মাছ ও মানুষ

গল্পটা বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের ভিড় হতে বাড়ির সদর দরজায় এসেও গল্পটি দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ বিশ^াস করে, ভয় করে, সেইসঙ্গে মনেপ্রাণে চায় এই রকম গল্প যেন আর না হয়। রাজশাহী শহরের প্রাণ এবং সৌন্দর্য দুটোই হলো পদ্মা নদী। তারই কোলে দাঁড়িয়ে মাহতাব সদ্য শোনা গল্পটির কথা ভাবছে। ওর যুক্তিবাদী মন গল্পটির বাড়াবাড়ি বানোয়াট অংশগুলিকে এক কথায় নাকচ করে দিলো। এমন আজগুবি গল্পের জন্ম দাদা-নানার কালে হতো। বেলা তার শেষ আলো নদীর ঢেউয়ে বিলিয়ে অস্তপ্রায়। একদল কচুরিপানা ঢেউয়ের ঘূর্ণিতে পাক খেতে খেতে দূরে ভেসে চলে গেল।

প্রায় এক মাস হলো মাহতাবের পোস্টিং হয়েছে এখানে। কাজের সূত্রে মানুষের সমস্যাগুলির সঙ্গে রোজ ওর বুদ্ধির কাটাছেঁড়া চলে। অধিকাংশই দরিদ্র আর বিপদগ্রস্ত লোকজন ওর দফতরে আসে। তাদের এই কদিনে একটা ধারণা জন্মেছে মাহতাবের কোমল হৃদয় সম্পর্কে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজনের আগমন ঘটছে।

মাহতাবের স্ত্রী স্কলারশিপ পেয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে গেছে। বছরের ছুটিছাটায় দেশে আসে। এই নিয়ে মাহতাবের মা নিমরাজি ছিলেন। কেননা ছেলে তার হাত পুড়িয়ে ভাত রেঁধে খাবে, তিনি চাইছিলেন না সেটা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা মিটে গেছে। মা থাকেন ঢাকায় আরেক ছেলের বাড়ি। মাহতাব এমনিতে বেশ গোছানো পরিপাটি মানুষ। শর্মীর সঙ্গে রোজ কথা হচ্ছে। দুজনের ভেতর মনের দূরত্ব নেই বললেই চলে।

আজ অনেক চেষ্টা করেও মাহতাব ঘুমাতে পারছে না। ক্ষণে ক্ষণে গল্পটা ওকে ঠেলে দিচ্ছে রাজ্যের বিস্ময় আর অকিঞ্চিৎকর সব প্রশ্নের মুখে।

ঝিঁঝি পোকার কোরাস বাইরে। অন্ধকারের সাজানো একটা মঞ্চ যেন পৃথিবীটা। সব রাতপাখিদের, পোকাদের, রাতফুলের সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। ওই তো আকাশ ভরা তারার আলো, মেঘের পাতলা বিচরণ – সবই মাহতাবকে মনে করিয়ে দেয় সেই ছোটবেলাকার কথা। স্কুল ছুটি পড়ে গেলে আব্বা-আম্মা একদম দেরি করতেন না। ওদের দু-ভাইকে নিয়ে সোজা দাদাবাড়ি রওনা দিতেন। আব্বার এক কথা, গ্রামে না এলে, মাটিতে পা না দিলে বুদ্ধি-বল কোনোটাই হয় না। কিন্তু আজ সমস্ত বুদ্ধি-বিচার ঘোলাটে লাগে মাহতাবের। এই শহরে যারাই পোস্টিং হয়ে আসেন সকলে বউ-ছেলেমেয়ে অন্যত্র রেখে আসেন। এবং এক বছরের মধ্যে সবার শহরটা ছেড়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় অনেক মানুষ ঘরবাড়ি বিক্রি করে চলে গেছেন পর্যন্ত।

মাহতাবের বাড়িতে প্রায়ই সন্ধে নাগাদ আড্ডা জমাতে অফিসের ব্যাচেলাররা আসেন। যারা আসেন তাদের মধ্যে একজন বেশ বয়স্ক এবং বুদ্ধিমান। নানা ধরনের নিরামিষ রান্নায় হাত পাকা তার। আজকে অন্যরা চলে যাওয়ার মুখে তিনি এলেন। মাহতাব বেশ অবাক। আকাশে মেঘ জমেছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টির আশঙ্কা থেকে ওরা দুজনে হাতে হাত

জানালা-কপাট দিলো।

মনসুর ভাই চা বসালেন। বারো মাস তার গলা খুসখুস করে নাকি।

আজকে রাতে তোমার একা না

থাকাই ভালো বুঝলে। তাই চলে এলাম।

মাহতাবের গলায় চরম বিস্ময়, কেন? আজকে কীসের রাত?

বলছি দাঁড়াও। চা-টা খেয়ে দেখ আগে। তুমি নতুন এসেছ, এখানের

হালহকিকত কিছুই জানো না। যারা চলে গেল তারা তোমাকে কিছুই বলবে না। কারণ এদের অন্যের সম্পর্কে চিন্তাভাবনা কম। ওই যে পশ্চিমের মাঠটা দেখছ, আগে হাট-বাজার বসতো। মাছের নিলাম হতো। খুব সুনাম ছিল এখানের মাছের বাজারের। নানা অঞ্চলের লোকজন এসে মাছ কিনে বাড়ি ফিরতো।

মাহতাব বুঝল সেই গল্পটা আজকে আবার শুনতে হবে। তাড়াতাড়ি মনসুর ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ট্যাটা আজহারের গল্প তো! ও আমি এসেই শুনে ফেলেছি!

মনসুর ভাইয়ের চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু ফুটে উঠলো যা দেখে মাহতাব শান্ত হয়ে গেল।

কিছুই জানো না তুমি। ধৃতরাষ্ট্রের নাম শুনেছ?

কে ধৃতরাষ্ট্র?

কৌরবদের পিতা। জন্মান্ধ ছিলেন। তার অন্ধ পিতৃস্নেহে পুরো কৌরব বংশ ছারখার হয়ে গেছিল। এই শহরের অবস্থাও পাঁচ বছর আগে তেমন ছিল। অন্যায় আর অত্যাচারে পুরো শহর মেতে উঠেছিল। কারো কথা কেউ শুনত না।

বাইরে বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাহতাবের ভেতরে ভেতরে রাগ হচ্ছিল বেশ! কোথায় এই রাতে ঘুমোবে নাক ডেকে, তা নয়তো কবেকার এক মেছো আজহারের গল্প শুনতে হবে জেগে জেগে।

মনসুর ভাই আঁটসাঁট হয়ে বসলেন। বোঝাই যাচ্ছে আজ আর তিনি ঘুমাবেন না। পাশেই ফ্লাস্কভর্তি চা। কণ্ঠস্বর তার একটু ভাঙা। কিন্তু যাই বলেন সেসব লোকে মন দিয়ে শোনে। অফিসের ক্যান্টিনে কি চায়ের দোকানে মানসুর ভাইয়ের আশেপাশে মৌচাকের মতো মানুষ ভিড় করে থাকে। অন্যসব সাধারণ কথাই তিনি যখন বলেন তা আর সাধারণ থাকে না।

মাহতাব উপায় না দেখে আরো এক কাপ চা নিল। ততক্ষণে মনসুরভাইয়ের সরু সরু আঙুলের ফাঁকে দেশি বিড়ি জ্বলতে শুরু করেছে।

বুঝলে, আজহারকে তেমন কেউ চিনতো না। আর চিনবে কী করে বলো? একটা সাধারণ ভ্যানচালক, যার কি না মৌসুমি মাছ ধরার নেশা – এ রকম মানুষ তো কতই আশেপাশে! কিন্তু আজহার নিজের জাত চেনাতে সক্ষম হয়েছিল, কেন জানো?

জবাব তো জানা নেই মাহতাবের। বোবার মতো চেয়ে থাকলো। জানে এটাই মনসুর ভাইয়ের গল্প বলার কায়দা।

তিনি একটু গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন – কারণ আজহার জানতো অন্যায় সে যেই করুক না কেন সেটা অন্যায়। অন্যায় সহ্য করার মতো অতো ধৈর্য ছিল না তার।

জানো, মাহতাব এই পদ্মায় আগে ইয়া বড় বড় মাছ উঠতো! সে কী মাছ!

 কাতল, বোয়াল, রুই, ইলিশ – হেন কোনো মাছ নেই যা উঠতো না পদ্মার পেট থেকে। আমাদের আজহারের ছিল নেশা, বুঝলে, রক্তে ছিল মাছের নেশা! বিরাট সাইজের মাছ ধরায় নাকি ওর হাতে জাদু ছিল। সেদিন রাতেও নাকি এই রকম ঝড়বৃষ্টি ছিল। যদিও শহরে ছিলাম না সে-রাতে। কিন্তু আজহার পেরেছিল বিরাট একটা কাতলা মাছ ধরতে! ভাবতে পারো, ওই সাইজের মাছ ধরার পর মনের অবস্থা কী দাঁড়ায়?

ভাবো তো একবার?

মাহতাবের ঝিমুনি মতো এসেছে। মনসুর ভাই পাঁচ বছর আগের এরকম একটা রাতের গল্প বলেই যাচ্ছেন মিহি কথার বুননে।

মাহতাব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে দৃশ্যপট। একটা প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার কালো লিকলিকে মানুষ ইয়া পেল্লাই সাইজের কাতল মাছ টেনে তুলছে নদী থেকে। এরপর ভ্যানে রাখা বস্তার কচুরিপানায় শুইয়ে দিলো মাছটাকে যত্নের সঙ্গে।

প্রফেসরের বাড়িতে আগে থেকেই বলা আছে তার। এই রকম মাছ উঠলে সবার আগে যেন তার বাড়িতেই নিয়ে যাওয়া হয়। কথামতো আজহার ভ্যান সেই দিকে ঘোরালো। মুখে তার আনন্দের সুরেলা শিস!

রাত তখন নটার মতো হবে। মেঘ ঘনিয়ে আসছে। প্রফেসর বারান্দায় বসে বসে সিগারেট ফুঁকছিলেন। আজহারকে দেখে খুশিতে লাফ দিয়ে নেমে এলেন।

কি রে পেরেছিস? কই আন আন ভেতরে, দেখি মাছটা!

আজহারের গলায় আবদার ফুটে উঠলো। পয়সার দরকার আছে বটে তার কিন্তু তার সেই কথাটাও রাখতে হবে।

প্রফেসর বেশ চকচকে চোখে মাছটা দেখে, এই মাছ আস্ত যাবে মেয়ের বাড়ি। তোর টাকা রেডি আছে। দাঁড়া বাড়ির লোকে দেখুক কত বড় মাছ!

আজহার রীতিমতো মুষড়ে গেল। কী বলেন স্যার, আপনি তো বলেছিলেন আমার দাবি অনুযায়ী দুই পিস মাছ দেবেন কেটেকুটে! কথার বরখেলাপ করবেন?

মুহূর্তে প্রফেসরের মুখটা চুকা হয়ে গেল।

মাছ তো কাটাতে পারবো না। তুই টাকা নিয়ে চলে যা। বাজারে গেলে এখনো মাছ পাবি। ওখান থেকে কিনে নিস।

কিন্তু আজহার নাছোড়বান্দা কম না। সে কিছুতেই মাছ কাটা না হলে বিক্রি করবে না। দুখানা পিস তার চাই-ই চাই।

সে বৃষ্টি-মাথায় ভ্যান ঘোরালো মাছ না দিয়েই।

কিন্তু এমন মাছের চেহারা দেখার পর কার মাথা ঠিক থাকে। প্রফেসর জায়গামতো ফোন করলেন একটা। এতবড় সাহস সামান্য ভ্যানচালকের। মাছ না দিয়ে চলে যায়!

আজহার বেশিদূর নিতে পারলো না ভ্যান। তার জানা এক বাড়ি এখনো ছয়-সাত মাইলের মতো পথ। কিন্তু তার আগেই একটা মোটরসাইকেল ওকে থামালো। টর্চ দিয়ে ভ্যানের মাছটাকে দেখে বললো – মাছ কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস রে?

আজহার ভেজা লুঙ্গি চিপতে চিপতে জবাব দিলো – ইদ্রিস সাহেবের বাড়ি।

মোটরসাইকেলের দুজনের পোশাকে বোঝা গেল তারা পুলিশ। খুব রুক্ষ মেজাজে বলে উঠলো, এ মাছ থানায় যাবে।

দুই

আজহারের খিদেয় পেট চো-চো করছে। সেই দুপুরে খাবার জুটেছিল কপালে। এভাবে থানায় বসে থাকলে চলবে না ওর। অনেকক্ষণ ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। গায়ের জামা-লুঙ্গি শুকিয়ে এসেছে প্রায়। ওর চোখের সামনে টেবিলে মাছটা রাখা। লাইটের আলোয় আঁশগুলো ঝিকঝিক করছে। মাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে, এই বুঝি বড় অফিসার এসে বলবেন, যা যা বাড়ি যা।

কিন্তু মাছের মরা চোখের মতো সে আশা মরে যেতে থাকে। কিছুক্ষণ লাগে না অবশ্য আশেপাশের দু-একজন পুলিশ এসে মাছের ছবি তুলে গালগল্পে মেতে ওঠে। আজহারের পাশেই একটা কিশোর ছেলে বসা। খালি গা। চোখমুখ শুকনো। বাপকে ধরে এনে প্রচুর পিটিয়েছে। ছেলেটা বলছে, বাপ নির্দোষ। এত কষ্টেও ছেলেটি ওর হাত ধরে বলে উঠলো, নদীর সেরা মাছ ধরিছেন ভাই। ইতিমধ্যে চলে এলেন ওসি। কতগুলো চিনাবাদাম মুখে পুড়ে চাবাতে চাবাতে বললেন, শোন, খবর নিয়ে দেখলাম তুই বেআইনিভাবে এই মাছ ধরেছিস। বর্ডারে খবর দিলে কী হবে তোর বুঝতে পারছিস?

আজহারের গলা শুকিয়ে কাঠ। কোনোমতে বললো, স্যার বটতলার ঘাট থেকে ধরেছি সন্ধেবেলা। সীমান্ত ঘাট যাওয়ার উপায় আছে, আপনি বলেন? ভুল খবর পাইছেন স্যার।

অমনি তেড়ে উঠলেন ওসি। শোন কথা কম বললে শাস্তি কম। মাছ তুই পাবি না। তোর জরিমানা পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে বাড়ি যা।

কঁকিয়ে উঠলো আজহার সঙ্গে সঙ্গে। স্যার রসুলের দোহাই লাগে, জরিমানা দিয়েন না। এত টাকা কই পাবো স্যার। এই মাছ বিক্রি করে বউ এর ইঞ্জেকশন কিনতে হবে স্যার। খুব অসুস্থ আমার বউ। ব্যথায় সারারাত ঘুমাতে পারে না। দয়া করেন স্যার। সীমান্তের আশপাশেও যাইনি আমি।

ওসি একদলা থুথু ফেলে বললেন, তাহলে এই থুথু চেটে দেখা। তারপর তোর কথা বিশ^াস করবো।

মরিয়া হয়ে তাই করে দেখালো সে। কিশোরটি মুখ নিচু করে ফিসফিস করে বলে উঠলো, খোদার গজব নামবে।

থানার বাকিদের মনে তখন দয়া-মায়ার বদলে উল্লাস। ভীষণ লোভে তাদের চোখ ঝিলিক খাচ্ছে। তবু নিরুপায় আজহার শেষ চেষ্টা করতে লাগলো।

স্যার মাছ নেন। কিন্তু আমাকে দুই পিস দিয়েন। বউটা বাঁচবে না। দুই নলা বড় মাছের ঝোল-ভাত খেতে চেয়েছে বেচারী। এই অনুরোধ রাখেন স্যার।

ওসি কদাকার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, জেলে পুরে দিচ্ছি না এই তোর ভাগ্য। যা এখন ভ্যানের চাবি রেখে ভাগ। দেখ গিয়ে বউ মরে গেল কি না। মাছের পেটির লোভ কত!

এই ইকবাল যা তো মাছটা নিয়ে যা।

দৌড়ে গিয়ে পা ধরলো অসির সে। ভ্যান নিলে আমি খাবো কী স্যার! দয়া করেন।

দয়া তো দূরে থাক উল্টো কখানা বেদম চড়-থাপ্পড় খেল। চাবি রেখে দেওয়া হলো ভ্যানের। বাইরে তখন আচ্ছা ঝড়-তুফান।

থানার পেছনে মহা উৎসবে ওসি নিজ তত্ত্বাবধানে মাছ কেটে কয়েকটা ভাগ করে দ্রুত কয়েকটি জায়গায় পাঠালেন। সে-রাতে আর কী হয়েছিল জানে না কেউ। শুধু পরদিন আজহারের বউয়ের দেহে প্রাণ ছিল না আর।

মাছ মারা টেঁটা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আজহার সোজা সেই সকালে ওসির কোয়ার্টারের কাঁঠাল গাছ বেয়ে দোতলার জানালা বরাবর ছুড়ে মেরেছিল। নিখুঁত মাপ। টেঁটা গিয়ে একেবারে ওসির নগ্ন পেটে সেঁধে গিয়েছিল। মুহূর্তে গতরাতের মাছভাত বেরিয়ে বিছানা রক্তে মাখামাখি।

মনসুরভাইয়ের গলায় আশ্চর্য শান্ত ভাব। যেন পবিত্র কেতাব পাঠ করছেন তিনি। মাহতাব শিউরে ওঠে থেকে থেকে।

পরমুহূর্তেই মনসুর ভাইয়ের পালটা প্রশ্ন ছুটে আসে ওর দিকে। কিন্তু পাপির দল কী করলো জানো? এক বছর পর ফাঁসির আদেশ দিলো। এ তো জানা কথাই। পুলিশ হত্যা যে সে কাণ্ড তো নয়!

মাহতাব এবার মুখ খুললো। এই ঘটনার সঙ্গে পুরো শহরের মাছ না খাওয়ার কী সূত্র? আজহার খুন করেছে, ফাঁসি হয়েছে, বিচার শেষ, ব্যাস।

রাত অনেকটা বেড়েছে। ঝড়ের আলামত নেই আর। বৃষ্টি এখন অনেকটাই স্তিমিত। বিদ্যুৎ নেই অনেকক্ষণ। ঘরে চার্জারের আলোতে যতটা একে অপরকে দেখা যায় তাতে দেখতে পেল মনসুর ভাই ঠোঁট ফাঁক করে সামান্য হাসলেন।

আজহারের ইচ্ছে ছিল মরার আগে শেষবারের মতো পদ্মায় মাছ ধরবে। তাই কি হয়? ফাঁসির আসামিকে কে মাছ ধরতে দেবে খোলা ময়দানে। ওর মৃত্যুর দিন থেকেই শহরের মানুষ মাছ খেতে পায় না। বাজারেই পচে গন্ধ উঠতে লাগলো। এত বরফ এত কায়দা তবু মাছ পানি থেকে ওঠালেই চোখের পলকে পচে যেতে লাগলো। সরকার কত কী করলো, কিছুতেই কিছু হলো না। এই করে করে পাঁচ বছর হলো আজ।

দীর্ঘশ্বাস কি না বোঝা গেল না। তারপরই মনসুর ভাই অনেকটা হাই তুলে বললেন, সেই প্রফেসর তো বাড়ি বিক্রি করে পালালেন।

কেন? মাহতাব বেশ অবাক।

যাবে না আবার? ওর বাড়িতে নাকি আজহার মাছ চাইতে যেত প্রতিদিন মাহতাবের বেশ রাগ হলো। মরা মানুষ মাছ চায়! এ বাড়াবাড়ি বানোয়াট বক্তব্য। মেনে নেওয়া যায় না।

মনসুরভাই সুর তুলে বললেন, অভিশাপ! শাপ লাগলে এই রকম হয়! দেখো না এখানে কেউ অন্যায় করতে পারে না। সব অফিসে কেমন প্যাল প্যাল করে কাজ হয় নিয়মমাফিক। ঘুষ বলে কিছু দেখতে পাবে না এখানে। সব্বার মনে ভয়।

মাহতাব তর্ক চালিয়ে বললো, মনসুর ভাই সব মানলাম। মাছ বিক্রি হয় না। খায় না। কিন্তু কত দিন! একদিন সব ভুলে আবার মানুষ সেই পুরনো অভ্যাসে ফিরবে।

হ্যাঁ, পাঁচ বছরে ঠিক হলো না। তুমি কালই যাও পাশের সদর থেকে মাছ-ভাত খেয়ে এসো, সাতদিন বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। এমনই দশা হবে। জানো এই চোখ অনেক পাপ দেখেছে। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। জানি না আজহার কে ছিল! কেন ওর অভিশাপে মানুষ আর মাছ খেতে পারে না। তবে এটা মানি, যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে।

তিন

সকালে অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙল মাহতাবের। দেখলো মনসুরভাই চলে গেছেন। সুন্দর ঝলমলে রোদ জানালার ওপাশে। গাছের পাতা হাসছে। বড় কয়েকটি ডাল ভাঙা ছাড়া তেমন কিছু হয়নি। অফিসের জন্য তৈরি হতেই ফোন পেল শর্মীর। ফোনের বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা গেল খুব ভয় পেয়েছে গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এ কী করে সম্ভব?

মাহতাব দৌড়ে অফিসের ক্যান্টিনে গিয়ে মনসুর ভাইকে জাপটে ধরলো। কোনার দিকে নিয়ে গিয়ে জানালো শর্মীর স্বপ্নটার কথা। মনসুর ভাই চায়ে চুমুক দিয়ে মৃদু হাসলেন। বলেছিলাম না আজহার মরে নাই, ওই আসমান-জমিনের মতো সত্য সে। চিন্তা করো না। কিছু হবে না। তুমি খাস দিলের লোক।

কিন্তু এসবের মানে কী! শর্মী কেন স্বপ্ন দেখবে কালো লিকলিকে একটা লোক ওর কাছে দু-পিস মাছ চাইছে বউকে খাওয়াবে বলে!

কাঁধে হাত রাখলেন মনসুরভাই মাহতাবের। যাও ঘুরে আসো বউয়ের কাছ থেকে। আর সবকিছুর এত তত্ত্ব-তালাশ করতে যেও না। দুনিয়ায় কত কী ঘটে!

মাহতাব কাজ করে আর ভাবে, এসবের অর্থ হয় না। একটা পাগলের শহরে এসে পড়েছে ও। সত্যি সত্যি ছুটি নিয়ে কদিন শান্তিনিকেতন যাবে। অফিস থেকে ফেরার পথে বাজারে এলো ও। থরে থরে সবজি দিয়ে সাজানো বাজার। চারদিকে মানুষের ব্যস্ত কেনাকাটা। কোনো মানুষের মনে অশান্তির ছাপ নেই পর্যন্ত। ও সাহস করে একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ভাই মাছের বাজারটা কোন দিকে?

সঙ্গে সঙ্গে লোকটি জিভ কেটে দুই কান স্পর্শ করে মাথা নেড়ে ভিড়ে মিলিয়ে গেল।