শিল্পীর ভুবন ও রূঢ়-সমকাল

জাহিদ মুস্তাফা

মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সে, তবু সে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে, অন্যের সঙ্গে মেলায়। মানুষ কি পারে নিজেকে আবিষ্কার করতে? চেষ্টা করলে হয়তো সম্ভব। নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেন দার্শনিকরা। সক্রেটিস তো কবেই বলেছিলেন – নিজেকে জানো। সে-জানা কি এখনো অজানা! সব হয়তো জানা হয়নি, তবে সৃজনশীল মানুষ নিয়ত নিজেকে খোঁজে, আত্মবিশেস্নষণ করে।

এখন নিজ চিত্রপটে যেমন শিল্পী রণজিৎ দাস নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করে বিশেস্নষণ করছেন। শান্ত, ধীর মানুষটা নিজের অবচেতনের অশান্ত দ্রোহের আগুনকে দীর্ঘ অবয়বের অভিব্যক্তিতে তুলে আনছেন ক্যানভাসে। তাঁর এই দ্রোহ কি দুনিয়ার অসাম্য নিয়ে, নাকি নিজেকে অতিক্রম না করতে পারার অপার যন্ত্রণা থেকে উদ্ভূত? এ-প্রশ্নটি মনে আসে শিল্পীর সাম্প্রতিক কাজ দেখে।

এক বৃষ্টিসিক্ত বিকেলে ঢাকার উত্তরায় গ্যালারি কায়ায় দেখতে গিয়েছিলাম শিল্পী রণজিৎ দাসের ২৩তম একক চিত্রপ্রদর্শনী। শিল্পী এর শিরোনাম দিয়েছেন – ‘জার্নি ও ইমেজগুলো’। প্রদর্শনীতে সাম্প্রতিককালে আঁকা শিল্পীর ৪২টি চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। শিল্পী কাজ করেছেন ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে আর কাগজে কালি ও চারকোলে।

শিল্পী রণজিৎ দাস চিত্রকলায় সণাতক সম্পন্ন করেন ১৯৭৫ সালে ঢাকার চারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে। তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল ঢাকায় জয়নুল গ্যালারিতে ১৯৮১ সালে। ওই বছর তিনি ভারতের গুজরাটের বরোদায় মহারাজ সোয়াজি রাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপমহাদেশের  কৃতীশিল্পী অধ্যাপক কেজি সুব্রহ্মণ্যনের তত্ত্বাবধানে চিত্রকলায় সণাতকোত্তর সম্পন্ন করে সদ্য দেশে ফিরেছেন। তখন আমি ঢাকার চারুকলার শিক্ষার্থী ছিলাম। ফলে প্রথম প্রদর্শনীসহ তিন যুগ ধরে ঢাকার বিভিন্ন চিত্রশালায় আয়োজিত তাঁর প্রায় সব প্রদর্শনী আমি দেখেছি। তাঁর দীর্ঘ শিল্প-অভিযাত্রা ও বাঁকবদলের সঙ্গে আমার দেখার যোগাযোগও বোধ করি প্রায় গোড়া থেকে।

তিনি শুরু করেছিলেন প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে। প্রথমদিকে শিল্পী রণজিৎ দাসের ঝোঁক ছিল নিসর্গের নানা বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তোলায়। তখন তাঁর চিত্রপটে মানুষ আসত প্রধানত প্রকৃতির অনুষঙ্গ হয়ে। নিসর্গের সৌন্দর্য ও তার অমত্মঃসলিলা রূপের প্রতি আকর্ষণ মনে নিয়ে তিনি সেই সুন্দরের ধ্যানে ছবি আঁকতেন। সে-সময় তাঁর বর্ণপ্রয়োগে তুলনামূলক উজ্জ্বল রঙের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল। শিল্পীর কিছু কাজে আমরা বাগানের আবহ এবং আলোছায়ায় ফুল ও পাতার নন্দিত রূপ প্রত্যক্ষ করেছি। দেখায়, আঁকায় তিনি বরাবর অনুপুঙ্খ বিশেস্নষক।

গত নববইয়ের দশক থেকে রণজিৎ দাস তাঁর চিত্রপটে মানুষের শরীরকাঠামো নিয়ে আসেন। গ্রামের বালক-বালিকা, তাদের কোলে ছাগলছানা, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অবয়ব ইত্যাদি বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে তাঁর কাজে। এ-সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক আর্টক্যাম্পে শিল্পীর সহযাত্রী হিসেবে তাঁর কাজের কৌশল দেখেছি। সবুজ, হলুদ ও কালচে রঙে তিনি প্রকৃতি ও রূপের অনুবাদ করেছেন। প্রকৃতি-সংলগ্ন থেকেও মানুষের শরীরের নানারকম মোচড়, ক্ষিপ্রতা ও গতি তাঁর চিত্রের বিষয় হতে থাকে। তারপর একযুগ ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি রণজিতের কাজে আরো পরিবর্তন ঘটেছে। গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে নগরজীবনের নানা গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে শিল্পীর চিত্রকর্মের বিষয়-আশয়।

শিল্পী রণজিৎ দাসের এবারের প্রদর্শনীতে তাঁর চার দশকের শিল্পচর্চার অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধি প্রত্যক্ষ করা গেল। কিছুকাল আগের কাজে ফিগারের যে-গতিময়তা দেখেছি, তার সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে মুখাবয়বের অভিব্যক্তির তীব্রতা। এডওয়ার্ড মুঙ্ক-অংকিত চিৎকারচিত্রের মতো তীব্র না হলেও রণজিতের কাজে মানুষের ভেতরকার আবেগ যেন অবয়বের স্বাভাবিকতাকে অতিক্রম করে গেছে। তাঁর আঁকা ‘মানবিক জটিলতার সমাধানে’ শীর্ষক চিত্রটিতে আমরা দেখতে পাই এক কামুক পুরুষের উৎফুলস্ন দাঁতাল অবয়ব। ক্যানভাসের দুপাশে শিল্পী সণানরত নারীর নগ্নরূপ আঁকায় দর্শকদের সহজেই ঘটনাটির সারমর্ম বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। এর মানে হচ্ছে – শিল্পী তাকিয়েছেন মানুষের ভেতরকার অসুস্থ মানসিকতার দিকে। অভব্যতার এই আদিরূপ মানুষ ঢেকে রাখে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি বোধ দিয়ে। ফাঁক পেলেই মানুষের এই অশুভ চেহারা বিকটাকার ধারণ করতে পারে – শিল্পী সে-ইঙ্গিত রেখেছেন তাঁর চিত্রকর্মে।

‘আত্মদ্বন্দ্ব’ শিরোনামের চিত্রে শিল্পী আত্মানুসন্ধানও করেছেন। ক্যানভাসের কেন্দ্রস্থলে নিজের দুটি প্রতিকৃতির অভিব্যক্তিতে মনের ভেতরকার দ্বান্দ্বিকতা মেলে ধরেছেন। এ দ্বন্দ্ব হয়তো শিল্পসৃজনের নান্দনিকতার সঙ্গে শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার। রণজিৎ দাস এ-দুটি বিষয়কে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। সৌন্দর্যের অন্বেষণ করেছেন আবার মানুষের অবচেতনের কদর্যরূপটিও তুলে এনেছেন।

লোভনীয় জীবন শিরোনামে একাধিক চিত্রে শিল্পী তুলে ধরেছেন স্বাভাবিক জীবনের যথাযথ পথচলা থেকে বিচ্যুত হওয়ার ইঙ্গিত। এর ১-সংখ্যক চিত্রটিতে আমরা দেখতে পাই জনৈক নারীর লাস্যময়ী অবয়ব। পোশাকি জীবনে নারীকে যে-পণ্য করা হচ্ছে শিল্পী যেন সেদিকে দর্শকের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। আবার মানুষের ভালোর সঙ্গে মন্দের যে-দ্বন্দ্ব সেটি শিল্পী তুলে ধরেছেন দুটি নারী অবয়বে মানসিক সংগ্রামকে চিত্রিত করে। আরেকটি চিত্রের শিরোনাম শিল্পী দিয়েছেন – সামাজিক দ্বন্দ্ব। নারীর অসহায়ত্বকে তুলে ধরেছেন চিত্রপটে একাধিক মুরগি ইমেজ দিয়ে। আবার হাসিখুশি নারী-অবয়ব শিল্পী তুলে ধরেছেন প্রফুলস্ন মন নামের চিত্রে। দেখা যাচ্ছে, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুই-ই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন রণজিৎ দাস তাঁর সচেতনতা দিয়ে।

মানুষের সুন্দর ইচ্ছা – সুখী জীবনের প্রত্যাশা শিরোনামের চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে। ক্যানভাসের কেন্দ্রে প্রিয়জনের জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষারত এক তরুণীর অভিব্যক্তি এঁকেছেন শিল্পী। অন্তর্গত প্রতিবিম্ব শিরোনামে আরেকটি চিত্রে চুলহীন এক নারী অবয়ব এঁকেছেন শিল্পী, সে-নারীর কান থেকে ঘাড়ের অংশে দণ্ডায়মান আরেকটি নারীমূর্তি সংস্থান করা হয়েছে; তার হাতে ফুল। তরুণীর নিজের মনের ভেতরকার দ্বন্দ্বকেই যেন চিত্রপটে ধরা হয়েছে।

নাগরিক জীবনে ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইস ব্যবহার ব্যাপক বেড়েছে। নবীন প্রজন্ম থেকে শুরু করে আজকাল বয়সী মানুষরাও নিজের হাতের স্মার্টফোন নিয়ে মহাব্যস্ত। সেদিকেও দৃকপাত করেছেন শিল্পী –  ইলেকট্রিক যন্ত্র দিয়ে ধারণ এবং একটি অবর্ণনীয় নিমজ্জনের গল্প নামের চিত্রের মাধ্যমে। মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতায় ভাবিত শিল্পী আরেকটি চিত্রে উপস্থাপন করেছেন এ-বিষয় সম্পর্কে। এটির শিরোনাম দিয়েছেন – নিজের পৃথিবী নিয়ে জনৈকের ব্যস্ততা।

জড়জীবন শীর্ষক চিত্রের গড়নও ভিন্ন রণজিতের ক্যানভাসে। অ্যাক্রিলিক ও তেলরঙে শিল্পী বেশকটি জড়জীবন এঁকেছেন। চিত্রপটে কাচের বোতল, কেডস, রঙের ডিববা, পেইন্টিং ব্রাশ, হাতপাখা এসব নানান কিছু নিয়ে চিত্রগঠন করেছেন শিল্পী। জড়জীবন এঁকে দর্শকদের যেন একটু মুক্তি দিয়েছেন সামাজিক অস্থিরতার ভারি বিষয় থেকে।

গ্যালারি কায়ার আয়োজনে এ-প্রদর্শনী চলে ১১ থেকে ২৫ মার্চ, ২০১৭ পর্যন্ত। r