আবলুস কাঠের চেয়ার

সেই যে এক রাত্রি এসেছিলো যেন বা দক্ষিণ দিক থেকে সহসা উড়ে। তার আকাশব্যাপী ডানার ঝাপটায় যেন উলটপালট হয়ে যাচ্ছিলো চরাচর।

সেই রাতে আমরা একটা ঝড়ের স্বপ্নই দেখছিলাম, আমার মনে আছে – স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন। আমি আর মা। দেখছিলাম একটা ঘূর্ণি এসে আমাকে আর মাকে জড়িয়ে নিয়েছে। আর দিগন্তাবধি একটা মাঠের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে আকাশগামী হচ্ছে। সেই সময় যেন বা ঝড়ের শব্দেই আমাদের ঘুম ভেঙে, স্বপ্ন ভেঙে আমরা আরেক ঝড়ের মুখোমুখি হলাম।

সেই রাতে আমাদের খড়ের গাদা, গোয়াল ঘর, চালের তিন বান টিন উড়ে গেলো। চারটা নারিকেল গাছের মাথা, একটা তালগাছের অর্ধেকটা, একফালি কলা বাগান, লাউয়ের মাচাং, একটা কলাবাগান, আধখানা বাঁশঝাড়, হাঁসের ঘর, তেরোটা হাঁস আর একটা কালো রাজহাঁস, একটা জামকাঠের ঢেঁকি, ধানের গোলা, দুইটা আমড়াকাঠের গুড়ি, একটা প্লাস্টিকের খেলনা গাড়ি, ষাট বছরের পুরনো দোলনটা, দশটা সুপারিগাছ উড়ে গেলো। টলটলে চোখের একটা লাল গরুর বাছুর উড়ে গেলো। আরো কতো কী যে উড়ে গেলো তার হিসাব নাই। ভয় হচ্ছিলো, বাড়ির পাশের নদীটাও যদি উড়ে যায়!

২৯ এপ্রিল এলেই আমার সেই সময়ের কোনো না কোনো ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় বছর বছর। সব কথা বলা হয় না বা লিখে রাখা হয় না কোথাও। কিন্তু আজ ভোরবেলা থেকেই মাথায় ঘুরছে তেমন একটা ঘটনার কথা, যেই কথা যেন বা লাল হয়ে আছে মাথার ভিতর।

একত্রিশ বছর হয়ে গেলো – সেই রাতের ঝড়ের নৃত্য এখনো চোখের ভিতর ভুলে যাওয়া অসম্ভব এক পাখি হয়ে আছে। সব ডানাহীন, প্রাণহীন, জীব আর জড় যেন সেই রাতে ডানা পেয়ে উড়ছিলো আর উড়ছিলো, তাদের ডানায় সব বর্ণিল পালক দানবিক শক্তিতে ছটফট করছিলো। এবং আকাশে বাতাসে ছোটাছুটি আর হুড়োহুড়ি করছিলো, যেন বা আনন্দে, মহানন্দে।

জলোচ্ছ্বাসের জল ঢুকেছিলো ঝড়ের গতিতে, পাঁচ ফুট তো হবেই। সেই জল অবশ্য রাতেই নেমে গেলো। সমুদ্র থেকে একটু দূরে বলেই, নাহয় জলের উচ্চতা হতো কুড়ি ফুট।

৩০ এপ্রিল, ১৯৯১ সাল। মঙ্গলবার মানে ঝড়ের রাতের পরদিন ন্যাড়া আর ভাঙামাথা ভিটে বাড়ি আর উঠানে সূর্যের প্রথম আলো ঢুকতেই আমাদের চোখ আটকে গেলো উঠানের পাড়ে উল্টে পড়ে থাকা একটা চেয়ারের উপর।

আমি আর মা উঠানের কাদা মাড়িয়ে চেয়ারটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি চেয়ারটার হাতল ধরে উল্টে সোজা করে বসালাম। কাদা লেগেছিলো। মা এক বালতি পানি এনে ঢেলে দিলো চেয়ারের উপর। পুরনো, কাঠের চেয়ার, কাঠের রং কালো, বার্নিশ করা। বার্নিশ পুরনো হলেও এখনো খানিকটা চকচক করছে। চেয়ারের গায়ে হাত বুলিয়ে মা বললো, ‘আবলুস কাঠ হবে হয়ত।’

চেয়ারটা বেশ বড়, হাতলঅলা, আর মাথার দিকটায় নকশা কাটা। মা বসলো চেয়ারটায়, আনমনেই বললো, ‘বেশ মজবুত। আবলুস কাঠ এমনই হয়।’

মা চেয়ারে বসার পরই আমার জিনিশটার দিকে চোখ গেলো, চেয়ারের তলায় সামনের বাম পায়ার কাছে কাদায় মাখামাখি লাল কী যেন একটা। আমি উপুড় হয়ে হাত বাড়িয়ে চেয়ারের তলা থেকে সেটা বের করলাম। বাচ্চাদের একপাটি জুতো। লাল ভেলভেট কাপড়ের। আমি দৌড়ে গিয়ে পাশের ডোবার পানিতে জুতাটা ধুয়ে এনে হাতে নিয়ে মার পাশে দাঁড়ালাম। মা আমার হাত থেকে জুতাটা নিয়ে বসা থেকে উঠে চেয়ারের উপর জুতাটা রাখলো। তারপর বললো, ‘কার কে জানে! আশপাশের কারো হবে হয়ত, ভেসে এসেছে, বা উড়ে এসেছে। এইখানেই থাকুক। রাস্তা থেকে কেউ দেখে চিনলে এসে নিয়ে নিয়ে যাবে’। ইত্যাদি।

চেয়ারটাকে রেখে আমি ঘূর্ণিঝড়ে ধ্বস্ত পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। বেশিরভাগ বাড়িঘরের চালই উড়ে গেছে, গাছপালার মাথা ভেঙে গেছে। এইসব দেখে-টেকে একটা চান্দের গাড়ি মানে একটা পাবলিক জিপের পেছনে রড ধরে ঝুলতে ঝুলতে উপকূলের দিকে চলে গেলাম। কতো কী দেখলাম! গাছের মাথায় আটকে আছে  গোরু, মানুষ, কুকুর, রাজহাঁস, তরমুজ, কলার কাদি, শাড়ি ইত্যাদি।

একটা টিউবওয়েলও দেখলাম কাঁঠালগাছের মাথায়। একটা নারিকেল গাছের মাথায় দেখলাম একটা মা আর শিশুর লাশ শাড়ি দিয়ে বাঁধা। বাঁচার জন্যেই হয় মা নিজেদের বেঁধেছিলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নাই।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। মার কাছে বকা শুনতে হলো উঠানে পা রাখতেই। চেয়ারটাকে দেখলাম আগের মতোই আছে। তবে দেখই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন চেয়ারটা রোদ খেয়েছে। বাতাস খেয়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও খেয়েছে। আর মার কাছে শুনলাম কেউ নিতে আসেনি।

মা আর আমার মাথায় নানা চিন্তা – চেয়ারটা কাদের হতে পারে? সারাদিন যখন কেউ এলো না তাহলে দূরের কারো মনে হয়। জুতোটাও কি চেয়ারটা যার, তাদের? জুতোটা কি কোনো বাচ্চার পায়ে ছিলো। আরেকপাটি জুতো কই? বাচ্চাটা কি উড়ে গেলো? কোথায় গেলো? কার বাচ্চা? নাকি ভেসে গেলো? কতো দূরে গেলো? বেঁচে আছে কি না? এত ঝড়ে কেমন করে বেঁচে থাকবে?

আমি আর মা বাতাসের মধ্যে উঠানে বসে রইলাম, জোছনায়। তখনো হালকা ঝড়ো হাওয়ায় যেন জোছনাও কাঁপছিলো তির তির করে। আর মাঝে মাঝে চেয়ারটার দিকে আমাদের চোখ যাচ্ছিলো। রাতে মা বললো, ‘যা, দড়ি দিয়ে চেয়ারটা ওই সুপারিগাছটার সঙ্গে বেঁধে রেখে আয়, নাহয় কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে। কার না কার জিনিশ, ঘরে নিয়ে রাখতে মন করছে না।’

আমি চেয়ারটা মোটা একটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলাম সুপারিগাছের সঙ্গে রাস্তামুখী করে। আর হাতলে জুতাটাও জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখলাম।

কয়েকদিন পর একদিন সকালে দেখি চেয়ারটায় বাঁধা দড়িটা কেউ কাটার চেষ্টা করেছে। সঙ্গে ধারালো কিছু ছিলো না, আর মোটা দড়ি বলে কাটা শেষ করতে পারে নাই। হয়ত ভোঁতা কিছু বা পাথরের ফালি দিয়ে কাটতে গিয়েছিলো।

হাঁসের ঘরটা তো উড়েই গিয়েছিলো, কেবল ছিলো দরজাটা। মা হাঁসের ঘরের দরজার তালা আর শেকলটা  এনে চেয়ারটাকে শেকল দিয়ে পাশের জামগাছটার সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে তালা দিয়ে দিলো। কয়েকদিন পর একটা পলিথিনের ছাউনিও দিয়ে দিলাম আমরা চেয়ারটার উপর। ওখানে কখনো আমি বসে থাকি, কখনো মা কাজের ফাঁকে বসে একটু জিরিয়ে নেয়। কিংবা বাহিরের কেউ এলেও আমরা চেয়ারটাতে বসতে দিই। সকলে আরাম করেই বসে দুই হাতলে দুই হাত ছড়িয়ে।

দিন যায় রাত আসে, আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হতে থাকে। নদী দিয়ে লাশ ভেসে যাওয়া বন্ধ হয়। সঙ্গে মাছ খাওয়াও বন্ধ হয় আমাদের। কারণ তখন মাছের খাদ্য ছিলো নদী আর সমুদ্রে ভেসে যাওয়া আর ডুবে থাকা মানুষের লাশের মাংস। আমাদের পাশের বাড়িতে একটা টুনা মাছের পেটে একদিন মানুষের হাতের আঙুল পাওয়া গেলো। মনে হয় মধ্যমা। নখে লাল রঙের নেইলপলিশ দেখে বোঝা গেলো কোনো মেয়ের। সেই আঙুল দেখার জন্যে পাড়ার লোকজন জড়ো হলো সেই বাড়িতে। তারপর মাছসহ আঙুলটা কবর দেয়া হলো।

এক বছর পর আমরা মাছ খাওয়া শুরু করি। যেদিন আমি বাজারে গিয়ে একটা দেড়হাত লম্বা বোয়াল মাছ কিনে নিয়ে আসি আশি টাকায়, আর মা সেই মাছ কাটতে থাকে উঠানে বসে, তখন দেখি একটা বুড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আমাদের উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে।  বয়স সত্তর-আশি বছর হবে হয়ত। রোদে পোড়া মুখ। পরনে একটা সবুজরঙের থামি আর গায়ে শাদার উপর লাল-নীল-হলুদ ফুলের নকশা করা সুতির একটা বড় উড়না, মাথা ঢাকা। দেখি বুড়ি তাকিয়ে আছে চেয়ারটার দিকে। তারপর ধীরপায়ে হেঁটে চেয়ারটায় গিয়ে বসে। লাঠিটা উঠানে ফেলে দেয়। আমি গিয়ে কাছে দাঁড়াই। মাও মাছ কাটা রেখে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। বুড়িটাকে বলে, ‘তুমি কোথা থেকে আসছো?’

বুড়িটা মার কথার কোনো জবাব দেয় না। সে প্রথমে ঝুঁকে বসে। তারপর দুইহাত হাতলের উপর ছড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে, দুইটা হাই উঠায়। তারপর বাম হাতলে রাখা বাম হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।

বুড়ি সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে পানি খেতে চায়। মা জগ ভর্তি করে পানি এনে দেয়। দুইটা মুড়ির মোয়া, আর চিড়াগুড় আর একটা পাকা কাচকলা দেয়। বুড়ি সব খায়। তারপর থামির কাচার ভাঁজ থেকে আবুল বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই বের করে আয়েশ করে একটা বিড়ি ধরিয়ে টান  দেয়। আর মা আর ছেলেকে অবাক করে দিয়ে চেয়ারের ডান হাতলের তলার একটা চোরা পকেট থেকে একটা ছোট্ট পলিথিনের পুরিয়া বের করে। সেটা খোলে, ভেতরে তামাক-রং পেস্টের মতো আঠালো কিছু। ওইখান থেকে একটুখানি ছিঁড়ে হাঁ করে বামপাশে মাড়ির দাঁতের একপাশে রেখে আবার মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে দেয় একটুখানি।

আমি আর মা একসঙ্গেই অস্ফূটে বললাম, ‘আফিম।’

আমাদের বাড়ির সামনের ডোবাটার ওপারে যে বাড়িটা আছে, ওই বাড়ির জমির কাকুর বৃদ্ধ বাবা এইভাবে আফিম খায়। আমরা দেখেছি।

আমরা ততোক্ষণে বুঝে গেছি চেয়ারটার মালিক এসে গেছে। এক বছর পর। মা তারপরও জিজ্ঞেস করলো বুড়িকে চেয়ারটা তার কি না। বুড়ি কোনো জবাব দিলো না। মা চেয়ারের বাম হাতলে ঝুলতে থাকা লাল জুতোটা খুলে বুড়ির হাতে দিলো। বুড়ি ওইটা চোখের সামনে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর খিক খিক খিক করে হাসলো। তারপর জুতোটা বুকে চেপে ধরে হো হো করে কাঁদলো, আর কাঁদলো, কপাল চাপড়ে বিলাপ করে কাঁদলো, বুক চাপড়ে কাঁদলো। তারপর একদম শান্ত হয়ে গেলো, একদম স্তব্ধ। তারপর জুতাটা ফিতা দিয়ে নিজের গলায় ঝুলিয়ে নিলো হারের মতো।

মা এর মধ্যে চেয়ারটার তালা আর শেকল খুলে নিয়েছে। বুড়িটা উঠে সেই ভারী বড় চেয়ারটা আমাদের আবারও অবাক করে দিয়ে মাথায় তুলে নিলো ধানের বস্তার মতো। আর হাঁটতে লাগলো বড় রাস্তার দিকে। তখন আমাদের দৃষ্টিভ্রম হলো নাকি দৃষ্টিবিভ্রম কেটে গেলো আমি আর মা ঠাহর করতে পারলাম না।

আমাদের মনে হলো আসলে বুড়ি নয়, আমরা কোনো তরুণীকে হেঁটে যেতে দেখছি।