রেখাচিত্রের নতুন মাইলফলক

দ্রাবিড় সৈকত

শিল্পে প্রাণ-প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি বাকবিনিময়ে বসিয়ে দেওয়ার একরকম জাদুকরি বিদ্যা আছে বোধহয় শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের। না-হয় তাঁর শিল্পকর্মের সামনে এতো বেশি সময় দিতে হয় কেন? চিত্রভাষায় যাপিত জীবনের এতো ভঙ্গি-বিষাদ-বিভক্তি-বিভাব-অনুভাবের সমাহার ইতোপূর্বে পৃথিবীর কোনো শিল্পকর্মে কি আমরা দেখেছি? হ্যাঁ বিচ্ছিন্ন অনেক চিত্রকল্প আমাদের পূর্বপরিচিত; তবে সমগ্রতার মানদণ্ডে শিশিরের শিল্পকর্ম যে-ব্যঞ্জনায় ধরা দেয় তা সম্পূর্ণ নতুন।
বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলার মূল প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা যায় পশ্চিমানুগামী প্রাতিষ্ঠানিক রীতিকে, এর পরেই রয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারসহ শিল্প-উপকরণে বৈচিত্র্য যুক্ত করার বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্প-সৃষ্টির প্রচেষ্টা। প্রাতিষ্ঠানিক রীতির অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো এর আবর্তনিক প্রক্রিয়া। ঘুরেফিরে একই স্থানে থেকে যাওয়ায় এই ধারায় কোনো উল্লম্ফন নেই। দর্শক বিমোহিত বিস্ময়ে চিত্রকর্মের সামনে থমকে যাবে এমন সৃষ্টি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা কিংবা এসএম সুলতানের প্রথম বৃক্ষরোপণের পর খুব একটা দেখা যায়নি। একেবারে সমসাময়িক শিল্প-প্রবণতায় সর্বশেষ উপকরণ যুক্ত হওয়ার পরও অনেকটাই এলোমেলো পশ্চিমা খোলসের অনুকরণ মনে করার সংগত কারণ রয়েছে। শিল্পকর্মে ধারণা ও দক্ষতার যথাযথ সমন্বয় অত্যন্ত দুর্লভ হয়ে গেছে আমাদের চিত্রকলায়। ঠিক এখানেই শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের কৃতিত্বের জায়গা; তাঁর চিত্রপটে আধুনিকতার বাড়াবাড়ি নেই, নিত্যনতুন উপকরণের চমক নেই,  নেই নিরেট সাদা-কালো রেখার বিচরণ। কিন্তু শিল্পকর্মে যা থাকতে হয়, যা থাকলে শিল্পকর্মকে বিনা দ্বিধায় রসোত্তীর্ণ শিল্প বলা যায়, তার সবটাই পাওয়া যাবে এই আপাত-সাদামাটা শিল্পকর্মে।
ঢাকা আর্ট সেন্টারে ১৪ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত হয়ে গেল শিশির ভট্টাচার্যের ‘দাগ তামাশা’ শীর্ষক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেই এখন তামাশা মনে হয় অথবা যে-কোনো তামাশাই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কাজেই শিশিরের ‘তামাশা’ আদতেই ‘তামাশা’ কিনা, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা  রয়েছে। তার ‘দাগ তামাশা’য় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ‘দাগ’। রেখার পৈতা ছেড়ে ‘দাগ’ হয়ে ওঠার এটা সামাজিক বিকার।  রেখার একরৈখিকতা থেকে মুক্ত হয়ে দাগ হয়ে ওঠে বহুগামী।  রেখা যেখানে ক্যানভাস ছেড়ে বেরোতে অনিচ্ছুক দাগ, সেখানে ক্যানভাস থেকে বেরোনোর পন্থাই প্রথম এজেন্ডায় রাখে। দাগের গমন বহুবিচিত্র জায়গায়। দাগ লাগতে পারে চিত্রপট ছেড়ে জামা-কাপড়ে, আসবাবপত্রে, সমাজে-সময়ে, রাজনীতি-অর্থনীতিতে, চরিত্রে-চেহারায় এমনকি অন্তরে। যদিও অন্তরে লাগলে সেটা দাগ থেকে দাগায় পরিণত হয়ে নিজের ওজন বাড়িয়ে নেয়। কাজেই শিশিরের এই ‘দাগ তামাশা’র অনুধাবন পদ্ধতি আলাদা হতে বাধ্য। এটা অনেকটাই দর্শকের অন্তরে দাগা দেওয়ার মতো তামাশা করে ফেলেছে।
শিশির ভট্টাচার্যের শিল্পকর্ম খুবই স্পষ্ট ভাষায় মানুষের কথা বলে; বলা যায় অনেকটা অজনপ্রিয় ঠোঁটকাটা ভঙ্গিতে। এই ভঙ্গি সমসাময়িককালে খুব ঝুঁকিপূর্ণ, মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ক্রমেই তলানিতে নেমে যাচ্ছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চরম প্রদর্শনী চলছে শিল্পে, সমাজে। অপরকে নিয়ে কথা হচ্ছে অনেক কিন্তু নিজেকেই জাহির করার তীব্র প্রচেষ্টা দেখা যায় এসব অপর-কথনে। অপরকে আপন ভাবার হার্দিক তাত্ত্বিকের দেখা মেলা ভার। কাজেই ‘দাগ তামাশা’র নামে শিশিরের খোঁচাগুলো হজম করা খুব সহজ নয়। প্রদর্শনীতে ছোট-বড় মিলিয়ে কাজের পরিমাণ ২৪টি। ছোট কাজগুলো নানা ঘটনার খণ্ডচিত্র, যদিও খণ্ডচিত্র বলতে আক্ষরিক অর্থে যতটুকু বোঝায় এদের ব্যাপ্তি তার থেকে বহুদূরবিস্তৃত। কিন্তু বৃহৎ আকৃতির শিল্পকর্মগুলো সমুদ্রের মতো দর্শককে ভাসিয়ে নেয়। প্রস্তুতিহীন দর্শক এক্ষেত্রে খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন।
আচার্য ভামহ প্রাচীন ভারতে যে-ধ্রুপদী ধারণার সূত্রপাত করেছিলেন, শিশিরের শিল্পকর্ম তাঁর সমকালীন প্রতিচ্ছবি। স্থানিক বৈশিষ্ট্য আচরণের স্বাভাবিকতাগুলো যদি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ না করা হয়, তাহলে তার ছাপ থাকবেই। ভারতীয় শিল্পের প্রাণ মূলত শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রেখা, যা শিশিরের চিত্রপটে নতুন জীবন লাভ করে মোক্ষলাভের আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে। মাটির সূত্রে পাওয়া লোকজ শিল্পের নির্যাস এবং পাশ্চাত্য ঘরানার প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনে একীভূত দৃশ্যশিল্পের রূপ কেমন হতে পারে শিশির ভট্টাচার্যের এ-প্রদর্শনী তার একটি উদাহরণ।
শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের ক্যানভাস দর্শককে স্তব্ধ করে দেয়, সময়কে মুহূর্তেই জমাট করে তোলে, কোনো অজানা সেতুবন্ধ রচিত হয়ে শিল্পকর্ম ও দর্শকের দূরত্ব বিলীন হয়ে যায়। তার প্রবল রেখার স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আঁতকে ওঠা, শিউরে ওঠা অথবা ঘৃণায় বিবমিষা তৈরি করে তার জীবিত থিকথিকে চলমান রেখা। অসংখ্য প্রশ্নের জাল বিস্তার করে তাঁর শিল্পকর্ম। এ-প্রশ্নগুলো আমাদের পরিচিত, উত্তরগুলো জানা আছে কিন্তু দৈনন্দিন যাপনের চাপে কুঁকড়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো শিশিরের ‘দাগ তামাশা’ নতুন করে চাগিয়ে দেয়। দর্শককে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া এই প্রদর্শনীর সার্থকতা।
স্বল্পতম উপাদান ব্যবহারের পরও শিল্পকে কতটা উচ্চমার্গে স্থাপন করা যায় এর প্রথম উদাহরণ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং এর পরেই শিশির ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের চিত্রকলায় শিশির একটি মাইলফলক স্থাপন করেছেন, পরবর্তী শিল্পীদের যা মাথায় রাখতে হবে; যদি কেউ এই পথে হাঁটেন অবশ্য এ-পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ নয়।