মুলুক চানের খোয়াব

শানকিভরা কাঞ্জির ভাতের শেষ লোকমাটুকু পেটে চালান দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে মুলুক চান। পেঁয়াজ-মরিচ আর নুনের মিলমিশে আমানির শেষ তলানিটা তার কাছে অমৃতের মতো মনে হয়। ভালোমন্দ যা-ই থাকুক না কেন, পরম যত্নে সবই তোলা থাকে সালেহার। কিন্তু সেদিকে নজর দেয় না মুলুক চান। আগের রাতের বাসি ভাতের পান্তা পেটের কোনায় হামাগুড়ি দিলেই তার শরীরটা শীতল হয়ে আসে। স্বর্গীয় এক প্রশান্তিতে চোখ দুটি বুজে আসতে চায় নিশ্চিন্ত আরামে। কিন্তু সে-আবেশ বেশিক্ষণ থিতু হয় না।

বিক্ষিপ্ত আয়েশি চিন্তার আনমনা ঘোর কেটে যেতেই মাদুর ছেড়ে উঠে পড়ে সে। ঢক্ঢক্ করে একটু জল খেয়ে হাতের তালুর অপর প্রান্ত দিয়ে মুখটা মুছে নেয় আলগোছে। অনিচ্ছুক অলস ভঙ্গিতে ঢিল হয়ে যাওয়া লুঙ্গির গিঁট কোমরের কাছে শক্ত করে বেঁধে ঘর ছেড়ে উঠানে নামে সে।

বাইরের উঠানে ঝলমল করছে রোদ। রোদ দেখে মুখের হাসি আরো প্রশস্ত হয় তার। মুলুক চান গতরখাটা পরিশ্রমী মানুষ। কাজে বেরোনোর আগে এই বিলাসী ভোজ প্রতিদিন তাকে স্বর্গসুখ এনে দিলেও রাজ্যের আলসেমি এ-সময় তার শরীরে ভর করে। তখন আর কাজে যেতে মন চায় না। কোনো কিছুই স্ব-বশে থাকে না তখন। নারকেলগাছের নিচে পাতা খাটিয়ায় বসে ভীষণ তামুক খেতে ইচ্ছা করে তার। আজো ঠিক তেমনই হলো। ইচ্ছাটাকে আশকারা দিয়ে হুঁকার নৈচায় তামুক সাজিয়ে খাটিয়ায় আয়েশ করে গা এলিয়ে বসে। গরগর শব্দে তামুক টানে নবাবি ভঙ্গিতে। তবে তার সতর্ক চোখ সালেহাকে খুঁজে বেড়ায় উঠানের সর্বত্র।

চিলের ছোঁ মেরে শিকার ধরার মতো সালেহা তার সামনে এসে তামুক কেড়ে নেয় এক ঝটকায়। মুলুক চানের কী দোষ? কাঞ্জির ভাতে তার যে এ-সময় শুধু ভাতঘুম লাগে। আর তাই দেখে সালেহার জিদ উঠে যায় তুঙ্গে। অগ্নিমূর্তি চেহারার সঙ্গে ফোসফোসানির হলকা সবেগে ছুটে আসতে থাকে তার দিকে।

– মিনসের রং দ্যাখো, তামুক নিয়া বসছে। কামে না গেলে খাওনের চিন্তা কইরা আর লাভ নাই। চাউল নাই এক ছটাক, আনাজপাতি কিচ্ছু নাই ঘরে। সবকিছুই শ্যাষ। আর উনি তামুক নিয়া বসছেন নবাবের মতো।

সালেহার এই রূপ মুলুক চানের অচেনা নয়। সংসারের নিত্যদিনের নানান ধরনের অভাব-অভিযোগ আর চাহিদার ফিরিস্তি দিয়ে মুখর বয়ান ছোটে সালেহার মুখে। এক এক করে বিদ্ধ করে পরিশ্রমী শরীর, আয়েশি মনকে। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও গায়ে কুর্তা চাপিয়ে ঝুড়ি-কোদাল হাতে বেরিয়ে পড়ে মাঠের দিকে।

মুলুক চান জন খেটে রোজগার করে। এ উপার্জন তার জমাট বাঁধা রক্তবিন্দুর দাম। সে-উপার্জনের প্রতিটি পয়সায় উদয়াস্ত পরিশ্রমের ঘাম মিশে থাকে, মিশে থাকে তার শরীরের গন্ধ। হাড়ভাঙা খাটুনির এ-রোজগার তাই অনেক দামি, তা সে জানে। চারজনের মোটে সংসার। শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ করে দিয়েছে অনেক আগে। ভাটার প্রবল টানে খেই হারিয়ে যাওয়া সংসারে তবু আশার জোয়ার আসে না। অভাব-অনটন নিয়ে তারপরও সে সুখী। খুব অল্পতেই সুখী হওয়া মুলুক চান তার খোয়াব নিয়ে বেঁচে আছে।

দুই

শ্যামপুর বাজারের যতন মুন্সির বিরাট মুদিখানার সামনের বেঞ্চিতে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয় মুলুক চান। দোকানে বেচাকেনার ভিড় দেখে চুপ করে বসে থাকে এক কোণে। তাকে দেখে দোকানের ভেতর থেকে যতন মুন্সির হাঁকডাক শুরু হয়।

– তোর আইজ কাম নাই মুলুক?

– আছে তো দাদা।

– এইখানে বইয়া রইলি যে!

– যামু দাদা। আপনার কাছেই আইছিলাম। ঘরে কিচ্ছু নাই। কিছু সদাইপাতি লাগে দাদা।

– তোর তো ম্যালা বাকি পড়ছেরে মুলুক। শোধ দিবি ক্যামনে?

– সব শোধ দিয়া দিমু দাদা। আগে বড় রাস্তাখানের কাম শ্যাষ হোক, তারপর দিমু দাদা।

­ থাক হইছে, এইবার থাম। বুঝছি সব। যাওনের সময় লইয়া যাইস।

কথা না বাড়িয়ে যতন মুন্সির দোকান থেকে বড় রাস্তা ধরে মাঠের দিকে এগোয় মুলুক চান। শ্যামপুর বাজারের উত্তর দিকে মাঠে যাওয়ার যে ভাঙা বড় মাটির রাস্তাগুলি মেরামত হচ্ছে সেই কাজের শ্রমিক সর্দার সে। বর্ষার সময় রাস্তাগুলি দিয়ে এমনিতেই চলাচলের কোনো জো থাকে না। তার ওপর গরুর গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে জানটাও নিভু নিভু। তাই নতুন মাটি ফেলে উঁচু করে মেরামত হচ্ছে সব। তাছাড়া, বাজারের পেছনে হাই স্কুলের মাঠে মাটি ফেলার কাজটাও পেয়েছে সে। বড় বড় কাজে জন খাটার ফরমাশ পেলেই সবার আগে ডাক পড়ে তার। আর তখনই দলবল নিয়ে হাজির হয় মুলুক চান। কিন্তু ওদিকে বেলা গড়িয়ে গেলেও কাজে মন নেই শ্রমিক দলের। সর্দারের দেরি দেখে বাকিরাও বসে আছে ঝুড়ি-কোদাল ফেলে। এক কোদাল মাটিও কেউ কাটেনি। এক ঝুড়ি মাটিও পড়েনি কোথাও। রোদের আকাশের নিচে তাতা শরীর নিয়ে বসে আছে সব।

দূর থেকে মুলুক চানকে আসতে দেখে জটলা করে বসে থাকা শ্রমিকরা আলপথ ডিঙিয়ে এলোমেলো উঁঁচু রাস্তার দিকে উঠে আসে। এ-সময় জমিতে ফসলের সমারোহ থাকে না। করার মতো হাতে তেমন কাজও থাকে না তাদের। তাই কঙ্কালসার রাস্তাগুলির দেহ ঠিক করার নামে নিজেদের দেহের চাকা সচল রাখার একরকম উপায় খুঁজে নেয় তারা। কাজ থাকলে তবেই না মজুরি। দু-চার পয়সা যা রোজগার হয় এতে, তাতেই জোটে ক্ষুধার্ত মুখগুলির অন্ন।

বজলুই সবার আগে এগিয়ে যায় সেদিকে। বলে, ‘তোমার শরীল খারাপ নাকি সর্দার? দেরি হইল যে।’ কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে তেমন মনে হয় না বজলুর। তাই জবাব শোনার আগেই আবার জিজ্ঞাসা তার।

– কাম কি আইজ করবা না? আমরা যে সব তোমার অপেক্ষায় সেই কখন থিকা বইসা রইছি।

– আমার আইজ কাম করার মন নাই রে বজলু। তোমরা কামে মন দাও। আইজ অন্য কাম আছে। তারপর চোখের দৃষ্টি দিয়ে জটলাটার দিকে তাকিয়ে নিজের মতো করে হিসাব করে নেয় সে। জনা বিশেক শ্রমিক আছে সেখানে। তারপর বজলুর দিকে চেয়ে দরাজ কণ্ঠে বলে, ‘আইজকার মইধ্যে কাম শেষ হওন চাই। কাইল থিকা বড় কাম আছে। কী মিয়ারা, পারবা না?’

– হ হ পারুম। বজলুসহ আরো কয়েকজন আওয়াজ তোলে সরবে।

– তুমি থাকবা না সর্দার? জটলার পেছন থেকে কে যেন একজন জিজ্ঞাসা করে।

– কাইল থিকা তোমাগো লগে আছি আমি। আমার খোঁজ পড়লে কইবা আমার শরীল খারাপ।

মধ্য দুপুরের বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে বজলুর নেতৃত্বে শ্রমিকদলের জটলা ভাঙে। ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে যার যার মতো কাজে লেগে যায় সব। বেলা থাকতেই জোর হাত চালিয়ে মেরামত শেষ করতে হবে মাঠের এই রাস্তাটার। আজকের মধ্যে শেষ না হলে মতি মেম্বার চৌদ্দ গুষ্টি তুলে যে গালাগাল শুরু করবে সেই ভয়েই যেন মাঠে আরো জোরেশোরে কোদালের কোপ পড়ে শ্রমিক দলের।

গনগনে সূর্যের প্রখর তেজ মাথায় রেখে আবার ফিরে যায় মুলুক চান। হনহন করে সোজা এমনভাবে ছুটে যায় যেন চারদিকে আর খেয়াল করার কিছু নেই। মাঠের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে শ্যামপুরের বড় রাস্তায় ছোটে সে। তারপর সেখান থেকে যতন মুন্সির দোকান হয়ে হারিয়ে যায় একেবারে বাড়ির পথে।

তিন

আজ কাজে আসার আগে হাওয়ায় ভেসে আসা কথাটা লোকমুখে তার কান পর্যন্ত আসে। তবে বাজারের মধ্যে জালালের মুখ থেকে কথাটা শুনে আরো নিশ্চিত হয়   সে। সেই থেকেই অদ্ভুত এক অস্থিরতা পেয়ে বসেছে তাকে। কালক্ষেপণ না করে ছেলে ফকির চাঁনকে নিয়ে এক্ষুনি যাবে সে। চেষ্টা-তদবির করে যদি একটু হাসিল করা যায় এই আশায়। জোর মিনতি করলে হয়তো পেয়েও যেতে পারে কাক্সিক্ষত সেই বস্তু।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আজ এমনিতেই কাজে আসতে মন চায়নি মুলুক চানের। ম্যাজম্যাজ করা শরীরে আলসেমি বাসা বেঁধেছিল চোদ্দো আনা। দুই আনার আয়েশি মন তখন তামুক খাওয়ার বাহানা খুঁজে বেড়ায়। নেহাত ঠেকায় না পড়লে বাড়ি থেকে বের হয় না সে। তার এই নবাবি খামখেয়ালির সঙ্গে সালেহার মুখ ঝামটার সাক্ষাৎ ঘটে প্রায় প্রতিদিন। তারপরও সে মুখ বুঁজে থাকে নির্বিবাদী মানুষের মতো।

মনের ভেতর এমন দশ কথা ওলটপালট করতে করতে কখন যে উঠানের কাছে দাঁড়িয়ে পড়েছে সেই খেয়াল নেই তার। তপ্ত রোদে ঘরের উঠানে পা ফেলা দায়। এদিকে হনহন করে ছুটে আসায় তার বুক ধড়ফড় করে। তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে কাঠ। সালেহাকে দেখে তিয়াস মেটানোর আগেই তার রুক্ষ কথার বাণে সম্বিত ফিরে পায়।

– কী ব্যাপার? তুমি ফিরা আসলা যে। মাঠে যাও নাই?

কী বলবে ভেবে না পেয়ে সেদিকে কান দেয় না সে। সালেহার দিকে না তাকিয়েই বলে, ‘কাজে যামু; তয় তার আগে ছোট্ট আরেকখান কাম আছে। ফকির চাঁন কই? ওরে ডাকো। ওরে লইয়াই যামু।’

সালেহা কথার আগামাথা বোঝে না। হঠাৎ কী এমন হলো যে, কাজ ফেলে বাড়িতে ফেরত আসতে হলো তার। তার ওপর আবার ছেলের খোঁজ। এই প্রয়োজনের মানে বোঝে না সে।

– শোনো বউ; তোমারে একবার কইছিলাম আমার একখান খোয়াবের কথা। মনে আছে তোমার?

– কীসের কথা কও তুমি?

– অনেক আগে একবার মায়েরে লইয়া একখান খোয়াব দেখছিলাম। দেখলাম, মা আমারে ডাকতাছে। আদর কইরা কইতাছে; ও মুলুক, চান আমার। আমারে গোশত দিয়া এক থালা ভাত দে। খুব মন চায় দুম্বার গোশত দিয়া প্যাট ভইরা একথাল ভাত খাই।’

– এইটা তো বহু আগের কথা।  তারপরে তো মানত কইরা মসজিদে একটা ছাগল দিছিলাম।

– তা ঠিক আছে বউ। কিন্তু, দুম্বা হইল বেহেশতি পশু। যদি একটু গোশত আনবার পারি মায়ে ঠিক অনেক খুশি হইব। মায়ের জবানে তালা পড়ছে। সে তো ভালো-মন্দ কিছু কইবার পারে না। 

– তোমার কথার উল্টাসিধা আমি কিছুই বুঝতাছি না। হঠাৎ কী কও এইসব?

– থাক, বেশি বুঝনের কাম নাই।

বিরক্তি নিয়ে মুলুক চান থেমে গেলেও সত্যিই সালেহা কিছুই বুঝতে পারে না। কয়েক মাস আগে দেখা খোয়াবের সঙ্গে আজ হঠাৎ দুম্বার গোশতের কী যোগসূত্র উদয় হলো সেই রহস্য ভেদে ব্যাকুল হয় সালেহা। এদিকে আনন্দের এক চাপা উত্তেজনায় মুলুক চানের চোখ দুটো চকচক করে ওঠে।

মুলুক চানের আর কাজে যাওয়া হয় না। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলে খাটিয়ায় শুয়ে মুলুক চান গোলেজান বিবির শখ পূরণের কথা ভাবে। বৃদ্ধা মায়ের

শখ-আহ্লাদ, আবদার-আকাক্সক্ষা কখনোই কিছু পূরণ করতে পারেনি সে।

খোদা তার জবান কেড়ে নিলেও তার ভালোমন্দ তো তিনি ঠিকই দেখছেন। তাই তো মনের অপূর্ণ বাসনা সব মুলুক চানকে ডেকে খোয়াবেই বলে দিচ্ছেন হয়তো। সে এমনটাই বিশ^াস করে। আর বিশ^াস করে বলেই ছোট ছোট এসব ইচ্ছার কথা অকপটে জানায় বউ সালেহার কাছে।

সালেহার কাছে আসল ব্যাপারটা খোলাসা হয় রাতের বেলায়। অন্যদিনের মতো কাজে যাওয়ার সময় যতন মুন্সির দোকানে জালালের সঙ্গে দেখা হয় মুলুক চানের। জালালের সহোদর জব্বার সদর উপজেলায় কী যেন ছোট একটা কাজ করে। বিস্তারিত ঘটনা জালাল তার ভাইয়ের কাছেই শুনেছে। খবরের সূত্রপাত যে সেখান থেকেই বুঝতে আর বাকি থাকে না মুলুক চানের।

চিঠি এসেছে সেখানে আরো বড় অফিস থেকে। হজের সময় তামাম দুনিয়ার লাখো মানুষ খোদার ঘরে জমায়েত হয়ে কুরবানি দেয়। ত্যাগের সেই বস্তু সারা দুনিয়ায় বিলি-বন্দেজ হয়ে জাহাজবোঝাই করে এদেশে এখানেও এসেছে। খোদার নামে জবাই হওয়া সেই কুরবানির গোশত এখন তারও হাতের নাগালের মধ্যে। এই খবর শোনার পর থেকে মুলুক চাঁন আর নিজের মধ্যে নেই। বিশ^াসই হতে চায় না খবরটা তার কাছে।

খোদাপাকের অসীম কুদরতের ইশারা মুলুক চান জানে। তাই তো সে খোয়াবের মাধ্যমে জানতে পেরেছে বেঁচে থাকা বৃদ্ধা মায়ের অন্তিম ইচ্ছার কথাটা। সামান্য গোশত হাতে পেলেই যা সে পূরণ করতে পারবে অনায়াসে। মনের সকল খেদ মিটিয়ে ফেলে সেটাই আজ পূরণ করার জন্য কালবিলম্ব না করে ছুটে এসেছে মুলুক। বাকি এখন আল্লাহর ইচ্ছা।

চার

ছোট্ট ঘরের গুমোট অন্ধকারে বসে বাইরের বিশাল দুনিয়ার খবর গোলেজান বিবির কানে যায় না। ঘরে বসে তাই সে ছেলে মুলুক চানের সংসারের কথা ভাবে। অজানা অসুখের ধকলে তার জবান বন্ধ অনেকদিন। কিন্তু তারপরও পুরনো ভাবনা বন্ধ হয় না। কারো কথার আওয়াজ শুনলেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে শুধু। তারপর সে-কথার জবাব দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে তার চোখ। গোঙানির মতো বের হয় অদ্ভুত সব আওয়াজ। মুলুক চান এ-কষ্টের কথা বোঝে, অনুমান করতে পারে সে মুখের দুর্বোধ্য ভাষা। মায়ের জন্য কিছুই করতে না পেরে শুধুই আফসোস বাড়ে তার।

স্বামী আলেক চাঁন যখন বেঁচে ছিল তখনো ছিল গোলেজান বিবির অভাব-অনটনের সংসার। বছরের এ-মাথায় ও-মাথায় সন্তান বিয়াতে গিয়ে শরীর ভেঙে গিয়েছিল তার। সে জানে, শুধু ফল ধরলেই হয় না, সেই ফলবতী বৃক্ষের যত্নও নেওয়া লাগে। কিন্তু নিত্য অভাবের সংসারে সে-আশা করাও বাতুলতা মাত্র। দুর্বহ সে টানাপড়েনে পিষ্ট হয়ে একে একে মারা গিয়েছিল সব আদরের ধন। 

মুলুক চানই ছিল তার শেষ আশার প্রদীপ। এ যে খোদার কাছে আকুল পরানে চেয়ে নেওয়া তার সাধনার সম্পদ। একসময় তার গতরে যখন শক্তি ছিল মুলুক চানকে নিয়ে কত পীর-ফকিরের দরগায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সে। একবেলা আধপেটা খেয়ে না খেয়ে শিরনি বিলিয়ে মাথা ঠুকে মরেছিল গোলেজান। হাতে তাবিজ, গলায় মাদুলি আর কোমরে কালো তাগা বেঁধে তিলতিল করে লালন করে বড় করেছিল তাকে। ছেলের বেঁচে থাকার জন্য দান-খয়রাত ও মানত করে তবেই ক্ষান্ত হয় সে। পড়শিরা নানান কথা বললেও কোনোটাই আমলে নেয়নি গোলেজান। খোদা তার সেই ফরিয়াদ শোনে। 

গোলেজান বিবির সহজ-সরল মনে সেই সময় খোয়াবের এক একটি নতুন বসত গড়ে উঠেছিল সন্তর্পণে নিজের খেয়ালে। একসময় ইচ্ছা ছিল ছেলে তার মস্ত আলেম হবে গঞ্জের বড় কোনো মাদ্রাসার। আবার পরক্ষণেই ভেবেছে শ্যামপুর বাজারের কাছে মোহসেন পীরের দরগার খাদেম কিংবা পুরনো জামে মসজিদের ইমামতি করলেও শেষ পর্যন্ত আপত্তি থাকবে না তার। অথচ জোড়াতালির সংসারে মক্তব অবধি গেলেও মাদ্রাসায়ই পড়াতে পারেনি ছেলেটাকে।

কত অল্প বয়সেই স্বামীর সঙ্গে জন খাটতে পাঠিয়েছিল মাঠে-ময়দানে। উদ্দেশ্য ছিল অতিরিক্ত দুটি হাতের বদৌলতে সংসারে খানিকটা যদি বরকত হয়। এখন আর এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার। কিছু না হলেও ছেলেটা তো তার চার হাত-পায়ে সুস্থভাবে বেঁচে আছে। এইবা কম কী? এটাই তো তার পরম পাওয়া। তবে সহজ-সরল মুলুক চানকে নিয়ে ভয়ও হয় গোলেজানের। তার অবর্তমানে দুনিয়ার হিংসা, দ্বন্দ্ব, হানাহানি সামাল দিয়ে পারবে তো সে একলা টিকে থাকতে। এই ভাবনায় মাঝে মাঝে রাতে ভালোমতো ঘুম হয় না তার।

পাঁচ

বাড়ির কাছের যে মক্তবখানা ছিল ফজর শেষে সেখানেই এক সময় ছুটে যেত মুলুক চান। কিন্তু কায়দা-আমপারা শেষে খোদার পাক কুরআনের কালাম কোনোদিন আর ধরা হয়নি তার। মায়ের আগ্রহ ও খায়েশে আপাদমস্তক নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে মাঝে মাঝে তারও ইচ্ছা হতো বড় মাদ্রাসায় পড়ার। কিন্তু সে ইচ্ছা বেশিক্ষণ মনে ঠাঁই পেত না। দীর্ঘদিনের সেই অপূর্ণ খোয়াব আজ সে পূরণ করতে পেরেছে একমাত্র সন্তানের মধ্য দিয়ে। কৈশোর পেরোনো ফকির চানের মাঝেই পূর্ণতা পেয়েছে তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন। একদিন হয়তো সে তামাম দুনিয়ার আলো হয়ে জ্বলজ্বল করবে – এই বিশ^াস ও ভরসায় দিন গুনে যায় মুলুক চান।

মুলুক চানের অক্ষরজ্ঞানের বান তেমন শক্ত নয়। কোনোমতে নিজের নাম সই আর ছোটখাটো হিসাব-নিকাশের সহজ অঙ্ক জানা আছে তার। কিন্তু খোদার অমিয় বাণীতে অন্তরে যে ভক্তি আসে তার ব্যাপ্তি অনেক গভীর। অন্তরের ভেতরে কোরান মজিদের প্রতিটি হরফ প্রবেশ করে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে অবিরত। প্রতিটি হরফের নেকি মনের গহিন কোণে প্রবেশ করে ঘুরপাক খায়। মূর্খ মুলুক চান যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের সে-জটিল হিসাব মেলাতে পারে না। সত্তরগুণ নেকি হাসিলের আকাক্সক্ষা তাকে বড় অস্থির করে দেয়।

কোনো কোনোদিন সন্ধ্যায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ফকির চান যখন সুর করে তেলাওয়াত করে – আল্লাহর ঘরের নূর সে যেন তার ভাঙা ঘরেই খুঁজে পায়। সতেরো পারা পর্যন্ত কুরআন মুখস্থ করে ফকির চাঁন যে নেকি হাসিল করে তার হিসাব তার কাছে অজানা। তবে গভীর রাত পর্যন্ত সেই তেলাওয়াত শুনে মূর্খ মুলুক চানের মনে পবিত্র ভাব আসে। 

ধর্ম-কর্ম খুব একটা করে না মুলুক চান। তবে ছেলের কথায় ওক্তিয়া যে নামাজ আদায় করে তাতেও সুরা-কিরাত ভুল হয়ে যায় তার। দুনিয়ার আজগুবি চিন্তায় মাথায় তালগোল পাকিয়ে আসে। রোজার মাসে সারাদিন অভুক্ত থেকে খোদার সন্তুষ্টি আদায় করলেও শরীরে মোটেই বল পায় না সে। কামলা খাটা মানুষের গতরের বলটাই পুঁজি। তাই কাজের ছুতায় রোজা ছুটে গেলেও ফকির চানের এই জ্ঞান বড্ড টনটনে। সর্বদর্শী মহান খোদা পরম ক্ষমাশীল। তিনি তাঁর তুচ্ছ বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন – এই ভাবনায় রাতে তার প্রশান্তির ঘুম আসে।

মুলুক চানের মনোজগতে ছেলেকে নিয়ে গভীর ধাঁধার জন্ম হয়। মাঝে মাঝে সে ভাবে, ফকির চান মনে হয় তার আর সালেহার সন্তানই নয়। তার কথাবার্তায় আদব-লেহাজের চিহ্ন ও গুরুভক্তি দেখে উল্টা ছেলের প্রতিই তার ভক্তি আসে। এই যুগে যদি কোনো পীর-পয়গম্বর খোদার দুনিয়ায় আগমন করতেন, তবে তার চেহারা এমন নুরানি হতো কি না কে জানে। এ-কথা ভেবে পরক্ষণেই আবার তওবা কেটে জিভে কামড় দিয়ে সাময়িক কাফ্ফারা দেয় সে। মনের অজান্তে অজ্ঞানতাবশে না জানি কী পাপ করে ফেলেছে সে। নিশ্চয় আল্লাহ তার সীমিত চিন্তার এই গণ্ডিকে কসুর করে দেবেন।

ছয়

গোলেজান বিবির অপূর্ণ বাসনা পূরণে মুলুক চানের দৃঢ়চেতা মন ছেলে ফকির চানের মনোবলের কাছে এসে বারংবার হোঁচট খায়। তার মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করে আরো অস্থির করে দেয়। বুকের ভেতর তোলপাড় করা কথা মুখ পর্যন্ত আসে না। গতকাল রাতে পা টিপে টিপে নিজের ঘর ছেড়ে একবার ছেলের ঘরমুখো হয়েছিল সে। সেখান থেকে কী সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াতের নরম সুর ভেসে আসছিল। মাথায় সাদা টুপি আর লম্বা আচকানে ফকিরের সৌম্যদর্শন অবস্থা দেখে মুলুক চানের কেমন জানি অন্যরকম লাগে। নুরানি চেহারার মাঝে খোদাই করা সুরমা লাগানো সরল অথচ তীক্ষè চোখের গভীরতা সম্মোহিতের মতো কোনো অপার্থিব জগতের দিকে টেনে নিয়ে যায় তাকে। সে চোখের দিকে তাকিয়ে দুনিয়ার কিছু বলতে বা চাইতে শুধুই বুক কাঁপে তার।

কুপি বাতির থরথরে কম্পিত আলোয় ফকির চানের মুখে যে পবিত্র ভাব জ্বলজ্বল করে তা যেন সাত আসমান ছাড়িয়ে অন্য কোনো দুনিয়া হতে আসা কোনো আশ্চর্য দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল। স্রষ্টার বিভূতিমাখা সেই পবিত্র মুখের আচানক দর্শনলাভে সে বিমূঢ় হয়ে থাকে খানিকক্ষণ। বিমুগ্ধ বিস্ময়ে তার মুখে কোনো কথা ফোটে না, বাকরুদ্ধ হয়ে থমকে যায় পায়ের পাতা। তার ভাঙা ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে নূরের যে আলো ঝিকমিক করে ওঠে সেখানে যেন প্রবেশ নেই তার। দ্বিধাদ্বন্দ্ব আর দুরুদুরু বুকে তিন কদম এগিয়ে আবার পাঁচ কদম ফিরে আসে মুলুক।

একসময় মা বলতেন, ‘তিনখান   জিনিস খুব চিন্তা কইরা ব্যবহার করিস বাপ; কলম, কসম আর কদম।’ সামান্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মুলুকের কলমের যে খুব জোর নেই তা সে জানে। নির্বোধ হয়ে জীবনটা একভাবে কাটিয়েই দিলো সে। তবে কাউকে জবান দিলে সেই কথায় পাহাড়ের মতো অটল থাকে মুলুক চান। তাছাড়া ভালোমন্দ কাজে কদম ফেলার ক্ষেত্রেও খুব সাবধানে হিসাব করেই পা ফেলে সে। অর্থাৎ, কসম আর কদমের ক্ষেত্রে মায়ের সেই আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনে সে কখনোই কুণ্ঠাবোধ করে না। আসলে এসব সাত-পাঁচ চিন্তা থেকেই গতকাল রাতে ফকির চানের ঘরে গিয়েও আসল কথাটা আর বলতে পারেনি সে। দ্বিধান্বিত মুলুক চান ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট কুপি বাতির থরথর আলোর মতোই কম্পিত হয়ে ফিরে আসে শুধু।

আয়েশি আলসেমি মুলুক চানকে পেয়ে বসেছে আবার। দুদিন ধরে কাজে না গিয়ে সহজে পুণ্য হাসিলের ঘোরে ডুবে রয়েছে সে। ফকির চানকে নিয়ে এতিমখানায় যাওয়ার কথা থাকলেও দ্বিধান্বিত মন বাধা দেয় প্রবলভাবে। ছেলে তার ভীষণ অন্যরকম। নানা কৌশলে তার কাছে কথাটা পাড়তেই বুকের গভীর কোণের ধুকপুকানির আওয়াজ নিজেই শুনতে পায় কানে। অটল বিশ্বাসে গভীর এক আশা নিয়ে বিচলিত মুলুক চান তারপরও ছুটে যায় গঞ্জের উদ্দেশে।

সাত

ঘটনা আসলেই মিথ্যা নয়। কলের জাহাজে করে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে দুম্বার গোশত এসেছে সরকারিভাবে। কিন্তু এ গোশত বিলি-বন্দেজের শুরু থেকেই কিছু কিছু গায়েব হয়ে যায় সকলের অগোচরে। পবিত্র জিনিসের দোহাই দিয়ে পথে পথে লোপাট হলেও সকলেই ভাবে, এতে মনে হয় পাপবিদ্ধ হতে হবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি মিশে আছে, তাই যে যার মতো করায়ত্ত করতে চায়।

জেলার বড় অফিসে প্রথম যখন আসে, সেখানে বাটোয়ারা হয়ে যায় বড় কর্তার মেজাজমর্জি মতো। অনেক হাত ঘুরে সবশেষে আসে উপজেলা সদরে। মুলুক চান শুনেছে এবার সমস্ত চালান বণ্টন করে দেওয়া হবে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে। বিতরণ করা হবে সব ফকির-মিসকিনদের মাঝে; এতিমখানা আর মাদ্রাসাগুলিতে।

কর্তৃপক্ষের এমন কঠোর সিদ্ধান্তে সে বড় আশান্বিত হয়।

মুলুক চান হারিয়ে যায় কল্পনার শৈশবে। হাতড়ে খোঁজে তার শৈশবের সেইসব ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি। সে যখন অনেক ছোট মা প্রায়ই আক্ষেপ করতেন। বাবা আলেক চানের সহায়-সম্বল ও আয়-রোজগার তেমন না থাকায় নিত্য অনটন ছিল বছরজুড়ে। অনেক ছোটবেলায় বাবা চলে গেলেও মাকে নিয়ে সাধ্যের মধ্যেই দিন যাপন করতে চেয়েছে মুলুক। একবার কুরবানির সময়ে মা তাকে অক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘বাজান, খোদা আমাগোরে তৌফিক দ্যায় নাই। নাইলে কুরবানি দিতাম। খোদার ঘর দেখবারও খায়েশ হয়। মন চায় পাক মদিনায় যাই। কিন্তু, তা কি আর সম্ভবরে বাপ?’

– সবুর করো মা। দেইখো, একদিন ঠিক তোমারে আমি খোদার ঘর দেখাইতে লইয়া যামু।

সম্ভব না জেনেও অলীক সান্ত্বনা দিয়ে মাকে খুশি করতে চায় মুলুক চান। মায়ের চোখে খুশির ঝিলিক দেখে সেও পরিতৃপ্ত হয় মনে মনে।

– তুই আমারে একদিন দুম্বার গোশত আইনা দে। আল্লাহ-রসুলের নামে এই পবিত্র জিনিস খাইয়া মনে না হয় একটু শান্তি পাই।

এইসব কথা মনে উঠলে বুকটা খাঁখাঁ করে ওঠে মুলুক চানের। গোলেজান বিবি সেই সময় মুখ ফুটে অনেক কিছুই চাইতে পারতো তার কাছে। জানাতে পারতো তার আশার কথা, স্বপ্নের কথা। কিন্তু আজ তার বোবা চোখে অসীম শূন্যতা হাহাকার করে চারপাশ ঘিরে। আজ অনেকদিন পর মহান সৃষ্টিকর্তা তার মনের কথা শুনেছে। মুলুক চানের দীর্ঘদিনের অপূর্ণ বাসনা ও খোয়াব পূরণ হতে চলেছে একটু একটু করে।

আট

দারুল উলুম ফোরকানিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার ছাত্রদের অনেকেই এতিম ও দুস্থ। বিত্তবানদের দেওয়া অর্থসাহায্য ও সরকারি কিছু দান-অনুদানে বেশ ভালোভাবেই এটি চলে। শ্যামপুর বাজারের পশ্চিমে সুবিশাল পরিসরে এর কেতাদুরস্ত ভাব দেখার মতো। সরকারের যে-কোনো সাহায্য-সহযোগিতার নেক নজর সর্বদাই এখানে আসে প্রথমে। 

ফকির চাঁন হাফেজি পড়ছে এইখানে। তবে মাদ্রাসা বন্ধ হতেই পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি চলে গেছে সে। মুলুক চান কেন তাকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে তা সে জানে না। তবে এর পেছনে যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে তা সে ঠিক বুঝতে পেরেছে।

মাদ্রাসার প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে মুলুক চান ভেতরে উঁকি দেয়। বিকালে গোশতের চালান আসার কথা থাকলেও তেমন কোনো লক্ষণ দেখতে পায় না সেখানে। বিরক্তি নিয়ে ফকির জিজ্ঞাসা করে, ‘বাবা, মাদ্রাসা তো বন্ধ। আমরা ক্যান আসছি এইখানে?’

– তুমি জানো না বাবা; তোমার মাদ্রাসায় আইজ গোশত বিলি হইব। আমি খবর পাইছি। তোমার দাদির বড় খায়েশ ছিল এই গোশত খাওনের। কিন্তু তখন সন্ধান পাই নাই।

­ বাবা; ওইগুলা তো এতিমদের জন্য। আমরা খামু ক্যান?

– আমরাও তো গরিব ফকির চান। আমাদের হক আছে। আমরা খাইলে গুনাহ হইব না। কত্ত বড় বড় লোক সব লোপাট কইরা দেয়। অফিসের বড় বড় কর্তারা লুট কইরা নেয়। আমরা নিলে কোনো পাপ নাই বাজান। তুমি ভিতরে গিয়া একবার খোঁজ নিয়া আসো। তোমার শিক্ষক কাউরে ডাইকা আনো। আমি একটু কথা কই।

জোর সাহস নিয়ে মুলুক চান যখন কথাগুলি বলছিল ছেলে তার মুখের দিকে অবাক চেয়ে থাকে। তারপর প্রধান ফটকের ভারী লোহার দরজা ঠেলে আস্তে আস্তে ভেতরে প্রবেশ করে ফকির চান। ভবনের বারান্দায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে দেখতে পেয়ে ডেকে নিয়ে আসে বাবার কাছে।

মুলুক চান মিনতি করে বৃত্তান্ত জানায় তাকে। এক পর্যায়ে কী যেন শুনে খুশিতে চকচক করে ওঠে তার চোখ। অন্তত এটুকু নিশ্চিত হয় উপজেলা সদরের গোশতের চালান থেকে বরাদ্দের একটা অংশ এই এতিমখানাতেও আসবে। সেখান থেকে একটু ভাগ যেন তাকে দেওয়া হয় – এমনটাই ছিল তার বিনীত আরজি। কিন্তু হঠাৎ তার চোখ-মুখ থমথমে হয়ে যায়। এতিম-দুস্থদের ন্যায্য প্রাপ্য মুলুক চানের জন্য নয়। অনেক পীড়াপীড়ি করেও কোনো আশ^াস বাণী না পেয়ে গভীর আশাহত হয় মুলুক চান। ফকির চানকে কিছু জানতে না দিয়ে অগত্যা সে বাড়ির পথ ধরে।

থম ধরে থাকা সে মুখের দিকে তাকিয়ে ফকির চান দিব্য দৃষ্টি দিয়ে কিছু একটা আঁচ করতে পারে।

– কিছু হইছে বাবা?

– খুব কষ্ট লাগতাছেরে বাপ। আমাগো কপালে নাই। মন্দ কপাল। তাই এমন হইছে।

ফকির চান চুপ হয়ে গেলে বাড়ির পথে যেতে যেতে মুলুক চান দীর্ঘশ^াস ফেলে হালকা হতে চায় নিজের কাছে। কিন্তু বুকের চাপা কষ্ট যেন আরো ভারী হয়ে বুকের ওপর চেপে বসে। জবান বন্ধ হওয়া মায়ের চেহারাটা মনে ভেসে উঠলে ফকিরকে উদ্দেশ করে বলে ওঠে, ‘বুঝলা বাবা; তোমার দাদির কথা শুধু মনে পড়তাছে আজকে। মায়ের অনেক খায়েশ ছিল এক টুকরা দুম্বার গোশত খাওনের। সে তো কথা কইতে পারে না। আমারে খোয়াবে ডাইকা কে যেন এই কথাই কইছিল একদিন। মুখখান একদম মায়ের মতো। মায়ের বোবা মুখখান খালি সামনে ভাসতাছে বাবা।’

তারপর হঠাৎ কী মনে হতেই বাড়ির পথে না গিয়ে ফকির চানকে নিয়ে সদরের প্রধান সড়কের পাকা রাস্তায় উঠে যায় মুলুক চান।

– চল বাজান, সদর থিকা ঘুইরা আসি। মনটা বড় অস্থির হইয়া উঠছে। গোশতের চালান আসছে কি না দেইখা আসি।

ফকির চান বাবার কথায় জবাব না দিয়ে তাকে অনুসরণ করে। জালালের ভাই জব্বারের সঙ্গে ওঠাবসা মুলুক চানের। তাকে একটু মিনতি করলে হয়তো কিছু একটা অংশ আদায় করতে পারবে। এই ভেবে মুলুক চানের শেষ ভরসার পালে উদ্দাম হাওয়া লাগে। যে-হাওয়া তাকে দিগি¦দিক শূন্য করে একেবারে তাড়িয়ে নিয়ে যায় অকুস্থলে কিছু একটা পাওয়ার নগ্ন লোভে।

পাপ-পুণ্য বোধের হিসাব-নিকাশ মেলানোর সময় তার থাকে না। মায়ের ইচ্ছা পূরণ কিংবা খোয়াবের সেই ঐশী বাণীর অমোঘ নির্দেশ তাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায় সেখানে। এই আকর্ষণ অমান্য করার শক্তি কোথায় তার?

শ্যামপুর বাজারের কাছে আসতেই যতন মুন্সির দোকানের সামনে দু-দণ্ড থেমে নেয় মুলুক চান। কিছুটা দূরে জটলার মতো দেখে ফকিরকে নিয়ে বসে পড়ে দোকানের বেঞ্চিতে। দূর থেকেই দেখে ত্রিপলে ঢাকা একখানা ট্রাক কীসের যেন মালামাল নিয়ে থেমে পড়ে আছে রাস্তার এক ধারে। আর বাজারের লোকজন জটলা পাকিয়ে সেই তামাশা দেখছে।

দলের ছেলে-ছোকরাদের নিয়ে মতি মেম্বার হইচই করে ঘোট পাকাচ্ছে সেখানে। উপস্থিত জটলা থেকে কেউ কেউ আবার লাফ দিয়ে উঠে পড়ছে ট্রাকে। বেসামাল শোরগোলে দাঙ্গা লাগার পরিস্থিতি প্রায়। ত্রাণ অফিসের কর্তাদের নাভিশ্বাস উঠে যায় সেই হট্টগোল থামিয়ে সবাইকে শান্ত করতে। কিন্তু প্রাণান্ত চেষ্টা করেও সে-চেষ্টা বৃথা হয় মাত্র।

মুলুক চান সহজেই বুঝে যায় এই দুরভিসন্ধি কার? নিশ্চয়ই কোনো বদমতলব এঁটে মতি মেম্বার এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। হাটুরে লোকের মুখে মুখে সেই ঘটনাও আর চাপা থাকে না। সে যা ভেবেছিল ঘটনা আসলেই তাই।

নির্দেশ অনুযায়ী কুরবানির সেই গোশতের চালানটি যাচ্ছিল মাদ্রাসা আর এতিমখানাগুলিতে। কিন্তু শ্যামপুর বাজারের কাছে আসতেই মেম্বারের নেতৃত্বে হাজির হয়ে যায় ছেলে-ছোকরার একটি দল। তারা চালককে কিলঘুষি মেরে নামিয়ে দেয় ট্রাক থেকে। শেষমেশ তারই নির্দেশে তাদের দু-একজন সোৎসাহে উঠে পড়ে লুট করার আশায়। আস্তে আস্তে অসহায় ট্রাকের ওপর থেকে এক এক করে খালি হয়ে যায় সম্পূর্ণ চালান।

বাজার পেরিয়ে চালানভর্তি ট্রাকটা মাদ্রাসার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না। বাজারসুদ্ধ লোক এই পুণ্য ভাগাভাগির মচ্ছবে মেতে ওঠে সহজ সংযমকে বিসর্জন দিয়ে। কিছু কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তির মুখোশ উন্মোচিত হয় সাময়িক এই বরকত লাভের আশায়।

আসরের ওয়াক্ত ঘনিয়ে আসতে থাকে ধীরে ধীরে। লিল্লাহ বোর্ডিং আর এতিমখানার কর্তাব্যক্তিরা পুণ্যলাভ থেকে বঞ্চিত হয়ে এক এক করে জড়ো হতে থাকে বাজারের দিকে। অনেকে আবার আজানের ধ্বনি অনুসরণ করে অজু সেরে মসজিদমুখী হয়। নামাজ সেরে পবিত্র বস্তুর দর্শন ও গ্রহণ লাভ শেষে সুযোগ বুঝে কিছু সংগ্রহ করে বাড়ির পানে ছুটবে – এমনটাই হয়তো আশা ছিল তাদের। কিন্তু তাদের নেক মকসদ পূরণ হওয়ার আগেই এবাদতত্যাগী একদল ভণ্ড ব্যক্তির পুণ্যলাভের মহড়া মঞ্চায়িত হয়ে যায় শ্যামপুর বাজার জুড়ে। এক নিমিষেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় সংযম ও ত্যাগের মহিমা। সুউচ্চ আরশের অজানা কোনো স্থানে আসীন হয়ে ঠিক এমনই সময়ে মহান সৃষ্টিকর্তা ধৈর্য আর সত্যের পথ বাতলে দিচ্ছিলেন তার আশরাফুল মাখলুকাতের মনে।

জ্ঞানী গুণী স্বার্থপর মানুষের এই লুণ্ঠন দেখে ঘৃণায় মূর্খ মুলুক চানের মুখভর্তি থুতু আসে। বাজারভর্তি মানুষের এ তুঘলকি কাণ্ড শেষ হলে উল্টো পথে বাড়ির দিকে সওয়ার হয় সে। ক্ষুধিত এই মানুষজাতির অসংযত লোভী আচরণ সে কোনোভাবেই মেলাতে পারে না। খান খান হয়ে ভেঙে যাওয়া খোয়াবের জন্য শুধুই ক্ষোভ জমা হতে থাকে মনে।

হতবল ফকির চানের চেহারা ভাবান্তরিত হয় নিমিষে। সে জানে মানুষের মধ্যে যা কিছু ‘অতি’ তাই স্রষ্টার বিভূতি। এই ‘অতি’ ভালো না মন্দ তার স্বরূপ খোঁজা অতি সাধারণ মুলুক চানের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে মহান স্রষ্টার নূূরের ছটা কোথায়? কেনইবা শুধু পঙ্কিল অন্ধকারের উপস্থিতি? না, তা তো হতে পারে না। বোকা অথবা চতুর মানুষগুলিকে দেখে কেমন অভক্তি আসে তার। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যাটা আরো গাঢ় হয়ে আসে। সেই অন্ধকারের মধ্যেই ফকির চাঁনের নুরানি চেহারায় অন্য রকম একটা গভীর অন্ধকার কালো হয়ে নামে।