গোলদিঘি মাঠের কীর্তি

হুঁশ ফিরে এলে নামিয়া টের পায় তার শাড়ি ধরে কেউ টানছে। চোখ মেলে দেখে ফুলু, তাদের বাড়ির কুকুর। আগে দেখা তার পিঠের দিকের লোম হালকা হলুদ। এখন নিচ থেকে তার পেটের দিকটা চোখে পড়ে। সেখানকার লোম সাদা।

নামিয়ার মুখটা ডানদিকে কাত করা। ফুলুও সেদিকে। তাই দেখা যায় তার মুখে শাড়ির আঁচল। সেটা নিয়ে সে পেছনের দিকে হটার চেষ্টা করে। তাতেই নামিয়ার দেহে টান পড়ে। তবে সে চোখ মেলে তাকালে ফুলু সুবোধ বালকের মতো মুখ থেকে শাড়ির আঁচল ছেড়ে দেয়। ফলে বোঝা যায় নামিয়ার হুঁশ ফিরেয়ে আনার জন্যই ছিল তার এই প্রয়াস। তাতে ফলও হয়। কেননা এই টানাটানির কারণেই তার হুঁশ এতো জলদি ফিরে এসেছে। নইলে হয়তো আরো দেরির পথ নিত।

ফুলুর দিক থেকে চোখ ফিরেয়ে নামিয়া নিজের দিকে তাকায়। দেখে প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় তছনছ হওয়া বাগানের মতো তার দেহের ওপর ছড়ানো শাড়ির বাকি অংশ। আর সে শুয়ে আছে শুকনো পাতায় ছাওয়া তাদের বাড়ির পেছনে, মাঠ থেকে ঢোকার পায়ে চলা পথে। তাই একটু নড়ে উঠতেই নিহত পাতারা স্বর তোলে। মচমচ করে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। শেষে উঠতে গিয়ে টের পায় তার পুরো শরীর ব্যথায় ভরে গেছে। তারা দেহের আনাচে-কানাচে জায়গা করে নিয়েছে।

উঠে বসার পর কোমরের কাছে তার দেহ ভাঁজ খায়। তার ওপরের অংশ খাড়া আর নিচের দিক – দুই পা সামনে মাটিতে ছড়ানো। তখনই দুই অংশের সন্ধিস্থল, কোমরের নিচে তাকিয়ে ‘হায়! আল্লাহ এ কী’ বলে আর্তনাদ করে ওঠে। কেননা তখনই বুঝতে পারে যে, তার সর্বস্ব, জীবনের সেরা সম্পদ, বিশ বছর ধরে আদরে-যতনে, স্নেহ-মমতায় আগলে রাখা, প্রাণপণে রক্ষা করা অমূল্য ধন লুট হয়ে গেছে। তার বেহুঁশের সময় কেউ তারে খাবলে-খুবলে খেয়েদেয়ে চম্পট দিয়েছে। তাই যেখানে লুকানো ছিল তার গৌরবের ধন, সেখানকার শাড়ির অংশটা রক্তরসে মাখামাখি। আর তার নিচে কোনো রকম হাত না দিয়ে, স্পর্শ ছাড়া বুঝতে পারে যে, গুপ্তধনের সিন্দুকের মুখটা খুঁড়ে খুঁড়ে তছনছ করা।

অ্যাঁ! এখন কী হবে? তার দুশ্চিন্তায় সে যেন জীবন থেকে পালানোর, দুনিয়া থেকে আড়ালে চলে যাবার প্রয়াসে দুই হাতে মুখ ঢাকে। তখন দু-চোখ থেকে প্রবাহিত জলের ধারা তার হাত ও মুখ ভিজিয়ে দেয়।

বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেখে তার শাড়ি হাঁটু অবধি নামানো। লুটেরা তার কার্যসিদ্ধির স্বার্থে নিশ্চয়ই তা কোমরের ওপরে গুটিয়ে এনেছিল। তাহলে তা এতো দূরে নামল কীভাবে? সে কি লুটপাট সমাধা করে, সব সম্পদ অপহরণশেষে যাবার সময় শাড়িটা টেনে দিয়েছে? তাই তা হাঁটু অবধি পৌঁছে আছে। নাকি তাড়াহুড়োয়, দ্রুত পালানোর তাড়নায় উন্মুুক্ত রেখেই ছুটে গেছে। আর ফুলু, শাড়ির আঁচল টানায় তার যে-দক্ষতা দেখা গেছে, সেভাবেই কোমর থেকে টেনে নামিয়ে দিয়েছে। তাহলে তার আগে নিশ্চয়ই সবকিছু দেখেছে। নাক গলিয়েছে। এমনকি রক্তরসে হয়তো জিহ্বাও লাগিয়েছে। গুপ্ত জায়গায়ও কি মুখ দিয়েছে? ভাবতেই নামিয়ার পুরো শরীর রি-রি করে ওঠে। লুটেরার প্রতি যত না তার চেয়ে প্রবল ঘৃণায় সে ফুলুর পানে তাকায়। দ্যাখে হাঁ হয়ে তার পানে তাকিয়ে আছে। নামিয়া হাত তুলে ‘যা’ ‘যা’ বলে তারে খেদাতে চায়। কিন্তু সে এতোটুকু নড়ে না, যেমন ছিল তেমন একটু দূরে দাঁড়িয়ে একবার ঘেউ করে ওঠে মাত্র।

এখন লোকজনের সামনে কীভাবে যাই? সর্বস্ব খোয়ানো চেহারা কীভাবে দেখাই? তারপর যদি কিছু হয়, পেটে বীজ ঢুকে আশ্রয় নেয়? যদিও এখন ডেঞ্জার টাইম নয়। মাত্র দুদিন আগে নিয়মিত পিরিয়ড হাত গুটিয়ে নিয়েছে। তারপরও নারীর শরীর, উঠতি দেহ, পুরোদস্তুর উর্বর ক্ষেত্র, সুতরাং তার বিশ্বাসঘাতকতা করতে কতক্ষণ। নামিয়া সামনে তাই কেবল আঁধার দেখে। আলোর এতোটুকু ইশারা খুঁজে পায় না।

এসব ক্ষেত্রে মেয়েরা কী করে? কলেজপড়ুয়া নামিয়ার দিন-দুনিয়ার অনেক খবরই জানা। সেগুলো মনে পড়ে। তাতে দেখা যায়, তাদের বেশিরভাগই আত্মহননের পথে পা দেয়। লজ্জা- অপমান থেকে বাঁচতে নিজেই নিজের জীবন নিয়ে নেয়। এখানে তো সে-সুযোগ একেবারে হাতের নাগালে। এই তো আশপাশে কত গাছ। তার একটার ডালে শাড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়লেই হয়। নামিয়া তখন ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশের গাছপালার পানে তাকায়।

এখন ভরসন্ধ্যা, দিনের আলো পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়েছে। তবে এই পায়ে চলা পথ, বাগানের গাছগাছালির ডালপালায় ঘেরা গুহার মতো, তার ও-মাথায় খোলা মাঠ, বিস্তৃত তার পরিসর, তা থেকে উঁকি দেওয়া গোধূলির আলোর রেখার কারণে এখনো কাছাকাছি সবকিছু দেখা যায়। চোখে ঠাহর করা সম্ভব হয়। কিন্তু তার দু-পাশে ঘন গাছপালার বাগান, তাতে ইতোমধ্যেই সন্ধ্যা গাঢ়তর রূপে বসতি নিয়েছে। আঁধারে সবকিছু ডুবিয়ে দিয়েছে। সুতরাং তাতে ঢুকে কোনো গাছের শক্তপোক্ত ডালে ঝুলে পড়লেই হয়। তা আর কারো কিছু টের পাবার নেই। বিনিময়ে নিজের পাবার আছে – লজ্জা ও অপমান থেকে চিরতরে মুক্তি। নামিয়া তাই যেন বারবার গাছপালার পানে তাকায়। ডাল চুজ করতে নামে – কোনটায় ঝোলা যায় তা ঠিক করার প্রয়াস চালায়।

কিন্তু কেউ যদি কিছু না জানে, তাহলে অপমান করবে কীভাবে? কাউকে কিছু না জানালে তারা লজ্জা দেবে কোন পথ ধরে? সাক্ষী তো কেবল এই ফুলু, তাও পুরোটার নাকি লুটেরার চলে যাবার পরের টুকুর, পরিশিষ্ট অংশের মাত্র, তা নিশ্চিত নয়। তারপর সে তো আবার অবোধ প্রাণী। তার বলা-কওয়ার কী আছে। আর যদি পেটে কিছু বেঁধে যায়, দিন দিন বীজ অঙ্কুর গজায়, তাহলে লোকজনের টের পাবার, জানাজানি হবার ভয় আছে। তবে তখন তারে সমূলে ফেলে দিয়ে নির্ভার হবার ভাগাড় – ক্লিনিক-হাসপাতাল তো আজকাল রাস্তার মোড়ে মোড়ে। কলেজে যাবার পথে, থানা সদরেই তো গোটাচারেক নজরে পড়ে। কিন্তু লুটেরা, সে তো তার বীরত্বের, একেবারে পুরোদস্তুর এক কুমারী দেহের স্বাদ গ্রহণের কীর্তিগাথা বলে বেড়াতে পারে। রাষ্ট্র করে দিতে পারে তার আগাগোড়া কাহিনি। নামিয়া এবারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আটকে যায়। তাই গাছগাছালির ডালপালার গুহার দুপাশের অজানা আঁধারপানে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে।

তবে লুটেরা যেভাবে ঘাপটি মেরে থেকে, আঁধারে কাজ সেরে চোরের মতো দ্রুত পালিয়ে গেছে তাতে তার বীরত্ব ফলানোর কিছু নেই। তা লোকজনের কাছে বলে বেড়ানোর মতো কোনো কীর্তি-কাহিনিও নয়। সুতরাং সে মুখ বুজেই          থাকবে। চেহারাও হয়তো লুকিয়েই রাখবে। নামিয়া তার হিসাব পাকা করে সাহস ফিরে পায়। তখন উঠে দাঁড়াতে যায়। দু-হাত দুদিকে রেখে তাতে ভর দিতেই পাতারা আবার মর্মর করে ওঠে। তাদের মর্মবেদনা জানান দেয়। আর শরীর একটু নাড়াতেই কোমরের নিচে সন্ধিস্থলটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। তার ওপর দিয়ে যে এতোটুকু জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ, কুমারিত্ব হরণের ঝড় বয়ে গেছে তার আফটার শক প্রকাশ করে।

নামিয়া দু-হাতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে দাঁড়ায়। একটু উঁচু হতেই তার পায়ের ওপর গোটানো শাড়ি নিচে নামে। পুরোপুরি দাঁড়ালে তারা একেবারে গোড়ালিতে গিয়ে পৌঁছে। তবে কোমরের নিচের জমাটটা থেকেই যায়। নামিয়া তখন হাত দিয়ে টেনেটুনে, হাতের তেলো দিয়ে ডলে তা ঠিক করে। শাড়ির বাকি অংশের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তারা তখন সবটাই একই রূপ ধারণ করে তার অঙ্গের সঙ্গে ঝুলে থাকে।

ছিটকেপড়া ভ্যানিটি ব্যাগ, মেলা থেকে কেনা ঘূর্ণি, পিঠার সাজ, বাঁশের বাঁশি – এসব কুড়িয়ে নিয়ে নামিয়া ঘরের পথ ধরে। ততক্ষণে ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক সন্ধ্যাপ্রদীপ – দেয়ালে গাঁথা লাইট জ্বালানো সারা। উঠোনের কোনার কাছে ঝোলানো রাতের একচোখা পাহারাদার, ঘরের বাইরের একমাত্র বাল্ব চোখ মেলে দিয়েছে। চারদিকে ছড়ানো তার উজ্জ্বল নজর বাড়ির পেছনের বাগানের ফাঁক-ফোকর গলে ঢুকে পড়েছে। তার কিছু আভাস পায়ে চলা পথেও এসেছে। নামিয়া তা ধরে এগোয়।

তবে খুবই সতর্ক তার পা। যেন সামনেই বাঘ, আদি ও অকৃত্রিম রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সে আর কেউ নয় – গর্ভধারিণী মা। কেননা সে দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছে, তারপর আবার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে, আদর-যত্নে বিশ বছরের তরুণী করে তুলেছে। ফলে মেয়ের প্রতিটি লোমকূপই যেন তার চেনাজানা। তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাই মেয়ের কিছু হলে, সামান্য চোট লাগলে, কেটে-ছিঁড়ে গেলে এক নজরেই তা ধরে ফেলে। আর এ তো মহাবিপর্যয়, নারীজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ধন – কুমারিত্ব খোয়ানো। সুতরাং এখন নজর দেওয়ারও দরকার পড়বে না। বরং কেবল মেয়ের পায়ের আওয়াজ, তার পা ফেলার ধরন-ধারণে, হালচালেই সব বুঝে ফেলবে। আর একবার যদি বুঝে যায়, তার আহ্লাদের মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গেছে, তাহলে আর হুলস্থূল গড়ে তুলতে, হাউমাউ করে উঠতে, এক মুহূর্তও দেরি করবে না। তখন লোক জানাজানিতেও আর বাকি থাকবে না। তাই যে করেই হোক তাকে ফাঁকি দিতে, তার নজর এড়াতে হবে। আর একবার যদি সম্ভব হয়, তার অগোচরে ঘরে ঢোকা যায়, তাহলে অন্তত প্রাথমিক ধাক্কা সামলানো হয়ে যাবে। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে, পয়পরিষ্কার হয়ে বাকিটাও সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। তাই নামিয়ার পা এতো সতর্ক, চোখ-কান এতো সজাগ।

আরো দু-চার কদম এগিয়ে নিজেরে একটা গাছের আড়ালে রেখে সে উঠোনে তাকায়। একশ পাওয়ারের পাহারাদারের আলোতে সব ফকফকা। এক নজরেই সব চোখে পড়ে। কিন্তু কই! কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না কারো। তাহলে বোধহয় বাবা মসজিদে চলে গেছেন। আর কোনো ওয়াক্তে না হলেও মাগরিবে তার গ্রামের শানবাঁধানো মসজিদে যাওয়া চাই। আর স্কুলপড়ুয়া ছোটভাই রাকিব – সে তো মনে হয় এখনো খেলার মাঠ থেকে ফেরেনি। তার মধ্যে দিন দিন যেন সাবালক হয়ে-ওঠার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। তাই খেলাশেষে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে ফিরতে ইদানীং প্রায়ই দেরি হয়। এছাড়া বাড়ির বারো মাসের কামলা আয়নাল ভাইকে হিসাবে না ধরলেও চলে। কেননা সে গরু-বাছুর গোয়ালে তুলে দিয়ে এতোক্ষণে নিশ্চয়ই তার বাড়ির পথ ধরেছে। কিন্তু আসল ভয়, রিয়েল বাঘ, গর্ভধারিণী মা, সে কোথায়? তার তো কোথাও যাবার নেই। বরং তার তো ওত পেতে থাকার, মেয়ের ফিরতে দেরি দেখে বারবার পথপানে চাওয়ার কথা।

নাকি দেরির সময়ও পার হয়ে গেছে, ধরে নিয়েছে মেয়ে ফারিয়াদের বাড়িতেই রয়ে গেছে। আজ আর ফিরবে না। তাই আর পথপানে না চেয়ে নিশ্চিতমনে সংসার করছে। কিন্তু কই! সংসারের কোথাও তো দেখা যাচ্ছে না। সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে

না কোথাও। নামিয়া চোখের নজরে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তার পেয়ারের মাকে পায় না।

ফুলু এতোক্ষণ ওর পিছু পিছু ছিল। ওকে থামতে দেখে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে উঠোনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর রাজা-বাদশাহদের আগমনের আগে নকিবদের ঘোষণা দেওয়ার মতো করে মুখ তুলে বারকয়েক ডাকে। ঘে-উ ঘে-উ স্বর তোলে।

তার ডাকেই যেন রান্নাঘরের পাশের কলঘর থেকে একটা মুখ বের হয়। নামিয়া দেখে – ওহ্! এই তো মা। নিশ্চয়ই এতোক্ষণ কলঘরে অজুতে ব্যস্ত ছিল।

এখন নিজের ঘরে গিয়ে নামাজে বসবে। তখন আর তার এই জগতের কোনো খোঁজখবর থাকবে না। সুতরাং সেটাই পারফেক্ট টাইম, মোক্ষম

সময়। এক দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়া। তারপর ঠিকঠাক হয়ে নেওয়া। নামিয়া তাই মায়ের কেবলামুখী হয়ে জায়নামাজে আত্মসমর্পণ করার অপেক্ষায় থাকে।

দুই

ফারিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নামিয়া জোরে পা চালায়। হাতে একদম সময় নেই। সন্ধ্যা দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসছে। সামনে গোলদিঘির মাঠ। আঁধার জমাট বাঁধার আগেই তা পাড়ি দিতে হবে।

তারপরও মাঠের পাড়ে এসে সে থমকে দাঁড়ায় – অ্যাঁ! ওপারের কিছুই তো দেখা যায় না। কেবল মনে হয় একটা কালো রেখা শুয়ে আছে। তবে জানে, যত এগোবে, ওপারের কাছে যাবে, তত সে চেহারা বদলাবে। কালো থেকে সবুজে রূপ নেবে। শেষে একবারে কাছে গেলে তো গাছগাছালির সারি বই আর কিছুই মনে হবে না। আর সে-সারির ওপাশেই লক্ষ্মীমন্ত হয়ে বসা তাদের বসবাসের ঘরদুয়ার। তার অমোঘ টানে নামিয়া মাঠে নামে। দ্রুত পা ফেলে।

এই গোলদিঘির মাঠ এ-এলাকার এক অনন্য দ্রষ্টব্য। তাকে নিয়ে হাজারো গল্পকথা মানুষের মুখে মুখে জায়গা নেওয়া। বাবা-ফুফুদের কাছে নামিয়ারও তার কিছু কিছু শোনা – একসময়, সেই রাজা-বাদশাহদের আমলে, এটা ছিল একটা সুবিশাল দিঘি। তাদের কোনো এক খেয়ালি ধর্মাবতার অদ্ভুত চেহারার এ-জলাশয় খনন করান। কেননা আর সব দিঘি, বুকভরা জল নিয়ে আকাশপানে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকা বড় ধরনের পুকুর, যেমন হয় স্কয়ার – চারদিক সমান দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কিংবা আয়তাকার – লম্বায় বেশি, চওড়ায় কম, এটা সেরকম নয়। বরং একেবারে গোল। জ্যামিতি বইয়ে আঁকা বৃত্তের মতো। এই বেমিল আকার-আকৃতি, চেহারা-সুরতের জন্য তার নামও গোলদিঘি। তাই মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেদিকে তাকাও, সাবেক আমলের তীর, এখন গ্রামরেখা সমান দূরত্বের মনে হবে।

তবে দিনে দিনে পলি ধারণ করে ভরাট হয়ে আজ তা মাঠের চেহারা নিয়েছে। ক্ষেত-খামারে রূপান্তরিত হয়েছে। তাই এখন সে বছরে দুই বেলা, বোরো ও চৈতালী খন্দে, ফসল ফলায়। চারপাশের গ্রামবাসীর গোলা ভরে তোলে।

আবার সে যখন কেবল গোলাকার দিঘি ছিল, তখন তার বিচিত্র খোরাক, তাজা প্রাণের চাহিদার কথা গ্রামময় ছড়ানো আছে। আর তার জোগান না দিলে ক্ষুধাপেটে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজ্যময় বন্যা ডেকে এনে প্রজাদের চরম দুর্দশায় ফেলার গল্প-কাহিনি, তারপর চোর-ডাকাত-ঠ্যাঙাড়েদের ধরে এনে হাত-পা বেঁধে তাতে ফেলে দিয়ে তার খুৎপিপাসা নিবারণের রূপকথাও নামিয়ার শোনা। সেসব বিদেহী আত্মা আজো নাকি মাঠ দখল করে আছে। তারা তাই অমাবস্যার রাতে টহল দেয়। আর কেউ তার মাঝে, গ্রামরেখা অতিক্রম করে মাঠের ভেতরে বাড়িঘর তুললে বাতাসের রূপ ধরে তা উচ্ছেদ করে। একেবারে সমূলে উপড়ে ফেলে। তাই শত শত বছর ধরে আজো তার দেহাবয়ব, বৃত্তের মতো আকার, অটুট। এতোটুকু ক্ষুণ্নবিহীন। দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধির জোয়ারে বাড়িঘরের অবাধে মাঠঘাট, ক্ষেত-কোলা হজম করে নেওয়ার এই জমানায় এরকম খোলা প্রান্তর, সুবিশাল মাঠ আজকাল আর চোখে পড়ে না। তাই দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন তারে দেখতে আসে। তার পাড়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকায়।

ছোটবেলা থেকে তার বিশালতা চোখের সামনে দুলে বেড়ানোয় নামিয়ার বিস্ময় হাত-পা গুটিয়ে নিয়েছে। দূর হয়ে গেছে। বরং যখন-তখন, শর্টকাট রাস্তার প্রয়োজন হলেই তার বুক মাড়ানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। যেমন আজ দুপুরেও পুবপাড়ে তাদের বাড়ির পেছন থেকে নেমে তার বুক এফোঁড়- ওফোঁড় করে পশ্চিমপাড়ে ফারিয়াদের বাড়ি গেছে। তারপর দুজনে মিলে বাইষের মেলা দেখে, শখের জিনিসপত্র কিনে, জিলাপি-মিষ্টি খেয়ে বান্ধবীকে তার বাড়িতে রেখে আবার নিজে একা একাই তার বুকে পা রেখেছে। দ্রুত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে।

কিন্তু পথ যেন এগোয় না। যেখানে ছিল সেখানেই যেন আছে। তারপর আবার তাড়াতাড়ি পা বাড়াতে গেলে গোড়ালির কাছে শাড়ি বাগড়া দেয়। আটকে গিয়ে হোঁচট খাবার উপক্রম করে। বারো হাতের ঘোরপ্যাঁচে অভ্যস্ত না হলে যা হয় আর কি। কেননা কলেজ-পাড়া-বাড়ি – সবটাই সারে সালোয়ার-কামিজ-ওড়নায়। কেবল পালা-পার্বণ-উৎসব কিংবা কলেজের ফাংশনে শাড়ির ডাক পড়ে। তাও মায়েরগুলো ছুঁতে দেয় না। ঈদ-কোরবানিতে গিফট পাওয়া নিজের যে দু-চারখানা আছে তা-ই ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে পরে। আজ তাই মেলায় যাবার জন্য পরতে গেলে মা বারণ করে – ‘অত দূরে যাবি। শাড়ি পরে ঠিকমতো হাঁটতে পারবি না।’

কিন্তু এমনিতে যে-কোনো মেলার জন্য শাড়িই পারফেক্ট। তারে তার ড্রেস কোডও বলা যায়। তারপর বাইষের মেলা বলে      কথা।   এ   এলাকার   সবচেয়ে   বড় জনসমাগমের আসর। পুরনো বনেদিও। তাই তারে কি শাড়ি ছাড়া আর কিছুতে তুষ্ট করা যায়?

বাবার কাছে শোনা আগে ছিল তা মহিষের মেলা। সে-আমলের জোয়াল ও গাড়ি চালানোর জলজ্যান্ত জ্বালানি, কুচকুচে কালো দেহের সে ভারবাহী পোষা প্রাণী বেচাকেনার বার্ষিক বৃহৎ আয়োজন। কিন্তু মানুষের মুখের আজব মহিমা। নামের খোলনলচে পালটে দিতে ওস্তাদ। তাই ঘাড়ে নিয়ে চলতে চলতে মহিষরে এক সময় করে দিয়েছে বাইষ। মুখে মুখে তো বটেই এমনকি কাগজপত্র, পত্রপত্রিকায়ও এখন এ-নামের দারুণ দাপট। তবে তার চেহারা-সুরত, স্বভাব-চরিত্রও পুরোদস্তুর পালটে গেছে। মহিষের বদলে তাই এখন তা হাজারো রকমের মনোহারি, গৃহস্থালি ও শখের সামগ্রীর উপচেপড়া আসরে রূপ নিয়েছে। আর তার লোভে মধুমক্ষিকার মতো চৌদ্দগ্রামের লোকজন ছুটে আসে। নামিয়াও কোনো বছর মিস দেয় না। যে করেই হোক একবার ঘুরে আসে। ছোটবেলায় বাবা-মামারা সঙ্গে গেছে। ক্লাসমেট ফারিয়াদের বাড়ি থেকে মেলা তুলনামূলকভাবে কাছে হওয়ায় এবার তাকে সঙ্গী হিসেবে চুজ করে। সে আগেই বলে দিয়েছে – ‘শাড়ি পরে আসবি। আমিও পরব।’ এক যাত্রায় দুই বেশ বেমানান। নামিয়া তাই পছন্দের কচিপাতা রঙের লালপাড়ের শাড়িটা পরে তার সঙ্গে জোটবাঁধা কিছু সাজুগুজু, যেমন লিপস্টিক নেওয়া, কাজল টানা ইত্যাদি সেরে ফারিয়াদের বাড়ি পৌঁছলে সে হা হয়ে যায় – ‘ওয়াও! তোরে দারুণ লাগছে। এক্কেবারে হিন্দি ফিল্মের নায়িকা ক্যাটরিনা।’

তবে সে-ই দুপুর থেকে শাড়ি পরে এতো পথ হাঁটা, মেলায় ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করা – কই! আর কখনো তো সে এভাবে পথ আটকায়নি। হোঁচটরে ডেকে এনে হাঁটার গতিরে শ্লথ করেনি। এখন তাহলে তার এতো মতিভ্রম কেন? নামিয়া তাই তাকে বাগে আনার উদ্যোগ নেয়। বাঁ-হাতে কোমরের নিচে ধরে মুঠো পাকায়। ফলে তার মতিভ্রমের মূল কেন্দ্র, গোড়ালি থেকে সে সামান্য উঁচুতে উঠে আসে। এবার স্বচ্ছন্দে সামনে পা ফেলার সুযোগ নামিয়ার হাতের মুঠোয় এসে হাজির হয়।

অনতিবিলম্বে সে তখন সে-সুযোগ কাজে লাগায়। দ্রুত সামনে পা ফেলে। কিন্তু মাঠের মাঝবরাবর পৌঁছে চোখ তুলে চারদিক তাকিয়ে আঁতকে ওঠে – অ্যাঁ! মাঠের কোথাও দেখি আর কেউ নেই।

গোলদিঘির মাঠের ভেতরে সরকারি খাতায় নাম তুলে অহংকারে বুক ফোলানো, উঁচু হয়ে ওঠা কোনো আনুষ্ঠানিক রাস্তা নেই। তবে শুকনো সিজনে, ফসল উঠে যাওয়ার পর খালি মাঠের ওপর, বৃত্তের ভেতরে আঁকিবুকি, মানচিত্রের আঁকাবাঁকা রেখার মতো অসংখ্য ছিলাপথ তৈরি হয়। তা ধরে চারপাশের গ্রামবাসী শর্টকাটে এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে পাড়ি জমায়। রাতবিরেতেও চলাচলা করে। ফলে এতো বড় মাঠের কোথাও না কোথাও সবসময় কেউ না কেউ থাকে। নামিয়া দুপুরে পাড়ি দেওয়ার সময়ও অনেককে দেখেছে।  কিন্তু  এখন  সবাই  গেল কোথায়?  সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাওয়া হয়ে গেল কেন? নামিয়া আবার চোখ তুলে তাকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখে – না, কোথাও কোনো জনপ্রাণী নজরে পড়ে না। এতো বড় মাঠে সন্ধ্যা লাগার মুহূর্তে সে একা – ভাবতেই তার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। লোমকূপগুলা সজাগ হয়ে যায়। সে থমকে দাঁড়ায়।

আজ কি তাহলে অমাবস্যা? ঘোর কালো অন্ধকারের রাত? তাই আগেভাগে, আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই সবাই মাঠ থেকে উঠে গেছে? তার পায়ে চলা ছিলাপথে তাই আর কেউ নেই? কেননা গল্প চালু আছে যে, দিঘিতে প্রাণ হারানো আত্মারা অমাবস্যার রাতে মাঠ জুড়ে আসর বসায়। এমাথা-ওমাথা চষে বেড়ায়। তখন মাঠের ভেতরে, তাদের টেরিটোরিতে কাউকে পেলে আর ছাড়ে না। ঘাড় মটকে তার আত্মারে তাদের সঙ্গী করে নেয়। তাই অমাবস্যার রাতে মনের ভুলেও কেউ মাঠে পা দেয় না। আর তার সতর্কতা হিসেবে সন্ধ্যা লাগার, আঁধার ঘন হয়ে আসার আগেই আজ সবাই মাঠ ছেড়েছে। ভাবতেই নামিয়া ভয়ে থ’ হয়ে যায়। তার শিরদাঁড়ায় একটা ঠান্ডা স্রোতের আনাগোনা টের পায়। তাহলে তো আমারও তাড়াতাড়ি মাঠ ছাড়া দরকার। তা না হলে যে-কোনো সময় ডাকাত-ট্যাঙাড়ের আত্মারা হামলে পড়তে পারে। কিন্তু কীভাবে ছাড়ব? ফিরে যাব? বাড়িতে বলা আছে দেরি হলে ফারিয়ার সঙ্গে থেকে যাবে। রাতে আর ফিরবে না। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখে অনেক দূর চলে এসেছে। এখন ফিরে যেতে যেতে আঁধার আরো ঘন হয়ে উঠবে। অমাবস্যার রাত জাঁকিয়ে বসবে। তার চেয়ে সামনে এগিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে যাওয়াই শ্রেয়। তখন একবার ভাবে, দৌড় দেবে? কিন্তু শাড়িতে আটকে যদি হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাই? নামিয়া তাই মায়ের শেখানো ভয় তাড়ানোর হাতিয়ার আয়াতুল কুরসি আওড়াতে আওড়াতে ঘনঘন সামনে পা ফেলে। তা অনেকটা দৌড়ের রূপই নেয়।

এই তো এসে পড়েছি। বাড়ির পেছনের বাগান দেখা যায়। তার গাছগাছালির মধ্যে সবচেয়ে উঁচু, প্রায় আকাশছোঁয়া কাঠবাদাম গাছটা নামিয়ার স্পষ্ট চোখে পড়ে। তাহলে আর ভয় নেই। তবে তারপরও সে তার পায়ের গতি কমায় না। দৌড়ের রূপেই এগোতে থাকে। কেননা যত দ্রুত মাঠ, অতৃপ্ত আত্মাদের টেরিটোরি ছাড়া যায় ততই মঙ্গল।

কিন্তু আরো কাছে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায় – অ্যাঁ! বাগানে তো আঁধার নেমে গেছে। তাতে সন্ধ্যা অলরেডি বসতি নিয়ে নিয়েছে। অমাবস্যার রাতও যেন নেমে আসতে আর কসুর করেনি।

নামিয়াদের দাদার আমলের পুরনো বাগান। তাতে আম-কাঁঠাল, জাম-জামরুলের মতো ফলফলাদির গাছ ও গোটা পাঁচেক বাঁশঝাড়ের পাশাপাশি আকাশে ডানা মেলা, গা-গতরে জং ধরা ছালবাকলের শিরিশ-মেহগনির নিবিড় সমাবেশ। আর তাদের সঙ্গে জোটবাঁধা নাম-না-জানা লতাপাতার অজস্র ঝোপঝাড় তো আছেই। ফলে সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাতে আঁধারের জুতসই হয়ে বসতে আর কোনো অসুবিধা হয় না।

এখন এই একেবারে ঘোর সন্ধ্যায়, দিনের শেষ, রাতের শুরুর সন্ধিক্ষণে তাতে ঢুকে এ-মাথা থেকে ও-মাথায় পাড়ি দিয়ে ঘরে পৌঁছতে হবে। ভাবতেই নামিয়া শিউরে ওঠে। কেননা দৈত্য-দানো হয়তো নেই। তাদের সে-রূপকথার যুগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু গোলদিঘির দু-চারটা অশুভ আত্মা যে ঘাপটি মেরে নেই তার নিশ্চয়তা কি? তাছাড়া এমন ঘন জায়জঙ্গল, তাতে সাপখোপ, শেয়াল-চিতারা বাসা বেঁধে থাকবে না তা কী করে হয়। আর তারা যদি আমারে তাদের নাগালে পায়, তরুণ-তন্বী যার দেহ, কারো চোখ রাঙানিতে যে ভয়ে কাঁপে, হুঁশ হারিয়ে  ফেলে, তাহলে নিশ্চয়ই ছাড়বে না। এক লহমায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে। নামিয়া তাই আর এগোনোর সাহস পায় না।

তাহলে কি কাউকে ডাকব? আলো নিয়ে আসতে বলব? কিন্তু এতো বড় বাগান, যার এ-মাথা থেকে ও-মাথা দেখা যায় না, তা ভেদ করে তার মেয়েলি ক্ষীণ গলার স্বর কি ওদিকে কারো কানে পৌঁছবে? তারপরও নামিয়া বারকয়েক ‘আয়নাল ভাই’ ‘আয়নাল ভাই’ বলে গলা চড়ায়। কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। আশপাশের বাড়ির দিকে ঘাড় ঘোরায় – যদি হালকা-পাতলা কোনো বাগান পাওয়া যায়। এখনো যাতে আঁধার অতটা জাঁকিয়ে বসেনি এমন কোনো পথ। কিন্তু কই! তাদেরটার মতো আশপাশের সবগুলো বাড়িরই সম্মুখভাগ ওদিকে। গ্রামের মূল রাস্তাপানে। এদিকে গোলদিঘির মাঠের পানে তাদের পেছনভাগ। আর সেখানে যথারীতি ঘন বাগান। ঝোপঝাড়ে ভরা ঘন জঙ্গল যেনবা।

না, আর অপেক্ষা করা যায় না। গোলদিঘির মাঠে অমাবস্যার রাত নেমে আসতে আর বাকি নেই। আত্মারা এক মাস ধরে চাতক পাখির মতো এ-রাতের অপেক্ষায় থাকে। সুতরাং তা নেমে এলে তারা আসর বসাতে আর এতোটুকু দেরি করবে না। আর তখন যদি নাজুকদেহী কোনো মেয়েমানুষ তাদের এলাকায় পায়, তাহলে নিশ্চয়ই আর আস্ত রাখবে না। এক ফুৎকারে ঘাড় মটকে নেবে। নামিয়ার তাই আর দাঁড়িয়ে থাকা হয় না। অনন্যোপায় হয়ে বরং ধীরপায়ে তাদের বাড়ির পেছনের বাগানপানে এগোয়।

আরে এ তো আমাদেরই বাগান। ঘরের লাগোয়া গাছপালার সারি। ছোটবেলা থেকে তাতে কত ঘোরাঘুরি, গাছে চড়ে পা দোলানো, আম-জাম-জামরুল পারা। তার অলিগলিতে কত দৌড়ঝাঁপ দেওয়া। সুতরাং তার বাসিন্দা, দেহী হোক কিংবা বিদেহী, এখন তাদের নাম না নেওয়াই ভালো, তবে তাদের তো আমাকে চেনার, আমার সম্পর্কে জানাশোনা থাকার কথা। আর চেনাজানারে কে না খাতির করে? তার জন্যে পথ ছেড়ে না দেয়? নামিয়া সে-ভরসায় ভর দিয়ে গাছগাছালির ডালপালার নিচে গুহার মতো পায়ে চলা পথে পা দেয়।

তবে বেশি দূর এগোতে পারে না। দু-চার কদম মাত্র। তারপরেই পাশের ঝোপ থেকে যেন একটা ছায়ামূর্তি বের হয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়। তারে আর দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ হয় না। তার আগেই বরং তার চেতনা লোপ পায়। হুঁশ হারিয়ে ফেলে। শুকনো পাতায় ছাওয়া পায়ে চলা পথে তার দেহ লুটিয়ে পড়ে। ভ্যানিটি ব্যাগ ও মেলা থেকে কেনা শখের জিনিসপত্রও হাতছাড়া হয়। তারা ছিটকে গিয়ে এদিক-ওদিক জায়গা নেয়।

তিন

লুটেরাটা কে? কোনো বিদেহী নয়, বরং পুরোদস্তুর দেহী। শাড়িতে মাখানো রক্তরস তার নির্ভেজাল প্রমাণ। বিদেহীদের এসব থাকার কথা নয়। তাছাড়া তাদের তো ইজ্জতে হাত দেওয়ার কোনো কারবার নেই। তাদের যত মামলা-মোকাদ্দমা সব জান নিয়ে। ঘাড় মটকানোর খেলা। তারপর আত্মা ধরে টানাটানি। সুুতরাং তাদের কেউ নয়। বরং দেহী কেউ। নামিয়া শুয়ে শুয়ে তারে খোঁজার চেষ্টা করে।

পত্রপত্রিকার খবরে প্রায়ই দেখা যায় পারিবারিক বিরোধে এমন হয়। কোনো পরিবারের কর্তা মানে বাবার সঙ্গে বিরোধের রেশ ধরে মেয়ের ওপর হামলে পড়ে। তার ইজ্জত লুটে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। কিন্তু জানামতে বাবার সঙ্গে তো তেমন কারো বিরোধ নেই। তিনি তো নিরীহ গোবেচারা টাইপের মানুষ। আগে ছিলেন জেলা সদরের এক ছাপাখানার ম্যানেজার। কিন্তু দাদা-দাদি চলে যাওয়ার পর শহরের সব পাততাড়ি গুটিয়ে গ্রামে চলে আসেন। এখন নিজেদের জায়গা-জমি দেখাশোনা করেন। লোকজন দিয়ে চাষবাস করান। আর বাড়িঘর বাগানের যত্নআত্তি করেন। তাতেই চারজনের পরিবার-পরিকল্পনার আদর্শ সংসার ভরাজলে নৌকার মতো তরতর করে চলে যায়। তার আর কোনো দিক, গ্রামের পলিটিক্স, ঝই-ঝামেলাপানে হাত কিংবা মুখ কিছুই বাড়ানোর দরকার পড়ে না। তাহলে তার সঙ্গে আর কার বিরোধ থাকবে?

তবে গ্রামে সবচেয়ে বড় বিবাদ দেখা দেয় ভাইয়ে ভাইয়ে, জ্ঞাতি-গুষ্টিতে। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া বিষয়-সম্পত্তিই তার উর্বর চারণভূমি। তা ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে বিরোধ মুখ তোলে। তারপর তা যেন অতি দ্রুত হাঁটা শুরু করে। জেলা সদরের আইন-আদালত পাড়ি দিয়ে কখনো কখনো একেবারে রাজধানীর সাদা দালানে গিয়ে হাজির হয়। তার মধ্যে যখন যেমন দরকার হয় – খুনি-খারাবি, বাড়িঘরে আগুন, ইজ্জত-আব্রু লুটপাট – কোনো কিছুই যেন আর বাকি থাকে না।

কিন্তু এখানে তো আমাদের কোনো জ্ঞাতি-গুষ্টি নেই। তিন উপজেলা ওপারে তারা। সেখান থেকে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে এসে দাদা এই গোলদিঘির পাড়ে বসত গাড়েন। আর ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ – তার তো এতোটুকু সুযোগ নেই। কেননা বাবা তার বাপ-মায়ের একমাত্র ছেলে। বড় আহ্লাদি তাই। তবে বড় দুই বোন আছে। দূর দূর গ্রামে তাদের বিয়ে হয়েছে। স্বামী-সংসার নিয়ে তারা সুখেই আছেন। তাদের সঙ্গে বিরোধের কোনো আলামত নামিয়ার কখনো চোখে পড়েনি। তবে একমাত্র ছোট ভাইয়ের প্রতি তাদের স্নেহ-মমতার নমুনা, পালা-পার্বণ-উৎসবে পাঠানো তত্ত্ব, তার অনেক দেখা আছে।

আর গ্রামীণ জীবন থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত দফতর খুলে বসা – প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ, সীমানা নিয়ে নিত্য ঝগড়া, মারামারি, গোলাগুলি মায় খুনোখুনি – তার কোনো কিছুইর আমাদের সঙ্গে মাথা তোলার সুযোগ নেই। কেননা উত্তরে আমজাদ চাচাদের বাড়ি। কিন্তু তারা কেউ আর এখানে থাকেন না। খোদ রাজধানীর অভিজাত হিসেবে গাল ফোলানো এলাকার স্বর্ণালি মাটিতে তারা শিকড় গেড়েছেন। বাড়ি-গাড়ি করে থিতু হয়েছেন। তবে চার দেয়ালে ঘেরা তাদের এখানকার ঘরদুয়ার বাবাই দেখেশুনে রাখেন আর দু-চার বছর পর কখনো এলে সমাদর করেন। আর দক্ষিণে কবিরাজ কাকার বসবাস। রোগী-পত্তর, গাছগাছড়া, ফলমূল ও ছালবাকল নিয়ে সারাক্ষণ বেঘোরে থাকা এক মানুষ। তাই তার সঙ্গে কারো বিরোধের এতোটুকু সূত্রও খুঁজে পাওয়া ভার। প্রতিবেশীদের মধ্যে আর আছে পূর্বে গ্রামের রাস্তা, থানা সদরে ছুট লাগানো ইটবিছানো ট্রাক। পশ্চিমে যথারীতি গোলদিঘির মাঠ – এক আশ্চর্য কুহক, একদিকে ঘাড় মটকায় আরেকদিকে স্নেহছায়ায় লালন-পালন করে চারধারের সব গ্রাম।

সুতরাং কারো সঙ্গে বিরোধের লেজে, রেশের বুকে চড়ে তার ইজ্জতের ওপর হামলা হয়নি। বরং অন্য কোনো পথ ধরেই তা এসেছে। কিন্তু সে-পথটা কী আর পাড়ার ভাবি ও বিবাহিত বান্ধবীদের কাছে শোনা – প্রথমবারের স্বাদ একেবারে আলাদা, পুরোপুরি স্বর্গীয়। তার সঙ্গে জগতের আর কিছুর তুলনা হয় না। সে অপূর্ব স্বাদ থেকে সহিংস উপায়ে বঞ্চিত করা লুটেরার খোঁজে নামিয়া পা দিতেই তার দরজায় করাঘাত – এই নামু, নামু! খেতে আয়।

অ্যাঁ! এতো রাত হয়ে গেছে? খাবারের সময় হয়েছে? মায়ের ডাকে নামিয়ার চমক ভাঙে।

আগে কেরোসিনের হাতের মুঠোয় যখন ছিল গ্রামের রাত, তখন তা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সবাই খেয়েদেয়ে বিছানা নিত। কিন্তু ঘরে ঘরে ইলেকট্রিসিটি নাক গলানোয়, তার ছত্রছায়ায় নাগরিক কেতায় গ্রামের লোকজনেরও এখন রাতের  খাবার খেতে নটা-দশটা বাজে।

নামিয়া সেই সন্ধ্যায় মায়ের মাগরিবের নামাজের ফাঁক গলে ঘরে পা দেয়। ভেতরের বাথরুমে সবকিছু ধুয়েমুছে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে এসে দরজার ছিটকিনি তোলে। তারপর থেকে এক ধ্যানে লুটেরাকে খুঁজে আসছে। আর কোনো দিকে খেয়াল দেয়নি। এখন মায়ের ডাকে বোঝে – রাত অনেক দূর এগিয়ে গেছে, খাবারের সময় হয়ে গেছে।

না গেলে আবার বারবার হানা দেবে। নানা সন্দেহ মায়ের মাথায় ভর করবে। তাই নামিয়া তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়। আর বারান্দায় পা দিতেই উঠোনের ওপার থেকে ফুলু ছুটে এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়।

নামিয়া তার পানে তাকিয়ে অবাক হয় – অ্যাঁ! ওর চোখমুখ জুড়ে এ কিসের ভাষা? এমন ভঙ্গি কেন? আগে তো কখনো এমন চোখে পড়েনি।

ফুলু বছরখানেক আগে কোত্থেকে এসে যেন জোটে। মায়ের দেওয়া ফ্যানভাত, কাঁটা-ঝুটা খেয়ে অচিরেই গা-গতরে মোটাতাজা, শক্তি-সামর্থ্যে বলীয়ান হয়ে ওঠে। রাকিব আদর করে নামটা দেয়। আর কী আশ্চর্য! দুদিনেই সে তা বগলদাবা করে নেয়। এখন তাই ফুলু বলে ডাক দিলেই যেখানেই থাকুক না কেন ছুটে এসে পাশে দাঁড়ায়। হুকুমের প্রত্যাশায় লেজ নাড়ে।

নামিয়া অবশ্য তেমন পাত্তা দেয় না। তারপরও তার কলেজে যাওয়ার সময় হেঁটে গেলে পিছু পিছু ধায়। কিছুদূর গিয়ে আবার নিজেই আপনমনে ফিরে আসে। আর রিকশা বা ভ্যানে গেলে তাতে ওঠা পর্যন্ত আশপাশে ঘুরঘুর করে।

তবে কখনো তো তার চোখমুখ জুড়ে এমন ভাবভঙ্গি দেখেনি। ও কি তাহলে কিছু বলতে চায়? বাগান থেকে উদ্ধার করে আনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে বলে? নাকি তার বিনিময়ে কোনো পুরস্কার? কিংবা অন্য কিছু? নামিয়া তার পানে থির চোখে তাকিয়েও কিছুই বুঝতে পারে না। শেষে মায়ের ফের ডাকে খাবারঘরপানে পা বাড়ায়।

জীবনে প্রথম আঘাত, তারপর আবার এলোপাতাড়ি, হিংস্র। তাই কোমরের নিচে ঊরুসন্ধিতে বেশ উঁচু ধরনের ব্যথা বাসা বেঁধেছিল। বাগান থেকে উঠে আসার সময় তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়েছে। কিন্তু ঘরে এসে এতোক্ষণ টানটান হয়ে শুয়ে

থাকায় ব্যথাটা হাত-পা গুটিয়ে নেয়। শরীর থেকে যেন দূর হয়ে যায়। স্বাভাবিক হয়ে ওঠে পুরো দেহ। তাই নামিয়া মায়ের সামনে স্বভাবসিদ্ধ পদক্ষেপে হাজির হয়। খাওয়া-দাওয়ার সময়টাতেও তা সচেতনভাবে বাজায় রাখে। তাই মা বাড়তি কিছু আর জিজ্ঞেস করে না। কেবল মেলা কেমন জমেছে, ফারিয়ারা তেমন আছে তা দিয়েই খাবার সময়ের আলাপ শেষ করে। নামিয়া তাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে – ওহ! মার কাছে যখন লুকানো গেছে তাহলে দুনিয়ার আর কেউ-ই কিছু টের পাবে না।

রুমে ফিরে এসে আবার তাড়াতাড়ি বিছানা নেয়। কিন্তু ঘুম আসে না। অনেক গল্প-কাহিনিতে নামিয়ার পড়া – ব্যর্থ প্রেমিকরা এমন করে। অপমানের প্রতিশোধ নিতে দেহের ওপর হামলা চালায়। ইজ্জত-আব্রু লুটপাট করে পালায়। তার জীবনেও কি তাহলে সেরকম কিছু হলো? কিন্তু সে কে? ক্লাসের সেরা সুন্দরীদের একজন সে। তাই অনেকেই তাকে দেখে হাঁ হয়ে তাকায়। চিঠিপত্র-চিরকুট ছুড়ে মারে। ফুলটুল সমেত হাত বাড়ায়। তারা হয়তো প্রেম করতে চায়। তবে ব্যর্থ? হ্যাঁ, সে একজনই আছে – নাদিম। 

ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই তার সঙ্গে পরিচয়। এক বছরের সিনিয়র। তার পুরনো নোট আনতে গিয়ে ঘনিষ্ঠতা। তারপর দুজনে মিলে দু-একদিন কলেজের পেছনে ঝোপের আড়ালে আড্ডাও দিয়েছে। শেষে একদিন থানা সদরের এক রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। নামিয়া ঢুকে দেখে ছোট ছোট অনেক কেবিন। তাতে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে। ওরাও একটায় বসে। কিন্তু খাবার আসার আগেই নাদিম ওর হাত ধরে কাছে টানার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় তা ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে বের হয়ে আসে। আর কখনো তার কাছেও ঘেঁষেনি। তবে একদিন কলেজে ঢোকার সময় সামনে হাত বাড়িয়ে ওকে থামায় – ‘সবাইকে বলেছিলাম তোমার সঙ্গে লাভ হয়ে গ্যাছে। এখন সবাই আমারে ক্ষেপায়। টিটকারি মারে।’ কিন্তু ওর বাড়ি থানা সদর থেকে ওদিকে। সেখান থেকে এতোদূর পথ, সাত-আট কিলো তো হবেই, তা পাড়ি দিয়ে একেবারে মোক্ষম সময়ে, সন্ধ্যা লাগার মুহূর্তে, সবকিছু চিনে-জেনে বাগানে ওত পাতা অসম্ভব।

তাহলে কি বাড়ির কাছের, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ? হ্যাঁ, সেরকম দু-চারজন আছে। বাড়ি থেকে বের হলে, কলেজে যাওয়ার পথে তাদের দেখা যায় –  হয় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছে। ওকে দেখলেই এরকম-সেরকম ভঙ্গি করে, শিস বাজায়। সহজেই বোঝা যায় – সবটাই ওকে লক্ষ করে। কিন্তু ও কখনো ফিরেও তাকায় না।

তবে এদের মধ্যে ওপাড়ার সাদেকটা বেশ ডেসপারেট। সবসময় বেপরোয়া ভাব দেখায়। বাপ আহাদ গাজি, সরকারি দলের হোমড়া-চোমড়া, ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা, তাই বোধহয় কখনো কখনো দু-চার কদম এগোয়। পিছু পিছু হাঁটে। এমনকি কিছুদিন আগে, সম্ভবত পহেলা ফাল্গুনের দিন, একটা গোলাপ ছুড়ে মেরেছিল। নামিয়ার গায়ে লেগে তা রাস্তায় পড়ে। সহজেই সে তা মাড়ায়ে এগোয়। 

তার প্রতিশোধ নিতেই কি তাহলে ওকে মধ্যমাঠ থেকে একা একা আসতে দেখে ওত পাতে? কাছে আসতেই, বাগানে পা দিতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে? হ্যাঁ, তা-ই হবে। কেননা তখন ভয়-আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে ছিল, তাই অত খেয়াল করতে পারেনি। বাট এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে – হ্যাঁ, মধ্যমাঠ থেকে আসার সময় যখন একবার চোখ তুলে তাকায়, তখন দেখেছে – দু-চার বাড়ি ওদিকের ওপাড়ার কোনো বাড়ির পেছন থেকে কেউ একজন বের হয়ে ছুটে এসেছিল।

কিন্তু তার কোনো প্রমাণ? এতোটুকু নমুনা? কাল দিনের বেলা বাগানে গিয়ে খুঁজতে হবে। তাড়াহুড়োয় অসাবধানে কোনো কিছু ফেলে গেছে কি না। কিছু একটা পেলে আর কথা নেই। মামাদের সবকিছু, আগাগোড়া বলার দরকার নেই, তাহলে আবার জানাজানি হয়ে যাবে, তার চেয়ে কেবল বলতে হবে একটু শায়েস্তা করে দিতে। দু-গ্রাম ওপারে একই ইউনিয়নে তারা বেশ বনেদি ফ্যামিলি। সাত মহলার তালুক ছিল এককালে। এখনো তার রেশ আছে। সুতরাং সাদেকের বাপ যতই সরকারি দলের নেতা হোক, মিছিলের আগায় আগায় তারে দেখা যাক না কেন, মামারা তা মানবে না। বরং এমন প্যাঁদানি দেবে, জীবনে আর চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না।

পরদিন সকালে নামিয়ার ঘুম ভাঙে বাবার শোরগোলে। রুম থেকে বের হয়ে দেখে – সকালের পাড়া-বেড়ানো শেষ করে তিনি কেবল ফিরেছেন। বাড়িতে ঢুকেই বলেন – ‘শুনছো নামিয়ার মা! কাল অমাবস্যার রাইতে ওপাড়ার আহাদ গাজির বখাটে ছাওয়ালডা গোলদিঘির মাডে নামছিল। তাই আত্মারা তার ঘাড় মটকাইয়া দিছে। কাল রাইত থাইকা ওরে পাওয়া যাচ্ছিল না। সকালে দ্যাহে মাডের মাঝখানে মইরা পইড়া আছে। তয় গা জুইড়া নাকি অনেক আঁচড়ের দাগ। মনে অয় কোনো পশুতে আঁচড়াইয়্যা-খাঁমচাইয়্যা সারাশরীর ছিঁইড়্যা ফালাইছে।’ নামিয়া সঙ্গে সঙ্গে উঠোনের কোণে দাঁড়ানো ফুলুর পানে তাকায়। এবারে যেন তার কাল রাতের চেহারার ভাষা আগাগোড়া বুঝতে সমর্থ হয়। তবে বীরত্বের কাজটা সে কখন করেছে – তার আঁচল ধরে টানাটানির আগেই, কাজ সেরে পলায়নের সময়, নাকি ঘরে পৌঁছে দিয়ে তারপর ওপাড়ায় গিয়া খুঁজে ধাওয়া করে মধ্যমাঠে নিয়ে, তা আর বুঝতে পারে না।