে আমার সখ্য গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। মেঘনা পাড়ে আমার অক্ষরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে; কিন্তু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা স্কুলজীবন শুরু হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। তাই আমার জীবনে নদীর প্রভাব অনেক বেশি। নদী দেখলেই তাই আমার রক্তে অন্য রকম শিহরণ তৈরি

হয়। (চলবে)