দূরের গাঁও

‘পাখি আকাশে উড়ে বেড়ায় মন পড়ে থাকে ছোট্ট নীড়ে কুসুম কোমল ছানার কাছে।’

মাধবীর অফিস করতে ভালো লাগছে না আজ। সকাল থেকেই কেন জানি খুব অস্থির লাগছে। রাশেদের সঙ্গে কথা বলার কারণে এমনটা হতে পারে। কারণ যতবার রাশেদের সঙ্গে তার কথা হয়, সেই শুরু থেকেই প্রতিবারই তার মধ্যে একধরনের অস্থিরতা কাজ করে। সম্পর্কের প্রথম দিকের অস্থিরতাগুলি ছিল আনন্দের, আর এখন সেটা তীব্র মানসিক যন্ত্রণার। একবার শুরু হলে কোনোভাবেই মন আর স্থির হতে চায় না। দিগি¦দিক ছুটে বেড়ায়। ছোটবেলায় মাধবী তার দাদা আর বাবাকে একদিন হাঁস জবেহ করতে দেখেছিল। হাঁসটাকে জবেহ করার পর বাবা যখন ছেড়ে দিলো তখন সে দেখল, কাটা গলা নিয়েই হাঁসটা সারা উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। কী ভয়ংকর একটা দৃশ্য! বাবা আর দাদা আর বাড়ির অন্য সবাই এই দৃশ্য দেখে খুব হাসাহাসি শুরু করল; কিন্তু সে এত ভয় পেল যে তার জ¦র এসে গেল।

রাশেদের সঙ্গে কথা শেষ করার পর তার নিজেকে সেই গলা-কাটা হাঁসের মতো মনে হয়। একটা মানুষ এত পেইনফুল কীভাবে হতে পারে? অথচ রাশেদের কাব্যিক কথা শুনেই কোনো একদিন সে একদম মাজনুন হয়ে গেছিল রাশেদের জন্য। বাড়ির সকলের অবাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিল রাশেদকে।

‘এই কোথায় তুমি?’

‘অফিসে।’

‘হ্যাঁ তুমি তো অফিসেই থাকবে। সেখানে না গেলে তোমার মন ভরে না। প্রতিদিন নতুন নতুন শাড়ি পরে রংঢং করে অফিসে যাবে আর কলিগদের বিনা খরচায় দেখিয়ে বেড়াবে।’

‘তুমি কি এসব বলার জন্যই ফোন দিয়েছো?’

‘তোমার কি মনে হয় আমার সময়ের কোনো দাম নেই? তোমার সঙ্গে ফালতু প্যাচালের জন্য আমি ফোন দেই না। ফালতু মেয়েলোকরা যা মন চায় করে বেড়াক আমার তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না।’

‘প্লিজ রাশেদ কেন ফোন দিয়েছো সেটা বলো। নয়তো আমি ফোন রেখে দেব এখন। অফিসে বসে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না।’

‘তোমার তো অফিস ছাড়া দুনিয়া চলে না। অফিসই সব। হাজারবার বললাম ছেলেটাকে মানুষ করো। ওকে সময় দাও। আমার ছেলের যদি কিছু হয় আমি তোরে খুন করব মাগি কোথাকার!’

‘রাশেদ আমি ফোন রাখছি।’

‘ফোন রাখবে না বললাম। একদম ফোন রাখবে না। আমার কথা শেষ হয়নি।’

‘কী বলতে চাও বলো।’

‘আমার ছেলেকে চাই। ও তোমার কাছে থাকলে মানুষ হবে না। একটা ভণ্ড প্রতারক হয়ে বড় হবে তোমার কাছে থাকলে। ওকে আমি মানুষ করব। আমার কাছে থাকবে ছেলে।’

‘দশ মাস ওকে আমি পেটে ধরলাম। জন্ম দিলাম। কত কষ্ট করলাম। কত ঝড়ঝঞ্ঝা বয়ে ছেলেকে বড় করতেছি, আর ছেলে এখন তোমার হয়ে গেল? গত চার বছর কোথায় ছিলে তুমি? এখন খুব বাপ ফলানো হচ্ছে। আমার ছেলে কোথাও যাবে না। আমার কাছেই থাকবে।’

‘তোমার কাছে থাকবে মানে? মুখের কথা নাকি? তোর কথায় সব চলবে? এই ছেলের জন্মদাতা পিতা আমি। ছেলে আমার কাছে থাকবে।’

‘রাশেদ আমি ফোন রাখতেছি। মাথা ব্যথা করছে আমার।’

‘এই তুই ফোন রাখবি না। আমার ছেলেকে আমার কাছে দিয়ে যাবি ডাইনি কোথাকার। তুই জাহান্নামে যা, দশজনের সঙ্গে লাগায় বেড়া আমার কিছু যায়-আসে না। আমি তোর নামে মামলা করব। তুই সন্তান পালনের যোগ্য না।’

‘রাশেদ তোমার যা ইচ্ছে করো।’

মাধবী লাইন কেটে দেয়। তীব্র মাথাব্যথা করছে। রাশেদের সঙ্গে কথা বলার আফটার ইফেক্ট। লাইন কেটে দিয়ে মাধবী মোবাইলের হোমস্ক্রিনে তার ছোট্ট সোনামণির ছবিটা দেখে। স্পাইডারম্যানের কস্টিউম পরে আছে। কী সুন্দর মুচকি হাসি দিয়ে আছে কলিজার টুকরাটা। আর কয়দিন গেলেই চারে পড়বে। কত দ্রুত বাচ্চারা বড় হয়ে যায়! মাধবী দ্রুত মোবাইলের অ্যাপ অপশনে গিয়ে সিসিটিভি প্রোগ্রাম চালায়। এই অ্যাপটা সে বেশ কয়েক মাস হলো সেটাপ দিয়েছে। এটা দিয়ে ওয়াইফাই কিংবা ডেটা কানেকশন দিয়ে তার বাড়ির লাইভ অবস্থা দেখতে পারে। মাধবীদের একতলা বাড়ি। নিচতলায় তার নিজের ফ্ল্যাটসহ আরো দুটো ফ্ল্যাট আছে ভাড়া দেওয়া। ছাদে প্রচুর ফুলের টব এক পাশে। বাকি পাশগুলি রেলিংবিহীন। বাবার টাকায় এই বাড়িটা হয়েছিল। মাধবী তার ফ্ল্যাটের প্রতিটা কোনায়, ফ্ল্যাটের বাইরে, সিঁড়িরুমে, পার্কিং  লটে, এমনকি বাড়ির বাইরেও দুদিক মুখ করিয়ে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে। সিসিটিভি অ্যাপ চালানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ক্যামেরাগুলো জীবিত হয়ে উঠল। মাধবী দ্রুত তার বেডরুমের ক্যামেরা সিলেক্ট করল। পুরো ঘর দেখা যাচ্ছে। ওই তো সোনামানিক ঘুমাচ্ছে। ইস ক্যামেরটা যদি আরো পরিষ্কার হতো তাহলে দারুণ হতো। সকালে সে যখন অফিসে আসে তখনো তার স্পাইডারম্যান ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে একটু পরপর ভিডিও কল। বাসায় তেমন কেউ থাকে না মাধবীর। বৃদ্ধ বাপ, আর টনটনে পুঁচকি ছেলে স্পাইডারম্যান, আর শাফিয়ার মা। বাড়ির সবকিছুর দায়িত্ব শাফিয়ার মায়ের ওপর। শাফিয়ার মা দীর্ঘদিন তাদের বাড়িতে কাজ করছে। খুব বিশ^স্ত। শাফিয়ার মাকে ঘরের কোথাও দেখা গেল না। মাধবীর ছেলে অহন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে ঘড়ি দেখল। পৌনে দশটা বাজে। আর একটু পরই ঘুম থেকে উঠবে অহন। একদম ঘড়ির টাইম ধরে অহনের সবকিছু চলে। এতটুকু একটা ছেলে কীভাবে সময়ের সঙ্গে এত অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মাধবী সেটা জানে না। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবার রাশেদের ফোন।

‘তুমি ফোন কাটলে কেন? কেন ফোন কাটলে?’

‘রাশেদ আমি তো এখন তোমার কেউ নই। আমার সঙ্গে তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না। ন্যূনতম ডিসেন্সি তোমার বজায় রাখা উচিত।’

‘আমি তোর কেউ না তাতে কিচ্ছু যায়-আসে না; কিন্তু অহন আমার ছেলে।   আমার ছেলে আমার কাছে থাকবে। তোর মতো ডাইনির কাছে থাকবে না। থাকতে পারে না।’

ফোনটা আবার কেটে গেল। মাধবী তাকিয়ে দেখে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ শেষ।

তীব্র মাথাব্যথায় সে কাতর। অফিসের ব্যাগ খুলে মোবাইলের চার্জার বের করল। নাপা খেলো। ব্যাগের ভেতর সে দেখে স্পাইডারম্যান কসটিউমের মুখোশটা পরে আছে। এই মুখোশ সে ব্যাগে ভরল কখন? মাধবী মনে করতে পারল না। মোবাইলটা চার্জারে লাগিয়ে কড়া এক কাপ চা নিয়ে সে অফিসের বারান্দায় দাঁড়াল। লম্বা করে দুবার শ^াস নিল। চায়ে চুমুক দিলো। তারপর ভাবতে শুরু করল রাশেদ নামের জঘন্য পশুটাকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়। খুব বাপ ফলানো শুরু করেছে। মুখের কী ভাষা! মাধবী অবাক হয়ে ভাবে, একটা মানুষের একই সঙ্গে এমন দুটো রূপ কীভাবে থাকতে পারে? কত সুন্দর করে কথা বলতো রাশেদ। উচ্চারণ শব্দচয়ন সবকিছুতে কী দারুণ মাধুর্য ছিল। রাশেদকে দেখার পর এখন বেটা মানুষের ওপর তার ঘেন্না ধরে গেছে। তার কলিজার টুকরা ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শয়তানটা এখন মামলার ভয় দেখায়।

ডেস্কে এসে বসে মাধবী। ঘড়িতে দশটা বিশ বাজে। অহন ঘুম থেকে উঠে গেছে। এখন হয়তো নাস্তা করছে। অহনের সকালের মেন্যু আজকে দুধ দিয়ে রুটি ভেজানো আর একটা কলা। শাফিয়ার মা খুব যত্ন করে খাওয়ায়। এই মহিলাটা না থাকলে একা একা অহনকে মানুষ করা তার জন্য অসম্ভব হয়ে যেত। চাকরিটা ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু মাধবী চাকরি ছাড়তে চায় না। সে কারো ওপর ভরসা করতে চায় না। নিজের যুদ্ধটা নিজেকেই করতে হবে তাকে। রাশেদকে বুঝিয়ে দিতে হবে মাধবী দুর্বল অলস অযোগ্য নয়।

ডেস্কের ফোন বেজে ওঠে।

‘হ্যালো।’

‘এই কুৎসিত ডাইনি তুই ফোন কাটলি কেন? কেন ফোন রেখে দিলি?’

মাধবী খুব শান্ত থাকার চেষ্টা করে।

‘ফোনে চার্জ নেই। বন্ধ হয়ে গেছে।’

‘বন্ধ হয়ে গেছে? নাকি বন্ধ করে রেখেছিস? তোর কাছে  তো হাজারটা অজুহাত আর ব্যাখ্যা সব সময় রেডি করা থাকে। এত কুচক্রী ডাইনি আমার জীবনে দেখিনি।’

মাধবী টেলিফোন কেটে দিয়ে ফোনের তার খুলে রাখল। আর কত সহ্য করা যায়। মাধবী ঘড়ি দেখল। দশটা চল্লিশ। অহনের সকালের খাবার এর মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এগারোটায় ওকে গোসল করানো হবে। মাধবী ডেস্কের ফাইল খুলল। কাজ জমে আছে অনেক। কিন্তু কিছুতেই কাজে মন বসছে না। রাশেদ তার সমস্ত এনার্জি আর উদ্দীপনা নষ্ট করে দিয়েছে। মাধবী চার্জার থেকে মোবাইলটা খুলে ওপেন করল। খুব বেশি চার্জ হয়নি। মাত্র বিশ পার্সেন্ট। মোবাইল অন করার সঙ্গে সঙ্গেই রাশেদের ফোন আসা শুরু করল। আজকে কী হয়েছে রাশেদের? সে এমন করছে কেন?

মাধবী রাশেদের নাম্বারটা ব্লক করে দিলো। হঠাৎ করে তার মনে একটা ভয়ংকর চিন্তা এলো। আচ্ছা রাশেদ তার বাসায় গিয়ে ছেলেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে না তো? বাসায় তো তেমন কেউ নেই। শাফিয়ার মাকে বলা আছে সে বাসায় আসার আগে কোনোভাবেই যেন বাড়ির তালা খোলা না হয়। কিন্তু শাফিয়ার মাকে যদি রাশেদ ভুলিয়ে-ভালিয়ে দরজা খুলে ফেলে তখন কী হবে? রাশেদকে শাফিয়ার মা খুব ভালো করে চেনে। শাফিয়ার মায়ের ধারণা, রাশেদ বাবা হিসেবে খুব ভালো হবে। মাধবীর সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে। বুকের ধড়ফড় শব্দ সে টের পায়। দ্রুত মোবাইলের ডাটা চালু করে লাইভ ক্যামেরা অ্যাপ অন করে। বেডরুমের সিসি ক্যামেরা সিলেক্ট করে। মুহূর্তেই তার শোয়ার ঘরের ছবি ভেসে ওঠে। মাধবী মোবাইলের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। ঘরের প্রতিটা কোনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। অহন শোয়ার ঘরে নেই।

তাহলে হয়তো সে ডাইনিংয়ে শাফিয়ার মায়ের সঙ্গে খাবার খাচ্ছে। মাধবী ডাইনিংয়ের ক্যামেরা অন করে। কি অদ্ভুত! ডাইনিং রুম একদম ফাঁকা। সেখানেও কেউ নেই। বাবার ঘরের ক্যামেরা খুব দ্রুত অন করে মাধবী। তার বৃদ্ধ বাবা একদম দলা পাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন এখনো। বাবার নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। জড়া তাঁকে প্রকটভাবে গ্রাস করেছে। বাবার ঘরের কোথাও অহনকে দেখা গেল না।

মাধবী দ্রুত শাফিয়ার মাকে ফোন দিলো। শাফিয়ার মায়ের ফোন বন্ধ। সে আবার ট্রাই করল। ফোন বন্ধ। মাধবীর কপাল ঘামতে শুরু করেছে। এমনটা হওয়ার কোনো কারণ নেই। ঢাকায় শাফিয়ার মায়ের কেউ থাকে না। তার মেয়ে থাকে গ্রামের বাড়িতে। শাফিয়ার মা অন্য কোথাও যাবে – সে-সুযোগ নেই। মাঝেমধ্যে সে বাড়ির পাশেই ছোট্ট মুদির দোকানে যায়। তখন সে মাধবীকে ফোন করে জানায় যায় যে, সে দোকানে যাচ্ছে। মাধবী তখন লাইভ ক্যামেরা দিয়ে ছেলেকে চোখে চোখে রাখে। কিন্তু আজকে শাফিয়ার মা কোথায় গেল। মাধবীর হাত-পা অবশ হয়ে আসে। ডাইনিংয়ের ক্যামেরা দিয়ে সে ভালো করে ঘর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পারে, ফ্ল্যাটের মূল দরজা আলতো করে খোলা। শাফিয়ার মা কি তাহলে বাইরে গেছে? মাধবীকে না জানিয়ে কিভাবে বাইরে গেল?

মাধবী ফ্ল্যাটের বাইরের ক্যামেরায় চোখ রাখল। বাড়ির বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে মাধবীর চোখ ভিজে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। সে খুব শক্ত মেয়ে। কিন্তু এখন কোনোভাবেই নিজেকে সে ধরে রাখতে পারল না। চোখের দু-ফোঁটা পানি গালে এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার শক্ত হয়ে যায়। এখন কান্না করার সময় নয়। মাথা ঠান্ডা রাখার সময়। বাড়ির বাইরের ক্যামেরা দিয়ে সে আরো ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখে। বাড়ির আশেপাশে কোথাও শাফিয়ার মা বা তার সন্তানকে দেখা যাচ্ছে কি না? মাধবীর হাতের আঙুল কাঁপছে। সে ভালোভাবে মোবাইলের স্ক্রিন টানতে পারছিল না। শাফিয়ার মাকে আবার ফোন দিলো মাধবী। ফোন বন্ধ। কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? তার ছেলে কোথায় গেছে? বাবা রে আমি তোকে ফেলে আর কোথাও যাবো না। প্রমিজ। এই জীবনে তুই যতদিন নিজের পায়ে না দাঁড়াবি আমি তোর ওপর সারাক্ষণ ছায়া হয়ে থাকব সোনা আমার। তোর জন্য সবকিছু ছেড়ে দেব।

মাধবীর চোখ ভিজে উঠছে বারবার। চোখের পানির জন্য সে মোবাইলের ছবিগুলি ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না। চোখ মুছে মোবাইলের লাইভ ভিডিও দেখতে দেখতে হঠাৎ তার মনে হলো, বাড়ির বাইরের ক্যামেরা দিয়ে তার বাড়ির ছাদের একটা অংশে কিছু একটা ছোটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছে। মাধবী ক্যামেরা জুম করল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লাইভ ভিডিও দেখল। হ্যাঁ। একদম ঠিক তাই। তার মনে যে ভয়টা এতদিন ছিল সেটাই হলো। রেলিংহীন ছাদে অহন একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুলের টবগুলির পাশে তাকে দেখা যাচ্ছে এখন। বাড়ির বাইরের ক্যামেরা দিয়ে ছাদের পুরো অংশ দেখা যায় না। অহনের ছোট ছোট পা দুটো দেখা যাচ্ছে। রাতে স্পাইডারম্যানের পোশাকটা সে এখনো খোলেনি। কুটকুট করে ফুলের টবের পাশ দিয়ে হাঁটছে। নিচে ফুলের পাপড়ি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ফুল ছিঁড়ছে। মাধবী ক্যামেরায় তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখল অহন নাই। মনে হয় ছাদের অন্য পাশে চলে গেছে।

কী করবে সে এখন। তার মাথায় কোনো বুদ্ধি আসছে না। এতটুকু বাচ্চা ছেলে। যদি একা একা খেলতে গিয়ে রেলিংহীন ছাদ থেকে পড়ে যায়? মাধবী আর ভাবতে পারছে না। সে দ্রুত ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে কাউকে কিছু না বলেই ঝড়ের মতো অফিস থেকে বের হয়। একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। অটোরিকশায় বসে সে শাফিয়ার মাকে আবার ফোন দেয়। তার ফোন বন্ধ। পাশের ফ্ল্যাটের কাউকে ফোন দিয়ে ছাদে পাঠানো যেতো। কিন্তু এই বিষয়টা কিছুতেই মাধবীর মাথায় আসছিল না। সে মোবাইলের লাইভ ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকে। অহনকে দেখা যাচ্ছে না।

হে আল্লাহ, তুমি আমার অহনকে রক্ষা করো। বাবা আমার স্পাইডারম্যান আমি তোকে আর একটা মুহূর্তও চোখের সামনে থেকে দূরে রাখব না। বাড়ির বাইরে রাখা সিসি ক্যামেরার সামনে অহন চলে আসে। মাধবী দেখতে পায় ক্যামেরায় তিন বছরের অহনের লাইভ ভিডিও ভেসে উঠছে। ছেলেটা নিজের মনে খেলছে। ফুল ছিঁড়ছে। একবার ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে কিছু একটা ছোড়ার মতো করল যেমনটা স্পাইডারম্যান করে। মাধবীর মনে হলো, সে জ্ঞান হারাবে কিংবা এখনি তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে। অহন কিছুক্ষণ এমন করে আবার অন্যদিকে চলে গেল। এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছে না।

‘সিএনজিওয়ালা ভাই একটু জলদি যান না। আমার খুব বিপদ।’

অটোরিকশার ড্রাইভার তার কথা বুঝতে পারল কি না বা শুনল কি না সেটা বোঝা গেলো না। তবে অটোরিকশার গতি বেড়ে গেল। এর মধ্যেই রাশেদ আবার ফোন দিলো আননোন নাম্বার থেকে।

‘আজকে তুমি এমন নাটক শুরু করছো কেন মাধবী? ঘটনা কী? আমাকে ব্লক করেছো, অফিসের ফোন ধরছো না। নতুন লাঙ জুটিয়ে ফেলেছো।’

মাধবী এবার আর নিজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারল না।

‘এই শুয়োরের বাচ্চা তুই যদি আবার ফোন দেস তোর বাপের নাম আমি ভুলিয়ে ছাড়ব হারামির বাচ্চা। একটা মাকাল ফল কুৎসিত। গান্ধা।’

মাধবীর ঝাড়ি শুনে ওপাশ থেকে রাশেদ কিছু সময়ের জন্য তব্দা খেয়ে গেল। তারপর আবার স্বমহিমায় ফিরে আসার চেষ্টা করল।

‘আমি মাকাল ফল? আমি কুৎসিত? তুই তাহলে কি ফকিরনির বাচ্চা। এই অফিসটাইমে গাড়ি দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? বসের সঙ্গে পিরিত মারাইতে যাচ্ছিস?’

মাধবী ফোন কেটে দিলো এবং সে লক্ষ করল, রাশেদকে গালাগাল করে তার বেশ হালকা লাগছে।

অটোরিকশা বাড়ির গেটে চলে এলো। মাধবি ক্ষিপ্ত হরিণীর মতো অিটোরিকশা থেকে ছিটকে বের হয়ে দ্রুত বাড়ির সিঁড়ি ধরে ছাদে চলে গেল। ছাদে উঠেই তার সমস্ত শরীর হিমশীতল বরফের মতো জমে গেল। এক পাও সে নাড়তে পারছিল না। যেন সে কোনো কালো জাদুর অকস্মাৎ মন্ত্রে পাথর হয়ে গেছে।

অহন ছাদের পূর্বদিকের একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো সে স্পাইডারম্যানের মতো যেকোনো সময় শূন্যে উড়াল দেবে।

মাধবী বুঝতে পারছিল না কী করবে? এখন যদি হঠাৎ করে তাকে দেখে অহন চমকে ওঠে তাহলে হয়তো চমকের ধাক্কায় অহন ছাদ থেকে পড়ে যেতে পারে।

মাধবী দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে।

অহন হঠাৎ করে পেছন ফিরে মাধবীকে দেখতে পায়।

একটু ভয় পেয়ে যায় অহন মাকে এই অসময়ে দেখে। তারপর দুষ্টুমি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেছে এমন ভান করে বলে, ‘মামি অহন স্পাইডারম্যান। জাম্প।’

মাধবী শান্ত হয়ে বসে। তারপর বলে, ‘বাবা, আসো মায়ের কাছে আসো।’

‘নো। অহন স্পাইডারম্যান। অহন ফ্লাই।’

কথা শেষ করে ছোট্ট অহন হাত দিয়ে এদিক-সেদিক নাড়ে। তখন মাধবীর হঠাৎ করে কী জানি মনে হয়। সে ব্যাগ খুলে দেখে ভেতরে স্পাইডারম্যানের মুখোশ। মুখোশটা হাতে নেয়। তারপর বলে বাবা অহন এটা তোমার, দেখো কী সুন্দর!’

অহন কয়েক পলক মায়ের হাতের স্পাইডারম্যানের মুখোশের দিকে চেয়ে থাকে। তারপর একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ায়।

‘মাম্মি ইটস মাই। গিভ মি।’

‘আসো বাবা, এটা নাও।’ অহন এক পা এক পা করে ঘুরে আসে। মাধবী সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের মতো ছিটকে অহনের কাছে যায়। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। অহন তখন মায়ের হাতের মাস্কটা নিতে ব্যস্ত। মাধবী কাঁদতে থাকে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। তখন আবার রাশেদের ফোন আসে।

‘এই ডাইনির বাচ্চা তুই ফোন কাটস কেন? কোথায় কি করে বেড়াচ্ছিস? আমার ছেলের যদি কিছু হয়…’

মাধবী ফোন কেটে দেয়। সে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।