সন্তানবৎ

স্রোতস্বিনী পদ্মা কত কিছুই না ভাসিয়ে নেয়! কখনো ঘর, কখনো বাড়ি। কখনো শস্যক্ষেত, গাছপালা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট। কখনো মানুষও। এবার ভাসিয়ে এনেছে একপাল মোষ। ভাসতে ভাসতে তারা আরো ভাটিতে, পদ্মা-যমুনার সঙ্গমস্থলে, কিংবা দূর বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারত। যেতে দেয়নি বিজিবি। ইউসুফপুর ক্যাম্পের বিজিবি উদ্ধার করেছে সাতটি মোষ এবং আলাইপুর ক্যাম্পের বিজিবি নয়টি। এদিকের সীমান্ত প্রহরীরা চিরপ্রবাহিনী পদ্মা থেকে প্রায়ই নানা কিছু উদ্ধার করে। উজান থেকে দরকারি-অদরকারি অনেক কিছু ভেসে আসে। বর্ষায় ভেসে আসে ঘর, বড় বড় গাছ, লাঙল, জোয়াল, চেয়ার, টেবিল, দেবী দুর্গার ভাঙাচোরা প্রতিমা, সরস্বতীর বীণা, গণেশের শুঁড়। গত বছর আলাইপুর ক্যাম্পের বিজিবি উদ্ধার করেছিল দুটি চোরাই মোষ। খারিজাগাতীর চর থেকে চুরি করে আনা হচ্ছিল। দুই চোর তাদের শার্ট, মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ গামছায় পেঁচিয়ে মোষের শিংয়ে বেঁধে দিয়েছিল। তারা সাঁতরে পার হচ্ছিল মোষের লেজ ধরে। মাঝনদীতে এলে তারা ভেসে যায় স্রোতে, মোষগুলি সাঁতরে চলে আসে এপারে। এবারের বর্ষায় ইউসুফপুর বিজিবি উদ্ধার করে বেনোজলে ভেসে আসা একটা হাতির বাচ্চা এবং সেগুন কাঠের আটটি পাইল। হাতির বাচ্চাটা পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজশাহী চিড়িয়াখানায় এবং পাইলগুলি কাস্টমসে।

ইউসুফপুর ক্যাম্পের কমান্ডার ভেবেছিলেন মোষগুলি ইন্ডিয়া থেকে ভেসে আসা। তিনি অপেক্ষা করছিলেন বিএসএফের পক্ষ থেকে কোনো লেটার আসে কি না। ইউপি চেয়ারম্যান প্রস্তাব দিয়েছিলেন মোষগুলি তাঁর জিম্মায় দিয়ে দিতে, তিনি দেখবেন ব্যাপারটা, সন্তোষজনক পার্সেন্টেজ পেয়ে যাবেন কমান্ডার। উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিয়েও কমান্ডারকে ফোন করিয়েছিলেন। কমান্ডার রাজি হননি। পারতপক্ষে তিনি অবৈধ কোনো প্রস্তাবে রাজি হন না। প্রায়ই নানা প্রস্তাব আসে তাঁর কাছে। ইউসুফপুর সীমান্তবর্তী এলাকা, চোরাচালানের প্রাচীন রুট, আসাটাই স্বাভাবিক। কখনো আইনের ভয় দেখিয়ে, কখনো হেসে উড়িয়ে দিয়ে আর কখনো কৌশলে প্রত্যাখ্যান করেন সেসব প্রস্তাব।

ওদিকে আলাইপুর ক্যাম্পের কমান্ডারকে এক গরু ব্যাপারী প্রস্তাব দিয়েছিল যে, নয়টি মোষের দাম কমপক্ষে আট লাখ উঠবে নিলামে। কী দরকার নিলামে তোলার? সে পাঁচ লাখ দিতে রাজি। কেউ কিছু জানবে না, সব গোপনে সারা হবে। কমান্ডার বলেছেন, এফএস অলরেডি জেনে গেছে, খবর চলে গেছে ব্যাটালিয়ন সদর দফতরে। ব্যাপারী বলেছিল, কমান্ডার যেন সদর দফতরকে ম্যানেজ করে নেন। প্রয়োজনে সে আরো এক লাখ বাড়িয়ে দেবে। কামান্ডার বলেছেন, সদর দফতর কাকে বলে তোমার ধারণা আছে মিয়া? বদলি তো হবোই, চাকরিও থাকবে কি না সন্দেহ।

মোষগুলি উদ্ধারের তৃতীয় দিন দুপুরে ইউসুফপুর ক্যাম্পের মাঠে হাবিলদারের সঙ্গে সীমান্তের স্মাগলিং নিয়ে আলাপ করছিলেন কমান্ডার। সীমান্তে হুন্ডি ব্যবসা বেড়ে গেছে। ইন্ডিয়া থেকে পেঁয়াজ ও পাথর আমদানি এবং গরু চোরাচালানের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। আসছে বিদেশি অস্ত্র, হেরোইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য। সীমান্ত পয়েন্টগুলিতে টহল জোরদারের বিষয়ে হাবিলদারকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন কমান্ডার। তখন সেন্ট্রি এসে খবর দিলো যে, গোদাগাড়ী থেকে এক লোক এসেছে, উদ্ধারকৃত মোষগুলি তার বলে দাবি করছে। কমান্ডার বললেন, তাকে নিয়ে এসো এখানে, কথা বলে দেখি।

পঞ্চাশের মতো হবে লোকটির বয়স। গায়ে নীল ফতুয়া, পরনে কালো প্যান্ট, চেহারায় দূর-পথ-জার্নির ক্লান্তি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিভৃত কোনো পল্লির মানুষ, পোশাক কিংবা ফ্যাশন সম্পর্কে যার কোনো সচেতনতা নেই। হাত তুলে সে সালাম দিলো। মাথা নাড়লেন কমান্ডার। লোকটির চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন বাটপার, না ভদ্রলোক। এর আগে আরো দুজন এসেছিল মোষের দাবি নিয়ে। কেউ সঠিক প্রমাণ দিতে পারেনি।

কী নাম আপনার?

গণি, ছ্যার। হ্যামার নাম আবদুল গণি।

বাড়ি কোথায়?

গোদাগাড়ী।

গ্রাম?

নীলবোনা।

আপনার কটি মোষ হারিয়েছে?

হু ছ্যার, ষুলোডা।

কিন্তু আমরা তো উদ্ধার করেছি সাতটি।

ছ্যার, হ্যামি খবর পানু আলাইপুর ক্যাম্পেও বুলে কয়ডা মহেষ উদ্ধার হইলছে। হ্যামার মুনে বুইলছে বাকি মহেষগিলি ওহিনডাই আছে।

আচ্ছা। কিন্তু মোষগুলি যে আপনার তার প্রমাণ কী?

বাহিরের ভুঁইয়ে মহেষগিলি হ্যামি দেখিছিনু ছ্যার। দেখিই চিনিলিহেলছি। তিনডির শিং তেড়ি, চারডির গোল। চারডির গায়ের রং ছায়ের মুতুন, তিনডির কালো।

হাবিলদার অট্টহাসি দিলেন। কমান্ডারও হেসে নিলেন একচোট। তারপর বললেন, আপনি তো মোষগুলিকে দেখে এই বর্ণনা দিচ্ছেন। না দেখলে আপনার কথা বিশ্বাস করতাম। তাছাড়া সব মোষের রংই তো কালো কিংবা ছাই রং। শিংও প্রায় একই হয়। খুবই দুর্বল প্রমাণ। কবে থেকে চিটারি শুরু করেছেন?

চিটারি ল্যা, ছ্যার। আমি সত্যি বুইলছি। প্রমাণ আরো দিতে প্যারবো। হ্যামার চারডি মহেষ ভরণ, মাসখানেকের মইধ্যে ছাও হবি।

তা-ও তো মিলছে না। আমাদের উদ্ধারকৃত সাতটার মধ্যে প্রেগন্যান্ট তো মাত্র একটা, বাকিগুলি তো নরমাল।

মনে বুলছে আর তিনডি ভরণ মহেষ আলাইপুর ক্যাম্পে আছে।

সরি গণি সাহেব, আমি আপনার কোনো উপকার করতে পারছি না। মোষগুলির মালিকানার পক্ষে আপনি শক্ত কোনো প্রমাণ দিতে পারছেন না। আপনি এখন আসতে পারেন।

আবদুল গণির বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। তিনদিন ধরে তার ঘুম নেই, খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। কোথায় না খুঁজেছে মোষগুলিকে! নীলবোনা থেকে কাঁঠালবাড়ি, কাঁঠালবাড়ি থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে কত গ্রামে, কত বাড়িতে, কত খামারে খুঁজেছে, কতজনকে জিজ্ঞেস করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। প্রেমতলী পুলিশ তদন্ত  কেন্দ্রে জিডি করেছে। পুলিশ আশ্বস্ত করেছে, তারাও খুঁজে দেখবে, কোনো খোঁজ পেলে জানাবে। কিন্তু তারা কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। সে খোঁজ পেয়েছে গোদাগাড়ীর এক গরু ব্যাপারীর মাধ্যমে।

ভাঙা মনে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আবদুল গণি মোষগুলির দিকে তাকায়। দক্ষিণের কর্দমাক্ত জমিনে বসে জাবর কাটছে মোষগুলি। আর অশ্রু ঠেকিয়ে রাখতে পারে না সে। বুলির জন্য তার খুব খারাপ লাগে। গোল শিংয়ের পোয়াতি মোষটাকে আদর করে তার বউ মনসুরা নাম দিয়েছে বুলি। মনসুরাকে দেখলেই সে ছুটে যায়, গা শোঁকে, মুখ বাড়িয়ে দেয়। মনসুরা তার মাথায় হাত বুলায়, পিঠে হাত বুলায়, আঠালি বেছে দেয়।

ধনুকের মতো শিংয়ের মোষটার নাম ধুনকা। আবদুল গণির দেওয়া নাম। বুলির মতো সে কাছে আসে না, গা শোঁকে না, আদর চায় না। গণিকে দেখলেই মাথা ঘুরিয়ে নেয়। যেন তার প্রতি খুব অভিমান। কিন্তু আবদুল গণি রোজ খামার ছেড়ে আসার সময় ধুনকা করুণ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যেন বলতে চায়, আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ? যেয়ো না, আরো কিছুক্ষণ থাকো।

ধুনকার জন্মের পর তিনশো লোক দাওয়াত করে খাইয়েছিল গণি। গোটা গোদাগাড়ীতে ছড়িয়ে পড়েছিল এই খবর, পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল, বিস্তর মানুষ দেখতে এসেছিল ধুনকাকে। মোষের জন্ম উপলক্ষে এমন জেয়াফত দেওয়ার কারণ ছিল। আবদুল গণির বড় মেয়ে শরিফা ছিল নিঃসন্তান। সন্তানের জন্য বহু চেষ্টা-তদবির করেও লাভ হচ্ছিল না। ধুনকা যেদিন জন্ম নিল, সেদিন এলো সুখবর : নানা হবেন আবদুল গণি। ডাক্তার বলেছে, শরীফা গর্ভবতী। আবদুল গণির মনে হলো, এই সুখবরের পেছনে রয়েছে ধুনকা। নিশ্চয়ই সে সৌভাগ্যের প্রতীক। সৌভাগ্য আর সুখবর বয়ে এনেছে সে। সেই আনন্দে একটি গরু আর পাঁচটি ছাগল জবাই দিয়ে দাওয়াত করে খাওয়াল নীলবোনার তিনশো মানুষকে।

আবদুল গণি দূর থেকে শেষবারের মতো মোষগুলিকে দেখে নেয়। কাছে যেতে চেয়েছিল, ধুনকা ও বুলির মাথায় হাত বুলিয়ে একটুখানি আদর করতে চেয়েছিল। সেন্ট্রি যেতে দেয়নি। অনুমতি নেই, যাওয়া যাবে না। রাগ উঠেছিল গণির। বলেছে, হ্যামি তো চুর না, ছ্যার। এই সলকের সময় মহেষগিলি তো আর চুরি কেরি লি যাব না। এ্যাকবার দেখতে দিলে কি আইন-আদালত ঢোসি যাবি? সেন্ট্রি বলেছে, যান তো ভাই! ঝামেলা করবেন না প্লিজ।

ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে ইউসুফপুর বাজারে এলো আবদুল গণি। বাজার থেকে ধরল চারঘাটের টেম্পো। চারঘাট থেকে বাসে করে বাঘায় পৌঁছাল রাত সাড়ে ৮টায়। এক হোটেলে রাতটা কাটিয়ে সকালে রওনা হলো আলাইপুরের উদ্দেশে। আলাইপুর ক্যাম্পের পাশে এক চা-দোকানে নাশতা খেতে খেতে দোকানদারের কাছ থেকে জানল যে, সত্যি নয়টি মোষ উদ্ধার করেছে বিজিবি। নাশতা করে সে ক্যাম্পে গেল। সেন্ট্রি জানাল যে, কমান্ডার নেই। সকালে সদরে গেছেন, ফিরতে ফিরতে দুপুর হবে।

দুপুর কেন, রাত হলেও আপত্তি নেই গণির। দেখা না করে সে ফিরবে না। তার মন বলছে, এই ক্যাম্পেই আছে তার বাকি নয়টি মোষ। নুনাকে সে ইউসুফপুর ক্যাম্পে দেখেনি, নিশ্চয়ই সে এই ক্যাম্পে আছে। জন্মের পর নুনা হাঁটতে পারত না। গোদাগাড়ী পশু হাসপাতালের ডাক্তার এনে তার চিকিৎসা করিয়েছিল। হাঁটা শিখতে লেগেছিল এক মাস। সেই নুনা এখন সবচেয়ে তেজি, সবচেয়ে রাগী। যত্রতত্র শিং ঢুকিয়ে দেয়, যাকে-তাকে ধাওয়া করে বেড়ায়। গোদাগাড়ীতে একবার মোষের লড়াই প্রতিযোগিতায় পরপর তিন বছরের বিজয়ী সেলামত মোল্লার মোষকে পরাজিত করেছিল।

কমান্ডার এলেন দেড়টার দিকে। তিনটায় আবদুল গণির ডাক পড়ল। আবারো সেই একই জেরা। কী নাম? বাড়ি কোথায়? প্রমাণ কী? আবদুল গণি নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, বাড়ির কাছে পদ্মার তীরে তার খামার। সাতাশটি মোষ ছিল খামারে। খামার দেখাশোনার জন্য একজন রাখাল রেখেছে। রোজ সকালে মোষগুলি সে পদ্মার চরে চরাতে নিয়ে যায় এবং বিকেলে ফিরিয়ে আনে। সেদিন ছেলেটির খুব জ্বর ছিল বলে আবদুল গণি সকালে মোষগুলি চরে রেখে এসেছিল। দুপুরে সে গিয়েছিল গোদাগাড়ী। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। খামারে গিয়ে দেখে এগারোটি মোষ ফিরেছে, ষোলোটি ফেরেনি। ষোলোটির মধ্যে চারটি পোয়াতি। একটি পোয়াতি মোষ সে ইউসুফপুর ক্যাম্পে দেখে এসেছে। তার মন বলছে বাকি তিনটি এই ক্যাম্পে আছে।

কমান্ডার ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ান। বিশ্বাস হয় না আবদুল গণির কথা। নিশ্চয়ই সে খোঁজখবর নিয়ে এসেছে, নিশ্চয়ই এলাকার কারো কাছ থেকে জেনেছে তিনটি মোষ যে পোয়াতি। প্রমাণ খুবই দুর্বল, মালিকানা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়। তার কিচ্ছু করার নেই। কালই তিনি মোষগুলি ব্যাটালিয়ন সদর দফতরে পাঠিয়ে দেবেন।

আবদুল গণি বলে, ছ্যার, মহেষগিলি হারা যাওয়ার পরদিন বিয়ানবেলা হ্যামি পেমতলী থানাতে মামলা করিছিনু।

কমান্ডার বললেন, জিডি দিয়ে তো প্রমাণ হয় না মোষগুলি যে আপনার। জিডি তো যে কেউ করতে পারে। একজন চোর গিয়েও বলতে পারে তার মোষ হারিয়ে গেছে। আমি অবিশ্বাস করছি না আপনার কথা, কিন্তু কী করব বলুন, আমার হাত তো আইনের দড়িতে বাঁধা। আইনের বাইরে আমি যাব কেমন করে?

আবদুল গণি ফিরে গেল। ইউসুফপুর ক্যাম্পের সাতটি এবং আলাইপুর ক্যাম্পের নয়টি মোষ পাঠিয়ে দেওয়া হলো বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দফতরে। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদর দফতর মোষগুলি পাঠাল রাজশাহী কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের গুদামে। কাস্টমস সেগুলি নিলামে তুলবে। খবর পেয়ে আবদুল গণি ছুটে গেল কাস্টমস অফিসে, সঙ্গে নিয়ে গেল ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, যেখানে চেয়ারম্যান লিখেছেন, আবদুল গণিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাঁর স্বভাব-চরিত্র ভালো। তার খামার থেকে যে ষোলোটি মোষ নিখোঁজ হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি অবগত আছেন। তার দৃঢ় বিশ^াস, বিজিবি কর্তৃক উদ্ধারকৃত মোষগুলি আবদুল গণির।

মোষগুলি ফেরত চেয়ে কাস্টমস কমিশনার বরাবর একটি আবেদন করল আবদুল গণি। সঙ্গে জুড়ে দিলো চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্রটি। অফিসের এক কর্মচারীর মাধ্যমে জানতে পারল যে, মোষগুলির মালিকানা দাবি করে কাশিয়াডাঙার শামসুল হুদা নামের এক লোকও একটি আবেদন করেছে। আবদুল গণি একটু ধাক্কা খায়, কিন্তু তাতে তার প্রত্যয়ে চিড় ধরে না। সে নিশ্চিত ষোলোটি মোষ তার, শামসুল হুদার দাবি ভুয়া। তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য।

দুই ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিলাম প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে মালিকানা যাচাইয়ের প্রয়োজন মনে করল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। যুগ্ম কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে সদস্যসচিব করে গঠন করল পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্তে ডাকা হলো দুই আবেদনকারীকে। আবদুল গণি গেল, কিন্তু শামসুল হুদা লাপাত্তা। গণি এবার আরো নিশ্চিত হয় শামসুল হুদা যে ভুয়া দাবিদার। তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়ে সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলো সে। ষোলোটি মোষ জন্মের পর যে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে রেজিস্ট্রি করেছিল, তার কাগজপত্রও দেখাল। সে নিশ্চিত ছিল তদন্ত রিপোর্ট তার পক্ষে যাবে, তার মোষ সে ফেরত পাবে। কিন্তু দুদিন পর জানা গেল, রিপোর্ট গেছে তার বিপক্ষে, তদন্তে প্রমাণিত হয়নি মোষগুলি যে তার।

শেষ প্রচেষ্টাটিও ব্যর্থ হলো। আবদুল গণি ক্লান্ত হয়, কিন্তু নিরাশ হয় না। সে চেয়ারম্যানের শরণাপন্ন হয়। বলে, এডি বড়ই অন্যায় চিয়ারমেনসাব। কিছু করি দেন পিলিশ। লাগলে ট্যাকাপয়সা খরচ কততে রাজি আছি, তা-ও হ্যামার মহেষ ফিরত লিব। ছাওয়ালের মুতুন প্যালি-পুষি বড় করা মহেষগিলি এভাবে ঐন্যে মানুষের হাতে চলি যাবি, এডি হ্যামি সইহ্যি করতে প্যারবো না। হ্যামার বুকডা ফ্যাটি যাহাবি চিয়ারমানসাব। হ্যাপনি হ্যামাদের ছব, এই বিপদে হ্যাপনে ছাথে না থাইকলে আর কেহে আছে বুইলেন?

সাংবাদিকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিলেন চেয়ারম্যান। সাংবাদিকই শেষ ভরসা। ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারলে তারা পত্রিকায় রিপোর্ট করে দেবে। তাতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নড়বে, মোষ ফেরত দিতে বাধ্য হবে। গোদাগাড়ীর সাংবাদিক জুমলা হাসানের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে। ঢাকার বড় কাগজের প্রভাবশালী সাংবাদিক। তার রিপোর্টের কারণে গোদাগাড়ী কলেজের অধ্যক্ষকে একবার জেল খাটতে হয়েছিল। আরেক রিপোর্টে বদলি হয়ে গিয়েছিল থানার ওসি।

রাজশাহী নগরের দাসপুকুরস্থ শুল্ক গুদামে নিলামে তোলা হলো ষোলোটি মোষ। তার আগে সাংবাদিক জুমলা হাসানকে নিয়ে উপস্থিত হয় আবদুল গণি। সে আবার দাবি করে মোষগুলির মালিকানা। তার মোষ তাকে ফেরত না দিয়ে এভাবে নিলামে তোলা জুলুম। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তার কথা আমলে তো নিলই না, উল্টো তাকে ধমক দিলো। বেশি বাড়াবাড়ি করলে থানায় দেওয়ার হুমকি দিলো।

সাংবাদিক জুমলা হাসান দেখা করল কাস্টমসের কমিশনারের সঙ্গে। কমিশনার বললেন, দেখুন, একটি দলে অনেক কৃষকের মহিষ থাকে। বিজিবির উদ্ধারকৃত মহিষগুলি একজনেরই হবে, এটা হতে পারে না। আমি চরাঞ্চলের মানুষ। মহিষ লালন-পালনের ধরন দেখেছি, দেশের নানা জায়গায় বিস্তর খামার দেখেছি। আমার অভিজ্ঞতায় বলছে না মহিষগুলি আবদুল গণির। আমরা তো তার দাবি আমলে নিয়ে তদন্ত কমিটি করেছি। কমিটি তদন্ত করে সত্যতা পায়নি। যে রেজিস্ট্রির বলে সে মহিষগুলির মালিকানা দাবি করছে, সেই রেজিস্ট্রির সঙ্গে বিজিবির কাছে সংরক্ষিত রেজিস্ট্রির মিল পায়নি কমিটি। আমাদের আসলে কিছু করার নেই, মহিষগুলি নিলামে তুলতেই হবে।

আবদুল গণির মাথা চক্কর দেয়। বুলির জন্য, ধুনকার জন্য, নুনার জন্য তার বুকে হাহাকার জাগে। সে ভাবতেই পারছে না তার মোষগুলি এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাবে। তার বুকে বইতে লাগল শোকের পদ্মা। জেদ চাপল তার মাথায়। না, মোষগুলি সে কোনোভাবেই হাতছাড়া করবে না। যেভাবেই হোক মোষগুলিকে সে খামারে ফেরাবে। নিলামে অংশ নিল সে। প্রথমে দাম হাঁকল আট লাখ। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন হেঁকে বসল দশ লাখ। এবার গণি হাঁকল এগারো লাখ। অন্য একজন হাঁকল এগারো লাখ দশ হাজার। গণি সোয়া এগারো লাখ হাঁকার পর আর কেউ হাঁকল না। টাকা বুঝিয়ে দিয়ে গণি সরোষে বলল, হ্যামার সাথে জুলুম হচে। আল্লাহ কহরবি হ্যায়ার জুলুমের বিচার।

আবদুল গণির মুখের দিকে তাকায় সাংবাদিক জুমলা হাসান। চোখেমুখে কী প্রবল আত্মবিশ্বাস! মোষগুলি যে তার, জুমলা হাসানের অবিশ^াস হয় না। তার কৌতূহল জাগে। সত্যিই কি মোষগুলি আবদুল গণির? মিথ্যার বাতাবরণ সরিয়ে সত্য খুঁজে বের করাই তো সাংবাদিকের কাজ। সত্যতা যাচাই করতে চায় সে। আবদুল গণি যখন মোষগুলি ট্রাকে তুলে নীলবোনার উদ্দেশে রওনা হলো, তখন সেও বাইক হাঁকাল ট্রাকের পেছনে। ট্রাক নীলবোনার আগের গ্রাম গহমাবোনায় পৌঁছালে ড্রাইভারকে থামতে বলল সে। ট্রাক থামলে পরে আবদুল গণিকে বলল মোষগুলি নামাতে। গণি প্রথমে দ্বিধায় ভুগছিল। পরে ভাবল, সাংবাদিকের নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে। তার কথা অমান্য করা উচিত হবে না। মোষগুলি নামাল সে। জুমলা হাসান বলল, চলেন হ্যাপনার বাড়িতে যাব। খিদি লাইগছে মেলা। খাব। খ্যাতে দিবেন তো?

আবদুল গণি বলে, সমস্যা নাই তো। হ্যাপনি হ্যামার বাড়িত খাবেন, এডি হ্যামার আনন্দের বিষয়। কিন্তু মহেষগিলির কী হবি?

এগুলি থাক, চরে বেড়াক ইখানে। বিকেলে আসি লিয়ে যাবেন।

গণিকে বাইকের পেছনে তুলে নিল জুমলা হাসান। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা তিনটা। ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল সাংবাদিক। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে জানালার ফাঁকে দেখছিল পদ্মা নদী আর নদীর তীরে আবদুল গণির মোষের খামার। হঠাৎ দেখল ষোলোটি মোষ হেলেদুলে খামারে ঢুকছে। শুনতে পায় মনসুরার হাঁকডাক। মনসুরা ছুটে যায় খামারে। পেছনে আবদুল গণিও। মনসুরা জড়িয়ে ধরে বুলিকে এবং আবদুল গণি ধুনকাকে। মনসুরা তার প্রিয় বুলির মাথায় হাত বুলায়, পিঠে হাত বুলায়। ধুনকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আবদুল গণি কাঁদে। সাতদিনের জমিয়ে রাখা কান্না বের করে দিতে থাকে। তার দেখাদেখি কাঁদে মনসুরাও।

সাংবদিক জুমলা হাসান ক্যামেরটা নিয়ে খামারে গেল। কয়েকটি মোষ গামলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে, অবিরাম লেজ নাড়ছে। একটি শালিক বসেছে নুনার কুঁজে। বুলি ও ধুনকার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু, অঝোর ধারায়।