রুশ চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ সপ্তরথী

আলম খোরশেদ

চলচ্চিত্রের ইতিহাসবিষয়ে অবগতজনেরা জানেন, শৈল্পিক ও আধুনিক চলচ্চিত্রের সূত্রপাত প্রধানত রুশদেশ তথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। আর এর অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে আমাদের, তিনি আর কেউ নন সের্গেই এইজেন্স্টেইন বা প্রচলিত উচ্চারণে আইজেন্স্টাইন (১৮৯৮-১৯৪৮)। কিন্তু আমি এই আলোচনা শুরু করতে চাই তাঁরই সমসাময়িক আরেক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিন্তক লেভ কুলেশভকে (১৮৯৯-১৯৭০) দিয়ে। এইজেন্স্টেইনের নামের সঙ্গে যেমন মন্তাজ বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তেমনি কুলেশভের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কুলেশভ ইফেক্ট নামে সম্পাদনার একটি বিশেষ রীতি। সের্গেইয়ের মতো কুলেশভেরও রয়েছে চলচ্চিত্রলেখক হিসেবে খ্যাতি, The Basics of Film Direction নামে একটি অত্যন্ত মূল্যবান ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রবিষয়ক গ্রন্থ যার সাক্ষ্য বহন করে। তবে কুলেশভ মূলত চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র শিক্ষাকেন্দ্র মস্কো ফিল্ম ইনস্টিটিউটের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে। তিনি ছিলেন সেই ইনস্টিটিউটের এবং সেই অর্থে সমগ্র পৃথিবীর সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক ক্লাসের পরিচালক ও শিক্ষক। অনেকেই হয়তো এটা জেনে চমকে উঠবেন যে, খোদ এইজেন্স্টেইন সেখানে কিছুদিনের জন্য তাঁর ছাত্র ছিলেন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে লেভ কুলেশভের হাতেখড়ি হয় একেবারে তরুণ বয়সেই, Twilight (১৯১৭) ছবিটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। তাঁর মাস্টারপিস কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম The Extraordinary Adventures of Mr. West in the Land of the Bolsheviks (1924), By the Law (1926), The Great Consoler (১৯৩৩) ইত্যাদি। ১৯৪৩ সালে তাঁর সর্বশেষ ছবি নির্মাণের পর থেকে আমৃত্যু তিনি মস্কো ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শৈল্পিক পরিচালক ও শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

কুলেশভের সঙ্গে যেহেতু এইজেন্স্টেইনের একটা তুলনা এসেই গেছে ওপরে সেহেতু এক্ষণে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। সের্গেই এইজেন্স্টেইনের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই একটি নির্বাক চলচ্চিত্র, Battleship Potemkin  (১৯২৫)-এর কথা আমাদের সবার মনে পড়ে যায়, যাকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে অদ্যাবধি। আধুনিক চলচ্চিত্রের এক বিশেষ ভাষারীতি সোভিয়েত মন্তাজের জনক সের্গেই এইজেন্স্টেইন শুরুতে থিয়েটারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকলেও একপর্যায়ে চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ১৯২৩ সালে Glumov’s Diary নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও এর মাত্র দু-বছরের মাথায় ১৯২৫ সালে তিনি ঝঃৎরশব নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন, যা ছিল রুশ বিপ্লবের ওপর তাঁর নির্মিতব্য ট্রিলজির প্রথম খণ্ড। এরই দ্বিতীয় পর্ব পূর্বোল্লিখিত ব্যাটলশিপ পটেম্কিন ছবিটি। রুশ বিপ্লবের দশকপূর্তি উপলক্ষে ট্রিলজির সর্বশেষ ছবি October : Ten Days That Shook the World  (১৯২৭) নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর অপর দুই উল্লেখযোগ্য কাজ lexander Nevsky (১৯৩৮) ও Ivan the Terrible  (১৯৪৪, ১৯৫৮)। ইভান দ্য টেরিবল ছবিটিকেও তিনি একটি ট্রিলজি আকারেই নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম খণ্ডটি মুক্তির পর সোভিয়েত শাসকদের সঙ্গে তাঁর আদর্শিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলে ছবিটির দ্বিতীয় পর্ব তাঁর জীবদ্দশায় আলোর মুখ দেখতে পায়নি, যদিও ১৯৪৬ সালেই তিনি এর কাজ সমাপ্ত করে ট্রিলজির শেষ পর্বের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রভাষার একজন অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক, চিন্তক ও লেখক, যার অন্যতম নিদর্শন ফিল্ম ফর্ম ও ফিল্ম সেন্স নামক কালজয়ী গ্রন্থদুটি। ১৯৪৮ সালে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর অকালপ্রয়াণ ঘটে।

আলোচ্য তিন পথিকৃতের মধ্যে যিনি সর্বাগ্রজ সেই ভ্সেভলদ পুদভ্কিনের জন্ম ১৮৯৩ সালে। তাঁর নামের সঙ্গে অমর হয়ে আছে নির্বাক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি মাদার, যেটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন এইজেন্স্টেইনের বিখ্যাত ব্যাটলশিপ পটেম্কিন মুক্তি পাওয়ার পরের বছরই, ১৯২৬ সালে। সবারই জানা, এটি বিশ্বশ্রুত সোভিয়েত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির একই নামের ততোধিক বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এইজেন্স্টেইনের মতো পুদভ্কিনও মন্তাজ বিষয়ে প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষা ও ব্যাকরণ নির্মাণেও তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর এইসব তত্ত্ব ও ভাবনাসমূহ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যা তাঁর বিখ্যাত Film Technique and Film Acting গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পরবর্তীকালে। সোভিয়েত চলচ্চিত্রে শব্দ-প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং তিনি, সতীর্থ সের্গেই এইজেন্স্টেইন ও তাঁর বন্ধু গ্রেগরি আলেক্সান্দ্রভের সঙ্গে মিলেই আসলে রুশ চলচ্চিত্রের Manifesto of Sound রচনা করেছিলেন। তাঁর এই শব্দ নিয়ে চিন্তাভাবনার সফল বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় A Simple Case (1932) The Deserter (1933) ছবিদুটোতে। পুদভ্কিনের অপর দুই আলোচিত চলচ্চিত্র The End of St. Petersburg (1927)Storm Over Asia (1928) হচ্ছে মূলত তাঁর রুশ বিপ্লব নিয়ে নির্মিত ট্রিলজিরই শেষ দুই পর্ব। প্রসঙ্গত, পুদভ্কিনের জীবন ও কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুজন মানুষের নাম না করলেই নয়। তাঁদের একজন তাঁর স্ত্রী Anna Zemtsova, যিনি নিজে একজন দক্ষ অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক ছিলেন, এবং যাঁর প্রতি অসীম ঋণের কথা পুদভ্কিন নিজেই স্বীকার করে গেছেন। অপরজন Mikhail Doller, যিনি পুদভ্কিনের ছায়াসঙ্গী হয়ে সহপরিচালক হিসেবে তাঁর বেশকিছু ছবিতে কাজ করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, এইজেন্স্টেনের মতো পুদভ্কিনও তেমন দীর্ঘায়ু হননি। ১৯৫৩ সালে তাঁর সর্বশেষ ছবি The Return of Vasili Bortnikov নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রয়াত হন। মস্কোতে তাঁর স্মৃতিতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।

পুদভ্কিনের জন্মের পরের বছরই, ১৮৯৪ সালে, তৎকালীন সোভিয়েত ইউক্রেনে জন্মগ্রহণ করেন রুশ চলচ্চিত্রের আরেক পথিকৃৎ আলেক্সান্ডার দভ্ঝেন্কো। তিনিও উল্লিখিত অপর তিন মহারথীরই মতো সোভিয়েত চলচ্চিত্রের বিখ্যাত মন্তাজ তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা ও সফল প্রয়োগকারী ছিলেন। দভ্ঝেন্কো অন্যদের তুলনায় একটু দেরিতেই পা দেন চলচ্চিত্রের আঙিনায়। কিছুদিন চিত্রনাট্য রচনায় হাত পাকিয়ে এবং সহকারী পরিচালকের ভূমিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ১৯২৮ সালে তিনি তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র Zvenyhora নির্মাণে হাত দেন এবং প্রথম ছবিতেই সাফল্য করায়ত্ত করেন। এটি সেই যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হিসেবে বোদ্ধাজনের স্বীকৃতি অর্জন করে। এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি একে ঘিরে একটি ট্রিলজির পরিকল্পনা করেন, যার দ্বিতীয় খণ্ড Arsenal-এর পরের বছরেই মুক্তিলাভ করে। এটি তৎকালীন সোভিয়েত প্রশাসনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিলেও ট্রিলজির পরের ছবি Earth তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। নির্বাক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে দভ্ঝেন্কোর অমর সৃষ্টি এই Earth-কে। এতটাই যে, ২০০২ সালে প্রখ্যাত চেক-ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা কারেল রাইসকে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রসমূহের তালিকা করতে বলা হলে তিনি একে দ্বিতীয় স্থানে ঠাঁই দেন। দভ্জেন্কো চলচ্চিত্রবিষয়ক বহুমুখী কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রাখলেও নিজে মাত্র সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণ করে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর বাকি ছবিগুলো হলো : Ivan, (1932), Aerograd, (1935),  Shchors (1939) Michurin (1948)। এরপর তিনি বেশ কিছুদিন কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হন। তিনি পরে ক্রুশ্চেভের কল্যাণে তাঁর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আবারো চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন। তিনি একসঙ্গে দুটো ছবির কাজে হাত দেন : বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক নিকোলাই গোগলের তারাস বুলবা উপন্যাসের চিত্ররূপ এবং তাঁর নিজের লেখা চিত্রনাট্য অবলম্বনে  Poem about a Sea। কিন্তু ১৯৫৬ সালে মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হওয়ার ফলে এর কোনোটাই তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। অবশ্য দ্বিতীয় ছবিটি দভ্জেন্কোর প্রয়াণের দুই বছর পরে তাঁর পত্নী Yulia Solntseva সমাপ্ত করে মুক্তি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। দভ্ঝেন্কো রুশ চলচ্চিত্রের জগতে তাঁর অনেক অনুসারী ও অনুরাগীর জন্ম দিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে অন্যতম বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্রনির্মাতা সের্গেই পারামাজানভ, লারিসা শেপিট্কো প্রমুখ। তাঁর মৃত্যুর পর কিইভ শহরের প্রধান ফিল্ম স্টুডিওটিকে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়।

রুশ চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ সপ্তরথীর মধ্যে এর পরেই যাঁর নাম করতে হয় তিনি ঝিগা ভের্তভ (১৮৯৬-১৯৫৪), যিনি জন্মসূত্রে ডেনিস কাউফম্যান নামেও পরিচিত ছিলেন। ঝিগা ভের্তভ মূলত তাঁর ছদ্মনাম, যেটি তিনি একটি ইউক্রেনীয় শব্দ থেকে নিয়েছেন, যার অর্থ ‘ঘুরন্ত লাটিম’। ভের্তভ প্রধানত সংবাদচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতা এবং এর একজন প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে বিশ্বময় পরিচিত। শুরুর দিকে তিনি কিনো-প্রাভদা তথা সত্য-সিনেমা নামে তেইশটি ছোট ছোট প্রামাণ্যচিত্রের একটি সিরিজ নির্মাণ করেন, যেখান থেকে পরবর্তীকালে তিনি তাঁর প্রামাণ্যচিত্র বিষয়ক বৈপ্লবিক তত্ত্ব ও কৌশলসমূহ উদ্ভাবন করেন। আমরা সবাই জানি, তাঁর নামের সঙ্গে ম্যান উইথ আ মুভি ক্যামেরা (১৯২৯) নামক একটি কালজয়ী প্রামাণ্যচিত্রের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছবির এই ক্যামেরাকাঁধের মানুষটি হচ্ছেন তাঁর ভাই মিখাইল কাউফম্যান, যিনি ছবির চিত্রগ্রহণের কাজ করেন, আর ভের্তভ নিজে পরিচালনা ও তাঁর স্ত্রী এলিজাভেতা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। বস্তুত এই ছবিতেই ঝিগা ভের্তভ তাঁর চলচ্চিত্রসম্পর্কিত যাবতীয় ধ্যানধারণার বাস্তব প্রয়োগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাসমূহ করেন। আজ আমরা যেসব চলচ্চিত্রিক পরিভাষা কিংবা প্রকরণগত কৌশলের নাম শুনে থাকি হরহামেশা, তার অধিকাংশই কিন্তু এই ছবি থেকেই উদ্ভূত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য multiple exposure, fast motion, slow motion, freeze frame, jump cut, split screen, Dutch angle, extreme close-up, tracking shot, reversed footage, stop motion animation ইত্যাদি। ভের্তভের এই ছবিটিকে ২০১২ সালে ব্রিটেনের বিখ্যাত সাইট অ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবির তালিকার অষ্টম স্থানে স্থান দিয়েছিল। এর দু-বছর বাদে তারাই একে সর্বকালের সেরা প্রামাণ্যচিত্র আখ্যা দেয়। এর বাইরেও আরো কতশত স্বীকৃতি-তালিকায় যে এর স্থান হয়েছে এর কোনো ইয়ত্তা নেই।

ঝিগা ভের্তভ নানা কারণে নিজে হয়তো খুব বেশি ছবি তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রচিন্তা, দর্শন, নিরীক্ষা ও উদ্ভাবনসমূহ বিশ^জুড়ে চলচ্চিত্রকারদের মননে ও কর্মে যে বিপুল প্রভাব ফেলেছে তার জুড়ি মেলা ভার। আজকে যে সিনেমা-ভেরিতের কথা এত প্রচলিত, সেটি মূলত তাঁর কিনো-প্রাভদা শব্দবন্ধেরই ইংরেজি তর্জমা। তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এমনকি ফরাসি কালাপাহাড়ি পরিচালক জঁ-ল্যুক গোদারও, যিনি তাঁর সহযোদ্ধা জঁ-পিয়ের গোর্যাঁকে নিয়ে Dziga Vertov Group নামে একটি বিপ্লবী সমবায়ী চলচ্চিত্র সংগঠন পর্যন্ত গড়েছিলেন। এছাড়া যুক্তরাজ্যের Free Cinema, উত্তর আমেরিকার Direct Cinema, কানাডার Candid Eye ইত্যাদি আন্দোলনের মূল প্রেরণা আসলে ভের্তভ ও তাঁর যুগান্তকারী চলচ্চিত্রদর্শন। নিউ মিডিয়া আর্টের প্রধান তাত্ত্বিক লেভ মানোভিচ তাঁকে এমনকি হালের চলচ্চিত্র-নিরীক্ষা Database Cinema-এরও অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করেন। ঝিগা ভের্তভের অপর একটি উল্লেখযোগ্য ছবি Enthusiasm : Symphony of the Donbass (1931), যেখানে তিনি প্রথমবারের মতো শব্দ ব্যবহার করেন এবং সেটি সিনেমার সত্যিকার লোকেশন থেকে ধারণ করা শব্দ, যা একধরনের সিম্ফনির আমেজ আনে বলেই তিনি ছবিটির এমন নাম রেখেছিলেন। রুশ বিপ্লবের মহান নেতা লেনিনের দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নির্মিত তাঁর Three Songs about Lenin (1934) ছবিটি বোদ্ধাজনের প্রভূত প্রশংসা কুড়ালেও তৎকালীন সোভিয়েতের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনকে সমভাবে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এর পর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে সরাসরি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনতে থাকেন। ১৯৩৭ সালে নির্মিত Lullaby ছবিটিই সম্ভবত তাঁর সর্বশেষ স্বাধীন ও শিল্পিত চলচ্চিত্রের উদাহরণ। ঝিগা ভের্তভ ১৯৫৪ সালে মাত্র আটান্ন বছর বয়সে কর্কটরোগে আক্রান্ত হয়ে মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন।

বিশ শতকের প্রথম বর্ষেই বর্তমান ইউক্রেনের ওডেসায় জন্মগ্রহণ করেন রুশ চলচ্চিত্রের আরেক দিকপাল মার্ক দন্স্কয় (১৯০১-১৯৮১), যিনি সৌভাগ্যক্রমে যথেষ্ট দীর্ঘায়ুও হয়েছিলেন। আর এই দীর্ঘজীবনে তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের স্থাপন করে যাওয়া রুশ সিনেমার প্রাথমিক ভিত্তিটিকে আরো মজবুত ও প্রসারিত করতে সক্ষম হন। বয়সে কিঞ্চিৎ বড় হলেও তিনি এইজেন্স্টেইনের কাছ থেকে চলচ্চিত্রের প্রথম পাঠ নেন এবং কালক্রমে একজন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়ে ওঠেন। তিনিই প্রথম তৎকালীন সোভিয়েত সিনেমার প্রচলিত বিশালাকার, জীবনের চেয়ে বড়, মহাকাব্যিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ব্যক্তিমানুষের জীবন ও তাদের দৈনন্দিন গল্পকথার গীতিময়তাকে সেলুলয়েডে ধরার প্রয়াস পান। আর এর জন্য তিনি গ্রহণ করেন তাঁর অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ম্যাক্সিম গোর্কির (১৮৬৮-১৯৩৬) বিশ্বখ্যাত ট্রিলজি My Childhood (1938),  My Apprenticeship (1939) My Universities (1940)-এর চিত্ররূপ দেওয়ার মহতী এক প্রকল্প, যা তাঁকে রাতারাতি জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। ম্যাক্সিম গোর্কির প্রতি তাঁর এতটাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল যে, পরবর্তীকালে তিনি তাঁর আরো দুটি উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দেন। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে তাঁর অগ্রজ পুদভ্কিনের ত্রিশ বছর আগে বানানো বিখ্যাত মাদার ছবিটি, যেটিকে ১৯৫৬ সালে তিনি সবাক চলচ্চিত্রে রূপ দেন। একই বছর দন্স্কয় গোর্কির Foma Gordeyev ev The Gordeyev Family অবলম্বনেও আরেকটি ছবি নির্মাণ করেন, যার জন্য তিনি ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত লোকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান। এর আগে গোর্কি ট্রিলজি নির্মাণের দু-বছরের মাথাতেই তিনি আরেকটি জনপ্রিয় রুশ উপন্যাস How the Steel was Tempered-এরও চিত্ররূপ দিয়েছিলেন, যা বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে ইস্পাত নামেই সমধিক পরিচিত।

তবে যে দুটি ছবি দন্স্কয়কে বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় রীতিমতো কিংবদন্তিতুল্য করে তোলে সেগুলো হচ্ছে, Rainbow (1944)The Taras Family বা The Unvanquished (1945)। এর প্রথমটি পোলিশ লেখিকা  Wanda Wasilewska (1905-1964) রচিত রাদুগা উপন্যাস অবলম্বনে। যুদ্ধের নিমর্মতাকে নিয়ে নির্মিত ছবি Rainbow মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত হলে সেটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আবেগের জন্ম দেয়। এতটাই যে, তাঁদের মধ্যে অনেকেই তখন জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ছবিটি দেখেন এবং এতটাই আপ্লুত বোধ করেন যে, তিনি দন্স্কয়কে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে উল্লেখ করেন, ‘সোভিয়েত সৈন্যেরা কেবল রুশ জননী ও শিশুদের জন্যই যুদ্ধ করছেন না, তাঁরা যুদ্ধ করছেন মার্কিন মা ও শিশুদের জন্যও।’ দন্স্কয় এ-ছবিটির জন্য আমেরিকার চলচ্চিত্র-সমালোচক সমিতি কর্তৃক সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হন। দ্বিতীয় ছবি The Unvanquished-কে বলা হয়ে থাকে হলোকস্ট তথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মানি কর্তৃক ইহুদি নিধনযজ্ঞের ওপর নির্মিত বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র, দন্স্কয় যেটি তাঁর নিজেরই রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নির্মাণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, তিনি এই ছবিটি ও এর আগের Rainbow চলচ্চিত্রটিও যখন তৈরি করছিলেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে এবং দন্স্কয় একপ্রকার যুদ্ধক্ষেত্রে বসেই সেগুলি তৈরি করেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। রুশ লেখক Boris Gorbatov (১৯০৮-১৯৫৪)-এর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটির মূল উপজীব্য ইউক্রেনের এক সাধারণ কৃষক পরিবার ও একজন মানবতাবাদী ইহুদি চিকিৎসকের মধ্যেকার চিরন্তন মানবিক সম্পর্ক এবং তার সমান্তরালে জার্মান নাৎসিবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। এই ছবিটির জন্য দন্স্কয় ১৯৪৬ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালের সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করেন। প্রখ্যাত ইতালীয় পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনির মতে, তাঁদের নিউ রিয়েলিজম চলচ্চিত্রধারার আদি পথিকৃৎ আসলে এই মার্ক দন্স্কয়। শেষ জীবনে দন্স্কয় মস্কোর ম্যাক্সিম গোর্কি স্টুডিওর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে প্রখ্যাত আফ্রিকান চলচ্চিত্র পরিচালক ওসমান সেম্বেনে তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালে তিনি মস্কোতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

রুশ চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ সপ্তরথীর সর্বশেষজন হিসেবে দুটি নাম বিবেচনা করা যায় : গ্রিগরি কোজিন্ৎসেভ (১৯০৫-১৯৭৩) ও সের্গেই গেরাসিমভ (১৯০৬-১৯৮৫)। এঁদের মধ্যে বৈশ্বিক পরিচিতির দিক থেকে হয়তো কোজিন্ৎসেভই এগিয়ে থাকবেন, যাঁর ওভারকোট (১৯২৬), দন কিহোতে (১৯৫৭) ইত্যাদি ধ্রুপদি চলচ্চিত্র এবং শেক্সপিয়রের নাটকসমূহের চিত্ররূপ, বিশেষ করে হ্যামলেট (১৯৬৪), বিশ্বচলচ্চিত্রের অঙ্গনে অমর হয়ে আছে। এছাড়া বয়সের জ্যেষ্ঠতা তো রয়েছেই। আমার পক্ষপাত তবু তাঁর এক বছর পরে জন্মানো সের্গেই গেরাসিমভের প্রতিই থাকবে। কেননা গেরাসিমভ একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা মাত্র ছিলেন না। সিনেমাকে ঘিরে তাঁর ছিল আরো বহুবিধ কর্মকাণ্ড, যা প্রথম যুগের রুশ চলচ্চিত্রের পাটাতনটিকে মজবুত ও প্রসারিত করার কাজে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। প্রথমত তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত শক্তিমান ও মেধাবী অভিনেতা। সত্যি বলতে কি, গেরাসিমভ তাঁর চলচ্চিত্রজীবন শুরুই করেছিলেন একজন অভিনেতা হিসেবে, এবং সেটি খোদ কোজিনৎসেভ, ত্রাওবের্গ যুগল পরিচালিত ছবিতেই। পরে তাঁকে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ থেকেই তৎকালীন socialist realism তথা সামাজিক বাস্তবতা ঘরানার কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি সেই দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেন। তাঁর নির্মিত সেইসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলেক্সান্ডার ফাদেয়েভের উপন্যাস অবলম্বনে The Young Guard (১৯৪৮) এবং মিখাইল শলোকভের একই নামের বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে বানানো তিন খণ্ডের মহাকাব্যিক চিত্রগাথা And Quiet Flows the Don (১৯৫৭-৫৮)। গেরাসিমভ নিজেও একজন দক্ষ চিত্রনাট্য রচয়িতা ছিলেন, তাই পাশাপাশি নিজের চিত্রনাট্যেও তিনি কয়েকটি নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : Men and Beasts (1962), The Journalist (1967), By the Lake (1969) ইত্যাদি। The Journalist ছবিটি ১৯৬৭ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। সের্গেই গেরাসিমভ পরিচালিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র সাহিত্যিক আলেক্সি তলস্তয়ের বিখ্যাত নাটক/ উপন্যাস Peter I-এর ওপর ভিত্তি করে নির্মিত দুইখণ্ডের জীবনগাথা The Youth of Peter the Great (1980)At the Beginning of Glorious Days (1980)। অক্লান্ত কর্মী গেরাসিমভ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চলচ্চিত্র নিয়ে চিন্তাভাবনা ও হাতেকলমে কাজ করে গেছেন। মৃত্যুর এক বছর আগে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর জীবনের আরেক মাস্টারপিস Lev Tolstoy (1984), যার চিত্রনাট্যও তাঁর নিজের লেখা এবং যেখানে তিনি নিজে তলস্তয়ের চরিত্রে ও তাঁর স্ত্রী তামারা মাকারোভা তলস্তয়ের পত্নীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের পাশাপাশি তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র বিদ্যালয় মস্কো ফিল্ম ইনস্টিটিউটে (১৯১৯) শিক্ষকতার মাধ্যমে শতশত চলচ্চিত্রকর্মী তৈরি করে গেছেন। তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় Gerasimov Institute of Cinematography (VGIK)। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন সোভিয়েত চলচ্চিত্রের আদি স্বর্ণযুগের অন্যতম পথিকৃৎবিশেষ।

একথা অনস্বীকার্য যে, এইসব স্বপ্নবান পথিকৃতের মেধায় ও শ্রমে নির্মিত পথেই পরবর্তীকালে ক্যামেরাকাঁধে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছেন সের্গেই বন্দারচুক (১৯২০-১৯৯৪), সের্গেই পারাঝানভ (১৯২৪-১৯৯০), তেন্গিজ আবুলাদ্জে (১৯২৪-১৯৯৪), আন্দ্রে র্তাকোভোস্কি (১৯৩২-১৯৮৬), কিরা মুরাতভা (১৯৩৪-২০১৮), লারিসা শেপিট্কোর (১৯৩৮-১৯৭৯) মতো উজ্জ্বল উত্তরসূরিরা, কিংবা এখনো সেই পথে সগৌরবে হেঁটে চলেছেন আন্দ্রে কন্চালোভ্স্কি (১৯৩৭), নিকিতা মিখাল্কভ (১৯৪৫), পাভেল লুঙ্গিন (১৯৪৯), আলেক্সান্ডার শকুরভ (১৯৫১), আন্দ্রে ক্রাভ্চুক (১৯৬২), আন্দ্রে ঝ্ভিয়াগিনৎসেভের (১৯৬৪) মতো বিশ^মাতানো তুখোড় চলচ্চিত্রনির্মাতারা। জয় হোক গৌরবোজ্জ্বল সোভিয়েত তথা রুশ চলচ্চিত্রের।