শেষ ফাল্গুনের আশ্চর্য সুন্দর সকালবেলা।
শীত প্রায় ফুরিয়ে এসেছে কলকাতা শহরে। সকালের ঝকঝকে রোদের সরু রেখা জানালা গলে বিছানায় এসে পড়েছে। রোদের রং সোনালি মধুর মতো। হেমন্ত তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ঋতু, কিন্তু ফাল্গুনের আলো-হাওয়ার মাধুরী তাঁকে মুগ্ধ করে।
ঘুমের আমেজে পাশ ফিরে নিবিড় হয়ে বালিশটাকে আঁকড়ে ধরেছেন আর তখনই ঘুমটা কেচে গেল জীবনানন্দ দাশের।
ছুটির দিন।
জীবনানন্দ ভেবেছিলেন, আয়েশি ভঙ্গিতে বেলা করে ঘুম থেকে উঠবেন। বিছানায় বসেই প্রথমবার চা খেয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাবেন। ধীরেসুস্থে বাথরুমে ঢুকবেন। সারাদিনের কাজ ও অকাজ নিয়ে নির্জনে একা একা বসে ভাববেন। ভাবতে তিনি ভালোবাসেন। বিশেষ করে কবিতার কথা। দূর তারুণ্যের প্রথমবেলায় পূর্ববাংলার বরিশালে হারিয়ে ফেলা মুনিয়ার কথা। কখনো শোভনার কথা।
কিন্তু না, সেসবের কিছুই আর হলো না।
ঘুম ভাঙলো লাবণ্যর চিৎকার ও চেঁচামেচিতে।
লাবণ্য প্রায় মারমুখী ভঙ্গিতে তেড়ে এলো – এমন বাড়িতে কি থাকা যায়? সাতসকালে এসব কী শুরু হয়েছে? রাত নেই দিন নেই, সারাক্ষণ গান-বাজনা আর হল্লা চলছেই? রাতে ভালো করে ঘুমুতে পারিনি।
জীবনানন্দ ঘুমভাঙা চোখে পাশ ফিরে তাকালেন। কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
লাবণ্য চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কী হয়েছে? দয়া করে একবার বিছানা ছেড়ে উঠে দেখো।
ভোরবেলায়, সূর্য ওঠার সময় একটু হাঁটতে বেরোন জীবনানন্দ। আজ বের হননি। তাঁর শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। তারচেয়ে বলা ভালো, মনটা ভালো নেই। ইদানীং নানা কারণে বিব্রত ও সংকুচিত হয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। হয়তো জীবনের মানেও।
আড়মোড়া ভেঙে জীবনানন্দ বিছানায় উঠে বসলেন।
লাবণ্য কথা বলে একবার ঘরের বাইরে গিয়েছিল। আবার ফিরে এলো। তার গলার স্বর আগের থেকে ওপরে উঠলো – আজই তুমি এই মহিলাকে তুলে দেবে; নয়তো আমি নিজেই এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
জীবনানন্দ কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। তিনি খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন।
একটু বিরতি দিয়ে লাবণ্য বলল, অসম্ভব। এভাবে কোনো বাড়িতে থাকা যায় না। কোনো ভদ্র মানুষ থাকতে পারে না।
আর একবার ‘কী হয়েছে’ – বলতে গিয়েও চেপে গেলেন জীবনানন্দ। স্ত্রীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক কিছু বললেন না।
সংসারে কেউ একজন উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে এলে দ্বিতীয়জনকে বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। বরং প্রয়োজনে নীরব থাকা ভালো। নিরাপদও কি নয়?
এই সূত্রটা তিনি মেনে চলেন।
লাবণ্য বলল, সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় ওই মহিলা টয়লেট এতক্ষণ আটকে রাখে যে, রোজ আমার স্কুলের দেরি হয়ে যায়।
জীবনানন্দ দুঃখী মুখ করে স্ত্রীর চোখে তাকালেন।
লাবণ্য আরো সরে এলো, জীবনানন্দের একেবারে মাথার কাছে এসে বলল, আচ্ছা সে কি বাথরুমেও গানের চর্চা করে নাকি? আশ্চর্য মহিলা তো।
এখন ঘুমের চেষ্টা করা বৃথা। ঘুম আর আসবে না। বিছানা ছেড়ে স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে জীবনানন্দ ঘরের বাইরে এলেন। আবার ঘরে এলেন।
লাবণ্য বলল, তুমি তাকে আমাদের বাথরুম ব্যবহার করতে দিও না।
জীবনানন্দ বললেন, সে কী করে হয়, বলো? তাকে সাবলেট করার সময়েই কথা দিয়েছিলাম। এখন তাকে কোথায় স্নান করতে বলি?
উঠোনের কলে সে চান করুক।
সেটা কী ভালো দেখায়?
এই তো দিন কয়েক আগের কথা; সেদিন লাবণ্যর স্কুল ছিল না। তবু সকাল শুরু হতে না হতেই তেড়ে এলো জীবনানন্দের ঘরে। রণমূর্তি ধারণ করে সে বলল, এই যে কবি সাহেব, ছেলেমেয়ে নিয়ে ভোরের ঘুমটাও কি আমার এবার ত্যাগ করতে হবে?
কেন, কী হলো? জীবনানন্দ থতমত ভঙ্গিতে তাকালেন।
ভোর হয়ইনি গান-বাজনা শুরু হয়ে গেছে। এটা কি যাত্রার মঞ্চ নাকি? এভাবে কোনো বাড়িতে সুস্থ মানুষ ঘুমাতে পারে?
জীবনানন্দ গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, দেখো, একটু সহ্য করো। বেচারা গান শিখিয়ে সংসার চালায়। এছাড়া সে গানবাজনা ভালোও বাসে। তার রেওয়াজটুকু সে করবেই। ওর একটু স্বাধীনতা তো দরকার।
লাবণ্য কটমট চোখে জীবনানন্দের মুখে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সে গজরাতে লাগলো।
ভাড়াটে হিসেবে এই বাড়িতে ওঠার পর, দিনে দিনে সুরুচি মজুমদার নামক উপভাড়াটিয়া মহিলার স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে গেছে। এখন সেটা সহ্যের মধ্যে আর আটকে নেই। লাবণ্য তবু মাঝে মাঝে সহ্য করে নেয়। কিন্তু পাশের ঘরের গান-বাজনা ও হই-হুল্লোড় জীবনানন্দের পড়া ও লেখায় এত বিঘ্ন ঘটায়, তাঁর পাগল হওয়ার দশা হয়।
উপভাড়াটিয়া ভদ্রমহিলার জীবনধারার সৌরভ ও গৌরবে তাঁর নিজের লেখা এবং সংসারও চাপে পড়েছে। তবু তিনি কিছু বলতে পারছেন না। পারছেন না যে, সে-কারণেও তাঁর স্নায়ুচাপ হচ্ছে। নানাভাবে তিনি চেপে আছেন, দিনের পর দিন।
লাবণ্য দাঁড়িয়ে থেকে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। তার কপাল কুঁচকে আছে। ঠোঁট কাঁপছে।
জীবনানন্দ আর কথা বাড়ালেন না, সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলেন।
বাথরুম এক রহস্যময় জায়গা। অনেক ভাবনা ও কৌশলের সমাধান বাথরুম থেকে পাওয়া যায়। সাত সকালে যে তীব্র ও অচেনা আবহাওয়া শুরু হয়েছে বাড়িতে, কীভাবে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, বাথরুমে বসে তাই ভাবতে লাগলেন জীবনানন্দ।
অনেক ভাবলেন। কিন্তু ভেবেচিন্তে কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। উপভাড়াটিয়া সংক্রান্ত জটিলতায় তিনি ও তাঁর পরিবার অনেকদিন ধরেই ভুগছেন। কিছু বিহিত করতে পারেননি। তিনি কি পালিয়ে বাঁচবেন?
এর আগে আরো দুজনকে সাবলেট করেছিলেন জীবনানন্দ।
একজন ছিলেন তরুণ কবি অমল দত্ত। অমল অমায়িক মানুষ। শেষের দিকে অমল কিছুই করতেন না, ফলে ভাড়া দিতে না পারায় নিজে থেকেই চলে গেছেন।
তারও আগে ছিলেন মেজর এইচ কে মজুমদার। ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে শুরু করে ছয়-সাত মাস ছিলেন মেজর মজুমদার। তিনি জীবনানন্দের ননী পিসির বোনের স্বামী। তখন তাঁর কাছে বীমার পলিসি বিক্রি করার চেষ্টাও করেছিলেন। অন্যদের মধ্যে তাঁর নিজের বাসার ভাড়াটেকেও একটা পলিসি কেনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন জীবনানন্দ।
কিন্তু এখনকার মতো কোনো উপভাড়াটিয়াকে নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়নি।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে, মুখে কিছু না দিয়েই জীবনানন্দ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। চা পর্যন্ত না খেয়ে এবং সকালের যেটি সবচেয়ে প্রধান কাজ তাঁর, সেই খবরের কাগজ পড়াও বাকি রাখলেন। বাড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনো একটি উপায়ের সন্ধান করা জরুরি। কাজেই না বেরিয়েও উপায় নেই।
গণেশ অ্যাভিনিউতে জীবনানন্দ দাশ প্রথমে যে ঠিকানায় গেলেন, সেখানে খুব একটা কাজ হলো না।
এমন সময় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কথা তাঁর মনে পড়লো।
জীবনানন্দ ঠিক করলেন, সঞ্জয়ের কাছে যাবেন। সঞ্জয় কেবল তাঁর বন্ধুই নন, জীবন ও কবিতার সমঝদার শুভাকাক্সক্ষীও। আর সঞ্জয় এমন মানুষ, যাঁর কাছে কবিতার বস্তু-তত্ত্ব নিয়ে যেমন অবলীলায় আলাপ করতে পারেন, মনের কথাও বলতে পারেন। ব্যক্তিগত ও সংসারের সমস্ত রকম কথা অনায়াসে তাঁকে খুলে বলা যায়।
বছর তিনেক আগে, ১৯৫০ সালের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে, হাতে একদমই টাকা-পয়সা ছিল না; কী করে টাকার জোগাড় হবে, বুঝতে পারছেন না; অথচ টাকার ভীষণ দরকার। চাকরি নেই, দু-একটা টিউশনি ছাড়া কোনো আয়ও নেই জীবনানন্দের।
কী করা যায়?
সংকোচ চাটিয়ে তখন সঞ্জয়কে একটা চিঠি লিখেছিলেন :
‘বেশি ঠেকে পড়েছি, সেজন্যে বিরক্ত করতে হ’ল আপনাকে। এখুনি চার পাঁচশো টাকার দরকার। দয়া ক’রে ব্যবস্থা করুন।’ …
চিঠি পেয়ে সঞ্জয় খুব একটা দেরি করেননি। সময়ও নেননি। যতটা সম্ভব টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
সেই সঞ্জয়। বন্ধু। জীবনানন্দের পরম আত্মীয়। এর মধ্যে একদিন বিকেলে জীবনানন্দ আচমকা উপস্থিত হয়েছিলেন সঞ্জয়ের ডেরায়। চা-পর্ব চলার অবকাশে নানা কথা হলো। সঞ্জয় বললেন, আপনি সবচাইতে ভালো লিখছেন।
আচমকা সঞ্জয়ের প্রশংসায় জীবনানন্দ অবাকই হলেন। কবিতা কবিতা করে জীবনের এতগুলি বছর পার করে এসেছেন জীবনানন্দ, কবি ছাড়া তিনি আর কিছু হতে চাননি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে টিকিয়ে রেখেছেন, তাও সেই কবিতার জন্যই।
জীবনানন্দের চাকরি নেই অনেকদিন, সবাই জানে; আত্মীয়দের মধ্যে একজন চাকরি ঠিক করে দিয়েছিলেন আসামের এক কলেজে। তিনি যাননি। বাংলা ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে চান না। এতে তাঁর লেখার ক্ষতি হবে, এই ভেবে।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ভালো? জীবনানন্দ সন্দেহের ভঙ্গিতে চোখ টিপে জানতে চাইলেন।
ভালো নয়? রবীন্দ্র পুরস্কারের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, ইস্ট পাকিস্তানের বাঙালি কবিরা কেউ বলতে পারবেন, তাঁরা জীবনানন্দের ছাত্র নন? তাছাড়া এখানেও বা কী? জীবনানন্দের বৃত্তে শত শত তরুণ কবি নেই?
জীবনানন্দ হা হা করে হেসে উঠলেন। এমন এক হাসি, যে হাসির সঙ্গে তাল মেলানো যায় না। কেউ মেলাতে পারে না।
একটু থেমে তিনি বললেন, আপনারা তো বলছেন, কিন্তু আমার স্ত্রী তো এমন কথা বলেন না।
আপন মানুষকে অনেকে ভালো বলে প্রচার করতে চান না। ভালো মতোন বুঝতে পারেন, এটাও নিশ্চয় করে বলা যায় না। সঞ্জয় উত্তর দিলেন।
এসব অনেকদিন আগের কথা।
আজ কিছুক্ষণ রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলেন জীবনানন্দ। পরে একরকম ছটফট করে প্রিয়তম বন্ধু সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ডেরায় চলে এলেন।
অসময়ে জীবনানন্দকে দেখে সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং অন্য সবাই অবাক। তিনি বসলেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এবং দ্রুত তালে কথা বলতে লাগলেন।
কোনো ভূমিকা না করে জীবনানন্দ সোজাসুজি কথাটা পাড়লেন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সামনে। বললেন, বুঝলেন সঞ্জয়দা, চতুরঙ্গ অফিসে গিয়েছিলাম। শুনেছিলাম, হুমায়ুন কবির সাহেব আছেন। ওখানে গিয়ে দেখি, তিনি নেই। আতাওয়ারও নেই। কারো সঙ্গেই দেখা হলো না।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য একটা কাজ নিয়ে ডুবে ছিলেন। জীবনানন্দের হঠাৎ আগমনে তিনি ব্যস্তসন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, আহা, বসুন তো আগে। তারপর শুনব, কী এমন ঘটলো যে কবির সাহেবের কাছে এই সকালবেলায় আপনাকে ছুটে আসতে হলো?
জীবনানন্দ বললেন, না, আমাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। বসব না। ভাড়াটে মহিলাটি এই সাত সকালেই যে-রকম কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তুলেছেন, আর তো পারা যায় না। ওঁকে তুলে দিতে না পারলে আমাকেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে।
সঞ্জয় তাঁর চেয়ারে বসে মৃদু হাসলেন। তাঁর যা বোঝার বুঝে গেলেন।
জীবনানন্দের এতদিনে বিখ্যাত হয়ে ওঠা সন্দেহজনক স্বভাবচরিত্রের সেই ভাড়াটে মহিলাটি, আজ সকালবেলাতেই একটু বাড়াবাড়ি রকমের ঝঞ্ঝাট পাকিয়ে তুলেছেন। তিষ্টোতে না পেরে জীবনানন্দ ঝটিতি সমাধানের আশায় চলে এসেছেন হুমায়ুন কবির সাহেবের কাছে।
সঞ্জয় হেসে বললেন, আপনি যেমন বললেন, তেমনভাবে চাইলেই কি আর সঙ্গে সঙ্গে কোনো ভাড়াটে তুলে দেওয়া যায়? নাকি কেউ পারে?
জীবনানন্দ বললেন, কেন, কবির সাহেবের তো রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক। তিনি পারেন না? তারাশঙ্কর পারেন না? আপনাকে কতবার যে ওঁদের বলার জন্য চিঠি লিখলাম।
সঞ্জয় বললেন, তা লিখেছেন। ওঁদের কি আপনার-আমার এই রকম সব পেটি সমস্যা নিয়ে মাথাব্যথা করার সময় আছে? ওঁরা কত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আর কতসব বড় বড় কাজ হাতে থাকে ওঁদের।
জীবনানন্দ এখানে আসা অবধি দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবারেও বসলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। মনে হয় তিনি সঞ্জয়ের কথায় দুঃখ পেলেন। গলাটা খাদে নামিয়ে বললেন, তা-ই? তাহলে বলেননি? বলেননি যখন, আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে?
কথা শেষ না করেই জীবনানন্দ রাগে, হতাশায়, নাকি যাঁকে বন্ধু বলে জানা গেছে তাঁর সাক্ষাৎ স্বীকৃত অবহেলায় মর্মাহত হলেন, বোঝা গেল না।
তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূর্ব্বাশা অফিস থেকে বেরিয়ে গণেশ অ্যাভিনিউ ধরে বিষণ্ন মুখে একা একা হাঁটছেন জীবনানন্দ। তাঁর হাঁটায় গতি আছে, কিন্তু গন্তব্য নেই।
এত সকালে, সব মানুষ কাজে বেরোয়নি। অনেক অফিস ও দোকান এখনো খোলেনি। এই সকালবেলায় তিনি কোথায় যাবেন, বুঝতে পারছেন না। একবার মনে হলো, মন খারাপ করে শিয়ালদহ স্টেশনে গিয়ে বসে থাকবেন। মানুষ দেখবেন। ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখবেন। দুপুর হলে, যদি ক্ষুধা পায় এবং মন স্বাভাবিক হয় তাহলে বাড়িতে ফিরবেন। না হলে স্টেশনে সারাটা দিন কাটিয়ে দেবেন।
কিন্তু এখন তো আমার আর একার জীবন নয়; এখন আমি চাইলেই যা কিছু তা করতে পারি না।
এসব ভেবে স্টেশনে বসে মানুষ দেখার ভাবনা বাতিল করলেন।
গণেশ অ্যাভিনিউ ছেড়ে বাসে চড়ে একসময় কালীঘাটে এসে নামলেন জীবনানন্দ। এখান থেকে তাঁর ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িটা কাছেই, হাঁটাপথের দূরত্ব।
রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে তিনি বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলেন।
এমন সময় পেছন থেকে নাম ধরে কেউ তাঁকে ডাকলো। তিনি একবার পেছন ফিরে তাকালেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না।
জীবনানন্দ আবার হাঁটার জন্য পা বাড়ালেন। ভাবতে লাগলেন, মানুষের কত ধরনের সমস্যা থাকে, সমস্যার সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। আমি এমন একটা সমস্যায় পড়েছি, এর থেকে যেন উদ্ধার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
কী করা যায়?
কদিন আগেও একটা চাকরির জন্য কত জায়গায় দরখাস্ত করেছেন, কত মানুষকে ধরেছেন; কোনো কাজ হয়নি। চাকরি নেই বলে সমাজ ও সংসারে কোনো দাম ছিল না তাঁর। আত্মীয়দের কাছে মুখ দেখানোর উপায় ছিল না। খুবই অসহায় আর দুর্দিন কেটেছে জীবনানন্দের।
কিন্তু সেই সময় এতটা দুঃসহ দিন কাটেনি। এখন তাঁর চাকরি আছে। হাওড়া গার্লস কলেজে তিনি ইংরেজির অধ্যাপক। চাকরিটা ভালো। ১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে এখানে জয়েন করেছেন। কলেজ থেকে ভালো মাইনে পান; লাবণ্যও স্কুলে শিক্ষকতা করছে। সংসারে স্বস্তি এসেছে, কিন্তু শান্তি নেই। সারাক্ষণ উপভাড়াটিয়া মহিলার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
ফুটপাত ধরে জীবনানন্দ বাড়ির পথে হাঁটছেন, হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন তাঁর পিঠে হাত রাখলো। জীবনানন্দ চমকে পেছন ফিরে তাকালেন।
দ্রুতবেগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। দেখলেন, গোপালচন্দ্র রায়। এই গোপালবাবুই হাওড়া গার্লস কলেজের চাকরিটা জুটিয়ে দিয়েছেন জীবনানন্দকে। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকায় কাজ করেন। সহকারী সম্পাদক। পরিচয়ের বহু আগে থেকেই তিনি জীবনানন্দের কবিতার বিশেষ অনুরাগী। জীবনে অল্প দু-একজন মানুষের দেখা পেয়েছেন জীবনানন্দ, যাঁরা বন্ধু ও আত্মীয়ের চেয়েও আপন; গোপালবাবু তেমনই একজন মানুষ।
জীবনানন্দ বললেন, আরে গোপালবাবু, আপনি?
হ্যাঁ, আপনাকে তো একবার ডাকলাম, মনে হয় শুনতে পাননি।
জীবনানন্দ মৃদু হাসলেন। বললেন, না, শুনতে পেয়েছিলাম। কিন্তু পেছন ফিরে কাউকে দেখতে পাইনি বলে আর দাঁড়াইনি।
গোপালচন্দ্র বললেন, তা এই সকালবেলায় কোথা থেকে ফিরলেন?
গিয়েছিলাম গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউতে, হুমায়ুন কবির সাহেবের কাছে।
এত সকালে?
হুম, একটু বিশেষ দরকার ছিল। আপনি কোথা থেকে?
গোপালবাবু বললেন, আমি এই কালীঘাটেই এসেছি। একটু শুদ্ধসত্ত বসুর বাড়িতে যাব।
জীবনানন্দ বললেন, তা চলুন, আমার বাড়ি থেকে ঘুরে আসবেন।
না, এখন যাব না। অন্য একদিন গিয়ে চা খেয়ে আসব।
এমন সময় জীবনানন্দের মাথায় উঁকি দিলো, আরে, হুমায়ুন কবিরের কাছে যে কাজে গিয়েছিলেন, সেই ব্যাপারটা তো গোপালবাবুকে বলা যায়। তিনি তো আমার উপকারও করতে পারেন।
গোপালবাবু বললেন, কী, কিছু ভাবছেন নাকি?
জীবনানন্দ বললেন, গোপালবাবু, চলুন কোথাও একটু বসি। আপনার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে।
গোপালচন্দ্র রায় বললেন, তা বলুন না।
চলুন, কোথাও বসি। বসে বলি। সকাল থেকে বেশ হাঁটাহাঁটি হয়েছে। একটু চা খেতে পারলে ভালো লাগবে।
তাঁরা দুজন একটা চায়ের দোকানে এসে বসলেন।
সকাল বলে চায়ের দোকানে ভিড় তেমন নেই। এক ভদ্রলোক আনন্দবাজার পত্রিকা পড়তে পড়তে রসিয়ে চা খাচ্ছেন। যেভাবে পত্রিকা পড়ছেন, খুব শিগগিরই পত্রিকা পড়া শেষ হবে বলে মনে হয় না।
চায়ের ভেতর বিস্কুট ডুবিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন জীবনানন্দ। গোপালবাবু বললেন, তা বলুন, কী আপনার জরুরি কথা? আর শুনুন, চা দুজনে খাচ্ছি বটে, বিল কিন্তু আমি দেব।
জীবনানন্দ আর একবার চায়ে চুমুক দিয়ে হাসতে লাগলেন। তাঁর হাসি দেখে গোপালবাবুও হাসতে শুরু করলেন।
কিছুক্ষণ পর, চায়ের কাপ ঠেলে জীবনানন্দ গোপালচন্দ্র রায়ের হাত চেপে ধরলেন; গোপালবাবু, আমি একটা বড় বিপদের মধ্যে আছি। কিছু উপকার করতে পারবেন?
জীবনানন্দ কী কথা বলবেন, আঁচ করতে পারেননি গোপালচন্দ্র রায়; তিনি বললেন, কী হয়েছে? আপনার চাকরিটা চলে গেছে?
আরে নাহ। চাকরি কেন যাবে?
তাহলে?
কলকাতার কত লোকের সঙ্গেই তো আপনার পরিচয়, দেখুন না যদি কিছু করতে পারেন।
কী বিপদ, আমাকে খুলে বলুন।
তাহলে বলছি, শুনুন। আমার চাকরি-বাকরি নেই, অথচ এই রকম জায়গায় তিনখানা ঘরের একটা ফ্ল্যাট নিয়ে আছি। এই দেখে একদিন এক ভদ্রলোক আমার বাড়িতে এসে বলল – স্যার, আপনার কোনো ঘর খালি আছে? একখানা ঘর এক ভদ্রমহিলাকে ভাড়া দেবেন? তাঁর সঙ্গে আর কেউ থাকবে না। ভাবলাম, এতে তো কোনো ঝামেলা নেই। অথচ কিছু আর্থিক সাশ্রয়ও হবে।
কথা বলার ফাঁকে গোপালচন্দ্র পকেট থেকে পয়সা বের করে চায়ের বিল মিটিয়ে দিলেন।
জীবনানন্দ বললেন, এই ভেবে ওই পুবের দিকের ঘরটা মহিলাকে ভাড়া দিলাম। ওঁর নাম সুরুচি মজুমদার।
গোপাল বললেন, ওহ, এই কথা। ওই মহিলা তাহলে আপনার আত্মীয়া নন?
না।
গোপাল বললেন, আপনার বাড়িতে গেলে মাঝে মাঝেই ওই মহিলাকে দেখতে পাই। তাঁকে দেখেও আমার কোনো কৌতূহল হতো না যে, উনি কে? আমি ভাবতাম, তিনি হয়তো আপনার সংসারেরই কেউ হবেন।
জীবনানন্দ বললেন, উনি ছেলেকে নিয়ে একাই থাকেন বটে, কিন্তু ওঁর কাছে সব সময়েই এত লোক আসে যায় যে, সে এক ভয়ংকর ব্যাপার। আর সবচেয়ে আপত্তিকর, রাতে ওই ঘরে লোকজন নিয়ে গান-বাজনা, হাসি-হল্লা ইত্যাদি কাণ্ড একেবারে অসহ্য। আমি মেয়েটিকে ঘর ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে বলেছি, তা উনি কিছুতেই যাচ্ছেন না। ওঁকে কী করে তোলা যায়, বলতে পারেন?
গোপাল কপাল কুঁচকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলেন। একটু নীরব থাকলেন। বললেন, তা মহিলাটি কিছু কাজকর্ম করেন কি?
শুনেছি, তিনি হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স কোম্পানির একজন এজেন্ট।
আইনের সাহায্যে কোনো প্রকারে ওঁকে তোলা যায় কি না আগে দেখা দরকার। একটা কাজ করা যায় -কী কাজ? জীবনানন্দ উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
আগামী রোববার সকালে আমি আপনার বাড়িতে আসব। এসে আপনাকে নিয়ে আমার পরিচিত এক লোকের কাছে নিয়ে যাব।
কে তিনি?
তাঁর নাম চাঁদমোহন চক্রবর্তী।
চাঁদমোহন?
হ্যাঁ। তিনি একজন প্রবীণ উকিল। ভালো লোক। তাঁর কাছে নিয়ে যাব। চাঁদমোহনবাবু নিজেও একজন সাহিত্যিক মানুষ। তাঁর গল্পের বইটইও আছে। আশা করি, একজন কবির বিপদের কথা শুনে তিনি তাঁর যথাসাধ্য করবেন।
জীবনানন্দের ভার মুখটা হালকা হয়ে এলো। কপালের দুশ্চিন্তার রেখাও খানিকটা মুছে গেছে।
গোপালবাবু বিদায় নিয়ে শুদ্ধসত্তর বাসায় চলে গেলেন। জীবনানন্দও নিজের বাসায় ফিরে এলেন।
বহুদিন বেকার ছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
হাওড়া গার্লস কলেজের চাকরিটা তাঁর জীবনে স্বস্তি ও সুস্থিরতা এনে দিয়েছে। বরিশালের জীবনের মতো একটা প্রশান্ত আবহ ফিরে পেয়েছেন। এখানকার পরিবেশ সহনীয় ও পছন্দসই হয়েছে। কাজের প্রতিও একটা ভক্তি-প্রীতির সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। অধ্যাপকমণ্ডলী ও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে পছন্দ করেন, বোঝা যায়। ছাত্রীরাও তাঁকে সমীহ করে। বড় ভালো লাগে তাঁর। এতদিনে মনের দিক থেকে একটা শান্তির জায়গায় তিনি থিতু হতে পেরেছেন।
একদিন, থার্ড পিরিয়ডের ক্লাস নিয়ে জীবনানন্দ টিচার্স রুমে ফিরলেন। দেখলেন, চায়ের আয়োজন চলছে।
স্যার, আপনাকে চা দেব? পিয়ন বলল।
দাও, চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছেও বটে।
হঠাৎ দর্শন বিভাগের বিনীতা বসু তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে জীবনানন্দের পাশে বসলেন। জীবনানন্দ একবার পাশ ফিরে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। মুখে কিছু বললেন না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি একটা বই খুললেন।
টিচার্স রুমে বেশ কয়েকজন অধ্যাপক বসে আছেন; সবাই একসঙ্গে চা খেতে খেতে গল্প করছেন। তাঁদের সামনেই বিনীতা বললেন, জীবনানন্দবাবু, আপনার কাপ থেকে একটু চা আমার কাপে ঢেলে দিন তো।
জীবনানন্দ অবাক; বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, কেন?
আপনি যে আমার সহকর্মী এবং আপনার মতো একজন বিখ্যাত কবি আমার কাপে চা ঢেলে দিয়েছেন, এটা আমি পরে গর্ব করে বলতে পারবো।
জীবনানন্দ হা হা করে হাসতে লাগলেন।
কিন্তু বাসায় ফিরে সব শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। অসভ্য দজ্জাল উপভাড়াটিয়া মহিলা জীবনটা বরবাদ করে দিচ্ছে। অবিরাম স্নায়ুর পীড়নে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। মনের সংবেদনশীলতা কমে আসে। মাঝে মাঝে শীতের বিকেলের মরা রোদের মতো মনটা মিইয়ে আসে জীবনানন্দের। এজন্য কোনো কোনোদিন বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না।
কী করা যায়?
রোববার সকাল।
লাবণ্য এইমাত্র স্কুলে বেরিয়ে গেল। নাশতা সেরে জীবনানন্দ খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তাঁর হাতে একটি ইংরেজি পত্রিকা। সময় পেলেই জীবনানন্দ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে ভালোবাসেন। ছুটির দিন বলে আজ বেশ ক-খানা খবরের কাগজ ও বই নিয়ে বসেছেন। ইজিচেয়ারে শুয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। ইংরেজি পত্রিকাই তিনটি। পাশে জীর্ণ-বিবর্ণ একটা অক্সফোর্ড ডিকশনারি; আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর এবং সাপ্তাহিক দেশও রয়েছে। ইজিচেয়ারের সামনে ফুটরেস্ট হিসেবে একটি খালি চেয়ার।
সমস্ত মনোযোগ ঢেলে একমনে পত্রিকা পড়ছেন জীবনানন্দ।
এমন সময় বাইরের দরজায় কেউ করাঘাত করলো। জীবনানন্দ নিজেই উঠলেন।
দরজা খুলতেই দেখতে পেলেন গোপালবাবুকে। সকালেই হাজির হয়েছেন গোপালচন্দ্র রায়। জীবনানন্দের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
গোপালচন্দ্র তাড়া দিলেন, চলুন, দেরি করা যাবে না। এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।
পাঞ্জাবি, ধুতি ও পাম্প শু পরে জীবনানন্দ তৈরি হয়ে নিলেন। দুজনে বেরিয়ে পড়লেন। ল্যান্সডাউন রোড পেরিয়ে রসা রোড ও প্রতাপাদিত্য রোডের সংযোগস্থলের কাছে চাঁদমোহনবাবুর বাড়ি। দরজায় করাঘাত করতেই খুলে গেল।
জীবনানন্দ নমস্কার জানালেন চাঁদমোহনবাবুকে।
চাঁদমোহন বিগলিত হেসে বললেন, আপনার কবিতা আমি পড়েছি জীবনানন্দবাবু। খুব ভালো লাগে।
কিন্তু যে কারণে তাঁর কাছে আসা, তিনি সেসব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। বললেন, দেখুন, আপনি সাবলেট করেছেন, আর সে যখন আপনাকে ভাড়া দেয়, ওকে তোলা মুশকিল। আপনি ওর কাছ থেকে ভাড়া না নিলে সে মনি অর্ডার করবে। আপনি মনি অর্ডারের টাকা না নিলে সে রেন্ট কন্ট্রোলে জমা দেবে।
জীবনানন্দ হতাশ হয়ে বললেন, তাহলে উপায়?
চাঁদমোহন বললেন, সে নিজে থেকে না ছেড়ে চলে গেলে ওকে তোলা দায়। তবে পাড়ার লোকজন দিয়ে ভয় দেখিয়ে যদি তুলতে পারেন।
জীবনানন্দ ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, আপনি আইনের লোক হয়ে এ কী বলছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কাজ হলো না। কথাও আর এগুলো না।
জীবনানন্দ ও গোপালচন্দ্র রায় বেরিয়ে এলেন।
ফেরার পথে ট্রামে উঠলেন দুজনে। জীবনানন্দ বললেন, পাড়ায় তো কারো সঙ্গে আমার তেমন আলাপ নেই। আর থাকলেও তারা আমার হয়ে বলতেই বা যাবে কেন?
গোপালচন্দ্র জীবনানন্দের এ-কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
জীবনানন্দ বললেন, আপনার তো বহু লোকের সঙ্গে আলাপ, এভাবে কি কিছু করতে পারবেন?
গোপালচন্দ্র বললেন, আমি থাকি বউবাজারে। আপনার পাড়ার দু-একজনের সঙ্গে ছাড়া কারো সঙ্গেই আমার তো আলাপ নেই।
জীবনানন্দ হতাশ হয়ে বললেন, ওহ।
আচ্ছা, আপনি এক কাজ করুন –
জীবনানন্দ প্রশ্নচোখে তাকালেন, কী কাজ?
যেদিন কলেজে আপনার দেরিতে ক্লাস থাকবে, সেদিন কলেজে যাওয়ার পথে আমাদের ভারতবর্ষ পত্রিকা অফিসে একবার আসুন। আমাদের কাগজের সম্পাদক ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় একজন কংগ্রেসের এম.এল.এ। কংগ্রেসেরই তো রাজত্ব। তাঁকে একবার বলে দেখি। পুলিশের সাহায্যে বা অন্য কোনোভাবে যদি কিছু করতে পারেন।
জীবনানন্দ বললেন, আমি কালই যাব এগারোটা নাগাদ।
রসা রোড ও রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে ট্রাম এসে গেলে জীবনানন্দ নেমে পড়লেন। গোপালচন্দ্র তাঁর বাড়ির দিকে ফিরে গেলেন।
উপভাড়াটিয়া সংক্রান্ত ঝামেলার দায়টা যেহেতু জীবনানন্দ দাশের নিজের, সে কারণে তিনি আর দেরি করলেন না। পরদিন সকালে কলেজে বেরোবার আগে ভারতবর্ষ অফিসে হাজির হলেন।
গোপালচন্দ্র ফনীবাবুর সঙ্গে জীবনানন্দের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফণীবাবু শান্তভাবে সব কথা শুনলেন। বললেন, চাঁদমোহনবাবু ঠিকই বলেছেন। ওকে তোলা যাবে বলে মনে হয় না। আর পুলিশও সহজে এ ব্যাপারে হাত দেবে না।
ফণীবাবুর মুখেও একই ধরনের কথা শুনে জীবনানন্দ বেশ দমে গেলেন।
তাঁরা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন।
পথে বেরিয়ে জীবনানন্দ বললেন, তাহলে কী করা যায়, গোপালবাবু?
আচ্ছা, সাবিত্রীদাকে একবার বলে দেখি।
জীবনানন্দ বললেন, আপনার সাবিত্রীদাটা কে?
কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। তিনি হিন্দুস্থান ইনসিওরেন্স কোম্পানির পাবলিসিটি অফিসার। আপনার উপভাড়াটিয়া মহিলাও তো ওই অফিসের একজন এজেন্ট। সাবিত্রীদা যদি তাঁদের অফিসের ওপরওয়ালাদের বলে আপসে মহিলার চলে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে পারেন।
জীবনানন্দের কলেজে যাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছিল। বললেন, তাই করুন; বলেই তিনি কলেজের উদ্দেশে চলে গেলেন।
জীবনানন্দের কাছে উপভাড়াটিয়া মহিলার নাম আর একবার জেনে নিয়ে গোপালবাবুও বিদায় নিলেন। তিনি নিজের কাজ মনে করে হাজির হলেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধায়ের অফিসে।
গোপালচন্দ্রের কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে সাবিত্রী বললেন, ও মেয়েটাকে আমি চিনি। আমাদের অফিসের প্রায় সব ওপরওয়ালার সঙ্গেই ওর খুব খাতির। তাই ওর বিরুদ্ধে কিছু বললে, তাঁরা কেউই শুনবেন না।
সাবিত্রীবাবুর কাছেও কোনো সাহায্য পাওয়া গেল না।
বেলা পড়ে এলে সান্ধ্য-ভ্রমণের সঙ্গী সুবোধ রায়ের সঙ্গে হাঁটতে বেরুবেন জীবনানন্দ দাশ। অপেক্ষা করছেন। এমন সময় জীবনানন্দের বাড়িতে গোপালবাবু এসে উপস্থিত হলেন। সব কিছু জানালেন। জীবনানন্দ আরো দমে গেলেন। বললেন, তাই তো। কী করি, বড় বিপদেই পড়েছি।
গোপালচন্দ্রের তাড়া ছিল, তিনি আর দাঁড়ালেন না। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, দেখি নতুন কী করা যায়; বলেই তিনি চলে গেলেন।
গোপালবাবুকে বিদায় করে বিষণ্ন মুখে ঘরে ফিরলেন জীবনানন্দ। কী যে করা যায়, এই মহিলাকে নিয়ে? ভেবে ভেবে নিজেকে জখম করতে লাগলেন।
দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে।
জীবনানন্দ হাঁটতে বেরুবেন। কিন্তু সুবোধ রায় তো এখনো এলেন না। তাঁর কি অসুখ করেছে, নাকি কোনো সমস্যা হলো? এসব কথা মনে হতে লাগলো জীবনানন্দের। বারান্দায় ইজিচেয়ার বের করে তিনি অপেক্ষা করার ছলে দোল খেতে লাগলেন।
কয়েকদিন পর।
সেলুনে চুল কাটাতে এসেছেন জীবনানন্দ।
দুপুরের কিছু আগে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে ল্যান্সডাউন রোড ধরে বামদিকে হাঁটতে লাগলেন। বামদিকে প্রথম তিনটে গলি পেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর, একটা গলি বেরিয়ে গেছে। গলিতে, মডার্ন হেয়ার ড্রেসার নামে একটি সেলুন আছে। জীবনানন্দ এই সেলুনের নিয়মিত সেবাগ্রহণকারী। দাড়ি কাটার কাজ তিনি বাড়িতেই সারেন। চুল কাটাতে অন্য কোথাও আর যান না, এখানে চলে আসেন।
মডার্ন হেয়ার ড্রেসার সেলুনের নরসুন্দর রতন ছেলেটা খুব ভালো। যত্ন করে তাঁর চুল কেটে দেয়। কখনো বিরক্ত হয় না। মাঝে মাঝে নিজে থেকে সে নানা ধরনের গল্পও বলে। কাকা, জানেন, কী হয়েছে -; গল্প শুরু হয় রতনের।
চুল কাটানোর সময়টা সবচেয়ে সুখের লাগে জীবনানন্দের কাছে। মনে হয়, মাথা আর শরীরের ক্লান্তি ও ক্লেদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। জগতের সব ভাবনা ও বেদনা থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পাওয়া যায়।
কিন্তু তাঁর যে স্বভাব, ভাবালুতার, তা যেন কিছুতেই তাঁকে ছেড়ে যায় না। নিত্যদিনের করণীয় কর্মতালিকা তাঁকে খোঁচাতে থাকে। জীবন ও সংসার এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে, নানা ধরনের ভাবনা, প্রতিকূলতা ও উৎপাত সহ্য করে এগোতে হয়, প্রতিদিন।
চুল কাটাতে এসেছেন বটে, অথচ মাথায় কাজ করছে, এরপরে তো কাঁচাবাজারে যেতে হবে। সংসারের জিনিসপত্রের সঙ্গে নিজের জন্যও কিছু দরকারি বস্তু কিনতে হবে। সুলেখা স্পেশাল ঝরনা কলমের কালি কিনবেন, আর পেনসিল, খবরের কাগজ, দেশ ও রিডার ডাইজেস্ট কিনবেন। ভাবতে চাননি, তবু একবার মাথায় খেলে গেল।
এর মধ্যেই মাথায় উঁিক দিলো, উপভাড়াটিয়া মহিলাকে তুলে দিতে আর কার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়? কিছুতেই তো ওকে তোলা যাচ্ছে না।
অগত্যা ভাবছেন, নতুন বাড়ি খুঁজবেন, নিজেই চলে যাবেন; তবু এখানে থাকা সম্ভব নয়।
সম্ভাব্য সবই কেনা হয়ে গেছে। এবার বাড়িতে ফিরছেন জীবনানন্দ।
ফেরার পথে মনে হলো, বাড়িতে যাওয়া মানেই তো আবার সেই নরকে ঝাঁপ দেওয়া। শান্তিপ্রিয় জীবনানন্দের সব শান্তি সুরুচি মজুমদার নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু কী উপায়ে এই বেপরোয়া-উচ্ছৃঙ্খল উপভাড়াটিয়া মহিলাকে তুলে দেওয়া যায়?
হাঁটতে হাঁটতে কতগুলো পয়েন্ট তাঁর মাথায় এসে যায় –
প্রথমে বুঝিয়ে-সুজিয়ে সুরুচি মজুমদারকে উঠে যেতে রাজি করানো; সুধাংশুবাবুর মারফত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরে তাঁকে দিয়ে সরকারকে বলিয়ে পুলিশের সাহায্যে তুলে দেওয়া; থানায় গিয়ে ডায়েরি করে পুলিশকে ব্যাপারটায় টেনে আনা; পাড়ার ছেলেদের দিয়ে মহিলাকে ভয় দেখিয়ে তুলে দেওয়া; নিজে থেকেই অন্য কোনো একটা ফ্ল্যাটে সরে যাওয়া; জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের যে কর্তারা মহিলাকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, মহিলাটি যাতে অন্যত্র উঠে যান তাঁদের বলে ব্যবস্থা করা;
শক্ত-সমর্থ দুর্দান্ত টাইপের কিছু লোককে খুঁজে বের করা, যাঁরা ভয় দেখিয়ে মহিলাকে তুলে দেবেন; ভেতরে ভেতরে কোনো একটা কুটিল প্যাঁচ কষা …
ভাবতে ভাবতে বাড়ির গলিতে এসে দাঁড়ালেন জীবনানন্দ।
চুল কাটাতে গিয়ে এত যে ভাবনা ও দুর্ভাবনা নিয়ে জীবনানন্দ বাইরে সময় কাটিয়ে ঘরে ফিরছেন, এসব নিয়ে তিনি নিত্যদিন ডায়েরিতেও লিখে চলেছেন। তিনি যেন জলের কুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছেন, সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার কথা ভাবছেন, লিখে রাখছেন; কিন্তু মুক্তি মিলছে না।
বাড়ির সরু গলিতে ঢুকে পড়লেন জীবনানন্দ।
দিনশেষে, সন্ধ্যার মুখে রাসবিহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন জীবনানন্দ, একা। হঠাৎ কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পেলেন, হেঁটে যাচ্ছেন। হাত তুলে তাঁকে ডাকলেন জীবনানন্দ।
জীবনানন্দকে দেখে বীরেন্দ্র হাসিমুখে কাছে এলেন। কুশল বিনিময় করলেন দুজনে।
তরুণ কবিদের মধ্যে বীরেন্দ্র ভালো কবিতা লিখছেন। নিজের স্বতন্ত্র ভাষা ও ভঙ্গি ইতোমধ্যেই প্রকাশ করতে পেরেছেন বীরেন।
দুজনের নিয়মিত দেখা বা কথা হয় না। কিন্তু কয়েকবার জীবনানন্দের বাড়িতে এসেছেন বীরেন্দ্র। আলাপ আছে। বীরেন্দ্র কোনো একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, বেশ কবার চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছে। জীবনানন্দের কবিতা বীরেন্দ্র অন্যচোখে দেখেন। বিশেষ পছন্দ করেন। একদিন কথাপ্রসঙ্গে সে-কথা বীরেন্দ্র জানিয়েছেন জীবনানন্দকে।
আপনার কবিতাচর্চা কেমন চলছে, জীবনানন্দবাবু?
এই চলছে, আর কী।
আপনার শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ছি। অসাধারণ জিনিস।
কবিতাচর্চা আর হচ্ছে না, বীরেন।
বীরেন চমকে উঠলো, কেন?
সে কথা বাদ দিন। আচ্ছা, আপনার খোঁজে কোনো গুন্ডা আছে? দিতে পারেন?
জীবনানন্দ দাশের পারম্পর্যহীন কথায় প্রায় বোকা হয়ে গেলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বললেন, গুণ্ডা দিয়ে কী হবে?
আমার বাড়ির ভাড়াটে সেই মহিলাকে গুন্ডা দিয়েই তুলতে হবে। না হলে তোলা যাচ্ছে না।
উপভাড়াটিয়া এক মহিলার কথা আগেও শুনেছেন বীরেন্দ্র, যাকে নিয়ে বিব্রত আছেন জীবনানন্দের পরিবার। তবু পরিষ্কার হওয়ার জন্য বললেন, এটা কি চূড়ান্তভাবেই ভেবেছেন?
একদম।
সেজন্য তো পয়সা খরচ করতে হবে, জীবনানন্দবাবু।
পয়সা নগদই পাবেন। আপনি ব্যবস্থা করুন, বীরেন। বলেই বীরেন্দ্রর হাত চেপে ধরলেন জীবনানন্দ।
জীবনানন্দের মুখে তাকিয়ে কেঁপে উঠলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না। কিন্তু উপলব্ধি করতে পারলেন, কী বিপন্নতার ভেতর দিয়ে দিন কাটছে জীবনানন্দবাবুর?
ধাতস্থ হতে খানিক সময় নিলেন বীরেন্দ্র। বললেন, কিন্তু গুণ্ডা দিয়ে ভাড়াটে তুলবেন, সেটা কি নিরাপদ হবে?
জীবনানন্দ বললেন, আপনি কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন?
না, পরে সেই গুন্ডাই যখন শেষে আবার আপনাকেও হটাতে চেষ্টা করবে, তখন কী করবেন?
বীরেন্দ্রর কথায় জীবনানন্দ কোনো কথা খুঁেজ পেলেন না। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর, কোনো কথা না বলে সোজা উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন জীবনানন্দ। একবারও পেছন ফিরে তাকালেন না।
অপরাধীর মতো মুখ করে রাসবিহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একা। ভাবলেন, আহারে, কথাটা ঠিক সহানুভূতির সঙ্গে হয়তো বলা হয়নি। সে-কারণে জীবনানন্দবাবু কোনো কথা না বলে অমন করে চলে গেলেন।
সন্ধ্যার অন্ধকার গায়ে মেখে আরো কিছু মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
কিছু সময়ের জন্য দেশপ্রিয় পার্কে ঢুকেছিলেন জীবনানন্দ।
মন টিকলো না। তিনি পার্কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়িতে ঢোকার আগে হঠাৎ থমকালেন, একটু উদাস ও আনমনা হলেন, খানিক ভাবলেন – বাড়িতে ঢোকা মানেই তো আবার সেই নরকের কুয়োর মধ্যে পড়া।
তাহলে কী করা যায়?
পায়ে পায়ে তিনি ফুটপাতে এসে দাঁড়ালেন। পায়চারির ছলে, যেন তিনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন, এমন ভঙ্গিতে ধীরপায়ে হাঁটতে লাগলেন জীবনানন্দ দাশ।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।
সন্ধ্যাটা ঘন হয়ে নামতে শুরু করেছে। প্রশস্ত রাস্তার অন্যপাশে পায়ের তলার মাটি কাঁপিয়ে একটা ট্রাম ছুটে আসছে। জীবনানন্দ ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গেছেন। অথবা, আলোর স্বল্পতার কারণে তিনি খেয়াল করতে পারেননি।
কিন্তু ট্রাম এসে পড়ার আগেই কি তিনি রাস্তা পেরিয়েছিলেন?
বীরেন্দ্রর কপাল কুঞ্চিত হলো। চোখ ছোট হয়ে এলো। তাঁর চোখের পাতা দ্রুত ওঠানামা করলো। তিনি, প্রায় ভাষাহীন চোখে রাসবিহারী মোড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.