পশরের জোয়ার-ভাটা

সবুজ মাস্টার হাঁসের দুটো ডিম সিদ্ধ করছেন। মেহমানকে খাওয়াবেন। দোকানে ডিম পোচ করার ব্যবস্থা  নেই। চা বানানোর বড় অ্যালুমিনিয়ামের কেটলিতে সেদ্ধ হচ্ছে। সামনের বটগাছের পাখিরা সেই লোভে বসে আছে। যা যা বেকুবের দল … বলে পাখি তাড়াতে চেষ্টা করলেন সবুজ মাস্টার। মিষ্টি এই ধমক ষষ্ঠিনী পাখির দল এক পয়সাও দাম দিলো না। বরং ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের পর্দা বাড়ল। পাখির কাছে উপেক্ষিত সবুজ মাস্টার বললেন, দেখছেন কেমন ফাজিল! এই পাখির অনেক কেচ্ছা-কাহিনি আছে, তাই মানুষরে বিশেষ পাত্তা দেয় না। সুমিত টের পেল, ক্লান্তি ভাবটা কাটতে শুরু করেছে। সাদাসিধে নিরীহ মানুষের সঙ্গটাই আসলে মনের ওষুধ।

তিনদিন ধরে রোদে পুড়ে, অসংখ্য চোর, বন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে ক্লান্ত লাগছিল তার। এলোমেলো তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল লোকজন। ঢাকা থেকে বাগেরহাটের মোংলার গ্রাম ঘুরে সাক্ষাৎকার জোগাড় করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির অ্যাসাইনমেন্ট সেধেই নেওয়া অফিস থেকে। এত ধকল হবে বুঝতে পারেনি। অনেকেই আগে মুঠোফোনে আশ^স্ত করলেও এখন মুখ খুলছে না। ইতং বিতং আলাপ করে। যাকে বলে নগদ পলটি। উন্নয়নকর্মী মনে করে কথা বলতে চেয়েছিল। সংবাদকর্মী পরিচয় জেনে অস্বস্তি হচ্ছে, বুঝতে পারে সুমিত।

এর মধ্যেও বনের কিছু কিছু গল্প অবশ্য শোনা হয়েছে সুমিতের। গরান বা বাইনের মতো দামি গাছের চোরাই কাঠ নৌকার তলায় বেঁধে নেওয়া হয়।

পাথুরিয়া ঘাট আর মাদারীপুরে এসব বিক্রির বড় বাজার। অবৈধ পাশ বন অফিস থেকেই পাওয়া যায়। তবে বিনিময় প্রথা আছে। চোরা শিকারিরা বনে আগুন দিয়ে মাছ ধরার গর্ত বানায়। বর্ষায় পানি জমলে ওই গর্তে মাছ একাই আসে সুড়সুড় করে। অথবা বাণীশান্তায় বিদেশি জাহাজ ভেড়ে বলে সেখানকার নারীরা টুকটাক ইংরেজি জানে। এমন কিছু খুচরো তথ্য সংগ্রহ হয়েছে।

সুন্দরবন হচ্ছে চিরকালের এক অমীমাংসিত রহস্য। লঞ্চে করে আসা টুরিস্ট হিরণ পয়েন্টের নীল কমলে দাঁড়িয়ে দেখবেন সূর্যোদয়। ১৯৯৫ সালে এখান থেকে গত শতকের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল প্রায় সোয়া দুই মিনিট। এসবই চলে যাবে ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ বা চেক ইন হয়ে। দুবলারচরে শুঁটকি ব্যবসার ব্যাপারীদের কারবার বা রাশ পূর্ণিমায় পুণ্যস্নান হবে। প্রাণীবিশারদের ব্যাগে থাকবে বন্যপ্রাণী দেখার দূরবীক্ষণ যন্ত্র অথবা কয়েকটি রেডিও কলার। উন্নয়নকর্মীর চোখ যাবে নুনের জ্বলে ক্ষত হওয়া নারীর ত্বকে। ইতিহাসবিদ খুঁজবে পর্তুগিজদের বানিয়ে যাওয়া লবণ কারখানার ধ্বংসাবশেষ। সুন্দরবনকে দেখা যায় শতরকম করে। তবে টুকরো গল্প দিয়ে আর যা হোক সংবাদকর্মীর ধারাবাহিক প্রতিবেদন হয় না।

গতকাল মোফাজ্জল বলছিল, ‘একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন। নোনা পানি মাটির দেশে রোইদও নোনা হয়। অভ্যাস তো নাই, কাহিল হইছেন। চাপ না নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করেন।’ ঘুরেফিরে বেড়ানোর জন্য মোফাজ্জল তাকে চিলার বৈদ্যমারির সিন্দুরতলায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে আজ সকালে। মোফাজ্জলের ভাষায়, এ-জায়গা হচ্ছে তাদের মিনি সেন্টমার্টিন। পশর নদের পাশে একেবারে খোলামেলা জায়গা। তিন রাস্তার মোড় থেকে ডানে ঢুকে মাইলখানেক এগোলে সিন্দুরতলার খাল। নদীর হাওয়া উঠে আসছে। পশরের পানি ঋতুভেদে নোনা, স্বাদু দুই-ই হয়। সিন্দুরতলা খালে জোয়ার-ভাটা আসে। গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে আবুল হোসেন আর সবুজ মাস্টার আছেন এখন ধারেকাছে। মোফাজ্জল পরিচয় করিয়ে দিয়ে মোংলার দিকে গেল। আবার এসে ঘাট থেকে নিয়ে যাবে সুমিতকে।

আবুল হোসেন কিছুক্ষণ ঝড়বৃষ্টির কথা বলে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। ‘ও মাস্টার কড়া এক কাপ চা দাও’ বলে একবার নিজেকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন। বিশেষ সুবিধা হলো না। তিনি সম্ভবত এতক্ষণে বাড়িতে ফিরে ঘুমে তলিয়েছেন।

তখন থেকে সবুজ মাস্টারের দোকানের সামনে বসে আছে সুমিত। রোদের বয়স বাড়ল। হাওয়া ছাড়ল। সুমিত দেখল, ভাটার টানে পাড়ের গোলপাতা গাছের গোড়ার অনেকটা আবার বেরিয়ে গেছে। সিন্দুরতলার খাল পশর নদের জোয়ার-ভাটায় দুলে দুলে ওঠে। বাতাসে একটু সরে গেল খুঁটির সঙ্গে বাঁধা নৌকাটা। নৌকা না বলে ছোট ডোঙা বলা ভালো। এসব ডোঙায় সাধারণত কাঁকড়ার দড়ি ফেলতে যায় একজন করে। দুজন উঠলে ডোঙা যেন শরীর দুলিয়ে বলে, না না। সেই খালের একপাশে সবুজ মাস্টারের দোকান। ওখানে বসেই দেখা গেল, পশরে ভাটা শুরু হতেই বেরিয়ে গেল পাড়ের উদোম জমি। সেখানে লবণসহিষ্ণু ছোট ছোট গাছ এতক্ষণ তলিয়ে ছিল পানিতে। নদীর গভীর দিক দিয়ে এখন সাগরের দিকে যাচ্ছে নীল রঙের দু-একটা বড় জাহাজ। দিনভর থেকে থেকে জাহাজ চলাচল করে পশরের এই চ্যানেল ধরে। মাদার ভেসেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে জাহাজ যায় নির্দিষ্ট পয়েন্টে। সেখানে রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট নৌকায় উঠে যায় চোরাই মাল। বাদাবনের অনেক গল্প সবুজ মাস্টারের জানা। ‘এসব জাহাজে সব ফরেন মানুষ থাকে’ বলতে বলতে একটা সেদ্ধ ডিম সুমিতের হাতে তুলে দিলেন।

সবুজ মাস্টারের হাতে একটা আংটি আছে। সবুজ পাথর বসানো আংটিটা অ্যালুমিনিয়ামের বাসনে লেগে টুং করে উঠল। ফরসা টুকটুকে বৃদ্ধ। পান খেয়ে মুখ লাল করে রেখেছেন। তাঁর টিনের দোকানের সামনের দিকে দড়িতে ঝোলানো পটেটো চিপসের প্যাকেট। কয়েক ফানা কলা আছে। এসব দিয়েও আতিথেয়তা করা যেত। ডিম সেদ্ধ করে খেতে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি আন্তরিকতা। এই গ্রামের ভেতর দোকানটা চলে কি না জিজ্ঞেস করতে যাবে, এমন সময় এক শিশু এলো বিস্কুট নিতে। মাস্টার ওর প্যান্টটা টেনে একটু তুলে দিলেন। কোমরে ঘুনসি বাঁধা ছেলেটার। টাকা না দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে দৌড়ে অদৃশ্য হলো গ্রামের ভেতর। সামান্য দৃশ্য কিন্তু মনে আরাম হয়। সুমিত জানতে চাইল, স্কুলে পড়ানোর পেশা কত দিন আগে ছেড়েছেন তিনি। সবুজ মাস্টার এবার একটু শব্দ করেই হেসে উঠলেন।

– দর্জির দোকানের টেলার মাস্টাররা স্কুলে পড়ায়?

– আপনার তাহলে কাপড় বানানোর দোকানও আছে? মোংলায়?

– না। আমাদের গ্রামে একজন খুব ভালো মাংস কাটতে পারত। তাকে সবাই মাস্টার ডাকত। তার নাম শুনে শখ হয়েছিল নিজের নামের সঙ্গে মাস্টার পদবি লাগাইতে।

– এই গ্রামে মাংসের দোকানের ব্যবসা চলে? চলার কথা নয়।

– ব্যবসা কে বলল? সে একবার একটা মানুষ খুব সুন্দর টুকরা টুকরা করে কাটছিল। সেই দৃশ্য যে পাঁচজন দেখেছে তারাও খুব ফেরেস্তা না। কিন্তু জীবনে আর মাংস মুখে দিতে পারে নাই। মুখে মুখে সেই গল্প চাউর হওয়ার পর থেকে লোকটার নাম হয়ে যায় মাস্টার।

– খুন করার পর কাটতে হলো কেন? প্রমাণ গায়েব করতে?

– নাহ্, ক্ষোভে। শোধ নিতে। খুন করে সব রাগ মিটায়ে লোকটারে টুকরা টুকরা করছিল নিশানখালীতে নৌকায় বইসা। তারপর গামলা ভরা ভরা মাংস ফেলায় দিছে গাঙে।

– আর আপনি সেই নৃশংস লোকটার খেতাব নিয়ে নিজের নামের সঙ্গে মাস্টার যোগ করলেন!

– আহা, মানুষটা তো আর শখ করে করে নাই। তার সঙ্গে যা ঘটল সেই গল্পটা শুনবেন না?

– যাই ঘটুক, তাই বলে এত হিংস্র একজনের জন্য আমার অন্তত কোনো সহমর্মিতা হতো না। যা হোক মোফাজ্জল অবশ্য বলছিল আপনি অনেক কিছু জানেন। কী হয়েছিল ওই লোকের সঙ্গে আর খুন যে হলো সে কে?

 – ‘বাদাবনে খুনের ঘটনা একেবারে হয় না, তা না। কিন্তু এই খুনটা মানুষ গত ত্রিশ বছরেও ভুলে নাই। ঘটনা নিশানখালীতে; কিন্তু কেউই সেই জায়গার না। রামপালের শহীদ তালুকদার ভালো শিকারি ছিল। আপনারা খালি চোখে ঠিক বুঝবেন না, পানিতেও সীমানা ভাগাভাগি আছে। জেলে মাঝিরা যেমন মানে, চোর-ডাকাতরাও জানে। শহীদ তালুকদার ছিল পয়সাওয়ালা। হরিণ আর পাখি তার লোকজনই শিকার করত। কিন্তু শহর থেকে বড় সাহেব এলে শহীদ নিজে বনে ঢুকত। চাঁদপাই রেঞ্জের নিশানখালীতে তখন অনেক হরিণ ছিল। ওই এলাকা ছিল হাতকাটা সালাম বাহিনীর দখলে। তুলাতলা বিল দিয়েও নিশানখালীর মুখে যাওয়া যায়।’

‘তখনকার বন কর্মকর্তাদের হাতকাটা সালাম বাহিনীর ভয়ে ছিল বেচান দশা। ফরেস্ট অফিস হয়ে গেল বাহিনীর বিশ্রামঘর। সেইখানে তারা হিন্দি ছবি দেখে, খাওয়া-দাওয়া করে। সেই হাতকাটা সালাম দল চালাইত বুদ্ধির জোরে। বাহিনীর দ্বিতীয়জন ছিল তাইবুর। মাঠের কাজ আসলে চলতো ওর তদারকিতেই। প্রাণে ভয় ছিল না মানুষটার। বড় জাহাজে অস্ত্রের চালান হোক আর ভারতের চোরাই মালের হিস্যা, সালাম বাহিনী না পাইলে মাল নিয়া নিশানখালী পার হইতে পারত না কোনো বাপের বেটা। সেই খালে শহীদ তালুকদার অবাধে শিকার করতে চায়। বড় অফিসাররা তারেও সমীহ করে, কারণ ভালো হরিণ, বনমোরগ এসব শুধু চাইলেই হলো – তার লোকজন একবেলার মধ্যে হাজির করতে পারে। এই ক্যাচালে সালাম বাহিনী আর শহীদ তালুকদারের বিবাদ তখন চরমে। একেবারে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসের নোনা পানির মতো। এ সময় কী হয় জানেন? বৃষ্টি যদি না হয় গাঙের পানির নুন কাটে না। একদিকে গরম আরেকদিকে খাওয়ার পানি নাই। ভাবেন অবস্থাটা। যা হোক শহীদ তালুকদারের আবার জ্ঞানবুদ্ধি ছিল মারাত্মক। সে ভাবল, এক ঢিলে দুই পাখি মারবে।’

‘ওপরতলায় খুশি হবে বনের রসদের নিয়মিত ব্যবস্থা হইলে। এই সুযোগে যদি সালাম বাহিনীকে চাপে রাখা যায় তাইলে আজ হোক আর কাল হোক দল আস্তা থাকবে না। নিশানখালীতে শিকার করতেও কোনো বাধা নাই। আর শুধু এক জায়গা কেন, অন্য খালের মাঝিদের কাছ থেকে বখরা নেওয়াও সহজ হবে। শহীদ তালুকদার খবর পাঠাইলো ঢাকায় হেডকোয়ার্টারে। বন কর্মকর্তাদের ক্ষোভটা কাজে লাগাইলো সে।’

‘সালাম বাহিনীর দ্বিতীয় নেতা তাইবুরের বাড়ি দাকোপের লাউডোবে। সেইখানে পুলিশ রেড দিলো। তাইবুরের বউ তখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাইবুর তখন বনের নামায়। নামায় বোঝেন তো? নিচু দিকে আর কি। পুলিশরে শহীদ তালুকদার বুদ্ধি দিলো, একটা বডি ফেলাইতে পারলে তাইবুর দল ছাড়বে। লং টাইমের ভাবনা আর কি বুঝলেন?’

– বুঝলাম। পুলিশ সেই ফাঁদে পা

দিলো? তাই করল? 

– ‘পা দেবে না কেন, তাদেরও তো এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যাপার আছে।’

‘লাউডোবে তখন তাইবুরের বুড়া বাপ, ছোট ভাই আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী থাকে। বউয়ের নাম রুপালি। তাইবুরের বড় বোনের সংসার হইছে আরো আগে। তাইবুর কিন্তু খুব সহজ-সরল ভালো মানুষই ছিল। বড় বোনের স্বামীর মাছের ট্রলার একবার আটকাইলো এক জলদস্যুর দল। তাইবুর তখনো বিয়া-শাদি করে নাই। হাত-পা ঝাড়া মানুষ। ছুইটা গেল বোনের স্বামীরে বাঁচাইতে। পত্রিকাওয়ালারা খবর শুইনাই হাজির। যেন ভাঙন মাছের দোপিঁয়াজা পাইছে। ভালো কথা ভাঙন মাছ চিনেন? লম্বা মুখ মাছের। গাঙের গাছপালার আবর্জনা খায়, তাই সেইরকম স্বাদ। এই মাছ অবশ্য আপনারা ঢাকায় পাবেন না। তো সেই সাংবাদিক ভাইয়েরা আবার সাথে কইরা নৌপুলিশ নিয়া আসছে। বেচারা তাইবুর আর তার বোনের স্বামী হইলো বন মামলার আসামি।’

‘হাতে হ্যান্ডকাফ পরায়ে তাদের ছবি তুলল। বন আইন মামলায় চালান দিলো খুলনা সদরে। সালাম বাহিনীর নেতা সালাম তখন ছিল সেই জেলে। চোরে চোরে খালাতো ভাই। তাইবুর দস্যু না হইলেও এখন তো তার তাই পরিচয়, ঠিক না?’

‘খাতির জমল। তাইবুরও ভাবল, পথে না নামলে আর কোনো দিন শোধ নেওয়া যাবে না। কারাগার থিকা সালামের সঙ্গে একসঙ্গে বাইর হইলো সে। বছরতিনেকের মধ্যে সে হাতকাটা সালাম বাহিনীর দ্বিতীয় মানুষ। নিশানখালীর হিস্যা নেয়। মাছ ধরার ট্রলার আটকায়। নীল জাহাজের চালান সামলায়। জাহাজে খাসি পাঠায় নৌকায় কইরা; কিন্তু শুনছি সে মানুষের গায়ে কখনো হাত তোলে না। বাংলা সিনেমায় গরিবের নায়ক থাকে না – ওইরকম আর কি। তাইবুর মাঝেমধ্যে বাড়ি ফিরে বুড়া বাপ আর ছোটভাইয়ের জন্য। বাপ ভাবল, কোনোমতে সংসার শুরু করায়ে দিতে পারলে ছেলের মন বসবে। বাড়ি ফিরা আসবে। আত্মীয়র ঘরের রুপালির সঙ্গে তাইবুরের বিয়া দিলো বুড়া।’

‘তাইবুরের মনে তেমন রং ধরল কি না বোঝা গেল না। কিন্তু বাড়ি একটু ঘনঘন আসা শুরু হইলো। তখন পানির চেয়ে ডাঙার টান আবার বাড়ল তাইবুরের। মনে মনে ইচ্ছা করে পরিবার নিয়া নিশ্চিন্তমনে একটু ঘুমাইতে। আহারে মানুষ তো সে। রুপালি আবার তারে ফিরা আসার বাতাস দেয়। মাঝ রাইতে আহ্লাদ কইরা এক পা স্বামীর পায়ের ’পরে তুইলা দিয়া বলে, ভোরে না গেলে হয় না? আপনারে ছাড়া আমার একা লাগে।

‘কিন্তু তাইবুর তো নিজের ভাগ্যে নিজেই আটকা পড়ছে। সালাম তারে ছাড়বে কেন? এর মধ্যে ইন্টার পাশ তাইবুর যতখানি ইংরেজি পড়তে পারে, বিদেশি জাহাজের বিদেশি মানুষগো কথা বুঝে – এমন শিক্ষিত সদস্য তো দলে আর নাই। সালাম তারে কারাগার থিকা ছাড়াইছে না? এত সুজা না সব হিসাব।’

‘বাপ হইতে যাবে – এই খবরে তাইবুরের মনে টান আরো বাড়ে। যাতায়াতও বাড়ে বাড়িতে। ঠিক তখন শুরু হইলো হাতকাটা সালাম বাহিনীর সঙ্গে শহীদ তালুকদারের কাইজ্জা। পুলিশ গেল সালাম বাহিনীরে কাবু করতে। তাইবুর তখন বড় চালানের জাহাজ থেকে মাল আনতে গভীর সমুদ্রে।’

‘সেদিন ভোররাতে তাইবুরের লাউডোবের বাড়ি রেইড হইলো। গ্রামের ঘরবাড়িগুলার সঙ্গে সঙ্গে বাথরুম থাকে না – দেখছেন তো। তাইবুরের বউ ওই শরীরে একা গেছে বাথরুমে। ঢাঙমারি খালঘেঁষা সেই বাথরুম থেকে ফিরার পথে মানুষের আওয়াজে ভয় পাইছে রুপালি। ভারী শরীর নিয়া দৌড় দিতে গেছে। এক বেকুব পুলিশ পরিস্থিতি না বুইঝা গুলি ছুড়ছে। রুপালি আর কোনো শব্দ করে নাই।’

‘খবর পাইয়া বাড়ি ফিরতে ফিরতে রুপালির নতুন ঘরের মাটিতে ততক্ষণে টান শুরু হইছে। ঢাঙমারির মাটির ভিতর তখন তাইবুরের বউ রুপালি আর তার পেটের ভেতর ছয় মাসের সন্তান। গতবার বাড়ি আইসাও তাইবুর জানতে চাইছে, বাচ্চা কি নড়াচড়া করে? সেই শব্দ কি কান পাতলে শোনা যায়? বাজান বইলা ডাক দেয় নাকি ভেতর থিকা?’

‘কবরের পাশে দাঁড়ায়ে এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলে নাই তাইবুর। বুড়া বাপরে ছোট ভাইয়ের জিম্মায় রাইখা সে ঘর ছাড়ছিল।’

– তাহলে শহিদ তালুকদার সাকসেস? সালাম বাহিনীর কী হলো?

– শহিদ মাস্টারেরও তো স্যারদের খুশি করার দায় ছিল। ১৫ দিন পর আবার নিশানখালী ঢুকছিল সে। খুলনায় বন মন্ত্রণালয়ের বড় সাহেব আসছে – খবর শুইনাই তাইবুর হিসাব মিলায় ফেলছে, নিশানখালীতে শহীদ তালুকদার কখন ঢুকতে পারে। এই সুযোগ ছাড়বে কেন। সেদিন দুপুর থেকে ঝড়বৃষ্টি হইছে। থমথমে হইয়া রইছে চারপাশ। শহীদ তালুকদার আরো দুইজনরে সঙ্গে নিয়ে ঢুকছে হরিণের ফাঁদ পাইতা রাইখা আসতে। সে আসার খবর আগে থিকাই পাইছে তাইবুর। খাঁড়ির ভেতর নৌকা নিয়া অপেক্ষায় ছিল। সঙ্গে তিন শাগরেদ। বন্দুক আছে, নৌকায় আছে ছেনি, চাপাতি আর দাও। রান্নাবান্নার কাজে এসব এমনিও লাগে বনের ভেতর। কিন্তু সেদিন ছোট নৌকায় এগুলা আলাদা কইরা কেন নিতেছে বুঝতে পারে নাই তাইবুরের লোকজন। নিশানখালীর ওই জায়গা তো তাইবুরের হাতের তালুর মতো চেনা। খুব বেশি বেগ পাইতে হয় নাই। বন্দুক থাকতেও তাইবুর কিন্তু শহীদ তালুকদাররে মারছে বুকে বর্শা বিঁধায়ে, যাতে যন্ত্রণা হয়। এরপর নৌকায় বইসা সারারাত ধইরা সে তার শিল্পকর্ম সম্পন্ন করছে। দেড় ইঞ্চি দেড় ইঞ্চি কইরা এক একটা টুকরা করছে সে। একেবারে সলিড পিস। মাথাটা শুধু আলাদা রাখছে।  তখন আবার বৃষ্টি শুরু হইছে। ও আল্লাহ একটা মানুষের শরীরে এত মাংস থাকতে পারে!

‘কিন্তু তাইবুরের সেই মাংস কাটার দৃশ্য কেউ ভুলতে পারে নাই। মুরগি টুকরা করার একটা নিয়ম আছে জানেন? বুকের টুকরা, রান, এগুলা সব কাটার আলাদা নিয়ম। শহীদ তালুকদারের শরীরটাও সেইরকম খুব সুন্দর কইরা যত্ন নিয়া টুকরা করছিল তাইবুর। বৃষ্টি রক্ত ধুইয়া নিছে।’ 

– এমনভাবে গল্পটা বললেন মনে হচ্ছিল আপনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আপনার বাড়ি এই সিন্দুরতলা থেকে নিশানখালী অনেক দূর। গল্পটা মানুষের মুখ থেকে শোনা?

প্রবীণ সবুজ মাস্টার এ-প্রশ্নে আবারো সেই প্রচ্ছন্নের একটা হাসি উপহার দিলেন সুমিতকে।

সবুজ মাস্টারের হাতের দিকে তাকিয়ে গল্পের বাকি অংশটুকু শেষ করলো সুমিত।

– তাইবুর খুন করার পর শহীদ তালুকদারের হাতের আংটিটা খুলে নিজের হাতে পরেছিল। প্রতিশোধ নেওয়ার বিজয় চিহ্ন হিসেবে সে-আংটি থাকে সব সময় তার আঙুলে। কিন্তু রুপালির কবরটা সে সহ্য করতে পারে না, তাই জীবনে ফিরে সে নতুন জীবন শুরু করে আরেক গ্রামে গিয়ে। সঙ্গে রাখে দলের দেওয়া খেতাব মাস্টার আর সেই আংটিটা। ভুল বললাম?

– আপনি কে?

– আমি একজন নিতান্ত ছা-পোষা সংবাদকর্মী। বড় হয়েছি রাজধানীর শিশু নিকেতন নামে এক আশ্রয়কেন্দ্রে।

– এতিম?

– বলা যায় ওরকমই। আপনার সামনে একটা সিগারেট ধরাতে পারি?

– পারেন।

পশর নদের বুকে একটা দুপুর গাঢ় হচ্ছে তখন। এখন আর জাহাজের যাতায়াত নেই। সিন্দুরতলায় দাঁড়িয়ে অন্যপাশটাকে জলরঙে আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে।

সিগারেটের মুখে আগুন দিতে দিতে উঠে দাঁড়িয়েছে সুমিত। ফেরা উচিত এখন।

সবুজ মাস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার বাবা খুন হওয়ার পর মা আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে যায়। আমার বোনের সংসার হয়েছে। মা এখন আমার সঙ্গে থাকে। ছোটবেলায় আমাকে শিশু নিকেতনে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল এক আত্মীয়।

‘আপনার আঙুলের আংটিটা শহীদ তালুকদার বিয়ের সময় উপহার পেয়েছিল। আমার মায়ের কাছে একটা ছবিতে দেখেছিলাম বাবার হাতের আংটি। মোংলার কোনো স্টুডিওতে গিয়ে বিয়ের পর পর ছবিটা তুলেছিল। ভালো কথা, ষষ্ঠী না এরকম কী যেন নাম বলছিলেন পাখিটার। এমন নামের পাখির কথা শুনিনি।’

– বনের পাখি। এই পাখিদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুবই প্রবল-প্রখর। যেসব মা সন্তানের জন্য খুবই কষ্ট করে, সন্তানদের দেখেশুনে রাখে, তাদের বলে ষষ্ঠিনী। এই পাখির চরিত্রও তেমন। দুর্গাপূজার শুরুর দিকে অশ^ত্থতলায় ষষ্ঠীপূজার আয়োজন হইলে তখন নাকি এইসব পাখির আনাগোনা বাড়ে। কেন যেন আইসা বসলো আজকে আমার দোকানের কাছে।

– আজ আসি, কেমন?

সবুজ মাস্টার পশর নদের দিকে তাকিয়ে আছেন। জোয়ার আর ভাটার মাঝামাঝি সময়ে একটা ছোট্ট ঢেউ এলো, দুলিয়ে দিয়ে গেল পাড়ের ঢোল কলমির গাছটা। ঝাপসা দেখাচ্ছে চোখ। সবুজ মাস্টার আপন মনে বললেন, ‘আমার অনেক বয়স হয়েছে। সব আর স্পষ্ট দেখি না। অবশ্য তরুণ বয়সেও যে সব স্পষ্ট দেখতাম, তা না।’

ব্যাকপ্যাক তুলে নিল সুমিত। মোফাজ্জল মোংলা থেকে রওনা হয়েছে তার জন্য।