শামসুর রাহমান : তাঁর কবিতা

বাংলা ভাষাভাষী জগতে শামসুর রাহমানের মুখ্য পরিচয়, তিনি কবি। বেশ কিছুদিন থেকে তাঁকে দেশের প্রধান কবি আখ্যায়িত করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যখন তিনি এভাবে আখ্যায়িত হন, সেটা যতই বাহুল্য হোক, যতই পুনরাবৃত্তিমূলক হোক, আমরা বিনা তর্কে আমাদের সম্মতি জানাই। সময়ের হিসেবে মোটামুটি সিকি শতাব্দীকাল ধরে কবিতার এই উচ্চাসনে তাঁর অধিষ্ঠান। ইতোমধ্যে কবিতায় নতুন কণ্ঠস্বর শোনা গেছে। ইতোমধ্যে ষাটের দশকের আগন্তুক কবিদল অনেকেই নিজ নিজ স্বতন্ত্রভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়েছেন, নিজ নিজ স্বতন্ত্র পরিচয়ে পরিচিত হয়েছেন। ষাটের দশকের কবিতায়, বাংলাদেশের কবিতায় একটি স্পষ্ট পালাবদলের কাজ চলেছিল, যার ভিত্তি রচনায় শামসুর রাহমানের অবদান ছিল সর্বাধিক। কবিতায় শামসুর রাহমানের এর পূর্ববর্তী এক দশকের অর্জনকে এই নবাগতরা চমৎকারভাবে আত্মগত করেছিলেন। অথচ তারপরও হারিয়ে যাননি। ভেসে যাননি, স্বভূমে স্থিত থেকেছেন, নিজের ক্ষেতেই নিজের ফসল ফলিয়েছেন। গ্রহণ, আত্তীকরণ ও স্বনিষ্ঠতায় বিকশিত হওয়ার এই সাহিত্যিক ধর্মাচরণ, এর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে শামসুর রাহমান। তাঁর জন্য এ এক পরিতৃপ্তিকর ঘটনা যে তাঁর উত্তরসূরিগণ, পরবর্তী চার দশকের প্রজন্মান্তরের কবিগণ, নিজেরাও এভাবে কবিতার পথে যাত্রা করেছেন, বাংলাদেশের কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন।

বাংলাদেশের কবিতায় এক পরম্পরাগত ধারার জন্ম হয়েছে, যার প্রধান ও অন্যতম প্রত্যক্ষ উৎস শামসুর রাহমানের কবিতা। তাঁর নিজের কবিতার প্রবহমানতায় ছেদ পড়েনি। তাঁর পূর্ণ প্রৌঢ়ত্বেও তিনি কথা বলেছেন প্রেমিকের কণ্ঠস্বরে, যৌবনের অহমিকায়, প্রতিবাদীর তীক্ষ্নতায়, সবুজ প্রাণের মুগ্ধতায়। তাঁর কবিতার অবিরল ও ফসলপ্রদ বৃষ্টিধারা বাংলা কবিতার জমিন সরস ও সিক্ত রেখেছে। সেই মাটিকে নতুন শস্যের অনুকূল উর্বরতা দান করেছে।

এই যে কথাগুলো কলমের মুখে বেরিয়ে এল, এখন এ মুহূর্তে আমার চিন্তাটা এ রকম : এর একটি কথাও তো নতুন নয়। বিগত বিশ-পঁচিশ বছরকাল নানাজনের মুখে আমরা একই কথা নানাভাবে শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়িনি কি? কবিতায় তাঁর সিদ্ধি ও খ্যাতি বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে অনেক আগেই কি বিস্তৃত হয়নি বৃহত্তর বাংলাজগতে ও সেই সুবাদে বহির্বিশ্বেও? বৃহত্তর বাংলা জগতে তাঁর খ্যাতি, তাঁর কবিতার সমাদর যেমন প্রশ্নাতীত, তাঁর কবিপ্রতিষ্ঠা যেমন দৃঢ়ভিত্তিক, বহির্বিশ্বে তা নয়। যত বড় তাঁর কৃতি, তত ব্যাপক নয় তাঁর পরিচিতি। ভাষার ব্যবধান তৈরি করেছে এই অপরিচয়ের প্রাচীর। কবিতার ভাষান্তর এক দুরূহ কর্ম। যে-কোনো বাঙালি কবির বিশ্বপরিচিতি সম্পূর্ণ হবে না, হতে পারবে না, যতদিন না বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ও চর্চার বিষয় হচ্ছে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বাংলাদেশে সাত-পুরুষের শিক্ষা ও চর্চার বিষয় হওয়ার কারণে আমরা ওদের কবিতা, উপন্যাস, নাটকের প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছি ও তার খণ্ডাংশ অনুবাদের মাধ্যমে আনতে পেরেছি আমাদের ভাষায়।

শিক্ষা ও যোগ্যতা থাকলে আমরা শেকসপিয়রকে চিনতে পারি তাঁর সম্পূর্ণতায়। তুলনায় ওরা, ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান-রুশ জগতের ওরা, আমাদের রবীন্দ্রনাথকে চেনে অত্যন্ত খণ্ডিত পরিচয়ে। শামসুর রাহমানই বা তার ব্যতিক্রম হবেন কেন? তাঁর কবিতার অনুবাদ হয়েছে, কিছু গ্রহণযোগ্য মানের অনুবাদও হয়েছে, কিন্তু অনুবাদের ক্ষমতা সীমিত।

শামসুর রাহমান কবিতা লেখেন প্রতিদিনের ডায়েরি লেখার মতো। বিগত বছরগুলোতে তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবেই এই প্রাত্যহিকতার ছাপ পড়েছে। কোনো এক সকালের আলোয় দেখা দৃশ্য, কোনো এক সন্ধ্যায় টেলিফোনে কারো প্রিয় কণ্ঠস্বর, কোনো এক অলস অপরাহ্ণে মনে পড়ে যাওয়া অতীতের এক সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতি, এমনি আরো অনেক কিছু যা প্রত্যহের দান, সবই কবিতার স্তরে তিনি তুলে নেন অবলীলাক্রমে। সাধারণকে দান করেন অসাধারণত্ব। কবিতার জন্য বিরল মুহূর্তের দুর্লভ প্রেরণার অপেক্ষায় তিনি থাকেন না। তাঁর অনুভূতির মায়াবী বৃত্তে যা কিছু প্রবেশ করে, মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এর পিছনে কাজ করে এক দিকে তাঁর দৃষ্টির ও অনুভূতির স্বাতন্ত্র্য, ও সেই সঙ্গে তাঁর নির্মাণের কৌশল। পঞ্চাশ বছরের নিরলস চর্চায় কবিতা হয়েছে তাঁর একান্ত বশীভূত। তাঁর ডাকে সাড়া দিতে সদাপ্রস্তুত। অধিকাংশের বেলায় কবিতা চলে অনেকটা নিজের খেয়ালে, ব্যতিক্রমীদের মধ্যে নিঃসন্দেহে পড়েন আমাদের প্রধান কবি।

শামসুর রাহমানের সমগ্র কাব্যসৃষ্টি, পরিমাণগতভাবেও বিস্ময়কর। অঙ্কের হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম যদি না-ও করে থাকেন, তাঁর অনতিদূরত্বেই আছেন তাঁর পরেই। এক্ষেত্রে এই সংখ্যার হিসাবও বালখিল্যতা হতো, যদি না ওই কবিশ্রেষ্ঠর মতো তাঁরও থাকত মানগত স্থিরতা। লেখা যখন প্রতিদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়, তার অপ্রতিরোধ্য দাবি নিয়ে হাজির হয়। প্রতিদিন – প্রতিদণ্ডে প্রতিপলে না হলেও – তখন তার পরিচর্যায় ত্রুটি ঘটতে পারে মাঝে-মধ্যে। তখন প্রতিটি কবিতায়, প্রতিটি কাব্যে, নির্ভেজাল নতুনত্বের আশা দুরাশা হতে বাধ্য। কিন্তু প্রতিটি কবিতাই একটি পৃথক সত্তা, একটি নির্মাণ। আর নির্মাণের নৈপুণ্যই স্তব্ধ করে দেয় আমাদের অসম্ভবের প্রত্যাশা, তৃপ্ত করে আমাদের নান্দনিক তৃষ্ণা।

সমকালীন মূল্যায়নে শামসুর রাহমান শুধু এ সময়ে আমাদের মহত্তম কবি নন, সম্ভবত জনপ্রিয়তম কবিও। সমকাল পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে তাঁর কবিতার অঙ্গে অঙ্গে। আমরা জানি তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে এটা মুখ্য নয়, তবে প্রাসঙ্গিক অবশ্যই। প্রকৃত ব্যাখ্যা আছে অন্যত্র। সমকালের সবচেয়ে সংবেদনশীল মনে তিনি অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন, কেবলমাত্র জনতার তরল চিত্তে নয়। কবিতা যখন কেবলই কবিতা, প্রচার নয়, বিলাপ নয়, উত্তেজনা নয়, শুদ্ধ কবিতা, তখন তার কাজ চিত্তের সংবেদনশীলতাকে জাগিয়ে দেওয়া। শুদ্ধ সংগীতও বোধহয় এই কাজই করে, আরো মায়াবী উপায়ে। কবিতার বাহন ভাষা ও ছন্দ। কবিতার ভাষা ও ছন্দকে অনাবিষ্কৃত পথে ধাবিত করা শ্রেষ্ঠ কবির কাজ। শামসুর রাহমান সেই কাজ করেছেন। পাঠকের উপলব্ধিতে তাঁর এই কৃতিত্ব ধরা পড়েছে বলেই তিনি জননন্দিত।

শামসুর রাহমান শুধু আমার সমবয়সী ও সহপাঠী নন, আযৌবন আমরা পরস্পরের বন্ধু। তাঁর প্রথম কাব্য প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে তিনি আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রকাশের পরই। ওই কাব্য আমাকে এক আশ্চর্যের অনুভূতি দিয়েছিল। সেই অনুভূতির উত্তেজনার পরিচয় ধরা আছে, কাব্যটির যে রিভিউ আমি লিখেছিলাম ত্রৈমাসিক পূর্বমেঘের জন্য, সেই লেখায়। এরপর অজস্র ধারায় কবিতা লিখেছেন তিনি। নতুন কাব্য প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত। আর প্রতিটি কাব্যই আমি উপহারস্বরূপ পেয়েছি যথারীতি, দুটি-একটি বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া। মাঝে-মধ্যে আমাদের যোগাযোগে ছেদ পড়েছে। সেই সময়ে সদ্যপ্রকাশিত কাব্যটি আমার হাতে পড়েনি, যদিও অত্যন্ত বিরল এই ঘটনাটি। প্রসঙ্গত আমার দিক থেকে যে বিচ্যুতি, একজন অনিয়মিত রিভিউয়ার হিসেবে, তা আমি এই সুযোগে স্বীকার করব। এদেশে এযাবৎ কোনো সাহিত্যপত্রিকা বিশ বছরের আয়ু নিয়ে চলেনি। অনেকটা এজন্য এদেশে বইয়ের রিভিউ কখনো নিয়মিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেনি। যাঁরা পরিচিতজনকে তাড়া দিয়ে নিজের বইয়ের সমালোচনা লিখিয়ে নেন, শামসুর রাহমান কখনো তাঁদের দলভুক্ত ছিলেন না। তাঁর স্বভাবের গভীরে আছে বিনয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিজের কবিতা সম্বন্ধে তাঁর নিজের বিশ্বাস। সমালোচকের ব্যর্থতায় তাঁর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়নি। এর মধ্যেও তাঁর কবিজীবনের প্রথম পর্যায়ে যে অল্প কয়জন তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করেছিল, আমি নিজেকে তাদের একজন গণ্য করি। আমি আমার যৌবনোত্তর প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল গভীর আগ্রহে অনুসরণ করেছি শামসুর রাহমানের কবিতার ধারা। আমার দৃষ্টিতে যে বিশিষ্টতায় তিনি ধরা দিয়েছিলেন তাঁর প্রথম কাব্যে, সেই বিশিষ্টতার গৌরব তিনি এখনো বহন করে চলেছেন। জরা তাঁর দেহকে আক্রমণ করেছে, তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে ছুঁতে পারেনি।

আমার পূর্ব রচনার মধ্যে অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক (১৯৮৫) একটি লেখায় আমি বলেছিলাম : ‘এখন থেকে দশ বছর আগে শামসুর রাহমানের মোট কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছিল দশটি (এক ধরনের অহংকার পর্যন্ত)। বিগত দশ বছরে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সতেরোয়, যদি উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশকে তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ধরি।’ দশ বছর পূর্বে শামসুর রাহমান সম্বন্ধে আমি কয়েকটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। কোনোরূপ পণ্ডিতি সিদ্ধান্তে নয়, নেহাত তাঁর কবিতার একজন অনুরাগী ও উৎসাহী পাঠকসুলভ সিদ্ধান্তে।

বাংলা তরজমায় সেটা এ রকম :

শামসুর রাহমানের এযাবৎ যে সৃষ্টি ও সিদ্ধি, তার মূল্যবিচার কীভাবে করব? একজন গুরুত্বপূর্ণ (important) কবির কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা (আমি ইচ্ছে করেই প্রধান (major) শব্দটি ব্যবহার করছি না) তিনি তা-ই পূরণ করেছেন। দেশবিদেশের কাবা আবহ তিনি আত্মস্থ করেছেন। এই আত্তীকরণে তিনি পরিচয় দিয়েছেন তাঁর বুদ্ধি ও বিবেচনার। তিনি সেই আবহকে বদলে দিয়েছেন এবং তাঁর স্বকীয়, তাঁর অসংশয়িত কণ্ঠকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর দিক থেকে তিনি নিজেই এখন একটি সবল প্রভাবে পরিণত হয়েছেন। নিজের ঐতিহ্যের গভীরে তাঁর শেকড় হলেও তিনি ভূগোলের সীমা ছাড়িয়ে কথা বলেছেন এ-যুগের, আমাদের কালের ভাষায়। যখন তিনি হ্যামলেট হয়ে যান (‘অধমর্ণের গান’/ নিরালোকে দিব্যরথ), কিংবা এ যুগের টেলিমেকাস, নিজের দেশকে প্রত্যক্ষ করেন হোমারের ইথাকা-সদৃশ, কিংবা একাত্তরের সেই দুর্যোগের দিনে, মিলটনের স্যামসন- ছদ্মবেশে স্বগতোক্তি করেন, তখন তিনি সুধীন্দ্রনাথ বা বিষ্ণু দে যে-টেকনিক বা পদ্ধতি ইতিপূর্বেই ব্যবহার করেছেন, তারই অনুসারী, তবে তাঁর নিজের পন্থায়। তিনি সুধীন্দ্রনাথের বাণীসৌকর্যের (elegance) কাছে পৌঁছান না, হয়তো এ তাঁর ইচ্ছাকৃত। জীবনানন্দের মরমি দর্শনও (mystic vision) তাঁর অনায়ত্ত, সপ্রাণ নাগরিকতায় অমিয় চক্রবর্তীর পেছনেই তিনি থাকেন; বৈদগ্ধে বিষ্ণু দে অগ্রগামী, যিনি বৃহৎ প্রসঙ্গের রূপায়ণে তুলনায় যোগ্যতর। কিন্তু সহানুভূতির ব্যাপকতায়, তাঁর সর্বগ্রাসী ঔদার্যে, আমাদের জন্য তাঁর জরুরি ও তাৎক্ষণিক প্রাসঙ্গিকতায় তিনি অদ্বিতীয়। জীবনানন্দের মতোই তাঁর পদ্যপঙ্ক্তি ক্বচিৎ কখনো অগোছালো মনে হতে পারে, কিন্তু এহ বাহ্য। কখনো কখনো যা ছন্দচ্যুতি বলে মনে হয়, তা আসলে ইচ্ছাকৃত নিয়মভঙ্গ, যার পেছনে ছন্দ-বিষয়ে একটা উচ্চতর বিবেচনা কাজ করছে, যা অনুসরণ করতে চাইছে আমাদের উচ্চারণের রেখা ও চাপকে। জীবনানন্দের দৃষ্টান্ত আবারও মনে আসছে। যদি তাঁর (শামসুর রাহমানের) ছন্দ বিষয়ে যোগ্যতা নিয়ে কেউ সন্দেহ পোষণ করেন, তিনি তার নিয়মিত ছন্দোবদ্ধ কবিতাগুলো পড়ে দেখতে পারেন। সংখ্যায় এগুলোও কম নয় – তাঁর সন্দেহ দূর হবে। কবিতার ভাষার শিল্পী হিসেবে, একজন যিনি প্রত্যন্তবাসীর উপভাষাকে শুদ্ধতায় উত্তীর্ণ করেছেন Ñ as one who has purified the dialect of the tribe Ñ শামসুর রাহমানের জায়গা গত পঞ্চাশ বছরের শ্রেষ্ঠদের সারিতে। যিনি আমাদের কালে ভাষার সম্পূর্ণ সম্ভাবনাকে উজাড় করেছেন, যাঁর প্রবল প্রাণশক্তি ও নমনীয় কল্পনা একটি পুরো প্রজন্মকে অস্তিত্বের গূঢ় অর্থ শিখিয়েছে, যাঁর হাতে কবিতা হয়ে উঠেছে অন্তরঙ্গ ও সমকালীন, ইতিপূর্বেই অর্জিত তাঁর সিদ্ধির তুলনায়, সামগ্রিক সিদ্ধির বিচারে, বাংলা ভাষার সমকালীন আর কোন কবি উচ্চতর আসন পেতে পারেন, আমি জানি না। এরপরও তাঁর সিদ্ধি কোন পথে যাবে, তা আমাদের কল্পনার বিষয়।

এভাবেই আমার মূল্যায়ন শেষ হয়েছিল। কেউ কেউ এতে অতিশয়োক্তির আভাস পেয়েছিলেন। কিন্তু সমকালের একজন জীবিত কবির কাব্যবিচারে ভিন্নমতের জায়গা সবসময়েই ছিল। আমার মূল বক্তব্য যে পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না।

ইতোমধ্যে শামসুর রাহমানের আরো অনেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় তিনি অনায়াসেই একজন ‘অতিপ্রজ’ কবি বলে আখ্যায়িত হতে পারেন। পূর্ণ প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে, ও তারও পরে, তিনি এখন তাঁর ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিব্রত নন। বরং তাঁর ব্যক্তিত্বকে সাহস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে বয়ে বেড়াতে থাকেন। বলা যায়, এই ব্যক্তিত্বই তাঁর কবিতার বড় মূলধন, বাইরের ঘটনাবলি নয়। পেশায় সাংবাদিক, কবিতায় বিস্তর সাংবাদিকতার উপকরণ ও লক্ষণ নিয়েও, বলতে পারি, সবই তাঁর কবিত্বের রসে জারিত। তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায় যে-সকল পুনরাবৃত্ত প্রতীক আমরা ব্যবহৃত হতে দেখেছি (ঘোড়া, হরিণ, খঞ্জ, খাদ, ভিখিরি) সেগুলো বিদায় নিয়েছে, তাদের জায়গায় এসেছে নতুন প্রতীক। এর মধ্যে কোনটি যথার্থ প্রতীক, কোনটি শুধুই চিত্রকল্প, এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের কবিতায় চিত্রময়তা লক্ষ করেছিলেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় শুরু থেকেই এই লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। কালে তা ক্রমশই স্পষ্টতর হয়েছে। এমন অভিযোগ অগ্রাহ্য করার নয় যে, অতিরিক্ত চিত্রকল্পের ভিড়ে তাঁর কবিতা কখনো-কখনো ভারাক্রান্ত, তাঁর বক্তব্যকে ছাপিয়ে ওঠে। প্রশ্ন করলে তিনি হয়তো ইয়েটসের ভাষাতেই জবাব দেবেন : একই চিত্রকল্প বিভিন্ন কবিতায় কিছুটা ভিন্ন অর্থে ধরা দেয়। তাছাড়া পাঠক নিজেও তার নিজস্ব কিছু অর্থ আরোপ করবেন। এতে চিত্রকল্পের অর্থসমৃদ্ধি ঘটবে, এতে দোষের কিছু নেই। অবচেতনের গভীর থেকে উদ্ধৃত-উত্থিত যে-সকল ছবি, কোনো কবিই তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য জানেন, এমন দাবি করতে পারবেন না।

উদাহরণত আমি শামসুর রাহমানের ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ কবিতাটির উল্লেখ করব। (এর ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে আমি হিমশিম খেয়েছিলাম, এর চিত্রকল্পের উজ্জ্বল্যে, ঐশ্বর্যে ও জটিলতায় বিভ্রান্ত হয়েছিলাম।) নানাদিক দিয়ে কবিতাটি পাঠকের মনোযোগ দাবি করবে। সমকাল কী রহস্যময় পথে কবিতার পরোক্ষতায় ও প্রতীকতায় উত্তরে যায়, কবিতা কীভাবে দৃশ্যকে আড়াল করে, অব্যক্তকে ব্যক্ত করে, প্রতীকের ঘন অরণ্যে কবির পথরেখা অনুসরণ কীভাবে একই সঙ্গে উচ্চকিত ও বিমূঢ় করে বা করতে পারে পাঠককে, এবং আরো অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উৎস হিসেবে এটি একটি প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা।

আমি বলেছি ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’ একটি প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা। এটা ধরা পড়বে, একদিকে এর গতির মন্থরতায়, চিত্রকল্পের নিবিড়তায়, এর বক্তব্যের পরোক্ষতায়; অন্যদিকে এর অন্ত্যমিলের বর্জনে, এর কিছুটা অনিশ্চিত ছন্দে। অসুস্থ নৃপতি ও তৃতীয় রাজকুমার এসেছে দেশীয় রূপকথার জগৎ থেকে। কিন্তু দেশীয় রূপকথা বা পুরাণ কাহিনীর মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি এই কবি। ইউরোপীয় সাহিত্যের ইলেকট্রা, হ্যামলেট, টেলিমেকাস, ইউরোপীয় পুরাণের ইকারুস, ডিডেলাস প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে তাঁর কবিতার উপজীব্য। বর্তমানের মধ্যে অতীতের প্রতিস্থাপনা, এলিয়ট, বিষ্ণু দে-র এই প্রতীকসন্ধানী তৎপরতায় খুব আগ্রহের সঙ্গেই যোগ দিয়েছেন শামসুর রাহমান। ‘মধ্যপথে কেড়েছেন মন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, সম্মিলিত তিরিশের কবি’, তাঁর এই স্বীকারোক্তি আবারও স্মরণ করছি। যে-ঐতিহ্যে তাঁর বিশ্বাস, যে-ঐতিহ্য তাঁকে পুষ্ট করেছে, তা সম্মিলিত তিরিশের কবিদের ঐতিহ্য। আর এই পথেই তিনি আন্তর্জাতিক কবিতার জগতে ছাড়পত্র পেয়েছেন – বোদলেয়ার, আরাগঁ, নেরুদার জগতে এবং একই সঙ্গে – এখানেও বিষ্ণু দে-ই পথিকৃৎ – মাতিস, পিকাসো, ক্যান্ডিনিস্কির তুলি ও রঙের জগতে। এই জগৎকে চিনে নিতে – এর সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তুলতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন বুদ্ধদেব বসু। প্রসঙ্গত, এ বিষয়ে তাঁর নিজের স্বীকারোক্তিও পাই একটি কবিতায়, ‘বুদ্ধদেব বসুর প্রতি’ :

শব্দেই আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়

আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম।

অফলা সময় আসে সকলেরই মাঝে মাঝে, তাই

থাকি অপেক্ষায় সর্বক্ষণ। যতই যাই না কেন দূরে

অচেনা স্রোতের টানে ভাসিয়ে জলযান,

হাতে রাখি আপনার কম্পাসের কাঁটা; ঝড়ে চার্ট

কখন গিয়েছে উড়ে, চুলে-চোখে-মুখে রুক্ষ নুন,

অস্পষ্ট দিগন্তে দেখি মুখ। আপনার ঋণ

যেন জন্মদাগ কিছুতেই মুছবে না কোনোদিন।

এখানে ঋণের সব কথা বলা হয়নি। তবু যেটুকু বলা হয়েছে তা থেকেই বাকিটা আমাদের জানা হয়ে যায়। শামসুর রাহমানের নাড়ির যোগ ত্রিশের কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে, বিশেষত জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু দে, এই ত্রয়ীর সঙ্গে। তবে কোনো প্রকৃত কবিই কতকগুলো উপাদান বা প্রভাবের মিশ্রফল-মাত্র নন। শামসুর রাহমানের মৌলিকতা, তাঁর গ্রাহিকাশক্তি, তাঁর পরিবেশচেতনা, তাঁর কল্পনার অজস্রতা ও আগ্রহের ব্যাপ্তি, তাঁর আবেগের ব্যক্তিকতা ও দর্শনের অনিশ্চয়তা – সব কিছুর সমন্বয়েই তাঁর কবি-ব্যক্তিত্ব। কবি হিসেবে তিনি যে-ঐতিহ্যকে চিনে নিয়েছেন, যা তাঁকে পুষ্ট করেছে, সেই ঐতিহ্য ও তাঁর কবিতার আবহ পরস্পরের পরিপোষক। এই আবহে তাঁর দেশ ও কাল যেমন উপস্থিত, তেমনি ততোধিক উপস্থিত তাঁর নিজের মনের ভূদৃশ্যাবলি। যে-চিত্রময়তার কথা বলছিলাম, তা-ও এই ভিতর ও বাহিরের অগণিত চিত্রের সমাহার। তাঁর কবিতায় বাংলাদেশের নিসর্গ কেউ খুঁজলে পাবেন, তবে অতি শীঘ্র তিনি আবিষ্কার করবেন, তিনি নিজেই এক বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। দৃশ্য ও দ্রষ্টা প্রায়শই একাকার হয়ে যায় :

আরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে, যেখানে

                                                      সূর্যের

চুম্বনে ফসল পাকে রাঙা হয় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল,

সজীব মুখের ত্বক রুটির মতোই ঝলসে যায়।

যেখানে বিশদ খরা, কখনো বা ভীষণনির্দয় বানভাসি

…                  …                    …

আরাগ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে আজ,

যেখানে দানেশমন্দ বসে থাকে অন্ধকার গৃহকোণে বুরবক সেজে,

জরাগ্রস্ত মনে, অবসাদ কবলিত কখনো তাড়ায় আস্তে

অস্তিত্বের পচা মাংসে উপবিষ্ট মাছি।

আরাগঁ তবুও জ্বলে গ্রীষ্মে কী শীতে

আমাদের স্বপ্ন জলে খনি-শ্রমিকের বাতির মতন স্বপ্ন আমাদের।

(‘আরাগঁ তোমার কাছে’, ইকারুসের আকাশ)

কবি হিসেবে শামসুর রাহমান এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এর ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ হবে না। একদিকে তিনি এক মিশ্র পাঠক-সমাজের নান্দনিক চাহিদা পূরণ করেছেন অকৃপণভাবে, অন্যদিকে এই চাহিদাসৃষ্টির মুখ্য ভূমিকাও তাঁরই। তিনিই মহৎ কবি যিনি তাঁর কালের কবিতা পাঠকের কাব্যরুচি তৈরি করেন। নিজের নিঃসঙ্গতার গৃহকোণ থেকে তিনি ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছেন গণমানুষের মধ্যে। একাত্ম হয়েছেন তাদের
দুঃখ-বেদনা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। একটি নতুন জাতির উন্মেষপর্বে তিনি সে জাতির হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানিকে ভাষা দিয়েছেন। যেখানেই মানবতার অপমান, বীরের আত্মোৎসর্গ, স্বৈরশাসকের উদ্ধত অনাচার – দেশে হোক পরদেশে হোক – সেখানেই তাঁর কণ্ঠস্বর বেজে উঠেছে কবিতার উজ্জ্বল চরণে। একজন নিভৃতচারী কবির এই প্রকাশ্য ভূমিকায় উত্তরণ তাঁর জন্য সৃষ্টি করেছে এক অনন্য সম্মানের আসন, এক ভিন্ন ধরনের নেতৃত্বের ভূমিকা। তাঁর কবিতার পাঠক নিজের আনন্দে, ক্ষোভে, ধিক্কারে, ঘৃণায়, ভালোবাসায় তাঁকে পেয়েছে বিশ্বস্ত সুহৃদের মতো। অথচ প্রচলিত অর্থে তিনি রাজনীতি করেননি, রাজনীতির ক্ষুদ্রতা, কলুষতা ও কলহ থেকে দূরেই থেকেছেন। দূরে থেকেও তিনি এক বিরল নৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতিকে, যেমন দিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল বা জাহানারা ইমাম। সমাজের প্রতি এক কঠিন দায়িত্ব পালন করেছেন, দেহের জরাকে অস্বীকার করে, শুধুমাত্র প্রত্যয়ের বলে বলীয়ান হয়ে। তাঁর এই যুযুধান সত্তার স্মরণীয় উচ্চারণ তাঁর ‘এক ধরনের অহংকার’ এই কবিতা।

এখনো দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহংকার।

বেজায় টলছে মাথা, পায়ের তলায় মাটি সারা দিনমান

পলায়নপর,

হা-হা গোরস্তান ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি না

আপাতত, তবু ঠিক রয়েছি দাঁড়িয়ে

প্রখর হাওয়ায় মুখ রেখে।

অত্যন্ত জরুরি কোনো আবহাওয়া ঘোষণার মতো

দশদিক রটাচ্ছে কেবলি : হাড়ে ঘাস

গজাতে গজাতে

বুকে হিম নিয়ে তুমি নির্বান্ধব, বড় একা হয়ে যাচ্ছো।

এ সবকিছুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে, সম্পূর্ণত না হলেও অনেকটাই, তাঁর বিপুল ও অব্যাহত পাঠকপ্রিয়তার রহস্য। কবিতার সঙ্গে জীবনের গূঢ় ও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক কতদূর যেতে পারে তারই এক বিস্ময়কর দলিল শামসুর রাহমানের সারাজীবনের কবিতা। তাঁর কবিতায় তিনি উন্মোচিত করেছেন নিজেকে, সম্পূর্ণভাবে, এক অসাধারণ অকপট স্বচ্ছতায়। আর স্বদেশ ও সমকালকে দিয়েছেন এক গাঢ় উচ্চারণ, যার কাব্যবিভূতি আমাদের কালে এক বিস্ময়।

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০০৪/ ফাল্গুন ১৪১০) প্রকাশিত হয়েছিল।