কুনাফার শহরে

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো শহরগুলির একটায় বসে ইতিহাসের পাতায় পাতায় গল্প খুঁজে বেড়ানোর এক শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতাই হলো এবার। প্রস্তর যুগের চিহ্ন পাওয়া গেছে এখানে, এতটাই প্রাচীন এই দেশ আর এর রাজধানী শহর। বলা হয়ে থাকে, ৭২৫০ খ্রিষ্টপূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আম্মান শহর, যার অলিতে-গলিতে শুধু প্রাচীন আমলের গন্ধই ভেসে বেড়ায় না, বর্তমানও হয়ে আছে দারুণ বাঙ্ময় হয়ে। উজ্জ্বল অতীত আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বর্তমানের এক অপূর্ব মেলবন্ধন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানের এই রাজধানী শহর!

ভ্রমণতালিকায় অবশ্য দর্শনীয় যেসব স্থানের নাম লিখে রেখেছি তার মধ্যে জর্ডানের নাম বেশ পরেই ছিল; কিন্তু মেয়েদের একটি ভ্রমণদলের জর্ডান ঘুরতে যাওয়ার ছবি ও বর্ণনা – যার অন্যতম আকর্ষণ বিশ্বঐতিহ্য ও প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি পেত্রা দেখে মনটা একদম আইঢাই করে উঠলো! মহামারি কোভিড শুরু হওয়া অবধি তিন-চার বছর হয়ে গেল কোথাও যাওয়া হয়নি! মন আর একেবারেই মানছিল না। কোনোকিছু চিন্তা না করেই ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাওয়ার জন্যে বুকিং দিয়ে দিলাম। কিন্তু তারপরই পড়েছিলাম পারিবারিক বিপর্যয়ে। একপর্যায়ে যাওয়াটাই অনিশ্চিত হয়ে উঠেছিল, তবু শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলাম এই ভ্রমণে এবং ঘুরে আসার পর এখন ভাবি, জীবনে যে-কয়টা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার মধ্যে জর্ডান ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল অন্যতম। কী নেই এখানে, সহস্র বছরের পুরনো সভ্যতা, অপূর্ব সুন্দর এক মরুভূমি, লাখো বছরের  পুরনো ধর্মীয় কাহিনিসমৃদ্ধ ডেড সি বা মৃতসাগর – কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি!

নব আনন্দে জাগো

আবুধাবিতে দীর্ঘ ট্রানজিট শেষে পাঁচ ঘণ্টার আকাশ পাড়ি দিয়ে ঠিক মধ্যদুপুরে জর্ডানের কুইন আলিয়া এয়ারপোর্টে এসে থামলো আমাদের হংসবলাকা। এয়ারপোর্টে নামতেই সামনে পেয়ে যাই এখানকার ট্যুর কোম্পানির প্রতিনিধিকে। একটা কার্ডে আমাদের এই নারীদল ওয়ান্ডার উইম্যান ও দলনেত্রী সাবিরার নাম নিয়ে সুশ্রী চেহারার ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর নানাবিধ সাহায্যে খুব সহজেই এয়ারপোর্টের কাজকর্ম সারা হলো। ভেতরের কাজ সেরে বাইরে আসতেই প্রাকৃতিক ঠান্ডা হাওয়া প্রাণে আরামের পরশ বুলিয়ে দিলো যেন। গরমের দেশ বলে জেনে আসা এই দেশে এমন শীতল (এ-শীতল
সে-শীতল নয়) অভ্যর্থনা পেয়ে তো অবাকই হলাম। ট্যুর কোম্পানির প্রতিনিধি আমাদের অসংখ্য বলিরেখাসমৃদ্ধ এই জনপদের মতোই প্রাচীন এক মানুষ। আমাদের গাইড ওয়ালিদের কাছে পাঁচদিনের জন্য আমাদের সঁপে দিয়ে বিদায় নিলেন। একটু দূরেই আমাদের গাড়ি দাঁড়ানো, যার ঝাঁ-চকচকে চেহারা দেখেই মনটা খুশি হয়ে গেল এই ভেবে যে, এ-বাহনই সামনে সব জায়গায় আমাদের সঙ্গী হবে। ওয়ালিদভাইয়ের তাগাদায় অন্যরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাদের বাক্স-পেঁটরাসহ গাড়িতে ওঠার ফাঁকে আমি চারপাশে একটু নজর বুলিয়ে নিতে থাকি। চোখে পড়লো বেশ কিছুদূর পরপর জর্ডানের পতাকা পতপত করে উড়ছে, পতাকার রং কিছুটা যেন আমাদের মতো, লাল-সবুজের ছোঁয়া লাগানো। খানিক পরপর কয়েক রকমের রুক্ষ-সূক্ষ্ম পামগাছ সারি দিয়ে লাগানো, তেমন কোনো ছিরিছাঁদ নেই গাছগুলির। তবে ছিমছাম সাজানো চারদিক। মানুষজন কম। খুব বেশি সবুজের দেখা না মিললেও দেখতে খুব ভালো লাগছে টিপটপ করে গুছিয়ে রাখার কারণে। নতুন যে-কোনো শহরে পা দেওয়ার অনুভূতি সবসময়ই আমার কাছে একইরকম – নতুন একটা জায়গার সমস্ত নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার আনন্দে ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজনা অনুভব করি। নিখাদ ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ছাড়া এই অ‌নুভূতি কেউ বুঝবে না।

গাড়িতে উঠে হোটেলের পথে যেতে যেতে চোখ ভরে দেখতে থাকি সুপ্রাচীন এই শহরের বর্তমান চেহারা। আম্মানের চারদিকে তাকালেই এটা যে একটা সুপ্রাচীন শহর, তা এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি রাস্তা বলে দেয়। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সহস্র বছরের পুরনো সব নিদর্শন। হাল ফ্যাশন আর পুরনো মডেলের গাড়ি, সমানতালে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ভুসভাস করে। মানুষের চেহারাগুলি খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করি। আরব জনপদে বসে আরব মুলুকের মানুষ এই প্রথম দেখছি। বড় সভ্যতাগুলি যখন আস্তে আস্তে কালের গর্ভে মিলিয়ে গেল, তারপর দীর্ঘসময় এসব জায়গা পড়ে ছিল শুধু কিছু আরব বেদুইনের জায়গা হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যানদের পরাজয়ের পর ট্রান্সজর্ডান হিসেবে আবার যাত্রা শুরু হয় এদেশের, আম্মান যার রাজধানী, সেখানে এখন চার মিলিয়ন লোকের বাস। জর্ডান কোনো জনপ্রিয় পর্যটক গন্তব্য নয়। বাংলাদেশের কোনো দূতাবাসও নেই এখানে। বাংলাদেশিরা সাধারণত কাজের কারণে এদেশে যায়। একার জন্যে পর্যটক ভিসা পাওয়া কঠিন। তবে গ্রুপ ভিসা সহজে পাওয়া যায়। এ-কারণেই ট্যুর কোম্পানিগুলির ডাকে এখন পর্যটকরা জর্ডানে যাওয়ার সুযোগটা নিচ্ছে।

এয়ারপোর্ট থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে এসে আমরা উঠলাম মোনার্ক হোটেলে। ছোটখাটো হোটেলের
সাজানো-গোছানো চেহারা দেখে মন খুশি হয়ে গেল। সামনে একটা বসার লন এবং সুন্দর করে কিছু চেয়ার-টেবিল দিয়ে বসার জায়গাটা আকর্ষণীয় করে রাখা হয়েছে। দেখে সত্যিই মনে হয় চুপ করে কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি। আমার একটু ‘ভালো হোটেল’প্রীতি আছে। আর কেইবা একটু ভালো জায়গায় থাকতে না চায় সামর্থ্যানুযায়ী! তবে এ-বেলা আর বসা হলো না। হোটেলে নেমেই আমরা আবার জলদি বের হয়ে পড়বো সে-কারণে। সুন্দর, পুরনো আমলের নকশা করা একটা জগ থেকে শরবত ঢেলে হোটেলে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হলো। যার যার চাবি নিয়েই আমরা রুমে ছুটলাম, কারণ একটু বিশ্রাম নিয়েই শহর দেখতে বের হবো – দিনের আলো এখনো যে আছে কিছু অবশিষ্ট। 

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা বের হয়ে গেলাম পুরনো আম্মানের উদ্দেশে, তবে তার আগে কিছু ডলার ভাঙানোর জন্যে একটা মানিচেঞ্জার দোকানে ঢুকলাম। ডলার ভাঙানোর পরে তো সবার চক্ষু চড়কগাছ। ডলারের চেয়েও যে জেডি বা জর্ডানিয়ান দিনারের দাম বেশি, তা তো জানা ছিল না। ডলার ভাঙিয়ে কত কত জায়গায় আমরা লাখোপতি, কোটিপতি হয়ে গেছি, আর এখানে কি না এ-অবস্থা! মানিচেঞ্জের সুশ্রী চেহারার ছেলেমেয়েগুলি যখন ডলার ভাঙিয়ে কত পেলাম সেটা হিসাব কষে বললো, আমাদের তখনকার চেহারা দেখে ওরা নিশ্চয়ই পরে খুব হাসাহাসি করেছে। মোগালেপ্পো বা ইনভেলাপ বা খামে করে যখন ডলারের থেকে কম জেডি নিয়ে মলিনমুখে দোকান ছাড়লাম ততক্ষণে আমরা বুঝে গেছি যে, এসে পড়েছি বেশ ধনী এক দেশে!

প্রাচীন শহরের অতিথি

পুরনো আম্মানের দিকে গাড়ি ছুটলো, আমাদের পুরান ঢাকা আরকি! কিন্তু সেটা শুধু নামেই – বাস্তবে পুরনো আম্মান দারুণ একটা জায়গা, যার আগের নাম হচ্ছে ফিলাডেলফিয়া – এদেশের সবচেয়ে বড় শহর, রাজধানী শহর বলে কথা! শহরের নতুন দিকটি বেশ সাজানো, কিছু ঝাঁ-চকচকে বাড়ি, হোটেল, ফুটবল স্টেডিয়াম‌, মল ইত্যাদি। সেগুলি পার হয়ে ডাউনটাউন আম্মানে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম যখন, রাত তখনো দূর কা বাত! পুরো এলাকাটা মানে রাস্তার দুপাশে সাজানো দোকানপাট, রেস্তোরাঁ সবকিছু মানুষের সমাগমে গমগম করছে। আশপাশের মানুষজনকে খুব হাসিখুশি মনে হলো, নাকি সবই খরিদ্দার পটানোর কায়দা, কি জানি! তবে এদেশের মানুষের চেহারার মধ্যেই কেমন জানি একটা অন্য ব্যাপার থাকে বলে মনে হয়। পশ্চিমাদের মতো সদা ছুটে চলা ধরনের নয়, কেমন যেন একটা শান্ত, আয়েশি একটা ব্যাপার আছে এদের জীবনযাপনে। কাজ করতে করতে হাসিঠাট্টা করছে, গল্প করছে – সেটা দেখতে বেশ লাগে। জীবন শুধুই নিরন্তর ছুটে চলা নয়, বরং আয়েশ করে জীবন নিয়ে একটু ভাবার সময়ও দরকার – সেটা যেন এরা বোঝে। ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মিশেলে দোকানপাটের চেহারা ভীষণ আকর্ষণীয়। সবকিছুতেই এদেশের নিজস্ব সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে।  মধ্যপ্রাচ্যের কোনো শহরের চেহারা যে এত খোলামেলা হতে পারে বাস্তবিকই তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। ছেলেমেয়ে, যুবক-বৃদ্ধ সবাই যেন জীবনটা উদ্যাপন করছে। কাউকে কোথাও উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করে দৌড়াতে দেখলাম না কখনো। সবার চোখেমুখে একটা ধীর, শান্ত, সমাহিত ভাব। কেউ কেউ পরিবারসহ, কোথাওবা মেয়েরা একসঙ্গে কয়েকজন মিলে খাবারের পাশাপাশি সিসা, সিগারেট নিয়ে বসে তুমুল আড্ডাবাজি চালাচ্ছে।

ধর্মের কারণে কোনো মেয়েকে জবুথবু হয়ে থাকতেও দেখিনি কোথাও। কাজেকর্মে সব জায়গাতেই মেয়েদের সমান পদচারণারই সাক্ষী হলাম। পোশাক-পরিচ্ছদেও একটা মিশ্র অবস্থা চোখে পড়ে। যার যা ইচ্ছে পরে আছে, সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। একই পরিবার এক জায়গায় বসে খাওয়া-দাওয়া করছে। তাদের কেউ জিন্স-টপ পরে আছে, তো কেউ মাথায় হিজাব। ছেলেরাও পশ্চিমা পোশাকের সঙ্গে সমানতালে আলখেল্লা পরে আছে। রাস্তার দুধারে ভীষণ সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো আলো-ঝলমলে সব দোকান, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডাবাজি সব একসঙ্গেই চলছে এবং তা নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণেই। আরবরা দেখতে সুন্দর। কখনো কখনো কাউকে একটু রুক্ষ বা অহংকারী মনে হয়; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কথা বলার পর সে-ভুল ভেঙে যায়।

এক এক জায়গায় ঢুকে দোকানগুলি ঘুরেফিরে দেখতে খুব ভালো লাগছিল। আরবিতে সুক মানে বড় বাজার – যেখানে ঘুরছি সেটা আমাদের গাওছিয়া, এলিফ্যান্ট রোড বা নিউ মার্কেটের মতো জায়গা। ছড়ানো-ছিটানো কিন্তু আবার ভীষণ রকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও উপভোগ্য। একটা গ্রোসারি ধরনের দোকানে ঢুকে তো প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। বাহারি সব মশলা আর চকলেট সাজিয়ে রেখেছে সামনে, রূপকথার জগৎ মনে হয় যেন। দোকানজুড়ে আরো নানান সদাই তো আছেই। শখ করে বেশ কিছু আরবদেশীয় চকলেট, সেইসঙ্গে বোতলজাত মধু আর এক বোতল জলপাই-তেল কিনে ফেললাম! মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি তো খাঁটি জলপাই-তেলের জন্য বিখ্যাত। মধুর স্বাদও ছিল অপূর্ব। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি সন্দেহ নেই, তবে মানও খুব ভালো। একটা বেশ পুরনো আমলের বাড়ির ওপরতলাটা বারান্দাসহ রেস্তোরাঁ – আমরা কয়েকজন সেখানে বসে কফি নিলাম – বারান্দায় বসে কফির কাপে চুমুক দেওয়ার পাশাপাশি নিচের মানুষদের আসা-যাওয়া দেখি – মানুষই দেখি আসলে। একটা মাদকতাময় বিকেল ও সন্ধে কাটলো পুরনো আম্মানের রাস্তায় আর দোকানে ঘুরে ঘুরে; মানুষজন আর তাদের জীবন দেখে। এর মধ্যেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো যেন। আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা হোটেলের পথ ধরি – নৈশাহার সেখানে প্রস্তুত। আগামীকাল আমাদের নানান দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়ার কথা রয়েছে।

পরদিন বেশ সকালেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম – প্রথম গন্তব্য আম্মান সিটাডেল। চলতি পথে একটু উঁচু-নিচু পথে ঝাঁকুনিতে আমাদের নীল চোখা ওয়ালিদভাই মাঝেমধ্যেই ইয়াম্মা ইয়াম্মা বলে ওঠেন, যার অর্থ ‘ও, মাগো!’ তাঁর প্রাচীন মুখের অসংখ্য বলিরেখা বলে দেয় অভিজ্ঞতায় ভরপুর এক জীবনের কথা। তাঁকে দেখতে দেখতে,  সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তিনি বৃদ্ধ হলেন’ গানটা মনে পড়ে যায় আমার, ওয়ালিদভাইও যেন বনস্পতির ছায়া হয়ে আছেন আমাদের সঙ্গে আর একের পর এক প্রাচীন সব জনপদের ভেতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন।

প্রাচীন রোমের মতো, প্রাচীন শহর আম্মানকেও বলা হতো সাত পাহাড়ের শহর। কারণ এর প্রাথমিক বিকাশ হয়েছিল সাত পাহাড়কে কেন্দ্র করে। এখন তা উনিশটি পাহাড়কে কেন্দ্র করে বিস্তৃত। ৭২৫০ খ্রিষ্টপূর্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া জর্ডানের অনন্যসুন্দর রাজধানী শহর আম্মান আরব দুনিয়ার এমনকি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহরগুলির একটি। এই সুপ্রাচীন বসতিতে নয় হাজার বছর আগের মানব বসতির চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। আমোনাইটস রাজত্বের অন্তর্গত, রাব্বাথ আম্মোন নামে পূর্বে পরিচিত ছিল বর্তমানের আম্মান নগরীটি। রাব্বাত আম্মোন – আমনদের রাজ্য – যাদের কথা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে  উল্লেখ করা হয়েছে।

গ্রেকো-রোমান সময়ে আম্মানের নাম ছিল ফিলাডেলফিয়া। মধ্যবর্তী সময়ে এর গুরুত্ব হ্রাস পায়। তবে ১৯২১ সালে ট্রান্সজর্ডান রাজধানী হওয়ার পর থেকে এর দ্রুত সমৃদ্ধি হতে থাকে। রোমান রাজত্ব এ-অঞ্চলে শুরু হওয়ার পরে তারা তাদের পূর্ববর্তী নাবাতিয়ানদের আধিপত্য খর্ব করার জন্য দশটি শহরের একটি সংঘ গড়ে তোলে যাকে বলে ডেকাপোলিস (Decapolis)। গ্রিক ভাষায় ডেকা মানে দশ এবং পোলিস মানে শহর। শহরগুলি রোমানদের প্রতি অনুগত ছিল। বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই দশটি শহরের বেশিরভাগেরই অবস্থান ছিল আজকের জর্ডানের সীমানায় যাদের নাম, জেরাশ বা গেরাসা,  আবিলা, গেলা, উম কায়েস বা গাদারা এবং আজকের আম্মান বা ফিলাডেলফিয়া। ডেকাপোলিসের বাকি শহরগুলি ছিল সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস, ক্যানাথা, ডিয়ন ও ক্যাপিটোলিয়াস এবং ইসরায়েল অংশে অবস্থিত স্কাইথোপোলিস। আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এই অঞ্চলের প্রাচীন ভৌগোলিক পরিবেশের কথা মনে করে খুবই অন্যরকম এক অ‌নুভূতি হয়।

আম্মান সিটাডেল

আমাদের গাড়ি থামলো এক উঁচু পাহাড়ের সামনে যার নাম, আম্মান সিটাডেল। গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস আর মিঠে রোদের আরাম গায়ে এসে লাগলো। যতদূর চোখ যায় সেই নরম মিঠে রোদ ছড়িয়ে রয়েছে সিটাডেলের গায়ে। এমন মনোরম আবহাওয়ায় সবকিছুই ভালো লাগে। আমাদের গাইড ওয়ালিদভাই তার মতো করে গুছিয়ে ইতিহাসের গল্পগুলো আমাদের বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু বারোজন নারীর নানারকম আগ্রহে সেগুলি সবসময় সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কেউ কেউ নিজের মতো করে ঘুরছে, নিজের মতো করে বোঝার বা দেখার চেষ্টা করছে বা ছবি তুলছে আর ওয়ালিদভাই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাদের সবাইকে এক জায়গায় করে তাঁর গল্পগুলি শোনাতে কিন্তু প্রায়শই তা না হওয়াতে মাঝে মাঝে নীল চোখের অসংখ্য বলিরেখাময় মানুষটা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করছিলেন। ভাবটা এমন, নাহ, এদের জ্ঞানের দিকে কোনো মনোযোগই নেই! তবে কেউ কেউ অবশ্য মাঝে মাঝে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে আমাদের নারীদলের মানসম্মান কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিল বইকি!

সিটাডেলে ঢুকতেই মনে হলো কত হাজার বছরের পুরনো এক জায়গায় ঢুকে গেলাম – মনে অসীম কৌতূহল – কী কী দেখবো সামনে! ঢুকতেই চোখে পড়ল আরবি এবং ইংরেজিতে লেখা রাব্বোত আম্মান, ফিলাডেলফিয়া এবং আম্মান কখন কোন শাসনের অধীন ছিল এই শহর সেই সময়গুলি বড় বড় করে পাথরের গায়ে খোদাই করে রাখা। প্রথমেই তাই পর্যটকরা জেনে যায় কত পুরনো ভূমিতে পা পড়েছে তাদের!

দূর থেকেই চোখে পড়ে হারকিউলিসের বিশাল কলাম দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত জায়গার পুরো আকর্ষণটা তার দিকে টেনে নিয়ে আর চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে বিভিন্ন যুগের সব অবাক করা চিহ্ন। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগও পুরোপুরি মুছে দিতে পারেনি সেসব চিহ্ন। সিটাডেলের সবদিকেই চলাচলের জন্য মোটামুটি প্রশস্ত রাস্তা করে রাখা, যেসব রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখা যায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। সব জায়গায় সবকিছুর বর্ণনা, ম্যাপ দেওয়া আছে যেন মানুষ খুব সহজেই বুঝতে পারে। আশপাশে নানা দেশের পর্যটকরা ধীরেসুস্থে দেখছে যার যার মতো করে। কারো কোনো তাড়াহুড়ো নেই। পুরো জায়গাতেই সবুজের সমারোহ ভালোই চোখে পড়ে। চলার ফাঁকে ফাঁকে কিছু গাছপালাও দেখা যায় আর এখানে-সেখানে ফুটে থাকা নাম-না-জানা খুবই মিষ্টি রঙের কিছু ফুলও মন কাড়ে।

অনেক পথ হেঁটে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য গাছের ফাঁকে কিছু বসার ব্যবস্থাও রয়েছে। জায়গাটা খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই।

অনেকগুলি ছোট-বড় পাহাড় আর টিলা জুড়ে আম্মান শহরের বিস্তৃতি। তার মধ্যে একটা উঁচু পাহাড়। আরবিতে যার নাম ‘জাবাল আল কালা’ – এটাই আম্মান সিটাডেল নামে পরিচিত। জাবাল মানে পাহাড় ও কালা মানে দুর্গ। সিটাডেল হচ্ছে নগরদুর্গ বা নগরীর অভ্যন্তরে উঁচু অংশ, যে-অংশে শাসক শ্রেণির লোকজন দাপ্তরিক কাজকর্ম সারতো, আবার বসবাসও করতো। আম্মানের গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থানের মধ্যে সিটাডেল সবচেয়ে বিখ্যাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে আটশো মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই দুর্গটি আম্মানের ডাউনটাউন এলাকায় অবস্থিত। এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও বটে। সাত পাহাড় দিয়ে ঘেরা শহর আম্মানের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে রোমান, বাইজেনটাইন এবং উমায়েদ সভ্যতা, আর রেখে গেছে হাজারো চিহ্ন – যা দেখতে ছুটে এসেছি আমরা হাজার মাইলের পথ পাড়ি দিয়ে! সিটাডেল থেকে পুরো শহরের অতি সুন্দর, দমবন্ধ করা সুন্দর, প্যানারোমিক ভিউ দেখা যায়। পুরো জায়গাটা রোমান, গ্রিক, বাইজেনটাইন ও মুসলিমদের শতসহস্র বছরের ইতিহাসের খনি।

সতেরোশো মিটারব্যাপী প্রসারিত এই দুর্গটি প্রথমে খ্রিষ্টপূর্ব আঠারোশো শতকের ব্রোঞ্জ যুগে তৈরি হয় এবং এটি ছিল সেই আম্মোন সাম্রাজ্যের রাজধানী। আবার এই প্রাসাদ থেকেই সমস্ত আরব দেশ নিয়ন্ত্রণ করত রোম সম্রাটরা। সমস্ত আরব দেশের প্রাণকেন্দ্রই ছিল এই প্রাসাদ ঘিরে। এরপর রোমান, বাইজেনটাইন ও উমাইয়াসহ বহু সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এই দুর্গটি। এখানকার বেশিরভাগ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে যুগের পরিক্রমায়, তবে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রোমানদের হাতে-গড়া স্থাপত্যকর্মের ধ্বংসাবশেষ।

পাহাড়ের ওপরে রোমান সাম্রাজ্যের এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে গ্রিক দেবতা হারকিউলিসের আশ্চর্য মন্দিরের অবশিষ্ট কলাম এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ৩০ মিটার উঁচু অতিকায় পিলার দুটি দেখে আন্দাজ করা যায়, কী বিশাল ছিল  এই স্থাপনা। এই মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল আনুমানিক ১৬২-১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে, তারপর অজ্ঞাত কারণে তা আর শেষ হয়নি। বিশালাকার থামগুলি অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই অতীত গৌরবের স্মৃতি বহন করে আজো দাঁড়িয়ে আছে।

কলামগুলির কাছে পিপিলিকার মতো ক্ষুদ্রাকার আমরা রাশি রাশি ছবি তুলে ফেললাম নানান ভঙ্গিমায়! এখানে দাঁড়িয়ে কেমন অদ্ভুত এক শিহরণ-জাগানো অনুভূতি হলো – এই প্রথম কোনো রোমান স্থাপনা দেখছি খুব কাছে থেকে। এতকাল ধরে ইতিহাসে যে রোমান সাম্রাজ্যের শৌর্য, বীর্যের রূপকথার মতো সব কাহিনি পড়ে এসেছি, তাদের হাতে বানানো স্থাপত্যকর্মের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছি, ছুঁয়ে দেখতে পারছি, সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, এ এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। বিশাল কলামগুলির অদূরেই পড়ে আছে হারকিউলিসের বিশাল মুষ্টিবদ্ধ হাতের তিনটা আঙুল ও কনুই, যা শক্তিশালী রোমানদের অবিস্মরণীয় সব সৃষ্টির গৌরব প্রকাশের পাশাপাশি কালের গর্ভে সবই যে কত নশ্বর, কত ভঙ্গুর সেই বেদনার কথাও মনে করিয়ে দেয় বইকি!

সকালের নরম রোদে অনেকটা সময় আমরা কাটালাম এই প্রাচীন রোমান ধ্বংসাবশেষে। পাহাড়ের এই উঁচু জায়গা থেকে রোমান যুগের ভাঙা সব পাথরের টুকরোর মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আধুনিক আম্মান শহরের দিকে তাকালে অপরূপ লাগে। পুরনো আর নতুনের সংমিশ্রণে সে এক অপূর্ব দৃশ্য! গা-শিরশির করে উঠলো এই ভেবে যে, হাজার হাজার বছরের পুরনো এই শহরে কত কত মানুষের জীবন কত রকমভাবেই না বয়ে গিয়েছে! কত হাজার, লাখ মানুষের কত গল্প মিশে আছে এখানকার আকাশে, বাতাসে, মাটিতে! এই অনুভূতির তুলনা হয় না – ইতিহাস ভালোবাসা প্রত্যেক পর্যটকের এই অনুভূতি হবেই হবে এখানে দাঁড়িয়ে! আমাদের গাইড ওয়ালিদভাই দেখালেন যে, পাহাড়ের এখান থেকেই হাঁটা দূরত্বে দেখা যাচ্ছে বিখ্যাত ফিলাডেলফিয়া, পুরনো আমলের থিয়েটার দেখার জায়গা, একটু পরেই যেখানে আমাদের যাওয়ার কথা।

হারকিউলিসের মন্দির পেরিয়ে এলে দেখা মেলে অটোমান যুগের এক প্রাসাদ, বাইজেনটাইন যুগের এক চার্চ এবং
নাম-না-জানা আরো কত ধ্বংসাবশেষের। ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি বাইজেনটাইন আমলের গির্জাও এখন দৃশ্যমান। কিছু স্তম্ভ এবং মোজাইক করা মেঝে সেই গির্জার স্মৃতি বহন করছে। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ভ্রমণ করেন এই স্থানটি, যেখান থেকে আম্মান শহরটি পাখির চোখে দেখা যায়।

ইসলামিক সভ্যতার নিদর্শন : বিশাল উমাইয়া প্রাসাদ

উমাইয়া আমলের প্রশাসনিক প্রাসাদটি এখনো আকর্ষণীয় স্থাপনা হয়ে টিকে আছে এখানে, খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীতে যেটা নির্মিত হয়। যদিও ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই প্রাসাদের খুব সামান্য অংশই এখন অবশিষ্ট আছে। নীল গম্বুজের অভ্যর্থনা কক্ষটি এখনো দেখা যায়। চমৎকার স্থাপত্যের এই প্রাসাদের ভগ্নাংশটি সাক্ষী হয়ে আছে ইসলামের ইতিহাসের সুবর্ণ সময়ের, যা পর্যটকদের আজো বিস্মিত করে। প্রাসাদের পাশেই ঘুরে ঘুরে দেখি বিশাল পানির আধার এবং আবাসিক ভবনসমূহের ধ্বংসস্তূপ। পাহাড়ের ওপর এই নগরদুর্গে পানির মজুদ ও সরবরাহ ছিল নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জ। এত উঁচুতে পানি সরবরাহের প্রাচীন পদ্ধতিও খুবই বিস্ময়কর। কূপ ও নালার মাধ্যমে এখানে পানি সংরক্ষণ ও বিভিন্ন ভবনে সরবরাহ করা হতো সুপ্রাচীন কাল থেকেই। উমাইয়া আমলের প্রাসাদ ছাড়া আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এখানে অবস্থিত ছিল। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় প্রতিদিনই হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় দেখা যায় পরিত্যক্ত প্রাসাদটি দেখতে। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের সময়ে দাঁড়িয়েও প্রাচীন সভ্যতার আশ্চর্য এসব উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রদর্শন আমাদের অসম্ভব বিস্মিত করে। অথচ এত উন্নত হয়েও এখনো বিশ্বজুড়ে সব মানুষের কাছে জীবনের দৈনন্দিন এসব সুবিধা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।

প্রত্নতাত্বিক জাদুঘরের জাদুর মায়ায় বন্দি

পাহাড়ের ওপর থেকে অপূর্ব দেখা যায় পুরো আম্মান শহর। ওখানেই আছে  চমৎকার একটি জাদুঘর, ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত, পুরনো এই জনপদের ঐশ্বর্য সব সাজিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঢোকার মুখেই চেখে পড়ে মেডুসার একটা দারুণ ভাস্কর্য। বলা হয়, জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনার সেবায় ছোটবেলাতেই নিজেকে উৎসর্গ করেছিল স্বর্ণকেশী রূপসী মেডুসা। তাই ধর্মযাজিকা হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিল দেবীর মন্দিরে। মেডুসার অপরূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে সমুদ্রের দেবতা পসাইডন প্রেমে পড়ে গিয়ে মন্দিরের ভেতরেই সঙ্গমে লিপ্ত হন। তার মন্দিরের ভেতর এমন কাণ্ডে ক্রুদ্ধ হলেন দেবী; কিন্তু স্বয়ং সাগরের দেবতাকে তো কিছু বলা যায় না।

অ্যাথেনার সব রাগ গিয়ে পড়ল বেচারি মেডুসার ওপর। তিনি অভিশাপ দেন মেডুসাকে, আর সঙ্গে সঙ্গে মেডুসার দুধে-আলতা গায়ের রং বদলে সাপের মতো সবুজ হয়ে যায়। মাথার ঘন চুল পরিণত হয় হাজার হাজার বিষাক্ত সাপে, কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত সাপের লেজে বদলে যায়। চোখদুটো হয়ে যায় আশ্চর্য রকম শীতল, সেদিকে যে তাকাবে সে নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়ে যাবে। এই কাহিনি মনে করে কিছুক্ষণ মেডুসার মূর্তির দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি জাদুঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লাম, বলা যায় না, আমিও যদি পাথর হয়ে যাই, সেই ভয়ে!

প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে ওই জাদুঘরের দ্রষ্টব্য বস্তুসমুদয়ের মূল্য অপরিসীম। গত ছয় হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাস ওখানে সাজিয়ে রাখা রয়েছে। ওই একটি ছোট কিন্তু অসীম মূল্যবান জাদুঘর দেখেই জর্ডানের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

রোম সম্রাটের ব্যবহৃত অলংকারসহ প্রায় অনেক কিছুই সংরক্ষণ করা আছে এই জাদুঘরে। একটা চুড়ির নকশা দেখে চমকে উঠলাম, হুবহু এমন নকশার একটা সোনার বালা আছে আমার! যুগ যুগ ধরে পোশাক, অলংকারের নকশা, ফ্যাশন এমন ঘুরেফিরেই আসে! কি আশ্চর্য!

সেই পুরনো শহর, ফিলাডেলফিয়া যার নাম

সিটাডেল ছাড়াও আম্মান শহরজুড়ে আছে আরো বেশ কিছু রোমান যুগের স্মৃতিচিহ্ন। শহরের পুবদিকে পুরনো শহরের ব্যস্ত এলাকার মাঝে এই পাহাড়ের গায়ে বসে আছে এক প্রকাণ্ড রোমান এম্ফিথিয়েটার যা তৈরি হয়েছিল ১৩৮-১৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীন আম্মান শহরের মধ্যে। আধুনিক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পুরনো আমলে ঘুরে বেড়ানোর এক অপূর্ব নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি। মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো পাথরের তৈরি এই স্থাপত্যের তিন দিক ঘিরে উঁচু গ্যালারি আর একদিকে মঞ্চ ও অন্যান্য স্থাপনা। শব্দবিজ্ঞানে তাদের কথিত দক্ষতার জন্য মঞ্চের এমন অবস্থান থেকে নট-নটী অথবা পুরোহিতের বচন একদম সবার ওপরের ধাপ থেকেও স্পষ্ট শোনা যেত বলে মনে হয়। দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তৈরি এই মুক্ত থিয়েটারটিতে একসঙ্গে ছয় হাজার দর্শক বসতে পারত এবং এটা এমনভাবে বানানো হয়েছিল যাতে দিনের কোনো সময়েই দর্শকদের চোখে সরাসরি সূর্যের আলো না এসে পড়ে। মজার ব্যাপার হলো, আম্মানবাসী আঠারোশো বছরেরও বেশি পুরনো এই সৌধকে মিউজিয়ামের মোমের পুতুল বানিয়ে রাখেনি বরং তাদের কাছে এটি নিত্যদিনের সাথি – বাচ্চারা ফুটবল খেলছে, উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরারা একসঙ্গে বসে গল্প বা গান-বাজনা করছে। কেউবা পড়ন্ত দুপুরের রোদের ওমটুকু গায়ে মেখে বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। কেউ সটান শুয়ে আছে – সব মিলিয়ে বেশ সহজ এবং মনোরম এক পরিবেশ।

আহা! কুনাফা!

আম্মান সিটাডেল থেকে আমরা যাবো মাউন্ট নেবো; কিন্তু ভোরবেলা থেকে এই পুরনো দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মন যতই ভরুক না কেন, পেটে সবার ততক্ষণে ইঁদুর-ছুঁচো ডন দেওয়া শুরু করেছে। ওয়ালিদভাইকে বলতেই বললেন, ‘রসো, রসো, এমন এক খাবার জায়গায় নিয়ে যাবো যে, সবাই সেটার কথা অনেকদিন মনে রাখবে -।’ তথাস্তু! সিটাডেল থেকে গাড়ি ছুটলো শহরের পথে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা জায়গায় গিয়ে থামলাম। বেশ কিছু খাবারের দোকান সেখানে আর সুগন্ধে ম-ম আশপাশ। ওয়ালিদভাই ঢুকলেন এক দোকানে, তাঁর পিছু পিছু আমরাও। পুরনো আর আধুনিক আয়োজনের সমন্বয়ে নানান খাবার বানানোর আয়োজন চলছে সেখানে – দোকানের আধুনিক সাজসজ্জা সেইসঙ্গে বড় উনুন, ওভেন সবকিছুই পাশাপাশি। দোকানে বেশ ভিড়। কর্মীরা দিয়ে কুল পাচ্ছে না। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলে উঠলো – ‘আরে কুনাফা! দারুণ!’ ঢাকায় এখন তামাম দুনিয়ার বিখ্যাত সব খাবার বেশ সহজলভ্য। সেই সুবাদে মানুষের কাছে জগদ্বিখ্যাত অনেক খাবারই বেশ পরিচিত। অনেকেই কুনাফার কথা বলাতে আমিও উৎসুক হয়ে রইলাম কখন আমার পালা আসবে, হাতে পাবো কুনাফা। চুলা থেকে একেবারে গরম গরম নামিয়ে মোড়কে করে সবার হাতে হাতে দিয়ে দিচ্ছে দোকানের কর্মীরা, ঠান্ডা করারও ফুরসত পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে আমার হাতে এলো আমার ভাগেরটা – অল্প সিরায় ভেজানো নরম এক টুকরো বেশ গরম খাবার; ফুঁ দিয়ে মুখে একটু একটু করে দিই আর মুহূর্তেই তা মুখের মধ্যে মসলিনের মতো গলে যায় – দারুণ সুস্বাদু কোনো সন্দেহ নেই! 

খাবারটা মূলত একধরনের মিষ্টি বা পেস্ট্রি। মধ্যপ্রাচ্যের লোকজন সাধারণত সকালের নাশতার সঙ্গেই খায়। স্ট্রিট ফুড হিসেবেও খুব নাকি জনপ্রিয়। সবাই মিলে চেটেপুটে কুনাফা গলাধঃকরণ করে তবেই ঠান্ডা হলাম। আমাদের কেউ কেউ এর সঙ্গে পরোটা রোলও খেল। তবে সত্যিই কুনাফার স্বাদ মুখে যেন লেগেই রইলো। পেটপুজোর পর আমাদের গন্তব্য নতুন আরেক জায়গা, মাউন্ট নেবো, তবে সে-গল্প আরেকদিন।

মিষ্টি এক শীতের সকালের

তিন-চারটে ঘণ্টা জর্ডানের রাজধানী শহর আম্মানের পুরনো এক  জনপদের কোনায় কোনায় ঘুরে যে ঐশ্বর্যের দেখা পেলাম তাতে সেই সকালটা যেন জীবনের এক সার্থক সকাল হয়ে উঠলো। জায়গাগুলো ধরে হাঁটতে হাঁটতে বারবারই গা-শিরশির করে উঠছিল এই ভেবে যে, কত লাখ বছর ধরে কত রকমের মানুষই না এই মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে! সকালটা শেষও হলো আরবদেশীয় অতীব উপাদেয় নতুন এক খাবারের স্বাদে যে স্বাদ শুধু সেদিনই না, আজ অবধি  মুখে লেগে আছে, এ যেন একেবারে মধুরেণ সমাপয়েৎ! গাড়িতে উঠতে উঠতে, শত বাধা ঠেলে এসে নিজের পা দুটো যে এখানে ফেলতে পেরেছি, সেজন্যে নিজেকেই বারবার ধন্যবাদ দিতে থাকি।