একটি ‘বাতিল’ চিত্রনাট্য, এক ঐতিহাসিক দলিল

১৯৩০ সালের ২৪শে জুলাই। জার্মানির বাভারিয়া প্রদেশের রাজধানী মিউনিখ শহরের হোটেলের ঘরে লিখতে বসলেন রবীন্দ্রনাথ। আগের দিনই মিউনিখ থেকে সোয়া বাহান্ন মাইল দূরে জার্মানি আর অস্ট্রিয়ার সীমান্তবর্তী ছোট জনপদ ওবেরআমমারগাউ-তে গিয়েছিলেন কবি। উদ্দেশ্য, যিশুখ্রিষ্টের জীবনান্তকালীন ঘটনাবলি অবলম্বনে নির্মিত খ্রিষ্টীয় ভক্তিনাট্যের অভিনয় দেখা। খ্রিষ্টানরা এ-ধরনের ভক্তিনাট্য বা সেটির অভিনয়কে বলেন ‘প্যাশন প্লে’। ওবেরআমমারগাউ-তে এই অভিনয়ের আসর বসে প্রতি দশ বছরে একবার। ছ-ঘণ্টার এই নাটকের মরসুম চলে পাঁচ মাস – মে থেকে অক্টোবর। ১৯৩০ সালের অভিনয়ের মরশুমে হিমাংশু রায়কে সঙ্গে নিয়ে কবি অভিনয় দেখেছিলেন ২৩শে জুলাই। জার্মানির চলচ্চিত্র প্রযোজক সংস্থা UFA-র সহযোগিতায় যিশুর জীবনী নিয়ে একটি ছবি তৈরির চেষ্টা করছিলেন হিমাংশু রায়, যিনি তখন বৈবাহিক সূত্রে কবির আত্মীয়ও বটে। সেই কারণেই তাঁর রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হওয়া। চিত্রনাট্যকার হিসেবে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের নাম ব্যবহারের সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়েছিল UFA। তাদেরই ব্যবস্থাপনায় কবিকে ওবেরআমমারগাউ নিয়ে গিয়েছিলেন হিমাংশু। আর ‘প্যাশন প্লে’ দেখে এসেই একটি অভিনব রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কবি। কবির ভ্রমণসঙ্গী তথা সচিব অমিয় চক্রবর্তী ২৬শে জুলাইয়ের একটি চিঠিতে নিজের মামা, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক, সোমনাথ মৈত্রকে জানালেন, রবীন্দ্রনাথ সারাদিন ধরে ইংরেজিতে ‘নতুন রকম টেকনিকে ফিল্মের জন্যে নাটক’ লিখছেন। অবশ্য এ-ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের নিজেরও কিছু তাগিদ ছিল। অর্থাভাবে জর্জরিত বিশ্বভারতীর সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কবি তখন অর্থাগমের ন্যূনতম সম্ভাবনাতেই উৎসাহিত হচ্ছেন। বস্তুত অশক্ত শরীরে তাঁর এবারকার বিদেশভ্রমণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অর্থসংগ্রহ। রবীন্দ্রনাথের এই ব্যতিক্রমী উদ্‌যোগ কোনো সদর্থক পরিণতি পায়নি। কোনো ছবিই তৈরি হয়নি এই রচনা অবলম্বনে। মূল্যস্বরূপ কোনো  পারিশ্রমিকও আসেনি রবীন্দ্রনাথ বা বিশ্বভারতীর তহবিলে।

প্রায় নয় মাস পরে দ্য চাইল্ড নামে একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশ পেল কবির মূল রচনার এক সংশোধিত এবং পরিমার্জিত কাব্যরূপ – যেটি চূড়ান্ত হয়েছিল ১৯৩১ সালের ২০শে এপ্রিল। অবশ্য সে-সময় লন্ডনের যে-প্রকাশনা সংস্থা কবির রচনার ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করছিল নিয়মিত, সেই ম্যাকমিলান তাঁর এই ইংরেজি রচনাটি প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। হতেই পারে, এটির সাহিত্যমূল্য বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন ম্যাকমিলানের কর্তাব্যক্তিরা। হতেও পারে, তাঁদের আশঙ্কা ছিল, আয়তনের কারণে এই রচনার বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সামান্য। দশ সর্গে বিন্যস্ত হলেও এই কাব্য ছাপার অক্ষরে যেতে পারে বড়জোর বিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত, তার বেশি নয়। এরপর জুতসই একটি ভূমিকা জুড়লেও পৃষ্ঠাসংখ্যা খুব বাড়বে না। ম্যাকমিলানের কর্ণধারেরা এও লক্ষ করছিলেন, মাত্র এক দশক আগেও যে-কবিকে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীর দল প্রায় একজন পূর্বদেশীয় জ্ঞানী বা magi-এর আসনে বসিয়েছিলেন, নানা কারণে তখন তাঁর সম্পর্কে তাঁদের ‘মোহভঙ্গ’ হচ্ছে। সেসবের প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে খুব স্পষ্টভাবে। ফলে, পাঠকমহলে এই বইয়ের কাট‌তি হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় ছিল তাঁদের। অনেক চেষ্টার পরে লন্ডনেরই অন্য একটি প্রকাশনা সংস্থা জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড একটি পুস্তিকার আকারে অল্প কিছু কপি ছেপে তার বিক্রি বাবদ লেখকের প্রাপ্য রয়্যালটি তুলে দেয় রবীন্দ্রনাথের হাতে। তবে পরবর্তীকালে এই রচনার দ্বিতীয় কোনো সংস্করণ বেরোয়নি।

এত ঘটনার ঘনঘটায় রবীন্দ্রনাথের মূল রচনাটি চলে গেছে চোখের আড়ালে। কিন্তু সেটির ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব যে নেহাত কম নয়, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করবো এই প্রবন্ধে।

দুই

মনে রাখা দরকার, মিউনিখের লেখাটি ছিল নিছক খসড়া। ঘষামাজা করে কবি তাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছিলেন হাইডেলবার্গ শহর থেকে ৪২ মাইল দূরে ওডেনহ্বাল্ডেন নামের এক পাহাড়ি অঞ্চলে ওডেনহ্বাল্ড স্কুলে (Odenwaldenschule, Post Heppenheim, BERGSTR) তিন দিনের নিভৃতবাসের সময়ে। এখানে পল আর এডিথ গেহিব নামে এক দম্পতি প্রকৃতির কোলে কিশোরমনের বিকাশের এক আয়োজনে মেতে ছিলেন ১৯১০ সাল থেকে, যার মূলমন্ত্র ‘তুমি যা তেমনই হয়ে ওঠো’ (Be What You Are)। শান্তিনিকেতন আশ্রম-বিদ্যালয় আর বিশ্বভারতীর মতোই এখানে চলত মনের মুক্তির প্রয়াস। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র অরবিন্দ বসুর মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের খবর পৌঁছেছিল কবির কাছে। তাঁদেরই দেওয়া প্যাডে কবি নিজের খসড়াটিকে পরিপূর্ণ রূপ দিলেন ইংরেজি গদ্যে। কবির স্বকৃত পরিমার্জনাসহ তার প্রথম পাতাটির পাঠ এইরকম –

They ask, What is the time?

No answer comes.

The night is deep in the valley, the sky overcome by clouds. The things around are incoherent, they are a noise, the refuse of time’s rejections, fruitless failures and reckless attempts rusting and crumbling, the bridge that is broken, the canal dry and gaping, huts deserted, scattered bricks and rafters, the ruined temple haunted by bats, trees uprooted and rotting, marble steps leading to blankness. Masses of shadows, darker than night, do they belong to some giant life choked by a nightmare of death? The lurid red glow that waxes and wanes on the rim of horizon, is it a threat from a neighbouring planet or an elemental hunger licking the sky?

Sounds suddenly coming out from their ambuscades seem to fight in the sky, and the shudder of an indefinite fear runs along the sleepless hours. The noises are difficult to recognise, are they floods breaking their dams, storm winds howling and whirling like  some suicidal frenzy of piety, a forest fire hissing and crackling and panting hot breaths, or the piteous screams of a dumb multitude attacked by the blind and the deaf?

The men gathered there are vague, like torn pages of an epic. While groping in groups or single their torchlight absurdly tatoos their faces, producing pictures of frightfulness. A continual hum creeps up and spreads underneath the noises like a bubling hot volcanic mud, a mixture of sinister whisper, rumours and slanders, laughters of derision and ugly growls.

The women weep and wail, they cry that their children are lost. While others are defiantly ribald, with raucous laughter and bare limbs unshrinkingly loud, for they think that nothing matters.

এইভাবে প্যাডের পাতার পর পাতা জুড়ে কবির কলমের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে চিত্রময়, শব্দময় আংশিক বাক্য আর পূর্ণ বাক্যমালার এক অনর্গল স্রোত, তৈরি হয়েছে আবিল সময়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির খোঁজে বিপন্ন মানবতার এক আত্মিক অভিযাত্রার আখ্যান।

কবির হস্তাক্ষরে মূল ইংরেজি রচনার এই একটি পাতাই রক্ষা পেয়েছে। সেটি রাখা আছে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনের একটি পাণ্ডুলিপি ফাইলে (EMSF_002), যেটির শিরোনাম ঞযব ঈযরষফ। তবে হাতে লেখা এই রচনার কোনো শিরোনাম নেই। এই পাতারই একটি টাইপধৃত পাঠ আছে ওই ফাইলে, কবির আলঙ্কারিক কাটাকুটিসহ (doodles)। এটিও শিরোনামহীন। আছে পুরো রচনার ১১-পৃষ্ঠাব্যাপী দুটি টাইপধৃত পাঠ, গদ্যে, ‘দ্য নিউকামার’ শিরোনামে। ফাইলে আছে আরো দুটি দলিল, ‘হি ইজ ইটার্নাল, হি ইজ নিউলি বর্ন’ শিরোনামে একটি গদ্য, যাকে বলা যায় ‘দ্য নিউকামার’-এর পাঠভেদ – প্রথম পাতার ওপরে বাঁদিকে পেন্সিলে লেখা (The Babe) x The Child; এছাড়া ‘দ্য বেব’ শিরোনামে আর-একটি পাঠ, এটি অবশ্য কাব্যে, প্রথম পাতার ওপরে বাঁদিকে লেখা Final version (একটু অস্পষ্ট), তার নিচে তারিখ ২০.৪.৩১, আর পাতার ডানদিকে ওপরে পেনসিলে লেখা রবীন্দ্রনাথের নাম। Final version মানে প্রকাশক অ্যালেন অ্যান্ড আনউইনকে দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত পাঠ। তখনো শিরোনাম আছে ‘দ্য বেব’, অর্থাৎ ‘দ্য চাইল্ড’ শিরোনামটি কবি ঠিক করেছেন ছাপার সময়।
‘দ্য চাইল্ড’-সংক্রান্ত আরো একটি পাণ্ডুলিপি ফাইল আছে রবীন্দ্রভবনে – RBVBMS_223। এতে পরপর সাজানো আছে হাতে লেখা কাব্য ‘দ্য বেব’ শিরোনামে, ‘দ্য নিউকামার’-এর টাইপধৃত পাঠ, গদ্যে, অবশ্য শিরোনামটি এখানে হাতে লেখা, আর ‘দ্য বেব’-এর টাইপধৃত পাঠ, কাব্যে, প্রথম পাতার ওপরে বাঁদিকে লেখা Final Copy, 20.4.31। কিন্তু এখানে কবির নাম বা সই নেই, আর এই পাঠটি প্রকাশিত কবিতার পাঠের থেকে কিছুটা আলাদা! প্রকাশিত কবিতার পাঠের সঙ্গে মিল আছে EMSF_002 ফাইলে রাখা নথিটির, যেটিতে কবির নাম লেখা আছে। এই এত নথি তৈরি হয়েছে ১৯৩০ সালের ২৪শে জুলাই থেকে ১৯৩১ সালের ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত।

আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের এই রচনা অবলম্বনে কোনো ছবি শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভাইমার সংবিধানের যুগটি (১৯১৯-৩৩) যত না ছিল গণতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধ্যায়, তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার। এর প্রমাণ ১৪ বছরে নয়টি নির্বাচন পেরিয়ে ২৬টি সরকারের ক্ষমতায় আসা। অথচ শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উনিনশো বিশের দশকটি বেশ সমৃদ্ধ। ‘নিউ অবজেক্টিভিটি’ নামে আধুনিকতাপন্থী এক শিল্পদর্শনে তখন মজে আছেন জার্মানির বহু শিল্পী। কিন্তু এই দশকের শেষে জার্মানির অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চরমে ওঠে। ১৯৩০ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে আক্ষরিক অর্থেই চলছে এক মাৎস্যন্যায়। অবস্থার সুযোগ নিয়ে তখন ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে নাৎসিরা। তারই প্রস্তুতি হিসেবে তারা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি দখল করছে। বাইরে থেকে UFA-কে যতই সমৃদ্ধ মনে হোক, প্রতিষ্ঠানটির অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। ১৯২৭ সালে UFA-র অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের রাশ নিজেদের হাতে নিয়ে আসতে নাৎসিদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এরপর আস্তে আস্তে প্রযোজনার ব্যাপারেও তাদের ছড়ি ঘোরানো শুরু হয়। ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে ছবি তৈরির ব্যাপারে UFA-এর সঙ্গে মোটামুটি একটা বোঝাপড়ায় এলেও হিমাংশু এ-কথা বুঝতে পারছিলেন যে, ঘটনাপ্রবাহ আর বেশিদিন তাঁর পক্ষে অনুকূল না-ও থাকতে পারে। কবিকে নিজের এই ধারণার কথা জানিয়েছিলেন উনি। ততদিনে হিমাংশু কবির সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রেও বাঁধা পড়েছেন। স্নেহভাজন মানুষটির মনের কথা বুঝে তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘প্যাশন প্লে’ দেখে এসেই পরের সারাটা দিন ধরে ‘ফিল্মের জন্যে নতুন টেকনিকে নাটক’ লেখার মূল রহস্য এটাই। কিন্তু এতকিছু করেও শেষরক্ষা হলো না। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নাৎসিরা সরকারে আসতে না পারলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা আরো সংহত হলো। এরই সুযোগ নিয়ে UFA-র সাংগঠনিক কাঠামোকে ঢেলে সাজালো তারা। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন বিশেষ করে সেইসব মানুষ, যাঁরা ইহুদি। উনিশশো বিশের দশকে প্রায় পুরোটা সময় টঋঅ-য় যিনি ছিলেন প্রযোজনা-অধ্যক্ষ, সেই এরিক পোমারকে প্রথমেই ঠুঁটো জগন্নাথ করে দিলো নাৎসিরা। ড. নিকোলাস কাউফমান অবশ্য চাকরি এবং প্রাণ বাঁচাতে টিকে গেলেন নাৎসিদের সঙ্গে আপস করে। হিমাংশু রায়ের সঙ্গে এঁদেরই ছিল বেশি সখ্য। মুরুব্বিদের এই হাল হওয়ায় তাঁর পরিকল্পনাটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের চিত্রনাট্য অবলম্বনে কোনো ছবি তৈরি না-হওয়ার সেসবই প্রকৃত কারণ। কিন্তু যিশুজীবনী নিয়ে যেরকম ছবি হিমাংশু রায় তৈরি করতে চেয়েছিলেন, এই রবীন্দ্র-চিত্রনাট্য অবলম্বনে সেরকম কোনো ছবি তৈরি করাও ছিল দুঃসাধ্য। আমাদের এই আলোচনা তা-ই নিয়ে। তবে সেই আলোচনায় পৌঁছতে হলে শনাক্ত করতে হবে রবীন্দ্রনাথের করা মূল চিত্রনাট্যটিকে।

তিন

মূল রচনাটিকে অমিয় চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘নতুন রকম টেকনিকে ফিল্মের জন্যে নাটক।’ সেই সময়ে কবির সঙ্গেই ছিলেন উনি, ফলে তাঁর কথায় গুরুত্ব দিতে হবে। আবার, লন্ডন-প্রবাসী শিল্প-সংস্কৃতিবেত্তা প্রয়াত নিমাই চট্টোপাধ্যায় কবির মূল রচনাটিকে একটি দীর্ঘ কবিতা হিসেবে উল্লেখ করে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘টঋঅ কোম্পানির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা হয়েছিল কবিতাটিতে বর্ণিত বিভিন্ন নাট্যদৃশ্য এবং ইতস্তত ছড়ানো যৎসামান্য সংলাপের ভিত্তিতেই ফিল্‌মটি তৈরি হবে; …।’ কীসের ভিত্তিতে ‘টঋঅ কোম্পানির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা’র উল্লেখ তা জানাননি নিমাইবাবু। এ-বিষয়ে কোনো চিঠির সন্ধান রবীন্দ্রভবনের লেখ্যাগারে নেই। তবে লন্ডনে বসে নিমাইবাবু যে নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে তাঁর প্রয়াণের পরে পাওয়া কাগজপত্র থেকে। কিন্তু এখানে আমাদের বক্তব্য, কবির হাতে লেখা অংশের সাক্ষ্য অনুযায়ী, মূল রচনাটি ছিল গদ্য – তাতে কাব্যময় ভাষার প্রাচুর্য থাকলেও তাকে ঠিক কবিতা বলা যায় না। পুরো রচনাটি একগুচ্ছ চিত্রময় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য (sensuous) অভিব্যক্তিতে ভরা, যেগুলিকে চোখের সামনে দেখা যায়, প্রায় ছোঁয়া যায়, এমনকি প্রায় শোনা যায় সেগুলিতে বর্ণিত শব্দও। অর্থাৎ অভিব্যক্তিগুলি ভীষণভাবে মূর্ত, কবিতার মতো ইঙ্গিতবাহী বা অনুভূতিনির্ভর নয়।

দুটি পাণ্ডুলিপি ফাইলে যে-কটি খসড়ার পূর্ণপাঠ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ‘দ্য নিউকামার’ আর ‘হি ইজ ইটার্নাল, হি ইজ নিউলি বর্ন’ লেখা হয়েছে গদ্যে। একমাত্র ‘দ্য বেব’ কবিতায় লেখা, প্রকাশের সময় যেটির শিরোনাম হয় ‘দ্য চাইল্ড’। নিমাই চট্টোপাধ্যায় অনুমান করেছেন কবির দেওয়া প্রথম নামটি ছিল ‘হি ইজ ইটার্নাল, হি ইজ নিউলি বর্ন’, তারপর ‘দ্য নিউকামার’, তারপর ‘দ্য বেব’ এবং সবশেষে ‘দ্য চাইল্ড’। খসড়ার পাঠগুলি খুঁটিয়ে পড়লে এই ক্রমটি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। ‘দ্য চাইল্ড’ নামের রচনার পাঠভেদ-সংক্রান্ত সবচেয়ে বেশি নথি আছে EMSF_002 ফাইলে, এত নথি অন্য ফাইলে, অর্থাৎ RBVBMS_223 ফাইলে, নেই। একমাত্র যে-নথিটি RBVBMS_223 ফাইলে আছে অথচ EMSF 002 ফাইলে নেই, সেটি কবির হাতে লেখা ‘দ্য বেব’-এর সম্পূর্ণ পাঠ। RBVBMS_223 ফাইলের বাকি দুটি নথি EMSF 002 ফাইলেও আছে। কিন্তু এই তথ্যের ভিত্তিতে কেউ যদি প্রামাণ্য  হিসেবে EMSF_002 ফাইলটিতেই মনোনিবেশ করতে চান, তাহলে তিনি একটি সমস্যায় পড়বেন।

কবির হাতে লেখা যে-পাতাটি পাওয়া গেছে EMSF 002 ফাইলে, তার পাঠের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল আছে ‘দ্য নিউকামার’-এর তুলনীয় অংশটুকুর টাইপধৃত পাঠের। কিন্তু টাইপধৃত এই পাঠও দুটি ফাইলে দুই রকম! আবার কোনোটিই কবির হাতে লেখা অংশের পাঠটির হুবহু প্রতিলিপি নয়।

কবির অলঙ্কৃত কাটাকুটি বা doodle-সহ যে-টাইপধৃত পাঠটি আছে EMSF_002 ফাইলে সেটিও আবার ওপরের তিনটি নথির পাঠ থেকে কিছুটা আলাদা। পাঠভেদের আধিক্যই প্রমাণ করে এটিই আদি রচনা।

‘হি ইজ ইটার্নাল, হি ইজ নিউলি বর্ন’-এর তুলনীয় অংশের পাঠ ‘দ্য নিউকামার’-এর তুলনীয় অংশের পাঠের থেকে অনেকটাই আলাদা। এটির বরং কিছুটা মিল আছে ‘দ্য বেব’ নামের কবিতার তুলনীয় অংশের সঙ্গে, যেটি ১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসেই লেখা হয়েছিল বলে অনুমান করা অসংগত হবে না। দুটিকে মিলিয়ে পড়লেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ফলে এ-কথা বলাই যায়, গদ্যে লেখা ‘হি ইজ ইটার্নাল, হি ইজ নিউলি বর্ন’-এর পাঠটি থেকেই ‘দ্য বেব’-এর কাব্যরূপের উদ্ভব। আর, ‘দ্য নিউকামার’-এর পাঠই প্যাশন প্লে দেখে এসে লেখা রচনার আদিরূপ থেকে জন্ম নেওয়া অমিয় চক্রবর্তী-কথিত ‘নতুন রকম টেকনিকে ফিল্মের জন্যে নাটক’-এর পাঠ।

এটিকে সরকারি বা অনুমোদিত রবীন্দ্র-রচনাভাণ্ডারের অংশ হিসেবে ধরা হয় না। এর প্রধান কারণ, এটি একটি ‘বাতিল’ রচনা। লেখাটি UFA-র হাতে আদৌ পৌঁছেছিল কি না তা-ই জানি না আমরা। তাছাড়া, লেখা শেষ করার এক বছরের মধ্যেই কবি এটির রূপান্তর প্রকাশ করে দেওয়ায় মূল রচনাটি মূল্যহীন হয়ে গেছে, তাকে গ্রাস করেছে বিস্মৃতি। কিন্তু
যে-পরিপ্রেক্ষিতে এটি লেখা হয়েছিল সেই ইতিহাসের বিচারে কবির এই মূল রচনাটিকে উপেক্ষা করা সমীচীন হবে না।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়সহ কেউ-কেউ যে বলেছেন, এই রচনাটি প্যাশন প্লে দেখার অনুপ্রেরণায় লেখা, এক অর্থে সে-কথা ঠিক। দুটি নাট্যেরই সংগঠনে আপাতদৃষ্টিতে সাদৃশ্য আছে। প্যাশন প্লে-র নাট্যটিতে তিনটি মূল বিভাগ স্পষ্টভাবেই চিহ্নিত। রবীন্দ্রনাথের রচনার পাণ্ডুলিপি খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যাবে, এতেও তিনটি বিভাগের ইঙ্গিত আছে। এই তিনটি বিভাগের মধ্যে ছড়ানো আছে মোট দশটি অনুচ্ছেদ – প্রথম বিভাগে একটিই অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় বিভাগে সাতটি আর তৃতীয় বিভাগে দুটি অনুচ্ছেদ। টাইপ-করা পাতায় অনুচ্ছেদগুলি স্পষ্টভাবেই চিহ্নিত।

প্রথম বিভাগের একমাত্র অনুচ্ছেদে পাই আবিল সময় আর সমাজের ছবি, অবসন্ন হতাশ মানবতার হাহাকার। পাশাপাশি প্রকাশ পায় পরিত্রাণের আকাক্সক্ষা।

দ্বিতীয় বিভাগের প্রথম অনুচ্ছেদে ঈর্ষা, দ্বেষ, হিংসা, হানাহানির বিষচক্রে আটকেপড়া মানবসমাজকে এক ভক্ত চান শ্রী ও ন্যায়ের পথ দেখাতে। বলেন, ‘মানুষ লড়াই করেই জয় করে নেবে আপন সৌভাগ্যকে।’ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই মানুষের
মুখোশ-পরা পশুদের দৌরাত্ম্যে হতাশ সমাজকে উজ্জীবিত করতে ভক্ত ডাক দেন, ‘সময় এসেছে, … চলো পরিপূর্ণতার খোঁজে।’ তৃতীয় অনুচ্ছেদে এক মানবসমুদ্রের ছবি এঁকেছেন কবি, নিজেদের সামাজিক অবস্থান ভুলে ভক্তের অনুগামী হয়ে যারা বেরিয়ে পড়েছে পরিপূর্ণতার খোঁজে। চতুর্থ অনুচ্ছেদে ফুটে ওঠে দীর্ঘ বন্ধুর পথের শ্রমে ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্রুদ্ধ মানুষের ছবি। পঞ্চম অনুচ্ছেদে রাত্রির অন্ধকারে বিশ্রামরত মানুষদের মধ্যে থেকে একজন হঠাৎই অধৈর্য হয়ে উঠে ভক্তকে হত্যা করে, ক্ষণিকের উত্তেজনার বশে। এই হিংস্র পরিস্থিতিতেও জায়গাটা ছেয়ে আছে যূথী ফুলের গন্ধে। ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে যাত্রীরা সন্ত্রস্ত, তাদের কে পথ দেখাবে এই দুশ্চিন্তায়। পুবদেশের বৃদ্ধ বললেন, ‘যাকে আমরা মেরেছি সে-ই!’ কারণটাও বলে দেন তিনি, ‘সন্দেহের বশে তাকে আমরা  আহত করেছি, ক্রুদ্ধ হয়ে আমরা তাকে হত্যা করেছি, এবারে আমরা তাকে গ্রহণ করি প্রেমে – কেননা, সে মরণকে স্বীকার করেছে আমাদের সকলের মনের মধ্যে বেঁচে থাকবে বলে, সে মৃত্যুহীন’। সপ্তম অনুচ্ছেদে দেখি যাত্রা শুরু হলো নতুনভাবে, উদ্দেশ্যও নির্ধারিত হলো নতুন করে। এবারের লক্ষ্য ‘প্রেম, শান্তি, জ্ঞান, আর অফুরন্ত ধনের মন্দির’। মৃত সঙ্গীর স্মৃতিতে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা জয় করে পথের সব কষ্ট, সব বাধা। এক সন্ধ্যায় সেই মৃত ভক্তের স্বর তাদের বলে, লক্ষ্য আর বেশি দূরে নয়।

তৃতীয় বিভাগের প্রথম অনুচ্ছেদে দেখি ঊষার আলোয় এক শাশ্বত গ্রামের ছবি, যেখানে ঘাসের মাথায় শিশিরের দ্যুতি উপেক্ষা করে জেগে উঠছে গ্রামীণ জীবন। সেই আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তে পুবদেশের বৃদ্ধ জানালেন তাঁর দেখা স্বপ্নের কথা। বার্তা দিলেন যাত্রা শেষের। কিন্তু সেই গ্রামে কোথায় পাওয়া যাবে পরিপূর্ণতার মন্দির? কী ধন পাওয়া যাবে সেখানে? সামনে পথের ধারে এক ফোয়ারার পাশে কুঞ্জঘেরা এক পর্ণকুটির। দলভুক্ত কবি বলে ওঠে, ‘মা, দ্বার খোলো।’ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শুরুতে খুলে যায় দ্বার। সেখানেই মায়ের কোলে সন্ধান মিলল নবজাতকের, যার জয়ধ্বনিতে মুখর হলো সেই ভোরের পৃথিবী। কবির গান ছড়িয়ে পড়ে হাওয়ায়, ‘জয় হোক নবজাতকের, চিরজীবিতের, জয় হোক মানবতার।’ পুবদেশের জ্ঞানী অস্ফুটে নিজেকে বললেন, ‘আমি দেখেছি তাঁর কল্পমূর্তি!’ এখানে লক্ষ করার বিষয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় কখনো-কখনো খ্রিষ্টীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করলেও কোথাও ব্যবহার করেননি এমনকি যিশুর নাম। নির্দিষ্টভাবে ইহুদি সমাজের উল্লেখও নেই এই কাব্যে।

বলে রাখা ভালো, ওপরের এই বিবরণ ‘দ্য নিউকামার’-এর আদিপাঠ-অনুসারী। এরপর বিভিন্ন শিরোনামের পাণ্ডুলিপিতে পাঠভেদ হয়েছে, তাদের চরিত্র আর বিন্যাসেও পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু মূল ভাবনাটি একই থেকে গেছে। এখানে যেন প্রাচীন গ্রিক নাটকের মতোই আদি-মধ্য-অন্ত সংবলিত একটি নাট্য নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে বলা যেতেই পারে, এই রবীন্দ্র-নাট্য প্যাশন প্লে’র নাট্য-সংগঠনের অনুসারী। 

আবার যাঁরা সিনেমার সঙ্গে কবির আদান-প্রদানের ইতিহাসে আগ্রহী, তাঁরা ‘চিত্রনাট্য’ হিসেবে লেখা মূল রচনাটিকে একটু অন্যভাবে পড়তেই পারেন। এর দুটি কারণ। প্রথমত, রচনাটি একটি সজীব সচল দৃশ্যমাধ্যমের সঙ্গে কবির মোকাবিলার এক উল্লেখযোগ্য দলিল, যেটিকে অনায়াসেই মাসকয়েক আগে মুরারিমোহন ভাদুড়িকে লেখা তাঁর চিঠির (তারিখ ২৬শে নভেম্বর ১৯২৯) পরিপূরক বলা যায় – যে-চিঠিতে কবি চলচ্চিত্রকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘দৃশ্যের গতিপ্রবাহ’ আর ‘রূপের চলৎপ্রবাহ’ হিসেবে। দ্বিতীয়ত, আপাতদৃষ্টিতে এর রচনাশৈলী ভীষণভাবেই চলচ্চিত্র-চিত্রনাট্য রচনার প্রচলিত ধারার অনুসারী – অবশ্য এটি বুঝতে গেলে চলচ্চিত্র-রচনার ইতিহাসে একবার নজর ফেরাতে হবে।

চার

চলচ্চিত্রের আদিযুগে (১৮৯৬-১৯১৫) সিনেমাটোগ্রাফ যন্ত্রের অনুকারী ক্ষমতার সুযোগ নিয়েই চলচ্চিত্রকারেরা মেতে উঠেছিলেন সেলুলয়েডের বুকে জীবনপ্রবাহের নানা টুকরোকে (slices of life) ধরে রাখতে। ফলে নতুন এই মাধ্যমটির প্রকাশভঙ্গিতে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিল একধরনের স্বাভাবিকতা, পোষাকি ভাষায় যাকে বলা চলে naturalism। সিনেমার সঙ্গে কাহিনির যে সংযোগকে আমরা এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধ বলে জানি, আদিযুগের শুরুতে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এক-একটি ছবির বিষয় হতো এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনা। এই আদি চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল সরল, একমাত্রিক প্রকাশভঙ্গি। দৃশ্যের প্রবাহ আবদ্ধ ছিল দলিলের স্তরে।

অল্পদিনের মধ্যেই অবশ্য আদিম উপস্থাপনার এই ধরনটা বদলাতে শুরু করল – কারো একার চেষ্টায় নয়, সম্মিলিত প্রয়াসে। সিনেমায় এলো থিয়েটারের আদল। থিয়েটারের ঢঙে বিন্যস্ত হলো দৃশ্যের গতি, ছন্দ আর যতি। সিনেমায় অনুপ্রবেশ করল আখ্যানের জটিলতা, চরিত্রের ধারাবাহিক বিকাশ আর নাটকীয় বিবর্তন। আদতে এগুলি সাহিত্যের অবদান, নাটকের পাঠ থেকে নাট্যমঞ্চ ঘুরে চলে এসেছে সিনেমায়। তবে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই চলচ্চিত্রকারেরা উপলব্ধি করলেন, স্থান, কাল আর দৃশ্যের যে আপেক্ষিক সীমায় থিয়েটার বাঁধা পড়ে যায়, সিনেমা তার থেকে মুক্তির একটা উপায় হতে পারে।

চলচ্চিত্রে বক্তব্যপ্রকাশের ধরনটাকে আমূল বদলে দিলেন তাঁরা। আদি সিনেমায় একটি শটের মধ্যেই কোনো ঘটনা বা ক্রিয়ার পুরোটা ধরা থাকত। তাই সে-যুগের ছবিতে হামেশাই দেখা যেত পাঁচ থেকে দশ মিনিটের শট। কিন্তু নতুন ধারার সন্ধানীরা উপলব্ধি করলেন, পর্দায় ঘটনার প্রতিরূপ হয়ে উঠতে পারে ভাবেরও বাহন। একটি ঘটনা বা ক্রিয়ারও সবটুকু তাঁদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। তাঁরা বেছে নিতেন, বলা ভালো তৈরি করতেন, ইঙ্গিতবাহী বা প্রতিনিধিত্বমূলক কয়েকটি টুকরো দৃশ্য। এরকম প্রতিটি অংশের অলংকরণ এবং বিন্যাসে তাঁরা ছিলেন অসম্ভব মনোযোগী। ফলে আপাতদৃষ্টিতে ঘটনা বা ক্রিয়ার অসম্পূর্ণ রূপায়ণ সত্ত্বেও সেসবের তাৎপর্য বুঝে নিতে কোনো অসুবিধে হতো না দর্শকের। অল্পকথায় বলা হয়ে যেত অনেক কিছু।

ছোট-ছোট শটের কালসংহতিকে তাঁরা কাজে লাগিয়েছেন ভাববিস্তারের ক্ষেত্রে। দৃশ্যপরম্পরায় একটা সাংগীতিক বিন্যাস তৈরি হতো তাঁদের হাতে। সংগীতে, বিশেষ করে মার্গসংগীতে, তাল, লয়, ছন্দ, শম অথবা হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরের আনুপাতিক ব্যবহার হয় ভাববৈচিত্র্য আনতে। নিজেদের ছবিতেও বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে, বিভিন্ন ভাবের দৃশ্য পরপর সাজিয়ে এইসব পরিচালক তাঁদের বর্ণনায় শুধু গতিই আনলেন না, তাতে যোগ করলেন ছন্দ। এই গতি বা ছন্দ মঞ্চদৃশ্যের গতি বা ছন্দের চেয়ে আলাদা – এগুলো একেবারে চলচ্চিত্রের নিজস্ব উপাদান।

ব্যঞ্জনাময় এই বিন্যাসকৌশলে সিনেমায় দৃশ্যসংগঠনের ধরনটা আমূল বদলে গেল। যেন তৈরি হলো চলচ্চিত্রের এক নতুন ভাষা। জগৎ ও জীবনের যথাযথ অনুকরণের বদলে সেসবের বস্তুগত সারসত্য উন্মোচনের লক্ষ্যে নতুনভাবে সংগঠিত হলো এই ভাষা। জন্ম নিল প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থাপনার রীতি (representation)। বিষয়বস্তুর নাটকীয় উপাদানকে তা আরও অর্থপূর্ণ করে তুলল।

এর অল্পদিনের মধ্যেই হলিউডের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কাহিনিচিত্রের মৌলিক কাঠামোটি সম্পূর্ণ করতে কথাসাহিত্যের আদলে অপরিহার্য হয়ে উঠল সুপরিকল্পিত একটি আখ্যানের নির্মাণ। এই আখ্যান আদি-মধ্য-অন্তযুক্ত একটি নিটোল উপস্থাপনা। কথাসাহিত্যের মধ্যে যেমন থাকে অধ্যায়, অনুচ্ছেদ, পরিচ্ছেদ অথবা নাট্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে যেমন দৃশ্য, অঙ্ক, তেমনি সিনেমাতেও এলো শট, সিন, সিকোয়েন্সের বিভাজন। এভাবেই সিনেমায় প্রথম তৈরি হলো এক সাহিত্য-অনুসৃত কাঠামো। এটি স্বনির্ভর, আদিযুগের চলচ্চিত্রের মতো কোনো বিচিত্রানুষ্টানের অন্যতম উপাদান নয়। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যেই তা ভাস্বর। কারণ, এটির কাঠামোয় থাকে সুসম্বদ্ধতা, বিস্তারে থাকে যুক্তিশৃঙ্খলা আর সত্তায় থাকে সম্পূর্ণতা। এই আখ্যান বিশেষভাবে মনে দাগ কাটে তার পরিণতি বা সমাপ্তির সুনির্দিষ্ট উপলব্ধির সূত্রে। এর ফলে বস্তুজগতের সঙ্গে দৃশ্য-উপাদানের নৈকট্য বজায় রেখেও অতিক্রম করা গেল বাস্তব অনুকৃতির দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা। এ-যেন হয়ে উঠল জীবনকে আরো প্রাণবন্ত করে দেখানোর আয়োজন। বাস্তবতাবাদ এরই দোসর অথবা, আরো পোশাকি ভাষায় বললে, পরিপূরক।

এই উপস্থাপন পদ্ধতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য এক ধরনের প্রাক্‌-পরিকল্পনার উদ্ভাবন করা হলো – কোন‌ কোন‌ বিষয় কীভাবে উপস্থাপন করা হবে তার লিখিত বয়ানের ভিত্তিতে। তিন পর্যায়ে ব্যাপারটা করা হতো – কাহিনিবিন্যাসের একটা প্রাথমিক খসড়া (treatment), ঘটনাবলির পারম্পর্য, পাত্রপাত্রীদের ভূমিকা এবং সম্ভাব্য সংলাপসহ একটা পরিপূর্ণ নাট্যরূপ (scenario), আর সবশেষে শুটিংয়ের সুবিধের জন্যে স্থান-কাল-পাত্রপাত্রীর বিস্তারিত বিবরণসহ একটি ব্যাপক পরিকল্পনার খতিয়ান (shooting script)। প্রথমেই ট্রিটমেন্ট তৈরি করা হতো সম্ভাব্য প্রযোজককে দেওয়ার জন্য, যেখান থেকে তিনি এই প্রকল্পের ব্যাপারে সদর্থক বা নঞর্থক, যে-কোনো প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁর সিদ্ধান্ত সদর্থক হলে, তবেই তৈরি করা হয় নাট্যরূপ অথবা সিনারিও। এর ভিত্তিতেই প্রযোজক আর্থিক সংস্থান করেন। টাকা-পয়সার ব্যাপারে সবকিছু চূড়ান্ত হয়ে গেলে তৈরি হয় শুটিংয়ের নীল নকশা বা শুটিং স্ক্রিপ্ট। টঋঅ-র সঙ্গে হিমাংশুর কী কথাবার্তা হয়েছিল তা আমরা জানি না। হিমাংশু রবীন্দ্রনাথের কাছে ঠিক কী চেয়েছিলেন, আমরা জানি না তা-ও। কিন্তু রবীন্দ্র-রচনাটিকে সেই সময়ের মাপকাঠি অনুযায়ী চলচ্চিত্র-প্রকল্পের জন্যে রচিত একটি প্রাথমিক খসড়া বা ট্রিটমেন্ট হিসেবে গণ্য করতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। মন দিয়ে পড়লে একটি তিন অঙ্কের নাট্যকাঠামো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, যার মধ্যে আছে তিনটি প্রধান প্লট-পয়েন্ট, অর্থাৎ ঘটনাপরম্পরার আকস্মিক দিকপরিবর্তন যা পরবর্তী ঘটনাবলিকে নতুন খাতে প্রবাহিত করবে। ওপরে যে তিনটি বিভাগের কথা বলেছি আমরা, সেগুলিকেই ধরে নেওয়া যায় তিনটি অঙ্ক হিসেবে।

প্রথম বিভাগের একমাত্র অনুচ্ছেদটিকে আমরা প্রথম অঙ্ক হিসেবে ধরতে পারি। এটি পরবর্তী সমস্ত ঘটনার আদি, মূল বা মুখবন্ধ – এক আবিল সময়ের দুর্ভাগ্যপীড়িত মানবগোষ্ঠীর দুর্দশার বর্ণনা আর তাদের আর্তি। এক অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছে মানুষ এখন পরিত্রাণ খুঁজছে। এখান থেকে ঘটনা এক নতুন মোড় নেবে। অর্থাৎ প্রথম মোচড় বা প্লট-পয়েন্ট।

দ্বিতীয় বিভাগে আমরা পৌঁছাই আখ্যানের মধ্যপর্বে। এখানে আখ্যান জটিল হয় – বহুবিধ টানাপড়েনে, নানা সমস্যার সমাহারে। এই বিভাগের প্রথম তিনটি অনুচ্ছেদে সেই পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষা মূর্ত রূপ পায় এক অভিযাত্রার প্রস্তুতিতে। ভক্তের আহ্বানে জাতি-বিত্ত-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ বেরিয়ে পড়ে পরিপূর্ণতার খোঁজে। কিন্তু পরবর্তী দুটি অনুচ্ছেদে পথশ্রমের প্রভাবে তাদের সেই আশা ব্যাহত হয়। একজন সংশয়ী মানুষ হত্যা করে ভক্তকে। আসে দ্বিতীয় মোচড় বা প্লট-পয়েন্ট। এই বিভাগের শেষ দুই অনুচ্ছেদে নতুন স্বপ্নের জন্ম হয়। সেই স্বপ্নে ভর করে এক সন্ধ্যায় অভিযাত্রীরা পৌঁছায় তাদের নতুন অভীষ্ট ‘প্রেম, শান্তি, জ্ঞান আর অফুরন্ত ধনের মন্দির’-এর কাছে।

তৃতীয় এক মোড়ে অর্থাৎ প্লট-পয়েন্টে এসে দাঁড়ায় কাহিনি।

তৃতীয় পর্বের প্রথম অনুচ্ছেদের শেষে চিহ্নিত হয় অভিযাত্রীদের অভীষ্ট ‘প্রেম, শান্তি, জ্ঞান আর অফুরন্ত ধনের মন্দির।’ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শেষে মায়ের কোলে এক নবজাতককে দেখা যায় ‘প্রেম, শান্তি, জ্ঞান আর অফুরন্ত ধনের’ প্রতীক হিসেবে। এই দুই অনুচ্ছেদের সূত্রে আখ্যান পৌঁছায় তার শমে, অর্থাৎ নিবৃত্তিতে বা সমাধানে।

কিন্তু এভাবে ব্যাখ্যা করলে প্রশ্ন উঠবেই, রবীন্দ্রনাথ কি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির এই রীতির সঙ্গে আদৌ পরিচিত ছিলেন? এবং এর অবধারিত উত্তরটি হবে, না। আমরা এ-কথাও বলতে চাইছি না যে, রবীন্দ্রনাথ খুব সচেতনভাবে চিত্রনাট্যের প্রচলিত লক্ষণ মিলিয়ে রচনাটি প্রণয়ন করেছিলেন। তবু কেন এসব কথা তুলছি আমরা?

তুলছি একটিই কারণে। জীবনের এই পর্যায়ে নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি বেশ পোক্ত এবং প্রসারিত। তাঁর বিশিষ্ট নাট্য-দর্শনও ততদিনে একটা পরিণতিতে পৌঁছে গেছে। ফলে ব্যতিক্রমী (অর্থাৎ, ‘ফিল্মের জন্যে’ ‘নতুন টেকনিকে’) একটি নাটক রচনার সম্ভাবনায় উনি উৎসাহিতই হয়েছিলেন। আর এই রচনার মধ্যে থেকে যে একটি পরিপূর্ণ নাট্য-সম্ভাবনা উঁকি মারছে, তা নিয়ে বোধহয় কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে কোথাও কি এই রচনার যোগ ছিল সেই সময়কার
রবীন্দ্র-নাট্যভাবনার সঙ্গে, যা ছিল একান্তই তাঁর নিজস্ব?

১৯৬৬ সালে লেখা ‘নাট্যমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার ইতিহাস পর্যালোচনা করে শঙ্খ ঘোষ আমাদের জানিয়েছিলেন কবির নাটকে দুই পদ্ধতির টানাপড়েনের কথা – ‘‘ ‘রক্তকরবী’ বা এমন-কী ‘মুক্তধারা’তেও কখনো মনে হতে পারে যে এপিক ধরনে এখানে মন্টাজের ব্যবহার যেন কিছু আসছে, ভিন্ন ভিন্ন টুকরোর একত্রগ্রন্থন – তা সত্ত্বেও, সাধারণভাবে বলতে গেলে, নাট্যবিষয়কে ক্রমাবর্তনে গড়ে তুলবার পুরোনো পদ্ধতিটিকেও রবীন্দ্রনাথ একেবারে ছাড়েন না।” তাঁর নাটকে ইউরোপীয় আদল মেনে প্লটগঠন বা চরিত্রনির্মাণের চলতি ধারণা বর্জিত হয়েছে। বরং স্থানকালের বিন্যাসকে এক নিবিড় ঐক্যের মধ্যে বেঁধে নিয়েও মাঝে মাঝেই তিনি তাদের বাঁধন আলগা করে দেন, দেশীয় যাত্রার আদলে – যে যাত্রা তাঁর চোখে জনজীবনের প্রতিচ্ছবি। দেশি-বিদেশি আদলের মধ্যে অনায়াস যাওয়া-আসার সূত্রে রবীন্দ্রনাট্য অর্জন করে এক বিশিষ্ট চরিত্র – ‘একটি অনতিনির্দেশিত স্থানকালে বিন্যস্ত তার ঘটনাজগৎ, কিন্তু সে পৌঁছে দেয় নিবিড় কোনো আত্মিক চেতনায়। আত্মভূমি বস্তুভূমি এইভাবে দুই প্রান্ত টান করে ধরে, তার মধ্যবর্তী যোগের পথ তৈরি রাখে লোকস্মৃতি।’ এই দুটি উদ্ধৃতিকে মনে রেখে যদি এখন চোখ বুলানো যায় ‘দ্য নিউকামার’ রচনাটির দিকে তাহলে এটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাটকের মূল ভাবনাগুলির সাদৃশ্য খুঁজে পেতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এখানেও পাওয়া যাবে ‘এপিক ধরনে’ ভিন্ন ভিন্ন টুকরোয় ‘মন্টাজের ব্যবহার’-এর পাশাপাশি ‘নাট্যবিষয়কে ক্রমাবর্তনে গড়ে তুলবার’ আয়োজন। তেমনি ‘একটি অনতিনির্দেশিত স্থানকালে বিন্যস্ত’ এই রচনার ঘটনাজগৎ অন্তে আমাদের পৌঁছে দেয় ‘নিবিড় কোনো আত্মিক চেতনায়’ – যা নবজাতকের দ্বারা প্রতীকায়িত। আর বস্তুভূমি আত্মভূমির মধ্যে সেতু-নির্মাণকারী যে তৃতীয় মাত্রা বা ‘লোকস্মৃতি’র কথা বলেছেন শঙ্খ ঘোষ, এই রচনায় তাকেই আমরা খুঁজে পাই বহুমাত্রিক জন-আচরণে। ফলে ‘‘ ‘শারদোৎসব’ থেকে অন্ত্যকাল পর্যন্ত যে-সময়খণ্ডে রবীন্দ্রনাটক তার নিজস্ব ধরন অর্জন করে নিয়েছে” বলে মন্তব্য করেছেন শঙ্খ ঘোষ, এই নাতিদীর্ঘ রচনাটি হয়ে ওঠে তারই অংশ। খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এটিই অমিয় চক্রবর্তী-কথিত ‘ফিল্মের জন্যে’ ‘নতুন রকম টেকনিকে’ লেখা নাটক। রূপান্তরিত রচনার কাব্য-চরিত্রটিকে মূল রচনায় আরোপ না করে পাথুরে প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা যদি খোলামনে মেনে নিই যে, মূল রচনাটি ছিল একটি গদ্য, তাহলেই বিভ্রান্তির অবসান হবে। কবির লেখা গদ্যও যে একটু কাব্য-ঘেঁষা হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আসলে টঋঅ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে গদ্যে-লেখা একটি ‘চিত্রনাট্য-চুম্বক’ বা ‘ট্রিটমেন্ট’ই চেয়েছিল, পরিপূর্ণ ‘চিত্রনাট্য’ বা ‘সিনারিও’ নয়। রবীন্দ্রনাথও সেভাবেই কাজটি করেছিলেন। এর ভিত্তিতে কোনো ছবি যে তৈরি হয়নি, তার দায় তো কবির হতে পারে না। কিন্তু এ-বিষয়ে তাঁর উৎসাহ, ভাবনা আর পরিশ্রমকেও অস্বীকার করা যায় না। ফলে কবির মূল রচনাটিকে, নির্দিষ্টভাবে বললে ‘দ্য নিউকামার’কে, একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে কবির সরকারি রচনাভাণ্ডারের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্‌যোগ নেওয়া উচিত। সেই মর্যাদা রচনাটির প্রাপ্য, ঐতিহাসিক কারণেই।

Published :