এলিয়ট ও এমিলি

উনিশ শ তেরোর সতেরোই ফেব্রুয়ারি এলিয়ট কেম্ব্রিজে এক ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এই কেম্ব্রিজ্ ব্রিটেনে নয়, যেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্স্ রাজ্যে এই কেম্ব্রিজ্; [ম্যাসাচুসেট্স্ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি ঠাট্টার কবিতা আছে; দেখুন : খাপছাড়া;] ম্যাসাচুসেট্সেও একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আছে; তার নাম হার্ভার্ড্; এলিয়ট তখন হার্ভার্ডে পড়াশোনা করেন। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল আন্ট্ হিঙ্কলির বাড়িতে। আন্ট্ হিঙ্কলি এলিয়টের মা শার্লটের আপন বোন, এলিয়টের খালা। এলিয়ট তাঁর জীবনের প্রথম ষোলো বছর কাটিয়েছেন মিসৌরি রাজ্যের সেইন্ট্ লুইসে, যেখানে, ১৮৮৮-র ২৫শে সেপ্টেম্বর, তাঁর জন্ম। সেইন্ট্ লুইস্ থেকে দূরে কেম্ব্রিজে খালার বাড়ি এলিয়টের কাছে নিজের বাড়ির মতোই মনে হতো। মাঝে-মধ্যেই সেখানে যেতেন। ওই দিনের অনুষ্ঠানে জেইন অস্টিনের এমা উপন্যাস থেকে একটি অংশ অভিনীত হয়েছিল। সেখানে এলিয়ট উড্হাউসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর খালাতো বোন এলেনর হিঙ্ক্লি ছোটো একটি নক্শা (‘স্কেচ’) তৈরি করেছিলেন – নাম দিয়েছিলেন ‘মঁসিয় র্মাসেল অ্যান্ড হিজ লেটেস্ট র্মাভেল’। সে-নক্শার মঁসিয় র্মাসেল চরিত্রেও এলিয়ট অভিনয় করেছিলেন। সে-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আরও একজন যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর নাম এমিলি হেইল। এলেনরের বন্ধু তিনি। এমিলি
সে-অনুষ্ঠানে মিসেস এল্টন নামে  এক চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘এক্স্টেসি’ ও ‘মে মর্নিং’ নামে দুটি গানও গেয়ে শোনান। এলিয়টের চেয়ে বয়সে তিন বছরের ছোটো, এমিলি জন্মেছিলেন নিউ জার্সির ইস্ট অরেঞ্জে, কিন্তু বড়ো হয়েছেন বোস্টনে; চার্লস নদীর একদিকে বোস্টন, অন্য দিকে কেম্ব্রিজ্। এমিলির ও এলিয়টের পরিবার একই রকম; এমিলির বাবা স্থপতি এড্ওয়ার্ড্ হেইল, পরে ইউনিট্যারিয়ান চার্চে ধর্মযাজক (‘মিনিস্টার’)। এমিলির সঙ্গে এলিয়টের  প্রথম  দেখা সম্ভবত ১৯১২-তে। প্রথমে এমিলি ছিলেন কেবলই হিঙ্ক্লিদের পারিবারিক বন্ধু; এলিয়ট তখন এডেলাইন নামে এক মহিলার প্রতি দুর্বল ছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই এলিয়ট এমিলির প্রেমে পড়েন; এমিলিও তাঁর।

এমিলির দিক থেকে এই প্রেম সারাজীবন টিকে ছিলো – কখনও বিয়ে করেননি; অন্য কারও প্রতি কখনও দুর্বল হয়েছেন, এমনও শোনা যায় না; সারা জীবন এলিয়টের জন্য প্রতীক্ষায় ছিলেন। অথচ ১৯১৪-তে এলিয়ট যখন এমিলিকে বলেন, তিনি তাঁকে ভালোবাসেন, তখন – কী আশ্চর্য! – এমিলি কথাটি যেভাবে নেন, তা দেখে এলিয়টের মনে হয়নি যে, এমিলির মনে তাঁর জন্য প্রেমের কোনওই অনুভব আছে। দর্শন পড়ার জন্য সেল্ডন্ ভ্রমণ-বৃত্তি নিয়ে সে-বছরই এলিয়ট য়ুরোপে চলে যান – প্রথমে জার্মানির র্মাবার্গে, পরে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেরটন কলেজে। অক্সফোর্ডে থাকার সময় এলিয়ট এমিলিকে ও এমিলি এলিয়টকে কয়েকটি চিঠি লেখেন, কিন্তু সেগুলো ছিলো এক বন্ধুর কাছে লেখা অন্য বন্ধুর চিঠি, তার বেশি কিছু নয়। এক নাটকে এমিলির অভিনয়ের পর, ১৯১৪-র ডিসেম্বরে, এলিয়ট তাঁকে অভিনন্দন জানান লাল গোলাপ পাঠিয়ে; সে-গোলাপ এলিয়টের বন্ধু কন্রাড্ অ্যাইকেন্ এলিয়টের হয়ে এমিলিকে পৌঁছে দেন। এর পরের বছর, ১৯১৫-তে, এলিয়ট হঠাৎ করে বিয়ে করেন ভিভিয়েন হেই-উড্কে। এলিয়টের দ্বিতীয় স্ত্রী ভ্যালেরি এলিয়ট তাঁর সম্পাদিত দ্য লের্টাস্ অব টি. এস. এলিয়ট-এর প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় ষাটের দশকের কোনও এক সময় লেখা এলিয়েটের ব্যক্তিগত কাগজ থেকে উদ্ধৃত করেন : ‘বছরখানেক পরে আমার মনে হলো, আমি এখনও মিস হেইলের অনুরক্ত। কিন্তু সে-কথাও আমি জোর দিয়ে বলতে পারবো না : এমন হতে পারে, এটি ছিলো ভিভিয়েনের সঙ্গে থাকা থেকে জন্ম-নেয়া আমার কষ্টের প্রতিক্রিয়া, আগের এক পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে।’

সেই যে এমিলিকে গোলাপ পাঠিয়েছিলেন এলিয়ট, তার প্রায় তেরো বছর পরে, ১৯২৭-এর মে মাসে, এমিলি এলিয়টকে এক চিঠি লেখেন – এর মধ্যে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। এমিলি তখন মিল্ওয়াওকি ডাউনার কলেজে প্রশাসনের কাজ দেখেন, একই সঙ্গে সেখানে বাচনভঙ্গি ও নাট্যকলার (‘স্পিচ অ্যান্ড ড্রামাটিক্স্’) সহকারী অধ্যাপক। [এ কলেজটি পরে উইস্কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হয়ে যায়।] চিঠিটি ছিলো খুবই সাধারণ – আধুনিক কবিতা সম্পর্কে একটি বক্তৃতা তৈরি করার জন্য সাহায্য চেয়ে লেখা। ভিভিয়েন তখন সুইজারল্যান্ডের এক আরোগ্য-সদনে; কিছুদিন আগে তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে একেবারে ভেঙে-পড়া। চিঠিটি পাওয়ার পর সেদিনই দুপুর বেলায়, খাবার বিরতির সময়, লন্ডনের রাসেল স্কোয়ারে হাঁটতে-হাঁটতে এলিয়ট এক ধর্মযাজক উইলিয়াম ফোর্স স্টিড্কে বলেন, ‘আজ সকালে বোস্টনের এক মেয়ের কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পেয়েছি – কত বছর হয়ে গেলো তাকে আমি দেখিনি, তার কাছ থেকে কোনও চিঠিও পাইনি। এই চিঠি এমন একটা কিছু আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, যা বহু, বহু দিন ধরে আমি অনুভব করিনি।’

এমিলি এলিয়টের কাছে, এক অর্থে, বিয়াত্রিস্ হয়ে যান। বিয়াত্রিস্ তেরো শতকের ইতালিয় কবি দান্তের স্বপ্নের নারী। রক্তমাংসের যে-নারী দান্তের কবিতায় বিয়াত্রিস্ হয়ে যান, তিনি সম্ভবত সিমোন দ্যা বার্দির স্ত্রী বাইস র্পতিনারি; ১২৯০-এ মারা যান; এ মৃত্যু দান্তেকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং তিনি দর্শন-চর্চায় সান্ত¦না খোঁজেন। এ শোক থেকেই লেখেন ভিতা নুয়োভা – এ-বইয়ের একত্রিশটি কবিতায় বিয়াত্রিসের জন্য তাঁর প্রেমানুভূতি উদ্বেল হয়ে ওঠে। কিন্তু এ-বইয়ে বিয়াত্রিস্ শেষ পর্যন্ত আত্মার মুক্তির উপায় হয়ে যান, মানুষের জন্য প্রেম ঈশ্বরের জন্য প্রেমের পথ খুলে দেয়। এ-বইয়ে কী করে এমনটি ঘটে, এ নিয়ে স্টিডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এলিয়ট তাঁকে বলেন, ‘এমনি অভিজ্ঞতা আমারও আছে’।

বিয়াত্রিসের আবার দেখা মেলে দিভিনা কম্মেদিয়া – ইংরেজিতে, ‘ডিভাইন কমেডি’ – নামের দীর্ঘ কবিতায়। এ-কবিতার শুরুতে রোমান কবি ভার্জিলের – পুরো নাম পাব্লিয়াস্ ভার্জিলিয়াস্ মারো – সঙ্গে দেখা হয় দান্তের। ভার্জিল ঘুরে-ঘুরে তাঁকে নরক (‘ইন্ফার্নো’) এবং স্বর্গ ও নরকের মাঝামাঝি যে-জায়গায় অনুতপ্ত পাপীরা মুক্তির অপেক্ষা করছে, সে-জায়গাটি – দান্তের ভাষায়, ‘র্পাগেতোরিয়ো’ – দেখান। কিন্তু স্বর্গ দেখানোর অধিকার ভার্জিলের নেই, সেখানে দান্তেকে পথ দেখান বিয়াত্রিস্।  ‘দান্তে’ শিরোনামে ১৯২৯-এ এলিয়ট যে-প্রবন্ধ লেখেন, তাতে বিয়াত্রিসের সঙ্গে স্বর্গের সীমানায় দান্তের দেখা  হওয়ার  দৃশ্যটি  এলিয়ট  নিজের ভাষায় তুলে ধরেন : ‘জলপাই পাতার মুকুট-পরা, মুখ সাদা পর্দায় ঢাকা, এক নারী এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। মুহূর্তেই আমার সমস্ত আত্মা … পুরোনো প্রেমের গভীর শক্তি টের পেয়ে গেলো। … ভার্জিলের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘আমার শরীরে এক ফোঁটা রক্তও নেই যা কেঁপে ওঠেনি : পুরোনো প্রেমের জেগে ওঠার লক্ষণ আমি জানি’।’ এলিয়ট স্বীকার করেন, এই লেখায় তাঁর নিজের জীবনেরই ছায়া পড়েছে।

দ্য ওয়েইস্ট্ ল্যান্ড্ বেরিয়ে গেছে এর অনেক আগেই, ১৯২২-এ। উনিশ শ তেইশের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এলিয়ট সুইনি অ্যাগোনিস্টিজ্ লিখতে শুরু করেন, কিন্তু এ কাব্যনাটকের দুটি অংশ – ‘ফ্র্যাগ্মেন্ট্ অব আ প্রোলাগ্’ এবং ‘ফ্র্যাগ্মেন্ট্ অব অ্যান এগোন্’ – লেখার পর আর এগোননি, কিংবা, বলা যাক, এগুতে পারেন নি। ১৯২৫-এর জানুয়ারিতে মার্ক ভ্যান্ ডোরেন্-কে লেখা এক চিঠিতে এলিয়ট বলেন, তিনি আর লিখতে পারছেন না। এমিলি তাঁকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেন। ১৯২৭ থেকে ১৯৩০, এই তিন বছর জুড়ে এলিয়ট লেখেন অ্যাশ্ ওয়েড্নেস্ডে, ১৯২৭-এ জার্নি অব দ্য ম্যাজাই; ১৯২৮-এ আ সঙ ফর সিমিউন; ১৯২৯-এ এনিমুলা; ১৯৩০-এ মারিনা। এমিলিকে অ্যাশ্ ওয়েড্নেস্ডের ‘লেডি অব সাইলেন্সেসে’র সঙ্গে এক বলে মনে হয়, মনে হয় ‘রোজ অব মেমোরি’, যে-গোলাপ ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু যা জীবন এনে দেয়, যা একমাত্র গোলাপ, ‘দ্য সিঙ্গল রোজ’। একই কবিতাই ‘ব্লোউন হেয়ার ইজ সুইট, ব্রাউন হেয়ার ওভার দ্য মাউথ ব্লোউন,/ লাইলাক অ্যান্ড ব্রাউন হেয়ার’ – ‘কী যে মিষ্টি ওই উড়ে-যাওয়া চুল, বাদামি চুল উড়ে-উড়ে মুখ ঢেকে দেয়া,/ লাইলাক আর বাদামি চুল/ – [‘লাইলাক’ বেগুনি রঙের এক ফুল] – এই পঙ্ক্তি এক স্বপ্নের নারীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। কেউ হয়তো বলতে পারেন, এগুলো তো – অ্যাশ ওয়েড্নেস্ডে ছাড়া বাকিগুলোকে বলা হয় ‘এরিয়েল পোয়েম্স্’ – প্রেমের কবিতা নয়, জার্নি অব দ্য ম্যাজাই তো নয়ই, তা হলে কেন বলবো, এমিলিই এইসব কবিতার পথ খুলে দেন। এ-প্রশ্নের একটি উত্তর এই হতে পারে যে, একজন কবিকে যে প্রেমের কবিতা লিখতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। একজন কবির কোনও-না-কোনও স্বপ্নের নারী তো থাকতেই পারে, কিন্তু সে-স্বপ্নের নারীর উদ্দেশে বা তাঁকে নিয়ে তিনি সরাসরি না-ও লিখতে পারেন। দ্য এর্ল্ডা স্টেইট্স্ম্যান নাটকের উৎসর্গ-পত্র ‘টু মাই ওয়াইফ’ – ‘ওয়াইফ’ মানে এখানে ভ্যালেরি এলিয়ট – ছাড়া এলিয়ট আর কোনও সরাসরি প্রেমের কবিতা লিখেছেন বলে আমার তো মনে পড়ে না। [প্রসঙ্গত, এলিয়ট-এর দ্য কম্প্লি­ট্ পোয়েম্স্ অ্যান্ড প্লেইজ্ বইয়ে ‘অকেজনাল ভার্সেস্’ অংশের ‘আ ডেডিকেশন টু মাই ওয়াইফ’ কবিতাটির ও দ্য এর্ল্ডা স্টেইট্স্ম্যান নাটকের উৎসর্গ-পত্রের পাঠ এক নয় – ওই কবিতার তৃতীয় স্তবকটি উৎসর্গ-পত্রে নেই, উৎসর্গ-পত্রের তৃতীয় স্তবকটি কবিতাটিতে নেই, উৎসর্গ-পত্রের দ্বিতীয় স্তবকের প্রথম পঙ্ক্তি কেবল দু শব্দের, কবিতাটিতে এই পঙ্ক্তিতে আরও ছটি শব্দ যুক্ত হয়েছে এবং কবিতাটির শেষ স্তবক উৎসর্গ-পত্রের শেষ স্তবক থেকে একেবারেই ভিন্ন।] এমিলির বন্ধু মার্গারেট যখন ১৯৬৩-এ এলিয়টের লেখায় এমিলির কথা কোথায় এবং কতটুকু বলা আছে, তা এমিলিকে খুঁজে বের করতে বলেন, তখন মার্গারেটের স্বামী প্রফেসর উইলার্ড্ র্থপ্কে এমিলি লেখেন : ‘মার্গারেট যা বলছে, তা আমি পরে করার চেষ্টা করবো – যদিও তাঁর কবিতায় আমার কথা যা আছে, তা খুবই সামান্য (‘মাইটি লিটল্’)।’ তার পরেও, অনেকদিন ধরে কবিতা লিখতে না পারা, এমিলির সঙ্গে নতুন করে যোগ তৈরি হওয়া, আবার কবিতা লেখা হওয়া – এইসব ঘটনা এলিয়টের মনে এমিলির জেগে ওঠার কারণেই, মনে হয়, ঘটে।

উনিশ শ বত্রিশ-এর জানুয়ারিতে এমিলি যুক্তরাষ্ট্রের পুবের সমুদ্রতট ছেড়ে পশ্চিমের সমুদ্রতটে চলে যান – ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লের্য়ামন্টে স্ক্রিপ্স্ কলেজে মৌখিক (‘অরাল’) ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এলিয়টও ১৯৩২-৩৩ শিক্ষা-বছরে চার্লস্ এলিয়ট নর্টন অধ্যাপক হিসেবে হার্ভার্ডে আসেন। রেলগাড়িতে তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এক শীতের সকালে এলিয়ট বোস্টন থেকে ক্লের্য়ামন্টে পৌঁছান – এমিলি প্ল্যাটফর্মে তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমিলি ও এলিয়ট বাল্বোয়া দ্বীপে যান; করোনা ডেল মার বেলাভূমিতে ঘুরে বেড়ান; প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রসৈকত এলিয়টকে মুগ্ধ করে। এই প্রথমবার, যখন এলিয়ট ও এমিলির সম্পর্ক কারও কাছে লুকোনো থাকে না। ১৯৩৩-এর জুনে এমিলি চলে আসেন বোস্টনে। এলিয়ট বিখ্যাত লোক, এখানে তাঁকে ঘিরে বহু মানুষের ভিড়। ডরোথি এল্স্মিথ্ নামে এক বন্ধুর বাড়িতে কয়েক বার যান এলিয়ট ও এমিলি; সেখানে, কেম্ব্রিজের লোকজন থেকে দূরে, সমুদ্রের কাছাকাছি ঘুরে বেড়ান।

এলিয়ট এরপর ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ভিভিয়েনের কাছ থেকে আইনগতভাবে আলাদা হতে চান – আইনের পরিভাষায় যাকে বলে ‘সেপারেশন’ – কিন্তু ভিভিয়েন রাজি হন না। এলিয়ট নিজের ঠিকানা কাউকে জানতে দেন না, ভিভিয়েনের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ান। ১৯৩৪-এ এমিলি স্ক্রিপ্স্ কলেজ থেকে এক বছরের ছুটি নেন। জুলাইয়ে চলে আসেন চিপিং ক্যাম্ডেনে। ইংল্যান্ডের গ্লর্স্টাশায়ারে চিপিং ক্যাম্ডেন্। এলিয়টও প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পৌঁছে যান সেখানে, তারপর বারবার ফিরে যান। গ্রামের পথে-পথে বহু সময় ধরে হেঁটে বেড়ান দুজন। এ নিয়ে এক মজার কবিতাও লেখেন এলিয়ট; কবিতাটির নাম : ‘এ কান্ট্রি ওয়াক্ : এন এপিস্ল্ টু মিস্ ই – এইচ – উইথ্ দ্য আম্বল্ কম্প্লিমেন্ট্স্ অব হার অব্লাইজ্ড্ র্সাভেন্ট, দ্য অথর’। গোরু দেখে একজন মানুষ কী রকম ভয় পেতে পারে, এ কবিতায় তা বলা আছে; মানুষটির মনে হয়,  প্রত্যেক গাছের আড়ালে একটি করে ষাঁড় শিঙ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবিতাটি কোথাও বেরোয়নি।

চিপিং ক্যাম্ডেন্ থেকে দু মাইলের মতো দূরে বার্ন্ট্ র্নটন। সেখানে যান এলিয়ট ও এমিলি। সম্ভবত ১৯৩৪-এর আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে। বার্ন্ট্ র্নটন হ্যারোবাইয়ের আর্লদের বাড়ি। যখন এলিয়ট ও এমিলি যান, তখন সেখানে আর্ল বা কাউন্টেস্ কেউই থাকতেন না। বাড়ির ভেতরে নয়, তাঁরা বাগানে ঘুরে বেড়ান। রাস্তার দু পাশে গোলাপ ফুটে ছিলো, রাস্তাটি চলে গিয়েছিল লনের ঠিক মাঝখানে, সেখানে দুটি বড়ো জলাশয় ছিলো, কিন্তু সেগুলোতে পানি ছিলো না। এই ছবি ফুটে ওঠে কয়েক মাস পরে লেখা ‘বার্ন্ট্ র্নটন’ শিরোনামের  কবিতায়, যা এখন র্ফো কোয়ার্টেট্স্-এর প্রথম কবিতা : ‘… দ্য রোজেজ্/ হ্যাড দ্য লুক অব ফ্লাওর্য়াস্ দ্যাট আর লুক্ড্ অ্যাট।/ … সো উই মুভ্ড্, অ্যান্ড দে, ইন আ র্ফমাল প্যাটার্ন,/ অ্যালঙ দ্য এম্প্টি অ্যালি, ইন্টু দ্য বক্স্ সার্কেল,/ টু লুক ডাউন ইন্টু দ্য ড্রেইন্ড্ পুল।’ এর একটু আগে শোনা যায় : ‘ফুট্ফল্স্ ইকো ইন দ্য মেমোরি/ ডাউন দ্য প্যাসেজ হুইচ উই ডিড নট টেইক্/ টুওয়ার্ড্স্ দ্য ডোর উই নেভার ওপেন্ড্/ ইন্টু দ্য রোজ-গার্ডেন।’ এ কি কেবল এই কবিতার মানুষটির কথা, নাকি, এলিয়টেরও? স্মৃতিতে কার পায়ের আওয়াজ বেজে ওঠে? কী সেই পথ যা ধরে এগুনো যেতো, কোন সেই দরোজা যা খোলা যেতো, পৌঁছে যাওয়া যেতো গোলাপ-বাগানে, কিন্তু যে-পথ নেয়া হয়নি, যে-দরোজা খোলা হয়নি? আর, এই কথাগুলো কি কবিতার মানুষটির একার? তা-ও নয়। ‘… মাই ওয়ার্ড্স্ ইকো/ দাস্, ইন ইয়োর মাইন্ড্।’ এইদিক থেকে দেখলে এই কবিতার প্রথম তিনটি পঙ্ক্তিও অন্য মাত্রা পেয়ে যায় : ‘টাইম প্রেজেন্ট্ অ্যান্ড টাইম পাস্ট্/ আর বোথ্ র্পাহ্যাপ্স্ প্রেজেন্ট্ ইন টাইম ফিউচার/ অ্যান্ড টাইম ফিউচার কন্টেইন্ড্ ইন টাইম পাস্ট্।’ [এই কথাগুলো সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এইভাবে লেখেন : ‘বর্তমান কাল আর ভূতকাল, উভয়ে বুঝি বা/ বর্তমান ভাবীকালে; এবং আশ্রিত ভাবীকাল/ ভূতকালে।’] এই যে গোলাপ-বাগানে একজন মানুষের এখনকার সময়, আর এই যে তার ফেলে-আসা দিন, যে-দিনগুলোতে গোলাপ-বাগানের দরোজা সে খোলেনি, ভবিষ্যতের দিনগুলোয় দুয়েরই জায়গা হবে, আর ভবিষ্যতের সেইদিন ফেলে-আসা দিনের ওপরই দাঁড়িয়ে থাকবে। তার মানে, সব এখনও ফুরিয়ে যায়নি, সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

এমিলি হেইল ১৯৩৫-এর পুরোটুকুই ইংল্যান্ডে থেকে যান, যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান সে-বছরের ডিসেম্বরে। সময়মতো ফিরে না আসায় ততোদিনে স্ক্রিপ্স্ কলেজে তাঁর চাকরিটি চলে গেছে। ১৯৩৫-এর ৬ই ডিসেম্বর রুথ জর্জকে এক চিঠিতে এমিলি লেখেন, ‘আগামী বছর কোনও রকমের একটি চাকরি পাওয়ার জন্য আমাকে আমার সব শক্তি নিয়োগ করতে হবে।’ একই চিঠিতে লিয়োনার্ড্ ও ভার্জিনিয়া উল্ফের সঙ্গে তাঁদের ছাপাখানা ‘হোগার্থ্’-এর ওপরতলায় তাঁদের বাড়িতে একটি বিকেল কাটানোর বিবরণ দেয়া আছে; এলিয়টের অনুরোধে লিয়োনার্ড্ ও ভার্জিনিয়া তাঁকে ও এলিয়টকে ১৯৩৫-এর ২৬শে নভেম্বর চা খেতে ডেকেছিলেন; সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন তখনকার এক তরুণ কবি; তাঁর নাম স্টিফেন্ স্পের্ন্ডা।

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে স্মিথ্ একাডেমীতে চাকরি পেয়ে যান এমিলি। ১৯৩৬-এ এলিয়ট যুক্তরাষ্ট্রে যান। ওই এক বছর ছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) শুরু হবার আগে পর্যন্ত, স্মিথ্ একাডেমীর প্রতিটি শিক্ষাবছর-শেষে, এমিলি গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে আসেন। ১৯৩৮-এর জুলাইয়ে এলিয়ট ডার্বিশায়ারের সোয়ান্উইকে কবিতা পড়তে যান; তাঁর সঙ্গে এক মহিলা ছিলেন; এই মহিলাকে দেখে মেরি ট্রেভেলিয়ানের মনে হয়েছিল, তিনি এলিয়টের স্ত্রী; এমিলিই সম্ভবত সেই মহিলা। এই কবিতা পড়ার আসরেই এলিয়টের সঙ্গে মেরি ট্রেভেলিয়ানের প্রথম দেখা হয়। মেরি ট্রেভেলিয়ান্ পরে এলিয়টের আরেক প্রেমিকা হয়ে যান। যুদ্ধের সময় যখন এমিলির কাছ থেকে দূরে ছিলেন এলিয়ট, তখন তাঁর সঙ্গে মেরির সখ্য বাড়ে।

১৯৩৭-এর শেষ এবং ১৯৩৮-এর প্রথম দিকে এলিয়ট তাঁর দ্বিতীয় কাব্যনাটক দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন-এর খসড়া তৈরি করেন; খসড়াটি এখন আছে হার্ভার্ড্ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গ্রন্থাগারে; নাটকটি প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয় ১৯৩৯-এর মার্চে, বই হিসেবেও বেরোয় কাছাকাছি সময়ে। এমিলির পরামর্শে এ নাটকের খসড়ায় দুটি বড়ো ধরনের পরিবর্তন করেন এলিয়ট। এক, এ নাটকে মেরি নামের চরিত্রটি একসময় তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমিলি বলেন, এ ক্ষোভ নাটকটির ঠিক জায়গায় বসানো হয়নি। এলিয়ট মেরির এই সংলাপটি নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে সরিয়ে আনেন, তা কিছুটা কেটে দেন ও তার তীব্রতা কমিয়ে আনেন। ফলে, মেরির চরিত্রটি হয়ে যায় এমন এক মানুষের যে সবকিছু কেবল দেখতেই থাকে এবং কেবল অপেক্ষা করেই থাকে। দুই, এই নাটকের নায়ক হ্যারি ‘ইউমেনিডিজ্’দের দেখতে পায়; গ্রিক নাটকে যারা ‘ফিউরি’, তাদেরই একটু ঘুরিয়ে, প্রশংসা করার ছলে, ‘ইউমেনিডিজ্’ (‘দয়াবান’) বলা হয়; ‘ফিউরি’দের কাজ বিবেক ও অনুতাপবোধ জাগিয়ে তোলা, অপরাধীদের যে-অভিশাপ দেয়া হয়, তা কার্যকর করা। এমিলি এ-নাটকের খসড়ায় লেখেন, ‘হ্যারি ‘ফিউরি’দের এখন যেভাবে দেখতে পায়, তার তা ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকা উচিত এবং যে-দৃশ্যে হ্যারি অ্যামির সঙ্গে কথা বলে, তা আরও জোরালো হওয়া উচিত।’ এই পরামর্শ মেনে নিয়ে এলিয়ট নাটকটির দ্বিতীয় পর্বে দ্বিতীয় দৃশ্যের শেষে একটি অংশ জুড়ে দেন। এই অংশটি শুরু হয় অ্যামির প্রশ্ন দিয়ে, ‘বাট্ হোয়াই আর ইউ গোয়িং?’ এবং শেষ হয় হ্যারির কথা দিয়ে, ‘আই মাস্ট ফলো দ্য ব্রাইট্ এন্জেল্স্।’

এক মানসিক-রোগী-নিবাসে ১৯৪৭-এর ২২শে জানুয়ারি ভিভিয়েন হঠাৎ করে মারা যান। এই মৃত্যুর ফলে এলিয়টের এমিলিকে বিয়ে করার পথে আর কোনও বাধা থাকে না, কিন্তু এলিয়ট সে-পথে অগ্রসর হন না। সে-বছরেরই এপ্রিলে এলিয়ট যুক্তরাষ্ট্রে যান। এলিয়ট সেখানে পৌঁছুনোর কিছুদিন পরেই তাঁর একমাত্র ভাই হেনরি মারা যান। এর কিছুদিন পরে হেনরির বিধবা স্ত্রী একদিন তাঁর বাড়িতে এলিয়ট ও এমিলিকে ডাকেন। এমিলিকে ভাবেন তাঁর প্রয়াত স্বামীর ভাইয়ের ভাবী বধূ। সেখানে পৌঁছে এলিয়ট এমন ক্ষেপে যান যে, হেনরির স্ত্রী তা জীবনে ভুলতে পারেন না। এরপরও এলিয়ট যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে-থাকতেই এমিলির সঙ্গে তাঁর কয়েকবার দেখা হয়। ওই বছরের সাতই আগস্ট এমিলি এক চিঠিতে তাঁর বন্ধু লোরেইন্ হ্যাভেন্স্কে লেখেন : ‘… অনেক দিন আগে আমি তোমাকে তার ও আমার যে-পারস্পরিক প্রীতির (‘মিউচুয়াল্ অ্যাফেক্শন্’) কথা বলেছিলাম, তা এখন এক অদ্ভুত অচলাবস্থায় (‘স্ট্রেঞ্জ ইম্পাস্’) এসে পৌঁছেছে, স্থায়ী, নাকি, সাময়িক, তা আমি বলতে পারবো না।’ ভিভিয়েনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে এমিলি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, এরপর আমাকে বিয়ে করার স্বাধীনতা সে পেয়ে যাবে, এটি সে সবসময়ই করতে চেয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু এখন ব্যাপারটি এ রকম মনে হচ্ছে না।’ আরও লেখেন, ‘… সে আমাকে ভালোবাসে  আমি তা পুরোপুরি বিশ্বাস করি। কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে, কম প্রতিভাবান লোকদের মতো করে নয়, অর্থাৎ, দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্য দিয়ে প্রেমকে পূর্ণতা দিয়ে নয়। আমি আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিইনি যে, এ অবস্থা – যা আমার কাছে এক অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে মনে হয় – থেকে সে হয়তো একদিন উদ্ধার পেতে পারে, কিন্তু, অন্যদিকে, এরকম একটি অনিশ্চিত ও নাজুক অবস্থার কাছে আমি আত্মসমর্পণও করতে পারি না।’ সে-বছরের জুন মাসে এলিয়ট আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। পরের বছর আবারও। এলিয়ট ১৯৪৮-এ যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার আগে
সে-বছরেরই ১২ই সেপ্টেম্বর এমিলি আরেক চিঠিতে লোরেইন্কে লেখেন : ‘এই শীতে অতিথি-বক্তা হিসেবে টি. এস. এলিয়ট প্রিন্স্টনের ইন্স্টিটিউট্ অব হায়ার এজুকেশনে আসবেন, কিন্তু আমার মনে হয় না, তাঁর সঙ্গে আমার খুব একটা দেখা হবে (‘বাট আই এক্স্পেক্ট্ আই শ্যাল সি হিম ওন্লি অকেজনালি’)।

এমিলির সঙ্গে এলিয়টের যোগ কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। দু বার, এক বার ১৯৪৮-এ এবং আবার ১৯৫২-তে, এলিয়ট অ্যান্ডোভারে যান – এমিলি তখন সেখানে পড়ান। ১৯৫৩-এর আগস্টে এমিলি যখন লন্ডনে আসেন, এলিয়ট তাঁকে রেলস্টেশনে স্বাগত জানান – এ সময় মেরি ট্রেভেলিয়ানের সঙ্গে তাঁর উইর্ন্ড্জ যাবার কথা ছিলো, কিন্তু তা তিনি বাতিল করেন। ওই মাসেরই শেষ দিকে যখন এডিন্বরায় এলিয়টের চতুর্থ কাব্যনাটক দ্য কন্ফিডেন্সিয়াল্ ক্লার্ক প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয়, তখন এমিলি ও মেরি দু জনই তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সে-সময় এমিলিকে দেখে এলিয়টের ভাগ্নি থিয়োডোরার মনে হয়েছিল, এমিলির আসা উচিত হয়নি – আগে যা ছিলেন, এমিলি এখন তার ‘ম্লান ছায়া’ মাত্র।

১৯৫৭-র ১০ই জানুয়ারি এলিয়ট তাঁর একান্ত সচিব ভ্যালেরি ফ্লের্চাকে বিয়ে করেন। এটি তাঁর বন্ধু জন হেওয়ার্ড্ ও মেরিকে অবাক করে দেয়। [এর কদিন আগেও, জানুয়ারির দু তারিখে, রাসেল হোটেলে মেরির সঙ্গে দু ঘণ্টা গল্প করে কাটান এলিয়ট।] এ বিয়ের খবর শুনে এমিলি একেবারে ভেঙে পড়েন। তখন কাজ করতেন এবট্ একাডেমিতে; সেখান থেকে অবসর নেন; অসুস্থ হয়ে পড়েন; হঠাৎ করে বয়স যেন দশ বছর বেড়ে যায়; বেতে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন; লোকজন থেকে দূরে একা-একা থাকেন; এলিয়টও তাঁর আর কোনও খোঁজ নেন না।

১৯২৭ থেকে ১৯৫৭ – এই তিরিশ বছরে এমিলিকে এক হাজারেরও বেশি চিঠি লেখেন এলিয়ট, এতো চিঠি আর কাউকে লিখেছেন বলে জানা যায় না। এমিলি এই চিঠিগুলো প্রিন্স্টন্ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেন – ২০১৯-এর বারোই অক্টোবরের (যেদিন এমিলির মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে) আগে এগুলো দেখা যাবে না। এমিলি এই চিঠিগুলো প্রিন্স্টন্কে দিয়ে দেয়ায় এলিয়ট ক্ষুব্ধ হন। যে-প্রকাশনা সংস্থার এলিয়ট একজন পরিচালক ছিলেন, সেই ফের্বা অ্যান্ড্ ফের্বা-এর আরেকজন পরিচালককে ১৯৬৩-তে কিছু চিঠি দিয়ে এলিয়ট তাঁকে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে বলেন এবং তিনি সেগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। এগুলো সম্ভবত এলিয়টকে লেখা এমিলির চিঠি। এতে এমিলি আহত বোধ করলেও একই সঙ্গে কৃতজ্ঞও বোধ করেন : ‘…আমাদের ‘প্রেম’-কে দারুণভাবে আড়াল করে রাখতে চেয়েছেন তিনি … হয়তো তিনি আমাকে বাঁচাতেই চেয়েছেন (‘প্রোটেক্ট্ মি’), কেবল নিজেকে বা ভ্যালেরিকে নয়। কে বলতে পারে?’ (উইলিয়ার্ড্ র্থপ্কে ২৭.১১.৬৫ তারিখে লেখা চিঠি)। লক্ষ করার মতো, ‘প্রেম’ (‘অ্যাফের্য়া’) কথাটি এমিলি উদ্ধৃতি-চিহ্নের মধ্যে লেখেন।

উনিশ শ তেষট্টি-র বারোই সেপ্টেম্বর এলিয়টকে এক চিঠি লেখেন এমিলি। এ-ই সম্ভবত এলিয়টকে লেখা এমিলির শেষ চিঠি। চিঠিটি শুরু হয় এইভাবে : ‘প্রিয় টম,/ আমাদের মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে যে-নীরবতা বিরাজ করছে, তা ভাঙা  কঠিন, … কিন্তু আমাদের দুজনেরই সাহস ও নির্লিপ্ততার সঙ্গে কিছু সত্য ও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হবার এখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।’ এমিলিকে লেখা এলিয়টের চিঠিগুলো এমিলি বা এলিয়ট, যাঁরই মৃত্যু পরে হবে, তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পেরুনোর আগে কেউ দেখতে পাবে না, এলিয়টের বেঁধে দেয়া এই সময়সীমা কমিয়ে আনা যায় কিনা, তা ভেবে দেখার জন্য এলিয়টকে অনুরোধ করেন এমিলি। তারপর লেখেন : ‘আমার মনে হয় এ বিষয়ে তুমি সচেতন যে, তোমার সঙ্গে – তুমি তো এক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তি – সম্পর্কের কারণে আমার জীবনকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা আমার জন্য খুবই কঠিন। … আমি ভীষণ আশা করে আছি, আমাদের ওপর যা আরোপিত হয়েছে (‘হোয়াট্ ইজ্ থ্রাস্ট্ আপ্অন্ আস্’), তা তুমি মেনে নেবে (‘অ্যাক্সেপ্ট্’) – বলা কি যাবে – তুমি তুমি বলেই মেনে নেবে (‘বিকজ ইউ আর ইউ’)।’ [রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি যে তুমিই, ওগো’ মনে পড়ে যায় কি? না, এমিলির চিঠিতে ‘তুমি’র ‘তুমি’ হয়ে ওঠা কোনও তত্ত্বকথা নয়, এইকথা গভীর আবেগ ও বিশ্বাস থেকে বলা।] চিঠিটির শেষে, নাম সই করার আগে, এমিলি লেখেন : ‘পুরোনো বন্ধুত্বের কথা মনে করে’ (‘ইন দ্য থট্ অব্ পাস্ট্ ফ্রেন্ড্শিপ্’)। এলিয়ট এ-চিঠির কোনও উত্তর দেননি।

দুই

এমিলিকে ভালো তো নিশ্চয়ই বাসতেন এলিয়ট, তাঁর বহু লেখার অনুপ্রেরণা ও কখনও-কখনও উৎস এমিলি, হঠাৎ করে হলেও তাঁকে বিয়ে করার পথও তো খুলে গিয়েছিল, কিন্তু তবু এমিলিকে এলিয়ট বিয়ে করলেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর কেবল অনুমানই করা যেতে পারে – এলিয়ট কোথাও এ-উত্তর সরাসরি দিয়েছেন, এমনটি আমার জানা নেই।

এলিয়টের কাব্যনাটক দ্য কক্টেল পার্টি-র এড্ওয়ার্ড্ ও সেলিয়াকে তো কখনও-কখনও (সব সময় নয়) এলিয়টের নিজের ও এমিলির মতোই মনে হয়। এড্ওয়ার্ড্ সেলিয়াকে বলে, ‘ইফ্ আই হ্যাভ এভার বীন ইন লাভ – অ্যান্ড্ আই থিঙ্ক্ আই হ্যাভ -/ আই হ্যাভ নেভার বিন ইন লাভ উইথ এনিওয়ান্ বাট্ ইউ,/ অ্যান্ড্ র্পাহ্যাপ্স্ আই স্টিল্ অ্যাম।’ এলিয়ট ও এমিলির বেলায়, এলিয়টের দিক থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত এ কথা তো নিশ্চয়ই সত্য বলে মনে হয়, ১৯৫৭-র পরেও তা সত্য হওয়া অসম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের এক গানে গানের মানুষটি বলে, ‘এসো আমার ঘরে।/ বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে’ (গীতবিতান)। সে বলে, তার মনের যে-মানুষ, সে ‘স্বপনদুয়ার খুলে’ ‘অরুণ-আলোকে’ চলে আসুক, ‘দুঃখসুখের’ দোলায় আসুক, ‘প্রাণের হিল্লোলে’ আসুক। এলিয়ট এমনি বলেন না। হতে পারে, তিনি চান তাঁর স্বপ্নের নারী কেবল স্বপ্নের নারীই হয়ে থাকুক। একজন শিল্পীর স্বপ্নের নারী আর একজন সাধারণ মানুষের স্বপ্নের নারী কিন্তু এক না-ও হতে পারে। শিল্পীর স্বপ্নের নারী শিল্পের পথ খুলে দেয়, শিল্প জাগিয়ে তোলে। ‘এসো আমার ঘরে’ এই গানটির যে-মানুষ, তার নারীও স্বপ্নেরই নারী, কিন্তু সে তো আর শিল্পের পথ খুলে দেয় না, অন্তত খুলে যে দেয়, তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। স্বপ্ন থেকে জীবনে চলে আসা, ‘ফাগুনবাতাসে’ ‘আশার অরূপ বাণী’ হয়ে যে-চলার শুরু, প্রতিদিনের জীবনে ‘প্রফুল্ল­’ ফুল হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তা শেষ হওয়া, এ তো তার এক স্বাভাবিক পরিণতি, শুধু স্বাভাবিকই, সম্ভাব্যও। শিল্পী তো তাঁর স্বপ্নের নারীর বেলায় এমনটি না-ও চাইতে পারেন। তাঁর কাছে, স্বপ্নের নারীর ঘরে চলে আসার চাইতে তার থেকে দূরে থেকে শিল্পের প্রেরণা হয়ে থাকাই অনেক বেশি জরুরি মনে হতে পারে। দ্য কক্টেল পার্টি নাটকে পিটার সেলিয়াকে ভালোবাসে; পিটার একজন শিল্পী – সে উপন্যাস লেখে, চলচ্চিত্রেও তার উৎসাহ আছে; কিন্তু সেলিয়া পিটারকে ভালোবাসে না, তার কাজ শুধু সমাজে পিটারকে পরিচিত করে তোলা, তার নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টা করা, কখনও-কখনও তাকে কন্সার্টে নিয়ে যাওয়া। পিটার যখন এড্ওয়ার্ড্কে তার সেলিয়াকে না-পাওয়ার ও সে-না-পাওয়া থেকে জেগে-ওঠা বেদনার কথা বলে, এড্ওয়ার্ড্ তাকে বলে, ‘ইন আ লিটল্ হোয়াইল্/ দিস মাইট হ্যাভ বিকাম অ্যান অর্ডিনারি অ্যাফের্য়া/ লাইক এনি আদার। অ্যাজ দ্য ফিবার কুউল্ড্/ ইউ উড্ হ্যাভ ফাউন্ড দ্যাট শি ওয়াজ অ্যানাদার উম্যান/ অ্যান্ড্ দ্যাট ইউ ওয়ের অ্যানাদার ম্যান।’ এমনি যাতে না হয়, সে জন্যই কি এমিলিকে বিয়ে করেন না এলিয়ট? এড্ওয়ার্ড্ পিটারকে বলে, ‘আই কন্গ্রাচুলেট্ ইউ/ অন আ টাইম্লি এস্কেইপ্।’

এমিলিকে এলিয়টের বিয়ে না করার আরও একটি কারণ হতে পারে, ‘রিয়েলিটি’ বলতে যা বোঝায়, সে-সম্পর্কে এলিয়টের ধারণা। ‘রিয়েলিটি’ তো, এক দিক থেকে, ‘বাস্তবতা’, আমরা যা দেখি, যা শুনি, জীবনে যে-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই, তা-ই; অন্যদিকে, ‘রিয়েলিটি’ এইসব দেখার, শোনার ও অভিজ্ঞতার গভীরে যে-আসল বিষয়টি লুকিয়ে থাকে, তা, কেউ-কেউ হয়তো একে ‘সত্য’ও বলতে চাইতে পারেন। পিটার এড্ওয়ার্ড্কে বলে ‘ইট ইজ নট্ হার ইন্টারেস্ট্ ইন মি দ্যাট আই মিস্ -/বাট্ দোজ্ মোমেন্ট্স্ ইন হুইচ উই সীম্ড্ টু শের্য়া সাম্ র্পাসেপশ্ন্,/ সাম্ ফীলিং, সাম্ ইন্ডিফাইন্এবল্ এক্সপেরিয়েন্স্/ ইন হুইচ উই ওয়েরে বোথ আন্অ্যাওয়ের অব্ আওর্য়াসেল্ভ্স্।’ একটু পরে যোগ করে, ‘দেয়ার ওয়াজ সাম্থিঙ্ রিয়েল।’ বলে, ‘… হোয়াট্ ইজ্ দ্য রিয়েলিটি/ অব্ এক্স্পেরিয়েন্স্ বিট্উইন্ টু আন্রিয়েল পিপল্?/ ইফ আই ক্যান ওন্লি হোল্ড্ টু দ্য মেমোরি/ আই ক্যান্ বির্য়া এনি ফিউর্চা।’ একই কথা পরে এড্ওয়ার্ড্ সম্পর্কে সেলিয়াও বলে : ‘…আই থিঙ্ক্ আই রিয়েলি হ্যাড্ আ ভিশন অব্ সামথিঙ্/ দো আই ডোন্ট্ নো হোয়াট্ ইট্ ইজ। আই ডোন্ট ওয়ান্ট্ টু র্ফগেট ইট্।/ আই ওয়ান্ট্ টু লিভ্ উইথ্ ইট্।/ আই কুড্ ডু উইথআউট এভরিথিঙ্,/ পুট্ আপ উইথ এনিথিঙ্, ইফ্ আই মাইট্ চেরিশ ইট্।’ এই ‘রিয়েলিটি’ যাতে নষ্ট না হয়, কলুষিত হয়ে না যায়, সেজন্যই কি এমিলিকে বিয়ে করেন না এলিয়ট? কেবল স্মৃতির মধ্যেই বেঁচে থাকতে চান, সেই স্মৃতি, যা ভবিষ্যতে যা-ই ঘটুক না কেন, তা-ই মেনে নেয়ার মতো শক্তি ও সাহস দেয়?

এড্ওয়াড্র্রে স্ত্রী ল্যাভিনিয়া এড্ওয়ার্ড্কে ছেড়ে চলে যায়; পরে অবশ্য একজনের কথায় ফিরে আসে; সে-একজনকে প্রথমে দেখা যায় এড্ওয়ার্ড্রে বাড়িতে অচেনা অতিথি হিসেবে; পরে জানা যায়, তিনি মানসিক রোগের কৃতী চিকিৎসক। ল্যাভিনিয়া চলে যাওয়ার পর সেলিয়া যখন এড্ওয়ার্ড্কে বলে, ‘ডাজন্’ট্ দ্যাট্ সেট্ল্ অল্ আওয়ার ডিফিকাল্টিজ্?’ এড্ওয়ার্ড্ বলে, ‘ইট্ হ্যাজ্ ওন্লি ব্রট্ টু লাইট দ্য রিয়েল ডিফিকাল্টিজ্।’ ভিভিয়েনের মৃত্যুর পর এমনি কথা কি এমিলিকে বলে থাকতে পারেন এলিয়ট? কিংবা, এমনি কথা ভেবে থাকতে পারেন? কী এইসব সত্যিকারের সমস্যা, যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় না? এড্ওয়ার্ড্ সেলিয়াকে আরও বলে, ‘ইট হ্যাজ্ বীন ভেরি ওয়ান্ডারফুল্, অ্যান্ড্ আই অ্যাম ভেরি গ্রেইট্ফুল্,/ অ্যান্ড্ আই থিঙ্ক্ ইউ আর আ ভেরি রের্য়া র্পাসন্।/ বাট্ ইট্ ওয়াজ্ টু লেইট।’ এলিয়টেরও কি মনে হয়, এমিলিকে বিয়ে করার সময় পেরিয়ে গেছে, বড়ো বেশি দেরি হয়ে গেছে?

কিন্তু এসব তো বানানো গল্প – সত্যিকারের মানুষের নয়, বানানো মানুষের কথা। এর মধ্যে এলিয়টের জীবনকে কেন খুঁজতে যাবো আমরা? খুঁজবো না-ই বা কেন? কবিতায় যে-মানুষটির কথা শোনা যায়, তা কি কেবল সে-মানুষটির কথা, একই সঙ্গে কবিরও কথা নয় কি? যদি কবির কথাও হয়, তাহলে নাটকে যাদের কথা শোনা যায়, তাদের কথা একই সঙ্গে নাট্যকারের কথাও হতে পারবে না কেন, অন্তত কখনও-কখনও? বিশেষ করে কাব্যনাটকে, যেহেতু কাব্যনাটক কেবল নাটকই নয়, একই সঙ্গে কবিতাও? ‘বড়ো বেশি দেরি হয়ে গেছে’, সেলিয়াকে এ-কথা বলার পর-পরই এড্ওয়াড্র্ যোগ করে, ‘অ্যান্ড্ আই শুড্ হ্যাভ্ নোউন্/ দ্যাট ইট ওয়াজন্’ট্ ফেয়ার টু ইউ।’ কেন নয়? সেলিয়াকে বিয়ে করা মানে সেলিয়ার প্রতি সুবিচার না করা হতে যাবে কেন? সেলিয়া তার স্বপ্নের কথা বলে। বলে, ‘… দেন আই সাডেন্লি ডিস্কার্ভাড্/ দ্যাট দ্য ড্রিম ওয়াজ্ নট্ এনাফ; দ্যাট আই ওয়ান্টেড্ সাম্থিঙ্ র্মো …।’ বলে, ‘পারহ্যাপ্স্ দ্য ড্রিম ওয়াজ বেটার। ইট সীম্ড্ রিয়েল রিয়েলিটি,/ অ্যান্ড্ ইফ দিস্ ইজ রিয়েলিটি, ইট ইজ ভেরি লাইক আ ড্রিম।/ পারহ্যাপ্স্ ইট ইজ আই হু বিট্রেইড্ মাই ওয়ন্ ড্রিম/ অল্ দ্য হোয়াইল্; অ্যান্ড্ টু ফাইন্ড্ আই ওয়ান্টেড্/ দিস্ ওয়ার্ল্ড্ অ্যাজ্ ওয়েল্ অ্যাজ্ দ্যাট …।’ এলিয়ট তাঁকে বিয়ে করবেন, এমিলির এই আশা কি তাহলে এমিলির দিক থেকে খুব বেশি কিছু চাওয়া হয়ে গিয়েছিল? এলিয়ট কি ভেবেছিলেন, এমিলি কেবল স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকবেন?

এলিয়ট ও এমিলির সম্পর্ক আমাকে কেন যেন রবীন্দ্রনাথের একটি গান মনে করিয়ে দেয়। মনে আছে অ্যাশ্ ওয়েড্নেস্ডে-র ‘লেডি অব সাইলেন্সেসে’র কথা, যার সঙ্গে এমিলিকে এক বলে মনে হয়? রবীন্দ্রনাথের এই গানে গানের মানুষটি বলে, যে-নারীকে সে ভালোবাসে, সে তার ‘হৃদয়ে’ ‘নীরবে’ থেকে যাবে, থেকে যাবে ‘নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী’র মতো। এই নারী এ-মানুষটির ‘জীবন যৌবন’, ‘অখিল ভুবন’ সবই ‘গৌরবে’ ভরে দেবে? রাতের মতোই; তার দুঃখ-বেদনা ও ‘সফল’ স্বপ্ন ‘সৌরভে’ ভরে দেবে? রাতের মতোই। এলিয়ট কি এই মানুষটির মতো করেই এমিলিকে পেতে চেয়েছিলেন? [একজন মানুষের জীবনে তার স্বপ্নের নারী নীরব হয়ে থাকে কেন? কী এবং কেমন এই নীরবতা? একজন নারী তার ভালোবাসার মানুষটিকে ‘গৌরবে’ ভরে তো দিতেই পারে, কিন্তু তা রাতের মতো হতে যাবে কেন? এই নারী তার মানুষটিকে কেবল গৌরবেই ভরে দেয় না, তার সফলতা ও ব্যর্থতা, দুই-ই ‘সৌরভে’ও ভরে দেয়। এ-গানের প্রথম দু পঙ্ক্তিতে এ-নারীকে দেখা যায় পূর্ণিমা-রাতের মতো, কিন্তু পরের পঙ্ক্তিগুলোতে পূর্ণিমার কথাটি আর থাকে না, এই নারী যে-কোনও রাতের মতো হয়ে যায়।

একজন নারী তার ভালোবাসার মানুষটিকে গৌরবে ভরে দিতে চাইলে সে তা সে-মানুষটির কাছে থেকে যেমন করতে পারে, তেমনি সে-মানুষটি থেকে দূরে থেকেও করতে পারে। কিন্তু, সৌরভে? জীবনের সবকিছু যদি সৌরভে ভরে দিতে হয়, তাহলে জীবনের কালিমা থেকে, ক্লেদ থেকে সে-নারীর দূরে থাকাই তো ভালো। সৌরভের সঙ্গে যখন নীরবতা যুক্ত হয়, এক অনিবার্য, হয়তো বা স্ব-আরোপিত, বিরহের আবহ তৈরি হয় – আমার অন্তর তেমনটিই মনে হয়। এ গানের ঠিক উলটোটি আমার মনে হয় আরেকটি গান, যেখানে ‘জ্যোৎস্নারাতে সবাই’ বনে চলে যায়, ‘বসন্তের’ ‘মাতাল’ বাতাস বইতে থাকে, রাত আর নীরব থাকে না।

‘হোয়াট্ ইজ্ অ্যা ক্লাসিক্’ প্রবন্ধে ঈনিসের কথা বলেন এলিয়ট, যে, দেবতাদের আদেশে, ডিডোকে ছেড়ে যায়। ঈনিস্ বলে, ‘আমি তো কোনও চুক্তিতে বাঁধা নই, একজন স্বামী যে-মশাল জ্বালায়, তেমন কোনও মশাল আমি জ্বালিনি।’ পরে, অন্যলোকে, ডিডোর সঙ্গে দেখা হয় তার। ডিডো কোনও অভিযোগ করে না, এমন-কি কোনও কথাও বলে না, কেবল নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। ডিডোর এই চলে-যাওয়াকে ঈনিসেরই বিবেকের প্রতিফলন বলে মনে হয় এলিয়টের। যে-মানুষের কথা ভাবেন এলিয়ট, সে জানে, সে যা করে, বা করে না, তা সে নিয়তির – বা, এমন শক্তির, যার ওপর তার কোনও হাত নেই – কারণেই করে, বা করে না, কিন্তু তাই বলে সে মুক্তি পায় না, তার অপরাধবোধ থেকেই যায়, নিজেকে সে ক্ষমাও করতে পারে না। যে-নিষ্পাপ, যন্ত্রণার হাত থেকে তারও কোনও মুক্তি নেই। দ্য কক্টেল পার্টি-তে সেলিয়া সম্পর্কে জুলিয়া স্যার হেনরিকে বলে, ‘… ইউ সিম্প্লি ডু নট আর্ন্ডাস্ট্যান্ড্ ইনোসেন্স্।/ …শি ইজ টূ আম্বল্।/ শি উইল পাস্ বিট্উইন দ্য স্কোল্ডিং হিল্স্,/ থ্রু দ্য ভ্যালি অব্ ডিরিসন্, লাইক আ চাইল্ড সেন্ট অন অ্যান্ এরান্ড্/ ইন ইর্গানেস্ অ্যান্ড্ পেশেন্স। ইয়েট শি মাস্ট্ সার্ফা।’ যন্ত্রণাই যদি মানুষের ভাগ্য হয়ে থাকে, তাহলে প্রিয়জনকে দূরে রেখেই সে-ভাগ্যের মুখোমুখি হওয়া ভালো, এমনটি কি ভেবে থাকতে পারেন এলিয়ট?

প্রায় তেরো বছর কোনও যোগ না থাকার পর ১৯২৭-এর মে মাসে বোস্টন থেকে এমিলির চিঠি পেয়েছিলেন এলিয়ট। এর ক দিন পরেই, ১৯২৭-এর ২৯শে  জুন, খ্রিস্টধর্মের এক বিশ্বাস থেকে অন্য বিশ্বাসে ধর্মান্তরিত হন এলিয়ট। না, এ দুয়ের মধ্যে কোনও যোগ আছে, এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। এলিয়টের সামনে তখন দুটি পথ খোলা ছিলো : হয় প্রেমের পূর্ণতার, নয়তো ধর্মের কঠিন নিয়মানুবর্তিতার, মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের সমাধান খুঁজে পাওয়া, তাঁর একাকিত্বের অবসান ঘটানো; এলিয়ট দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু এমিলির সঙ্গে তাঁর যে-জীবন, তাও কি তাঁকে ধর্মের গভীর থেকে গভীরতর বোধে টেনে নিয়ে যায়নি? জীবনের এই সময়টুকুতে যে-কবিতা ও যে-নাটকই লিখেছেন তিনি, তার সবটুকুই ধর্মানুভূতির কবিতা, ধর্মানুভূতির নাটক।

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় (এপ্রিল ২০০৪/ বৈশাখ ১৪১১) প্রকাশিত হয়েছিল।