রিচার্ড ডাউকিন্স : জিন ও মিমসের গল্পকথক

ব্রিটেনের রয়াল সোসাইটি সায়েন্স বুক প্রাইজের ৩০তম বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। তারা পাঠকের ভোটে নির্বাচিত করেছে ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী বিজ্ঞান গ্রন্থ’ – আর ডারউইনের অরিজিন অফ স্পিসিস কিংবা নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমাটিকার মতো যুগান্তকারী বইগুলিকে হারিয়ে এ-অভিধাটি জয় করে নিয়েছে একজন স্বল্পপরিচিত জীববিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক রিচার্ড ডাউকিন্সের লেখা বই দ্য সেলফিশ জিন। এ-তালিকায় দ্বিতীয় স্থানটি ছিল বিল ব্রাইসনের লেখা অ্যা শর্ট হিস্টরি অফ নিয়ারলি এভরিথিং (২০০৩) এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে চার্লস ডারউইনের ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত বহুল আলোচিত ধ্রুপদী গ্রন্থ অরিজিন অফ স্পিসিস।

দ্য সেলফিশ জিন ও এর লেখক রিচার্ড ডাউকিন্সকে আমরা কতটুকু জানি?

রিচার্ড ডাউকিন্স জন্মেছিলেন ২৬শে মার্চ, ১৯৪১ সালে – তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্লিনটন রিচার্ড ডাউকিন্স, যা থেকে পরে প্রথম নামটি ছেঁটে ফেলা হয়। তাঁর মা ছিলেন জিন মেরি ভিভিয়ান এবং বাবা ক্লিনটন জন ডাউকিন্স, যিনি নিয়াসাল্যান্ডে (বর্তমান মালাউয়ি) একজন কৃষি কর্মকর্তা ছিলেন। রিচার্ডের বয়স যখন আট বছর, তখন তাঁর পরিবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসে। উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর পিতা অক্সফোর্ডশায়ারে একটি কৃষি খামার পেয়েছিলেন, সেখানে তিনি বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু করেন। রিচার্ড তাঁর বোন সারাহকে নিয়ে অক্সফোর্ডে বাস করতে থাকেন। রিচার্ডের পিতামাতা দুজনেই প্রকৃতিবিজ্ঞানে উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে তিনিও বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে খ্রিষ্টান হলেও একসময় রিচার্ড আবিষ্কার করেন যে, বিবর্তনবাদের তত্ত্ব ধর্মীয় ব্যাখ্যার চেয়ে আরো পরিষ্কারভাবে সৃষ্টিতত্ত্ব ও জীবনের জটিল বিন্যাসকে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ। তখন থেকেই তিনি প্রথাগত ধর্মে আস্থা হারান। তিনি নিজে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন – ‘জীবনের জটিলতা নিয়ে আমি এতটা মুগ্ধ ছিলাম যে আমি ভাবতাম, নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন। কিন্তু আমি যখন ডারউইন তত্ত্ব অনুধাবন করলাম, তখন দেখতে পেলাম যে, সেটি জীবনকে ব্যাখ্যা করতে ধর্মীয় ব্যাখ্যার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। তখন আমার মনে হলো, কেউ যেন আমার পায়ের নিচে থেকে কার্পেটটি টেনে নিয়ে গেছে। আমি স্রেফ দাঁড়িয়ে রয়েছি মাটির ওপর – পায়ের নিচে আর কিছু নেই।’

নর্দাম্পটনশায়ারের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি ১৯৫৪ সাল থেকে ’৫৯ সাল পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করেন। এ-সময়েই তিনি প্রথমবারের মতো বার্ট্রান্ড রাসেলের কেন আমি খ্রিষ্টান নই (Why I am not a Christian) বইটি পাঠ করেন, যা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। অক্সফোর্ডের বালিয়ান কলেজ থেকে তিনি ১৯৬২ সালে জীববিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন নোবেলজয়ী নীতি, আচরণ ও চরিত্র গঠন বিশেষজ্ঞ (Ethologist) নিকোলাস টিনবার্গেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে গবেষক শিক্ষার্থী হিসেবে রিচার্ড কাজ শুরু করেন এবং পরে এমএ এবং ১৯৬৬ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। প্রাণীদের আচরণ, বিশেষ করে তাদের সহজাত প্রবৃত্তি, শিক্ষা-ক্ষমতা – ইত্যাদি বিষয়ে টিনবার্গেন ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তাঁর অভিভাবকত্বে ডাউকিন্সের গবেষণা ছিল প্রাণীরা কীভাবে তাদের সিদ্ধান্ত নেয়, এর ওপর। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে জীববিজ্ঞানে সহকারী অধ্যাপক (১৯৬৭-৬৯) হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এখানে চাকরিরত অবস্থায় তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। উনিশশো সত্তর সালে তিনি অক্সফোর্ডে ফিরে এসে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন, যেখানে ১৯৯০ সালে তিনি উন্নীত হন রিডার পদে। এরপর ১৯৯৫ সালে তিনি ‘পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফর সায়েন্স’-এর সিমোনেই অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান, যে-পদটি তিনি ২০০৮ সাল পর্যন্ত অলংকৃত করেন। এই বিশেষ অধ্যাপক পদটিতে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হাঙ্গেরিয়ান-মার্কিন বিজ্ঞানী চার্লস সিমোনেইয়ের ইচ্ছানুসারে ‘বিজ্ঞান প্রচার ও জন-অবহিতকরণে ভূমিকা’র জন্য কাউকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করা হয়েছিল।

রিচার্ড ডাউকিন্স তাঁর কর্মজীবনে বিজ্ঞান-অবহিতকরণে বহু বক্তৃতা দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রথম ইরেসমাস ডারউইন বক্তৃতা (১৯৯০), মাইকেল ফ্যারাডে বক্তৃতা (১৯৯১), টিএইচ হাক্সলি স্মারক বক্তৃতা (১৯৯২), ইরভিন স্মারক বক্তৃতা (১৯৯৭), টিনবার্গেন বক্তৃতা (২০০৪), শিশুদের জন্য রয়াল ইনস্টিটিউট ক্রিস্টমাস বক্তৃতা – ‘মহাবিশ্বে বেড়ে ওঠা’ – ইত্যাদি। বিবর্তনবিষয়ক বিশ্বকোষের তিনি সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, কাউন্সিল ফর সেকুলার হিউম্যানিজম ও স্কেপটিক ম্যাগাজিনেরও তিনি সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। বেশ কিছু পুরস্কারের বিচারক প্যানেলেরও তিনি সদস্য, যেমন রয়াল সোসাইটির ‘ফ্যারাডে পুরস্কার’, ব্রিটিশ অ্যাকাডেমির টেলিভিশন পুরস্কার ইত্যাদি। তিনি ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের জীববিজ্ঞান শাখার সভাপতি। অক্সফোর্ডের বালিয়ান কলেজ ২০০৪ সালে তাঁর নামে প্রবর্তন করেছে ডাউনিক্স পুরস্কার, যা পরিবেশ ও প্রাণী-আচরণ সংক্রান্ত গবেষণা ও প্রাণীকল্যাণে, বিশেষ করে মানুষের ক্রিয়াকলাপে হুমকির মুখোমুখি হওয়া প্রাণীদের কল্যাণে উৎসর্গিত। ২০০৮ সালে সিমোনেই অধ্যাপক পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি আবার ২০১১ সালে লন্ডনের নিউ কলেজ অফ হিউম্যানিটিজ নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

ডাউকিন্স বিজ্ঞান পাঠকদের নজরে আসেন ১৯৭৬ সালে, তাঁর বিখ্যাত বই স্বার্থপর জিন (The Selfish Gene) প্রকাশিত হওয়ার পর। এ-বইটিতে তিনি বিবর্তনের একক এবং প্রধান শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বংশগতির বাহক অণু জিনকে। একই সঙ্গে তিনি আরো একটি শব্দবন্ধকে পরিচিত করিয়েছেন, যা এসেছে মেমোরি বা স্মৃতিশক্তির সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে। বিবর্তনের প্রকৃতি নিয়ে ব্যাখ্যায় (যাকে সংক্ষেপে ডারউইন-যুদ্ধ বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে) বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরা পরিষ্কার দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এঁদের একভাগকে বলা হয় ডাউকিন্স অনুসারী, অন্য পক্ষ হচ্ছেন মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ স্টিফেন জে গোল্ডের অনুসারী। প্রথম দলে রয়েছেন স্টিফেন রোজ, লিয়ন জে কামিন, রিচার্ড সি লেওনথিন, স্টিভেন পিনকার, ড্যানিয়েল ড্যানেট প্রমুখ জীববিজ্ঞানী ও দার্শনিক – যাঁরা সমর্থন করেন বিবর্তনের জিনকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীববিজ্ঞানের লঘুকৃত (reductionism) চিন্তাধারা। প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও ডাউকিন্স এবং গোল্ড ২০০২ সালে গোল্ডের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পারস্পরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। ডাউকিন্স ২০০৩ সালে তাঁর প্রকাশিত বই A Devil’s Chaplain-এ গোল্ডকে নিয়ে একটি পুরো অধ্যায় জুড়ে আলোচনা করেছেন।

ডাউকিন্স তাঁর বহুল আলোচিত শব্দবন্ধ ‘মিমস’ (memes) প্রথমবার উল্লেখ করেছেন দ্য সেলফিশ জিন বইটিতে, যা নেওয়া হয়েছে স্বল্পপরিচিত জার্মান জীববিজ্ঞানী রিচার্ড সেমনের কাছ থেকে। সেমন শব্দটি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন আমাদের উত্তরাধিকারলব্ধ স্নায়বিক স্মৃতির সংগ্রহকে। এ-শব্দবন্ধটি মরিস মেটেরলিংকের The Life of White Ant বইতেও উল্লেখ করা হয়েছে। মিমস হচ্ছে আমাদের কিছু অভ্যাস, দক্ষতা, আচরণ, আইডিয়া বা গল্প – যা অনুকরণ হিসেবে একজনের কাছ থেকে অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয়। জিনের মাধ্যমে যেমন আমাদের অনেক দোষ-গুণ বংশবাহিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি মিমসও এক্ষেত্রে জিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে – তবে তা জীবকোষস্থ কোনো রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে নয়, বরং মস্তিষ্ক থেকে মস্তিষ্কে, মস্তিষ্ক থেকে কম্পিউটার, বই, চিত্রকলা, বা অন্য শিল্পমাধ্যমসমূহের দ্বারা বাহিত হয়ে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে একটি সফল মিমস পৃথিবীজুড়ে অল্পকালের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা পৃথিবীব্যাপী মানুষের মন-মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কৃতি ও ধারণাকে পরিবর্তিত করে নতুন রূপ দান করতে পারে।

জীববিজ্ঞানের বাইরে তাঁর ধর্মীয় মতামত সম্পর্কীয় বই গড ডিল্যুশন বের হয় ২০০৬ সালে, যা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। এর ৩ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয় ২০১৫ সালের মধ্যেই এবং সেটি ৩০টি ভাষায় অনুবাদ হয়। বইটি নব্যনাস্তিকতাবাদের উত্থানে ভূমিকা রেখেছে বলেও মনে করা হয়। আগ্রাসী নাস্তিকতা (militant atheism) নামে তাঁদের এ-দর্শনের প্রচারক হচ্ছেন ‘চার ঘোড়সওয়ার’ (Four Horsemen) নামে পরিচিত ক্রিস্টোফার হিচেন্স, স্যাম হ্যারিস, ড্যানিয়েল জ্যানেট ও রিচার্ড ডাউকিন্স। সব নিরীশ^রবাদীকে তাঁরা আহ্বান করেছেন তাঁদের মতাদর্শের ব্যাপারে লাজুক ও অন্তর্মুখী না হয়ে তা দৃঢ়ভাবে প্রচার করতে, রাজনীতি ও বিজ্ঞানচর্চায় চার্চের অশুভ হস্তক্ষেপ ও প্রভাব রোধ করার আন্দোলনে এগিয়ে আসতে। শিক্ষা নিয়ে তাঁর মতামত ডাউকিন্স পরিষ্কারভাবে জানান – তিনি কোনো ধর্মীয় মন্ত্রপূতকরণ (indoctrination) পছন্দ করেন না, বরং তার বদলে শিশুদের যুক্তিবাদী, সংশয়ী ও মুক্তমনা হওয়ার শিক্ষা দিতে আগ্রহী। এ-ধরনের স্কুল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিতে পারে, তবে তা কোনো আব্রাহামিক ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়ে নয়, বরং গ্রিক ও ইউরোপীয় সাহিত্যকে বুঝতে সহায়তাকারী মৃত ধর্মগুলি (প্রাচীন গ্রিক ও নর্স দেবতা-কাহিনি) শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। একইভাবে তিনি উপদেশ দেন যে, ক্যাথলিক শিশু, ইহুদি শিশু, মুসলিম শিশু – ইত্যাদি পরিচয়ে কাউকে আখ্যায়িত করা বাতুলতা মাত্র, যেমনটি হচ্ছে কোনো সমাজতন্ত্রী পিতামাতার সন্তানকে মার্কসিস্ট শিশু আখ্যা দেওয়া। পিতামাতার ধর্মবিশ্বাসের ভার শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই অনুচিত।

বেশ কিছু মনীষী, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ক্রিস্টোফার হিচেনস, স্টিভেন পিনকার, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন, স্টিভেন ওয়েনবার্গ প্রমুখ – তাঁরা ডাউকিন্সের এই মতামত সমর্থন করেছেন। তবে নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ পিটার হিগ্স, মার্টিন রিসসহ আরো কিছু মনীষী এই বলে তাঁর সমালোচনা করেছেন যে, এই অবস্থান ধর্মীয় মৌলবাদেরই একটি বিপরীত সংস্করণ, যা ধর্মীয় সহিংসতাকে উস্কে দেবে। কেউ কেউ বলেন যে, ধর্মের উপকারী দিকগুলিকে ডাউকিন্স একেবারে এড়িয়ে যান। তবে ডাউকিন্স জবাব দেন যে, অধ্যাত্মবাদীদের সক্ষমতা মহাবিশ্বের রহস্য বিশ্লেষণ ও উন্মোচনে কখনোই বিজ্ঞানীদের চেয়ে বেশি নয়। তাঁরা যদি নতুন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেন, তবে তিনি তাঁদের মত মেনে নিতে সর্বদাই তৈরি। সৃষ্টিবাদ বা creationism-এর তিনি উচ্চকণ্ঠ সমালোচক, যে মত দাবি করে থাকে যে, জীবন, মানুষ ও মহাবিশ্ব কোনো দেবতা বা ঈশ্বরের সরাসরি সৃষ্টি – বিবর্তনের কোনো ভূমিকা এতে নেই এবং আমাদের পৃথিবী মাত্র কয়েক হাজার বছরের পুরনো। গণমাধ্যমে প্রায়শ তাঁকে উল্লেখ করা হয় ‘ডারউইনের রটওয়েলার’ (‘রটওয়েলার’ এক ধরনের শিকারি কুকুর) বলে, যা টিএইচ হাক্সলির কথা মনে করিয়ে দেয়, যাঁকে ভাবা হতো ‘ডারউইনের বুলডগ’। স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষায় সহায়তাকল্পে প্রয়োজনীয় বইপত্র-ডিভিডি ইত্যাদি সরবরাহ করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘রিচার্ড ডাউকিন্স ফাউন্ডেশন ফর রিজন অ্যান্ড সায়েন্স’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান।

পৃথিবীর জনসংখ্যা সমস্যাটিকে তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখেন এবং বর্তমান জনসংখ্যা-ভারাক্রান্ত পৃথিবীর ভার লাঘবে তিনি সচেষ্ট। তাঁর দ্য সেলফিশ জিন বইটিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, লাতিন আমেরিকার জনসংখ্যা গত ৪০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। রোমান ক্যাথলিক চার্চের জন্মনিয়ন্ত্রণবিরোধী রীতিকে তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় নরবানর বা এপদের বিলুপ্তিরোধে গঠিত গ্রেট এপ প্রজেক্টে তিনি তাঁর সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর যৌবনে তিনি যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী সক্রিয় কর্মী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি প্রৌঢ় বয়সে ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট বুশের ইরাক আক্রমণ ও দখলের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে সরিয়ে একজন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিয়ে আসার আন্দোলনেও তিনি যুক্ত রয়েছেন। জাতিসংঘের বর্তমান ‘অগণতান্ত্রিক’ কাঠামোকে সংস্কার এবং একটি পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি প্রতিষ্ঠা করতেও তিনি আগ্রহী। বর্তমান নারীবাদী আন্দোলনেরও তিনি জোর সমর্থক।

অক্সফোর্ড থেকে ১৯৮৯ সালে ডক্টর অফ সায়েন্স উপাধি লাভ করার পর তিনি আরো বারোটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে অনারারি ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন। এগুলি ছাড়াও তিনি প্রচুর পদক পেয়েছেন – যেমন মাইকেল ফ্যারাডে পদক (১৯৯০), আমেরিকান হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন পদক (১৯৯৬), আন্তর্জাতিক কসমস পুরস্কার (১৯৯৭), ইতালিয়ান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্সি পদক (২০০১), আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ অ্যাচিভমেন্ট পদক (২০০৬) ইত্যাদি। ব্রিটেনের প্রসপেক্ট ম্যাগাজিন আয়োজিত শীর্ষ বুদ্ধিজীবী বাছাই প্রতিযোগিতায় ২০০৪ সালে তিনি ১০০ জনের মধ্যে প্রথম হন – রানারআপের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট বেশি পেয়ে। তাঁর নামে শ্রীলঙ্কা ২০১২ সালে নতুন একটি প্রজাতির মাছকে Dawkinsia নামে নামকরণ করে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিনবার বিয়ে করেছেন, তবে শুধু তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ইভা বারহামের গর্ভে জুলিয়েট এমা ডাউনিক্স (জন্ম ১৯৮৪) নামে এক কন্যাসন্তান রয়েছে। ২০১৬ সালে তিনি একবার মৃদু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তবে তা থেকে পুরোপুরি সেরে উঠেছেন।

যে-দুটো বিষয়কে সামনে এনে রিচার্ড ডাউকিন্স জনপ্রিয় হয়েছেন, সেই জিন ও মিমস্ সম্পর্কে আরো কিছু বিষয় আলোচনা করা যাক। ডাউকিন্স দেখিয়েছেন যে, প্রথম জৈব অণু, যা নিজে নিজে বংশবিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল, তা হচ্ছে আদিকালীন স্যুপ (Primordial Soup)-এর মধ্যস্থিত অণুসমূহ। সেগুলিই একই রকমভাবে বংশবিস্তারে অসমর্থ অণুসমূহের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে। বংশবিস্তারে সক্ষম এই অণুসমূহই (replicating molecules) যতই জটিলতর আকার ধারণ করতে থাকে, ক্রমশ তারা পরিণত হয় জীবদেহস্থিত কোষের জিনে। জিনের বাহক এই জীবদেহগুলি কাজ করছে শুধু জিনগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্র (survival machine) হিসেবে। তিনি আরো দেখিয়েছেন যে, এভাবে জিনের বিভিন্ন সম্মিলন জীবদেহটিকে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, তেমনি জিন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতেও ভূমিকা রেখেছে। তাই যে-কোনো ‘সফল জিন’ তার জীবদেহটির জন্যও সফলতা বয়ে আনে। এরই একটি উদাহরণ হচ্ছে এমন কিছু জিন, যারা জীবদেহটিকে কোনো রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এভাবেই জিন যেমন নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে ‘জিনপুলের’ বিস্তৃতি ঘটাতে সাহায্য করে, তেমনি সাহায্য করে জীবদেহ বা প্রাণীর বেঁচে থাকা ও কোনো প্রজাতির সফলভাবে টিকে থাকার সংগ্রামেও।

দু-একটি ক্ষেত্রে জিন ও জীবদেহটির মধ্যে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিতে পারে, যেমনটা দেখা যায় কিছু প্রজাতির মাকড়সার ক্ষেত্রে। যৌন সংগমের পর কিছু স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সাটিকে খেয়ে ফেলে, এরপরও পুরুষ মাকড়সা সে-যৌনক্রীড়াতে অংশগ্রহণ করে। এর কারণ, তার জীবদেহটি নষ্ট হলেও তার ‘জিনপুল’ উত্তরসূরিদের মধ্যে বেঁচে থাকে। তাই এক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, জীবদেহ ও জিনের সংঘাতে জিনটির স্বার্থই প্রাধান্য পায়। একইভাবে বিশ্লেষণ করা যায় পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে ছোট পরিবার গড়ে তোলার ঘটনাকেও। এটি যদিও সন্তান-সন্ততি বা অপত্যসংখ্যা হ্রাস করে, তবে অপত্যদের ভালোভাবে প্রতিপালন করার স্বার্থেই তা করা হয়ে থাকে। এখানেও মোট অপত্যসংখ্যা নয়, বেঁচে থাকা অপত্যদের জিনপুল বিস্তারের সুযোগটিই প্রধান বলে বিবেচিত হয়। পরার্থপরতার (altruism) পেছনে লুকানো রহস্যটিকেও এভাবে জিনের স্বার্থ সংরক্ষণ হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।

আমরা যখন মারা যাই, তখন আমরা শুধু দুটো জিনিস রেখে যাই – জিন এবং মিমস্। আমরা সবাই হচ্ছি জিন মেশিন, যারা তাদের জিনসমূহ অপত্যদের দেহে বিস্তার করতে ব্যস্ত। কিন্তু কয়েকটি প্রজন্ম পরেই জিন তার পূর্বপুরুষদের তথ্য বিস্মৃত হয়ে যায় – আপনার চেহারার সৌন্দর্য, গানের গলা বা চুলের রং কয়েক প্রজন্ম পর আর কিছুই থাকবে না। এর কারণ হচ্ছে প্রতি প্রজন্মেই আপনার জিনলব্ধ তথ্য কমে অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি শিল্পকলা, সাহিত্য বা সংগীতজগতে অবিস্মরণীয় কিছু করেন, এটি অবিকৃতভাবে অনেক শতাব্দী ধরে রয়ে যেতে পারে। হোমার, বাল্মীকি বা সক্রেটিসের জিনের ভগ্নাংশও হয়তো এখন পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না; কিন্তু তাতে কী? হোমার, বাল্মীকি, সক্রেটিস, দা ভিঞ্চি, আর্কিমিডিস, ওমর খৈয়াম বা বিথোভেনের মিমস্ আজো আমাদের মধ্যে যথেষ্ট শক্তি নিয়েই বেঁচে আছে।

এই মিমস্-সমষ্টি (memeplexes)-র মধ্যে রয়েছে এমন কিছু, যা আমাদের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করে – যেমন অর্থব্যবস্থাপনা, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহ, আইনব্যবস্থা, শিল্পকলা, ক্রীড়া ইত্যাদি। আবার অন্যদিকে কিছু মিমস্ রয়েছে যা সংক্রামক রোগের মতো একের কাছ থেকে অন্যকে সংক্রমিত করে। এর মধ্যে রয়েছে হাতুড়ে চিকিৎসা, কাল্ট, চেইন লেটার, কম্পিউটার ভাইরাস ইত্যাদি। এ-ধরনের সংক্রমণের পেছনে যা কাজ করে, তা হচ্ছে Ôcopy meÕ নামক নির্দেশ – যা প্রধানত প্রলোভন বা হুমকির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। ডাউকিন্স এদের মধ্যে রেখেছেন ধর্মীয় নানা আচার-অনুষ্ঠানকেও – যেমন খাবারের আগে প্রার্থনা, আরাধনা সংগীত, জাঁকজমকপূর্ণ বিশালাকায় ধর্মীয় স্থাপনা ইত্যাদি। এ-সবকিছুই ইহজীবন-পরবর্তী জীবনে স্বর্গে যাওয়ার লোভ অথবা চিরকাল নরকভোগের ভয় থেকে উদ্ভূত।

এই মিমস্ এত শক্তিশালী হতে পারে যে, তা জিনের বিস্তারকেও রোধ করতে সক্ষম, যেমন ধর্মযাজকদের কৌমার্যব্রত। ডাউকিন্সের মতে, পরকালে বিশ্বাস এমনই একটি মিমস্, যা আমাদের মস্তিষ্ককে পুরোপুরি অধিকার করে নেয় এবং বিচারবুদ্ধিকে বিলুপ্ত করে। আমরা জানি না যে, আমাদের ‘মিমস্পুলে’ কখন অনুপ্রবেশ করেছে ঈশ্বর এবং পরকালের ধারণা, তবে তা ইতোমধ্যে পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি মানুষের মস্তিষ্ককেই বাসস্থান করে নিয়েছে। এ সমস্ত বিশ্বাসের সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই, তবে তা আমাদের জীবনযাপনে এক ধরনের নিশ্চিন্তি ও মানসিক প্রশান্তি এনে দিয়েছে। আমাদের সত্তা-আলোড়নকারী অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলিকে দমিয়ে রাখতে এই মিমস্ এক ধরনের সুরক্ষা প্রদান করছে। সম্ভবত এটি চিকিৎসকদের দেওয়া সান্ত্বনামূলক ওষুধ (placebo) বা জড়িবুটির মতোই একটি ব্যবস্থাপত্র।

তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ দ্য সেলফিশ জিনে এভাবেই রিচার্ড ডাউকিন্স বিবৃত করেছেন জিন এবং মিমসের গল্প। সেলফিশ জিন ছাড়াও আরো কয়েকটি বইয়ে তিনি বিবর্তনের কাহিনিকে জনবোধ্য ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে – The Extended Phenotype (1982), The Blind Watchmaker (1986), Climbing Mount Improbable (1996), Unweaving the Rainbow (1998),  A Devil’s Chaplain (2003), The God Delusion (2006), The Greatest show in Earth (2009), The Magic of Reality (2011), Science in the Soul (2017) ইত্যাদি। আশি বছর বয়সে পৌঁছেও তিনি শারীরিক অসুস্থতা ও অন্যান্য প্রতিকূলতা জয় করে এখনো লেখালেখি ও বিজ্ঞানের মর্মবাণী প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তিনি আরো দীর্ঘদিন আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে বেঁচে থাকুন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

* রটওয়েলার এক ধরনের শিকারি কুকুর।