মোহাম্মদ রফিকের কবিতা

আত্মজৈবনিক

তুমি-আমি যোগ-বিয়োগের ফলাফল

একটি দাঙ্গা, তোমাকে করেছে ভিনদেশি –

আর আমি পরবাসী নিজ দেশে;

তুমি-আমি শূন্যের কোঠায় শ্বাস নিই

একটি যুদ্ধ বেশুমার স্মৃতিবহ

স্বাধীনতা ফিরে আসা দগ্ধগৃহে :

দেশ-দেশান্তরে বিভাজন রেখা টেনে দিলে

তুমি আজ কালের গহ্বরে অমলিন

আমি ধুঁকে মরি আত্মধিক্কারে লজ্জায়;

তুমি আজ বিস্মৃতির সহচর

বিস্তারিত নীলিমায় সন্ধ্যামণি ফুল,

আর আমি অর্ধমৃত অপরাধবোধে তাড়নায়,

ঠেকাতে পারিনি আমি সেদিনের ক্ষয়ের বিনাশ,

আজও তাই জেগে উঠি প্রতি ভোরে

তোমার চোখের আলো মেখে সকাতর প্রার্থনায়।

মৃত্যু

ধরতে চাই, পদানত করতে চাই,

সম্পূর্ণ আমুণ্ড গ্রাস করে ফের উগরে

দিতে চাই, দেখতে চাই, কিমাকার

মৃত পোকা পড়ে আছে কাদা মেখে,

শবের উপরে উড়ছে মাছি

বিজয় পতাকা, হায়, মৃত্যু কার দাস!

আশ্রয়

একা একা মনে হয় কবরের মধ্যে শুয়ে আছি,

হঠাৎ কাশির শব্দ, আচ্ছন্নতা ভেঙে উঠে বসি

পায়ের আওয়াজ, চেনা বা অচেনা; সারি সারি

নিস্তব্ধ গোরের ভিড়ে অধীর নিশ্বাস ওঠে-পড়ে।

মন্ত্র চাই

কিছুকাল স্বপ্নে বেঁচে থাকি

অতঃপর দুঃস্বপ্নের কালো রাত

জেগেও জাগিনি তবু অসাড় নিঃসাড়

মনে মনে ভাবি কবে হবে ভোর

এমন দুঃসহ কালে, কালান্তরে

অনাবৃষ্টি খরা ঘামে ভিজে-যাওয়া দেহের যন্ত্রণা

চৈত্রের দুপুর থেকে যায় যদি যায় দিন

তখনও অনেক দূরে ভাদরের মুখর প্রভাত

মাথার ভিতরে গুঞ্জরণ করে দগ্ধ ক্ষুধা

দহনের তাড়নার নেই বুঝি অবশেষ

তবে যাক যা-কিছু যাওয়ার ছিল

থাক শুধু গুরুভার আত্মতৃপ্ত সময়ের

স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের ভার বয়ে ক্ষীণ্ন দেহ,

ধু-ধু শূন্যতার বুকে অবগাহনের মন্ত্র চাই!

মা

আমার মা। বয়স ছিয়াশি।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে-চলে

ভাঙা হাতে খোঁজে ওষুধের

কৌটা, ঠোঙা, বেদনার দানা।

আমার মা। বৃদ্ধা যাকে বলে।

কুঁজো হয়ে ঝাঁট দিতে থাকে

ঘর-পইঠা, প্রতিটি জিনিস

জায়গামতো আছে কি-বা নেই;

ভোরে উঠে জল দেয় গাছে

রোদ তার একান্ত আপন

সখা যেন, কাল-কালান্তর,

হাওয়া দেয়, মোহমুক্ত ধন;

নিদ্রাহীন আমৃত্যু অমর

চক্ষু দুটি মশালের আলো

খোঁজ নেয় প্রতি সন্তানের

যারা ঘাটে মাঠে-তেপান্তরে;

স্বকালের কিংবা স্বদেশের

হয়তো-বা প্রতিমূর্তি নয়

ঘরে-ঘরে জ্বেলে দেয় আলো

সামলে রাখে আপন চৌকাঠ!

অভাজন

অবিশ্বাস্য ধ্বনিপুঞ্জ মাতাল করেছে

আমি নামি মাঠে, ভরা ফসলের ক্ষেতে

কাস্তে হাতে কাটি ধান, দুরাশার;

আঁটি বেঁধে নিয়ে চলি, উঠোনের কোণে

থরে থরে রেখে, ভাবি, বেলা হলো

আঁটির উপরে আঁটি বুঝি সময়ের মাপকাঠি;

এল মাড়াইয়ের কাল লাঙল-জোয়াল-গরু

খুঁজে ফিরি এদিক-ওদিক, অবশেষে সাহায্যের

হাত কেউ মেলে ধরে, ভাবি পার পাওয়া গেল

এখন মাড়াই শেষ, আঁতকে উঠি ভয়ে ও সন্ত্রাসে

এ কী, দেখি সব চিটে ধান, শুধু  খোসা

কপাল যদি-বা পোড়ে, সব তবে ভাগ্যের বিদ্রƒপ!

(গ্রন্থ : কালের মান্দাস, প্রকাশক : বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ২০১৩)