যখন অগ্নি-গিরি গিরি-মল্লিকার ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল

নজরুল ইসলামের প্রথম বিদ্রোহ-পর্বের কবিতার সঙ্গে তাঁর সায়ন্তন (জীবনের নয় – সাহিত্যের) জমিন-আসমান ব্যবধান ঘটে গেছে।

‘জমিন-আসমান’ শব্দবন্ধ সতর্কভাবেই বসিয়েছি।

প্রথম পর্যায়ের নজরুলের কবিতায় – রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – ছিল ‘জমি-দারী’ আর শেষ পর্যায়ের কবিতায় ছিল ‘আসমান-দারী’।

এরকম বিচারেও দুয়েকটি কথা মাননীয়। – এক. আদ্যন্ত কোনো-এক নজরুল প্রবাহিত। দুই. এসবের বাইরেও শাখানদী-উপনদী স্রোত-প্রতিস্রোত রয়ে গেছে ঢের।

শেষপর্যন্ত এই সামগ্রিক নজরুলই সন্ধানীয়।

নজরুলের শেষ জীবনের কবিতায়-গদ্যে-অভিভাষণে বারবার ওই পরিবর্তনের কথা এসেছে – মনো-পরিবর্তনের কথা।

১৯৪১ সালে, রবীন্দ্রনাথের ৮০-বছর পূর্তি উপলক্ষে, আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে যে-কয়েকজন কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন, নজরুল ছিলেন তাঁদের একজন। ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি’ নামের ওই কবিতায় রবীন্দ্র-বন্দনার মধ্যে কবি আত্মবিশ্লেষণ করেছিলেন অনেকখানি। লিখেছিলেন, ‘আনন্দ-সুন্দর তব মধুর পরশে/ অগ্নি-গিরি গিরি-মল্লিকার ফুলে ফুলে/ ছেয়ে গেছে।’ লিখেছিলেন, ‘আমার হাতের সেই খর তরবারি/ হইয়াছে খরতর যমুনার বারি।’ এই ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি’ কবিতার শব্দ ব্যবহার করে আমরা বলতে পারি : নজরুলের প্রাথমিক কবিতায় ছিল

‘বহ্নি-তরঙ্গ’, আর উপান্ত কবিতায় ‘চন্দ্র-জ্যোতি’।

কবির নিস্তব্ধতার পরে প্রথম প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ নতুন চাঁদ-এ (১৯৪৫) এরকম বেশকিছু কবিতা আছে। ‘চির-জনমের প্রিয়া’ কবিতায় কবি জানিয়েছেন, ‘গত জনমের অস্থি আমার নিদারুণ বেদনায়/ মুক্তা হয়েছে।’ ‘আমার কবিতা তুমি’ কবিতায়, ‘চেয়ে দেখ প্রিয়া, তোমার পরশ পেয়ে/ গোলাপ দ্রাক্ষা-কুঞ্জে মরুর বক্ষ গিয়াছে ছেয়ে।’

এরকমই একটি কবিতা ‘সে যে আমি’ (সওগাত, পৌষ ১৩৪৭, ২৩ : ২)। এই কবিতারই অবিকল গদ্য-ভাষ্যের মতন মনে হয় ‘বনগ্রাম সাহিত্য সম্মিলনীর চতুর্থ বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত’ কবির অভিভাষণ (সওগাত, বৈশাখ ১৩৪৮, ২৩ : ৬)।

‘সে যে আমি’ কবিতায় ‘দুরন্ত সুন্দর’ সম্বোধন করে কবি প্রশ্ন করেছেন, উত্তরও দিয়েছেন। কবি বলছেন, কার উপরে রাগ করে আকাশ ভরে তুমি গ্রহ-তারা ছড়িয়ে দিলে? কার দেখা না-পেয়ে চাঁদের গায়ে লাগিয়ে দিলে কলঙ্কলেখা? কেন ফুল ফোটাও? শ্রাবণের আকাশে ঘনিয়ে তোলো মেঘ? তোমার সৃষ্টিতে তুমি কেন জীবন দিয়েছ এবং জীবন দিয়ে আবার মৃত্যু দিলে কেন? রূপ নেই তোমার, তবু কেন তোমার মধ্যে জাগে রূপের তৃষ্ণা? – ‘দুরন্ত’, ‘সুন্দর’, ‘উদাসীন’, ‘অভিমানী’ – বিশেষণের পর বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন কবি সৃষ্টিকর্তাকে বোঝাতে। বলছেন : তুমি যাকে সন্ধান করছ, সে কী আমাকেই? পুরো কবিতাটি ঈশ্বরের সঙ্গে এই মিলন-তিয়াষারই একটি কাব্যরূপ। এই কবিতার দুটি স্তবক উদ্ধৃত করতে চাই এখানে –

কাহারে ভুলাতে ঝরো অনন্ত পরম-শ্রীর রূপে,

তোমারি গুণের কথা কি ভ্রমর ফুলে কয় চুপে চুপে?

মুহু মুহু উহু উহু করে ওঠো কুহুর কণ্ঠস্বরে

তোমারি কাছে কি শিখিয়া পাপিয়া পিয়া পিয়া রব করে?

পদ্মপাতার থালায় তোমার নিবেদিত ফুলগুলি

ঝরে ঝরে পড়ে অশ্রু-সায়রে, কেহ লইল না তুলি!

যাহার লাগিয়া ফুলের বক্ষে সঞ্চিত করো মধু,

সকলে যে মধু লইল, নিল না তোমারই মানিনী বধূ!

যে অপরূপারে খোঁজো অনন্তকাল রূপে রূপে নামি –

                   সে কি আমি? সে কি আমি?

সংহারে খোঁজো, সৃষ্টিতে খোঁজো, খোঁজো নিত্য স্থিতিতে,

যাহারে খুঁজিছ পরম বিরহে, খুঁজিছ পরম প্রীতিতে,

যে অপরূপা পূর্ণা হইয়া আজিও এল না বাহিরে

পাইয়া যাহারে বলিছ, এ নয়, হেথা নয়, সে তো নাহি রে!

সেই কুণ্ঠিতা গুণ্ঠিতা তব চির-সঙ্গিনী বালিকা

অনন্ত প্রেমরূপে অনন্ত ভুবনে গাঁথিছে মালিকা।

ভীরু সে কিশোরী তব অন্তরে অন্তরতম কোণে

হারাবার ভয়ে তোমারে, লুকায়ে রহে সদা নিরজনে।

সকলেরে দেখ, আপনারে শুধু দেখ না পরম উদাসীন,

দেখিলে, দেখিতে যেখানে তুমি, সেইখানে সে যে আছে লীন!

যত কাঁদে, তত বুকে বাঁধে তোমারেই অন্তর্যামী!

                   সে কি আমি ? সে কি আমি?

এরই সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাক বনগ্রাম-অভিভাষণের অংশ –

ঐ সমাধির মাঝে শুনতাম – অনন্ত প্রকাশ-জগৎ যেন আমায় ঘিরে কাঁদছে – ‘ফিরে আয়! ফিরে আয়!’ কেন যেন মনে হতো – এই নিথর নির্বিকার শান্তির পথ আমার নয়। সমাধির তৃষ্ণা যখন মিটল – পরম-একাকীর পরম শূন্য সেদিন যেন সাথিহীন একাকিত্বের বেদনায় কেঁদে উঠল। সেই রোদনের অসীম প্রবাহ-কূলে দেখা পেলাম আমার চির-চাওয়া পরম সুন্দরের – সেইখানে অনন্ত প্রেম, আনন্দ, অমৃত, রস ও বিরহের যে লীলা দেখলাম – তা প্রকাশের শক্তি যদি সেই পরম সুন্দর আমায় দেন – তাহলে পৃথিবী এই রস-ঘন প্রিয়-ঘন পরমানন্দ-লোকের রূপে রূপায়িত, ছন্দে গানে সুরে রসায়িত হয়ে উঠবে। আমার বাঁশিতে যে সুর বাজত – যে বাঁশি আমি অভিমানে দিয়েছিলাম ফেলে, সেই হারানো বেণু আবার ফিরে পেলাম সেই চির-সুন্দর লোকের অশ্রুমতী নদীতীরে। যে অপরূপ শ্রীমাখা মুখখানি আমার বন্দনায় উঠত ভেসে, যে শ্রীমুখের আভাস ফুটে উঠত আমার গানে কবিতায় ছন্দে সুরে, যার বিরহ, যার আকর্ষণ আমায় ধূলির পথ থেকে ফুলের পথে নিত্য আকর্ষণ করেছে, যার অশ্রু-ছলছল রস-ঢলঢল বিরহ-সুন্দর মুখখানি না দেখে পরম শূন্যের লয়েও শান্তি পাই নাই – সেই পরমা শ্রীমতী প্রেমময়ীকে সেইখানে দেখলাম। যদি তাঁর অনন্তশ্রীর একটি রূপ-রেণুকেও আমার কাব্যে গানে সুরে আজ রূপ দিয়ে যেতে পারি, তাহলে আমি ধন্য হবো – পৃথিবীতে আসা আমার সার্থক হবে।

‘সে যে আমি’ কবিতা এবং বনগ্রাম-অভিভাষণ দুটির মধ্যেই অনন্য অন্বেষণের রূপ ধরা পড়েছে ‘পরম’ শব্দটির পৌনঃপুনিক ব্যবহারে –

‘সে যে আমি’ (কবিতা)      ‘মধুরম্’* (বনগ্রাম-অভিভাষণ)

পরম স্বামী         পরম একাকী

অনন্ত পরমশ্রী     পরম শূন্য

পরম বিরহ        পরম সুন্দর

পরম প্রীতি        পরম প্রেমময়ী

পরম উদাসীন     পরম তৃষ্ণা

পরম মনোহর     পরম মধুময় অস্তিত্ব

পরম নিলাজ       পরম প্রসাদ

পরম নিরাবরণ – ইত্যাদি    পরম রুদ্র – ইত্যাদি।

হয়তো গদ্যরচনা বলেই অভিভাষণটিতে পরম-কেন্দ্রী আরো কিছু কথা দেখতে পাই আমরা : ‘পরমাশ্রী’, ‘পরমানন্দময়ী’, ‘পরম নিত্যম’, ‘পরমা শক্তি’ প্রভৃতি। ‘পরমশ্রী’ কথাটি ব্যবহার করেছেন কবিতায়, গদ্যে ‘পরমাশ্রী’। কাছাকাছি আরেকটি শব্দভাষণে দেখা যাচ্ছে, ‘অনন্তশ্রী’। কবিতায় যা ছিল ‘অনন্ত পরমশ্রী’, গদ্যে তা-ই যেন আরো সংহত হয়ে রূপায়িত হলো ‘অনন্তশ্রী’ শব্দবন্ধে। কবির অন্তকালীন একগুচ্ছ কবিতায়ও। অভিভাষণে মুহুর্মুহু ফিরে ফিরে এসেছে এই একটি শব্দ : ‘পরম’।

‘আমার কবিতা তুমি’ কবিতায় ‘পরম বিরহ’; ‘অভেদম্’ কবিতায় ‘পরম একাকী’, ‘পরম নিত্য’, ‘পরম আমি’; ‘অভয়-সুন্দর’ কবিতায় ‘পরম সুন্দর’, ‘পরম-শক্তি-আসন’, ‘পরম ক্ষণ’; ‘কেন জাগাইলি তোরা’ কবিতায় ‘পরম শক্তি’, ‘পরম জ্যোতি’; ‘আর কতদিন?’ কবিতায় ‘পরম একাকী’, ‘পরম বন্ধু’ প্রভৃতি।

কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলের (১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে) অভিভাষণে কবি ব্যবহার করেছেন ‘পরম রহমত’, ‘পরম করুণাময়’, ‘পরম গোপন’, ‘পরম দান’, ‘পরম প্রসাদ-দাতা’, ‘পরম নিত্যম’, ‘পরম ঐশ্বর্য’, ‘পরম ভিক্ষু’, ‘পরম সাম্য সুন্দর’, ‘পরম স্বামী’, ‘পরম প্রভু’, ‘পরম ক্ষমা-সুন্দর’, ‘পরম তত্ত্ব’, ‘পরম নিবারণ’, ‘পরম মুক্ত’, ‘পরম দিগম্বর’, ‘পরম কল্যাণ’, ‘পরম ঐশ্বর্য’ ইত্যাদি। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-সমিতির রজত-জয়ন্তী অনুষ্ঠানে সভাপতির অভিভাষণেও নজরুল অনুরূপ শব্দাবলি প্রয়োগ করেছিলেন : ‘পরম পতি’, ‘পরম গতি’, ‘পরম প্রভু’, ‘পরম স্বামী’, ‘পরম সুন্দর’, ‘পরম শূন্য’, ‘পরম প্রেমময়’ ইত্যাদি।

এখন এই-যে কবি নজরুল ইসলামের কবিতায়-অভিভাষণে ‘পরম’ শব্দটি পরাবর্ত-প্রক্রিয়ায় অবিশ্রাম প্রযুক্ত হয়েছে, এ-থেকেই তাঁর তৎকালীন মনোপ্রতিন্যাস শনাক্ত করা যায়। পরম মানে কী? – পরম অর্থ : প্রথম, আদ্য, প্রকৃত; শ্রেষ্ঠ, প্রধান; সর্বাতীত, দুঃখ-মায়া প্রভৃতির অতীত; চরম, অত্যন্ত। (সংসদ বাংলা অভিধান, ২০০১) তবে এই বিশেষণটিকে ভর করে যে-কথা কবির অভিপ্রেত, সেটিই আমাদের সন্ধান করতে হবে। ‘সে যে আমি’ কবিতায় যাঁকে তিনি ‘পরম স্বামী’, ‘পরম উদাসীন’, ‘পরম মনোহর’ বলছেন, বনগ্রাম-অভিভাষণে যাঁকে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘পরম একাকী’, ‘পরম সুন্দর’, ‘পরম রুদ্র’ ইত্যাদি বলে, তাঁকে আমরা সহজ ভাষায় বলতে পারি ‘ঈশ্বর’ কিংবা কবি বিনয় মজুমদারের ভাষায় ‘ঈশ্বরী’। তাহলেও, ‘প্রেমময়ী’ বলে ডাকলেও, তিনি নারী নন। ‘পরম স্বামী’ বলে ডাকলেও তিনি পুরুষও নন। শুধু এই কবিতায় বা এই অভিভাষণে নয়, আমাদের উল্লিখিত কবিতাগুচ্ছে ও অভিভাষণসমূহে নজরুল অরূপের অন্বেষী। আবার সেই অরূপ আত্মরূপেরই দ্বিতীয় প্রকাশ।

নজরুল ইসলাম যে বড় কবি, প্রকৃতার্থে মহৎ কবি, তা এই আত্মঅন্বেষণের কারণেই।

এটি তো আমরা সকলেই জানি যে, নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতার কৃৎকৌশলেও অসাধারণ : শব্দপ্রয়োগে তাঁর দক্ষতা অর্জুনের মতন (লাগসই আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে তিনি তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, ভারতচন্দ্র রায় যে-‘যাবনী-মিশাল’ ‘রসালো’ ভাষার কথা বলেছিলেন নজরুলেই যেন তা চূড়ান্ত চরিতার্থতা পেয়েছিল), ছন্দপ্রয়োগে সজ্ঞান ও অতিকুশলী (এমনকি মাত্রাবৃত্ত মুক্তকের আবিষ্কর্তা), চিত্রকল্পের সম্রাটই তো নজরুল – কিন্তু অন্তঃসন্ধানই একজনকে কবির চেয়ে বড় যে, সেই ‘শিল্পী’ করে তোলে। নজরুল ইসলামের ক্লান্তিহীন শিল্পসাধনার মধ্যে ছিল এই ক্রমাগত জীবনের-জগতের নিহিতার্থ সন্ধান। কবিজীবনের শেষদিকে যেন পর্দা পরিষ্কার সরে গিয়েছিল। উন্মোচিত হয়েছিল ঝলমলে প্রচ্ছদের অভ্যন্তরভাগ।

সওগাত পত্রিকার পৌষ ১৩৪৭ সংখ্যায় ‘সে যে আমি’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। ওই কবিতায় বারংবার আবৃত্ত হয়েছিল, গানের মতন, ‘সে কি আমি? সে কি আমি?’ প্রশ্নটি। ৫-বার – ৫টি অসমান স্তবকে। যাকে কবি সম্বোধন করছেন ‘দুরন্ত সুন্দর’ বা ‘পরম স্বামী’ কিংবা ‘প্রিয়তম’ অথবা ‘পরম মনোহর হিসেবে, যাকে বারবার প্রশ্ন করছেন ‘সে কি আমি? সে কি আমি?’ বলে, কবিতার সর্বশেষ পঙ্ক্তিদুটিতে তার জবাবেই যেন জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘খেলা-শেষে মহাপ্রলয়ের বেলা আমার দুয়ারে থামি/ জানাবে পরম-পতি আমারে কি – আমি, প্রিয়, সে যে আমি!’

সওগাত পত্রিকার পরের সংখ্যাতেই (মাঘ ১৩৪৭) বেরিয়েছিল নজরুলের একটি ‘গান’। ‘গান’ শিরোনামের এই গানটিতে ছিল একটি ধ্রুবপদ : ‘সে কি তুমি? সে কি তুমি?’ এই গানটির উদ্দিষ্ট কোনো শরীরিণী মানবী বলে মনে হয় না। এই সংগীতেও একটি ‘ক্ষুধিত প্রেম’ হাহাকারের মতন ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় না এ-কোনো কামিনীর জন্যে ক্রন্দন। ‘মহাসাগরের ঢেউএর মতন/ বুকে বাজে এসে কাহার রোদন’ – এই পঙ্ক্তিদ্বয় অপার্থিব তৃষ্ণা-হাহাকার-রোদনেরই ইশারা করে।

মনে হয় ‘সে যে আমি’ কবিতা ও ‘গান’টি সমীপকালের রচনা। ‘সে কি আমি?’ এবং ‘সে কি তুমি?’ মনে হয় ‘একই জিনিসের দুরকম উৎসারণ’।

তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশের দিনগুলোতে, সেই ১৯২৪ সালে, নজরুল লিখেছিলেন ‘আপন-পিয়াসী’র মতো কবিতা বা গান (ছায়ানট), যার প্রথম লাইন সুপরিচিত : ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন/ খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ এই কবিতা-গানের শেষাংশে দেখা যাচ্ছে : কবি স্বরচিত যে-কাননে বসে প্রিয়তমাকে মালা পরিয়ে দিচ্ছেন তা তাঁরই কণ্ঠে শোভিত। – ‘সে যে আমি’ কবিতাটিও যেন এই কবিতা-গানটিরই পরিবর্ধিত প্রকাশ। ‘আপন-পিয়াসী’ কবিতা-গানটি ছিল নজরুলের তখনকার রচনাধারায় খানিকটা আকস্মিক উদ্ভাসনের মতন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সৃজনশীলতার একটি ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে। সুস্থ জীবনের শেষে এসে যেন সেই ভাবনা-বেদনাই স্ফারিত হয়ে গেছে একগুচ্ছ কবিতায়-অভিভাষণে।

যদিও ১৯১৯ সালে ছাপার হরফে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তবু ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেই নজরুলের প্রথম আত্মস্বাক্ষর (পরে অগ্নি-বীণা গ্রন্থর্ভূত)। পুরো বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় অভিনব এই কবিতাটিতে আছে অসম্ভব রকম আত্মব্যক্তিত্বের উন্মেষণ। শব্দব্যবহারে, ছন্দপ্রয়োগে, চিত্রকল্পের নতুনত্বে হিন্দু-মুসলমান পুরাণের চূর্ণ-একত্রিত পৌনঃপুনিক উদ্দামতায়, সর্বোপরি বিষয়ের অভিনবত্বে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সেদিন বাংলা সাহিত্য-অঙ্গনে একটি সদর্থক বিস্ফোরণের মতন ফেটে পড়েছিল। ‘বিদ্রোহী’র মূল কথা আর কিছু নয় – আত্মতার জাগরণ। ‘চির-উন্নত মম শির’ কথাটি বারংবার আবৃত্ত হয়েছে এই কবিতায়। এই একটি কবিতার কারণেই নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে গেছেন চিরকালের মতন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন, ‘ভূলোক-দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!’ এবং ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবানবুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন!/ আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!’ ‘ধূমকেতু’ (অগ্নি-বীণা) কবিতার দুটি অংশ উৎকলন করা যাক : ‘ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিঁড়ি,/ আমি বসিব বলিয়া পেতেছে ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি।’ এবং ‘কাল-বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার/ তখনি রহু শোষে না রে তার,/ দৃষ্টিসীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড সুখে/ পুচ্ছ সাপটি খেলা করে আর শিকার মরে যে ধুঁকে;/ তেমনি করিয়া ভগবানে আমি/ দৃষ্টিসীমায় রাখি দিবাযামী,/ ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি/ এই অগ্নি-বাঘিনী আমি যে সর্বনাশী।’ – এই নজরুলই আরো বছর কুড়ি না-যেতে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলেন, ‘বহ্নি-তরঙ্গ’ নির্বাপিত বা অবসিত হয়ে ফুটে উঠেছিল ‘চন্দ্র-জ্যোতি’। তাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যরচনায়। এই শেষ পর্যায়ের দুটি রচনার – কবিতার ও অভিভাষণের – সামীপ্য-আনুরূপ্য থেকে তা প্রমাণিত হয়। ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ধূমকেতু’ কবিতার একেবারে উল্টোপিঠে আমরা স্থাপন করতে পারি ‘সে যে আমি’ কবিতা এবং বনগ্রাম-অভিভাষণ। মাত্র ২৪-বছরের সৃজনশীলতায় কাজী নজরুল ইসলাম একটি বৃত্তের সবগুলো র্অ পরিক্রমণ করেছিলেন। যা শুরু হয়েছিল দ্রোহে, তার সমাপ্তি ঘটেছিল সমর্পণে। মাত্র ৪৪ বছরে স্তব্ধবাক হয়ে গেলেও নজরুল কবিতায় তথা সাহিত্যে নিজের ধরনে একটি স্বয়ম্পূর্ণতা দান করেছিলেন।

* প্রসঙ্গত উল্লেখ করি : আবদুল কাদির-সম্পাদিত (এবং উত্তরকালেরও) নজরুল রচনাবলী-তে যে-১৪টি অভিভাষণ-প্রতিভাষণ মুদ্রিত হয়েছে তার সবগুলোর শিরোনাম নজরুল-প্রদত্ত নয়, এবং রচনাবলী-তে তা অনুল্লিখিত। আরো : সিরাজগঞ্জ-অভিভাষণটি দুবার দুরকমভাবে মুদ্রিত হয়েছে।

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ পঞ্চম সংখ্যায় (জুন ২০০৪/ আষাঢ় ১৪১১) প্রকাশিত হয়েছিল।