সহসা দুপুরে দহন

একদিন ছাদে হাঁটতে হাঁটতে নিশি দেখলো, বাহ, মজার ব্যাপার তো! কোত্থেকে যেন এক জোড়া দোয়েল এসে ঘর-সংসার পেতে বসেছে পশ্চিমকোণে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের ফিরোজা রঙের স্যানিটারি পাইপটার খোপে। জগৎ-সংসারের কিছু নিয়মনীতি সম্পর্কে নিশির ইদানীং কেমন একটা অনীহার ভাব জন্মেছে, নিতান্তই অবহেলায় বেড়ে ওঠা তৃণাঙ্কুরের মতো। জীবনপ্রদীপ নিভে আসা মানুষের ফ্যাকাশে দৃষ্টির মতোই বহির্বিশ্বটা ওর কাছে এখন প্রাণহীন।

যাদের জন্ম হয় মেহগনি কাঠের পালঙ্কে, অথচ জীবনের প্রণালি এসে থিতু হয়ে গেঁথে থাকে নর্দমার পাঁকে, নিশি সেই শ্রেণির মানুষের যাপিত জীবনের একজন দুর্বল প্রতিনিধি হয়ে বেঁচে আছে। ওর মনে হয়, পাখিদের মতো আর ওই দোয়েলদের মতো যদি মানুষের জীবন হতো, তাহলে বুঝি বেশ হতো, অন্তত একঘেয়েমি তো থাকতো না।

প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু স্বপ্নবিষয়ক ভাবনার সুতো ধরে খোলাচুলে আঁচল লুটিয়ে নিশি পায়চারি করে ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত। ছ-বছরের আদনান বল নিয়ে মায়ের পায়ে-পায়ে ঘোরে। আদনানের বাবা তৈমুর তখন অফিসার্স ক্লাবের গেমসরুমে দাবার ছক নিয়ে মশগুল। নিশি অনেকদিন বলেছে : আদনানকে সঙ্গে নিয়ে যাও না কেন? ছেলেটা ছাদের ওপর খেলতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পায়। মাঠে খেললে খেলার মজাটা পাবে আর দু-চারজনের সঙ্গে মিশতেও পারবে। ছাদ তো হাঁটার জন্য আর কাপড় শুকানোর জন্য। বল খেলার জন্য তো নয়। ছেলেটা এভাবে একা-একা থাকতে-থাকতে অসামাজিক হয়ে যাবে না?

: কেন, স্কুলে তো যথেষ্টই মেলামেশা হয়। তৈমুরের এক বাক্যে উত্তর শুনে নিশি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালা দিয়ে একদলা থুথু ফেলে রাস্তায়। আসলে নিশির কোনো কথাই তৈমুর কানে তোলে না। এতদিনের দাম্পত্য জীবনে নিশিকে ও অধীনস্থ কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই বোধহয় ভাবে না। মনে আছে একবার সেই কবে যেন, আদনানের জন্মের আগে নিশির বড় ভাই আমেরিকা যাওয়ার দুদিন আগে বড় একটা পার্টি দিয়েছিল তার বনানীর বাড়িতে। সে-উপলক্ষে সবাই খুব ছবিটবি তুলেছিল বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। নিশির ছোট ভাই বলেছিল : নিশিপা, দুলাভাইয়ের সঙ্গে দাঁড়াও, এই বাগানে একটা ছবি তুলি তোমাদের।

তৈমুর একটা হাতলঅলা চেয়ারে বসে দই খাচ্ছিল। নিশি স্বামীর গলায় একটা হাত রেখে চেয়ারের হাতলে বসে বলল : নে কচি, তোল দেখি।

তৈমুর এক লাফে ওর গলা থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়াল : কী ছেলেমানুষের মতো করছ! আশেপাশে মুরুব্বিরা রয়েছেন না!

নিশি দৌড়ে গিয়ে কোনার দিকে একটা ঘরে অনেকক্ষণ দরজা বন্ধ করে কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে সন্ধ্যার আগে আবার চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে সবার সঙ্গে বসে নৈশভোজের আয়োজনে মেতেছিল।

ওদের বড় সন্তান মিমি। আদনানের চেয়ে সাত বছরের বড়। ময়মনসিংহ ক্যাডেটে পড়ে। ছুটিছাটায় মিমি এলে নিশির সময়গুলি ব্যস্ততার মধ্যে কখন যে কেটে যায় তা সে টেরও পায় না। তৈমুরের চেয়ে মিমি বরং নিশির কাছে বেশি আকাক্সিক্ষত, প্রাণবন্ত এবং প্রিয় সখি। মা-মেয়েতে এমন সখ্য খুব একটা দেখা যায় না।

তৈমুরের সঙ্গে নিশির সম্পর্কটা আগ্রাসী নীরবতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আগে খুবই চিল্লা-হল্লা করত নিশি। এখন করে না। আদনান বড় হচ্ছে। মিমিকে হোস্টেলে দিয়ে নিশি বেঁচে গেছে যেন।

নিশির বড় খালা বলতেন, পৃথিবীতে মেয়েমানুষের জন্ম হয় শুধুই স্যাক্রিফাইসের জন্য। অশ্রু বিসর্জনের জন্য। দাসীবৃত্তি করার জন্য। পুরুষের কোলবালিশ হওয়ার জন্যে। ঝুটা-কাঁটা খাবার জন্য আর পাওয়ার খাতায় শূন্য লিখে দেনার দায়ে ঋণী হওয়ার জন্য। বড় খালা যখন অফিস করে এসে দুপুরে সকালের বাসি বিছানা গোছাতেন আর এই কথাগুলি বলতেন, নিশি হেসে গড়িয়ে পড়ত। এখন দেখে, বড় খালা তো ঠিকই বলতেন। আহারে! বড় খালার কবরের পাশে যদি একগুচ্ছ ধূপকাঠি জ্বালাতে পারতাম! ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে নিশি বিছানায় শুয়ে পড়ে। বালিশের তলা থেকে গল্পের বইটা তুলে নিয়ে চোখের ওপর মেলে ধরে। আদনানকে স্কুলে দেওয়া-নেওয়ার পর ঘরকন্নার ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু সময় পায় ও গল্পের বইয়ের ভেতর আত্মনিবেশ করে। পাড়ার ছেলেরা একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি করেছে। নিশি সেখানকার পয়লা নম্বর এবং সক্রিয় সদস্যা। নিশির স্কুল-কলেজ জীবনের সহপাঠিনী রেখা বলে : দুঃখ-ফুক্খগুলি ফেলে রাখ বুড়োকালের জন্য। এখন যত পারিস বেশি করে বই পড়। দেখবি ওই ম্যাড়মেড়ে দুঃখগুলি কড়কড়ে রোদের তাপে বাষ্প হয়ে গেছে। শোন নিশি, শোন। জীবনটা তো তোর। অন্যের জন্য স্রষ্টার দেওয়া এমন মহার্ঘ্য দানটা তুই নষ্ট করবি কেন? জীবনের কোনায় কোনায় অনেক রকম সুখ লুকিয়ে আছে, তুই শুধু একটু খুঁজে নিতে চেষ্টা কর, দেখবি জীবন কত সুন্দর। টেলিফোনে রেখা এসব কথা নিশিকে বলে।

একদিন নিশি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে দেখে সেই দোয়েল  জুটির বাচ্চা হয়েছে। আহ্ পাখিদের এত প্রেম! মা দোয়েল, বাবা দোয়েল শিশু দোয়েলটিকে নিয়ে কী যে মহাআনন্দ করে! নিশির চোখের কার্নিশে জমে থাকা বাষ্পগুলি শিশিরের মতো ফোঁটায় ফোঁটায় গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

তৈমুর একদিন অবিশ্বাস্যভাবে বলে বসল : আদনানের সাত বছরের জন্মদিনটা ঘটা করে করব এবার।

: হঠাৎ আদনানের জন্মদিন …? নিশির অবাক প্রশ্ন।

: বিস্ময়-টিস্ময় রাখো দেখি, যা বলছি শোনো। বাড়িতে ব্যবস্থা করব, নাকি বাইরে কোথাও?

নিশি বলল : কতজন গেস্ট ডাকবে?

: এই ধরগে, আমার এমডি, ডাইরেক্টর, আরো ধরো পাঁচ-সাতজন সহকর্মী স্ত্রীসহ আর তোমার চার-পাঁচজন বান্ধবীকে বলবে উইথ স্পাউজেস আর আদনানের ক্লাসের বেস্ট ফ্রেন্ডরা ওদের বাবা-মাসহ।

: কিন্তু মিমির যে এখন ছুটি নেই।

: আমি সেটাও ভেবেছি, কিন্তু এই মুহূর্তে একটা ভোজসভা খুবই অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

: ও! তাহলে চাইনিজেই করো।

নিশির জীবনে এইটুকু শলাপরামর্শ পরম পাওয়ার মতোই। তবু যা হোক সামাজিকভাবে একটু আনন্দ করা যাবে। এমন মশারি-ঘেরা জীবনে আবদ্ধ হয়ে আছে যে লোক-লৌকিকতাও ভুলে গেছে ওরা। দুজনে এক রিকশায় বসে না অনেক দিন। পাড়ার লোকেরা বোধহয় অন্য কিছু ভেবে বসে আছে। ভাববে না? পাড়ার ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রী নেই নাকি? সবাই তো আর বিদেশি সংস্থার ডেপুটি ডাইরেক্টর শাহাদাৎ তৈমুরের মতো গুরু আর নিশাত জাবীনের মতো শিষ্যা নয়।

খবরটা টেলিফোনে শোনামাত্রই রেখা সেই গ্রামোফোন কোম্পানির গলা বাড়িয়ে বসে থাকা জিনিসটার মতো কলকল করে উঠল।

: যাক বাবা নিশি, তৈমুরভাই এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ করেছে। দেখ আমি বলিনি, পাথরেরও ঘাম হয়।

: ছাই বুঝেছ তুমি। এ-ও একটা চাকরি। প্রমোশন পাওয়ার কলাকৌশল মাত্র।

: যা হয় হোক। আমরা তো কিছুটা মজা করতে পারব। শোন, কী শাড়ি পরবি আগে বল?

: কী আর পরবো, দেখি। নিশি বললো।

: ওই, তুই তাঁত-ফাত পরিস না তো। সিল্ক পরবি ব্লাউজ পিসসহ। পারলারে গিয়ে চুল বাঁধবি। আমিই এসে নিয়ে যাব তোকে।

: ঠিক আছে। নিশি টেলিফোন রেখে দেয়।

: কী ব্যাপার তূর্যর আম্মা আসেননি?

: উনি তো দেশেই নেই। তূর্যর বাবার চটপট উত্তর শুনে নিশি বললো : নেই মানে আপনি ইচ্ছে করেই আনেননি। স্কুলেও দেখি না ওনাকে।

: দেখবেন কী করে, উনি তো আমার সংসারেই থাকেন না। চলে গেছেন …।

: স … স্যরি। আমি ঠিক জানতাম না।

নিশি ব্যথাতুর চোখে তাকাল তূর্যর বাবার দিকে। তৈমুর ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো : চলো চলো, সবাই সম্ভবত এসে গেছেন। অর্ডার দিয়ে দিই। অতিথি-অভ্যাগতদের মধ্যে পরস্পর পরিচয় প্রদানপর্ব শুরু হলো। তৈমুরই সবার পরিচয় করিয়ে দিলো। নিশি শুধু আদনানের স্কুলের বন্ধুদের এবং ওদের বাবা-মায়েদের সঙ্গে পরিচয় করাল। তূর্যর বাবার দিকে তাকিয়ে ওর মুখের কথা আটকে গেল। থাই স্যুপের গরম ধোঁয়ার আবর্তে কেউ সেটা টের পায়নি।

সেদিনই বোধহয় নিশির মনের কোণে পেতে রাখা শীতলপাটিটায় রাজু অসতর্কে বসে পড়েছিল ক্লান্তি নিয়ে। আদনানের বন্ধু তূর্যর বাবা রিয়াজ মাহমুদের সুন্দরী স্ত্রী তূর্যকে ফেলে আর একজনের ঘরণী হয়েছেন আজ পাঁচ বছর হতে চলল। সেই থেকে রিয়াজ সাহেব নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন। তবে ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয় না যে এত বড় একটা ঘা-খাওয়া জীবন তিনি কাটাচ্ছেন। যৌতুকের জন্য যেখানে ছেলেরা মেয়েদের প্রাণে মেরে ফেলছে, ডিভোর্স করছে সেখানে যৌতুক দেয়নি বলেই তূর্যর মা তূর্যর বাবাকে ভাঙা ইটের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়ে শ্বেতপাথরের প্রাসাদে আয়েশে জীবন কাটাচ্ছেন। ব্যাপারটা তো পুরুষ মানুষের জন্য বড়ই অপমানজনক। কিন্তু ভদ্রলোক নাকি অপমানিত হচ্ছেন না। উনি নাকি উইমেন্স লিবে বিশ্বাসী। এসব কথা রেখা নিশিকে বলে টেলিফোনে। সেই থেকে রাজুর প্রতি নিশির উৎসাহ কিঞ্চিৎ বেড়ে গেল। আসলে লোকটা হাসাতে পারে। দারুণ মজার-মজার গল্প করে। কথা যে মানুষকে কত কাছে টেনে আনে, নিশি দিনদিন টের পাচ্ছে।

নিশির এখন আর বেলা-অবেলায় ঘণ্টাকে ঘণ্টা ছাদে উঠে অযথা পায়চারি করতে হয় না। পায়রার খোপে চোখ যায় না। নিশির মনে হয় প্রত্যেক বিবাহিত মেয়েরই একটি খোলা বারান্দার প্রয়োজন। যেখানে স্বামী-সংসারের আবর্তে হাঁপিয়ে উঠলে একটু দাঁড়ানো যায় চুল খুলে। মেয়েদের জন্য ঘর যতখানি সত্য, বারান্দাও ততখানি সত্য।

রাজু একদিন বললো : কার লেখা ভালো লাগে?

: নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।

: বুঝতে পারেন যে যৌবনের শেষ প্রান্তে এসে একজন স্ত্রীবিহীন মানুষ কতটা বিপজ্জনক হতে পারে।

নিশি খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর হাসির শব্দটা রাজু বুকে ধরে চোখ বুজে বসে থাকে। একদিন রাজু অফিসে এসে প্রথমে নিশিকে ফোন করল : আচ্ছা বলুন তো জীবনের সবচেয়ে মহার্ঘ্য দান কী?

নিশি বললো : ভালোবাসা।

: হলো না। গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে রাজু বললো।

: তাহলে কী?

: যৌবন নিবেদন।

: তা সে নিবেদনটা কোথাও করেছেন নাকি?

: নাহ, কাউকে করিনি এখনো, তবে করতে চাচ্ছি।

: কাকে?

: আপনাকে, নেবেন?

: আমার তো বেলা শেষ রাজুভাই। এই আসন্ন সাঁঝবেলাতে আমি কি সেই মহার্ঘ্য দান নিতে পারি?

: দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে সকাল-সন্ধ্যার ভূমিকার চেয়ে

দাতা-গ্রহীতার ভূমিকাই কিন্তু মুখ্য।

নিশি ডালিমের মতো ফেটে চৌচির হলো মনে মনে। কিন্তু কপট শাসনের সুরে বললো : যাহ্্, রাখি কাজ আছে ম্যালা।

দুজন মনে মনে ভালোবাসার নৈবেদ্য সাজায়। কল্পনায় একে অন্যের চোখের পাপড়িতে আলতো চুমু খায়। বড় বড় আম, জাম এবং অশ্বত্থগাছের তলায় দাঁড়ালে যেমন মনে হয় ভালোবাসার কাছে চলে এসেছি, রাজুর সঙ্গে কথা বললে নিশির মনে হয় ভাসমান মনটা যেন এবার নোঙর গেড়েছে। রাজু যায় তূর্যকে স্কুলে পৌঁছে দিতে, নিশিও আদনানকে। এভাবেই ওরা দুজন দুজনের মধ্যে একটা আলাদা ঘর তৈরি করেছে। সে-ঘরে ওদের অব্যক্ত ভালোবাসাগুলি জমা রাখা।

রাজুর চোখে যখন মাঝে মাঝে কামনার তারাবাতি ঝিকমিক করে, নিশি তখন সফল শিক্ষকের মতো অনর্গল বলে : দেখো রাজুবাবু, শারীরিক ভালোবাসাকে যদি মনের ভালোবাসা থেকে আলাদা করতে না পারো, তাহলে সমাজ-সংসারের কাছে কিন্তু দোষীসাব্যস্ত হয়ে যাবে। ভালো মানুষটি হয়ে আর থাকা যাবে না।

রাজু বলে : শোনেন ম্যাডাম, শোনেন বলি, সতীত্ব কিন্তু কেবলই শারীরিক ব্যাপার নয়, মনে রাখবেন। আপনি কি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেন, আমাদের চারপাশের কজন মেয়ে আসলে মনে-মনে সতী?

নিশি রাজুর চোখের দিকে তাকিয়ে হোঁচট খাওয়া পথিকের মতো বিব্রত হয়। রাজু বলে : শোনো, এই তুমি আর মধ্যবিত্ত সংসারের একটা পুরনো খাট হচ্ছে এক স্বভাবের। মচমচ করবে। নড়বড় করবে তবু ভাঙবে না। তার চেয়ে আমার বউ ভালোই করেছে। আমি ওর সাহসকে ধন্যবাদ দিই। যে-জীবনে ভালোবাসা নেই সে-জীবনে থেকে কী লাভ? – বঞ্চনার চেয়ে বড় পাপ এই পৃথিবীতে নেই।

সেদিন রাতে নিশি ঘুমাতে পারল না কিছুতেই। শুয়ে-শুয়ে শুধু এ-পাশ ও-পাশ করল। রাজুর কথাগুলি একটা-একটা করে হজমের ট্যাবলেটের মতো গিলতে চাইল। ট্যাবলেটগুলি এত বড় যে, এক ঢোকে গেলা যায় না।

তৈমুরের মতো একজন শরীরসর্বস্ব লোক নিশিকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জীবন বীমা করে দিয়েছে। ভালোবাসা দিতে পারেনি। তাহলে কি স্বামীর সঙ্গে ভালোবাসা হয় না? ভালোবাসার জন্য তাহলে মেয়েরা যাবে কোথায়? তৈমুরের বোঝা উচিত যে, মেয়েরা একটু সুন্দর কথা, সামান্য প্রশংসা, একটি লাল গোলাপ আর একটি কবিতার বইয়ের বদলে সবকিছু উজাড় করে দিতে পারে। আসলে তৈমুররা হচ্ছে বর্গির জাত। ধান ফুরালেও ক্ষমা নেই। এই বর্গিকে প্রতিরাতে ভালোবাসাবিহীন খাজনা দিতে দিতে নিশির শরীরটা ধুন্দুলের ছোবড়া হয়ে গেছে। দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মড়ার মতো পড়ে থাকা নিশিকে মাংসলোলুপ তৈমুর কোনোদিনও বুঝল না।

রাজুর সঙ্গে নিশির পরিচয়ের বয়স প্রায় দু-বছর হয়ে গেছে। আদনানের জন্মদিনটা আবার ফিরে আসছে।

দুপুরের অলস মুহূর্তে শুয়ে শুয়ে নিশি একটি উপন্যাস পড়ছিল। তৈমুর অফিসে। আদনান ঘুমে। রাজুর টেলিফোন বেজে উঠল। নিশি শুয়ে থেকেই রিসিভার কানে রাখল : হ্যালো।

: কী করছ?

: ‘নাজাই’ পড়ছি।

: কার লেখা?

: বুদ্ধদেব গুহর।

: ভদ্রলোক কী যে কঠিন-কঠিন সব অজ্ঞাত শব্দ ব্যবহার করেন না! সাসান ডিরি, ওয়াই কী কী …।

: ঠিক বলেছ। তাছাড়া বনজঙ্গলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার যে চমৎকার রূপায়ণ থাকে তাঁর লেখায়!

রাজু বলল : বাংরিপোসির দু’রাত্তির পড়েছো?

: না-তো।

: ভাগ্যিস পড়োনি, ওটা পড়লে তুমি এই দালানকোঠা ছেড়ে আমার হাত ধরে সোজা গভীর অরণ্যে গিয়ে বসে থাকতে চাইবে।

: ধুর! পাগল। নিশি হাসে।

: এ্যাই, ‘নাজাই’ মানেটা কী? রাজু বলল।

: ‘নাজাই’ হচ্ছে গিয়ে অনাদায়ী খাতে …। অর্থাৎ যা পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু পাওয়া হলো না। অনাদায়ীই রয়ে গেল। এই রকম আর কী।

রাজু কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলল না। কানে রিসিভার চেপে ধরে ঘাড় কাত করে চোখ বুজে বসে রইল।

নিশি বলল : কী হলো?

রাজু বলল : নিশো, দিন-দিন আমার একটি ইচ্ছে কেমন যেন তীব্রতর হচ্ছে। আমি … বিশ্বাস করো ইচ্ছেটাকে কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছি না …। রাজু আর কিছু বলতে পারল না। আস্তে করে ফোনটা রেখে দিলো।

নিশি রক্তিম গালে হাত রেখে ভাবল। ভাবতে ভাবতে প্রায় পাঁচদিন কেটে গেল। আগের মতো রাজুর ফোন প্রতিদিন আসে না। একদিন হঠাৎ সন্ধ্যায় রাজু বাসায় এসে উপস্থিত। তৈমুরের সঙ্গে খুব গল্প করল। আদনানের জন্মদিনের পার্টির সুখ্যাতি করল। তারপর চা খেয়ে সোজা চলে গেল। যাওয়ার সময় শুধু নিশির সঙ্গে একটু দৃষ্টিবিনিময় হয়েছিল। রাজুকে দেখে নিশির কেমন যেন একটু বেশি বুড়োটে নাকি রোগাটে মনে হলো। পরদিনই নিশি ফোন করল।

: কী ব্যাপার একেবারে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া?

: তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

: ব্যস?

রাজু বলল : কিছু একটা করো নিশি … প্লিজ, একদিন তো মরেই যাবো।

 : তাই বলে মরার আগে …।

নিশিকে থামিয়ে দিয়ে রাজু বলল : কেন বোঝো না … এ অন্যায় নয়। এ কোনো পাপও নয়। এ হচ্ছে ভালোবাসা।

: পাখির মতো। ফুলের মতো। নদীর মতো। আর খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের মতো কথা বলছ … নিশি হেসে গড়িয়ে পড়ে।

রাজু বলল : দেখো মেয়ে, শুধু সুযোগ করে দাও। ভালোবাসা কাকে বলে একবার দেখিয়ে দিই মরার আগে।

রাজুর কথায় নিশি প্রায়শই চমকে ওঠে। বলে কী লোকটা! নিশির সংক্ষিপ্ত জীবনের অবসরে রাজুর টুকরো টুকরো কথাগুলি নিশিকে অচল সংসারে সচল রাখে। যেমন – তোমাকে কতদিন দেখি না নিশো …। কবে আসবে, বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে যে …। তোমার জন্যে দুটো বই কিনে রেখেছি …। দিয়ে যাই? তুমি না সেদিন বললে যে বারবার বলা সত্ত্বেও তৈমুর তোমার জন্য ফেসিয়াল টিস্যু আনেনি। আহ্ ছাড়ো তো ওসব ছোট ছোট দুঃখের কথা। তোমার জন্য কিনে রেখেছি তো। আজই ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব কেমন? জানো, তোমার জন্য না একটা লিপস্টিক কিনেছি … রংটা দেখ আবার পছন্দ হয় কি না …।

রাজুর এইসব টুকরো-টুকরো কথা যখন নীরবে-নিভৃতে নিশির কানের কাছে বাজে, তখন নিশির মনে হয় এক্ষুনি প্রজাপতি হই।

প্রজাপতি হতে না পারলেও নিশির অন্তরে রাজুর জন্য ভালোবাসার মৌচাক তৈরি হয় ধীরে-ধীরে। কোথাও কোনো ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। বন্ধু-বান্ধবকে এসব ব্যাপারে খুব একটা বিশ্বাস করা যায় না। ওরা হয় ঘৃণা করবে, নয়তো রটাবে …। অবশেষে ঠিক হলো রাজুর অফিসেই। দুপুরের পর অফিসটা একটু ঝিমায়। রাজু আজকাল খাবার সময় হলেই দরজা লক করে দেয়। সব অফিসারই এরকম করেন। নিশি সংস্কারের ছেঁড়া কাঁথাটা গা থেকে ফেলে দিলো। সাপেরাও তো খোলস বদলায়। গাছেরও তো নতুন পাতা গজায়। মানুষ কেন একভাবে থাকবে? ছেলেরা বউ পছন্দ না হলে যদি আর একটা বিয়ে করতে পারে, তো মেয়েরা কেন স্বামী বরণ করতে পারবে না? যত নিয়ম সব পুরুষের জন্য। মেয়েরা কি জড় পদার্থ? একদলা থুথু ফেলে নিশি সমাজব্যবস্থার পানপাত্রে। মনকে ভালোবাসলে শরীর ছোঁয়া যাবে না কেন? ভালোবাসার অকপট স্বীকারোক্তি অবশ্যই আর দশজন মহিলার থেকে পৃথক শিরোপা দিতে পারে। এতদিন ধরে যে ভালোবাসার অর্থ দিয়ে সে সেঁজুতি সাজাচ্ছে আজ তার সম্পূর্ণ আলোটুকু রাজুর বুকে জ্বেলে দেবেই। বুকের ক্যাসেটে গম-গম করে বাজতে লাগলো – ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে …।’

সমস্ত শরীরে সুগন্ধি মেখে চোখে কাজল এঁকে সবুজ পাড়ের হলুদ একটা টাঙ্গাইল শাড়ি পরল নিশি। গোল গলার সবুজ ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। হাতে হলুদ, সবুজ কাচের চুড়ি। ভীরু-ভীরু পায়ে যখন রাজুর উনিশ নম্বর কক্ষের দরজার কাছে দাঁড়াল নিশি, ভেতর থেকে অনিন্দ্যসুন্দর কণ্ঠে ধ্বনিত হলো : এসো -।

নিশি রুমে ঢুকেই সোফায় বসে পড়ল। এই রুমে নিশি আরো কয়েকবার এসেছিল কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে এই প্রথম রাজুর দিকে আজ তাকাতে পারছে না ও কিছুতেই। টেবিলে রাখা কিছু ইংরেজি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে উল্টাতে-পাল্টাতে শুরু করল।

রাজু ওকে চোরা চোখে দেখছে। আহ্্ আজ যদি মরণ হয় তো হোক।

: এ্যাই।

: বলো -।

: মুখ তোল, তাকাও আমার দিকে।

নিশি লাজুক চোখে একবার তাকিয়েই জানালা দিয়ে চোখ দুটোকে বাইরে পাঠালো। রাস্তার পাড়ের বিশাল কৃষ্ণচূড়া আর শিরিষ গাছের দিকে তাকিয়ে রইল। বড়-বড় গাছের দিকে তাকাতে ওর সবসময় ভালো লাগে।

রাজু বলল : কী দেখছো ওদিকে?

: গাছ। বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের জীবনের সাযুজ্য কতখানি তাই ভাবছি।

রাজু একটা চুইংগামের প্যাকেট খুলে নিশির দিকে এগিয়ে দিলো। দুজনেই চুইংগাম চিবুতে চিবুতে আড়চোখে একবার করে চোখে চোখ রাখছে।

নিশি বিব্রত বোধ করতে-করতে ধমক লাগাল : অমন করে দেখছ কী?

: তোমার চোখ। ঠিক যেন করুণ শঙ্খ।

নিশি দু-হাতের তালু দিয়ে চোখ ঢাকল।

: মানসিকভাবে তৈরি হয়ে যাও নিশো।

মন্ত্রের মতো শোনাল রাজুর কণ্ঠ।

নিশি চোখ মেলে তাকাল রাজুর দিকে। যেমন করে বাগানে ফুটে থাকা সূর্যমুখীটা আকাশের দিকে তাকায়। আজ রাজুকে সত্যি যেন অন্য রাজু মনে হচ্ছে। তূর্যর বাবা এ নয়। আকাশি শার্টের ওপর মেরুনরঙা টাই। ছাইরঙা ট্রাউজার। একটা রুপালি চুলও দেখা যাচ্ছে না আজ। চশমার ভেতর দিয়ে চোখের তারা ঝিলমিল করছে জ্যোৎস্নাভরা আকাশের মতো।

ইন্টারকমটা বেজে উঠল। উদ্বেগ জড়ানো গলায় রাজু রিসিভার তুলল : জি স্যার। জাস্ট নাউ আই অ্যাম কামিং। থ্যাংক ইউ স্যার। ব্যস্ত হয়ে কলম আর প্যাডটা হাতে নিয়ে বলল : বসো আসছি। নিশি একটু নড়েচড়ে শক্তপোক্ত হয়ে বসল। মিনিট পাঁচেক পর রাজু এসে রুমে ঢুকল ঝড়ে তাড়া খাওয়া দাঁড়কাকের মতো। স্বেদবিন্দুতে মুখ ভিজে গেছে।

: নিশো – এমডির রুমে জরুরি মিটিং। ঘণ্টাখানেক লাগবে – তুমি কি এতক্ষণ বসতে পারবে? রাজুর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে নিশি স্বাভাবিকভাবে বলল : অস্থির হয়ো না প্লিজ -। তুমি যাও। ডিউটি ফার্স্ট -। আমি তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছি না। আর একদিন না হয় আসব। রাজু নিশিকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে শুকনো ডালপালার মতো হাত-পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে রিটায়ার্ড অফিসারের মতো মন্থর পায়ে এমডির রুমে গিয়ে বসল। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত ঘষে মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিল : ছাতুর চাকরি ছেড়েই দেব।

ততক্ষণে এমডিকে ঘিরে অন্য অফিসারেরা বসে পড়েছেন।

নিশি সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে সোজা রাস্তায় নেমে এলো। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল চেপে চেপে। কপালের টিপটা আলগোছে খুলে রাস্তায় ফেলে দিলো। রুমাল দিয়ে মুখ মোছার সময় লিপস্টিকের প্রলেপও ঠোঁট থেকে মুছে নিল। হাতের ইশারায় একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পড়ল।

দুপুরের গনগনে রোদ তখন ওর মাথার ওপর।