আমাদের বাসায় ওরা থাকে

উনিশশো স্কয়ার ফুটের এই বিশাল বাসাটায় আমি আর আমার স্বামী ওয়াহাব থাকি কেবল। বেশিরভাগ সময় আমরা কেউই থাকি না। থাকে শুধু কতগুলি ধুলোপড়া ফার্নিচার। ঢাকা শহরে যেহেতু আমরা দুজনই ছাপোষা কাজের লোক, কেরানিগিরি করে খাই, তাই বাসায় থাকার বিলাসিতাটা একেবারে নেই বললেই চলে। ওয়াহাব একটা বেসরকারি ব্যাংকের এভিপি। আমি একটি করপোরেট হাউজের মানবসম্পদ উন্নয়ন তথা এইচআরে কাজ করি। আমাদের কোনো ছেলেপুলে নেই। বহু চেষ্টাচরিত্র করে আমাদের ১১ বছরে আমরা কোনো সন্তান জন্ম দিতে পারিনি। এই কারণে আমরা আমাদের দুই পক্ষের পরিবার থেকেও মোটামুটি পরিত্যাজ্য।

পারিবারিক যে-কোনো আয়োজনে আইভিএফ করো, ডোনার স্পার্ম নাও, সারোগেসিতে যাচ্ছো না কেন, কিংবা কার সমস্যা তোমার নাকি ওয়াহাবের – এইসব শুনতে শুনতে আমরা রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে গেছি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমার এবং আমার স্বামীর একটু গোড়ামির মতো আছে। স্বাভাবিক বা ন্যাচারালভাবে যদি কোনোদিন সন্তান জন্ম দিতে পারি তাহলে দেব, নতুবা স্পার্ম ডোনার, সারোগেসির মতো কোনো বিষয়ে আমরা দুজনেই চরম অনাগ্রহী।

আমার মেজোভাইয়ের তিন বাচ্চা। আমার মা ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রায়ই মেজোভাবিকে বলেন, পালতে কষ্ট হলে যেন আমাকে দিয়ে দেয় একটা। এই কথা শোনার পর থেকে আমি মেজোভাবির বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি প্রায়। এ কেমন ধারার কথা! ভাবির কাছ থেকে আমি একটা বাচ্চা আনবো। দুনিয়ায় তার ফিজিক্যাল বাপ-মা থাকতে আমাকে মা ডাকবে, আমার পরিচয়ে বড় হবে – এর চেয়ে বিচ্ছিরি কিছু কোনো সন্তানের জন্য হতে পারে না। আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবার কাছেই আমি খুব বাচ্চাবান্ধব হিসেবে পরিচিত। মেজোভাবিও আমাকে পেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, তিন বিচ্ছুকে আমার কাছে দিয়ে ভাইয়া আর সে কফি খেতে, কখনো বাজারে যায়। আমি তখন এই তিনটাকে খেলার পুতুলের মতো করে সাজাই। কারো নখ কেটে দিই, জামা বদলে দিই, খাওয়াই। মেজোভাবির মা আমার সামনেই অনবরত বলতে থাকেন – ‘পরের বাচ্চাকে যে এত তোলা দেয়, তার ঘরেও বাচ্চা আসবে। দেখবা হামাগুড়ি দিয়ে আসবে।’ আমি গা করি না।

সন্তান-না-থাকা মানুষের সন্তানপ্রীতি বড় বিবমিষার। সবাই উদগ্রীব থাকে। গত বছর সেই রোড অ্যাক্সিডেন্টের কথা মনে আছে? ট্রাকের তলে চাপা পড়ে বাবা-মা মারা গেল। গর্ভবতী মা জন্ম দিয়ে গেলেন এক সন্তানকে। সেই বাচ্চাকে দত্তক নেওয়ার জন্য ওর ছবি দিয়ে আমার হোয়াটসঅ্যাপ ভরিয়ে ফেলেছিল আমার বন্ধুরা। এক বন্ধু বললো, দেখ হয়তো তোর জন্যই ও দুনিয়ায় আসছে। একদিন পত্রিকায় পড়লাম ওর নাম রাখা হয়েছে তিথি। আমি আঁতকে উঠলাম। আমার নামে ওর নাম কেন? তবে কি ও আমার জন্যই?

সংসারের তাবৎ হিসাব-নিকাশ কষে কিছুতেই সাহস করে উঠতে পারলাম না, একটা নিষ্পাপ শিশুকে নিজের করে নিতে। আসলে ওয়াহাবের কিছুটা আপত্তি ছিল। আপত্তির পাহাড় ছিল আমার মায়ের আর শ্বশুরের। কাউকেই নিরাশ করিনি। নিজেই আরেকটু গুটিয়ে গেছি।

আরেকটু একলা হয়েছি এই বিশাল ঝুল-বারান্দাওয়ালা বাসাটায়। সাধারণত ফ্ল্যাট বাড়িগুলিতে এতবড় বারান্দা হয় না। কী আনন্দে এই ব্যবস্থা করেছে কে জানে। আমার ভালোই লাগে। বারান্দায় বসে রাস্তার হাউকাউ দেখি। অর্থাৎ যেদিন বাড়িতে থাকার সুযোগ পাই। প্রায় প্রতিদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১১টা। স্বাস্থ্যসচেতনতার অনুষঙ্গ হিসেবে আমি আর ওয়াহাব লাঞ্চ-ডিনার দুটোই অফিসে নিয়ে নিই। সন্ধ্যায় খেয়ে নিই। ওর বা আমার অফিস থেকে বের হওয়ার কথা পাঁচটায় থাকলেও আমরা কোনোদিন ৮টার আগে ছাড়া পাই না। বাকি দুই-আড়াই ঘণ্টা জ্যামে। বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে এক কাপ লিকার চা বানিয়ে দুজন একটু বারান্দায় বসি,

থামতে থাকা শহর দেখি। ঘুমানোর আগে দুজনের লাঞ্চ-ডিনার প্যাক করি। এরপর ফেসবুকিং করতে করতে বা কোনো একটা সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাই। ঘুম থেকে উঠে প্রায়শই মনে করতে পারি না সিনেমাটা কী ছিল। মনে করার সুযোগই নেই। ছটায় উঠে চায়ের পানি চাপিয়ে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে ব্রেড টোস্ট, ডিম পোচ, কিংবা ফ্রোজেন পরোটা সেঁকে নিয়ে খেতে খেতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায়। ওয়াহাবের সকালে জুস চাই, তার সঙ্গে স্যান্ডউইচ। রাতে জুসটা চাইলেও বানিয়ে রাখতে পারি না, কারণ অতো রাতে ব্লেন্ডার বা জুইসার চালালে বিল্ডিংয়ের লোকেরা আমাকে মারবে। তাই সকালেই করে দিতে হয়। রাতে চেষ্টা করি ফলটা কেটে ফ্রিজে রাখতে। এরপর থালাবাটি ধুয়ে গুছিয়ে বের হতে হতে সোয়া আটটা।

 আমরা কেউ বাসায় থাকি না বলে আমাদের বুয়া সপ্তাহে দুদিন আসে। নইলে অন্য ছুটির দিনগুলিতে আসে। কোনো কোনোদিন ছুটির দিনগুলিতে আমরা ঘুরতে যাই বলে সেদিনও আসতে পারে না। তাই এই ঘরে সুস্থভাবে থাকতে ঝাড়ামোছা, থালাবাটি ধোয়া, কাপড় ধোয়া সব আমাদের ভাগাভাগি করেই করতে হয়। ডাস্টে সিভিয়ার অ্যালার্জি আছে বলে ওয়াহাব থালাবাটি আর কাপড় ধোয়ার কাজটা করে। প্রথম যেবার আমার শাশুড়ি শুনলেন তার ছেলে কাপড় ধোয়, সেদিন কান্নাকাটি করে বাড়ি মাথায় তুললেন। আমার মাকেও দুই থেকে তিনবার ফোন করে বললেন, ওয়াহাব শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হবেই না কেন, সে কাপড় ধোয়, ঘর মোছে। সেদিন রাত ১১টায় ডাইনিং টেবিলে ওষুধ খেতে খেতে আমার শাশুড়ি যখন হেঁচকি দিয়ে কেঁদে ফেললেন, তখন জানালাম, কেবল কাপড়গুলি নিয়ে ওয়াশিং মেশিনে দেয়, আর পুরো শুকিয়ে গেলে আয়রন করতে দোকানে দেয়। আর মব দিয়ে ঘর মোছে। ন্যাকড়া চিপে চিপে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ঘর মোছে না মা। উনার হেঁচকি ওঠা থামলো; কিন্তু কান্না কমলো না।

ছেলেকে দিয়ে কাজ করাই – এই দুঃখে নাকি বিশাল বাড়িতে একা থাকবেন না – এমন ভাবনায় মা পরদিন চলে গেলেন জানি না। সেদিনই তিনি এলেন। মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙে  গেল দেখলাম ড্রয়িংরুমে একটা ছায়া সরে গেল। আমার ভাই কিছু থাকুক আর না থাকুক, কলিজা ভরা সাহস। উঠে লাইট জ্বালালাম। ফ্রিজ থেকে পানি বের করে খেলাম। তিন বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং, স্টাডি সব ঘুরে এলাম।

কোথাও কেউ নেই। অথচ স্পষ্ট একটা ছায়া দেখেছি। মেয়ে না ছেলে বুঝতে পারিনি।

বাকি রাতটা আর ঘুমাতে পারলাম না। সকাল হতে হতেই কাজের চাপে ঘটনাটা ভুলে গেলাম। দুদিন পর ধড়মড় করে ঘুম ভাঙলো। কেউ একজন ঘরে ঢুকেছিল। আমার ঘুমানোর ভঙ্গি খুব এলোমেলো। আমি স্কার্ট আর টিশার্ট পরে ঘুমাই। তাড়াহুড়া করে জামা ঠিক করলাম। স্কার্ট টেনে নিয়ে পায়ের কাছে থাকা কাঁথা টেনে নিলাম। উঠে গিয়ে কাউকেই দেখতে পাবো না জানি। দুঃস্বপ্ন হবে ভেবে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

কিন্তু প্রতিদিন আমি একই দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলাম – এই বাড়িতে আমরা ছাড়াও কেউ থাকেন – এটা আমি বেশ টের পাচ্ছি। ওয়াহাবকে বলার চেষ্টা করলাম, সে আমাকে থ্রিলার মুভি না দেখার পরামর্শ দিলো।

আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম। সেদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফিল্টারে পানি দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। ফিল্টারে পানি দিয়েছি স্পষ্ট মনে আছে, কারণ পানি দেওয়ার জগটা ধুয়ে উলটে রেখেছি। কিছু মগ ফিল্টারের ওপরে হ্যাঙ্গারে গুছিয়ে রেখেছি। একটা মগ নামানো আর ফিল্টারে অল্প পানি আছে।

ওয়াহাব পানি খেলে এই মগে খাবে না। আর এত পানি তো জীবনেও ঘুম থেকে উঠে খাবে না। ওয়াহাবকে আবার জানালাম বিষয়টা, এবার সে রেগে গেল। সে জোর করে প্রমাণের চেষ্টা করলো, আমি হ্যালুসিনেশনে ভুগছি। এই বাসায় কেউ নেই। পানি আমি দিইনি, মগ নামিয়ে পানিও আমি খেয়েছি। নিজেকে নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেছি। সে আমাকে তার সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর নম্বর দিয়ে অফিসে চলে গেল।

আমি ইদানীং প্রায়ই বাসায় ফিরে এটা-সেটা এলোমেলো দেখতে পাই। আমার ছয়তলার ফ্ল্যাটবাসায় চোর বা বিড়াল আসবে – এটা আমি মনে করি না। কোথাও কোনো ঝামেলা হয়েছে।

আমি আমার বন্ধু স্বপ্নাকে বললাম কথাটা। আমার মনে হয়, এই বাসায় কেউ আছে। স্বপ্না নিজের প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে কথা না বললেও আমার সঙ্গে ওর যোগাযোগ আর মিলমিশ খুব ভালো। সে মাথা নেড়ে বললো, হুদা কথা বলিস না। আগেই বলছি এত্ত বড় বাসা নিস না। আজাইরা। তর শাশুড়িকে এনে রাখতে পারতি। তর বাপ-মাও তো আসে নাই। এত্ত বড় বাসা অযথা নিছিস। বাসা ছেড়ে দে।

আমার বাসাটা বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজনের অভয়ারণ্য। তারা এলে খুব আনন্দ হয় আমাদের। যদিও রাতে এক-দেড় ঘণ্টার জন্য দেখা হয়। তবু মানুষ তো আসে। তাই বাসাটা আমি বা ওয়াহাব কেউই ছাড়তে রাজি নই। এই তো গত মাসে ওয়াহাবের মেজো চাচি স্ট্রোক করলেন। সবাই মিলে এই বাসায়। আমার শাশুড়িও এসে থাকলেন। পুরা বাড়ি গমগম। ভালোই কেটেছে সেই কয়দিন। তাই বাসাটা ছাড়ার বিপক্ষে আমি। আমার বন্ধু রিমির ভাই ইফতির বিয়ে হলো এই বাসায়। স্বপ্নার এইসব আলাপ এড়িয়ে আমি ওর অফিস, বস, স্বামী এইসব আলাপে চলে গেলাম। আমি নিশ্চিত স্বপ্না ভুলে যাবে। এটা আমার জন্য খুব খুব ভালো হবে।

আজ বাসায় আমি আগে এসেছি। জুন ক্লোজিং বলে ওয়াহাবের ফিরতে দেরি হবে। আমি চায়ের পানি বসিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় তীব্র সুগন্ধি টের পেলাম। একটা ব্রুট অ্যাক্সের আফটার শেভের ঘ্রাণ। ঘরের মধ্যে এত কাছে ঘ্রাণ। ভেতরে কেমন কেঁপে উঠলো। আমি ‘কে কে’বলে উঠতেই ড্রয়িং আর ডাইনিং রুমের উইন্ডচাইমটা কোনো বাতাস ছাড়াই দুলে শব্দ করতে লাগলো। রকিং চেয়ারে কারো বসার শব্দ পেলাম। এই রকিং চেয়ারটা আমার শ^শুর পাঠিয়েছেন। তাঁর বাবার ছিল। দেখতে বেশ অ্যান্টিক ও সুন্দর। কিন্তু উঠতে ও বসতে গেলে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয়। ড্রয়িংরুমে গিয়ে যথারীতি কাউকে দেখতে পাবো না। তাই আর রুমের ভেতরে গেলাম না। ওয়াশরুম থেকে ফিরে ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করলাম। আমার কি নিওরোলজিক্যাল কোনো সমস্যা হচ্ছে? অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম দুপুর ২টায়। কালকের অফিসের লাঞ্চ টাইমটা পুরা ঘেঁটে গেল। বিরক্ত লাগতেছে। তবু একবার দেখিয়ে আসি। এরপর সাইকো কাউন্সিলরের কাছে যাব। এখন চা নিয়ে ওয়াহাবের অপেক্ষা করি। সে এলে তাকে এক কাপ চা দিয়ে ঘুমাতে যাব। খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে নিজের ভেতর থেকে কিছু একটা নেই হয়ে গেছে।

আমার প্রথম মিসক্যারেজের পর থেকে এমন অনুভূতি প্রায়ই হয়। এখন খুব তীব্র হওয়া শুরু করলো। আজকে রাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠার অনুভূতিটা খুব ভয়ংকর হলো। আমি চিৎকার করে বালিশ ছুড়ে ঘুম থেকে উঠলাম। ‘আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যান’ – বলে চিৎকার করতে লাগলাম। ওয়াহাব উঠে ঠান্ডা পানি দিলো। আমাকে অনেকক্ষণ যাবত মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কেন এত ভয়, নিজে জেগে উঠলাম, বুঝতে পারলাম না। কেন জানি মনে হচ্ছিল, রাতের সেই ব্রুট এক্স আফটার শেভমাখা লোকটা আমার মাথার কাছে এসে বসেছিল। আর তীব্র অশান্তিতে আমি জেগে উঠেছি। ভয়ের চেয়ে অশান্তিই বেশি – এটা সত্য।

 ওয়াহাব ডাক্তার কনসাল্ট করলো। আমিও ওকে জানালাম আমি নিওরো ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। দুজন একবেলা অফিস ছুটি নিয়ে সেদিনই ছুটলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে টুকটাক কিছু কেনার জন্য নিচে থেকে গেল ওয়াহাব। আমি ওপরে উঠলাম। বাতাস নেই তবু আমার উইন্ডচাইম বেজেই চলেছে। দুলছে। একটা বাচ্চার খিলখিল হাসির আওয়াজ পেলাম। বাচ্চার হাসিটা এত মিষ্টি। মনে হচ্ছে দরজা খুললেই ওপাশ থেকে একটা দুষ্টু ছোট্ট বাচ্চা ঝাঁপিয়ে এসে ‘মা’ বলে জড়িয়ে ধরবে। আমি স্থির হয়ে গেছি। বাচ্চাটার হাসির আওয়াজ বন্ধ দরজার কাছ পর্যন্ত একবার আসছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ঘরময় সে ছুটে বেড়াচ্ছে। একবার কাউকে ‘মা’ বলেও ডাকল। ও কি আমাকে ডাকলো? আমি দরজার সামনে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ওয়াহাব এসে আমাকে স্পর্শ করতেই জ্ঞান হারিয়েছিলাম। সে-রাতে নাকি একটা বাচ্চাকে আর তার বাবাকে ডেকে চলেছিলাম আমি। তীব্র জ্বর প্রলাপ-বকা আমার সঙ্গে থাকতে এলেন আমার মা। মা যে কয়দিন ছিলেন তারা বেশ দূরে দূরেই ছিলো। আমি নিত্যই দেখতাম। ডাক্তার আমাকে গাদা গাদা নিওরোর ওষুধ দিলেন। যাতে আমার হেলুসিনেশন, ভার্টিগোর মতো বিষয়গুলি কন্ট্রোলে থাকে। আমি গোপনে ওষুধগুলি ফেলে দেওয়া শুরু করলাম। কারণ আমি জানি, কেউ অবশ্যই আমার বাসায় থাকে। এত তীব্র অনুভূতি ভুল হতে পারে না।

 হতেই পারে তারা কোনো অশরীরী, কেবল আমিই তাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। মা চলে গেলেন। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আমাকে দেখতে আসছে। কেউ কেউ জবাকুসুম তেল নিয়ে এসেছে। এতে নাকি মাথা ঠান্ডা থাকে। প্রেসক্রিপশনে ‘লং স্ট্রেস’ লেখা থাকায় অফিস একদম এক মাসের ছুটি দিলো। যত জমানো ছুটি ছিল সব পেলাম। ওয়াহাবও ১৪ দিনের পাওনা অ্যানুয়াল লিভ নিল যাতে আমরা ঘুরে আসতে পারি। রাত ১০টায় বাস। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কী মনে করে পুরো বাসা ভিডিও করলাম। ওয়াহাব হাসলো। আমাকে যেহেতু ডাক্তার কোনো প্রশ্ন করতে মানা করেছে যাতে ট্রিগার্ড না হই, তাই আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না। আমি হাসলাম। আটদিন সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার করে একদম সানট্যান ও ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ঢোকার মুখে ওয়াহাবকে ডিম আনতে পাঠালাম। আমি লিফটে উঠে পড়লাম। দৌড়ে ঘরে ঢুকে আমি এক ঝটকায় বাসার ভিডিও করলাম। আমার গামছা যেখানে ছিল সেখানে নেই। সেটা ডাইনিংয়ের চেয়ারে। আমার একটা ছবি মাটিতে রাখা। বুক সেলফের ওপর হেলান দেওয়া ছিল ছবিটা। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প না হলে কোনোভাবেই পড়বে না ওপর থেকে। আমার একটা চুলের কাঁটা ড্রয়িংরুমে বুদ্ধের মূর্তির পাশে। আমি যে লেভেলের খুঁতখুঁতা মানুষ – এই কাজটা আমার জন্য অলমোস্ট অসম্ভব। ওয়াহাব ডিম নিয়ে ফেরার পর অন্তত তিনবার কলিংবেল দিয়েছে। আমি ভিডিও মিলিয়ে দেখায় এত ব্যস্ত ছিলাম যে দরজা খুলতে ভুলে গেছি। খুব কাঁচুমাচু হয়ে মিথ্যা বললাম, ওয়াশরুমে ছিলাম। সে বিশ^াসই করেনি আমি বাথরুমে গিয়েছি। কারণ আমার মতো শুচিবায়ুগ্রস্ত লোক বাথরুমে যাওয়ার আগে পোশাক ছাড়বে, সব এক সাইডে করে তবেই না যাওয়া। ওয়াহাব কিছুই বললো না। এত লম্বা একটা ট্যুর দিয়ে এসে স্বাভাবিকভাবেই সে ধরে নিয়েছিল আমি ঠিক হয়ে গেছি। আমার সেই পুরনো ক্লান্তিটা ফিরে আসছে। আমি সোফার ওপরেই শুয়ে পড়লাম। ওয়াহাব একবার কিছু একটা বলতে এসেছিল, না বলেই চলে গেল।

কখন যে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। ঘুম ভাঙলো ডিম আর পাউরুটি ভাজার গন্ধে, আর সব ছাপিয়ে ব্রুট এক্স আফটার শেভের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে ঘরজুড়ে। আমার সামনে পাউরুটির প্লেট নিয়ে ওয়াহাব নাক উঁচু করে ইতিউতি তাকাচ্ছে। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতেই বললো, আফটার শেভের ঘ্রাণ পাচ্ছো, ব্রুটের, আমি ইউজ করতাম একসময়? ঘরের ভেতরে ঘ্রাণ বুঝলাম না, আমার তো ভাই নুরানি দাড়ি, আমি আফটার শেভ ইউজ করি না! আমি এবার হেসে ফেললাম। এই বাসায় তুমি আমি ছাড়াও আরো কয়েকজন থাকে। কথাটা বলতে বলতে ওর হাত থেকে ডিম-পাউরুটির প্লেটটা নিলাম। কারণ সে এমন একজন মানুষ যে পৃথিবীতে অশরীরী, জিন-আত্মা এমন কিছু বিশ^াস করে না। তার হাত থেকে প্লেট পড়ে যাবে স্বাভাবিক। আমি ওকে পানির বোতল আনতে রান্নাঘরে পাঠালাম। আমার স্থির বিশ^াস, এই বাসায় যে লোকটা আর তার ছেলে থাকে তারা এখন রান্নাঘরে নাটঘাট করছে। আমার বিশ^াস দৃঢ় করতে ওয়াহাব একটা চিৎকার দিলো। ডিম ফেলে দিলো। পানির বোতল ভাঙলো। অথচ আমরা কাচ ভাঙার আওয়াজ পাইনি। এবার ওয়াহাবের চোয়াল ঝুলে পড়লো। আমার মাথা খারাপ মনে করে যে লোক এত ইনভেস্ট করলো তার এহেন ক্ষতি। ওয়াহাব যত ভয় পাচ্ছে আমি তত হাসছি। এই বাড়িতে আমরা ছাড়া আরো কেউ থাকে – এটা প্রমাণ করতে আমার ৪৬ হাজার টাকা খরচ করে একটা টপনচ সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ট্যুর দিতে হলো, নিওরো ও সাইকিয়াট্রিস্টের পেছনে অঢেল টাকা খরচ করতে হলো। অ্যানুয়াল লিভ নষ্ট হলো। এরপর বিপদ-আপদেও অফিস ছুটি দিতে গাইগুই করবে। যাক ভাই আরেকটা মানুষ তো বিশ^াস করলো।

এই যে বাসায় কেউ থাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু আমার মাথার কাছে এসে একটা ব্যাটা মানুষ বসে আছে সেটায়। আমি থাকতে মানা করছি না। কিন্তু ভাই আমার বেডরুমে বসা যাবে না। আমার তীব্র আপত্তি এটায়। ঢোকাই যাবে না এই ঘরে। এই কথাটা কীভাবে বোঝাই, কীভাবে কমিউনিকেট করবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় ওয়াহাব দুজন লোক ঠিক করে ফেলেছে। একজন হুজুর। তিনি রাক্কি, যিনি রুকিয়া করেন। মানে দোয়া করে দেবেন, দোয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেবেন, যাতে করে ঘরে থাকা জিন চলে যায়। সারারাত ইন্টারনেট ঘেঁটে রুকিয়ার বিধি ব্যবস্থা জেনে ফেসবুক থেকে একজন লোককে রাজি করালো ওয়াহাব। এরপর এক সাধুবাবা।  দুজনই ইন্টারনেট প্রোডাক্ট। আমি পুরা হা। রাতে সুরা বাকারা ছাড়া হলো। সুরা বাকারায় ঘরে জিন-ভূত আসে না। ওয়াহাব দেখলাম দরজা চাপিয়ে দিয়ে নামাজে দাঁড়ালো। এই লোক কিবলামুখ হইছে দেখেই আমি বিস্মিত। ভয় মানুষকে কতকিছু করে। আমার শাশুড়ি প্রতিবার এসে ‘এই তুই নামাজ পড়িস নে ক্যান’ বলে কান ঝালাপালা করে দেন। সেই লোক জায়নামাজে। আমি লুকিয়ে ছবি তুলে শ^শুরের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালাম শাশুড়িকে দেখাতে।

সেই রাতে খুব নির্বিঘ্নে ঘুমালাম। সকালে ফজরের সময় ওয়াহাব ডেকে বললো, ‘ওঠো। নামাজ পড়ো, রাক্কি আসবেন।’ আমি নামাজে দাঁড়ালাম। কেন জানি ভেতর থেকে হুহু করে কান্না উঠে আসছে। কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল যেন। আমি আর পারছি না। আমার পাশে ছোট্ট একটা বাচ্চার নিশ^াস টের পেলাম সালাম ফেরানোর সময়। জায়নামাজ ওঠানোর সময় টের পেলাম কেউ একজন জায়নামাজে বসে আসে। একটু আধভাঁজ করে রাখলাম। ঘুমন্ত বাচ্চার নিশ^াস। মেজো ভাবির টুবলুটা এমন করে নিশ^াস নেয় ঘুমালে। কী মায়া লাগলো। রাক্কি না আসা পর্যন্ত আমি জায়নামাজেই বসে রইলাম। একটা বিষণ্নতা, একটা হেলুসিনেশন দূর করতে কত কিছু যে করছি। নাকি সত্যি সত্যিই এমনটা ঘটছে। কেউ সত্যিই আছে। না থাকলে ওয়াহাব টের পেত না। বিশেষ করে আফটার শেভের ঘ্রাণ।

রাক্কি ভদ্রলোক ভীষণ স্মার্ট হুজুর। বিশাল এক ট্যাব নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে দুজন অ্যাসিট্যান্ট। ওয়াহাবের কাছে দুই বোতল পানি চাইলেন। আমাদের অজু করে আসতে বললেন। নানা রকম প্রশ্ন করলেন। ট্যাব খুলে একটু পরপর অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেক করছেন। দোয়া পড়ছেন। বোতলের পানি দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। একটা খেতে বললেন। আরেকটা সারাঘরে ছিটিয়ে দিতে বললেন। কালোজিরা ও মধুর একটা প্যাকেজ ছিল, সেটা দিলেন। তাঁর সঙ্গী সিøপ কেটে দিলেন। আমরা বিল দিলাম। ওয়াহাব নাস্তা দিলো। তাঁরা খেয়ে বের হয়ে গেলেন। আমাদের ছুটির আরো তিন দিন বাকি আছে। আমি ঘুম দিলাম। একসময় টের পেলাম ওয়াহাব আমার পাশে এসে শুয়েছে। খুব আরামের তিন ঘণ্টা ঘুম ঘুমিয়েছি। দুজনেরই ঘুম ভাঙলো খাট দুলে ওঠায়। একটা ছোট্ট বাচ্চার হুটোপুটি। আর খিলখিল হাসি। আর তেমন কোনো আওয়াজ কখনোই শুনিনি।

ওয়াহাব হুজুরকে ফোন দিতে গেল। আমি বাধা দিলাম। বললাম, থাক, দেখো কোনো ক্ষতি তো করছে না। কাউকে ভয় দেখাচ্ছে না। তাহলে থাকুক। বোধহয় আশ্রয় নেই। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি যে অসুস্থ নই এটা প্রমাণ হয়েছে এটাই শান্তি। শুধু বলে দিতে হবে ডিম ভাঙার মতো অনিষ্ট করা যাবে না।

হুজুরের দোয়ায় কাজ না হওয়ায় ওয়াহাব নিজে থেকেই সাধুবাবাকে মানা করে দিলো। আমরা মেনে নিলাম দুজন মানুষের উপস্থিতি। আমি কয়েকবার চিৎকার করে লোকটাকে বলেছি, আপনি আমার ঘরে আসবেন না। মজার বিষয় হলো, আমি নামাজে দাঁড়ালে দরজা খোলা থাকলে ছোট বাচ্চাদের মতো সেই শিশুটি জায়নামাজে খেলা করে। খুব মজার একটা খেলা। আমার মতো একেবারে কম নামাজ পড়া লোক একদম নিয়ম করে নামাজ পড়া শুরু করলাম। যেখানেই যাই নামাজে দাঁড়াই, মনে হয়, সেই ছোট্ট ছেলেটা এসে জায়নামাজে খেলা করবে।

মাসখানেক কেটে গেছে। তাদের উপস্থিতিতে আমরা ভালোই আছি। লোকটা এখন শুধু ড্রয়িংরুমে আর ডাইনিংয়ে আসে। একদিন ওয়াহাব চিৎকার করে উঠলো – আপনি কে। আপনিও ছিলেন এই বাড়িতে। আমি বেডরুম থেকে ড্রয়িংরুমের দিকে একটা ছায়া সরে যেতে দেখলাম। ওয়াহাবের আতঙ্কিত মুখ। রান্নাঘরে প্লেট গোছাতে ঢুকেছিল সে। আমরা ওদের দেখতে পাই না খুব একটা। মাঝে-সাজে একটা-আধটা ছায়া সরে যায়। কিংবা উপস্থিতি খুব টের পাওয়া যায়। এবার টের পেলাম এটা একজন নারী। মনে হয় সেই ছেলেটার মা। ছেলেটা এখন আমার কাছে কম আসে। খিলখিল করে হাসে। আমার উইন্ডচাইম দোলে।

বিষয়টা আপনাদের সবার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হলেও আমাদের কাছে খুব খুব স্বাভাবিক। আমরা মেনে নিয়েছি। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছা করে, এরা কারা? আমাদের বাসায় কেন? কখনো মনে হয়, এরা আমাদের খুব কাছের। হতে পারে এরা আমার বাসায় থাকা কোনো একটা বইয়ের চরিত্র। বই থেকে বের হয়ে এসেছে। নয়তোবা আমরা নেপাল থেকে যে উইন্ডচাইমটা এনেছি সেটায় খোদাই করা একটা বাড়ির ছবি আছে। ওরা ওই বাড়িটার লোকও হতে পারে। হয়তো ছবিটার সঙ্গে এখানে চলে এসেছে। এখন আমাদের উইন্ডচাইম দুললে, নিশ^াসের শব্দ কিংবা কখনো-সখনো ছায়া সরে গেলেই বুঝি ওরা আছে।

মেয়েটা মাঝে মাঝে গুনগুন করে গান গায়। কোনো ভাষা নেই গান নেই, শুধু মিষ্টি একটা আওয়াজ। খুব চেনা আওয়াজ; কিন্তু মনে করতে পারি না। বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে, শুধু মনে হয়, বহুদূরে কোনো এক নির্জন দ্বীপের অন্ধকার পাহাড় থেকে ভেসে আসছে এই সুর …