সম্পাদকীয়

কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রবন্ধকার, বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের অগ্রপথিক, সমাজ-সচেতক, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও প্রগতিচিন্তার অগ্রদূত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গত ১৪ মে ২০২০ তারিখে পরলোকগমন করেন। তার বিদেহী আত্মা ও স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবনত কালি ও কলম পরিবার। এদেশের যেকোনো জাতীয় সংকটকালে তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, স্থিতধী দূরদৃষ্টি এবং তীক্ষ্ণ ও সময়োপযোগী পর্যবেক্ষণ বাঙালি জাতিকে দেখিয়েছে আলোর দিশা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণা এবং লেখা সর্বদাই সমাদৃত ও অবশ্যপাঠ্য বলে বিবেচিত হবে নিঃসন্দেহে। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশ-বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া নানা শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বাংলাদেশ সরকার-প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকসহ দেশি-বিদেশি বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজিতে রচিত ও সম্পাদিত তাঁর বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন ও টোকিও থেকে। তাঁর জন্ম ১৯৩৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে।

দুই

করোনা ভাইরাসজনিত সংকটে আজ বিশ্ব উৎকণ্ঠিত, পীড়িত। কিন্তু জীবন কখনোই থেমে থাকে না, নিজ গতিতে ও ধারায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও পথ করে এগিয়ে চলে। সেই জীবনের গতিপথের বর্ণনা ধরা থাকে আমাদের সাহিত্যে, ছোটগল্পে।

কালি কলম  জন্মলগ্ন থেকে যত্নের সঙ্গে নানা ধারার ছোটগল্পের পরিচর্যা করে আসছে। এ-সংখ্যায় আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্পের চর্চা ও সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে চেয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করতে। তবে করোনা-সংকটের কারণে প্রতি বছরের মতো বর্তমান সংখ্যাটি হয়তো ততোধিক সমৃদ্ধ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তারপরও এদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের পাশাপাশি প্রতিশ্রুতিশীল নবীনদের গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে ‘কালি ও কলম ছোটগল্প সংখ্যা ২০২০’।

বাংলা ছোটগল্প সূচনাকাল থেকেই জীবনের বহুকৌণিক দিকের উন্মোচন করে চলেছে। বিস্তৃত পরিসর ও পটভূমি নিয়ে জীবনের নানা অনুষঙ্গ ছোটগল্পে প্রতিফলিত হয়েছে। ফ্রয়েডীয় ও মার্কসবাদী চেতনা ছোটগল্পের ভুবনকে একদা সমৃদ্ধ করেছিল। অন্যদিকে প্রান্তিক ও ব্রাত্য মানুষের জীবনসংগ্রাম ছোটগল্পকে নানাদিক থেকে জিজ্ঞাসা-উন্মুখ করে তুলেছিল।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত ছোটগল্পে মননধর্মিতার সঙ্গে সাধারণ লোকজীবন-উপলব্ধিকে যে প্রসারিত চেতনায় বিস্তৃত করেছিলেন, তা বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে। তাঁর হাতেই বাংলা ছোটগল্প সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। এই সময়ে মার্কসবাদী কয়েকজন গল্পকার এমনসব গল্প লিখেছিলেন যা ছিল জীবনচেতনার দিক থেকে অতল এবং নবীন জিজ্ঞাসার বিচ্ছুরণে দীপ্ত।

গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পও নানাভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে যেসব ছোটগল্প রচিত হয়েছিল তা ছিল জীবনের উত্তাপলগ্ন। এসব গল্পের মধ্যে গ্রামীণ ও নাগরিক মানুষের বৃহত্তর জীবনসংগ্রাম ও বেঁচে থাকার আর্তি প্রতিফলিত হয়েছিল। প্রেম, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছিল। এই সময়ে জীবনের নানা অনুষঙ্গকে ধারণ করে গল্পকারগণ এক সমৃদ্ধ ভুবন নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। সামরিক শাসন, প্রথার কর্তৃত্ব এবং বৈরী রাজনৈতিক বাস্তবতা কথাসাহিত্যের সৃজনধারাকে ব্যাহত করতে পারেনি। এ-অঞ্চলের নদী, মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছোটগল্পকারদের নিবিড় সংযোগের ফলে এবং বোধ ও বুদ্ধির প্রয়োগে ছোটগল্প তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল হতে থাকে।

ষাটের দশকে এই অঞ্চলের বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও বাঙালিত্বের সাধনা যখন স্বদেশনির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল, তখন থেকে ছোটগল্পের স্বরূপও পালটাতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও জীবনের নানা সূক্ষ্ম সংবেদনশীল দিকের উন্মোচন পাঠকের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। মনন ও শিল্পের দিক থেকে নতুন বেগ সঞ্চারিত হয় ছোটগল্পে। ছোটগল্পের সৃজনভূমি হয়ে ওঠে জীবন-অভিজ্ঞতার মনোগ্রাহী দলিল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশের ছোটগল্পকারদের মানসভুবনকেও নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ছোটগল্প রচিত হয়।

‘কালি ও কলম ছোটগল্প সংখ্যা ২০২০’ পত্রিকাটির সপ্তদশ বর্ষ, তৃতীয়-চতুর্থ যুগ্ম সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হলো।