লাবু রহমান, গিটার হাতে পঞ্চাশ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ইমু হাসান ও মির্জা আতিকুর রহমান

সালটা ১৯৭৩, ঢাকার জোনাকী সিনেমা হলে পপ শো – উইন্ডি সাউন্ড অফ কেয়ার, আজম খান (উচ্চারণ), স্পন্দনসহ দেশের বড় বড় গানের দল। এই শোতে মঞ্চে যখন পারফর্ম করছিল উইন্ডি সাউন্ড অফ কেয়ার তখন দর্শকসারিতে থাকা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী এক কিশোর পায়ে পায়ে মঞ্চের কাছে যেতে চাইছে। সে দেখতে চায় কে সেই হিরণ্ময় গিটারিস্ট আর তাঁর গিটারটাই বা কেমন! আজ ২০২৩ সালে, ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে সেদিনের সেই কিশোর নিজেই ইতিহাসের অংশ, তাঁর নাম লাবু রহমান।

লাবু রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমরা তাঁর বাসায় ঢুকলাম। বাসায় ঢোকা মাত্র তাঁর আন্তরিকতা আমাদের ভুলিয়ে দিলো যে, লাবু রহমান বা লাবু ভাইয়ের সঙ্গে এটিই আমাদের প্রথম দেখা! সময় কেটে গেল আড্ডা আর আলাপে। প্রায় তিন ঘণ্টা আড্ডার পর আমরা আবিষ্কার করলাম এতক্ষণের আলাপের কিছুই রেকর্ড হয়নি! পরে আমাদের স্মৃতি আর টুকিটাকি নোটসের মিলিত প্রয়াস হলো লাবু ভাইয়ের জবানিতে তাঁর ৫০ বছরের পথচলার একটা ছোট্ট লেখচিত্র।

আমার পুরো নাম লুৎফুল আহমেদ লাবু। জন্ম ঢাকায়, শান্তিনগরে ১৯৫৮ সালে। আমার বাবা আব্দুর রহমান আখুঞ্জি ছিলেন কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর মা লতিফা খাতুন শিক্ষকতা করতেন ঢাকার একটি স্কুলে। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে বন্ধুরা আমাকে রহমান জুনিয়র বলে ডাকতো। পরবর্তীকালে বন্ধুদের মুখে মুখে রহমান জুনিয়র আর ডাকনাম লাবু এই দুইয়ের কম্বিনেশনে আমার নাম হয়ে গেল লাবু রহমান। এগারো ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম দশম। আমার বাবা একটু রক্ষণশীল মানুষ ছিলেন এবং গান-বাজনা তেমন পছন্দ করতেন না। আমার সংগীতের সঙ্গে সম্পর্ককে তিনি শুরুতে সহজভাবে নেননি। কিন্তু পরে যখন আমার পরিচিতি বাড়তে থাকে এবং নানান লোকজন বাড়িতে এসে আমার খোঁজ করা শুরু করে, তিনি খুবই অবাক হন এই ভেবে যে, সবাই শুধু আমার ছোট ছেলেকে খোঁজে, বাকি ছেলেদের তো খোঁজে না!

যাই হোক শুরুর দিকে আপত্তি থাকলেও মৃত্যুর পূর্বে ছোট ছেলের সাফল্য তাঁকে বিশেষ স্বস্তি ও আনন্দ দিয়েছিল। বাড়িতে গান-বাজনার চল বলতে ছিল মায়ের গান শোনার জন্য এলপি প্লেয়ার আর বড় ভাইয়ের ফ্লেমেঙ্গো গিটার যা আমাদের দেশে তেমন প্রচলিত নয়। পরে নিলয়কে (নিলয় দাশ) দেখেছিলাম নাইলন স্ট্রিংয়ের গিটার বাজাতে। আমার বাজানো মা খুব ভালোবাসতেন, বলা চলে গিটার বাজানোর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়টা প্রথমে তিনিই দিয়েছিলেন। মায়ের কল্যাণে আমি ছোটবেলায় অসংখ্য পুরনো দিনের গান শুনেছি, যা পরে আমার মধ্যে সংগীতের ভিত গড়ে দিয়েছিল। পরবর্তী-জীবনে গিটার আমার পরিবারের অন্যতম অনুঘটক, বলা চলে আমার বিয়ের ঘটকও। আমার স্ত্রী স্মিতা কাজী মূলত আমার গিটার বাজানো শুনেই আমার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিল। আমার একমাত্র মেয়ে আনুশকা অরিত্রি রহমান বর্তমানে ফ্রান্সে থাকে। লেখাপড়ায় অনেক বেশি সিরিয়াস থাকায় ও সেভাবে মিউজিকে জড়ায়নি। এমনিতে সে গিটারে কিছু কর্ড বাজাতে পারে এবং কোনো প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই ও বেশ ভালো গাইতে পারে।

গিটার প্রেম, ফজলে রব এবং ফেন্ডার

স্বাধীনতার পরে ঢাকার সিনেমা হলগুলিতে অনেক সময় পপ শো হতো (এখন যাকে আমরা ব্যান্ড শো বলি)। ১৯৭৩ সালে ঢাকার জোনাকী সিনেমা হলের এমনি একটা পপ শো-তে উইন্ডি সাউন্ড অব কেয়ার, আজম খান (উচ্চারণ), ফিরোজ সাই, স্পন্দন ইত্যাদি শিল্পী ও গানের দল অংশ নিয়েছিল। জোনাকী সিনেমা হলের মালিকের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে বিনা দর্শনীতেই সেই শো দেখার সুয়োগ হলো আমার। সেই শো-তে উইন্ডি সাউন্ড অফ কেয়ারের গিটারিস্ট ফজলে রবের গিটার প্লেয়িং দেখে দারুণ অনুপ্রাণিত হই এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, আমাকে গিটারই বাজাতে হবে। উনি কোন ব্র্যান্ডের গিটার বাজাচ্ছিলেন জানার জন্য স্টেজের একদম সামনে চলে গিয়ে দেখতে পাই উনি একটা ফেন্ডার গিটার বাজাচ্ছেন। ফজলে রবের গিটার বাজানো এমনকি ফেন্ডার গিটারের সাউন্ডও আমাকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, পঞ্চাশ বছর পরেও আমি ফেন্ডার গিটারই বাজাই। শো-র পরে আমি বাসায় গিয়ে বড় ভাইয়ের গিটারে ফজলে রবের গিটারের মতো সাউন্ড তোলার চেষ্টা করছিলাম। এক পর্যায়ে বড় ভাই দেখে বললেন, ‘এটা নাইলন স্ট্রিং গিটার এবং এখান থেকে অ্যাকুস্টিক/ লিড গিটারের মতো শব্দ বের হবে না।’ পরে আমি ২৭৫ টাকা দিয়ে আমার প্রথম অ্যাকুস্টিক গিটারটি কিনে ফেলি এবং প্রথম দিনই টানা বাজাতে শুরু করি। বাজাতে বাজাতে আমার আঙুল কেটে রক্ত বের হতে থাকে, কিন্তু আমি বাজানো থামাচ্ছিলাম না। আমার প্রথম ফেন্ডার ইলেকট্রিক গিটার অবশ্য আশির দশকের শুরুর দিকে কেনা। সেই সময় এগারো-বারো হাজার টাকা দিয়ে কেনা কালো রঙের ফেন্ডার গিটারে বাজিয়েছি অজস্র গান। পরে আমার সঙ্গে ফজলে রব ভাইয়ের দেখা হয়। তিনি আমার কথা ও আমার বাজনা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন এবং প্রশংসা করেছিলেন।

গিটারে আমি বা আমাদের প্রজন্মের প্রায় সকলেই ছিল স্বশিক্ষিত। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষকই বা পাবো

কোথায়? তখন তো ঢাকায় গিটারই পাওয়া যেত না। গিটারের তারটা পর্যন্ত কিনতে পাওয়া যেত না। বিদেশ থেকে কেউ এলে আমরা তাদের অনুরোধ করতাম আমাদের জন্য গিটারের তার কিংবা গিটার সংক্রান্ত বই নিয়ে আসার জন্য। অনেক সময় সেতারের তার দিয়ে প্র্যাকটিস করেছি। একবার গিটারের তিন নম্বর তার ছিঁড়ে যাওয়ায় গুনা তার দিয়েও গিটার বাজিয়েছি। এমন একটা অবস্থায় কানে শুনে শুনে বাজানো ছাড়া কোনো সুয়োগ ছিল না। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে গিটারের প্রাথমিক কিছু লেসন নেওয়ার পাশাপাশি গিটার লেসনের ওপর একটা বই পাই। ওই বইটি থেকেই আমি মূলত গ্রামাটিক্যালি গিটার শিখি। এছাড়া এলিফ্যান্ট রোড থেকে বিভিন্ন ইংরেজি গানের অ্যালবাম রেকর্ডিং করে আনতাম এবং শুনে শুনে গিটারে তোলার চেষ্টা করতাম।

নয়ন মুন্সী

আমার বাসার দুই বাসা পরেই ছিল নয়ন মুন্সীর বাসা। ছোটবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি। ওর সে-সময় নিজের কোনো গিটার ছিল না। ও প্রায়ই আমার বাসায় এসে আমার গিটার বাজাতো। পরে আমরা আর্লি বার্ড নামে একটা ব্যান্ডদল গঠন করলে নয়ন তাতে যোগ দেয়। এখানে আমরা একসঙ্গে গিটার বাজিয়েছি। নয়ন মুন্সীর পরিবারে আগে থেকেই সংগীতের পরিবেশ ছিল। নয়নের বড় ভাই বিখ্যাত গায়ক আলমগীর (যিনি দেশ স্বাধীনের পর পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তাঁর মিউজিক্যাল ক্যারিয়ার গড়েছেন) এবং বোন জর্জিনা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার। পারিবারিক আবহ বা অন্য যে-কোনো কারণেই হোক সেই অল্প বয়সেই নয়নের মিউজিক সেন্স ছিল বেশ পরিণত, দক্ষতার কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। অ্যাকুস্টিক গিটার বাজাতে বাজাতে যখন আমার লিড গিটার বাজানোর শখ হলো তখন উপলব্ধি করলাম লিড গিটারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য রিদম গিটার বাজানোর লোক দরকার। তখন আমি আমার আশেপাশের আগ্রহী বন্ধুদের গিটার বাজানো শেখাতে শুরু করি। ১৯৭৫ সালে আমি  ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাশ করি এবং সে-বছরই প্রথম আনন্দ নামে ব্যান্ডদল গঠন করি। একই সময়ে ডার্ক ফেইট নামে একটা ব্যান্ড করেছিলাম, তবে এই ব্যান্ডের ফেইট ডার্কই ছিল!

আজম খান

১৯৭৭-৭৮, এই দুই বছর আমি আজম ভাইয়ের (আজম খান) সঙ্গে উচ্চারণ ব্যান্ডে বাজাই। উচ্চারণ ব্যান্ডে বাজানোটা অনেকটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল। সে-সময় আজম ভাই কিছুদিন অসুস্থ হয়ে তাঁর এক বন্ধুর বাসায় থাকাকালে একঘেয়েমি কাটাতে তিনি আবার মিউজিক করার জন্য গিটারিস্ট  খুঁজছিলেন। এমন সময়ে আমার এক বন্ধু তাঁকে আমার কথা বললে তিনি দেখা করতে বলেন। আমি খুব অবাক হয়ে পরের দিনই আজম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তাঁর ফরমায়েশ মতো কিছু কর্ড বাজালাম, আজম ভাই কোনো কথা না বলে শুধু শুনে গেলেন। তাঁর অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিল না যে, তিনি আমার বাজানো পছন্দ করেছেন কি না। অবশেষে মৌনতা ভেঙে তাঁর স্বভাবসুলভ ঢাকাইয়া ভঙ্গিতে বললেন, ‘তাইলে আর দেরি কইরা লাভ কী? কাইলকা থেইকা আহো, বইয়া পড়ি!’ তাঁর সঙ্গে বাজানোর সময়টা ছিল দুর্দান্ত। আমরা প্রায়ই শহর থেকে একটু দূরে চলে যেতাম। গিটার নিয়ে গান-আড্ডা হতো তখন। আসলে একটু আউটিংয়ের পাশাপাশি প্রকৃতির মাঝে নিরিবিলিতে বসে আমাদের বিভিন্ন ভাবনা, গান, কম্পোজিশন  নিয়ে চর্চা হতো। আমরা বেশি যেতাম মিরপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। আজম ভাইয়ের বহু শ্রোতাপ্রিয় গানের আঁতুড়ঘর এই বোটানিক্যাল গার্ডেন। এরকম একটি আউটিংয়ে আজম ভাইকে একবার বললাম, ‘আমি একটি গান লিখে সুর করেছি, আপনি কি গাইবেন?’ গানটা শুনে তিনি বললেন,  ‘আমারে গানটা  তুইলা দেও।’ বোটানিক্যাল গার্ডেনে রিহার্সাল করে তিনি তুলে নিলেন ‘আমি যারে চাইরে, সে থাকে মোরই অন্তরে’। আজম ভাইয়ের এই শ্রোতাপ্রিয় গানটার পুরো কৃতিত্ব আমি তাঁকেই দিই। তিনি গেয়েছিলেন বলেই এই গানটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে এবং একই সঙ্গে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের অন্যতম আইকনিক গানে পরিণত হয়েছে। আমি বা অন্য কেউ গাইলে সেটা এই লেভেলের শ্রোতাপ্রিয়তা নাও  পেতে পারতো। আজম ভাই আমাদের ব্যান্ড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলেন এক ম্যাজিকের মতো, তিনি একাই বিশাল এক মাইলেজ দিয়েছিলেন; কিন্তু আমরা তাঁকে সেই অর্থে মূল্যায়ন করতে পারিনি। এদিক থেকে চট্টগ্রামের তরুণ মিউজিশিয়ানদের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ওরা আইয়ুব বাচ্চুর দ্বারা মিউজিক্যালি খুবই প্রভাবিত। চট্টগ্রামে আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে রুপালি গিটারের মতো দারুণ একটা কাজ হয়েছে। অথচ ঢাকা শহরে আজম খানের স্মৃতিতে একটা স্মৃতি স্মারক নেই। আমি মনে করি, ইতিহাসের দায় থেকে হলেও অচিরেই এটা হওয়া উচিত এবং কেউ এ-ধরনের কোনো উদ্যোগ নিলে  আমি অবশ্যই পাশে থাকবো।

প্রফেশনাল গিটার প্লেয়ার (সিম্ফনি এবং প্লেব্যাক)

১৯৭৯ সাল থেকে আমি প্রফেশনাল গিটারিস্ট। সে-সময় প্রফেশনাল গিটারিস্ট হিসেবে কল্পনা করা মোটেও সহজ কোনো বিষয় ছিল না। আর্থিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও বিষয়টা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তখন আমাদের দেশে এমন পরিবার পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ছিল যারা নিজেদের সন্তানকে সানন্দে গিটারিস্ট হতে উৎসাহ দেবে বা একজন গিটারিস্টকে জামাতা হিসেবে সাদরে গ্রহণ করবে। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমার নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাতদিন গিটার নিয়ে মেতে থাকা আমার বাবাও শুরুতে ভালোভাবে নেননি। তিনি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে আমার বড় ভাইকে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। একটা দীর্ঘ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আমি আমার বড় ভাইকে বোঝাতে সক্ষম হই, আমি আসলে জীবনে গিটারই বাজাবো।

১৯৭৯ সালেই আমি সিম্ফনি নামে একটা ব্যান্ডে জয়েন করি এবং এই ব্যান্ডের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের পাগলায় বালাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ভাসমান রেস্তোরাঁ মেরি এন্ডারসনে গিটার বাজাতাম। এখানে বাজানোটা আমি খুব উপভোগ করতাম, মূলত ইংরেজি গান কাভার করতাম। তখন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে উইকেন্ড কাটাতে আসা ঢাকায় বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকরা ছিলেন আমার শ্রোতা। সকাল এগারোটা থেকে বেলা আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত এখানে বাজাতাম আর সপ্তাহের বাকি দিনগুলো বাংলা ছবির প্লেব্যাকে গিটার বাজানো এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক স্কোরের কাজ করতে শুরু করি। প্রয়াত সংগীত পরিচালক সত্য সাহা থেকে শুরু করে আলাউদ্দীন আলী, সমর দাশ, সুবল দাস, শেখ সাদী খান – সবার সঙ্গেই সেসময় কাজ করেছি আমি।

আমার প্লেব্যাকে আসা মূলত সত্য সাহার হাত ধরে। তখন আমি মোটামুটি প্রফেশনালভাবে মিউজিক করার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে বিভিন্ন ইংরেজি অ্যালবাম এনে গিটারের নোটসগুলি শুনে শুনে বাজাচ্ছি। হঠাৎ একদিন স্টেডিয়াম মার্কেটে পছন্দের ক্যাসেট রেকর্ড করতে গিয়ে রুমি ভাইয়ের (ওমর খালেদ রুমি) সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন পরদিন সত্যদার (সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা) ওখানে রেকর্ডিং (ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিও) আছে এবং আমাকে যেতে হবে। এভাবেই বাংলা ছবির প্লেব্যাকে আমার যাত্রা শুরু হয়ে গেল। এখানে আমি পুরোমাত্রায় পেশাদার যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছি। যাদের সঙ্গে বাজিয়েছি তাঁরা বংশানুক্রমিকভাবেই এ-পেশায় ছিলেন এবং তাঁদের বাবা-কাকারাই ছিলেন তাঁদের শিক্ষক। পাশ্চাত্য মিউজিকের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকেই একটা টান ছিল এবং আমি সে-টান থেকেই এটা শিখেছিলাম, এবার তাঁদের সংস্পর্শে এসে আমি প্রাচ্যের সংগীতের পাঠ নিই।

পরে প্রয়াত সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট করে নিলে আমার পরিচিতির কলেবর বেড়ে যায় এবং আমি প্রচুর কাজ পেতে থাকি। মোটের ওপর কতশত ছবির প্লেব্যাকে যে আমি বাজিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বেদের মেয়ে জোছনাসহ বাংলাদেশি সিনেমার অসংখ্য আইকনিক গানে আমার গিটার প্লে করা আছে। আমাকে যেসব সংগীত পরিচালক পছন্দ করতেন তাঁরা আমাকে ছাড়া কাজ করতে চাইতেন না। আমি অন্য স্টুডিওতে ব্যস্ত থাকলে আমার জন্যে অপেক্ষা করেছেন। অনেক সময় দেখা যেত আমি স্টুডিওতে একজন সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করছি, তখন অন্য আরেকজন সংগীত পরিচালক ফোন করে বলছেন, লাবুর কাজটা দ্রুত শেষ করে ওকে ছেড়ে দাও, ও আসার পরে আমরা কাজ শুরু করবো। একজন মিউজিশিয়ান হিসেবে সেটা ছিল আমার জন্য পরম পাওয়া।

সিনেমার কাজের সময়ে শুধু অ্যাকশন দৃশ্যগুলিতে গিটারে ডিস্টরশনের বিশেষ কদর ছিল! আরেকটা মজার অভিজ্ঞতা হলো, প্লেব্যাকে মিউজিক করার সময় গানটা কার লিপে যাবে সেটা মাথায় রেখে গানের টিউন বা গিটার পিস বানাতে হতো। একটা সিনেমার গানে খুব ভালো একটা গিটার পিস বানালাম কিন্তু অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এসে আমাকে বললেন যে, ‘এইটা কি বানাইছেন! এইটা এখানে চলবে না!’ আমি বললাম, এটা তো এই গানের সঙ্গে খুব ভালো যায়। তখন তিনি বললেন, ‘আপনি রাখলে রাখেন, আমিও এডিটিংয়ের সময় কাইটা দিমু, খালি আপনার গানের সঙ্গে ভালো গেলে হবে না আমার ছবির নায়িকার সঙ্গেও যাইতে হবে। আপনার মিউজিক এখানে নাচ ডিমান্ড করে কিন্তু আমার সিনেমার এই নায়িকা তো নাচতে পারে না, সে তো একবার বাম হাত তুইলা বাল্ব লাগায় আবার ডান হাত তুইলা বাল্ব খুলে!’ এছাড়া সেসময় আমার অন্যতম ভালো লাগার একটা কাজ ছিল প্রয়াত সংগীত পরিচালক সমর দাসের সহযোগী হিসেবে ১৯৮৬ সালের সাফ গেমসের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ করা। ঢাকা স্টেডিয়ামে সাফ গেমসে আমরা লাইভ বাজিয়েছিলাম।

‘ডিস্কো রেকর্ডিং’ ও বাংলাদেশের প্রথম অ্যালবাম

১৯৮০ সাল বের হওয়া বাংলাদেশের প্রখম অডিও ক্যাসেট এস এস শোয়েবের ‘১২ বছর আগের একদিন’-এর গিটার প্লেয়িং ছিল আমার। রেকর্ড লেবেল ছিল ডিস্কো রেকর্ডিং। ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের মালিক ছিলেন শাহিন ভাই। আমরা তাঁকে বলতাম ডিস্কো শাহিন। তাঁর অনেক অবদান আছে অডিও তথা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। নব্বইয়ের পর থেকে তিনি আমেরিকাতে থাকতেন তবে সেখান থেকেও তিনি আমাদের অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন। ডিস্কো রেকর্ডিং থেকেই মাইলস ব্যান্ডের প্রথম সিডি বের হয়। আমার মনে আছে, আমেরিকা থেকে কোনো একটা ট্যুর শেষে ফেরার সময় শাহিন ভাই আমাকে বিশাল একটি ব্যাগ দেন দেশে ফিরে মাইলসকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

দেশে-বিদেশে

প্রফেশনালি গিটার বাজানোর সূত্রে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে পুরো পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটাই ঘুরে ফেলেছি। যখন যে-দেশে গিয়েছি সে-দেশের গিটার স্কুলগুলিতে ঢুঁ মারতাম এবং তাদের টিচিং মেথড দেখার চেষ্টা করতাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শো করতে গিয়ে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা মন্দ লাগা তো অবশ্যই আছে, সেগুলি বলে শেষ করা যাবে না। অনেক বড় বড় ইভেন্টের পাশাপাশি এমন অনেক ছোট  বিষয়ও মনে দাগ কেটে আছে, যেমন আমি তো সাধারণত অন্য কোনো শিল্পীর সঙ্গে বাজাতে যেতাম, কিন্তু একবার নিউইয়র্কের একটি কান্ট্রি ক্লাবে প্রবাসী বাঙালিরা ‘লাবু রহমান নাইট’ আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপচেপড়া দর্শক দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওই সুদূর নিউইয়র্কেও আমার এত শ্রোতা, এত ভালোবাসা – এসবই আমার গিটার বাজানোর সূত্রেই। আরেকবার সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে সুইডেনে গিয়ে প্রথমবারের মতো আঙুর বাগান দেখে ঢিল মেরে আঙুর পেড়ে খাওয়ার মতো ছেলেমানুষি ঘটনাও মনে পড়ে। নিউজার্সিতে থাকাকালে আমার বাসার পাশের ছোট একটা ইন্সট্রুমেন্টের দোকানের পেছনে একটা গিটার স্কুলের ইন্সট্রাক্টরের মেথড আমাকে বেশ প্রভাবিত করে। সেটা অনেকটা ভাষা শিক্ষার মতো। কাগজে-কলমে ভাষা শিখতে অনেক সময় লাগে, কিন্তু ওই ভাষায় বাতচিৎ করলে খুব কম সময়ে একটা ফ্লুয়েন্সি চলে আসে আর বাক্যের গঠন শুনে শুনে বলতে বলতে ঠিক হয়ে আসে। সেখানেও গিটার বাজানোর  সময় কানে শোনাটাকে অনেক বেশি জোর দিতে দেখেছি। এই মেথডটা আমার পছন্দ হয়েছিল এবং পরে আমিও আমার স্টুডেন্টদের এই মেথডে শিখিয়েছি।

ফিডব্যাক

একসময় দেশে-বিদেশে স্টেজ শোতে বাজানো শুরু করি সলো শিল্পীদের সঙ্গে। বিশেষ করে সাবিনা ইয়াসমিন, এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ^জিৎ, বেবী নাজনীন, সাবাতানি, শেখ ইশতিয়াকসহ আরো অনেকের সঙ্গে। এই স্টেজ শোতে পারফর্ম করতে গিয়ে আমার মোটামুটি অর্ধেক দুনিয়া ঘোরা হয়ে গেছে। সম্ভবত ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সাবিনা ইয়াসমিনের শোতে ফিডব্যাকের মাকসুদুল হকের সঙ্গে গ্রিনরুমে দেখা। আমরা অনেকদিনের বন্ধু, তাই মাকসুদকে দেখে সহাস্যে এগিয়ে গেলে ও আমাকে সরাসরি বলে বসলো, ‘তুই এখন থেকে ফিডব্যাকের সঙ্গে বাজাবি।’

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন কী হয়েছে?’

ব্যাখ্যা না দিয়ে মাকসুদের পাল্টা প্রশ্ন, ’তোর আপত্তি আছে?’

আমি বললাম, ‘আপত্তি থাকবে কেন, আমি খুবই খুশি যে  তোরা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিস তোদের সঙ্গে বাজাতে।’

সে-সময় ফিডব্যাকের গিটারিস্ট সেলিম হায়দার রুনা লায়লার সঙ্গে বাজাতেন এবং আমি সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে বাজাতাম। সেলিম হায়দার রুনা লায়লার সঙ্গে ট্যুরে থাকলে আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার ফিডব্যাকের সঙ্গে বাজিয়েছি।

এভাবেই ১৯৮৬ সালে আমি ফিডব্যাকে জয়েন করি। আর ফিডব্যাকের সঙ্গে আমার বাজানো প্রথম স্টুডিও অ্যালবাম ‘মেলা’। ফিডব্যাকে আমার প্রথম কম্পোজ করা গান ‘ছোট পাখি’। ‘মেলা’ অ্যালবামের সফলতার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাইরে অর্থাৎ ভারতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফিডব্যাক। এরই সূত্র ধরে ভারতবর্ষের বিখ্যাত রেকর্ড লেবেল এইচএমভি থেকে প্রস্তাব আসে ফিডব্যাকের জনপ্রিয় গানগুলি নিয়ে একটা সংকলিত অ্যালবাম বের করার। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলা ব্যান্ডের জন্য অনন্যসাধারণ ঘটনা ছিল এই প্রস্তাব। বাংলাদেশের প্রথম  ব্যান্ড হিসেবে ভারতের কলকাতায় এইচএমভি স্টুডিওতে ১৫ দিন ধরে ‘জোয়ার’ নামক অ্যালবামটি রেকর্ড করি। এখানে বলে রাখি, আয়োজকরা আমাদের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ি থেকে শুরু করে আদর-আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি করেননি। ভারতে গিয়ে আমি আরেকটা জিনিস লক্ষ করেছি, ওখানে ওরা অনেক পরে বেইজ গিটার ব্যবহার করা শুরু করেছে। অনেক শো পারফর্ম করতে গিয়ে দেখেছি ওখানে আমাদের আগে যারা পারফর্ম করছে তারা বেইজ গিটার ইউজ করছে না। যা হোক জোয়ার অ্যালবামটা রিলিজের পর ভারতে ব্যাপক হিট হয়। পরে ১৯৯৪ সালে সাউন্ডটেক থেকে রিলিজ পায় ফিডব্যাকের পরবর্তী অ্যালবাম ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’। বিশাল সাইজের ক্যাসেট কাভারে রিলিজকৃত এই অ্যালবামটিও সমাদৃত হয় শ্রোতাদের কাছে।  বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাসফল অ্যালবামের তালিকায় সবসময়ই থাকে ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’।  সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর ‘সামাজিক কোষ্ঠকাঠিন্য’ বা ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’ এই গানগুলি শ্রোতারা পছন্দ করলেও বিটিভিতে এই গানগুলি আমরা করতে পারতাম না। যেমন বিটিভিতে গান প্রচারের আগে লিরিক পাঠাতে হতো। লিরিক রিভিউ করে সম্মতি প্রদান করলেই কেবল তখন বিটিভিতে গান প্রচার হতো। ফিডব্যাকের ‘আমার অহংকার, আমি জন্মেছি এই যুগে’ এই গানের লিরিক নিয়ে আপত্তি থাকায় এই গানটিও বিটিভিতে প্রচারিত হয়নি। ফিডব্যাক লিরিকের ক্ষেত্রে বরাবরই একটা স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে গেছে। উদাহরণস্বরূপ ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামে আমার গাওয়া গীতিকবি আহমেদ ইউসুফ সাবেরের লিরিকে ‘বিদ্রোহী’ গানটার কথা। ‘বিদ্রোহী’ গানটার অন্তরায় আছে ‘ক্লেদ যতো, ভেদ ততো’। ছন্দময় এই গানটায় কিন্তু তুলনামূলক অপ্রচলিত শব্দ রয়েছে। ফিডব্যাকের লিরিকের একটা বড় অংশ মাকসুদের। ও অবশ্য ইংরেজিতে লিরিক লিখে নিয়ে আসত এবং সেটি আমরা বাংলা করে নিতাম, অনেকটা ইংরেজি হরফে বাংলায় টেক্সট পাঠানোর মতো।

ফিডব্যাকে কম্পোজিশন করতাম মূলত আমি, ফোয়াদ নাসের বাবু এবং পিয়ারু খান। ‘বঙ্গাব্দ ১৪০০’ অ্যালবামের পরে ‘বাউলিয়ানা’ নামে একটা এক্সপেরিমেন্টাল অ্যালবাম রিলিজ পায়। এর পরে প্রয়াত আবদুর রহমান বয়াতীর সঙ্গে ‘দেহঘড়ি’ নামে একটা সিঙ্গেলস অ্যালবাম রিলিজ পায়। এই অ্যালবামের পরে মাকসুদ (মাকসুদুল হক) এবং খোকা (সেকান্দর আহমেদ) ব্যান্ড ছেড়ে যায়। তারা চলে গেলে পরবর্তীকালে ‘আনন্দ’ নামে একটা অ্যালবাম রিলিজ করি আমি, ফোয়াদ নাসের বাবু এবং পিয়ারু খান মিলে। অ্যালবামের গানগুলি আমার ভীষণ পছন্দ। এরপর ‘ফিডব্যাক ০২’ নামে আমাদের আরেকটি স্টুডিও অ্যালবাম রিলিজ পায়। এই অ্যালবামে ভোকাল হিসেবে কাজ করে রেশাদ মাহমুদ।

লাইভ শো

লাইভ শোতে বাজানো সবসময়ই অনেক এক্সাইটিং। অনেক অনেক স্মরণীয় শো আছে। তারপরেও বিশেষভাবে বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে নব্বইয়ের শেষে বামবার আয়োজনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে করা ওপেন এয়ার কনসার্টের কথা। এই কনসার্টই মূলত বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের গতিপথ বদলে দেয়। কারণ এর আগে আমরা এত শ্রোতার সামনে কখনো পারফর্ম করিনি। আরেকটা শো আছে দেশের ভেতরে, খুবই স্মরণীয়। এই শোটা হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে। তখন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খুবই খারাপ, তিনটি রাজনৈতিক সংগঠন পরস্পর মুখোমুখি। নিরাপত্তা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় চিন্তা করে আমরা আয়োজকদের জানিয়েছিলাম যে, তিন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা যদি আমাদের নিশ্চয়তা দেয় আমরা নির্বিঘ্নে প্রোগ্রাম করতে পারবো, শুধু তাহলেই আমরা স্টেজে উঠবো। এ পর্যায়ে সংগঠনগুলির নেতারা আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেখানে এসে আমাদের আশ^স্ত করেন। এত আয়োজন এবং অনিশ্চয়তার পর শুরু হলো বৃষ্টি। শোয়ের দিন সকাল থেকেই ঝুমবৃষ্টি। দুপুরে সাউন্ড চেকের জন্য স্টেজের ওখানে গিয়ে দেখি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার তেরপল দিয়ে সাউন্ড সিস্টেম ঢেকে মুখ কালো করে বসে আছেন। এত কিছুর পরেও শো হয়েছিল আর ওই শোতে হাঁটুপানিতে ভিজে শ্রোতারা গান উপভোগ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ^বিদ্যালয়ের আরেকটা শো আমার খুব প্রিয়। সেখানেও ঝুমবৃষ্টি ছিল; কিন্তু শ্রোতারা বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমাদের গান শুনেছেন। এছাড়া কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস অডিটোরিয়ামে করা আরেকটা শোয়ের কথা এখন মনে পড়ছে। শো করে কলকাতার হোটেলে ফিরে দেখি হোটেল লবিতে অনেক ভিড়। আমি আমার মতো করে রুমে চলে এলাম। একটু পরে মাকসুদ রুমে এলে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিচে কিসের ভিড়?’ সে বলল, ‘নিচে যা, তোকে খুঁজছে।’ নিচে গিয়ে দেখি স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স পরা এক লোককে ঘিরে এই বিশাল ভিড়। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তিনি কলকাতার জনপ্রিয় শিল্পী নচিকেতা। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ‘তোমার একটা গান আমি নিয়ে নিয়েছি, এখন তোমাকে কত দিতে হবে, অ্যানি অ্যামাউন্ট ইউ ক্যান আস্ক।’ আমি বললাম, ‘কোনো টাকা দিতে হবে না।’ তখন দেখি তাঁর চোখে জল। ফিডব্যাকের ‘দিন যায় দিন চলে যায়’ এই গান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নচিকেতা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গান ‘হাজার কবিতা, বেকার সবই তা’ (নীলাঞ্জনা)।

রেকর্ড লেবেল

নব্বইয়ের শুরু থেকেই বাংলাদেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক রেকর্ড লেবেল কোম্পানি চলে আসে। যেহেতু তারা ছিল বিনিয়োগকারী, বাণিজ্যিক দিকটিই ছিল তাদের কাছে মুখ্য। তারা যতটুকু সম্ভব কম পয়সা দিয়ে অ্যালবাম বানিয়েছে আর ব্যবসা করে চলে গেছে। যেটা হয়তোবা সব দেশেই হয়েছে প্রথমদিকে। বেশিরভাগ ব্যান্ড বা শিল্পী হয়তো সেসময় চিন্তাই করেননি যে, অ্যালবাম বের করে টাকা কামাবেন। বিশ-তিরিশ বা পঞ্চাশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে এক একটা অ্যালবাম থেকে রেকর্ড লেবেলগুলি আয় করেছে পাঁচ-দশ লাখ টাকা। তারা ছিল খুব ভালো ইনভেস্টর। তারা এসেছে, ব্যবসা করেছে, চলে গেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কোনো ব্যান্ডের অ্যালবামই ফ্লপ হয়নি। সবাই ভালো ভালো কাজ করেছে। তবে তাদের মধ্যে সারগামের মতো কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। সারগাম শুধুমাত্র রেকর্ড লেবেল কোম্পানিই ছিল না, বরং এর থেকেও বেশি ছিল এর অবদান। কাকরাইলে সারগামের রেকর্ডিং স্টুডিওর একটা বড় অবদান রয়েছে নব্বইয়ের ব্যান্ড মুভমেন্টের পেছনে। এই দশকের শুরুতে কাকরাইলে সারগামের রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল ব্যান্ডগুলির মিলনমেলা। এখানে সব ব্যান্ডের সদস্যরা ভিড় করতেন, আড্ডা চলতো সারাদিন। কে কী রেকর্ড করছে, বাজাচ্ছে – এই নিয়ে সবসময় সরগরম থাকত সারগামের রেকর্ডিং স্টুডিও। আইডিয়া শেয়ারিং হতো বিভিন্ন ব্যান্ডের সদস্যদের মধ্যে। খুবই ভালো সময় ছিল সেটা।

গিটার ভাবনা

আমাদের দেশে ব্যান্ড মিউজিকের প্রচলন হয়েছে বহুদিন ধরে। যদি ১৯৬৩ থেকেও ধরি, তাও প্রায় ৬০ বছর। এর মধ্যে অনেক কিছু হলেও এই যন্ত্রসমূহ সঠিকভাবে বাজানোর জন্যে বা মিউজিকের এই ধারাটা চর্চা করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। কোনো গিটার ইনস্টিটিউট বা ড্রামস ইনস্টিটিউট দূরে থাক, আমার জানামতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা এ-জাতীয় কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিটার সংক্রান্ত কোনো কোর্স চালু করা হয়নি। অন্তত আমার কাছে এখন পর্যন্ত এ-জাতীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে প্রশিক্ষণের বিষয়ে কোনো প্রস্তাব আসেনি।

নব্বইয়ের দশকে ব্যান্ড মিউজিকের উত্তুঙ্গ সময়ে শ্রোতারা আমাদের গ্রহণ করেছিলেন, কারণ সে-সময় ব্যান্ড মিউজিক প্রচলিত ধারার বাইরে নতুন সাউন্ড নিয়ে এসেছিল এবং লিরিকও ছিল বৈচিত্র্যময়। তবে ২০০০-পরবর্তী সময়ে একটা শূন্যতা এসেছে ব্যান্ড মিউজিক দৃশ্যপটে। এ সময় অনেক শিল্পী গান গাওয়া ছেড়ে দেন। তাঁদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মানহীন রিমেক গান দিয়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি সয়লাব হয়ে যায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে যাঁরা আমাদের শ্রোতা ছিলেন তাঁরা তাঁদের সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের প্রিয় গানগুলি পৌঁছে দিতে পারেননি। ফলে দুই হাজার সালের পরে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম আমাদের আশি ও নব্বইয়ের দশকের ব্যান্ডগুলির গান না শুনে ইংরেজি বা অন্য ভাষার গান শুনছে।

কীভাবে কীভাবে আমি আজকের আমি হয়ে উঠলাম তা আমি নিজেই বলতে পারি না। আমার শুধু মনে পড়ে একটা শো দেখতে গিয়ে একজন গিটারিস্টের ঐশ্বরিক বাজনা শুনে ছয় তারের এই যন্ত্রটার প্রেমে পড়েছিলাম, সেই প্রেম আজো চলমান। গিটার বাজিয়ে অনেক টাকা উপার্জন করতে হবে বা বিখ্যাত হতে হবে – এমনটা কখনো কল্পনাও করিনি। আমি শুধু জানতাম, ছয় তারের এই যন্ত্রটা বাজানো শিখতে হবে, বাজাতে হবে। গানের দোকান থেকে অ্যালবাম কিনে এনে গান শুনে গিটারে তোলা … এখনো গান তুলি, নিজের পছন্দের গান বাছাই করে। পঞ্চাশ বছর আগে শখ করে গিটার হাতে তুলে নিয়েছিলাম। মাঝে একটা দীর্ঘ সময় প্রফেশনালি গিটার বাজিয়েছি, এখন আবার মনের আনন্দে শখের

গিটার বাজাই, অনেকটা চক্রপূরণের মতো। এই মুহূর্তে ভাবছি, পুরনো ব্যান্ডগুলিকে কীভাবে আবার প্রমোট করা যায় বা কিভাবে আবার একসঙ্গে কাজ করা যেতে পারে। আমেরিকায় একবার শো করতে গিয়েছি, আমার স্ত্রী আর মেয়েও ছিল আমার সঙ্গে, নিউইয়র্কের ফর্টি টু স্ট্রিটে পিজ্জা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার স্ত্রীকে বলছিলাম, আমার নিজেকে সাকসেসফুলই মনে হয়, আমি কোথাকার কোন সামান্য গিটারিস্ট অথচ জীবনকে কতভাবেই না এক্সপ্লোর করলাম, তোমাদের সঙ্গে নিয়ে উপভোগ করলাম …!