কস্তুরমঞ্জরীর ঘাট

রোদের রং এখন অনেকটা নদীর মতো, মানে গঙ্গামাটি মেশা নদীর জলের যে-রং। এরকম একটা রোদ যখন ওঠে, তখন অনেক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে পারে। হলোও তাই। একটি ছেলে জেটিঘাট থেকে নেমে টোটো স্ট্যান্ডে যেতে যেতে থমকে তাকাল ডানদিকে। একটা ভেঙেপড়া স্তম্ভের গায়ে লেখা ডাফ সাহেবের স্কুল ১৮৪৯। এই শহরে সবই দেখছি খুব পুরনো। 

সালটা দেখলে কেমন বুকে ধাক্কা লাগে। ১৭০ বছর! একশ সত্তর বছর আগে পৃথিবীতে লোক ছিল! ধুত! সবকিছুই এতো পুরনো নাকি? 

সে টোটো স্ট্যান্ডে এসে বলল, ‘বালক সংঘের মাঠ যাব।’

‘এই অডিশন বসা, অডিশন।’

শুনেই খুব ভয় লাগল তার। অনেকে এসেছে তার মানে অডিশন দিতে? তার আগেই এসে গেছে সবাই? এদিকে সে ভাবছিল কে আর আসবে এতোদূরে অডিশন দিতে!  

ছেলেটার হাতে একটা গিটার ছিল, সে বাজাবে বলেই এনেছে কিন্তু তার এখন মনে হলো এই গিটারটা এখানে মানাচ্ছে না। এটা নিয়ে টোটোতে বসতে তার খুব অসুবিধে হচ্ছিল, সহযাত্রীরা তার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিল শুধু না একজন মহিলা ঝংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘লোকের গায়ে খোঁচা না দিলে বাবুদের গান হয় না।’

তাই শুনে আর একজন বলল, ‘গান না  জি ইউ এন – গান’ বলে সে নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে শুরু করল।

ছেলেটা, তার নাম বিক্রম দাস, এখন সে কুমার ভিকি নামে গায়, খুবই আহত হলো এ-কথায়। সে নিজের মনের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করল। যেভাবে খুনি খুন করার আগে, চারপাশের চপল, তরল জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। সে ভাবার চেষ্টা করল কারা কারা আসবে জাজ হয়ে, কুমার কানু, প্রীত গাঙ্গুলি আর সোনালি শাকিরা। এরা কী ধরনের গান পছন্দ করে, কোন গানে উঠে দাঁড়ায়, কোন গানে সানগ্লাস, ঘড়ি খুলে দেয়, সেসব তার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু সেই জানাগুলো সঠিক মনে হচ্ছিল না এখন। সে নিজের মনটা ছেড়ে দিলো। বাইরে তাকিয়ে দেখল একপাল পায়রা, দুধসাদা পায়রা উড়ছে। এসব পায়রা সাধারণ গোলা পায়রা নয়। এরা সাধারণত খুব পুরনো জমিদারবাড়িতে থাকে। এখন কেমন অনাথের মতো লাগছে ওদের। ও একটু শিস দেবার চেষ্টা করল। খুব মিহি সুরে। কারণ পাশের মহিলাটির নতুন শাড়ির খরখর কেমন বুকে হাঁপ ধরায়।

শুধু যে মহিলাটি খরখরে শাড়ি পরেছে তাই নয়, তার মনটাও দেখা গেল খরখরে। সে খরখরে গলায় তার স্বামীকে বলে উঠল, ‘তুমি যদি বাড়ি গিয়ে গাড়ির অটার না দাও, তো আমি অনথ্থ করব। আমি আর পাবলিকের মদ্দে যেতে পারিনে।’

ছেলেটা মানে কুমার ভিকির শিসটা ভেতরে ঢুকে গেল। আর তখুনি ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলল, ‘অডিশন অডিশন, কে নামবেন, আট টাকা খুচরো হাতে নিয়ে নামুন।’

সে যেখানে নামল, সেখানে এখনি ঘটিগরম, ফুচকা, আলুকাবলির জমায়েত। সেই ছোট ছোট খাবার ঘিরে গান আর গান। কারখানার গেটের মতো গেট, সামনে এক উর্দি সব গানকে আটকে দিচ্ছে। কুমার ভিকি ব্যাপারস্যাপার দেখে বেশ দমে গেল। এতো ছেলেমেয়ে অডিশন দিতে এসেছে! 

সে গিয়ে উর্দিকে বলল, ‘দাদা ভেতরে যাব।’

‘আইডি প্রুফ এনেছেন? সব অরজিনাল লাগবে। আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড।’ 

পাখির কি এসব লাগে? ভাবছিল সে। পাখি কত মায়া নিয়ে গান করে, কিন্তু তার কোনো এজেন্ট থাকে কেউ? তাকে কি পেনড্রাইভ নিয়ে ঘুরতে হয় দরজায় দরজায়?

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সিকিউরিটি আবার বলল, ‘আপনি যে এদেশের নাগরিক, তার প্রমাণ লাগবে। ওপারের অনেক লোক এসে গান গেয়ে যাচ্ছে, কী মুশকিল বলুন তো।’

দুই

সে কোনো কথা না বলে উলটোদিকে হাঁটতে শুরু করে। যে যে জায়গার ওপর দিয়ে সে অটোতে এসেছিল, সেই সেই জায়গা এখন সে হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে একটা নদীর কাছে এসে দাঁড়াল। এই ঘাটের নাম ঘণ্টাঘাট। এখানে একটা ওলন্দাজ গির্জা ছিল, তার চূড়ায় একটা ঘণ্টা ছিল, সেই নামেই ঘণ্টাঘাট। ১৭২৫ সালে নৃসিংহ সিংহ এই ঘাটটি তৈরি করিয়েছিলেন। এসব কোথায় পড়ল ভিকি? পড়ল সাদা পাথরে। তার মনে হলো, পেনড্রাইভে কিছু রাখার চেয়ে পাথরে লিখে যাওয়া ভালো। পাথর যদি গান গাইতে পারত? এই ঘাটের প্রতিটি ধাপ কি গেয়ে উঠত না? 

ঘাটে একটা মরা পাখি পড়ে। পাখিটা ঝুঁকে দেখল সে। তখনি দেখল ‘কস্তুরমঞ্জরী এই ঘাটটি নবরূপে নির্মিত করিয়াছেন।’ আহা কস্তুরমঞ্জরী! এই ঘাটে কত নৌকো এসে লেগেছে, ওই বাড়ির অন্দর থেকে নেমেছে কত আলতাপরা পা, পায়ের আঙুলে রুপোর চুটকি মল, আলতার ছাপগুলো ঘাট ধরে রেখেছে, তারপর জল এসে মুছে দিয়েছে আলতার দাগ, কিন্তু ইতিহাস মুছে দিলেও যেমন পথরেখা মোছা যায় না, তেমনি ওই আলতার দাগ থেকে যায় কারো কারো মনে। ঘাটে বসে থাকা কোনো যুবকের মনে থেকে গেছে, ক্বচিৎ কখনো ঘুরে তাকানো চাহনি, আঁখিপল্লবের ফাঁক দিয়ে একটি পূর্ণ দেখা, যে-দেখাটি তার বাকি জীবনটা গড়ে দেয়। কেউ চলে গেল হিমালয়ে, কেউ স্বদেশি দলে ভিড়ে গেল। এর মধ্যে কখনো কি এসে দাঁড়ায়নি কস্তুরমঞ্জরী? 

ছেলেটি মরা পাখিটির পাশে বসে পড়ে। ব্যাকপ্যাক পাশে রেখে খুলে সে কী যেন খোঁজে। একটা খেলনা পিয়ানো সে ট্রেনে আসতে আসতে কিনেছিল পাড়ার একটা বাচ্চার জন্যে। সেই পিয়ানোটা সে রাখে পাখিটির পাশে। পাখিটি উঠে কি বসবে এই পিয়ানোয় সুর তুলতে টুং টাং? দূরে কোথাও কি ঘণ্টা বেজে উঠল?

অনেক পায়রা উড়ে আসে হঠাৎ। মনে হয় ওরা ভয় পেয়েছে। ছেলেটি, যার নাম ভিকি, অপেক্ষা করে ভয়ংকরের। কিছু ঘটে না যদিও। একদল কিশোরী পরস্পরকে ঠেলাঠলি করতে করতে, হাসতে হাসতে নেমে আসে ঘাটে। ভিকি দেখে কয়েকটা সাইকেল দাঁড় করানো ঘাটের ধারে। চুমকি বসানো সালোয়ার-কামিজ, কোনো কোনো কামিজের পেছনে সেফটিপিন দেওয়া। ছেলেটি বোঝে এবার এরা জল ছোড়া শুরু করবে। কারণ এদের বাড়ির মধ্যে নদী দূরের কথা, জল পর্যন্ত নেই। এদের মুখে গঙ্গামাটির রং, তাতে ফুরিয়ে যাওয়া সকালের তীব্র রোদ।

মরা পাখি নয়, একটা জ্যান্ত পায়রা এসে বসে পিয়ানোয়। পিয়ানোর রিডের ফাঁকে ধান খোঁজে, ধান পায় না, কিন্তু খাঁজে খাঁজে প্রচুর রোদ, পায়রা সেই রোদ ঠোঁটে করে চলে যায়। ভিকি শান্ত হয়ে বসে, তার নিশ্চিন্ত লাগে যে, তার এই খেলনা পিয়ানো সেই গানগুলো খুঁজে পাবে, যা সে পায়নি এতোদিন। 

তার বাড়ির পাশে বাপ্টা আর তার বোন বড়বুড়ি না থাকলে তো সে আজ এখানে আসত না। ওদের বাড়ি কেন তাদের বাড়ির পাশে হলো, কেনই বা ওদের বাড়িতে টিভি থাকল, তাদের বাড়ি থাকল না? আর সেই টিভিতে কেনই বা মিউজিক হান্ট হবে তখন, যখন সজলকাকা তাদের বাড়ি আসবে আর মা তাকে বলবে, ওদের বাড়ি টিভি দেখতে যা? ক্যারমের একটা ঘুঁটি যেমন অনেকগুলো ঘুঁটিকে দিগি¦দিকে ঠেলে দেয়, তেমনি অনেকগুলো ঘটনা তাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে। টিভি দেখে ফিরে ও বাড়িতে অদ্ভুত একটা গন্ধ পাবে, মা সেই গন্ধের মধ্যে বসে ভাঙা খোঁপা আবার নতুন করে বাঁধছে। ওকে দেখেই মা একটা এগরোল খেতে দেবে আর সেই ঠান্ডা এগরোল গোগ্রাসে খেতে খেতে ও বলবে, ‘মা, আমি গানের অডিশন দিতে যাব, বাপ্টা বলছে বারবার, বড়বুড়িও বলছে। আজ কুমার কানু একজনকে সানগ্লাস খুলে দিলো মা, একদম নীল সানগ্লাস, সমুদ্রের মতো রং।’

সমুদ্রের মতো রং! মা আনমনা হয়ে বলবে, ‘সজলকাকাকে বলব।’

তিন

বলেছিল মা। এর উত্তরে সজলকাকা যা বলেছিল আন্দাজ করতে পারে কুমার ভিকি।

‘একদিনের অডিশন?’

‘আবার কী?’

‘কেন হোটেলে রেখে মাসের পর মাস ট্রেনিং করায় তো।’

‘আহা সে তো চান্স পেলে?’

‘দীঘা যাবে? সমুদ্র দেখোনি বলেছিলে সেদিন’ – অতর্কিতে বলে সজলকাকা।

‘সমুদ্র! সানগ্লাসের মতো রং যে সমুদ্রের!’

‘সানগ্লাসের মতো রং!’ সজলকাকা এর মানে বুঝবে মায়ের কোনো সানগ্ল­াস নেই।

‘ঠিক আছে তোমার জন্যে একটা সানগ্ল­াস কিনে দেব। ভিকির জন্যেও কিনব। ওকে বলো অডিশন দিয়ে ও যেন কোনো বন্ধুর বাড়ি দুদিন থেকে আসে। আমরা এই সুযোগে দীঘা ঘুরে আসি।’

‘ওকে কী বলব? তাছাড়া বাড়ি ফাঁকা রেখে যাওয়াটা ঠিক না। তার ওপর লাকি আছে, টুকু আছে।’

লাকি ওদের পোষা কুকুর আর টুকু হচ্ছে টিয়াপাখি।

‘ওদের বাইরে থেকে বন্ধ করে রেখে চলো। ভালোই তো। ওদের ডাক শুনে লোকে ভাববে বাড়িতে লোক আছে।’

আঁতকে উঠবে মা। ‘তা কি হয়? ধরো বন্ধ ঘরে গ্যাস বার্স্ট করল? কিংবা লাকি খিদের জ্বালায় খাঁচা ভেঙে টুকুকে খেয়ে ফেলল।’

‘ধুর রেন্ডি মাগি, তুই এই পচা ডোবায় পচে মর, তোর আর সমুদ্র দেখে কাজ নেই। না খেয়ে মরছিলি, কারো দুখ্খ দেখতে পারি না, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হবে কেন? কুকুরের সঙ্গে শোগে যা।’

বাবাও তো এমন বলত, তফাৎ এই বাবা দিনরাত বলত, সজলকাকা পার্টির কাজ করে দু-সপ্তায় একদিন আসে কি না আসে। হয়তো তার এমন দুখ্খ দূর করার অনেক ফ্যামিলি আছে। তবে কিছু দরকার পড়লে পার্টির ছেলেদের হাতে পাঠিয়ে দেয় ঠিক। কিন্তু ভিকি ভাবে মায়ের কথা। একেকটা মেয়ে এমন মার খাবার, গাল খাবার ভাগ্য করে আসে। কোথাও তাদের কপালে সুখ লেখা নেই। 

মা আসার সময় তার পকেটে একগোছা টাকা দিয়ে বলেছে, ‘ফেরার পথে পঙ্কজের বাড়ি দুদিন থেকে আসিস। অনেকদিন আসে না ছেলেটা। আর নদীতে নামবি না কিন্তু, তুই সাঁতার জানিস না মনে রাখিস।’

‘তুমিও সমুদ্রে নেমো না মা। সমুদ্র আরো গভীর। কোথায় টেনে নেবে কেউ জানে না।’

মা ঝরঝর করে কেঁদে ওকে বুকে টেনে নিয়েছিল। ও শুনতে পাচ্ছিল মা বলছে, ‘বড্ড জ্বালা রে বাবু এই বুকে। তুই আমায় ঘেন্না করিস জানি আমি।’

‘না মা, তোমাকে আমি এখন আরো বেশি ভালোবাসি। আমাকে একটু দাঁড়াতে দাও, এই পাড়া ছেড়ে চলে যাব আমরা। সেখানে তুমি সারাদিন শুধু গান শুনবে। কারো সঙ্গে সমুদ্রে যেতে হবে না।’

সেই কথাগুলো শুকনো ফুলের মতো নদীতে ভেসে যেতে দেখছিল এখন। সে তো অডিশনের গেটই পেরোতে পারল না। বাপ্টাদারা কেউ তো বলেনি এখানে আইডি প্রুফ লাগবে। এই সেকেন্ডহ্যান্ড গিটারটা সজলকাকা জোগাড় করে দিয়েছে। সে ভেবেছিল এটাই তার প্রমাণ যে সে গান করে। 

মাকে নিয়ে কোনো ভালো জায়গায় যেতেই পারবে না সে। ধুত্, কিছু মেয়ের ভাগ্যই এরকম। সুখ যেন তাদের কপালে নেই। এই কস্তুরমঞ্জরীর ভাগ্য কেমন ছিল কে জানে! বাড়ি যত বড় হয়, তার পাঁচিলও তত উঁচু হয়, সেই পাঁচিল পেরিয়ে রোদ-হাওয়া কিছুই ভেতরে ঢোকে না। এসব যখন ভাবছে, তখন একটা ফিসফিস শব্দ পেল। কারা যেন কথা বলছে। 

‘ঠিক রাত দেড়টা, মনে রেখো।’

‘ওইসময় পাহারা বদল হয়, তাই না?’

‘ওদের আমি গহনা দিয়েছি। ওরা কিছু বলবে না।’

‘এই ঘাটেই থাকবে নৌকা। তুমি দেরি করো না।’

‘আমি চলে আসব ঠিক।’

‘নূপুর পরো না কিন্তু, শব্দ হবে।’

‘সব গহনা খুলে একটা পুঁটলিতে বেঁধে আনব। তোমাকে দেব। পশ্চিমে চলে যাব আমরা। তুমি একটা দোকান দেবে, আমাদের দিব্যি চলে যাবে।’

ভিকির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো শুনে। এই গয়না দিয়ে দেবার ব্যাপারটা তার একটুও ভালো লাগল না। যেমন ভালো লাগেনি লাকি আর টুকুকে ঘর বন্ধ করে সমুদ্রে যাওয়াটা।

সে এতোক্ষণ ভাবছিল একটু পরেই চলে যাবে, বিকেলের ট্রেন ধরে সন্ধের মধ্যে পৌঁছে যাবে বাড়ি। তার কাছে একটা চাবি আছে, খুলে ঢুকতে পারবে। আর কিছু না হোক, লাকি-টুকুকে দেখতে পারবে। কিন্তু এই চাপা স্বরের কথাগুলো শুনে মনে হলো খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে, এখানে থাকা দরকার। যদি কিছু হয় সে বাঁচাবে মেয়েটাকে।

কিছুক্ষণ নদীর হাওয়া খাওয়ার পর তার খিদে পেল। আসার সময় ট্রেনে বাদামছাপা কিনেছিল আর দিলখুশ। সে তো কখন খাওয়া হয়ে গেছে। সে দেখেই এসেছে খাবার দোকান সব জেটিঘাটের দিকে, কিন্তু এখন এখান থেকে সে উঠতে পারবে না। রাত পর্যন্ত তাকে এখানে অপেক্ষা করতে হবে।

সে জল বের করার জন্যে ব্যাকপ্যাক খুলল। দেখল চকচকে একটা স্টিলের ডাব্বা। ডাব্বাটা চেনে সে। বাবার অনেকগুলো পুরনো প্যান্টের বদলে দরজায় রেখেছিল মা বাসনওয়ালির কাছ থেকে। সেই ডাব্বার দুটো ভাগ। এক ভাগে প্রচুর চাউমিন, অন্য ভাগে ছটা পাটিসাপটা। আজ রাতের পক্ষে যথেষ্ট তার। সে আন্দাজ করল এগুলোই মা রাস্তায় খাবার জন্যে নিয়ে গেছে। সজলকাকা চাউমিন ভালোবাসে না, মানে বাড়ির চাউমিন। বলে, ‘ওগুলো তো চাউ চচ্চড়ি হয়। তোমাকে একদিন খাঁটি চিনে দোকানের চাউমিন খাওয়াব। ভিকির জন্যে প্যাক করে নিয়ে আসব।’ কিন্তু ছোট থেকে এই বাড়ির চাউমিনেরই ভক্ত ভিকি। সেদ্ধ করে দিলেও খেয়ে নেবে। তাই ভিকির জন্যে চাউমিন বানিয়েছে আর সজলকাকার জন্যে পাটিসাপটা। খিদের মুখে সে পাটিসাপটাও ভালো লাগল তার। খাবার পর তার মনটা অনেক দূরে চলে গেল। সে দেখল সমুদ্রের ধারে ছোট্ট মেয়ের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে মা, ঝিনুক কুড়োচ্ছে, হাসছে। মা কি সত্যি সত্যি খুশি, নাকি সজলকাকাকে দেখানোর জন্যে এতো হাসছে? একটু আগে গাড়িতে যে মায়ের বিষণ্ন মুখ দেখে সজলকাকা বলেছে, ‘শালি ঢেমনি মাগি, নিয়ে এলাম দুদিন একটু ফুর্তি করব বলে, মুখ দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রে নয় শ্মশানে যাচ্ছে!’  

তার কানে এগুলোই বাজছে, নদীর ধারে এসে সে সমুদ্রের কথা ভেবে যাচ্ছে, ভাবছে মায়ের প্রতিটি অপমানের মুহূর্ত, বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে সজলকাকা বলছে, ‘এমন জায়গায় এসেছিস বাপের জন্মে?’  হোটেলের নরম দুধসাদা বিছানায় ঠেলে ফেলে বলছে, ‘মাগি ডুবে যাবি, শুয়েছিস এমন গদিতে?’ ভিকি দেখতে পাচ্ছে, মা গভীর রাতে সজলকাকা যখন শরীরের আরাম করে ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে, তখন এসে দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। দূরে অন্ধকার সমুদ্রের ওপর ফসফরাস জ্বলছে, আর মায়ের চোখে বিদ্যুতের মতো অশ্রু। চোখের জলও আগুনের মতো হতে পারে, জানে ভিকি। কিন্তু মা তো কিছুই পোড়াতে পারে না, পুড়ে যায় নিজেই শুধু। 

কয়েকজন বৃদ্ধ এসে বসল ঘাটে, সুদের হার, বউমার খারাপ রান্না এবং নাতির লেটেস্ট মোবাইল নিয়ে আলোচনা করে চলে গেল। দূরে দূরে অন্য পারের আলো জ্বলে উঠল, কিন্তু সেই আলো সত্ত্বেও নদী নিজের অন্ধকারের গাঢ়তা হারাল না। ভিকি যখন ভাবছে বাকি পাটিসাপটাগুলো ছুড়ে ফেলবে কি না, তখনি তার পাশ দিয়ে কে যেন ধীরে ধীরে জলের দিকে নেমে গেল। প্রথমে তার কিছু মনে হলো না, গঙ্গাজল নেয় কত লোকে, স্নান করে সন্ধ্যায়। কিন্তু শাড়ির খসখস আর মৃদু একটা ঝিমঝিম গন্ধ তাকে সন্ত্রস্ত করে তুলল। সে দ্রুত পায়ে ঘাটে নেমে দেখতে পেল, এক প্রতিমার মতো নারী, মায়ের থেকে ছোট হবে, জলে নেমে যাচ্ছে।

সে বলল, ‘আপনার না রাত দেড়টায় আসার কথা, নৌকো অপেক্ষা করবে?’

নারী রুদ্ধকণ্ঠে বলল, ‘সে আসবে না, তার বে ঠিক হয়েচে, আমি কিছু জানতে পারিনি।’

‘এই ঘাট কি আপনার তৈরি? আপনি?’

‘কস্তুরমঞ্জরী দাসী, আমায় ছাড়ো, আমি মা গঙ্গার বুকে পাপ জুড়োব।’

ভিকি দেখতে পেল মা আস্তে আস্তে সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

সে কস্তুরমঞ্জরীকে দু-হাতে জড়িয়ে ওপরে নিয়ে এলো। 

‘এই ঘাট আপনার তৈরি, এখানে ডুবতে নেই।’

‘আমি আর ঘরে ফিরব নাকো, তাহলে কোতায় যাব?’

‘শুনুন আমি এখানে গান গাইতে এসেছিলাম, আমার কাছে আইডি প্রুফ চাওয়া হলো।’

‘আইডি পুরুপ মানে কী গো?’

‘পরিচয়পত্র। কিন্তু গানের তো পরিচয়পত্র লাগে না। আমি আপনাকে গান শোনাব। সেই গান শোনার পর আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন আপনি কী করবেন।’

ভিকির মনে হয় এই গান শেষ না হলে তার মাও সমুদ্রে নামতে পারবে না।

গান শুরু হয়, গিটারের হালকা স্ট্রোকের সঙ্গে গান, তার ভালো জানা, অল্প জানা, একদম না-জানা গান। কস্তুরমঞ্জরী এমন গান আগে শোনেনি শুধু না, এতোক্ষণ কিছু না করে বসে থাকাও তার ভাগ্যে ঘটেনি কখনো। তার ভালো লাগছিল। সে ভুলে যাচ্ছিল মড়াখেকোটা মিছে কথা বলে তাকে ঠকিয়েছে, ভুলে যাচ্ছিল  প্রতিরাতের চাবুকের শব্দ, ভুলে যাচ্ছিল বাঁজামাগি শোনার খোঁটা। সে বসে রইল গানের পাশে। গান চলতে থাকে। কস্তুরমঞ্জরীর ঘাটে  একটা খেলনা পিয়ানো অপেক্ষা করে  পরবর্তী ঢেউয়ের।