লাল বেনারসি

আলমারিটা খুলতেই একগাদা জিনিস ঝপ ঝপ করে মাটিতে ঝরে পড়ল। পুরনো কাপড়, বাদামি কাগজের প্যাকেট, ভাঙা কাচের চুড়ি ও আরো বেশ কিছু টুকিটাকি জিনিস। বোঝা গেল, স্থানাভাবে জিনিসগুলি আলমারিতে রাখা হয়েছিল খুবই ঠাসাঠাসি করে। পুরনো দিনের নীল রঙের স্টিলের আলমারি। জায়গায় জায়গায় জং ধরেছে। আলমারিটায় লম্বা একটা কাচ লাগানো রয়েছে। তবে সে কাচের পারদেও কিছু জং চোখে পড়ে। বিশেষ করে কাচের কোনার দিকগুলিতে। দেখলেই বোঝা যায়, এ- বাড়িটার   মতো  এ-আলমারিটারও   অনেক   বয়স   হয়েছে।  আসলে এ-বাড়ির সবকিছুই বেশ পুরনো। কারণ বাড়িটাই তো পুরনো। প্রায় আশি বছর আগে আমাদের দাদা খান সাহেব নজিরউদ্দীন আহমেদ পাবনা শহরে এ-বাড়িটা বানিয়েছিলেন। তখনকার দিনের নির্মাণ যেরকম হয়, বেশ মজবুত ইট ও কড়ি-বরগা দিয়ে বানানো দোতলা এই হলুদ বাড়িটা। জানালাগুলিতে কাঠের খড়খড়ি দেওয়া, যা দেখতে বেশ নান্দনিক লাগে। বাড়িটাতে ছাদে ওঠার ঘোরানো একটা লোহার সিঁড়ি আছে, যা অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। সব মিলিয়ে বাড়িটা যে একসময় বেশ দৃষ্টিনন্দন ছিল তা এখনো বোঝা যায়। ছিল বলছি কারণ বাড়িটার সব কিছুরই বর্তমানে একটা ভগ্ন রূপ। আসলে বাড়িটার আর দোষ কী! ভালোভাবে দেখভাল করবে তেমন তো কেউ নেই। বাবা-মা দুজনেই  গত হয়েছেন দশ-বারো বছর আগে। আমাদের ছয় ভাইবোনের বড় ভাই ও বড় বোনও আর নেই। ছোট ভাইটা অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। সেজ বোন নওরীন ইংল্যান্ডে আর আমি থাকি আমেরিকার ডালাসে। বাড়িটাতে থাকত কেবল আমাদের সবার ছোট বোন শারমিন। শারমিনের বিয়ে হয়নি। তবে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে এ-প্রসঙ্গটি এলে বাইরের লোকজনকে অবশ্য আমরা বলতাম, ‘শারমিন বিয়ে করতে চায় না।’ আসলে শারমিনের ব্যাপারে আমাদের ভাইবোনদের সবার একটা গভীর দুঃখবোধ ছিল। শারমিনের বয়স যখন পনেরো-ষোলো বছর তখন পাড়ার একটা তেমন-কিছুই-করে-না ছেলের সঙ্গে ওর প্রেম হলো। আমাদের বড় সরকারি চাকুরে দাপুটে বাবা ও তাঁর একান্ত অনুগত আমাদের মায়ের তীব্র বাধার কারণে সে-প্রেম কোনো পরিণতি পায়নি। ক্রমে আমাদের অন্য বোনদের একে একে ভালো বিয়ে হলেও শারমিন গোঁ ধরে বসল যে, ও বিয়ে করবে না। মনে আছে, একবার এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে ওর বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে মা ঢাকার মিরপুরের বেনারসিপল্লি থেকে লাল রঙের সুন্দর একটা বেনারসি শাড়ি অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনিয়েছিলেন। শারমিনের জেদের কারণে সে-বিয়েটা আর হয়নি। সেই থেকে আমরা অন্য ভাইবোনেরা দেশে-বিদেশে থাকলেও শারমিন এ বাড়িটাতে একাই থেকে গেছে। যতদিন বাবা-মা বেঁচে ছিলেন ও বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল। বাবা স্বল্পভুগে মারা গেলেও মায়ের অসুস্থতা ছিল বেশ দীর্ঘদিনের। শারমিন বছরের পর বছর মায়ের সঙ্গে থেকে তাঁর দেখাশোনা করত। আমরা ভাইবোনেরা তাতে কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলাম। মাসে মাসে কিছু ডলার-পাউন্ড পাঠিয়ে আমরা তখন আমাদের নিজেদের বিবেকবোধটা পরিষ্কার রেখেছি।

তবে মা মারা যাওয়ার পর থেকে শারমিন পুরোই একা হয়ে পড়ে। বাড়িটা ও তখন একাই দেখাশোনা করত। পাবনা শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে চরে আমাদের যে কিছু জমি ছিল শারমিন সেখানেও যেত। বর্গাদারদের কাছ থেকে ধান আর টাকা নিয়ে আসত। বাড়ির দু-একজন পুরনো কাজের লোক নিয়ে ওর মতো করে শারমিন ওর জীবনটা চালিয়ে নিচ্ছিল। আমরা টেলিফোনে মাঝে মাঝে ওকে বিয়ের কথা বললে ও ক্ষেপে উঠত। বলত, আমি বেশ ভালো আছি। আমাকে বিয়ে-শাদির কথা বলবেন না। ভালো হয়তো ও ছিল। কিন্তু একটা বিষয়ে ওর ঝোঁক গেল বেড়ে। তা হচ্ছে – খাওয়া। এমনিতে আমাদের বাড়িতে নানা ধরনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা বেশ বড়সড়ই ছিল। বাবা খেতে ভালোবাসতেন। আর মা রান্নাও করতেন খুব ভালো। বাড়িতে সব সময়ই তাই থাকত নানা রকমের প্রচুর খাবার। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অন্যরা তাদের মতো করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সংযমী হলেও শারমিন বেশি পরিমাণে খাওয়াটা চালিয়েই গেছে। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তা আরো বেড়েছিল। প্রচুর খেত ও এবং দিন দিন ও খুবই স্থূলকায় হয়ে পড়ছিল। ওর শরীর যেরকম মোটা হয়ে গিয়েছিল তাতে ও চাইলেও ওকে যে কেউ বিয়ে করতে চাইবে – সে-সম্ভাবনাও ক্রমশ কমে আসছিল। ক্রমে ওর বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছিল। তারপরও আমরা ভাইবোনেরা নানাভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু শারমিনের বিয়ে আর হয়নি। এভাবেই চলছিল ওর জীবন। এ-মাসের প্রথম সপ্তাহে এক রাতে হঠাৎই আমরা খবর পেলাম যে শারমিনের স্ট্রোক করেছে। বেশ বড় রকম স্ট্রোকই ছিল সেটা। এবং শেষমেশ চরম বেদনার শেষ খবরটা পেলাম যে, হাসপাতালে নেওয়ার কিছু পরেই শারমিন মারা গেছে।

শারমিনের মৃত্যুর কারণেই ডালাস থেকে আমি ও বার্মিংহাম থেকে নওরীন এবারে দেশে এসেছি। ঢাকা থেকে গাড়িতে পাবনা যাওয়ার পথে সবার ছোট বোনটার এরকম করুণ মৃত্যু এবং শারমিনের জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে আমি আর নওরীন আলাপ করছিলাম। নওরীনের বেশ পড়াশোনা আছে। ইংল্যান্ডের এক বিশ^বিদ্যালয়ে ও এখন সমাজবিজ্ঞানে পিএইচ.ডি করছে। ও বলল : ‘মেজআপা, এ-ধরনের অতিরিক্ত খাওয়ার ঝোঁক জীবনে ফ্রাসটেশন থেকে আসে।’ এজাতীয় মানসিক উপসর্গের একটা ইংরেজি নামও বলেছিল ও।

পাবনার বাড়িতে এলেই আমার কেমন জানি অন্য এক রকম অনুভূতি জাগে। বাবা-মায়ের স্মৃতি, অল্প বয়সে আমাদের ভাইবোনদের নানা ঘটনার কথা ও আমার নিজের জীবনের নানা কাহিনি মনে পড়ে যায়। এ এক সুখদ বেদনার অনুভূতি। মাত্র একটা রাতই থাকব আমরা। এর মধ্যে বাড়িটার বিষয়ে বাস্তব কিছু খুঁটিনাটি কাজও সারতে হবে আমাদের। তবে সবচেয়ে বড় যে কাজ নিয়ে আমরা এসেছি তা হচ্ছে শারমিনের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্রের একটা সুরাহা করা। প্রায় দু-সপ্তাহ হলো শারমিনের মৃত্যু হলেও ওর নিজস্ব ব্যবহারের পুরনো নীল আলমারিটা এখনো খোলা হয়নি। আমাদের আসার অপেক্ষায় ওটা ওরকমই রাখা ছিল।

আজ সকালে সে আলমারিটা খোলা হয়েছে। খুব বেশি সময় নেই আমাদের হাতে। দুপুরের খাওয়ার পরই গাড়ি নিয়ে আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে। নওরীনের ফ্লাইট আগামীকাল। আমার ফ্লাইট একদিন পরে হলেও ঢাকায় কাল আমার বর জাফরের কিছু কাজ আছে। ফলে আজই আমরা পাবনা ছাড়ছি। আলমারি খোলার পর প্রথমে যা ঝর ঝর করে পড়েছিল সেসব কুড়িয়ে তুলে রেখে নওরীন বলল : ‘মেজ আপা, সোনার গহনাগুলি আগে দেখি।’ বস্তুত এ-ব্যাপারটায় আমরা কিছুটা উদ্বিগ্নই ছিলাম। বিভিন্ন সময় শারমিনের জন্যে কিছু সোনার গহনা বানানো হয়েছিল, গলার হার, কানের দুল, টিকলি – এই সব। তাছাড়া মা ওর বিয়ের জন্যে সোনার ভারি জড়োয়া গহনার একটা সেটও তৈরি করে রেখেছিলেন। সে সবই পাওয়া গেল। গহনাগুলি অক্ষত পেয়ে আমরা দুজনেই কিছুটা স্বস্তি পেলাম। নওরীন একটু দীর্ঘ নিশ^াস ফেলে বলল : ‘এত গয়না ছিল শারমিনের! ও যদি বিয়েটা করতে রাজি হতো!’ শারমিনের জীবনটা যেমন অগোছালো হয়ে পড়েছিল তেমনি ওর জিনিসগুলি রাখার ধরনটাও লক্ষ করলাম বেশ অগোছালো। কিছু জামা-কাপড়ের মধ্যেই হয়তো কিছুু কাগজপত্র। হয়তো জমিজমা-সংক্রান্ত দরকারি একটা ফাইল। আবার তার পাশেই ওর ছোটবেলার প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো কোনো কাপড়ের পুতুল। সব কিছুই কেমন যেন অবিন্যস্তভাবে রাখা। কেবল তার মাঝে একটা প্যাকেট খুঁজে পেলাম যেটা খুব যত্ন করে যে রাখা হয়েছে তা বোঝা যায়। বড় ওই প্যাকেটটা আলমারি থেকে নামানো হলো। পুরো প্যাকেটই বেশ ভালো করে পলিথিনে মোড়ানো, যাতে পানি বা ধুলো ভেতরে কোনো ক্ষতি করতে না পারে। ওপরের পলিথিনটা খোলা হলো। তার ভেতরে পাওয়া গেল মোটা বাদামি কাগজ দিয়ে মোড়া আরেকটা বড় প্যাকেট। কাগজের আবরণটা ছেঁড়া হলো। ভেতরে দেখা গেল একটা শাড়ির দোকানের প্যাকেট। প্যাকেটের ওপরে ঢাকার মিরপুরের এক দোকানের নাম বড় করে লেখা। ততক্ষণে আমাদের দুজনেরই কৌতূহল অনেক বেড়েছে। বেশ পুরনো প্যাকেটই। নওরীন তাই এবার প্যাকেটটা খুব সাবধানে খুলল। আর প্যাকেটটা খুলতেই ভেতরটা এক উজ্জ্বল লাল আলোয় চকচক করে উঠল। টকটকে লাল রঙের একটা বেনারসি শাড়ি। শাড়িটা চিনতে পারলাম আমরা। প্রায় বছর পনেরো আগে এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সঙ্গে শারমিনের বিয়ের যখন কথাবার্তা চলছিল মা তখন এ-শাড়িটা শারমিনের জন্যে বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে ঢাকার মিরপুরের বেনারসিপল্লি থেকে বানিয়ে আনিয়েছিলেন। নওরীনও বিস্মিত হলো শাড়িটা দেখে, বলল : ‘আপু দ্যাখো, সেই শাড়িটা!’ তারপর কেমন যেন অদ্ভুত কণ্ঠে বলল : ‘দেখেছিস আপা … শারমিন কত যত্ন করে শাড়িটা রেখে দিয়েছিল! … ও যে কেন বিয়ে করতে চাইল না!!’