রূপ-কথা

একরাশ বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে গোমড়ামুখে বৈকুণ্ঠবাবু সপরিবারে যখন শিমুলতলায় নামলেন, তখন অস্তগামী সূর্যটা স্টেশনের ধারে মস্ত ঝিলটায় ডুবসাঁতার কাটছে।

ওঁর স্ত্রী সেদিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলেন, দেখো, দেখো, জলের মধ্যে কী সুন্দর সূর্যাস্তের ছায়া পড়েছে!

বৈকুণ্ঠবাবু এমনিতেই তেতে ছিলেন। একে ঘরকুনো, তার ওপর শ্রমবিমুখ এবং কৃপণ স্বভাবের মানুষ তিনি। নিজেকে বরাবর মিতব্যয়ী বলে দাবি করলেও পাড়া থেকে অফিস, সকলেই তাঁকে মজা করে ‘ব্যয়কুণ্ঠ’ বলে ডাকে। বেড়ানোর কথায় বরাবর গায়ে জ্বর এলেও নিতান্ত দায়ে পড়ে আসতে হয়েছে তাঁকে।

একটা বাক্স টানতে টানতে স্ত্রীর আদিখ্যেতায় ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, সূর্যাস্ত দেখে অমন আহা-উহু করার কী হয়েছে? এর আগে সূর্য কি কখনো অস্ত যায়নি, নাকি তুমি এতকাল চোখ বন্ধ করে ছিলে?

অন্য সময় হলে এই সূর্যাস্তদর্শন পর্ব সহজে মিটত না। কিন্তু স্রেফ বেড়ানোর আনন্দে শ্রীমতি খোঁচাটা গায়ে মাখলেন না। বরং গলায় এক গামলা উদ্বেগ ঢেলে বলে উঠলেন, আহা, করো কী, করো কী? একে তোমার কোমরের ব্যথা, তার ওপর অমন ভারী ভারী বাক্স-প্যাঁটরা টানাটানি শুরু করেছ! এই ঘন্টু, হাঁ করে দেখছিস কী? যা বাবা, একটা কুলি ডেকে আন!

কুলির কথা বলামাত্রই হা-হা করে উঠলেন বৈকুণ্ঠবাবু। আসার সময় হাওড়া স্টেশনে কুলির খপ্পরে পড়ে নগদ আশিটা টাকা গচ্চা গেছে। সে শোক এখনো তিনি সামলে উঠতে পারেননি।

স্ত্রীর দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে বললেন, ওসব কুলিটুলি লাগবে না। বাবা ঘন্টু, আয় তো, একটু এদিকটা ধরতো। এই ক্ষেন্তি, মা, এই ব্যাগটা একটু নে না! একদম হালকা, ধরে দেখ, ঠিক নিয়ে যেতে পারবি।

শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে টানাটানি করে লটবহরগুলো স্টেশনের বাইরে আনতে পেরে একটু স্বস্তি পেলেন তিনি। কুলির খরচটা অন্তত বাঁচল! এরপর বিস্তর দরাদরি করে এক বুড়ো ভ্যানওয়ালার গাড়িতে সেগুলি চাপালেন বটে, কিন্তু একটু যেতেই দেখা গেল ওই লটবহর টানা তার কম্মো নয়। অগত্যা বৈকুণ্ঠবাবু নিজে সেই ভ্যান ঠেলতে ঠেলতে চললেন।

তবে তাঁর একটাই সান্ত্বনা, এখানে থাকার ব্যবস্থাটা অন্তত বিনি পয়সায় করা গেছে। বৈকুণ্ঠবাবুদের অফিসে মালপত্র সাপ্লাই দেয় কৃপাসিন্ধু বলে এক ছোকরা। তিনি হাওয়া বদলাতে যাবেন শুনে সে-ই শিমুলতলার হদিসটা দিয়েছিল। সঙ্গে মাগনায় থাকার অফার। বাড়িটা তার মামাশ্বশুরের মেসোমশাইয়ের। তাঁরা কেউ থাকেন না এখানে, স্টেশনের ধারে গোলদারির দোকানের পাঁড়েজির কাছে চাবি রাখা থাকে। তিনিই বাড়িটার দেখভাল করেন।

আসার দুদিন আগে কৃপাসিন্ধু হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, পাঁড়েজি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ, চিঠি দেখালেই তিনি চাবি দিয়ে দেবেন। পৌঁছে দেখলেন, কৃপাসিন্ধুর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। অমন হাসিখুশি সদালাপী মানুষ আর হয় না! চা খাওয়ার জন্য সে কী পীড়াপীড়ি!

কিন্তু বাড়ির অবস্থা দেখে তো সকলের মাথায় হাত। পোড়োবাড়ির হদ্দ! মূল ফটকের সামনে আবর্জনার ডাঁই, বহুকাল বন্ধ থাকার ফলে যত্রতত্র আগাছার জঙ্গল, এমনকি দরজা-জানালার ওপর পর্যন্ত বুনো লতার ঝোপ। মরচে-পড়া তালা খুলে তাঁরা যখন ভেতরে ঢুকলেন, তখন দিনের আলো প্রায় মরে এসেছে।

ঘরের অবস্থা দেখে একটু দমে গেলেন বৈকুণ্ঠবাবু। ঘরময় চামচিকের বাসা, আরশোলা-টিকটিকির ভরভরন্ত সংসার। মেঝের ওপর কয়েক ইঞ্চি ধুলোর মধ্যে কয়েকটা নেংটি ইঁদুর চু-কিতকিত খেলছিল, হঠাৎ বিজাতীয় জন্তু দেখে সেগুলি দুদ্দাড় পালিয়ে গেল।

উঠোনে আগাছার জঙ্গলের মধ্যে একটা পাতকুয়ো, সম্ভবত সেখান থেকেই জলের ব্যবস্থা। কিন্তু চেহারা দেখে মনে হলো, বহুকাল সেটার ব্যবহার হয়নি।

স্ত্রী-ছেলেমেয়ের মুখের অবস্থা দেখে বৈকুণ্ঠবাবু একবার বোকার মতো হাসলেন। তারপর নিজেই লেগে গেলেন সাফাইয়ের কাজে। যদিও তাঁর কোমরে ব্যথা, সর্বাঙ্গে বাত, তবু আপাতত গৃহযুদ্ধ এড়ানোর জন্যে ঘর ঝাড় দিতে দিতে একগাল হেসে বললেন, দেখছিস ক্ষেন্তি, বাড়ি তো নয়, রাজপ্রাসাদ! তাও আবার বিনি পয়সায়! ভাবা যায়!

তারপর পকেট থেকে একখানা ফর্দ বের করে ছেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যা তো বাবা, তোরা বরং মাকে নিয়ে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখ, নতুন জায়গায় এলি, ঘরে বসে থেকে কী করবি? শুধু ফেরার সময় পাঁড়েজির দোকান থেকে এই জিনিসপত্র নিয়ে আসিস। এখানে আমরা নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাব। শুনেছি এখানকার জল এত ভালো যে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়! হোটেলে খেলে আর দেখতে হবে না, এই কদিনে কুবেরের ভাণ্ডারও নিঃশেষ হয়ে যাবে!

ওরা বেরিয়ে যেতেই বৈকুণ্ঠবাবু নেমে পড়লেন ঘর-সাফাইয়ে। সারাদিন বাক্স-প্যাটরা টানাটানির ফলে কোমরের ব্যথাটা ভালোই চাগাড় দিয়েছে। তবু মরিয়া হয়ে ভাবলেন, যে করেই হোক স্ত্রী ফেরার আগে ঘরের কাজটা সেরে ফেলতে হবে। না হলে তিনি নিজেই হয়তো খুঁজে-পেতে সাফাইয়ের জন্যে লোক ধরে আনবেন। খামোকা খানিকটা বাজে খরচ! যাদের আয় করতে হয় না, তারা খরচের কষ্ট বুঝবে কেমন করে?

একটা টিমটিমে বাল্বের আলোয় কাজ করতে করতে বৈকুণ্ঠবাবু এসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন। এমন সময় আচমকা লোডশেডিং হয়ে গেল। গিন্নির পরামর্শে কয়েকটা মোমবাতি সঙ্গে এনেছেন বটে, কিন্তু শুরুতেই বেমক্কা তার একটা জ্বেলে নষ্ট করা উচিত হবে কি না বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল, নমস্তে বাবুজি!

চমকে উঠলেন বৈকুণ্ঠবাবু। দেখলেন, তাঁর সামনে রোগা চিমসেমতো একটা লোক এক হাতে একটা ঝাড়ু এবং আরেক হাতে একটা জলের বালতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না, তবে অন্ধকারে বিড়ালের চোখের মতো তার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। মাথায় দেহাতিদের মতো গামছার ফেট্টি বাঁধা। বৈকুণ্ঠবাবু অন্ধকারের মধ্যে এমন অদ্ভুতদর্শন মূর্তি দেখে একটু ঘাবড়ে গেলেন। 

তাঁর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটা কান-এঁটো-করা একগাল হাসল। বলল, মা’জি এলো, খোকা-খোকিভি এলো, ঘর সাফা না হলে আপনাদের তখলিফ হোবে, তাই মালিক হামাকে ভেজে দিলেন।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন বৈকুণ্ঠবাবু। মালিক তো এখানে থাকেন না। এখানকার লোকজন হয়তো পাঁড়েজিকেই মালিক বলে জানে। ঘর সাফাইয়ের জন্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি লোক পাঠিয়েছেন, এতে খুশি হওয়ারই কথা। বৈকুণ্ঠবাবুও হতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ মনের মধ্যে বাড়তি খরচের চিন্তাটা উদয় হওয়ায় খুশির ভাবটা মিলিয়ে গেল। ভাবলেন, এ-ব্যাটা আবার কত গলা কাটবে কে জানে!

লোকটা অমায়িক হেসে বলল, আপনাকে কুছু দিতে হোবে না বাবুজি। হামি এই বাড়ির কেয়ারটেকার হচ্ছি, আপনি থোড়া আরাম করে লিন, হামি সব বন্দোবস্ত করিয়ে দিচ্ছি!

এবার তিনি সত্যি সত্যি খুশি হয়ে উঠলেন। ‘ফাউ’ পাওয়ার মতো এত নির্মল আনন্দ জীবনে আর কী-ই বা আছে! তিনি মনে মনে কৃপাসিন্ধুকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলেন না।

অন্ধকারের মধ্যেই সেই চামচিকের মতো লোকটা দিব্যি সাফাইয়ে লেগে পড়ল। একবার আলো জ্বালানোর কথাটুকু পর্যন্ত তুলল না। আর কী মিষ্টি ব্যবহার! এত যে কাজ, তার জন্যে বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই!

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শোয়ার ঘর, রান্নাঘর, এমনকি কুয়োতলাটা পর্যন্ত ধুয়েমুছে একেবারে ঝকঝকে করে তুলল সে। মা’জির ‘সুবিস্তার’ জন্যে কুয়ো থেকে জল তুলতে তুলতে বলল, আজ খানা পাকাতে হোবে না বাবুজি। মিশিরজির দুকানে খুব ভালো পনিরকি সমোসা আর জিলাবি বানায়। মা’জি ঠিক লিয়ে আসবেন।

যাওয়ার সময় সে যখন নিচু হয়ে হাতজোড় করে আরেক প্রস্থ ‘নমস্তে’ করল, তখন বৈকুণ্ঠবাবুর নিজেকে রাজা-মহারাজা মনে হলো।

বহুদিন বাদে জ্যোৎস্নায় গা ডুবিয়ে কুয়োর ঠান্ডা জলে চান করতে করতে তিনি গুনগুন করে ছোটবেলায় শোনা কালোয়াতি ভাঁজতে লাগলেন।

লোকটা বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কারেন্ট এসে গেল। বৈকুণ্ঠবাবু ভাবলেন, সারাদিনের খরচটা এই বেলা লিখে ফেলা দরকার। দৈনিক খরচের হিসাব লিখে রাখা তাঁর বহুদিনের অভ্যেস।

সবে সে ফিরিস্তি নিয়ে বসতে যাবেন, এমন সময় কলকল করতে করতে ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হলো। স্ত্রীর হাতে একটা কাগজের ঠোঙায় সত্যি সত্যি খান-দুয়েক শিঙাড়া আর কয়েকটা জিলিপি।

তিনি হেসে বললেন, ঘরের যা অবস্থা দেখে গেলাম, জানতাম, এর মধ্যে রান্নাবান্না করা যাবে না! আমরা তাই দোকান থেকে খেয়ে এলাম। উহ্! কী ভালো পনিরের শিঙাড়া, তোমার জন্যেও এনেছি, খেয়ে দেখো। বাহ! ঘরদোর ঝকঝক করছে যে! কে করল, তুমি?

বৈকুণ্ঠবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, না, ভূতে করেছে!

স্ত্রীর হাত থেকে ঠোঙাটা নিতে নিতে ভাবলেন, ওদের একলা ঘুরতে যেতে বলাটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। বলা নেই কওয়া নেই, বেমক্কা একগাদা পয়সা খরচ করে এসে এখন আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে! নিকুচি করেছে পনিরের শিঙাড়ার!

কিন্তু মুখে দিয়ে দেখলেন, শিঙাড়া এবং জিলিপি, দুটোই খাঁটি ঘিয়ে ভাজা, অতীব সুস্বাদু! মন থেকে তবু বাজে খরচের খচখচানিটুকু গেল না।

পরদিন সকালে বাজারে গিয়ে কিন্তু বৈকুণ্ঠবাবুর মন ভালো হয়ে গেল। টাটকা শাকসবজি, খাবি-খাওয়া মাছ, পুরুষ্টু মুরগি, সব এক্কেবারে জলের দর। দেখেশুনে তাঁর মতো মিতব্যয়ী মানুষও কেনাকাটার লোভ সামলাতে পারলেন না।

এরপর কাটাকাটি, ধোয়াধুয়ি আর রান্নাবান্না করতেই একটা বেলা কেটে গেল।

বিকেলে ছেলেমেয়ে বায়না ধরল, লাট্টু পাহাড় দেখতে যাবে। লীলা মজুমদার তাঁর কোন বইতে নাকি এই পাহাড়ের খুব সুখ্যাতি করেছেন, ইচ্ছে করলেই যে কেউ নাকি সে পাহাড়ের মাথায় চড়তে পারে! অতএব – সারাদিনের খাটাখাটুনির ফলে বৈকুণ্ঠবাবুর কোমরের ব্যথাটা ভালোরকম বেড়েছে। কিন্তু বেড়াতে এসে কেউই ঘরে বসে থাকতে রাজি নয়। অগত্যা বাধ্য হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে খোঁজখবর করা শুরু করলেন। তারপর যখন জানলেন, লাট্টু পাহাড়ে যেতে গাড়িঘোড়া লাগবে না, খরচের চক্কর নেই, পায়ে হেঁটেই তেনার মাথায় পৌঁছানো যায়, তখন সমস্ত ব্যথাবেদনা উপেক্ষা করে সপরিবার বেরিয়ে পড়লেন।

ঘন্টু মহানন্দে লাফাতে লাফাতে বলল, এক্সপিডিশন লাট্টু পাহাড়!

বনের ভেতর দিয়ে লাল মোরাম-বিছানো পথ, ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি। তবে অদ্ভুতরকম নির্জন। আশপাশে দু-একটা বাড়িঘর চোখে পড়ছে বটে, কিন্তু সেগুলিতেও লোকজন বিশেষ আছে বলে মনে হচ্ছে না। শব্দ বলতে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দু-একটা দলছুট পাখির কলধ্বনি। একটু আগে পাচন হাতে একজন দেহাতি লোক একপাল গরু নিয়ে নেমে গেল। গরুগুলির গলায় বাঁধা ঘণ্টার আওয়াজ ক্ষীণ হতে হতে একসময়ে মিলিয়ে গেল। তারপর চারদিক একদম সুনসান। পথের দুপাশে বৃষ্টিধোয়া সবুজ গাছপালার ওপর পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। বৈকুণ্ঠবাবুর স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে তো একেবারে উচ্ছ্বসিত।

শুধু বৈকুণ্ঠবাবু ব্যাজার মুখে হাঁটতে লাগলেন। এমনিতেই এভাবে পয়সা খরচ করে বেড়াতে আসাটা নিতান্তই দায়ে পড়ে, তার ওপরে কোমরের ব্যথা এবং চড়াই পথ। ফলে কথা বললেই তিরিক্ষি হয়ে উঠছেন। বনজঙ্গল? দেখার কী আছে? পাহাড়? দেখার কী আছে? শরতের নীল আকাশে পেঁজা তুলোর চলমান হাতির দল তো বাড়ি বসেই দেখা যায়! তার জন্যে পয়সা খরচ করে কেউ শিমুলতলায় আসে?

হঠাৎ পথের দুপাশে অজস্র আতাগাছ দেখে খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। হ্যাঁ, এতক্ষণে কিছু দেখার মতো গাছ পেলেন বটে! প্রতিটি গাছ যেন ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। আতা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ফল। কিন্তু খরচের ভয়ে বড় একটা কিনে খাওয়া হয় না। ভাবলেন, না-ই বা হলো খাওয়া, দেখার সুখই বা কম কিসে?

বিকেলের আলো দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। জনমানবশূন্য রাস্তায় আরো কিছুটা যাওয়ার পর হঠাৎ কেমন যেন গা-ছমছম করতে লাগল বৈকুণ্ঠবাবুর। পথের দুপাশে জঙ্গল ক্রমশ ঘন হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু বাড়িঘর নজরে আসছে বটে, কিন্তু সেখানে কেউ বসবাস করে বলে মনে হচ্ছে না। বেশিরভাগই হতশ্রী এবং ভগ্নপ্রায়। দরজা-জানালাগুলি সব কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে। হানাবাড়ির মতো খাঁখাঁ করছে সেগুলো।

উল্টোদিক থেকে একটা লোক সাইকেলে আসছিলেন। এই অবেলায় ওঁরা লাট্টু পাহাড়ে যাচ্ছেন শুনে উনি খুব অবাক হলেন। বললেন, একটু বাদেই সন্ধে হবে, এ সময়ে কেউ ওদিকে যায় নাকি? চোর আছে, ডাকু আছে, আতঙ্কবাদী ভি আছে। অউর -ভদ্রলোক কথাটা অসমাপ্ত রেখে চুপ করে গেলেন। তারপর সন্দিগ্ধ চোখে চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে সাইকেলে উঠে হুস করে বেরিয়ে গেলেন।

এবার বৈকুণ্ঠবাবু সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। ছেলেমেয়েকে অনেক বুঝিয়েসুজিয়ে এক্সপিডিশন স্থগিত রেখে ফেরার পথ ধরলেন। বলা তো যায় না, ভিনদেশে আনপথে কোথায় কী বিপদ লুকিয়ে আছে!

ফেরার পথে টের পেলেন, সবচেয়ে বড় বিপদ আসলে তাঁর হাঁটুতে। ঢালু পথে নামার সময় সে-দুটোতে এমন খচখচানি শুরু হলো যে বাধ্য হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন।

সামনেই এলোমেলো আতাগাছের ঝোপ, কিছু কিছু ফলে পাক ধরেছে। দু-একটা তো ফেটে চৌচির হয়ে ডালে ঝুলছে,
যে-কোনো সময়ে টুপ করে খসে পড়বে। বৈকুণ্ঠবাবুর জিভে জল এসে গেল।   

চারদিকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। না, কোথাও জনমনিষ্যির চিহ্নমাত্র নেই। ছেলেমেয়েরা নিজেদের খেয়ালে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। তিনি আর লোভ সংবরণ করতে পারলেন না।

গুটিগুটি এগিয়ে গিয়ে ডাল থেকে সবে একটা আতা ছিঁড়েছেন, হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, আতা লিবেন বাবু?

সামনে আচমকা বাজ পড়লেও বুঝি বৈকুণ্ঠবাবু এতটা চমকে উঠতেন না। ভয়ার্ত চোখে দেখলেন, জঙ্গলের আলো-আঁধারিতে গতকালের সেই কেয়ারটেকার লোকটা যেন গাছপালার সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে গেলেন তিনি। এতকাল ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে এসেছেন, না বলে অপরের জিনিস নেওয়াকে চুরি করা বলে, চুরি করা মহাপাপ। অথচ তিনি নিজেই কি না – লোকটা বলল, আপনি কী ভাবছেন, হামি জানে। জঙ্গলের ফল, পাখি খায়, জন্তু খায়, আপনি দুটা লিয়েছেন তো কী হলো? অউরভি লিন বাবুজি, একদম পাকা আতা আছে।

অপ্রস্তুত বৈকুণ্ঠবাবু দেখলেন, লোকটার হাতে সত্যিই কয়েকটা পাকা আতা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেগুলি নিয়ে একটা দশ টাকার নোট লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বুঝি এদিকেই থাকো?

লোকটা কিন্তু নোটটার দিকে ফিরেও চাইল না। বলল, হামার থাকার কি কোনো ঠিক আছে বাবুজি? কখনো এ-জঙ্গলে থাকি, কখনো টিশানের মকানে। যখন যেখানে কাম থাকে – একটু থামল সে। তারপর খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, ও রুপেয়া আপনি রেখে লিন বাবুজি। আপনাদের যেতে দেখলাম, তাই ভাবলাম, ফেরার সময় এই আতাগুলি দেব। খোকা-খোকি খাবে, আপনিভি খাবেন। হামি জানে, আতা আপনার বহোৎ পছন্দ আছে।

লোকটাকে যত দেখছেন, ততই বিস্মিত হচ্ছেন বৈকুণ্ঠবাবু। আজকের দিনে এমন নির্লোভ মানুষও আছে? কিন্তু উনি যে আতা ভালোবাসেন, সে-কথা ও জানল কী করে? সবে কথাটা ওকে জিজ্ঞেস করতে যাবেন, এমন সময় সে ফিসফিস করে বলল, আপকা টাঙ্গ অউর কোমরমে দর্দ আছে, বহোত পুরানা, বাবুজি? মালিশ করাবেন? হামার কাছে জড়িবুটির তেল আছে। মালিশ করালে কোমরের দর্দ অউর বাতের তখলিফ বিলকুল গায়েব হয়ে যাবে!

খুব অবাক হলেন বৈকুণ্ঠবাবু। তাঁর যে কোমরে ব্যথা আর সারা শরীরে বাত, সে-কথা এই লোকটা জানল কী করে! নির্ঘাত গতকাল স্ত্রী গিয়ে পাঁড়েজির কাছে গল্প করে এসেছে!

মনে মনে হাসলেন তিনি। এতক্ষণে লোকটার মতলব বোঝা গেল। কাল সাফাইয়ের জন্যে পয়সা নিতে পারেনি, এখন মাগনা আতা দিয়ে ভালোমানুষি দেখাল। এবার জড়িবুটি দিয়ে মালিশের নামে সেটা সুদে-আসলে উসুল করে নিতে চায়। মনে মনে বললেন, আমাকে ঠকিয়ে পয়সা বের করা তোর কম্মো! এই বৈকুণ্ঠ শর্মাকে চিনতে তোমার এখনো ঢের বাকি আছে!

লোকটা যেন এবার বৈকুণ্ঠবাবুর মনের কথাই বলে ফেলল, হামার কুনো মতলব না আছে বাবুজি! হামি জানে, আপনার তকলিফ হচ্ছে। র্সিফ আটদিন আপনাকে মালিশ করিয়ে দিব, যদি আপনার দর্দ আরাম না হয়, আপনাকে কুছু দিতে হোবে না। আগর আপকো আরাম মিলা, তো আপনি খুশ হয়ে যা দিবেন, আপকা মর্জি। হামি কুছু বলবে না।

বৈকুণ্ঠবাবুর এবার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। লোকটা কি থট রিডিং জানে? উনি যা ভাবছেন, সব ওই লোকটা টের পাচ্ছে কী করে!  ওকে একবার বাজিয়ে নেওয়ার জন্যে বললেন, তুমি আটদিন মালিশের কথা বলছো কেন? আমি এখানে যে আটদিন থাকব, সে-কথা তুমি জানলে কেমন করে?

লোকটা আগের মতোই হেসে বলল, ইয়ে ক্যা কই পুছনেকা বাত হ্যায়, বাবুজি? পাঁড়েজিকো যো চিট্ঠি আপনি দিখলালেন, উসিমে তো সব লিখা আছে!

বৈকুণ্ঠবাবু এতক্ষণে আশ্বস্ত হলেন। ভাবলেন, এত করে যখন বলছে, একবার দেখাই যাক জড়িবুটির খেল। না সারলে তো আর পয়সা দিতে হচ্ছে না! কিন্তু মুশকিল হলো, ও-বাড়িতে একটামাত্র ঘরই তো বাসযোগ্য, তাহলে মালিশটা করাবেন কোথায়?

লোকটা নিজের থেকেই সমস্যার সমাধান করে দিলো। বলল, অসুবিস্তা হোবে না বাবুজি। ইতনা বড়া ছাদ হ্যায় – বৈকুণ্ঠবাবু ভাবলেন, ঠিকই তো বলেছে সে। ছাদের কথাটা মনে ছিল না তাঁর। বললেন, এসো তাহলে তোমার জড়িবুটি নিয়ে। তবে মনে রেখো, ব্যথা না সারলে কিন্তু পয়সা পাবে না। 

লোকটা বলল, আপনি কুছু চিন্তা করবেন না বাবুজি। ঘরে গিয়ে আরাম করুন, ছাদে গিয়ে হাওয়া খান। খোকা-খোকি যখন ঘরে বসে টিভি দেখবে, তখন –

– টিভি? টিভি আসবে কোত্থেকে?

– পাঁড়েজি ইন্তেজাম করে দিয়েছেন। বাচ্চালোগ হ্যায় না ঘরমে?

ঘরে ফিরে বৈকুণ্ঠবাবু দেখলেন, পাঁড়েজি সত্যি সত্যি একটা পোর্টেবল টিভি পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঘন্টু আর ক্ষেন্তি টিভির সামনে বসে একমনে কার্টুন দেখছে। গিন্নি রান্নাবান্নায় ব্যস্ত।

হাতমুখ ধুয়ে আয়েশ করে চা খেলেন। তারপর শতরঞ্চিখানা নিয়ে উঠোন পেরিয়ে সোজা ছাদে উঠে গেলেন বৈকুণ্ঠবাবু। একটু বসতেই ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। দেখলেন, ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় চরাচর যেন ভেসে যাচ্ছে। বহুকাল এমন জ্যোৎস্না দেখা হয়নি!

হঠাৎ কে যেন ডাকল, বাবুজি।

পেছন ফিরে দেখলেন, সেই লোকটা, হাতে একটা মলিন চটের থলি। জ্যোৎস্নায় মগ্ন ছিলেন বলেই হয়তো ওর আসাটা টের পাননি। সে একগাল হেসে বলল, আচ্ছা লাগছে, না বাবুজি? বাঙ্গালি বাবুদের এ জাগাহ বহোত পছন্দ। আগে তো এ পুরা মহল্লা বাঙ্গালি বাবুদের ছিল! হামলোগভি বাংলা শিখলাম।

লোকটা কথা বলতে বলতে থলি থেকে কী সব জড়িবুটি বের করে মালিশ শুরু করে দিলো। বাতাসে ক্রমশ কেমন একটা ঝিমধরা গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। লোকটার কাঠি কাঠি হাতে যেন জাদু আছে। বৈকুণ্ঠবাবুর শরীরের ওপর দিয়ে এমন নিপুণ দক্ষতায় আঙুল চলতে লাগল যে, তিনি আরামে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তারপর কখন যেন ঘুমিয়েও পড়লেন।

একসময়ে স্ত্রীর ডাকে ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখলেন, মালিশওয়ালা চলে গেছে।

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় বৈকুণ্ঠবাবু লক্ষ করলেন, একদিনেই শরীরটা যেন অনেকটা হালকা বোধ হচ্ছে।

এরপর প্রতি রাতেই লোকটা নিয়ম করে আসতে লাগল। মালিশের কারণেই হোক কিংবা জড়িবুটির গুণেই হোক, মালিশ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন বৈকুণ্ঠবাবু। লোকটাও তাঁকে না জাগিয়ে চুপি চুপি চলে যায়। দিন পাঁচেকের মধ্যেই টের পেলেন, কোমরের ব্যথা কিংবা শরীরের যত্রতত্র বাতের ব্যথা যেন বেশ কমে এসেছে।

ফেরার দিন দুয়েক আগে বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে শুনলেন, এখান থেকে ছ-সাত কিলোমিটার দূরে নাকি একটা সুন্দর ঝরনা আছে। একদম বনের মধ্যে, অটো করে দিব্যি ঘুরে আসা যায়। কয়েকদিন আগে কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে আসা একটা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।

ঝরনার খবরটা তাঁরাই দিলেন।

শোনামাত্র স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নেচে উঠল। এখানে বসে বসে বিরক্ত হওয়ার চাইতে ঝরনা দেখতে যাওয়াই শ্রেয়। দুটো পরিবার একসঙ্গে গেলে খরচও কম পড়বে। অগত্যা রাজি না হয়ে উপায় কী! বিশেষ করে বেড়াতেই যখন এসেছেন!

সন্ধেবেলা মালিশওয়ালা এসে চুপিচুপি বলল, ঝরনা দেখতে মত যাইয়ে বাবুজি! ওখানে ডাকু আছে!

মনে মনে লোকটার ওপর চটে গেলেন বৈকুণ্ঠবাবু। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে, লোকগুলিকেও কথা দিয়ে ফেলেছেন, এখন না গেলে ওরা কী ভাববে!

– আপনি বলে দেবেন, তবিয়ত ঠিক নেই। ব্যস!

– আমরা যে কাল ঝরনা দেখতে যাচ্ছি, একথা তুমি জানলে কী করে?

– আপনারা ফাগুলালের সঙ্গে অটোকো বারেমে কথা করলেন না? ফাগুলাল হামার ভাতিজা আছে!

পরদিন কিন্তু বৈকুণ্ঠবাবুদের ঝরনা দেখতে যাওয়া হলো না। তবে সেটা সত্যিই তবিয়ত ঠিক না থাকার কারণে।

সকালে বৈকুণ্ঠবাবুর স্ত্রী টিফিন বানাচ্ছিলেন। তখনই সম্ভবত তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে খানিকটা গরম তেল তাঁর পায়ে পড়ে গিয়েই বিপত্তি।

তবে ভাগ্য ভালো, তেমন মারাত্মক কিছু ঘটেনি। শুধু ঝরনা দেখা মুলতুবি রেখে সাতসকালে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হলো।

বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে বৈকুণ্ঠবাবু দেখলেন, অটোস্ট্যান্ডে রীতিমতো জটলা। কাছে গিয়ে যা শুনলেন তাতে তাঁর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। যারা ঝরনা দেখতে গিয়েছিল, ডাকাতরা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। এমনকি অটোওয়ালাকে পর্যন্ত রেহাই দেয়নি। একজনের তো হাতই ভেঙে গেছে।

সন্ধেবেলা তিনি মালিশওয়ালাকে বললেন, তোমার কাছে আমার অনেক ঋণ হয়ে গেল হে! একে তো আমার কোমরের ব্যথা আর বাত এখন নেই বললেই চলে, উপরন্তু, আজ একটা বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। তুমি না বললে – মালিশওয়ালা হেসে বলল, আপ ক্যায়া বলছেন বাবুজি? হামার বাত আপনি থোড়ি মানলেন! আগর গরম তেল মা’জির গায়ে না গিরা হোতা তো –

– মা’জির গায়ে তেল পড়েছে, এ-কথা তুমি জানলে কী করে?

– কী বলছেন বাবুজি! আপনি মা’জিকে ডগদরবাবুর কাছে নিয়ে গেলেন না? পাঁড়েজিভি আপকা সাথ গেল!

বৈকুণ্ঠবাবু দেখলেন কথাটা সত্যি বটে।

– বেশ তা না হয় হলো। কিন্তু আমার এতদিনের পুরনো কোমরের ব্যথা আর বাত যে তুমি সারিয়ে দিলে, এটা তো আর মিথ্যে নয়! আজ মালিশ শুরুর আগেই তোমার টাকাটা নিয়ে রাখো। না হলে আমি ঘুমিয়ে পড়ব, তুমি টাকা পাবে না।

টাকার কথা শুনে লোকটা দু-কদম পিছিয়ে গেল। বলল, ওটা আপনি রেখে লিন বাবুজি, কাল দিবেন। ইয়ে জড়িবুটিতে নোট গিলা হয়ে যাবে।

– কিন্তু কাল তোমার সঙ্গে যদি দেখা না হয়?

– পাঁড়েজির দুকানে হামার নামে শ’ রুপেয়া দিয়ে দিবেন, ব্যস! মামলা খতম!

এতদিন মালিশের জন্যে মাত্র একশ টাকা শুনে বৈকুণ্ঠবাবু মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলেন না। বললেন – মাত্র একশ টাকা? আমি তো আরো বেশি দেব ভাবছি।

– ছোড়িয়ে বাবুজি, শ’ রূপেয়ামে হামার কাম হয়ে যাবে।

– কিন্তু তোমার নামই তো জানা হয়নি।

– মেরা নাম থা রূপলাল আহির!

– থা কেন?

– দেখছেন না বাবুজি? এখন ইয়ে বদসুরতকো কই রূপলাল থোড়ি বোলেগা!

বৈকুণ্ঠবাবু দেখলেন, আলো-আঁধারিতে রূপলালের মুখে দুষ্টুমির হাসি।

পরদিন দুপুরে ফেরার ট্রেন। বৈকুণ্ঠবাবু সারাটা সকাল রূপলালের জন্যে অপেক্ষা করে রইলেন। অথচ সে এলো না। অগত্যা নিজেই গেলেন পাঁড়েজিকে ওর টাকাটা দিতে।

রূপলালের কথা শুনে পাঁড়েজি তো আকাশ থেকে পড়লেন। কৌন রূপলাল?

বৈকুণ্ঠবাবু বললেন, রূপলাল আহির, যে জড়িবুটির তেল দিয়ে মালিশ করে বাত সারায়। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার! আরে, প্রথমদিন আপনিই তো তাকে ঘর পরিষ্কার করতে পাঠিয়েছিলেন।

এবার পাঁড়েজি খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, আপনার মাথার ঠিক আছে তো বাবুজি? এক তো আমি কাউকে আপনাদের ঘর সাফাই করার জন্যে পাঠাইনি। অউর আপনি যার কথা বলছেন, সে তো এক সাল হলো ডাকুদের হাতে খুন হয়ে গেছে। হা, ইয়ে বাত সচ হ্যায় কি রূপলাল ইস মকানকা কেয়ারটেকার থা।

বৈকুণ্ঠবাবু কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কিন্তু ওর টাকাটা?

পাঁড়েজি গম্ভীর মুখে বললেন, হাঁ, আমার কাছে ওর একশ টাকা ধার ছিল, ঠিক কথা। কিন্তু সে-টাকা তো আপনার কাছ থেকে নিতে পারব না। আপনার ট্রেনের টাইম হোয়ে গেল। ফির আসবেন। নমস্তে বাবুজি!

পাঁড়েজির নমস্কার করার ভঙ্গিটা কি হুবহু রূপলালের মতো? নাকি মনের ভুল? দিনদুপুরে ধন্দে পড়ে গেলেন বৈকুণ্ঠবাবু।