যন্ত্র ও তার মন

সম্ভবত আমাদের মন হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্রের ভৌতসত্তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি বিমূর্ত ও জটিল বিন্যাস। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে একই জিনিস কি স্নায়ুতন্ত্র ছাড়া অন্যান্য ভৌত বস্তুর মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব? সেটি হতে পারে একটি পিঁপড়ের কলোনি, যেখানে সবাই মিলে কাজ করে একটি সামগ্রিক সত্তা হিসেবে; অথবা অর্ধপরিবাহী ট্রানজিস্টরের একটি নেটওয়ার্ক, যা একসঙ্গে মিলে স্নায়ুতন্ত্রের সজ্ঞান মনের মতোই কাজ করতে পারে। অর্থাৎ আমাদের চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ ইত্যাদি স্নায়ুতন্ত্রের উচ্চতর স্তরের কাজগুলো কি জৈব, ইলেকট্রিক অথবা অন্য কোনো উপায়ে করা সম্ভব?

একটি যন্ত্র কি মানুষের মতোই ভাষা ব্যবহার করে মানুষের যোগাযোগ রক্ষা করতে সমর্থ? ভাষা-ব্যবহারকারী সেরকম একটি যন্ত্রকে যদি মনে হয়, সে মানুষের ভাষা বুঝতে পারছে এবং তার নিজস্ব আইডিয়াও রয়েছে, তখন সেটি কি শুধু ঊনবিংশ শতকের একটি সরল গণনাযন্ত্র অথবা বিংশ শতকের একটি ওয়ার্ড-প্রসেসরের মতোই নিজস্ব চিন্তাহীন অন্তঃসারশূন্য যন্ত্র? প্রকৃত সজ্ঞান মন, বুদ্ধিমান মন এবং চাতুর্যের সঙ্গে তৈরি করা ফাঁপা ভাষা-ব্যবহারকারী মুখোশপরা যন্ত্রের সঙ্গে আমরা কীভাবে পার্থক্য করতে পারব? বোধ-বুদ্ধি ও যুক্তিচিন্তা কি জীবিত জিনিসকে যান্ত্রিক হিসেবে দেখার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ?

একটি যন্ত্র কি কখনো নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে? একটি যন্ত্রের কি কোনো ‘বিশ্বাস’ থাকতে পারে? একটি যন্ত্র কি ভুল করতে পারে, তার আপন ইচ্ছায়? যন্ত্র কি বিশ্বাস করতে পারে যে, তার সিদ্ধান্তটি সে নিজেই নিয়েছে? সে কি দাবি করতে পারে যে, সে স্বাধীন চিন্তার (Free will) অধিকারী? সে কি এমন কোনো আইডিয়াতে পৌঁছুতে পারে, যা তার মধ্যে পূর্ব-প্রোগ্রামকৃত নয়? একটি নির্দিষ্ট নিয়মের সেট থেকে কি সৃষ্টিশীলতা জন্ম নিতে পারে? আমরা, এমনকি আমাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে সৃষ্টিশীল, তারা কি আসলেই পদার্থবিদ্যার নিয়মের দাস স্নায়ুতন্ত্রের মালিক একটি ভৌত যন্ত্র মাত্র?

যন্ত্র কি কখনো আবেগাক্রান্ত হতে পারে? আমাদের আবেগ এবং প্রজ্ঞা কি আমাদের মস্তিষ্কের আলাদা অংশ বা খোপে বাস করে? মানুষের মতোই একটি যন্ত্রও কি কোনো ব্যক্তি, আইডিয়া কিংবা অন্য আরেকটি যন্ত্রকে দেখে উল্লসিত হতে পারে? একটি যন্ত্র কি অন্য আরেকটি যন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে পারে বা প্রেমে পড়তে পারে? সেরকম ক্ষেত্রে তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটি কী দাঁড়াবে? এর কি কোনো শ্লীল-অশ্লীল অথবা নৈতিক-অনৈতিক নীতিমালা থাকবে?

একটি যন্ত্র কি কখনো হতাশায় আক্রান্ত হতে পারে? হতাশাগ্রস্ত হয়ে কি সে ঘরের বাইরে চলে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে তার হতাশা বা উত্তেজনা প্রশমন করতে পারে? সে কি ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নেওয়া কিংবা টেনিস খেলার একটি প্রতিযোগিতার মধুর বেদনা উপভোগ করতে পারে? চরম কোনো মানসিক পরিস্থিতিতে মানুষ যেভাবে আত্মহত্যা করে, তেমনি একটি যন্ত্রও কি কখনো নিজেকে নষ্ট করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

এসব প্রশ্ন বিভিন্ন সময়ে আমাদের অনেকের মনেই উঁকি দিতে পারে, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, অন্তত একজন মানুষের মনে তা উঁকি দিয়েছিল, যাঁর নাম অ্যালান ট্যুরিং। আধুনিক কম্পিউটারের আবিষ্কারক বলে যাঁকে মনে করা হয়, প্রতিভাবান সেই ব্রিটিশ গণিতপ্রতিভা খুব বড় অবদান রেখেছেন জার্মান সামরিক কোড ভাঙার কাজ করে। সে-মানুষটিই আবার সমকামিতার অভিযোগে বিচারের দণ্ড মাথায় নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। বিংশ শতকের বিজ্ঞানে এটি একটি বড় ট্র্যাজেডি।

অ্যালান ট্যুরিংয়ের নিবন্ধ ‘Computing Machinery and Intelligence’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে, দর্শনের সাময়িকী মাইন্ডে। এতে প্রথমবার ‘ট্যুরিং টেস্ট’ নিয়ে আলোচনা করা হয়, যাতে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অদৃশ্য দুজনের মধ্য থেকে পার্থক্য করতে হবে কে মানুষ আর কোনটি কম্পিউটার। সাধারণত একটি কম্পিউটার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে সমর্থ, যেখানে মানুষের জন্য প্রয়োজন হয় অনেকটা সময়। অবশ্য এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁরা পরিগণনের কাজে কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুতগতিসম্পন্ন, যাঁদের একজন হচ্ছেন ভারতের বিখ্যাত শকুন্তলা দেবী। তেমনই একজন ছিলেন কৃষকের সন্তান জোহান মার্টিন জাকারিয়াস ও অন্যজন এডিনবরার গণিতের অধ্যাপক আলেকজান্ডার অ্যাটকিন – যাঁদের মুখে মুখে পরিগণনার ক্ষমতা ছিল কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুত।

দুই

‘যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি যন্ত্র একটি সনেট লিখতে পারছে, অথবা যন্ত্রসংগীতের একটি ঐকতান রচনা করতে পারছে, যা তার চিন্তা ও অনুভূতি থেকে উদ্ভূত, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনো যন্ত্রকে আমাদের মস্তিষ্কের সমান বলে ভাবতে পারব না। একটি যন্ত্র তার সাফল্য নিয়ে গর্ব করতে, তার একটি বাল্ব ফিউজ হলে হতাশা বোধ করতে, অন্যের স্তুতি শুনে গরম হতে, তার ভুলের জন্য দুঃখে নিপতিত হতে, যৌন উত্তেজনায় চমৎকৃত বোধ করতে, কিছু কামনা করে না পেলে রাগান্বিত বা দুঃখিত হতে সমর্থ নয়।’ – এ-কথাগুলো বলেছিলেন অধ্যাপক জেফারসন ১৯৪৯ সালে, তাঁর ‘লিস্টার বক্তৃতা’য়।

যন্ত্র ও মানুষের মনের মধ্যে অপরিমেয় পার্থক্য রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও অনেকে ধারণা করেন যে, মানুষের মন কাজ করে কম্পিউটারের মতোই। এটি এমন একটি ধারণা, যার স্বপক্ষে এমন কোনো শক্ত প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। আমরা শুধু এটি জানি যে, আমাদের মন কিছু প্রতীকী কাজ (Symbolic operatiions) সম্পন্ন করতে পারে – যেমন সংখ্যার যোগ-বিয়োগ-পূরণ-ভাগ করা, শব্দের তুলনা করা, সংগীতের স্বর পরিবর্তন করা ইত্যাদি। কিন্তু এটি হতে পারে যে, আমাদের মনে আরো এমন কিছু ঘটে, যেগুলো সম্পূর্ণরূপে অ-প্রতীকী (যেমন আবেগ-অনুভূতি) অথবা তারও চেয়ে নিচুস্তরের কার্যকলাপ (কোনো বস্তুকে দেখা অথবা পার্থক্য করা), যেগুলোর জন্য উচ্চ স্নায়ুকেন্দ্রগুলোর সাহায্য প্রয়োজন হয় না। মানুষের মনরূপী পরিগণন মডেলের সীমারেখা পরীক্ষা করাটা দর্শনেরও একটি আকর্ষণীয় নতুন অধ্যায়।

মানবদেহ গঠিত রক্তমাংসে এবং কম্পিউটার গঠিত ধাতু ও সিলিকনে। কেউই আমাদের সম্পর্কে বলে না যে, আমাদের দেখতে কম্পিউটারের মতো মনে হয়, অথবা আমরা কাজ করি কম্পিউটারের মতো। তবে আমরা যে- চিন্তা করি, সে-চিন্তাপদ্ধতিটি আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবেই প্রতীককে কাজে লাগায় – ঠিক যে-কাজটি করে থাকে কম্পিউটার। অবশ্য একটিমাত্র প্রতীক যেমন চিন্তা বোঝায় না, তেমনি অনেক প্রতীক ব্যবহারকেও মন বলে ধরে নেওয়া যাবে না – যেমনটি কোনো ক্যালকুলেটর কিংবা ইলেকট্রিক টাইপরাইটারের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সাধারণ একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রের চেয়ে একটি কম্পিউটারকে যা পৃথক করে, তা হচ্ছে, এটি স্বতশ্চলভাবে কাজ করতে সমর্থ, যা তার নিজের মধ্যেই সঞ্চিত বিশেষ প্রোগ্রামের ফল। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে যে বিষয়টি নিয়ে তা হলো – এই কম্পিউটার প্রোগ্রাম কি আমরা এমন দক্ষ, জটিল ও যথেষ্ট মার্জিত হিসেবে তৈরি করতে পারব যে, একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম চালিয়ে বলতে পারব কম্পিউটারটির মন রয়েছে?

নিচের বাক্যগুলো লক্ষ করুন –

কেন আমার অপেক্ষারত শিশুটি কথা বলতে চায়?

কেন আমার মেয়েটি আমার গানকে স্বপ্ন দেখতে চায়?

তুমি একটি সংগীতের মতো।

আমার অপেক্ষারত মেয়েটি তার মতোই স্বপ্ন দেখে।

স্পষ্টতই এ-বাক্যগুলো কোনো সঠিক অর্থপূর্ণ বাক্য নয়; কিন্তু একই কথা তো বলা যায় ডিলান টমাস, গিয়াম অ্যাপোলোনিয়ের, ই ই কামিংস, জীবনানন্দ দাশ বা আবদুল মান্নান সৈয়দের অনেক কবিতা নিয়েও। কেউ হয়তো বলবেন যে, এ-লাইনগুলো লেখার সময় লেখক ছিলেন বিষণ্ন বা স্বপ্নতাড়িত। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এ-লেখাগুলো লিখিত একটি কম্পিউটার-প্রোগ্রাম কর্তৃক (GRAM 3, যা একটি DEC-VEX কম্পিউটার দিয়ে চালিত হয়েছে)। এখানে এমন কিছু কি রয়েছে যা এই কম্পিউটারটিকে একজন প্রকৃত কবির সঙ্গে পৃথক করবে? আমরা যদি সঠিক একটি প্রোগ্রাম দিয়ে একটি কম্পিউটারকে কবিতা লেখার কাজে ব্যবহার করি, তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা একজন কবির সঙ্গে একটি কম্পিউটারের সীমারেখা কোথায় টানবো?

দাবা খেলতে সমর্থ কম্পিউটারগুলো এরকমই কৃত্রিম প্রজ্ঞাজগতের আরেকটি উদাহরণ। এদেরই একটি ভার্সন, আইবিএম কম্পিউটারের তৈরি করা পরিগণক ‘ডিপ ব্লু’ ১৯৯৭ সালের ১১ মে পরাজিত করেছিল দাবাজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে। মানুষের সঙ্গে দাবা খেলতে সমর্থ কম্পিউটারগুলো অবশ্য তারও এক দশক আগেই এ-বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছিল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কাসপারভের দাবায় রেটিং যখন ২৭০০, তখন ‘ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার’ নামে একটি দাবার কম্পিউটার অর্জন করেছিল ২৩০০ রেটিং। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিউং স্যু কর্তৃক প্রোগ্রামকৃত ‘ডিপ থট’ নামক কম্পিউটারটি অর্জন করেছিল ২৫০০ রেটিং, যা ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ার লংবিচে অনুষ্ঠিত একটি টুর্নামেন্টে একজন গ্র্যান্ডমাস্টার বেন্ট লারসনকে হারিয়ে দিয়ে প্রথম পুরস্কার জিতে নিয়েছিল।

তিন

বহুকাল থেকেই দার্শনিকেরা জানতে আগ্রহী যে, মানুষকে আলাদা কিছু বলে চিহ্নিতকারী গুণগুলো কোথায় রয়েছে? ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ পরিচালিত হয় একটি অমর আত্মা দিয়ে; কিন্তু বস্তুজগতের অন্যরা (যার মধ্যে রয়েছে সব ধরনের প্রাণীরাও)  চালিত হয় শুধু পদার্থবিদ্যার সূত্রসমূহ দিয়ে। তিনি অবশ্য একটি কুকুর বা বানরকে একটি ঘড়ি কিংবা একটি উইন্ডমিলের মতোই নির্জ্ঞান, মনবিহীন বস্তু বলে মনে করতেন। এ-কারণেই তিনি তাদের প্রতি কোনো করুণা অনুভব না করে অনেক জীবন্ত প্রাণীর ওপর ভয়ঙ্কর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেও দ্বিধা করতেন না। সে-যুগের একটি জনপ্রিয় ‘পাস টাইম’ ছিল অটোমাটা নামক স্বতশ্চল যন্ত্র তৈরি করা, যা ঘড়ির মতোই চলে বাহ্যিক অবয়বে মানুষ কিংবা পশুর মতোই কাজ করে যাবে। দেকার্তে তাঁর Zuvi Discourse on Meth e বইটিতে একটি আকর্ষণীয় অধ্যায়ে বলেছেন যে, এমন একটি অটোমাটা তৈরি করা যাবে, যা দেখতে ও অঙ্গসংস্থানে বানরের মতো হবে (অথবা অন্য কোনো জন্তু, যারা যুক্তি দিয়ে চালিত হয় না), যাকে আমরা একটি জন্তু থেকে পৃথক করতে পারব না। তবে মানুষের সঙ্গে এর পার্থক্যটি সহজেই সবার দৃষ্টিগোচর হবে।

দেকার্তের ধারণা অনুসারে, একটি যন্ত্র ‘কখনোই কোনো শব্দ ব্যবহার করতে পারবে না, অথবা এমন কোনো সংকেত দিতে পারবে না, যা আমরা একে অন্যকে মনের ভাব জানাতে ব্যবহার করি।’ হতে পারে যে, আমরা এমন একটি যন্ত্র বানাতে সমর্থ হবো, যার এক স্থানে স্পর্শ করলে তা বুঝবে আমি কী চাই, অন্য স্থানে স্পর্শ করলে চিৎকার করে বোঝাবে যে, তাকে ব্যথা দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু এটি কখনোই উত্তর দিতে সমর্থ হবে না যে, এর সামনে বসে আমরা কী আলোচনা করেছি, যা একজন অতিনির্বোধ ব্যক্তিও বলে দিতে সমর্থ।

দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে, একটি অটোমাটা বঞ্চিত থাকবে সাধারণ যৌক্তিক ক্ষমতা থেকে। ‘এটি মানুষের মতোই বা তার চেয়ে ভালোভাবে কিছু কাজ করতে পারলেও অন্য কিছু কাজ করতে অসমর্থ হবে, যার মাধ্যমে প্রমাণ হবে যে তারা এগুলো করেছে যথাযথ কোনো বিবেচনা ছাড়াই’। অন্য কথায়, একটি যন্ত্র তার অনুষঙ্গের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করে (যেমন চাবি দিলে একটি ঘড়ি অ্যালার্ম বাজাতে পারে, অথবা একটি খেলনা বানর ডিগবাজি খেতে পারে); কিন্তু মানুষ তার দৈনন্দিন কাজগুলো করে থাকে তার অন্তঃস্থ যুক্তি-বিবেচনা থেকে, যা যে কোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেই তার বুদ্ধি খাটিয়ে যথাযথভাবে সম্পন্ন করে।

মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে কী পার্থক্য, তা বোঝাতে গিয়ে দেকার্তে আমাদের স্বজ্ঞার ওপর কোনো গুরুত্ব প্রদান করেননি, কিংবা যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের আত্মা বা আবেগ-অনুভূতির উচ্চমার্গীয় পার্থক্যের বিষয়টিও তুলে ধরেননি। এর পরিবর্তে তিনি সামনে এনেছেন পরীক্ষাযোগ্য দুটো মানবিক আচরণকে : একটি হচ্ছে অর্থপূর্ণ ভাষা-ব্যবহার এবং অন্যটি সাধারণ যৌক্তিক ক্ষমতা। আমরা পরবর্তীকালে দেখতে পাব যে, আধুনিককালে কৃত্রিম প্রজ্ঞার গবেষণাতেও ভাষা এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণ – এ-দুটো বিষয়ই প্রধান অন্বিষ্ট বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দেকার্তের যুগে প্রধান যে-কয়টি যন্ত্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত, তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিল ঘড়ি এবং বায়ুকল (Windmill)। প্রথমটি ছিল একটি সময়-গণনাযন্ত্র এবং দ্বিতীয়টি ছিল মানুষের পেশিশক্তির বিকল্প। দেকার্তে যখন তাঁর  Discourse on Method  লিখছেন, তখন অন্য আরেক ফরাসি দার্শনিক ব্লেইস প্যাসকেল (১৬২৩-৬২) একটি যান্ত্রিক পরিগণক তৈরি করেছিলেন, যেটি যোগ ও বিয়োগ করতে সমর্থ ছিল। এরপর ১৬৭০ সালে গটফ্রিড লাইবনিৎস (১৬৪৬-১৭১৬) প্যাসকেলের পরিগণন যন্ত্রে যোগ করতে সমর্থ হলেন গুণ ও ভাগ করার ক্ষমতা। এসব যন্ত্রপাতি সে-যুগের প্রতীক ব্যবহারের (Symbol Manipulation) আদি উদাহরণ ছিল, তবু সেগুলো ছিল বিশেষ ধরনের উন্নত যন্ত্র, যার শুধু প্রাথমিক ধরনের পাটিগণিত সমাধা করার ক্ষমতা ছিল। আরো অগ্রসর ক্ষমতাসম্পন্ন পরিগণক, অর্থাৎ General purpose programmable symbol manipulator এসেছে আরো দু-শতাব্দী পরে। এসব অগ্রসর পরিগণকই পরবর্তীকালে mind model  হিসেবে বিবেচনার জন্য প্রার্থী হয়েছে।

চার

অ্যালান ট্যুরিং এবং জন ফন মিউম্যান আধুনিক কম্পিউটারের জনক হিসেবে পরিচিতি পেলেও তাঁদের এক শতাব্দী আগেই কৃত্রিম প্রজ্ঞার পরিগণন-শক্তি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন আরেক ব্রিটিশ গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ (১৭৯১-১৮৭১)। উৎকেন্দ্রিক এই গণিতবিদের উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত ব্রিটিশ গণিতপদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করা, যে-উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বন্ধু জন হার্শেলকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন Analytical Society। প্রথাগত ব্রিটিশ অভিজাততন্ত্রের চোখে তাঁরা ছিলেন বিদ্রোহী, যাঁদের দেখা হতো সন্দেহের চোখে। ব্যাবেজই দুটো ভিন্ন ধরনের যন্ত্র তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার প্রথমটিকে তিনি নাম দিয়েছিলেন Differential engine, যেটি গাণিতিক টেবিল গণনা করতে সমর্থ। এটি একটি অভিজাত জটিল যন্ত্র; কিন্তু প্যাসকেলের পরিগণকের মতোই এটি ছিল শুধু নির্দিষ্ট একটি কাজ করার ক্ষমতাসম্পন্ন। তাঁর দ্বিতীয় যন্ত্রটি হলো  Analytical engine  এবং সেটি একটি General purpose calculator, যা ছিল গাণিতিক অন্তর্দৃষ্টি এবং যান্ত্রিক দক্ষতার একটি উৎকৃষ্ট সংমিশ্রণ।

ব্যাবেজের অ্যানালিটিক ইঞ্জিনে আধুনিক একটি কম্পিউটারের অনেক বৈশিষ্ট্যই ছিল, যেমন – তাতে ছিল একটি Central Processing Unit, যাকে তিনি বলতেন CPU; একটা ডাটা মেমোরি এবং একটি নির্দেশক বা controlling unit। ক্যালকুলেটরের বিপরীতে এই যন্ত্রকে শুধু একটিমাত্র কাজে নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রোগ্রাম করা যাবে। তখনকার দিনে যেহেতু বিদ্যুৎশক্তি ছিল না, তাই এই প্রোগ্রামগুলো করা হতো কার্ডে পাঞ্চ করা ছিদ্রের মাধ্যমে এবং তাঁর যন্ত্রটি সেগুলো পড়তে পারতো। অবশ্য যন্ত্রটির আয়তন ছিল একটি বড় গাড়ির সমান। তবে ব্যাবেজ তাঁর স্বপ্নকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে সম্পূর্ণ করতে পারেননি। এই অক্ষমতার পেছনে তাঁর প্রযুক্তিগত ধারণার বৈজ্ঞানিক ত্রুটি নয়, বরং তার জন্য দায়ী তৎকালীন প্রযুক্তির অক্ষমতা এবং সরকারি আনুকূল্যের অভাব। বিদ্যুৎপূর্ব যুগে ব্যাবেজের যন্ত্রটি শুধু চাকা, গিয়ার, লিভার ইত্যাদি দিয়েই চালিত হতো।

ব্যাবেজের অ্যানালিটিক ইঞ্জিনকে একটি সংখ্যা ব্যবহারকারী গণনাযন্ত্র (Numeric calculator) হিসেবেই বানানো হলেও ব্যাবেজ ও তাঁর বন্ধুরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, একই যন্ত্রকে প্রোগ্রামভুক্ত করা যাবে অন্যান্য উপাত্ত বিশ্লেষণের (Symbolic data operate) কাজেও। তাঁরা নিজেরা বলাবলি করছিলেন যে, এরকম একটি যন্ত্রকে ‘বুদ্ধিমান’ বলা হবে কি না, তা নিয়ে। আভা লাভলেইস নামে ব্যাবেজের একজন সহকর্মী ব্যাবেজের লেকচার নোটের পাশে মন্তব্য হিসেবে লিখেছিলেন – ‘অ্যানালিটিক ইঞ্জিন নিজে কোনো কিছু উৎপন্ন করবে, এরকম কোনো আত্মম্ভরিতা নেই। আমরা একে যা করতে বলবো, এটি তাই শুধু করবে।’ এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেকার্তের সেই বিখ্যাত যুক্তি, যন্ত্র যুক্তি বিচার করতে অসমর্থ (কারণ যুক্তি বিচারে প্রয়োজন নতুন আইডিয়া), এবং কম্পিউটার কখনো সৃষ্টিশীল হতে পারে না – যে-ধারণাটি আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে। এটি নিয়ে সন্দেহ নেই যে, একটি কম্পিউটার তার প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত, তবে এখন এমন ধরনের অগ্রসর প্রোগ্রাম তৈরি করা সম্ভব, যাতে তার ব্যবহারকারী কম্পিউটারকেই সৃষ্টিশীল বলে দাবি করা যায়।

পাঁচ

ঊনবিংশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের দিককার সময়কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক অর্জন হচ্ছে যুক্তির পরিগণন ক্ষমতা (Calculus of Reasoning) আবিষ্কার। এটি ১৮৫৪ সালে জর্জ বোল নামে ইংরেজ গণিতবিদ ও দার্শনিকের মাধ্যমে শুরু হয়েছে চিন্তার সূত্রসমূহ পরীক্ষার (Investigation of the laws of thought) মধ্য দিয়ে। জর্জ বোল চেয়েছিলেন and  or – এরকম শব্দগুলোর সূক্ষ্ম যৌক্তিক সংজ্ঞা বের করতে। পরিগণন জগতে এর পরের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন অ্যালান ট্যুরিং। চার্লস ব্যাবেজের মতোই উৎকেন্দ্রিক এই ব্রিটিশ গণিতবিদের জীবনও ছিল ঘটনাবহুল এবং করুণ। নিরীশ^রবাদী এই প্রতিভাবান গণিতবিদকে সমকামিতার অভিযোগে ওষুধ প্রয়োগ করে পুরুষত্বহীন করা হয়, যে-যন্ত্রণাকে বহন করতে না পেরে তিনি হন আত্মঘাতী। এর দীর্ঘদিন পর যদিও তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়েছে; কিন্তু অ্যালান ট্যুরিং স্থান নিয়েছেন তখন সকল বিচারের ঊর্ধ্বে।

অ্যালান ট্যুরিং ত্রিশের দশকে পরিগণনের তাত্ত্বিক ভিত্তি দাঁড় করালেন, যা আধুনিক কম্পিউটারকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কাজ করতে লাগলেন ব্লেচলি পার্কে, যেখানে ব্রিটিশ সরকার একদল অ্যাকাডেমিককে জড়ো করে প্রয়াস নিয়েছিল জার্মান সামরিক বাহিনীর দুর্বোধ্য কোড মেসেজ ভাঙার কাজে। এটি করতে গিয়েই তাঁরা নির্মাণ করলেন পৃথিবীর প্রথম আধুনিক ইলেকট্রনিক কম্পিউটার। ‘কলোসাস’ (Colossus) নামের এই পরিগণন যন্ত্রটি আরেক আধুনিক মার্কিন কম্পিউটার ‘এনিয়াক’ (ENIAC)-এর দুই বছর আগে তৈরি করা। তবে এটির আবিষ্কার সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল, কারণ এটি নিয়োজিত ছিল জার্মান সামরিক কোড ভাঙার কাজে। পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী ইলেকট্রনিক কম্পিউটার Ferranti Mark I  ও তৈরির কাজেও অ্যালান ট্যুরিং অংশগ্রহণ করেছিলেন।

অ্যালান ট্যুরিং তাঁর বহুল পরিচিত নিবন্ধ ‘Computing machinery and intelligence’ প্রকাশ করেন ১৯৫০ সালে, যেখানে তিনি উত্থাপন করেন গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটি – যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে (Can machine think)? উপভোগ্য এই অ-প্রায়োগিক নিবন্ধে (Non-technical article) তিনি তুলে ধরেন একটি কৃত্রিম খেলা (Imitation Game), যা পরে পরিচিত হয় ট্যুরিং টেস্ট নামে। এই খেলায় প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে শনাক্ত করা সম্ভব অদৃশ্য দুজনকে, যাদের একজন মানুষ এবং অন্যজন কম্পিউটার। যদি অনেক প্রশ্নের পরও তাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব না হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, কম্পিউটারটিও মানুষের মতো চিন্তা করার ক্ষমতাসম্পন্ন। তাঁর নিবন্ধের দ্বিতীয় অংশে ট্যুরিং তুলে ধরেন কিছু যুক্তি – কেন কম্পিউটার সৃষ্টিশীল হতে পারে না বা ট্যুরিং টেস্ট উতরে যেতে পারে না। দেকার্তে যেমনটা ভাবতেন যে, মানুষ চিন্তা করতে সমর্থ তার একটি অবিনশ্বর আত্মা রয়েছে বলে, যেমনটা কোনো প্রাণী বা যন্ত্রের নেই। একইভাবে ট্যুরিং দেখালেন যে, প্রজ্ঞা হচ্ছে যুক্তির ক্ষমতা এবং ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষমতা।

ছয়

অনেকেই মনে করেন যে, আগামী একটি বা দুটি শতাব্দী সময়কালেই ইলেকট্রনিক কম্পিউটার বা রোবট মানুষের মতো সব কাজই করতে সমর্থ হবে। যাঁরা শৈশব-কৈশোরে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পড়ে বড় হয়েছেন, তাঁরা অনেকেই কৃত্রিম প্রজ্ঞা বিশেষজ্ঞ মার্ভিন মিনস্কির মতো বিশ্বাস করেন যে, আমাদের মন হচ্ছে একটি ‘মাংসের তৈরি কম্পিউটার’ এবং চেতনা, সৌন্দর্য ও হিউমার উপলব্ধি করার ক্ষমতা, স্বাধীন ইচ্ছা ইত্যাদি উচ্চতর ক্ষমতাও অবধারিতভাবে রোবটগুলোর মধ্যে এসে পড়বে। অবশ্য এর বিপরীত মতও রয়েছে, যাঁরা মনে করেন, কম্পিউটার একটি ক্যালকুলেটরের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। কম্পিউটার যদিও দাবা খেলতে সমর্থ; কিন্তু তারা কি কখনো দাবা খেলার আনন্দ উপভোগ করতে পারে? ভৌতজগৎ, যাকে বর্তমান পদার্থবিদরা গণিতের ভেতর পুরে দিয়েছেন, তা কি প্লেটোর গুহার মতোই একটি রহস্যময় জগৎ হয়ে দাঁড়িয়েছে?

বিগত কয়েকটি দশকে অত্যাধুনিক পরিগণন ক্ষমতাসম্পন্ন  রোবট নানাভাবে বিশ্ববাসীকে চমকে দিচ্ছে, যেগুলো সম্ভবত কিছুটা ‘মানবীয় গুণ’ও অর্জন করেছে। এমনই কিছু মানবসদৃশ  রোবট হচ্ছে চিতা আসিমো, সোফিয়া ইত্যাদি। জাপানের হোন্ডা ২০০০ সালে তৈরি করেছিল ‘আসিমো’, যার নামকরণ করা হয়েছিল প্রখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকার আইজাক আসিমভের নামে। যুক্তরাষ্ট্রে এটি প্রথম জনসমক্ষে আসে ২০০২ সালে, যখন সেটি ঘণ্টা বাজিয়ে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেড সেশন উদ্বোধন করে। রোবট নামের একটি অ্যানিমেটেড ফিল্মের মহরত অনুষ্ঠানে আসিমোকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আসিমো তার বিশ্বভ্রমণে কানাডা, রাশিয়া, আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি বহু দেশ ভ্রমণ করেছে এবং অগণিত দর্শককে দেখা দিয়ে তার কসরত প্রদর্শন করেছে। মিসৌরির সেন্ট লুইতে সে ছাত্রদের উৎসাহিত করেছে বিজ্ঞান, গণিত ও প্রকৌশল শিক্ষার জন্য। অন্যদিকে ‘চিতা’ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটিতে তৈরি একটি সামরিক কাজে ব্যবহারযোগ্য চতুষ্পদ জন্তুসদৃশ রোবট।

তবে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে হংকংয়ের হ্যানসন রোবটিক্সের তৈরি ‘সোফিয়া’, যা প্রথম প্রদর্শিত হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে। এর এক মাস পর এটি টেক্সাসের অস্টিনে নিজেকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরে এবং ব্যাপক পরিচিতি পায়। অক্টোবর, ২০১৭ সালে এটি অর্জন করে বিতর্কিত সৌদি নাগরিকত্ব, যা কোনো রোবটের জন্য প্রথম উদাহরণ। পরের মাসেই এটি জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির Innovation Champion খেতাব অর্জন করে; এটিও রোবট হিসেবে প্রথম। সোফিয়া ঢাকার দর্শকদেরও ২০১৭ সালে দেখা দিয়ে আনন্দ দিয়েছে।

 সোফিয়ার গড়ন নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় সম্রাজ্ঞী নেফারতিতি, জনপ্রিয় হলিউড নায়িকা অড্রে হেপবার্ন এবং নির্মাতার স্ত্রী আমান্ডা হ্যানসনের মিলিত অবয়ব। নির্মাতা ডেভিড হ্যানসনের মতে, এ-ধরনের রোবট ভবিষ্যতে ব্যবহৃত হবে হাসপাতাল, নার্সিং হোম, সামাজিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি জায়গায়। সোফিয়া মানুষের মুখাবয়ব আলাদাভাবে চিনতে পারে, প্রশ্নকর্তার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিতে পারে, হাঁটাচলা করতে পারে এবং ৬০ ধরনের মুখভঙ্গি করতে সক্ষম। সোফিয়া ২০১৯ সালে অর্জন করেছে ছবি ও পোর্ট্রেট আঁকার ক্ষমতা।

সোফিয়া ইতোমধ্যে সিবিএস টেলিভিশনের ‘60 minits’ অনুষ্ঠানে চার্লি রোজের সঙ্গে, ‘গুড মর্নিং ব্রিটেন’ অনুষ্ঠানে পিয়ের্স মর্গান, ফরবিস, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, গার্ডিয়ান ইত্যাদি পত্রপত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। এসব সাক্ষাৎকারে একজন রক্তমাংসের মানুষের মতোই আচরণ করে সে জানিয়েছে যে, অ্যালন মাস্ক সম্পর্কে অনেক পড়াশোনা করে সে এবং প্রচুর হলিউডি ছবি দেখে। জাতিসংঘের সহ-মহাসচিব আমিনা জে. মোহাম্মদের সঙ্গেও ২০১৭ সালে সে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়। সোফিয়ার নির্মাতা হ্যানসন যখন দাবি করেন যে, সোফিয়া ‘জীবিত’, তখন সম্ভবত তিনি এটিই বোঝান, যেরকমভাবে একটি ভাস্কর্য তার নির্মাণের শেষ মুহূর্তটিতে নির্মাতা শিল্পীর চোখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। সোফিয়াকে সেদিক থেকে অবশ্যই জীবিত বলা যায়।

সাত

মানুষের মস্তিষ্কের দুটো অংশ রয়েছে – সচেতনতার অংশ এবং বৌদ্ধিক (অসচেতন) অংশ। কৃত্রিম প্রজ্ঞার কোনো সচেতন অংশ থাকে না; কিন্তু তার বৌদ্ধিক অংশের ক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের উচ্চতর বৌদ্ধিক ক্ষমতার কারণেই একদিন যন্ত্র বা রোবট মানুষকে হারিয়ে দেবে এবং কর্মক্ষেত্রে অনেক স্থানেই মানুষকে হটিয়ে দেবে। ফলে মানুষ একদিন অর্থনৈতিক, প্রায়োগিক, সামরিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার অগ্রবর্তী অবস্থান হারাবে – বহুসংখ্যক মানুষ হয়ে পড়বে অকর্মণ্য বা বেকার। এর কারণ, রোবট একদিন মানুষের চেয়ে দক্ষভাবে গাড়ি, জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজ চালাতে পারবে; হাসপাতালে রোগ নির্ণয় কিংবা অপারেশন করতে পারবে; মহাসাগরের অতলে কিংবা খনির গভীরে কষ্টসাধ্য ও বিপজ্জনক কাজ করতে পারবে – যেসব কাজের অনেকগুলো সে এখনই করছে। তাদের এসব কাজ হবে মানুষের করা কাজের চেয়ে আরো অনেক সূক্ষ্মভাবে, দক্ষতার সঙ্গে সমাপনকৃত। আগে অনেক কাজ শুধু মানুষের পক্ষেই করা সম্ভব ছিল; একই ঘটনা ঘটতে চলেছে ভবিষ্যতে রোবটের ক্ষেত্রে।

প্রযুক্তি মানুষকে শুধু একদিন অকর্মণ্যই করে দেবে না, এটি তাদের একদিন ‘জবরদখল (hack)’ করে নেবে। মানুষ আর ভবিষ্যতে তার জীবন নিজের ইচ্ছায় কাটাতে পারবে না – প্রযুক্তি তাকে বাধ্য করবে তার পরামর্শমতো চলতে। প্রযুক্তি তাকে ঠিক করে দেবে কোথায় বাস করতে হবে, কাকে বিয়ে করতে হবে, কী তাকে খুশি করবে এবং কী তাকে অসন্তুষ্ট করবে। তার সব কাজকর্মই নিয়ন্ত্রিত হবে কম্পিউটার বা রোবটের উপাত্ত কর্তৃক, গাণিতিক বা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায়। গণমাধ্যম, টেলিভিশন, ফেসবুক-টুইটার-গুগল ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের মনোজগৎকে কীভাবে গড়েপিটে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা আমরা সজ্ঞান মনে বুঝে উঠতে পারি না। তবে আমাদের সচেতন চিন্তাশীল মানুষেরা, যেমন মার্শাল ম্যাকলুহান, আর্থার সি ক্লার্ক, আইজাক আসিমভ, নোয়াম চমস্কি, ইউডাল নোয়া হারারি প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক তা ইতোমধ্যেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। এর ক্ষতিকর দিকটা সম্পর্কে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে আমাদের আরো বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে।

দেকার্তে-লাইবনিৎস-প্যাসকেল-ব্যাবেজ-ট্যুরিংয়ের যুগ পার হয়ে আমরা এখন চলে এসেছি আসিমো-সোফিয়ার যুগে। যন্ত্রের কোনো মন আছে কি না – এ-বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে আগে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আসতাম উইন্ডমিল, ঘড়ি, অটোমাটা, ক্যালকুলেটর এবং আধুনিক যুগে কম্পিউটারকে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজ্ঞার অভাবনীয় উন্নতির বর্তমান রোবটের যুগে এসে এ-প্রশ্নটি সম্ভবত একটি নতুন মাত্রা লাভ করেছে। মানুষ ও যন্ত্রের মিথস্ক্রিয়া তৈরি করার ক্ষমতাসম্পন্ন বর্তমান আসিমো কিংবা সোফিয়া এখন যতটা ‘মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন’ বলে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে, তেমনটা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি। কৃত্রিম প্রজ্ঞার অনাগত জগৎকে আমরা যখন কল্পনা করি, তখন দিব্যচোখে দেখতে পাই যে, তারা কাজকর্মে আমাদের সমকক্ষই শুধু হয়ে ওঠেনি – একই সঙ্গে অর্জন করেছে আমাদের মতোই মানবিক গুণাবলি ও ত্রুটিবিচ্যুতি। তখনো কি আমরা অস্বীকার করতে পারব যে, মানুষের মতো যন্ত্রেরও রয়েছে

একটি মন, রয়েছে উচ্চতর মানসিক ক্ষমতা? সেরকম ক্ষেত্রে যন্ত্রও আর সূর্যের আলোতে প্রতিফলিত চাঁদের জ্যোৎস্না নয়, নিজেই দ্যুতিমান জ্যোতিষ্ক হয়ে বিরাজ করবে।