সম্পাদক মীর মশাররফ হোসেন

আবুল আহসান চৌধুরী

সাময়িকপত্র-সম্পাদনা, প্রকাশনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের আদিপর্বের উদ্যোগ ও অবদান সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে ওই সমাজের আধুনিক যুগের সাহিত্যচর্চার সূচনার ইতিহাসটিও স্মরণে রাখতে হয়। সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রেও বাঙালি মুসলমানের বিলম্বিত আত্মপ্রকাশ ঘটে। তার কারণও ওই একই সূত্রে গাঁথা।

বিষাদ-সিন্ধু কিংবা জমীদার দর্পণের মতো ধ্রুপদী-সাহিত্যের স্রষ্টা মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) উনিশ শতকের এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-প্রয়াসের সার্থক সূচনা তাঁকে দিয়েই। সব্যসাচী শিল্পীব্যক্তিত্ব মশাররফ ছিলেন নব্য-উত্থিত মুসলিম মধ্যশ্রেণির প্রধান সাংস্কৃতিক মুখপাত্র। মুক্ত মন, উদার শিল্পদৃষ্টি, সমাজমনস্কতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর জীবন ও সাহিত্যচর্চায় যেমন, সাময়িকপত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রেও তেমনই প্রতিফলিত হয়েছে। মশাররফের সাহিত্যজীবনের সঙ্গে তাঁর সাংবাদিকতা-কর্ম ও সাময়িকপত্র-সম্পাদনার যোগসূত্র অত্যন্ত গভীর। সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র-প্রকাশনার মুসলিম-উদ্যোগের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা পথিকৃতের।

 

দুই

সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতা – এই দুই পর্যায়েই মীর মশাররফ হোসেন প্রত্যক্ষ প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন মূলত গ্রামবার্ত্তা  প্রকাশিকা-সম্পাদক কুমারখালীর কাঙাল হরিনাথ মজুমদার এবং সেইসঙ্গে কলকাতার সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। এই দুই প্রাজ্ঞ সাময়িকপত্র-পরিচালকের উৎসাহ ও তত্ত্বাবধানেই মশাররফের সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। মশাররফ তাঁর আত্মকথা আমার জীবনীতে (১৯০৮-১০) স্মরণ করেছেন :

কলিকাতার সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু রামপ্রাণ গুপ্ত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। সহকারী সম্পাদক ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহিত পত্রে পত্রে দেখাশুনা যেরূপ হইতে পারে তাহা আছে। আমি অনেক সংবাদ তাঁহাদের কাগজে লিখিতাম। তাঁহারাও দয়া করে ছাপাইতেন। আমাকে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছিলেন – ‘‘আমাদের কুষ্টিয়ার সংবাদদাতা’’।… সাদাসিদে ভাবে সংবাদ লিখিতাম। ভুবনবাবু কাটিয়া ছাঁটিয়া প্রকাশের উপযুক্ত করিয়া দিতেন।… কুমারখালীতে সে সময়ে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ হইত। কুমারখালী, আমার বাটী হইতে নিকটে। গ্রামবার্ত্তা সম্পাদক বাবু হরিনাথ মজুমদার মহাশয় আমাকে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করিতেন। আমিও তাঁহাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় মান্য করিতাম, সপ্তাহে সপ্তাহে গ্রামবার্ত্তায় সংবাদ লিখিতাম, প্রভাকরেও লিখিতাম।… এদিকে হরিনাথবাবু আর কলিকাতার দিকে ভুবনবাবু আমার সামান্য লিখা সংশোধন করিয়া প্রভাকরে প্রকাশ করা আরম্ভ করিলেন।

– এই বিবরণ ১৮৬৫ সালের। এইভাবে তিনি সাংবাদিকতা ও সংবাদ-সাময়িকপত্র সম্পর্কে আগ্রহী ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। উত্তরকালে পত্রিকা-সম্পাদনায় তাঁর এই শিক্ষানবিশির অভিজ্ঞতা বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। এর নয় ও পঁচিশ বছর পরে তাঁর সম্পাদনায় দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় : আজীজন নেহার (১৮৭৪) ও হিতকরী (১৮৯০)। এছাড়া তিনি কোহিনুরসহ আরো কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গেও পরিচালক-সমিতির সদস্য, উপদেশক বা লেখক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।

 

তিন

সাময়িকপত্র-প্রকাশনার ক্ষেত্রে আজীজন নেহার মশাররফ হোসেনের প্রথম প্রয়াস। আজীজন নেহার পত্রিকা প্রকাশের প্রেরণা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে মশাররফ তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে জানাচ্ছেন :

আমার ভ্রাতাগণ হুগলী কলেজে পড়িতেছে। চুঁচুড়ায় আমাদের একটি বাসাবাড়ী আছে। সময় সময় চুঁচুড়ায় যাওয়া আসা করি। একদিন চুঁচুড়ায় বান্ধা ঘাটে বসিয়া গঙ্গার জলস্রোতে [নানা] বিষয় ভাবিতেছি।… অপর পারে বাঙ্গলার সুপ্রসিদ্ধ লিখক বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ী। একদিন সন্ধ্যার কিছু পূবের্ব বঙ্কিমবাবুকে সামান্য একখানি নৌকার উপর বান্ধাঘাট হইতে পূবর্ব পার যাইতে দেখিলাম। সঙ্গে একজন আরদালী। হুগলীর ফৌজদারী কাচারী হইতে বাটী যাইতেছেন। প্রত্যহ এইরূপ যাওয়া [আসা] করেন। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন মুসলমান ছাত্র ছিলেন। আমাদের সমাজে বাঙ্গলাভাষার চ্চর্চা একেবারে নাই বলিয়া অনেক দুঃখ করিলেন আর বলিলেন আমাদের সমাজে একখানি বাঙ্গালা খবরের কাগজ নাই বড়ই আক্ষেপের বিষয়।

এই চিন্তার ফলশ্রুতিতে আজীজন নেহার ‘মাসিক’পত্রটি হুগলি কলেজের কতিপয় উৎসাহী মুসলমান শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ও মশাররফ হোসেনের সম্পাদনায় চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রস্ত্ততি-প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (১৬ চৈত্র ১২৮০) আজীজন্ নেহার শিরোনামে ‘হুগলী কলেজে’র ‘কএকজন মুসলমানে’র বরাতে এই পত্রিকার প্রকাশ-বিষয়ে একটি ‘বিজ্ঞাপন’ প্রচারিত হয়। তাতে এই মাসিকপত্রটি ‘আগামী বৈশাখ হইতে’ প্রকাশের ঘোষণার পাশাপাশি কুষ্টিয়ার         লাহিনীপাড়ার ঠিকানায় মীর মশাররফকে চিঠি লিখলে পত্রিকা পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়।

মীরের প্রথমা পত্নী আজীজননেসার নামে এই পত্রিকার নামকরণ। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় আজীজন নেহারের আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়। পত্রিকাটি দুষ্প্রাপ্য বলে পত্র-পত্রিকার বিজ্ঞাপন-সংবাদ-সমালোচনা বা নিবন্ধের মন্তব্য এবং মশাররফের ভাষ্যই এ-বিষয়ে ধারণা গ্রহণের  মূল উৎস। কেননা এ-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ-সম্পাদকীয়-প্রবন্ধ-নিবন্ধের নমুনা আজ আর সুলভ নয়।

কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (আষাঢ় ১২৮১) আজীজন নেহার সম্পর্কে এই আলোচনাটি প্রকাশ পায় :

‘আজীজন নেহার’ মুসলমান কর্ত্তৃক সম্পাদিত পাক্ষিক পত্রিকা। আমরা ক্রমান্বয়ে ইহার ৩ সংখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছি। ইহার লেখকগণ আমাদিগের পরিচিত, এই ইঁহাদের নব্যোদ্যম নহে, তবে সাহস করিয়া পত্রিকা প্রচার করা নূতন বটে। ইঁহারা যে গুরুতর উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাহা সংসিদ্ধ হইবার যদিও অন্তরায় লক্ষিত হয়, তথাপি আজীজন নেহার দ্বারা তাহার কিছু না কিছু নিরাকৃত হইবে এরূপ আশা বিড়ম্বনার বিষয় নহে। ইহাতে যে কয়েকটী প্রস্তাব প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে অতি উপাদেয় ফল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। আমরা প্রস্তাবগুলি মনোযোগসহ পাঠ করিয়া পরম সন্তুষ্ট হইয়াছি। ভাষা অতি মনোরম। মুসলমান লিখিত বলিয়া মনে হয় না, এমন কি অনেক আধুনিক হিন্দু লেখকের লিপি-চাতুর্য্যকে ইহার নিকট বলিদান দিতে পরামর্শ দি।…

এডুকেশন গেজেটে (১ মে ১৮৭৪/ ১৯ বৈশাখ ১২৮১) প্রকাশিত ‘শ্রীপূ-’ ছদ্মনামে জনৈক পাঠকের এক চিঠিতে এই ‘মাসিক সংবাদপত্রে’র প্রশংসা করে মন্তব্য করা হয় : ‘দেখুন… মহম্মদীয়গণ মধুময় বাঙ্গালা ভাষার যথার্থ স্বাদগ্রহণে কেমন সমর্থ হইয়াছেন।’ পরের সপ্তাহে আজীজন নেহার পত্রিকার আলোচনা-প্রসঙ্গে এডুকেশন গেজেটে (৮ মে ১৮৭৪) আরো খোলাসা করে বলা হয় :

আমরা সম্প্রতি দুইখানি নূতন সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রাপ্ত হইয়াছি। একখানির নাম ন্যাসনেল বজেট,… অপরখানির নাম আজীজন্ নেহার। হুগলী কলেজের কতিপয় মুসলমান যুবক ইহার প্রচার আরম্ভ করিয়াছেন। ইহার মূল্যের ও প্রচারের সময়েরও এখন নিরূপণ হয় নাই। প্রচারকগণ লিখিয়াছেন, ‘‘এবারে মূল্যের কিছুই নির্ণয় করা গেল না। পাঠকগণের উৎসাহসূচক পত্রিকা ও গ্রাহকগণের সংখ্যাবৃদ্ধি দেখিলেই আগামী মাস হইতে পাক্ষিকরূপে প্রকাশের ইচ্ছা রহিল।’’ এই পত্রিকাখানির বিষয়ে বিশেষ বক্তব্য এই, এখানি মুসলমানের লিখিত, অথচ ইহাতে মুসলমানি বাঙ্গালার নামগন্ধ নাই, বিশুদ্ধ বাঙ্গালার রীতিতে লিখিত। লেখকেরা উৎসাহ পাইবার যোগ্য, তাহার সন্দেহ নাই। আমরা উভয় পত্রিকারই মঙ্গল কামনা করি।

সেকালের আর-এক বিশিষ্ট পত্রিকা সোমপ্রকাশ (১৮ মে ১৮৭৪) খুবই সংক্ষিপ্ত কথায় এই আজীজন নেহারের আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়েছিল :

আজিজন নেহার। এখানি নূতন সংবাদপত্র। ইহার বিশেষ চিহ্ন এই কতিপয় মুসলমান দ্বারা সম্পাদিত হয়। কাগজখানি পড়িয়া আমরা আনন্দিত হইয়াছি। ইহার ভাষা অনেক বিজ্ঞ বিজ্ঞ সম্পাদকের ভাষার অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। আমরা সবর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করি যে কাগজখানি দিন দিন উন্নত হউক।

চুঁচুড়ার সাধারণী সাপ্তাহিকে (২৫ জ্যৈষ্ঠ ১২৮১) ‘নূতন পত্রিকা’ শিরোনামে আজীজন নেহারের প্রকাশকে অভিনন্দন জানিয়ে মন্তব্য করা হয় :

আজিজন নেহার, বঙ্গীয় মুসলমানগণের মুখস্বরূপ হইয়া প্রকাশিত হইতেছে; বড় আহ্লাদের বিষয়। সকল সম্প্রদায়েরই পৃথক পৃথক পত্রিকা থাকা উচিত। বিশেষত বঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা বড় অল্প নহে। নিজ বাঙ্গালায় হিন্দু ১,৮১,০০,৪৩৮ জন, মুসলমান ১,৭৬,০৯,১৩৫ জন, সুতরাং নিজ বাঙ্গালায় হিন্দুমুসলমান প্রায় সমানই। অথচ মুসলমানদের হইয়া প্রায় কেহই কোন কথা কহেন না, এটি ক্ষোভের বিষয় বলিতে হইবে। এতদিন পরে মুসলমানেরা আপনাদের জিহবা সঞ্চালন করিবেন। একটি কথা, আজিজন নেহারে দুইজন বাঙ্গালী হিন্দু লেখকও এজেন্ট বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন, আমাদের বিবেচনায় এরূপ না হইলেই ভাল হইত। ভরসা করি প্রকাশকগণ এ বিষয়ে একটু বিবেচনা করিয়া দেখিবেন। যাহা হউক আজিজন নেহার চিরস্থায়ী হয় ইহা আমাদের একান্ত ইচ্ছা। হুগলি কালেজের মুসলমান ছাত্রগণ ইহা প্রকাশ করিতেছেন, আজিজন নেহার আমাদের একরূপ প্রতিবাসী। এরূপ উদারচেতা প্রতিবাসীর মঙ্গল হউক।

কিন্তু এই শুভেচ্ছা-জ্ঞাপনের কিছু পরেই সাধারণী (২৯ আষাঢ় ১২৮১) আজীজন নেহার পত্রিকার বিরুদ্ধে রুচিবিকারের অভিযোগ উত্থাপন করে একটি ব্যঙ্গাত্মক বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করে :

আজিজন নেহার। এই অভিনব পত্রের আমরা যথার্থই শুভানুধ্যায়ী। নহিলে সম্বাদপত্রের দ্বিতীয়বার সমালোচন সাধারণীতে সম্ভবে না। আজিজন নেহার ক্রমে একটি পক্ষীর দল হইয়া উঠিতেছে। পত্র এই চারি সংখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে, ইতিমধ্যে ইহাতে কাকাতুয়া, বুলবুলি, টুনটুনি, দাঁড়কাক, ফিঙ্গে ও তোতা দেখা দিয়াছে; শুদ্ধ চিড়িয়াখানা প্রদর্লন [প্রদর্শন] করিয়াই আজিজন ক্ষান্ত নহেন, লক্ষ্ণৌয়ের নবাব কৃত্রিম পাহাড়ে যোড়া [বোড়া] সাপ দেখান; ইঁহারা ইতিমধ্যে কেঁচো লাহির [বাহির] করিয়াছেন, বোধহয় ক্রমে সাপ বাহির করিবেন।

বিদ্রূপ ত্যাগ করিয়া আমরা জিজ্ঞাসা করি, অভিনব পত্র সম্পাদকের এরূপ রুচি কেন? এ রুচি বিকৃতা।

সাধারণীর এই ক্ষোভের প্রকৃত কারণ আমাদের কাছে অস্পষ্টই রয়ে গেলো।

এ-পর্যন্ত মূলত এডুকেশন গেজেট, সোমপ্রকাশ, সাধারণী ও গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকাই ছিল আজীজন নেহার পত্রিকা সম্পর্কে ধারণার মূল উৎস। তবে বেশ কিছুকাল আগে আবিষ্কৃত মশাররফ হোসেনের অপ্রকাশিত আত্মজীবনী, স্বরচিত জীবনবৃত্তান্ত ও দিনপঞ্জিতে আজীজন নেহার সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য মেলে। এর ভিত্তিতে এই পত্রিকার নামকরণ, প্রকাশের উদ্দেশ্য, প্রকাশকাল, প্রকাশ-ব্যবধান, স্থায়িত্ব, প্রকাশ-বন্ধের কারণ – এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা যায়। ফলে আজীজন নেহার পত্রিকা সম্পর্কে পূর্বসূরিদের অনেক অভিমত-অনুমান-সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা ও সংশোধনের সুযোগ মিলেছে।

 

চার

পত্নী আজীজননেসার প্রতি মশাররফের বিরূপ ধারণা ও অপ্রসন্ন মনোভাব কখনো প্রচ্ছন্ন ছিল না। এই প্রথমা পত্নী যে তাঁর জীবন কলহ-বিবাদে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন, সেই ঘরোয়া কথা জানাতেও তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। দাম্পত্যজীবন অসহ হয়ে ওঠায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ের প্রেরণাও পান। দীর্ঘ বত্রিশ বছর সংসার করার পর মশাররফ প্রথম পক্ষকে শেষ পর্যন্ত তালাকও দিয়েছিলেন। তবুও এই ‘হাড়জ্বালানী’ পত্নীর নামেই পত্রিকার নামকরণের বিষয়টি রহস্যজনক ও বিস্ময়কর। তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে  জানা যায় (এই বিবরণ শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ থেকে গৃহীত : সচিত্র-সন্ধানী, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) : ‘প্রথম স্ত্রী আজিজননেসা।… এই স্ত্রীর নামেই ‘আজিজননাহার’ পত্রিকা প্রকাশ করা।’ নামকরণের তাৎপর্য সম্পর্কে আভাস দিয়ে মশাররফ বলেছেন :

পত্রিকার নাম আজিজননাহার হইবার কারণ কি? আজ পর্য্যন্ত নামকরণ কেহই জ্ঞাত নহেন। এখন সময় হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ করিলাম। ‘আজিজননাহার’ – ‘প্রিয়দিন’ এই অর্থের ভাব লইয়া পত্রিকার শিরোদেশে লিখিত ছিল :

‘দিনপ্রিয় উপহার দিলাম যতনে

দীনপ্রিয় হের সদা সদয় নয়নে।’

আজীজন নেহার পত্রিকার প্রকাশ-ব্যবধান নিয়ে মতভেদ আছে। অবশ্য এই বিভ্রান্তির জন্যে মীরের বক্তব্যও অনেকাংশে দায়ী। তিনি কখনো এই পত্রিকাকে ‘পাক্ষিক’, কখনো বা ‘মাসিক’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একে ‘মাসিক’ বলে উল্লেখ করলেও আবদুল গফুর সিদ্দিকী ‘সাপ্তাহিক’ ও আলী আহমদ গ্রামবার্ত্তাকে অনুসরণ করে ‘পাক্ষিক’ বলে অভিহিত করেছেন। অবশ্য গ্রামবার্ত্তায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে পত্রিকাটি ‘মাসিক’ হিসেবে প্রকাশ পাবে বলে উল্লেখ করা হয়। এডুকেশন গেজেটে প্রথমে ‘মাসিক’, আবার এক সপ্তাহ পরে ‘সাপ্তাহিক’ হিসেবে আজীজন নেহার পরিচিতি পায়।

আজীজন নেহার পত্রিকা প্রকাশের ফলে বাঙালি সমাজে, বিশেষ করে মুসলমান সমাজে, বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ-সম্পর্কে মশাররফ তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন :

মাতামহীর স্বর্গারোহণের পর ১২৮১ সালের ১লা বৈশাখ ‘আজিজন নেহার’ নামে বাঙ্গলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করিলাম। মুসলমান সমাজে এই বাঙ্গালা পত্রিকা বঙ্গদেশে প্রথম প্রকাশিত হইল। বাঙ্গালী মুসলমানসমাজ জানিত না বুঝিত না যে সংবাদপত্র কি? প্রথম খন্ড প্রকাশ হইলে মহা আন্দোলন উপস্থিত হইল। ঘরের পয়সা খরচ করিয়া পরের ঘরে এরূপ খবরের কাগজ পাঠাইলে লাভ কি? সকল কথাই কি সত্য লিখা হয়? এত খবর পায় কোথা? যাহা হউক যিনি যাহা বলিতে লাগিলেন কান পাতিয়া শুনিতে লাগিলাম। মনকে দৃঢ় করিলাম। বিচলিত হইব না। যাহা সংকল্প তাহাই স্থির। প্রথম খন্ডে ‘‘সূচনা’’ ‘‘কি লিখি’’ এই দুই প্রবন্ধ প্রকাশ হইল।

মশাররফ যখন হুগলিতে ছিলেন, সেইসময়েই আজীজন নেহার পত্রিকা চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু মশাররফের অপ্রকাশিত আত্মজীবনী থেকে জানা যায় লাহিনীপাড়া থেকেই তিনি পত্রিকা পরিচালনা করতেন : ‘দুই বৎসরের মধ্যে কলিকাতা কি কৃষ্ণনগর যাই নাই। বাড়িতে বসিয়াই ‘আজিজন নাহার’ পত্রিকা পরিচালনা কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছি।’

পত্রিকা মোটামুটি দুবছর চলেছিল বলে খবর পাওয়া যায়। অনুমান করা চলে, পত্রিকাটি চুঁচুড়া থেকে প্রকাশের প্রথম পর্যায়ে মশাররফ সেখানে ছিলেন, তারপর লাহিনীপাড়ায় ফিরে আসেন এবং এখান থেকেই পত্রিকা-সংক্রান্ত কাজকর্ম সম্পাদন করতেন। হয়তো ক্বচিৎ কখনো চুঁচুড়ায় যেতে হতো তাঁকে।

মূলত সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই এই পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। সেইসঙ্গে পত্রিকার পরিচালকদের উদাসীনতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বও কম দায়ী ছিল না, সাধারণীর (২ আগস্ট ১৮৭৪) সূত্রে সে-কথা জানা যায়। মশাররফ তাঁর অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতেও এসব কথা কিছু কিছু লিখে গেছেন :

আজিজননাহার পত্রিকায় প্রথম দুই বৎসর বেশ টাকা আদায় হইল। তাহার পর আমারও মন খারাপ। লিখাও আর পূবের্বর মত উৎসাহের সহিত হইল না। মূল্যও পাওয়া যায় না… প্রেসের দেনা, কাগজের দেনা অনেক দায়ী হইতে হইল। পৃষ্ঠপোষক কাহাকেও পাইলাম না। লিখিবার লোকও আর নাই। মধ্যে মধ্যে আমার ভক্তিভাজন হরিনাথ মজুমদার বিশেষ সাহায্য করিতেন। আমার দুঃসময় সমাগত বলিয়াই যেন তাঁহার মাথার বেদনা। শীরপীড়া রোগ উপস্থিত হইল। তিনি লিখাপড়ার কর্ম্ম হইতে এক প্রকার বিরত হইলেন।

এরপরেও পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু অর্থাভাবে তা ব্যর্থ হয়। বলেছেন তিনি : ‘পত্রিকা বন্ধ হইয়াছে। যে প্রেসে ছাপাইতাম তাহাদের অনেক টাকা বাকি পড়ায় – হুগলী বোধোদয় যন্ত্রে ছাপাইতে দিলাম। টাকা অভাবে ছাপান কাগজগুলি সেই প্রেসেই রহিয়া গেল।’

আজীজন নেহার পত্রিকা কতদিন চলেছিল সে-সম্পর্কে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত (১০ বৈশাখ ১২৯৮) ‘হিতকরীর আত্মকথা’ নিবন্ধ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় : ‘কুষ্টিয়া সবডিভিসন সৃষ্ট হইতে এ পর্য্যন্ত এই হিতকরী লইয়া তিনখানি পত্রিকা প্রকাশ হইল। প্রথম গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা, তাহার পর আজীজননাহার। আজীজননাহার দুই বৎসরকাল চলিয়াছিল…।’

আনিসুজ্জামানের তালিকা-অনুসারে মশাররফের আজীজন নেহারের আগে মুসলিম-পরিচালিত তিনটি পত্রিকার খবর মেলে : সমাচার সভারাজেন্দ্র (সাপ্তাহিক, ১৮৩১), জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর (সাপ্তাহিক, ১৮৪৬) ও ফরিদপুর দর্পণ (পাক্ষিক, ১৮৬১)।        ফারসি-বাংলা দ্বিভাষিক সমাচার সভারাজেন্দ্র পত্রিকার স্বত্বাধিকারী-মুদ্রাকর-প্রকাশক শেখ আলীমুল্লাহ ছিলেন বলে কেউ কেউ মনে করলেও এর সম্পাদক হিসেবে সরকারি দপ্তরে নাম পাওয়া যায় দুর্লভচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। জগদ্দুদ্দীপক ভাস্কর ছিল ‘খুবই স্বল্পায়ু’ পত্রিকা। প্রকাশের জন্যে বিজ্ঞাপিত হলেও ফরিদপুর দর্পণ আদৌ বেরিয়েছিল কী না সে-সম্পর্কে সংশয় আছে (মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, ঢাকা, ১৩৭৬)।

প্রকাশকালের ক্রমানুসারে নয়, পরিচিতি ও পাঠকপ্রিয়তার বিষয় বিবেচনায় এনেই হয়তো সাধারণভাবে আজীজন নেহারকেই মুসলিম বাংলা সাময়িকপত্র-সাধনায় প্রথম সার্থক প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হিতকরী পত্রিকায় (৩০ আশ্বিন ১২৯৮) বলা হয়, ‘…মুসলমান লিখিত বাঙ্গালা সংবাদ পত্রিকা’র মধ্যে আজীজন নাহার পত্রিকাই প্রথম প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ও (১৮৬১-১৯৩০) মন্তব্য করেছেন, আজীজন নেহারই ‘মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে… সবর্বপ্রথম বলিয়া পরিচিত’ (প্রদীপ, পৌষ ১৩০৮)।

স্বল্পজীবী হলেও আজীজন নেহার সমকালে সমাদৃত হয়েছিল। সমাজহিতৈষণার আদর্শ নিয়ে এই পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। সমাজ-সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তা মোচনের উদ্দেশ্য যে এই পত্রিকার ছিল তা গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার (জুন ১৮৭৪) আলোচনা-সূত্রে জানা যায়। আজীজন নেহার সম্পাদনার অভিজ্ঞতা উত্তরকালে মশাররফের সাময়িকপত্র-পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ কাজে লেগেছিল।

 

পাঁচ

হিতকরী মীর মশাররফ হোসেন-সম্পাদিত দ্বিতীয় পত্রিকা। আজীজন নেহার প্রকাশের পর ষোলো বছর বিরতি দিয়ে আবার নতুন পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেন মশাররফ। হিতকরীর উদ্বোধনী সংখ্যায় (১ম ভাগ ১ম সংখ্যা : ১৫ বৈশাখ ১২৯৭) পত্রিকার প্রকাশনা-বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। এই সূত্রে হিতকরীর প্রকাশকাল সম্পর্কে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণালাভের সুযোগও মিলেছে। বলা হয়েছে : ‘হে! অনন্তশক্তি সম্পন্ন করুণাময়, কৃপাময়, কৃপাসিন্ধু ভববন্ধু ভগবান! তোমারই অনন্তগুণ আশ্রয় ও সহায় করিয়া হিতকরী ১২৯৭ সনের ১৫ই বৈশাখে প্রকাশ হইল।’

হিতকরী – এই পত্রিকা তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছিল জনকল্যাণের আদর্শ অনুসরণ করে। পত্রিকার উদ্দেশ্য ও নীতি সম্পর্কে স্পষ্টই জানানো হয় :

সকলের হিতকথা, যাহাতে সবর্বসাধারণের হিতের আশা থাকে, সেই সকল কথাই হিতকরীতে প্রকাশ হয়। জাতিগত, কি ধর্ম্মগত কোন পক্ষকে লক্ষ্য করিয়া কিছু প্রকাশ হয় না। (হিতকরী, ওই)

এই বক্তব্য থেকে হিতকরীর উদার মত, সর্বজনীন মনোভাব ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।

হিতকরী কুমারখালী মথুরানাথ যন্ত্রে মুদ্রিত এবং কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে প্রকাশিত হতো। পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছিলেন যথাক্রমে রজনীকান্ত ঘোষ ও দেবনাথ বিশ্বাস। প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল দুই পাই আর ডাকমাশুলসহ বার্ষিক মূল্য দুই টাকা। সম্পাদক হিসেবে কারো নাম ছাপা হতো না। তবে মীরের অপ্রকাশিত স্বরচিত জীবনবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, তিনি ‘১২৯৭ সালে ১৫ই বৈশাখ হিতকরী নামক পত্রিকার সম্পাদক হয়েন।’ অন্যান্য তথ্য ও পত্রিকার অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য-সাবুদও এই বক্তব্য সমর্থন করে।

এইসব তথ্য থেকে নিঃসংশয় হওয়া যায় যে, মীর মশাররফ হোসেনই বরাবর হিতকরী পত্রিকার সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন। তবে টাঙ্গাইল-পর্বে কৌশলগত কারণে মোসলেমউদ্দীন খাঁকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব দিতে হয়। আর হিতকরীর শেষপর্বে রওশন আলী চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় হিতকরী প্রকাশের উদ্যোগ যে-কোনো কারণেই হোক সফল হয়নি। তবে হিতকরী চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো কুমারখালী থেকে যে বেশ কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে মশাররফের রীতিমতো অনুমতি নিয়ে সম্পাদক হিসেবে পরিচিত হতে হয় জ্যোতিপ্রসাদ সান্যালকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত হিতকরীর মালিকানা ও সম্পাদনা-স্বত্ব উভয়ই মশাররফেরই ছিল।

হিতকরী পাক্ষিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পাঠক-চাহিদার কারণে দ্বিতীয় বর্ষে ‘দাশাহিক’ বা ‘দাশহিক’ হিসেবে (অর্থাৎ দশদিন পরপর) প্রকাশিত হতে থাকে। এই পরিবর্তন ব্যতীত পত্রিকার মূল্য, মুদ্রাকর, প্রকাশক, মুদ্রণালয়, এজেন্ট বা অন্য কোনো নীতি-বক্তব্যের রদবদল হয়নি।

প্রজাহিতসাধনের লক্ষ্যে সৎ ও বস্ত্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতার আদর্শ নিয়ে হিতকরীর আত্মপ্রকাশ। পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় পত্রিকা কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে (হিতকরী, ১০ বৈশাখ ১২৯৮) :

দুই দশ টাকা লাভের জন্য হিতকরী প্রকাশ হয় নাই। জীবিকা নিবর্বাহের কোন উপায় না পাইয়া এই কুটিল ও জটিলপথ আশ্রয় করা হয় নাই। ন্যায্য বলিব, সত্য প্রকাশ করিব। সত্যাশ্রয়ে থাকিব, সাধারণের হিতকরকার্য্যে অবশ্যই যোগ দিব। আমরা পূবর্ব হইতেই বলিয়া আসিতেছি যে, আমরা কোন সম্প্রদায়ভুক্ত নহি, আমরা সকলের। একচখো দৃষ্টি আমাদের নাই। যেখানে অন্যায়, সেইখানেই আমরা, যেখানে অত্যাচার, যেখানে অবিচার সেইখানেই আমাদের কথা! আমরা প্রশংসার প্রত্যাশী নহি। আর্থিক সাহায্যের আশাও রাখি না। সুতরাং আমাদের ভয়ের কোন কারণ নাই। প্রথম সূচনায় বলিয়াছি, আমাদের প্রথম পূজনীয় ঈশ্বর, তৎপরেই রাজা, গ্রাহকমাত্র না থাকুক, সাধারণে হিতকরী পাঠ না করুন, ক্ষতি নাই। যাঁহার নিকট জানাইলে দেশের উপকার হইবে, অত্যাচার অবিচার কমিবে, অন্যায়ের সুবিচার হইবে, কেবল তাঁহাকেই জানাইব। আর দেশের মান্যগণ্য লোক যাঁহাদের হৃদয় আছে, তাঁহাদের নিকট উপহারস্বরূপ উপস্থিত হইব। আর ভয় কি, কিসের আশঙ্কা।

এখানে লক্ষ করার বিষয় এই যে, রাজভক্তি ও রাজানুগত্যের প্রশ্নে হিতকরী তার যুগকে অস্বীকার বা অতিক্রম করতে পারেনি। তাই মূলত রাজদ্বারে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সমাজ ও জনগণের সমস্যা দূর করার প্রয়াসই অবলম্বন করেছিল হিতকরী।

বছরখানেক পত্রিকা প্রকাশের পর হিতকরীর পরিচালকদের এই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় যে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পত্রিকা পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন। নানা সংকট, সমস্যা ও পারস্পরিক বিভেদ-দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও হিতকরী সবার শুভবুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনার কাছে ঐক্য ও সদ্ভাবের জন্যে আবেদন জানিয়েছে। সেই সঙ্গে জন্মলগ্নের অঙ্গীকারের কথা পুনরায় উচ্চারিত হয়েছে। হিতকরীর (২০ ভাদ্র ১২৯৮) এক ‘সম্পাদকীয় মন্তব্যে’ এই বিষয়গুলো যেন সালতামামির প্রতিবেদনের মতো পেশ করা হয়েছে :

হিতকরী যে গুরুতর ভার মাথায় করিয়া সাধারণ সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে, যে পথে যে প্রণালীতে চলিতেছে তাহাতে তাহার প্রতিপত্তি লাভ করা সহজ নহে। এখানি হিন্দুর কাগজ, ওখানি ব্রাহ্ম পত্রিকা, ওখানি মুসলমান সমাজের মুখপত্র। এক একজন এক একজনের হইয়া কথা কহিতেছে। শুনিতেও মিষ্টি, চলিতেও সোজা পথ। কোনরূপ বাধা প্রতিবন্ধক কিছুই নাই। সকলের – সাধারণের হিতসাধনই হিতকরীর প্রধান উদ্দেশ্য। এবং ঐ পার্থক্যভাব দূর করার কথা মুখে আনা একপ্রকার পাগলের হেঁয়ালী। তবে একেবারে কাটাকাটি মারামারি না হইয়া ভ্রাতৃভাবে পরস্পর পরস্পরের দিকে কটাক্ষভাবে একবার দৃষ্টি করিলেও হিতকরীর জীবন সার্থক, জন্ম সফল। সকল দিক লক্ষ্য রাখিয়া আপন মস্তক বাঁচাইয়া, তেলে বেগুনে দা কুমড়ে, সদ্ভাব স্থাপন করিয়া প্রণয়ভাব বৃদ্ধি করা বড়ই কঠিন কার্য্য, নেহ্য নিরপেক্ষর সীমা হইতে একচুল পরিমাণ সরিবার ক্ষমতা হিতকরীর নাই। সুতরাং জাতিগত, সম্প্রদায়গত, ধর্ম্মগত কোনরূপ উত্তেজনা, কোনরূপ ইতরবিশেষে এমন কি উনিশ বিশে একটা বর্ণ উচ্চারণ করিবার ক্ষমতা হিতকরীর নাই। বাহবা পাইবার বরাত নাই। সহায় ঈশ্বর, ভরসা ঈশ্বর। আর অনুগ্রহ পাঠকগণের – মফস্বলে বাঙ্গালা খবরের কাগজ যাত্রার দলের সং বিশেষ -।

প্রেরণাশূন্য ও পৃষ্ঠপোষকতাহীন বৈরী সমাজে হিতকরীর চলার পথ সুগম ছিল না। অনেক বিরুদ্ধতা ও বিরূপ সমালোচনা সহ্য করে তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। এই সমালোচনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈরিতার রূপ নিয়ে শালীনতার গন্ডি অতিক্রম করেছে। কুষ্টিয়ার ছোটো আদালতের বিচারক ছিলেন বরদাপ্রসন্ন সোম। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের খবর প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষিপ্ত বিচারক প্রকাশ্য আদালতে হিতকরী পত্রিকাকে ‘পোঁদ পোঁছা কাগজ’ বলে কটূক্তি করেন এবং পত্রিকার সহকারী সম্পাদক উকিল রাইচরণ দাসকে ভৎর্সনা ও অপমান করেন। বিষয়টি এখানেই শেষ হয়নি – রাইচরণ দাসের বিরুদ্ধে বিচারক মহোদয় মোকদ্দমাও দায়ের করেন। এরপর ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ‘জজবাবুর স্বপক্ষে লিখিবার জন্য হিতকরীর নিকট গোপনে প্রস্তাব হইল, সকলই বিফল’ (হিতকরী, ২০ ভাদ্র ১২৯৮)। সমাজের কল্যাণচিন্তা                   ও প্রগতিশীল ভূমিকার জন্যে হিতকরীকে কখনো কখনো রক্ষণশীল-মানসতার মানুষের বিরাগভাজন হতে হয়। সম্মতিদান আইন সমর্থন করায় অনেক গ্রাহক হিতকরীর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ এবং কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে গালমন্দ করে চিঠিও লেখেন (হিতকরী, ২০ বৈশাখ ১২৯৮)। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও হিতকরী কর্তৃপক্ষ স্বাধীন মতপ্রকাশ ও নির্ভীক ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি দিতে ও তা রক্ষা করতে দ্বিধা করেননি।

অবশ্য নিন্দা-সমালোচনার পাশাপাশি হিতকরীর প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের আন্তরিকতার সন্ধানও মেলে। রায়ত-প্রজার অভাব-অভিযোগ এবং প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি-অব্যবস্থার কথা নির্ভীকভাবে প্রকাশ করে হিতকরী যথার্থ সামাজিক কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ থেকেছে – ‘জনৈক গ্রাহকে’র চিঠিতে (হিতকরী, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৮) এমন প্রশংসার কথা শোনা যায় :

ইতিপূবের্বও কয়েক সংখ্যাতে হিতকরীর প্রতি সাধারণের বিদ্বেষভাবের কথা প্রকাশিত হইয়াছে। হিতকরী কেন যে লোকের বিষ নয়নে পড়িতেছে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।… হিতকরী ন্যায়ের পথ অবলম্বন করিয়া লোকসেবাব্রতে জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। অত্যাচারীর অত্যাচার কাহিনী, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায়ের সমর্থন, স্বদেশবাসীর মঙ্গলচিন্তা, এইসকল বিষয়ই তো হিতকরীতে দেখিতে পাই।… কুষ্টিয়ার বড়ই সৌভাগ্য বলিতে হইবে যে, হিতকরীর মত একখানি উচ্চ ও উদার মতের পত্রিকা প্রকাশিত হইয়া দেশের দুঃখকষ্টের কথা সাধারণ ও কর্ত্তৃপক্ষীয়দিগের নিকট জানাইতেছেন।

হিতকরীর বিরুদ্ধে ‘কোন ২ প্রস্তাবে প্রেরিত পত্রে সংবাদে মুসলমানি কথা থাকা’ বিষয়ে অভিযোগ উঠেছিল। এর যুক্তিসংগত জবাব দিয়ে হিতকরী (২০ ভাদ্র ১২৯৮) মন্তব্য করে : ‘…মাতৃভাষার সহিত ভ্রাতৃভাষার যোগ করিতেছি।… ভাষার মিলনে ভালবাসার বৃদ্ধি। ইহাও আমাদের কম সৌভাগ্যের কথা নহে।’

‘দ্বিতীয় বর্ষে ‘হিতকরী’ টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত হয়’, – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাংলা সাময়িক-পত্র, ২য় খন্ড, কলকাতা, ১৩৫৯) পরিবেশিত এই তথ্য সঠিক নয়। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত হিতকরী লাহিনীপাড়া থেকেই প্রকাশিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ‘নানা কারণে’ তৃতীয় বর্ষে হিতকরী টাঙ্গাইলে স্থানান্তরিত হয়। এই পর্যায়ের সূচনাতেও মশাররফ যে হিতকরীর সম্পাদক তা বেশ বোঝা যায়। টাঙ্গাইলে হিতকরী মুদ্রিত হতো বিশিষ্ট লেখক আবদুল হামিদ খান ইউসফজয়ীর আহমদী প্রেসে। পরে মশাররফ এই ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী হন। মীরের অপ্রকাশিত দিনলিপি থেকে জানা যায়, ‘চাকরি নাই কেবল প্রেস লইয়া হিতকরী কাগজ লইয়া আছি।’

হিতকরী লাহিনীপাড়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তর ও তার ফলে নিয়মিত প্রকাশনার সমস্যার কারণ ব্যাখ্যা করে মশাররফ তাঁর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞাপনে নিজেকে ‘সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী’ হিসেবে            উল্লেখ করেন (হিতকরী, ১০ জ্যৈষ্ঠ  ১২৯৯)।  মীর-গবেষক আশরাফ সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ১২৯৯ সালের ১০ ভাদ্র সংখ্যা হিতকরীতে সম্পাদক হিসেবে মোসলেমউদ্দীন খাঁ ও মুদ্রাকর হিসেবে সাধু সরকারের নাম ছাপা হয়। ওই সংখ্যায় সহকারী সম্পাদক ও এজেন্ট হিসেবে আগের মতোই কুষ্টিয়ার রাইচরণ দাসের নাম পাওয়া যায়। মশাররফ সম্পাদক হিসেবে যে পত্রিকার পরিচালক ছিলেন তার প্রমাণ পত্রিকা-অভ্যন্তরেই মেলে। পত্রিকায় দেলদুয়ার জমিদারবাড়ির কলহ-বিবাদের অনেক ঘরোয়া খবর প্রকাশিত হয়। মশাররফ তখন দেলদুয়ার এস্টেটের ম্যানেজার। এ-ছাড়া টাঙ্গাইলের কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তাও নানা কারণে মীরের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। এসব কারণে স্বনামে পত্রিকা সম্পাদনা তাঁর পক্ষে নিরাপদ ছিল না। তাই তাঁর বিশ্বস্ত মোসলেমউদ্দীন খাঁকে সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন; – আশরাফ সিদ্দিকীর এই ধারণা যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়। এই পর্যায়ে হিতকরী কতদিন চলেছিল তার সঠিক খবর জানা যায় না। তবে অনুমান করা চলে, মীরের টাঙ্গাইল-ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই এই পর্বের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তী সময়ে মোসলেমউদ্দীন খাঁর সম্পাদনায় হিতকরী পত্রিকা নবরূপে টাঙ্গাইল হিতকরী নামে প্রকাশিত হয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। অবশ্য এই অনুমানের পক্ষে কোনো প্রমাণ মেলেনি। তবে ষাটের দশকে মিরজা আ. ম. আবদুল হাইয়ের সম্পাদনায় ‘টাঙ্গাইল মহকুমা মৌলিক গণতন্ত্রের মুখপত্র’ হিসেবে হিতকরী নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা (১৬ অক্টোবর ১৯৬২) প্রকাশিত হয়। পরে পত্রিকাটি মাসিকে রূপান্তরিত হয় এবং এই পর্যায়ে পত্রিকা-পরিচিতিতে মুদ্রিত থাকতো – ‘মাসিক হিতকরী (স্থাপিত ১৮৯২ – মীর মোশাররফ হোসেন)’।

 

ছয়

টাঙ্গাইল-ত্যাগের সাত বছর পর মশাররফ পুনরায় কোহিনুর-সম্পাদক এস.কে.এম. মহম্মদ রওসন আলীর [রওশন আলী চৌধুরী] সহযোগে হিতকরী পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কোহিনুর পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ (১৩০৬) শুরুর আগে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপন-পুস্তিকার শেষভাগে হিতকরীর পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় : ‘ ‘হিতকরী’ ১৩০৬ সালের শুভ বৈশাখ হইতে নতুন প্রণালীতে খাঁটি নিখুঁত মুসলমানীভাবে বাহির হইবে।’

৪র্থ বর্ষে নব-কলেবরে প্রকাশিত হওয়ার ওই বিজ্ঞাপন থেকে ধারণা করা যায়, ৩য় বর্ষে হিতকরী টাঙ্গাইলে মোটামুটি প্রায় এক বছর চলেছিল। অবশ্য টাঙ্গাইলে হিতকরী প্রকাশের সাত বছর পর পাংশা থেকে নবপর্যায়ে হিতকরী পত্রিকা ‘নতুন প্রণালীতে খাঁটি নিখুঁত মুসলমানীভাবে’ প্রকাশিত হওয়ার কোনো তথ্য-প্রমাণ  পাওয়া যায় না। তবে ওই বছরেই (১৮৯৯) হিতকরী পত্রিকা যে হিন্দু-পরিচালক ও সম্পাদকের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়েছিল তার সাবুদ মেলে।

১৮৯৯ সালে (বাংলা ১৩০৬) চতুর্থ বর্ষের হিতকরী পত্রিকা পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশের সুনির্দিষ্ট খবর পাওয়া যায় কাঙাল হরিনাথ-প্রতিষ্ঠিত কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রের ১৩০৭ সালের চিঠির নকল পুস্তক থেকে। হিতকরী এই পর্যায়ে কুমারখালীর মথুরানাথ যন্ত্রে মুদ্রিত হতো। মথুরানাথ যন্ত্রের মুদ্রাকর কুঞ্জলাল দাস Inspector General of Registration, Bengal-কে প্রেরিত প্রতিবেদন-পত্রে ১৮৯৯ সালে মুদ্রিত পুস্তক ও পত্রিকার মধ্যে উল্লেখ করেছেন, ‘Fortnightly newspaper ‘Hitakari’ 11 issues’. এই একই সালে ৪ খন্ড (‘4 parts’) কোহিনুর পত্রিকাও মুদ্রিত হয় এই প্রেস থেকে। এই পর্যায়ের হিতকরী মশাররফ হোসেন ও রওশন আলী চৌধুরীর যৌথ উদ্যোগের ফসল কিনা তা মশাররফের ডায়েরি, কোহিনুর পত্রিকা কিংবা মথুরানাথ যন্ত্রের পত্র নকল খাতা – কোনো সূত্র থেকেই জানা যায় না। তবে মথুরানাথ যন্ত্রের ১৩০৭ সালের চিঠির নকল পুস্তক থেকে হিতকরী পত্রিকা সম্পর্কে অন্য বিষয়ের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়।

বাংলা ১৩০৭ সালের (১৯০০ খ্রি.) ৫ম বর্ষের হিতকরীও যে মথুরানাথ যন্ত্রেই মুদ্রিত হয়, এই চিঠির নকল পুস্তক থেকে তার প্রমাণ মেলে। ৫ম বর্ষের হিতকরী ১৩০৭ সালের বৈশাখ মাস থেকে প্রকাশিত হয়। কুমারখালীর বিশিষ্ট চিকিৎসক, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ও কবি নবদ্বীপচন্দ্র পাল হিতকরীর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁকে লেখা মথুরানাথ যন্ত্রের মুদ্রাকর কুঞ্জলাল দাসের চিঠি থেকে নবপর্যায়ে ৫ম বর্ষের হিতকরীর প্রকাশনা-প্রস্ত্ততির আভাস পাওয়া যায় :

হিতকরীর সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী মহাশয়ের সহিযুক্ত আদেশপত্র না পাইলে আমার মুদ্রাযন্ত্র হইতে হিতকরী ছাপাইতে গেলে আমাকে ‘প্রেস এক্ট’ অনুসারে দায়ী হইতে হইবে। অতএব নিবেদন অতঃপর হিতকরীর কাপি দিতে হইলে বা সংশোধন করিতে হইলে উপযুক্ত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর আবশ্যক। শ্রীযুক্ত জ্যোতিবাবু [জ্যোতিপ্রসাদ সান্যাল] সম্পাদক বা স্বত্বাধিকারী বলিয়া পরিচিত নহেন। অতএব তাঁহার দস্তখত আইনসঙ্গত নহে। যদি আমাকে তাঁহার দস্তখত গ্রহণ করিতে হয় তবে তাঁহাকে ঐরূপে পরিচিত হওয়া আবশ্যক। নতুবা এ প্রকার দায়ীত্বহীন পত্র ছাপাইয়া আমি বিপদগ্রস্ত হইব। এই ভয়ে আপনাকে সমস্ত জানাইলাম। সত্বরে বিহিত বিধান করিয়া বাধিত করিবেন। (১০ সংখ্যক চিঠি : ৮ বৈশাখ ১৩০৭)

এই চিঠি থেকে বেশ বোঝা যায়, নবদ্বীপচন্দ্র পাল বা জ্যোতিপ্রসাদ সান্যাল নন, তৃতীয় একজন হিতকরীর সম্পাদক ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন এবং তিনি মীর মশাররফ হোসেন।

১৩০৭ সালের ৩০ বৈশাখের এক পত্রে জ্যোতিপ্রসাদ সান্যালকে হিতকরীর সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে মনে হয়, ইতোমধ্যে তিনি হিতকরীর প্রকৃত স্বত্বাধিকারীর কাছ থেকে নিয়মমাফিক সম্পাদকের দায়িত্বপালনের অনুমতি লাভ করেছেন। এই চিঠিতে মুদ্রাকর কুঞ্জলাল দাস মথুরানাথ মুদ্রাযন্ত্রে হিতকরী পত্রিকা মুদ্রণে অপারগতার কথা জানিয়ে দেন (২৮ সংখ্যক চিঠি : ৩০ বৈশাখ ১৩০৭)। অবশ্য এর পরপরই একই তারিখে ছাপাখানার স্বত্বাধিকারী কাঙাল হরিনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র সতীশচন্দ্র মজুমদারের আরেকটি চিঠিতে ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। চিঠিতে জানা যায়, কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে ‘কতিপয় দুঃখজনক কথা শ্রুতিগোচর হওয়ায়; স্বত্বাধিকারী ও প্রেসের কর্ম্মচারীদের মনের আবেগহেতু ঐরূপ পত্র লিখিত হইয়াছিল’। পত্রিকার মূল প্রেসকপি ছাপাখানায় সংরক্ষণ প্রশ্নে প্রেস ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের মধ্যে একসময় মতভেদ দেখা দেয়। প্রেসের পক্ষ থেকে বিষয়টির সুরাহার জন্যে হরিনাথের দুই সাহিত্যশিষ্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও জলধর সেনের পরামর্শ ও নির্দেশনা চাওয়া হয়।

এই পর্যায়ে প্রকাশনার পঞ্চম বর্ষে, হিতকরী ১৩০৭ সালের শেষভাগ পর্যন্ত যে প্রকাশিত হয়েই ছিল তার প্রমাণ আছে এই চিঠির নকল পুস্তকে। এই খাতার কীটদষ্ট শেষ চিঠিটিও (ফাল্গুন ১৩০৭) হিতকরী-সম্পর্কিত। এখানে জ্যোতিপ্রসাদ সান্যালের পরিচয় মেলে হিতকরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে। একাধিক চিঠিতে স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক [দায়িত্বপ্রাপ্ত] যে ভিন্ন ব্যক্তি সেই উল্লেখ আছে। তবে পরের বছর অর্থাৎ ১৩০৮ সালেও হিতকরীর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল কিনা কোনো সূত্রেই তা জানার সুযোগ পাওয়া যায়নি।

পূর্ববর্তী সময়ে হিতকরী মুদ্রণের জন্যে মথুরানাথ যন্ত্রের         অর্থ-পাওনা ছিল মীর মশাররফ হোসেনের কাছে। কোহিনুর-সম্পাদক এস.কে.এম. রওশন আলীর বকেয়া আদায়ের জন্যে বারবার প্রেস থেকে তাগিদ-পত্র পাঠানো হয়, তারই একটিতে এর উল্লেখ মেলে। অসহিষ্ণু ও বিরক্ত প্রেস-পরিচালক কড়া ভাষায় জানান :

২৭/২৮ বৎসর প্রেসের কাজ হইতেছে, কিন্তু এ পর্য্যন্ত লোকের নামে নালিশ করিয়া টাকা আদায় করিতে হয় নাই। এক মীর মশাররফের সঙ্গে আর আপনার সঙ্গে করিতে হইতেছে, সে বোধ হয় এক জাতীয়তার স্বভাব।

(৬৪ সংখ্যক পত্র : ২২ আষাঢ় ১৩০৭)

খাস-তথ্য পাওয়া না গেলেও ১৩০৭ সালের পর হিতকরী প্রকাশের সম্ভাবনা নানা বিবেচনায় একেবারে নাকচ করা যায় না। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, ১২৯৭, ১২৯৮, ১২৯৯, ১৩০৬ ও ১৩০৭ – এই পাঁচ বছর হিতকরী চলেছিল, তবে তা বিরতিহীনভাবে নয়। কিন্তু ১৩০০ থেকে ১৩০৫ – এই ছয় বছর হিতকরীর প্রকাশ পুরোপুরি বন্ধ ছিল বা অনিয়মিত বের হতো কিনা সে-তথ্য অজ্ঞাত। এছাড়া এ-রহস্যেরও সমাধান হয়নি, হিতকরী পূর্বঘোষিত যৌথ সম্পাদনায় ‘খাঁটি নিখুঁত মুসলমানীভাবে’ না বেরিয়ে হিন্দু-সম্পাদকের তত্ত্বাবধানে কেন প্রকাশিত হয়েছিল! বেশ বোঝা যায়, হিতকরীর অন্তিম-পর্বে জীবন-জীবিকার সংকটে জর্জরিত মশাররফের পত্রিকা-বিষয়ে তেমন আগ্রহ-উৎসাহ বা কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল না, যদিও খাতা-কলমে তিনিই ছিলেন এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী।

 

সাত

হিতকরী উনিশ শতকের শেষ দশকের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা – স্বতন্ত্র চরিত্রের এবং ভিন্ন মেজাজের। জাতিবৈর-অসহিষ্ণু সমাজ-পরিবেশে হিতকরী নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও সম্প্রদায়-সম্প্রীতির মনোভাব নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। আর্থিক ক্ষতি, গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ, সামাজিক বিরূপতা স্বীকার করে নিয়েও পত্রিকাটি সামাজিক সংকট-সমস্যার প্রতিফলন, লোককল্যাণ ও জনমত-গঠনে প্রশংসাযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি মনোযোগী ও কর্তব্যনিষ্ঠ হয়েও, ভিন্ন সম্প্রদায়কেও যে আপন করা যায়, প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব – সে-কথাটি যেমন লেখক মীর মশাররফ হোসেন অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতেন, তেমনই তাঁর পত্রিকা হিতকরীও সেই মিলনের বার্তাই পূর্বাপর ঘোষণা করেছে।

হিতকরীতে মূলত স্থানীয়-জাতীয়-বিবিধ-বহির্বিশ্বের সংবাদ, পীড়িত মানুষের অভাব-অভিযোগের চিঠিপত্র, সম্পাদকীয় মন্তব্য ও উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ এবং কখনো কখনো-বা সাহিত্যধর্মী রচনাও প্রকাশিত হতো। এইসব রচনায় লেখকের নাম সাধারণত মুদ্রিত হতো না। তবে ভাষাভঙ্গি ও বিষয়-নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এই অস্বাক্ষরিত অনেক রচনারই যে লেখক ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন তা বেশ অনুমান করা চলে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে  এ-বিষয়ে পত্রিকার সহ-সম্পাদক রাইচরণ দাসের নামও এসে যায়। মশাররফ ছিলেন উদার মন ও মতের লেখক। স্বদেশ ও সমাজ সম্পর্কে গভীর মনোযোগের পরিচয় তাঁর অনেক লেখাতেই পাওয়া যায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর চরিত্রের আর-এক বিশেষ গুণ। তাঁর পরিচালিত পত্রিকায় সংগত কারণেই এইসব বৈশিষ্ট্যের সাক্ষাৎ মেলে। মশাররফের চিন্তা-চেতনা কীভাবে হিতকরী পত্রিকায় তাঁর নানা লেখা বা মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে সেই বিষয়টি বিশেষ অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে উদ্ঘাটন করেছেন মীর-গবেষক শামসুজ্জামান খান (‘মীর মশাররফ হোসেন : নতুন তথ্যে নতুন ভাষ্যে’, ঢাকা, ১৪১০)। সামগ্রিকভাবে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত নানা নিবন্ধ, সংবাদ বা সম্পাদকীয় মন্তব্যে বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি, দুর্দশা-দুঃখ, সমস্যা-অভিযোগ ও জীবন-জীবিকার নানা সংকটের পরিচয় প্রতিফলিত। হিতকরীর সূত্রে উনিশ শতকের অন্তিমপর্বের বাংলার সমাজ-অর্থনীতি-শিক্ষা-রাজনীতি-ধর্ম-ভাষা-সাহিত্যের অন্তরঙ্গ পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়।

 

আট

গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার আদলে-আদর্শে ও কাঙাল হরিনাথের প্রেরণায় মশাররফ হিতকরী প্রকাশ করেন। গ্রামের কাগজ গ্রামবার্ত্তা যথার্থই পল্লির জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ছিল। এই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে পল্লিবাসী এর অভাব গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। উত্তরকালে যেসব পত্র-পত্রিকা এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয়, তা গ্রামবার্ত্তার যথার্থ বিকল্প হতে পারেনি। মীর মশাররফের হিতকরী পত্রিকায় (২৬ আগস্ট ১৮৯১) ‘পল্লীবাসী প্রজা’র নামে প্রকাশিত একটি চিঠিতে একজন পত্রলেখক গ্রামবার্ত্তার সঙ্গে হিতকরীর তুলনা এবং এই পত্রিকার কাছে গ্রামীণ মানুষের দাবি ও প্রত্যাশার কথা জানিয়ে লিখেছেন :

আজ কয়েক বৎসর হইতে গ্রামবার্ত্তার কণ্ঠ নীরব হইয়াছে। গ্রামবার্ত্তার সতেজ লেখনী প্রভাবে এ অঞ্চলের পুলিশ, বিচারক, হাকিম, মিউনিসিপ্যাল কমিশনার, জমীদার প্রভৃতির অত্যাচার শান্তভাব ধারণ করিয়াছিল। গ্রামবার্ত্তার জীবন এই সমস্ত অত্যাচার কাহিনী প্রকাশ করিয়া অনেক সময় নানা বিপদে পড়িতে হইয়াছিল যে তাহার আর উল্লেখের প্রয়োজন নাই; এ প্রদেশের সকলেরই অন্তরে তাহা জাগরিত রহিয়াছে।… তাই আমাদের নিবেদন গ্রামবার্ত্তার কণ্ঠ নীরবের পর যখন হিতকারী অভ্যুদয় হইয়াছে; তখন আমরা পল্লীবাসী আমাদের দুঃখের কথা গ্রামবার্ত্তায় যেমন তীব্রভাবে আলোচিত হইয়া রাজার গোচর করিত, সেইরূপ আলোচিত হইয়া আমাদের দুঃখ দূর করিতে চেষ্টা করুন।… পূবের্ব যখনই দুঃখ পাইতাম তখনই গরীবের দুঃখের  দুঃখী, কান্নায় সমভাগী গ্রামবার্ত্তার দ্বারে গিয়া কতবার কাঁদিতাম। স্বকরুণ স্বরে আমাদের জন্যে কত কান্নাই সম্পাদক রাজার নিকট, জমীদারের নিকট কাঁদিয়াছেন; কিন্তু এখন কাহার কাছে যাইব?… গ্রামবার্ত্তার স্থানে আবার হিতকারীকে আমরা দেখিতে পাইয়া গ্রামবার্ত্তার অভাবকষ্ট ভুলিয়া যাইব।

নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও হিতকরী ‘পল্লীবাসী প্রজা’-সাধারণের প্রত্যাশা যে অনেকখানি পূরণ করতে পেরেছিল, তা কবুল করতেই হয়।

 

নয়

বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে – বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানের প্রয়াসের ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত-পরিচালিত আজীজন নেহার ও হিতকরী পত্রিকার বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। এই দুটি আঞ্চলিক পত্র কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, জনসচেতনতা সৃষ্টি ও গ্রামীণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় যে উদ্যোগ-গ্রহণ ও ভূমিকা-পালন করেছে, তা সমকাল ও উত্তরকালের কোনো কোনো পত্র-পত্রিকার আদর্শ ও প্রেরণা হতে পেরেছিল। নিরপেক্ষ ও সৎ-সাংবাদিকতা, লোককল্যাণের প্রয়াস, পল্লি-উন্নয়নের চিন্তা, সম্প্রদায়নির্বিশেষে সমদর্শী-দৃষ্টিভঙ্গি, প্রয়োজনবোধে সরকার-প্রশাসন-জমিদারের সমালোচনা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশে নির্ভীকতা আজীজন নেহার ও হিতকরী পত্রিকা ও এর স্বত্বাধিকারী-পরিচালক মীর মশাররফকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।

আজীজন নেহার ও হিতকরী দুটি পত্রিকাই এখন অতি দুষ্প্রাপ্য। যাঁরা সাময়িকপত্রের ইতিহাস রচনা করেছেন এবং মীর মশাররফ হোসেন সম্পর্কে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে একালে -একজন হিতকরী পত্রিকা দেখলেও, আজীজন নেহার দেখার সুযোগ-সৌভাগ্য তাঁদের হয়নি – এমন কী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়। আজীজন নেহার সম্পর্কে তাই আমাদের জ্ঞান মূলত সেকালের পত্রিকা-নির্ভর। তারই আলোকে এই পত্রিকার বৈশিষ্ট্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা কিছু ধারণা পাই : ক. সমাজহিতকামনা, খ. বাংলাভাষার প্রতি অনুরাগ, গ. হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি, ঘ. জাতীয়তা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার সংশোধন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় (আষাঢ় ১২৮১) এই পত্রিকার হিতকামী উদ্দেশ্যের প্রতি স্বাগত জানিয়ে বলা হয়, আজীজন নেহারের মাধ্যমে সমাজ-সমস্যার ‘কিছু না কিছু নিরাকৃত হইবে’, বিশেষ করে ‘তাহা মুসলমান সম্প্রদায়ের পক্ষে অতি উপাদেয় ফল বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে’। লেখক হিসেবে আবির্ভাবের সূচনাতেই মশাররফ ‘বিশুদ্ধ বাঙ্গালাভাষা’-চর্চার জন্যে হিন্দু-পরিচালিত পত্র-পত্রিকার যে-প্রশংসা ও অভিনন্দন লাভ করেছিলেন, সম্পাদিত প্রথম পত্রিকার ক্ষেত্রেও সেই একই স্বীকৃতি জুটেছিল। আজীজন নেহার পত্রিকার ভাষা সম্পর্কে গ্রামবার্ত্তা (আষাঢ় ১২৮১) উল্লেখ করেছিল : ‘ভাষা অতি মনোরম। মুসলমান লিখিত বলিয়া মনে হয় না, এমন কি অনেক আধুনিক হিন্দু লেখকের লিপি-চাতুর্য্যকে ইহার নিকট বলিদান দিতে পরামর্শ দি’। এডুকেশন গেজেটের (১ মে ১৮৭৪) এক পত্রলেখক বাঙালি মুসলমান ‘মধুময় বাঙ্গলা ভাষার যথার্থ স্বাদগ্রহণে সমর্থ হইয়াছেন’ – এই দেখে উৎফুল্ল হয়েছেন। ওই পত্রিকাতেই (৮ মে ১৮৭৪) আবার বলা হয়, মুসলমান-পরিচালিত হলেও ভাষায় ‘মুসলমানি বাঙ্গালার নামগন্ধ নাই, বিশুদ্ধ বাঙ্গালার রীতিতে লিখিত’। সোমপ্রকাশও (১৮ মে ১৮৭৪) একই সুরে বলেছে : ‘ইহার ভাষা অনেক বিজ্ঞ বিজ্ঞ সম্পাদকের ভাষার অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট’। মশাররফ বরাবর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যের পক্ষে ছিলেন – সাহিত্যের মতো সাময়িকপত্র-পরিচালনাতেও। আজীজন নেহার মুসলমান-পরিচালিত পত্রিকা হলেও এতে হিন্দু সম্প্রদায়েরও যোগ ও সম্পর্ক ছিল। সাধারণীর (৮ জুন ১৮৭৪) সূত্রে জানা যায় : ‘আজিজন নেহারে দুইজন বাঙ্গালী হিন্দু লেখকও এজেন্ট বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন’। দ্বিতীয় পত্রিকা হিতকরী পরিচালনায় হিন্দুসমাজের সম্পৃক্ততা ছিল আরো বেশি।

দুষ্প্রাপ্য বলে আজীজন নেহারের কোনো রচনার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ আজকের দিনের পাঠকের নেই। শুধু সামান্য একটু অংশই রক্ষা পেয়েছে এডুকেশন গেজেটের (১১ ডিসেম্বর ১৮৭৪) কল্যাণে – ‘এ দেশের মুসলমানেরাও বাঙ্গালী’ শীর্ষক নিবন্ধে আজীজন নেহারের একটি রচনার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করার ফলে। রচনাংশটি বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার প্রশ্নে নেতিবাচক মনোভাব ও প্রচলিত সংস্কারের বিপক্ষে এক সাহসী ও নির্ভুল সিদ্ধান্তের স্বাক্ষর হিসেবে গ্রাহ্য হওয়ার যোগ্য :

আমরা মুক্তকণ্ঠে সংবাদপত্রে স্বীকার করিয়াছি, আমরা বাঙ্গালী, বাঙ্গালা আমাদের মাতৃভাষা, আমরা কি আমাদের অবমাননা করিয়াছি? কোন দেশে পুরুষানুক্রমে বাস করিয়া তদ্দেশীয় বলিয়া পরিচয় দেওয়া দেশীয় ভাষা ব্যবহার করা অবমাননার বিষয় নহে; পরন্তু বীর্য্যবান দেশাদি মাতৃভূমি ভাণ করিয়া তাহাদের বিকৃতিপ্রাপ্ত ভাষা ব্যবহার করা উপহাস-সঞ্চারক। ইহাও অল্প রহস্যের বিষয় নহে, প্রকৃত মাতৃভূমির প্রতি ঘৃণা করিয়া পশ্চিমদিক্বাসী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিলে গৌরব বিবেচনা করি।… যাহা হউক, আমরা বাঙ্গালী বলাতে আমাদের অবমাননা হয় নাই…।

একশ একচল্লিশ বছর আগে স্বদেশ-মাতৃভাষা-জাতীয়তার প্রশ্নে বিভ্রান্ত রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান সমাজের কোনো প্রতিনিধির কণ্ঠে এমন প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় বলে মনে হবে। এদিক দিয়ে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে মশাররফকে বাংলার ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রবক্তা বলে স্মরণ করতে হয়। উত্তরকালে মশাররফ তাঁর পরিচালিত পত্রিকা হিতকরী এবং সাহিত্যচর্চায় সম্প্রদায়-সম্প্রীতি, সমাজমনস্কতা, দেশ ও ভাষাপ্রীতির প্রশ্নে আরো প্রাজ্ঞ ও পরিণত হয়েছেন – বোধ-বিশ্বাস-চেতনায় আরো দৃঢ় হয়েছেন। নিবিড় পর্যালোচনায় এই নিরিখে বলা যায়, এসবকিছুর মূলে তাঁর প্রধান ও প্রথম ঋণ বোধহয় তাঁর পরিচালিত সাময়িকপত্রের কাছে। r

 

 

আল মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী

চৌধুরী শাহজাহান

 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি ও কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের সময় দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। এই আন্দোলনকে নিয়ে তিনি চার লাইনের একটি কবিতা লিখে পুলিশি হয়রানির শিকার হন। গ্রেফতার এড়াতে তিনি দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পালিয়ে বেড়ান। এ-কারণেই তাঁর অ্যাকাডেমিক শিক্ষার তেমন অগ্রগতি ঘটাতে পারেননি। আল মাহমুদের প্রথম দিকের কবিতা মূলত প্রেম, দেশপ্রেম ও প্রকৃতি নিয়ে রচিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতার মূল বক্তব্য সৌন্দর্যের আদি কারণ অনুসন্ধান ও আধ্যাত্মিকতা। আল মাহমুদের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে লোক লোকান্তর (১৩৭০), কালের কলস (১৩৭৩), সোনালী কাবিন (১৯৭৩), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), পাখির কাছে ফুলের কাছে (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫), আরব্য রজনীর রাজহাঁস (১৯৮৭), প্রহরান্তের পাশফেরা (১৯৮৮), এক চক্ষু হরিণ (১৯৮৯), মিথ্যাবাদী রাখাল (১৯৯৩), আমি দূরগামী (১৯৯৪), হৃদয়পুর (১৯৯৫), দোয়েল ও দয়িতা (১৯৯৭), দ্বিতীয় ভাঙন (২০০০), নদীর ভিতরে নদী (২০০১), পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫), সৌরভের কাছে পরাজিত (১৯৮২), গন্ধবণিক (১৯৮৮), ডাহুকী, কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, কবি ও কোলাহল, মরু মূষিকের উপত্যকা, রিপু, যে পারো ভুলিয়ে দাও, আগুনের মেয়ে, পুরুষ সুন্দর, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.), যেভাবে বেড়ে উঠি, দিনযাপন, কবির আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার মধ্যে লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, পানকৌড়ির রক্ত ও সৌরভের কাছে পরাজিত গ্রন্থে আল মাহমুদের মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।

আল মাহমুদ নারীকে তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে খুঁজে নিয়েছেন। যৌনতা-বিষয়ে আল মাহমুদের কোনো জড়তা নেই। তিনি এ-প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি অজু করে সাহিত্য রচনা করি না। পুরুষ মানুষ হিসেবে যা দেখেছি তাই লিখেছি। তার মানে এই নয় যে, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে নগ্নতা বা অশ্লীলতাকে জড়িয়ে লিখেছি। বাস্তব অর্থে মানবজীবন যেমন, তার আচরণ যেমন, তার সম্বন্ধসূত্র যেমন, তার যৌনতা যেমন, সবগুলি নিয়েই সাহিত্য হয়।’ তিনি নারীকে কেবল যৌন-সহচরী হিসেবে দেখেননি; কঠিন, কঠোর বাস্তবতায় কামনা করেছেন যৌথ আনন্দ-বেদনার অংশীদার হিসেবে। আল মাহমুদের নারী যৌনগন্ধময় ও সংগ্রামশীল। নারীর শরীরে তিনি খুঁজে পান কবিতার অকৃত্রিম অনুপ্রেরণা। নারীর দৈহিক সৌন্দর্য কখনো কখনো আল মাহমুদকে প্রবলভাবে কাতর করে। নারীর সৌন্দর্যকে কবি অনুভব এবং উপভোগ করতে চান। নারীর রূপ বর্ণনায় আল মাহমুদ দ্বিধাহীন। নারীদেহের একটি বিশেষ অঙ্গের বর্ণনায় তিনি চমৎকার উপমার সৃষ্টি করেছেন। যেমন –

ক.

আর ভাবি তোমার বসনহীন বুকের উপমা হওয়ার জন্যই

আজ পৃথিবীর এই পর্বতশিরায় বরফ জমছে।

(‘ঘৃণার পালঙ্কে’, মিথ্যাবাদী রাখাল)

খ.

জানি না কিভাবে এই মধ্যযামে আমার সর্বস্ব নিয়ে আমি

ঘরে যাই দুটি চোখ, যেন জোড়া যমজ ভ্রমর পাশাপাশি

বসে আছে ঈষদুষ্ণ মাংসের ওপর।

(‘অবগাহনের শব্দ’, সোনালী কাবিন)

গ.

আবার পুরনো দৃশ্যে ফিরে গিয়ে দেখি;

সমস্ত বোতাম খোলা, শিশুর মুখের কাছে

ফলভারে সুঠাম কামনা। শিয়রে রেহেলে রাখা

আল্লার আদেশ। বাতিদানে আচ্ছাদিত ময়ূরপুচ্ছের প্রায় মোমের

আগুন।

(‘শিল্পের ফলক’, লোক লোকান্তর)

 

আল মাহমুদ ‘আমি ও আমার কবিতা’ প্রবন্ধে তাঁর কবিতার বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, ‘আমার কবিতার প্রধান বিষয় হলো নারী। আমি এক সময় ভাবতাম একজন কবি-পুরুষের কাছে নারীর চেয়ে সুন্দর আর কে আছে? না, কিছু নেই। পৃথিবীতে যত জাতির কবিতায় যত উপমা আছে আমি আমার সাধ্যমতো পরীক্ষা করে দেখেছি, সবই নারীর সঙ্গে তুলনা করেই। দয়িতার দেহের উপমা দিতে কবিরা পৃথিবী নামক এই গ্রহটাকে চষে ফেলেছেন। এমন নদী, পর্বত বা প্রান্তর নেই, যার সঙ্গে কবিরা তাঁদের প্রেমিকার স্তন, ঊরু, অলকদাম বা নিতম্বের তুলনা দেননি। এভাবেই মানুষ তার প্রিয় মানবীর রহস্য ও রূপের সঙ্গে প্রকৃতির রহস্য ও সৌন্দর্যের সম্মিলন ঘটিয়েছেন এবং প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে উপনীত হয়েছেন আধ্যাত্মিকতায়, ধর্মে। আমার কবিতার আরেক প্রধান বিষয় হলো প্রকৃতি। আমি নিসর্গরাজি অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে এমন একটা সংগুপ্ত প্রেমের মঙ্গলময় ষড়যন্ত্র দেখতে পাই, যা আমাকে জগৎ-রহস্যের কার্যকারণের কথা ভাবায়। একঝাঁক পাখি যখন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে পতঙ্গ ও পিঁপড়ের সারি আর মৌমাছিরা ফুল থেকে ফুলে মধু শুষে ফিরতে থাকে, আমি তখন এই আয়োজনকে সুন্দরই বলি না বরং অন্তরালবর্তী এক গভীর প্রেমময় রমণ ও প্রজননক্রিয়ার নিঃশব্দ উত্তেজনা দেখে পুলকে শিহরিত হই। মনে আদিম মানুষের মতো অতিশয় প্রাথমিক এক দার্শনিক জিজ্ঞাসা জাগে – কে তুমি আয়োজক? তুমিও কবি? না কবিরও নির্মাতা? তবে তুমি যে অনিঃশেষ সুন্দর আমি তার সাক্ষ্য দিচ্ছি। আমার সাক্ষ্য গ্রহণ করো প্রভু। এভাবেই আমি ধর্মে এবং ধর্মের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ বীজমন্ত্র পবিত্র কোরানে এসে উপনীত হয়েছি।’ কবির উপরোক্ত স্বীকারোক্তি থেকে পাঠকরা অতি সহজেই আল মাহমুদের কবি-আত্মা ও কাব্যবিশ্বাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন।

(উপমা, আল মাহমুদ সংখ্যা, মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন)

আল মাহমুদ জীবনের প্রথম দিকে মার্কসবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। মার্কসবাদী চিন্তাচেতনা বা শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি মুখে মার্কসবাদের কথা বললেও বাস্তবে মার্কসবাদী ছিলেন না। ১৯৭৪ সালে জাসদ-সমর্থিত দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক হলে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে তিনি গ্রেফতার হন। জেলে থাকাকালীন তাঁর জীবনাদর্শের পরিবর্তন হয়। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনা বাদ দিয়ে ধর্মকেন্দ্রিক জীবনাদর্শে নিমগ্ন হন। এ-সময়ের ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এদেশে একটা র‌্যাডিক্যাল সংবাদপত্র সম্পাদনা করতে গেলে যা হয়, আমার ভাগ্যেও তাই ঘটলো। অর্থাৎ বিনা কারণে আমার জেল হয়ে গেল। আমি এক বছর বিনা বিচারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক থাকার সময় হঠাৎ আমার পিতার আদেশ পালনের সুযোগ পাই। অর্থাৎ একখন্ড পবিত্র কুরআন আমার স্ত্রী আমাকে জেলখানায় দিয়ে এলে আমি তা অর্থসহ আদ্যোপান্ত পাঠ করা শুরু করি। আর প্রথম পাঠেই আমার শরীর কেঁপে ওঠে। এর আগে কোনো গ্রন্থ পাঠে আমার মধ্যে এমন ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়নি। যেন এক অলৌকিক নির্দেশে আমার মস্তক মাটিতে গুটিয়ে পড়ে।’ আল মাহমুদ চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ               মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো থেকে মার্কসবাদী দর্শন ত্যাগ করে আল কোরান দ্বারা প্রভাবিত হন। সোনালী কাবিন পর্যায়ে তাঁর কবিভাবনা ছিল এরকম :

কিছুই থাকে না কেন? কারোগেট, ছন কিংবা মাটির দেয়াল

গাঁয়ের অয় বট উপড়ে যায় চাটগাঁর দারুণ তুফানে

চিড় খায় পলেস্তারা, বিশ্বাসের মতন বিশাল

হুড়মুড় শব্দে অবশেষে

ধসে পড়ে আমাদের পাড়ার মসজিদ।

(‘বাতাসের ফেনা’, সোনালী কাবিন)

মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো কাব্যগ্রন্থে সেই ধসে পড়া পাড়ার মসজিদটি বিধ্বস্ত হয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিতে –

তবু আমার মনে হলো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কাত হয়ে পড়া

গম্বুজটিই বুঝিবা খানিকটা উঁচু হয়ে আছে।

(‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)

আল মাহমুদ সোনালী কাবিন কাব্যে যে-মসজিদকে ভেঙে যেতে দেখেছিলেন, মতাদর্শের পরিবর্তনের কারণে তাঁর কাছে মনে হচ্ছে মসজিদের গম্বুজটি ‘খানিকটা উঁচু’ হয়ে আছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিবর্তন এভাবে তাঁর চিন্তাচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল বদলে দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত আল মাহমুদ প্রথম দিকে লিখেন :

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়েছে হাত

হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,

এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত

তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।

আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন

পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,

(‘সোনালী কাবিন ১০’, সোনালী কাবিন)

ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতিক অবস্থান বদলের পর কবি আল মাহমুদ কবিতা লিখেন এভাবে –

মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে

মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;

আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।

…             …               …

আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা

মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।

(‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, বখতিয়ারের ঘোড়া)

আল মাহমুদ প্রচলিত শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে ঘোষণা করেন : ‘ইসলামকে আমি গ্রহণ করেছি আমার জীবনের সকল সমস্যার সমাধান হিসেবে।’ তাঁর মনে প্রবল ধারণা জন্মেছে যে, একমাত্র ইসলামই পারে রাষ্ট্রের সকল সমস্যার সমাধান করতে। খাঁটি মুসলমানের মতো তাই তো তিনি একজন ইমামের অনুসন্ধান করেন। তিনি লিখেন –

চলো অপেক্ষা করি সেই ইমামের

যিনি নীল মসজিদের মিনার থেকে নেমে আসবেন

মেশকের সুরভি ছড়িয়ে পড়বে

পৃথিবীর দুঃসহ বস্তিতে।

(‘নীল মসজিদের ইমাম’, বখতিয়ারের ঘোড়া)

কমরুদ্দিন আহমদ (জ. ১৯৬৫) একজন কবি ও গবেষক। আশির দশক থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। এ পর্যন্ত তিনি ছয়টি গ্রন্থের জনক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো – শহর ছেড়েই যাবো (২০০৬), সবুজ সুখের পুলক (২০০৭), বিষাদের ভাসানে জলজ ঘাতক (২০০৯), আধুনিক কবিতা : প্রাসঙ্গিক বিবেচনা (২০১১), হৃদয় শঙ্খ তীরে (২০১৩) এবং এ-বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধগ্রন্থ আল মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী (২০১৫)। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থ শেষেরটি। এ-গ্রন্থে গবেষক কমরুদ্দিন আহমদ আল মাহমুদের সমগ্র সাহিত্যকর্মের আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি বিষয়ক্রম সাজিয়েছেন এভাবে – আবহমান বাংলাকাব্যে আল মাহমুদ, সোনালী কাবিন : জৈবিক সংকটের শিল্পরূপ, আল মাহমুদের ছন্দ ও উপমা, আল মাহমুদের কবিতায় কাহিনিকাব্যের খন্ড-আস্বাদ, আল মাহমুদ : ব্যতিক্রমী ছড়াশিল্পী, আল মাহমুদের উপন্যাস : নরনারীর বিচিত্র হৃদ্যতার সাতকাহন, ডাহুকী সমাজস্বীকৃত প্রেমের জয়গান, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস উপমহাদেশ, পারিবারিক উপন্যাস অর্ধেক মানবী, কাবিলের বোন দ্বান্দ্বিক জটিলতায় বৈধতার বন্ধন, আল মাহমুদের ছোটগল্প, প্রাবন্ধিক আল মাহমুদ, আল মাহমুদের কবিতায় নন্দনতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি ও আল মাহমুদের কবিতায় মিথের ব্যবহার। নিম্নে কমরুদ্দিন আহমদের কয়েকটি প্রবন্ধের আলোচনার প্রয়াস পাব।  সোনালী কাবিন : জৈবিক সংকটের শিল্পরূপ এই শিরোনামে তিনি আল মাহমুদের সোনালী কাবিন কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতার আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আবহমান বাংলার বাঙালির জীবন-যাপন, মৃত্যুর সীমারেখাকে অতিক্রম করে ভাষা আর ‘প্রেমময় কাব্যে’র শপথের নান্দনিকতায় পাঠকচিত্তকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে যায়, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন।… লোক লোকান্তর ও কালের কলসে দেখেছি কবির ব্যক্তিগত আত্মিক সংকট। সোনালী কাবিনে এসে প্রাধান্য পেয়েছে জৈবিক সংকট। সোনালী কাবিনের পূর্বে প্রাতিস্বিকতাকে ছুঁতে পারেননি কবি। তখন কবির প্রধান ভর ছিল কল্পনা, প্রতিভা এবং অনন্য কাব্যভঙ্গির ওপর। সোনালী কাবিনে এসে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক ভাষারীতির ধরন। আঞ্চলিক ভাষারীতির মিশ্রণ আল মাহমুদের কবিতাকে শুধু অভিনব করেনি, বাংলা কবিতায় আধুনিকতাকে তিরিশি কবিতার পর বহুদূর প্রসারিত করে দিয়েছে। এখানে এসে জীবনানন্দের পর আল মাহমুদও পরবর্তী কবিদের কবি হয়ে উঠেছেন।’ (পৃ ৩১ ও ৩৩)।

আল মাহমুদ ছড়া-সাহিত্যে উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ছড়া ও কবিতাকে তিনি আলাদাভাবে দেখতে নারাজ। কাব্যজীবনের প্রথম দিকে রচিত পাখির কাছে ফুলের কাছে গ্রন্থটিকে ছড়ার বই বললেও পরবর্তীকালে আলাদাভাবে কোনো ছড়াগ্রন্থ রচনা করেননি। বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে ছড়াজাতীয় রচনাগুলো স্থান পেয়েছে। আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, এক চক্ষু হরিণ, বারুদগন্ধী মানুষের দেশ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে তাঁর ছড়া-কবিতাগুলো স্থান পেয়েছে। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন কবি লেখেন ‘৩-সংখ্যক সনেট’।

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক।

কোথায় পাবে মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে।

তোরাই তবে সোনা মানিক/ আগুন জ্বেলে দে।

(‘ঊনসত্তরের ছড়া-১’, পাখির কাছে ফুলের কাছে)

আল মাহমুদ শিশুদের উপযোগী কিছু উল্লেখযোগ্য ছড়া লিখেছেন। এই ছড়াগুলোতে কবির শিশুমনের অভিব্যক্তি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন –

ক.

আম্মা বলেন পড়রে সোনা/ আববা বলেন মন দে

পাঠে আমার মন বসে না/ কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।

আমার কেবল ইচ্ছে জাগে/ নদীর কাছে থাকতে।

বকুলডালে লুকিয়ে থেকে/ পাখির মতো ডাকতে।

(‘পাখির মতো’, পাখির কাছে ফুলের কাছে)

খ.

একটা ছেলে এই ছেলেটা/ নখ ভরা তার মাটি

ময়লা হাতে খায় সে খাবার/ ধরে দুধের বাটি।

মাছি ভন ভন মাছি ভন ভন/ সর্দি-ভরা নাক

নাকের উপর পড়ছে মাছি/ যেন কাকের ঝাঁক।

এই ছেলে আর এই মেয়েটার/ অসুখ থাকে রোজ,

ঘণ্টা ধরে গিলছে বড়ি/ বোতল ভরা ডোজ।

(‘বাঁচার জন্য’, এক চক্ষু হরিণ)

আল মাহমুদ কাব্যচর্চার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাসও রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো – যেভাবে বেড়ে উঠি, কাবিলের বোন, নিশিন্দা রানী, উপমহাদেশ, অর্ধেক মানবী, ডাহুকী, আগুনের মেয়ে, কবি ও কোলাহল ইত্যাদি। গবেষক কমরুদ্দিন কিছু উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্ব, নর-নারীর প্রেমভাবনা, যৌন-ঈর্ষা, সামাজিকতাবোধ ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি আল মাহমুদের গল্প নিয়ে বিশদ কোনো বিশ্লেষণে যাননি। অথচ আল মাহমুদ একজন সফল গল্পকার। তাঁর তিনটি অসাধারণ গল্প হচ্ছে – ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘জলবেশ্যা’ ও ‘মীরবাড়ির কুরসীনামা’। নন্দনতত্ত্ব ও দেশজ সংস্কৃতি, লোকায়ত বিশ্বাস, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও মানুষ, দার্শনিকতার সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় সাধন তাঁর কবিতায় যেভাবে এসেছে, অন্য কারো কবিতায় সেভাবে আসেনি। তাঁর কবিতায় বাঙালির আবহমান কালের ইতিহাস মুদ্রিত হয়েছে। নারী, নারীর শরীরী কাম ও যৌনতা, প্রেম মিলেমিশে তাঁর কবিতার শরীর গঠিত। তিনি লেখেন –

ক.

শুরু হোক স্তোত্রপাঠ গন্ধবতী তোমার সুনামে,

পীতাভ ধোঁয়ার তলে ডুবে থাক মন্দির-দেহলি,

শঙ্খমাজা স্তন দুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি,

লজ্জায় বিবর্ণ মন ঢেকে যাবে ক্রিসেনথিমামে –

অথবা রক্তের নাচ শুরু হবে সিম্ফনির সুর

বৃষ্টির শব্দের মতো মনে হবে তোমার নূপুর।

(‘সিম্ফনি’, লোক লোকান্তর)

খ.

চরের মাটির মতো খুলে দাও শরীরের ভাঁজ

উগোল মাছের মাংস তৃপ্ত হোক তোমার কাদায়,

ঠোঁটের এ-লাক্ষারসে সিক্ত করে নর্ম কারুকাজ

দ্রুত ডুবে যাই এসো, ঘূর্ণমান রক্তের ধাঁধায়।

(‘৩-সংখ্যক সনেট’, সোনালী কাবিন)

 

আল মাহমুদকে নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকে গবেষণা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ইয়াহইয়া মান্নান দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রথমটি আল মাহমুদ ও বিচিত্র অনুষঙ্গ এবং দ্বিতীয়টি আল মাহমুদের উপন্যাস বিষয় চিন্তা। কাজলেন্দু দে রচনা করেন আল মাহমুদের কবিকৃতি নামক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। তারপর ফজলুল হক তুহিন রচনা করেন আল মাহমুদের কবিতা বিষয় ও শিল্পরূপ। সর্বশেষ আমরা পেলাম কবি ও প্রাবন্ধিক কমরুদ্দিন আহমদ-রচিত আল মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে। আল মাহমুদকে নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো হয়নি। গত ১১ জুলাই আল মাহমুদ আশি বছরে পদার্পণ করেছেন। কবি আল মাহমুদ সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। আমরা আশা করি, আগামী দিনগুলোতে তিনি আমাদের আরো অনেক ভালো ভালো সাহিত্য-রচনা উপহার দেবেন। r

 

 

 

 

তিলোত্তমা মজুমদারের আটটি উপন্যাস :

একটি ভূমিকা

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

 

 

নববইয়ের দশকে যে-কজন লেখকের আবির্ভাব ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-অঙ্গনে তাঁদের অনেকেই তুবড়ির বর্ণচ্ছটা দেখিয়ে, প্রভূত ধূম উদ্গিরণ করে কিয়ৎকালের মধ্যেই নির্বাপিত হলেও, তিলোত্তমা মজুমদার পাঠকের মধ্যে বিগত দুই দশক ধরে থেকে গেলেন। এর একটি বড় কারণ এই যে, তিলোত্তমার সৃজনের নতুন ভাষা, আধুনিক মানবমনের গভীর পরিজ্ঞান। আধুনিক মধ্যবিত্ত নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক-কাঙ্ক্ষা-যৌনতা শতাব্দীপ্রাচীন সংস্কার ছিঁড়ে-খুঁড়ে, সমস্ত চাপান আড়াল ভেঙে বেরিয়ে এলো যেন!

তিলোত্তমা প্রধানত ঔপন্যাসিক কিন্তু ছোটগল্প, কবিতাও অসামান্য। আমাদের আজকের আলোচনা তাঁর অদ্যাবধি প্রকাশিত সতেরোটি উপন্যাসের আটটি নিয়ে।

হ্যাঁ, তিলোত্তমা তাঁর ঋ, চাঁদের গায়ে চাঁদ, বসুধারা, শামুকখোল, প্রহাণ, জর্মের চোখ, একতারা, রাজপাট ইত্যাদি উপন্যাসে নিয়ে এলেন নতুন ভাষা।     যে-সযত্ননির্মিত গদ্যে অবলীলায় মিশে গেল প্রাচীন ‘আমাতে’, ‘তোমাতে’, ‘নাই’ ইত্যাকার প্রকাশভঙ্গি – ‘তা এই হলো যে মানুষের বিবিধ অবস্থা। পুরাণ-তত্ত্ব-গপ্পো। যুক্তি নাই। তর্ক থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু যুক্তি নাই। তোমার যেমন তিনটা চোখ নাই, আমার যেমন চারখান পা নাই। তেমন-তেমন, মানুষের কোনও যুক্তি নাই।’ (চাঁদের গায়ে চাঁদ) এবং এই গদ্য দর্শনঋদ্ধ। তিলোত্তমার উপন্যাসে যা হয়ে উঠেছে গভীরতা প্রকাশের অমোঘ একাঘ্নী।

ছেলের মা তাকে ‘স্বদেশি আন্দোলন’ থেকে ফেরাতে ঠাকুরঘরে ডেকে রাধারঞ্জনকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করাতে চাইছেন। ছেলে তাঁর কথা না শুনলে তিনি আত্মঘাতী হবেন। শুরু করেছেন পিলসুজ দিয়ে কপালে ক্রমাগত আঘাত। সেই সংকটকালের বর্ণনা – ‘কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন রাধারঞ্জন। তারপর অন্ধকারে জড়িয়ে ধরলেন মাকে। পিলসুজ কেড়ে নিতে চাইলেন। কিন্তু কাজটি বড় সহজ ছিল না। প্রার্থনা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় দয়াময়ীর ব্যক্তিত্বে হঠাৎ টান পড়েছিল। তিনি ধৈর্য হারিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে বাসা নিয়েছিল আত্মবিস্মরণ। এবং কে না জানে, আত্মবিস্তৃত হলেই মানুষ অতিমানুষতাপ্রাপ্ত হয়, কিংবা অবমানুষতা। তখন নিশ্চিহ্ন বোধের ঘরে ফুল দিতে হয় কারওকে। সে কর্মেই প্রয়াসী হলেন রাধারঞ্জন। পিলসুজটি কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন দিগ্ভ্রষ্ট অন্ধকারে। শব্দ করে ভেঙে পড়ল দেবতার পট। পিলসুজটি কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিল নিজের মতো।’ (ঋ)

বর্ণনাটি পড়ামাত্র স্মৃতিধার্য হয়ে যায় – ‘তখন নিশ্চিহ্ন বোধের ঘরে ফুল দিতে হয় কারওকে’ – বাক্যটি। আরো আছে লেখিকার এই প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে। বিনতা সন্তানসম্ভবা। তার স্বামী শেখর সন্দিহান – ‘এই বাচ্চার বাবা কে? বলো বলো। এর বাবা কে?’ এর পরে বিনতার যুক্তিবাদী মনের ছবি – ‘সাতদিন ধরে বিনতা কিছু খেতে পারল না। চুল বাঁধল না। সিঁদুর দিল না কপালে। তার কখনও ঘৃণা হল, কখনও বড় অপমানে ভিজে উঠল চোখ। কখনও ভীষণ রাগে মরে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু একটিবারও সে শেখরের পায়ে পড়ল না। ঈশ্বরের নামে শপথ নিল না। একটিবারও কেঁদে কেঁদে বলতে পারল না – ওগো! বিশ্বাস করো – বরং সে ভাবতে থাকল – কী আশ্চর্য! যারা পিতৃত্ব বহন করে, যাদের পরিচয় নিয়ে ঘটে যেতে পারে জন্মান্তর, তাদের আসলে বোঝার কোনো ক্ষমতাই নেই, সন্তান প্রকৃতই তার নিজের কিনা। এখানে শুধুই অনিবার্য বিশ্বাসের দাবি। এবং এই বিশ্বাস কত সহজেই ভেঙে ফেলা যায়…।’ এমত দার্শনিকতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটতে থাকে বিনতা-নাম্নী নারীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তার নরম সুবেদী মনের সমান্তরালে উন্মোচিত হয় চরিত্রের দার্ঢ্য। প্রকাশিত হয় তার আর শেখরের সম্পর্কের অচেনা স্তর, যা নাকি বিনতা সন্তানসম্ভবা না হলে বোঝাই যেত না!

আবার কোনো ব্যক্তি নয়, রাস্তার চরিত্র। বিকশিত হয় তিলোত্তমার নিজস্ব দৃষ্টিতে, তাঁর গদ্যের মায়াঅঞ্জনে – ‘অন্ধও ঘুমোয়নি। মাস্টারও না। জেগে আছে যে-যার মতো। ফটিকবিল বস্তিতে দু’টি মাত্র জাগ্রত মানুষ। বাকি সব ঘুমন্ত। সারা বস্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনকি ঘুমিয়ে পড়েছে মাছেরাও। বিলের জলের নীচে যথার্থ বাসস্থানে। শুধু কোনোদিন ঘুমোবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে জেগে আছে পি ডব্লু ডি রোড। রেললাইন তবুও ঘুমোয়। একটা ট্রেন যাবার পর আরও একটা আসার আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয় সে। অল্প অল্প ঘুমিয়েও কি পড়ে না? অন্তত এটুকু তো সে জানে – একটি রেল চলে গেলেই আর একটি সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে তার ঘাড়ে এসে চড়বে না! রাস্তার সে-সুযোগ নেই। তাকে কেউ ঘুমোতে দেবে না। তাই ঘুমোনোর ইচ্ছেই সে ত্যাগ করেছে। একমাত্র ধর্মঘটের প্রতীক্ষা। ধর্মঘট হলে পুলিশের গাড়ি ছাড়া আর কোনও গাড়ি সইতে হয় না তাকে। কিন্তু বরাহনগরের সব রাস্তা জানে – পুলিশের গাড়ির ওজন দুর্বহ।’ (বসুধারা)

এমন আপাত-নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কবিতাঘন গদ্যে পরিপার্শ্ব, চরিত্রের গভীর মনের কথা প্রকাশ করার আয়োজন দেখি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চাঁদের অমাবস্যায় – ‘দুপুরবেলায় ইস্কুলের বিশ্রামঘরে আত্মপ্রবঞ্চনার কথাটি যুবক শিক্ষক সর্বপ্রথম আপন-মনে স্বীকার করে। বস্ত্তত, স্বীকার করতে সে বাধ্য হয়। সর্বপ্রকার চেষ্টার শেষ হয়েছে, কি করে তার ক’দিনব্যাপী মানসিক বিহবলতার সত্য কারণ নিজের কাছে আর ঢেকে রাখে? সঙ্গে সঙ্গে যে-ন্যায়বানের শ্বেতসৌধ সে সৃষ্টি করেছিল তা নিমেষে ধূলিসাৎ হয়। নিজের কাছেই সে নিজে ধরা পড়েছে অবশেষে : কোথাও আর একটি প্রাচীর দাঁড়িয়ে নাই যার পশ্চাতে সে আত্মগোপন করতে পারে।’

অথবা – ‘অকস্মাৎ মুস্তফার প্রবল জ্বর শুরু হয়। তবারক ভুইঞা পূর্ণ-উদ্যমে জ্বরাক্রান্ত নিঃসঙ্গ মুহাম্মদ মুস্তফার সেবা-শ্রুশ্রূষায় লেগে যায়। একদিন রাতে মুহাম্মদ মুস্তফা দেখতে পায় তবারক ভুইঞা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সহসা সে একটি কণ্ঠস্বরও শুনতে পায়। তবে সে বুঝতে পারে, কণ্ঠস্বরটি তবারক ভুইঞার নয়, নিজেরই কণ্ঠস্বর। অকারণেই সে যেন চমকিত হয়ে পড়ে, অকারণে এ-জন্যে যে নিজের কণ্ঠস্বর শুনলে চমকিত হবার কোনো যথার্থ কারণ নেই। তারপর ঘরময় সহসা নীরবতা নাবে। অনেকক্ষণ সে-নীরবতা জমাট হয়ে থাকে, যে-নীরবতার মধ্যে বাইরে কোথাও বিদ্যুৎগতিতে চক্কর দিতে থাকা একটি বাদুড়ের আবির্ভাব হলে সে-বাদুড়ের শব্দ, পরে দূরে কোথাও একটি বিড়াল-ছানা ক্ষীণ-কাতর কণ্ঠে কাঁদতে শুরু করলে সে-কান্নার শব্দ – এসব উচ্চরব ধারণ করে। তবারক ভুইঞা কেমন চঞ্চল হয়ে একবার হাত-পাখাটি তুলে নেয়, পরক্ষণে রোগীর তৃষ্ণা পেয়ে থাকবে ভেবে পুঁতি-ঝোলানো জালি দিয়ে ঢাকা পানির গেলাসটি ওঠায়।’ (কাঁদো নদী কাঁদো)

যদিও সৈয়দ সাহেবের কাহিনি-নির্মাণ প্রকরণের সঙ্গে বহিরঙ্গে এক কণাও মিল নেই তিলোত্তমার সৃজনের, কিন্তু এই জীবন দেখার আপাত-নির্লিপ্তির সঙ্গে যেন তাঁর আত্মিক সংযোগ!

তিলোত্তমার প্রকাশভঙ্গির স্বকীয়তা আছে। ওই স্বাতন্ত্র্য কোথায়? বৈশিষ্ট্যই বা কী? উপন্যাসের কাহিনি বহমান, কখনো লেখকের কথনে, কখনো চরিত্রের সংলাপে। তার গভীর মনের কথায় উৎসারিত হচ্ছে জীবনবোধ, দার্শনিক বিশ্লেষণ, দাঁড়িয়ে পড়ছে তার আচরণের পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তি, যা আদতে লেখকেরই কথা। কিন্তু একটিবারের জন্যও কাহিনির বহমানতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না। সবাই হাত ধরাধরি করে মিলেমিশে চলছে ওই মূল প্রবাহের সঙ্গে। বস্ত্তত প্রবাহটির সহায়ক ক্রিয়া তারা। এই কারণেই, আমরা দর্শন কিংবা মনস্তত্ত্ব শিখব বলে তিলোত্তমা পড়তে বসি না। জীবনপ্রবাহের এক সংবেদী রূপ উপভোগ করব বলে তাঁর উপন্যাস পড়ি।

অনেকেই তিলোত্তমা-প্রসঙ্গে যৌনতা টেনে আনেন। তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক। যৌনতা নিয়ে প্রতিটি মানুষের নিজস্বতা আছে, তা কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা যায় না। তিলোত্তমা তাঁর সৃজনে সেই বৈচিত্র্য দেখাবার সৎ চেষ্টা করেছেন গভীর অভিনিবেশে। ফলে তাঁর যৌনতা নিছক যৌনতার প্রদর্শন নয়, তা হয়ে ওঠে সম্পর্কের জটিল স্তর প্রকাশের মাধ্যম। এই জটিলতা প্রবহমান সেই আদিম যুগ থেকেই। আদিম উলঙ্গ মানব-মানবীও, নৃতত্ত্ববিদ-সমাজবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সঙ্গমের সময় খুঁজে নিতে চেয়েছে আড়াল। স্বাভাবিক অভ্যাসে, প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, হয়তো কোনো গোষ্ঠীনেত্রী সঙ্গম করে তার পুত্রের সঙ্গে, হয়তো সেই পুত্র পেয়েছে তারই স্বামীর মর্যাদা, সেই নারীও অকারণে প্রদর্শন করতে চায়নি তার যোনিদেশ। বৃদ্ধ ঢাকতে চেয়েছে তার শিশ্ন। অর্থাৎ সভ্যতার জন্মলগ্নেই এই নৈতিকতা-অনৈতিকতার দ্বন্দ্ব। সেই আদিপর্ব থেকেই খাড়া মেরুদন্ড পাওয়া হোমো সেপিয়েন্সের এটিই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এটিই তার ধরন। অতএব, আধুনিক         নর-নারীর সম্পর্ক যে আরো জটিল, জটিলতর হবে তা নিয়ে তো তর্ক হতে পারে না। এবং সেই আধুনিক জটিলতার কোনো কোনো স্তর প্রকাশিত তিলোত্তমার রচনায়। যতদূর বুঝেছি, যৌনতা নিয়ে মানুষের ‘দ্বিচারিতা’ দেখানোর জন্য লেখক কোমর বেঁধে নামেননি, তিনি দেখাতে চেয়েছেন জীবনের একটি সত্যকে। তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা-প্রসূত লেখায় সেই জীবনের সত্য হয়ে উঠেছে শিল্পের সত্য। যা ম্যাক্সিম গোর্কির ভাষায়, ‘স্বাধীন, মুক্ত মানুষের ধর্ম’।

আরো এক কথা, তিলোত্তমা তথাকথিত ফেমিনিস্ট নন। যাঁরা কথায় কথায় পুরুষ-বিদ্বেষ প্রকাশ করেন, তাঁদের সঙ্গে লেখকের আড়ি। তাঁর কাছে সবাই মানুষ। তিনি তন্নিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ              করেন সেই বিচিত্র, চলমান মানুষের প্রেম-অপ্রেম, যৌনতা-শৈত্য, সারল্য-কুটিলতা তথা তার চারিত্র্য।

যৌনতা প্রসঙ্গে লেখকের যে-উপন্যাসগুলির কথা সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে তা হলো – চাঁদের গায়ে চাঁদ, প্রহাণ আর শামুকখোল।

প্রথমে চাঁদের গায়ে চাঁদ। ২২৮ পাতার আখ্যায়িকাটির প্রথম ২৮ পাতায় অনবদ্য সংযম-দক্ষতায়, মাত্র কয়েকটি তথ্যের অাঁচড়ে লেখক ‘অবলোকন’ করিয়েছেন নারীবঞ্চনার ইতিহাসের ভরকেন্দ্রটিকে, যা নাকি নারী আবাস গড়ে ওঠার প্রাথমিক, গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি। তারপরে ঘটনার শুরু উত্তর কলকাতার এক নারী-আবাসে, যেখানে ছাত্রীরা আসে তাদের বয়ঃসন্ধিকালে, কলেজ প্রবেশের সময়। কাহিনি এগিয়েছে শ্রুতি, শ্রেয়সী আর দেবরূপার নির্ভরে। যেখানে মফস্বল থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে আসা শ্রুতি দেখছে তার ঘরের অন্য দুই আবাসিক শ্রেয়সী আর  দেবরূপার  ক্রম-ঘনিষ্ঠতা। সে অনুধাবন করছে। আবর্তিত হচ্ছে দেবরূপা-শ্রেয়সীর সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। তার চেতনা পরিণত হচ্ছে। দেবরূপার মধ্যে ক্রমশ পুরুষভাব, কর্তৃত্ব বাড়ছে। সে শাসন করছে, অধিকার করছে, প্রায় গ্রাস করতে চাইছে শ্রেয়সীকে। শ্রেয়সীর মধ্যেও আত্মসমর্পণ। ক্রমশ স্থাপিত হচ্ছে সমলিঙ্গ-প্রেম। রাত্তিরে শ্রুতির কানে আসে দেবরূপা-শ্রেয়সীর একান্ত সংলাপ –

– এ কী! ব্রা পরে আছিস? এতক্ষণ ব্রা খোলার সময় পাসনি?

– আমার ইচ্ছে করেনি, খুলিনি! ব্যস!

– ব্রা খোল। বলেছি না, রাত্তিরে ব্রা পরে থাকবি না।

– থাকব। বেশ করব। উঃ…উ…উ…

– আবার কথা। দেখি, আমি খুলে দিই।

শ্রুতির চেতনায় বিস্ফোরণ ঘটেছে, যখন সে এক মধ্যরাতে হঠাৎ আলো জ্বেলে দেখছে দেবরূপা-শ্রেয়সীর শারীরিক মিলন – ‘…দু’খানি গোল চাঁদ যেন-বা যুক্ত আছে। এবং উপুড় করা গোলাটে সে চাঁদে পাঁচ পাঁচ দশখানি আঙুল যেন বা বাজাচ্ছে মৃদঙ্গম…।’ শ্রুতি লাইট জ্বালাতে ওরা বিরক্ত। নেভাতে বলেছে। শ্রুতি নেভায়নি। কিন্তু সে যে ওদের নৈকট্যকে অনৈতিক ভেবেছে, তা নয়। বরং কানাঘুষোয় ওদের নৈকট্যের খবর যারা জেনেছিল,  হোস্টেলের সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ আবাসিক দেবরূপা-শ্রেয়সীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের বহিষ্কারের দাবি তুললে, শ্রুতি, অভিযুক্তদের ‘রুমমেট’ হিসেবে যার সাক্ষ্য অতীব গুরুত্বের, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সে বিসদৃশ কিছু দেখেনি কোনোদিন। তার নিজের মতো করে শ্রুতি দেবরূপা-শ্রেয়সীর পাশেই দাঁড়িয়েছে।

প্রতিভাত হয়েছে শ্রুতি চরিত্রটির দার্ঢ্য এবং অন্যদের চেয়ে তার দশ কদম এগিয়ে-থাকা মনোভাব, যা আসলে লেখকেরই।

এর বহুকাল পরে শ্রুতি, তখন এক বেসরকারি সমাজসেবী সংস্থার কর্মী, আবার দেখা পায় দেবরূপার। সেও ঘটনাচক্রে ওখানেই কর্মী হয়ে এসেছে। সংস্থার আশ্রয়ে এসে পড়ে নারীমনোভাবাপন্ন, নিরাশ্রয় এক পুরুষ। যা প্রথমে বোঝা যায়নি। কারণ, সে পরে সালোয়ার-কামিজ, জনসমক্ষে স্নান করার সময়েও সে খুলতে চায় না বক্ষবন্ধনী। অচিরেই সে নাম পেয়েছে ললিতা। হঠাৎ শ্রুতি একদিন আবিষ্কার করে, দেবরূপার সঙ্গে ললিতা-নাম্নী পুরুষটির শারীরিক নিবিড়তা – ‘দেবরূপার শাড়ি উঠে গেছে কোমরে। পা ছড়ানো। ওর কোলে ললিতা। গায়ে শার্ট নেই। বুকে একটি কাপড় কাঁচুলির মতো বাঁধা। তার ওপর দেবরূপার হাত খেলছে। দুজনের মুখ একপাশে নামানো। এর ঠোঁটে ওর ঠোঁট ঢুকে আছে। কোনো হুঁশ নেই।’

এই নিবিড়তা ব্যাখ্যা করছেন তিলোত্তমা দার্শনিকতা-ঋদ্ধ ভাষায় – ‘…ওরা শরীর-প্রকৃতি ছাপিয়ে গেছে। মন-প্রকৃতিতে মিলেছে। চিরন্তর নারীমন চিরন্তন পুরুষমনে মিলেছে। দেহ-গঠন এখানে বাধা হয়নি। নারীদেহধারী পুরুষ, পুরুষদেহী নারীকে জড়িয়েছে।’ এর পরেই যখন সেই অমোঘ বাক্যবন্ধ উচ্চারণ করেন লেখক – ‘জয় প্রকৃতির জয়!’ – তখন এই প্রকৃতি আর শুধু ‘শরীর-প্রকৃতি’ কিংবা ‘মন-প্রকৃতি’র সংজ্ঞায় আটকে থাকে না, তা হয়ে যায় সেই অসীম প্রকৃতি – নেচার।

এক অন্যরকম যৌনভাবনা রূপ পায় প্রহাণ রচনায়। যেখানে সফল ব্যবসায়ী, নীতিবাগীশ সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা শ্রী, যার স্বভাবেই আছে লঙ্ঘন, আছে বিদ্রোহ, তীব্রভাবে কামনা করছে তাঁকেই! মাঝে মাঝে তুলে দিচ্ছে গভীর প্রশ্ন – ‘আচ্ছা বল তো বাপি, কোনটা বেশি অন্যায়? মা হওয়া না ভ্রূণহত্যা?’ আবরণহীন কামনাকাতর শ্রী সুজয়ের দিকে এগিয়ে এসেছে  সঙ্গমের তীব্র ইচ্ছায়। সুজয় শ্রীর গলা টিপে খুন করলেন – ‘…তোরা আর জন্মাস না এখানে। প্লিজ। প্লিজ। প্লিজ।’ অব্যবহিত পরেই সুজয় যখন বলেন, ‘…আজ আমি পাপ করলাম। আত্মজকে হত্যা করলাম আমি।’, তা আর শুধু সুজয়ের সংলাপ থাকে না, হয়ে ওঠে বর্তমানকালের সেসব গুটিকয়েক মানুষের চিন্তাধারা, যারা বিদেশ থেকে আমদানি করা সামাজিক উন্নয়নের মডেল স্থাপনার্থে, সুনীতির দোহাই পেড়ে, সফলতার কথা বলে, নিজের দেশের নিজের মানুষকে, আগামী প্রজন্মকে খুন করছে। এবং পাপ মাখছে। অবশ্য কেউ এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত না হয়ে বলতে পারেন, সুজয়ের এই খুন যৌননৈতিকতা রক্ষার্থে! বলতেই পারেন। সেও একরকমের ব্যাখ্যা। তার বিরোধিতাও করা যায় না। ভালো লেখা এমনই। নানারঙের আলো-বিচ্ছুরণকারী পলকাটা হীরকখন্ডের মতো!

আরো গভীর জটিলতা প্রকাশ করে শামুকখোল। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শুভদীপের সঙ্গে যৌনসংসর্গ হয় তার জীবনের প্রথম নারী বারো বছরের বড় মালবিকার। শুভদীপ অচিরেই বোঝে, এই সঙ্গম পরস্পরের সম্মতিতে ঘটে যাওয়া ক্ষণিকের উপভোগ্য মাত্র – সেখানে দীর্ঘস্থায়ী কিছু নেই। বিশ্বাস নেই, দায়িত্ব নেই, ন্যায়ের কণামাত্র নেই! দ্বিতীয় নারী মহুলী শুভদীপের শরীর জাগিয়ে দূরে সরিয়ে দেয় তাকে। গড়ে উঠতে থাকে তার নিজস্ব দর্শন। প্রত্যাখ্যাত শুভদীপের জীবনে এসে পড়ে তৃতীয় নারী চন্দ্রাবলী। সে কুরূপা কিন্তু কিন্নরকণ্ঠী। জীবনের লড়াইয়ে আহত চন্দ্রাবলী নিজেই আসে ঋজু, নির্মেদ, সুদর্শন শুভদীপের শরীরে। তার শরীর-দর্শনে শুভদীপের ঘৃণা জন্মায় কিন্তু নিখাদ কামবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে সে চন্দ্রাবলীকে রমণ করে। শুভদীপের এই অদ্ভুত যৌন-আচরণে প্রকাশিত পুরুষ মনস্তত্ত্বের এক জটিল স্তর। সে একদিকে অতীতে পাওয়া যাবতীয় অপমান অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া অন্য এক নারীর অভিমুখে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে তারই সঙ্গে বারংবার সঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে। এভাবেই তৃপ্ত হচ্ছে তার অহংবোধ! আবার একদিন চন্দ্রাবলী তাকে ছেড়ে চলে গেলে তীব্র স্নায়বিক দাহ গ্রাস করে শুভদীপকে। তার জীবনদর্শনে, চেতনায় এসে যায় মৃত্যুবোধ। আত্মঘাতী চিন্তায় আচ্ছন্ন শুভদীপকে আবার জীবনের পথে ডাকে চন্দ্রাবলী – ‘আমার জন্য বাঁচো শুভদীপ’। সেই কুরূপা চন্দ্রাবলীর ডাকে শুভদীপ ফিরে আসে জীবনের দিকে। বহিরঙ্গের রূপের আকর্ষণ ব্যর্থ করে জয়ী হয় গভীর মনের ভাষ্য।

 

যৌনতার মনস্তত্ত্ব, তার বিভিন্ন স্তর নিয়ে তিলোত্তমার উপন্যাস এই তিনটি। এর আগেই তিনি লিখেছেন ঋ, বসুধারা, যা বিষয়ের দিক থেকে এই তিনটি উপন্যাসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আবার ঋ এবং বসুধারা দুই-ই ভিন্ন-ভিন্ন গোত্রের। ঋর ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে দুই পুরুষ, দুই নারীর বিশ্বাস, বিশ্বাসহীনতা আর তার প্রতিক্রিয়া।  বসুধারার চলন অনেক মানুষকে নিয়ে। এতে ধরা থাকে সমকালের রাজনীতি, শান্তি-অশান্তি, সংঘর্ষ-নির্মাণ এবং মানবপ্রেম যা নাকি কখনো ধর্মকে অতিক্রম করেছে। এরই মধ্যে এক অধ্যাপক সমগ্র চেতনা দিয়ে অনুভব করেন মানবতার অনিবার্য আকর্ষণ, প্রেমের অনিরুদ্ধ শক্তি। ক্রমশ বোঝা যাবে বসুধারার মধ্যেই নিহিত তিলোত্তমার অন্যতম নিপুণ কৃতি রাজপাটের বীজ।

চাঁদের গায়ে চাঁদ-প্রহাণ-শামুকখোল সিরিজের পর এসে যায় জর্মের চোখ। প্রথম জীবনে রাজকুমার, পরবর্তীকালে ধর্মপ্রচারক, সন্ন্যাসী জর্মের অাঁখিপল্লব থেকে চা-গাছের জন্ম – এই বৌদ্ধ উপকথা উপন্যাসটিতে প্রতীকের মতো ব্যবহৃত। এই আখ্যানের পটভূমি মাটিবাড়ি চা-বাগান, বাগানের ক্ষুদ্র, কুটিল রাজনীতি। করণিক বিজু লিখতে শুরু করেছিল চা-শ্রমিকদের ইতিহাস। মালিক, দালাল আর স্বার্থান্বেষী ইউনিয়ন নেতা – এই ত্রয়ীর অশুভ অাঁতাত। তাদের চক্রান্তে চা-বাগানের অবস্থা হতমান। শ্রমিকজীবনে ঘোর বিপর্যয়। ক্রোধে অধৈর্য শতাধিক শ্রমিক বাগান-অফিসে হামলা চালাল, লুট করা হলো ম্যানেজার-নেতাদের বাড়ি। এরপরেই বিজুর যে-বন্ধুটি নেপালি লেবার-লাইনে আদিবাসীদের লেখাপড়া শেখাত, সেই কমল খুন হয়ে গেল। প্রতিক্রিয়ায় বিজু উন্মাদ। একদিন ঠান্ডা হলো চা-বাগান। আরোগ্যলাভ করল বিজু। এক ভোরে বিজু তার ডায়েরি ছিঁড়ে ফেলল, ‘একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে কুচি-কুচি করে উড়িয়ে দিল বাতাসে। ছেঁড়া-ছেঁড়া কাগজের টুকরো পড়ে রইল উঠোনময়।’ অকস্মাৎ বিজুর মনে হয়, এরা কাগজের কুচি নয়, এরা কমলের চোখের পাতা। ‘কমলের নাকি জর্মের? জর্মই কমল হয়ে এসেছিল বুঝি… সে এখন নিশ্চিত, এসব চোখের পাতার থেকে আবার জন্ম নেবে সহস্রের অধিক স্বাস্থ্যবান চা-গাছ।’ কমলের চোখের পাতা থেকে জন্মানো এই নতুন চা-গাছ নতুন এক সময়, নতুন এক প্রতিবেশ চাইছে, বেশ বোঝা যায়। প্রতীকটির প্রয়োগও যথাযথ হয়ে ওঠে। সর্বোপরি চা-বাগানের নোংরা রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে নতুন এক দিনকে আবাহন করে।

এবার একতারা আর রাজপাট। প্রথমে একতারা। এ-রচনা দেবারতি ভট্টাচার্য নামে এক মেয়ের অপমান, বঞ্চনা আর তার ঘুরে দাঁড়াবার আখ্যান। যে-মেয়ে পাহাড়-জঙ্গল-নদীঘেরা উজানিনগর বলে এক ছোট মফস্সল শহর থেকে তার বিবাহ উপলক্ষে কলকাতায় এসেছিল। দেবারতির মতোই তার বিবাহের উপহার হিসেবে সেই নগর থেকেই বাসের মাথায় চেপে কলকাতায় এসেছিল এক কাঠের ওয়ার্ডরোব। কলকাতায় পৌঁছতে তার লকটা হয়ে গেছে নড়বড়ে, ‘পাল্লার পালিশে অাঁচড়, হাতলের নকশায় আধুনিকতার বদলে গেঁয়ো প্লাস্টিক’। বিবাহের আসরে সে যেন উজানিনগর থেকে আসা দেবারতির এক দীন-দুঃখী আত্মীয়। তার দিকে বিদ্রূপ ছুড়ে দিচ্ছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন, যারা ওয়ার্ডরোবের চারপাশে ঘুরছে – ‘তার গ্রাম্যতায়, দুর্বলতায়, পালিশের ওপরকার ক্ষতে কটূক্তি নিক্ষেপ করছিল। হাসাহাসি করছিল। ওদের ধনী, অহংকারী ঠোঁট বেয়ে, গাল বেয়ে, দামি পাঞ্জাবির পকেট উপচে বিদ্রূপ ঝরে পড়ছিল।’ এমনতর অপমানের আবহে দেবারতির বিবাহ অনুষ্ঠানের শুরু।

বিবাহের প্রস্ত্ততির সময়েই অবশ্য বেনারসি শাড়ি কেনা উপলক্ষে দেবারতি অপমানিত হয়েছে তার বড়মামার কাছে। বিবাহের পর তার স্বামী নীল, শাশুড়ি মাধবী এবং শ্বশুর শিবানন্দের থেকে প্রতিনিয়ত পাওয়া নানান ছোটবড় অপমানের তরঙ্গে ডুবে-ভেসে দেবারতি পার করে সাত-সাতটি বছর। সব অপমান একেবারে নীরবে মেনে নেয়নি। তার সীমিত ক্ষমতায়, ভদ্রতা বজায় রেখে কখনো প্রতিবাদও করেছে সে। এবং নিজের মতো করে লিখতেও শুরু করেছে তার নিজস্ব কথা। যে-ওয়ার্ডরোবকে ত্যাজ্য-ত্যক্ত করে অন্যত্র রাখা হয়েছিল, তাকে ফিরিয়েও এনেছে নিজের ঘরে। সমগ্র উপন্যাসে এই মূক ওয়ার্ডরোব হয়ে উঠেছে এক অপার ব্যঞ্জনায় বাঙ্ময় এক চরিত্র। দেবারতি তার দিকে তাকিয়ে নিজের পীড়িত জীবনের কথা ভেবেছে কতদিন! তার জীবন সত্যিই পীড়িত, তার শাশুড়ির দেওয়া লাঞ্ছনা ছাড়াও, তার সন্দেহ, যা অমূলক নয়, সে বোঝে তার স্বামী নীল লোক ঠকিয়ে পয়সা রোজগার করে বেড়ায়। কখনো তীব্র আপত্তি জানায় দেবারতি, জোরগলায় তা ঘোষণাও করে। কাজটা সহজ নয়, কারণ, সেই যৌথ পরিবারের বাড়িতে বিবাহিত হয়ে আছে তার দিদি সঞ্চিতা, যার স্বামী নির্মল। তাকে ভাবতে হয়েছে দিদি-জামাইবাবুর যেন কোনো অপমান না হয় তার কথাও। দেবারতি তার এই বিবাহিত জীবনের ইতি ঘোষণা করে শ্বশুরালয় ছাড়ে সেদিন, যার কিছুকাল আগেই নীল একটি লোকের লালসা মেটানোর জন্য অর্থের বিনিময়ে তাকে তুলে দিয়েছিল সেই অর্থবানের কাছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত রাগের মাথায় নেওয়া নয়। যদিও নীলের প্রযোজনায় ঘটা ওই চরম অপমানের ঘটনাটি দেবারতিকে চরম সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়, তার আগের প্রতিটি অপমান, প্রতিটি লাঞ্ছনা তার ‘ছেড়ে যাবার তপস্যায়’ যুক্তি নির্মাণ করতে সাহায্য করেছে। এর পরেই দেবারতির নতুন জীবনের শুরু। না, সে তার পিত্রালয়ে ফিরে যায় না, তার নতুন ঠিকানা ‘স্বনির্ভরা’ সরকারি  হোস্টেল। তারপর চাকরি পাওয়া। চাকরিতে প্রচুর শ্রম, স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা। তারই মধ্যে লেখালেখি। আইনগতভাবে তাদের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি। একদিন বড় প্রকাশনা থেকে দেবারতির প্রথম বই প্রকাশ। দেবারতি আর মরবে না। বাঁচবে। প্রতিদিন নিজের মতো করে, নিজের জোরে বাঁচবে।

অদ্যাবধি যে-সতেরোটি উপন্যাস লিখেছেন তিলোত্তমা, তার মধ্যে একতারা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ২৩৭ পাতার এ-আখ্যানের প্রথম ৫৬ পাতার মধ্যেই দেবারতির গৃহত্যাগের দৃশ্য রচনা করলেও, তার কারণগুলি, লেখক মেলে ধরেন কখনো সামনে এগিয়ে, কখনো অতীতে ফিরে, অসামান্য কথকের দক্ষতায়। সমগ্র আখ্যায়িকাটির নির্মাণেই সংযমের পরিচয়, কিন্তু এই ঘর ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্যটিতে তা অনবদ্য। এই ঘরছাড়া নিয়ে লেখক খুব সহজেই             টিভি-সিরিয়াল মার্কা মেলোড্রামা বানাতে পারতেন, করেননি। বরং তার শ্বশুরালয় ত্যাগ যে বহুদিনের সঞ্চিত অপমানের পরিণতি, তা বোঝাতে দেবারতিকে বহিরঙ্গে একেবারে স্বাভাবিক রেখেছেন – ‘ঠিক বারোটায় আমি খেতে বসি একা। কারওকে ডাকি না। তৃপ্তি করে খাই পুঁই-চিংড়ি, ডাঁটা চিবোই। মাছের কাঁটা চুষে, চিবিয়ে ছাতু করে ফেলি একদম।’ এরপরে সে নীলের মুখোমুখি, সেখানেও কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। অবশেষে যৌথ পরিবারের গুরুজনদের প্রণাম করে সদর খুলে পথে নামা। কোনো উচ্চকিত শব্দক্ষেপণ নেই কোথাও। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সকল কলাসৃষ্টিতেই সরলতার সংযম একটা প্রধান বস্ত্ত। সংযমই হচ্ছে সীমার তর্জনী দিয়ে অসীমকে নির্দেশ করা।’ দেবারতির ‘স্বাভাবিকতা’, ‘সংযম’ আমাদের বুঝিয়ে দেয় তার সিদ্ধান্তের গভীরতা, তার আত্মবিশ্বাস। বোঝা যায়, সে অকূল কষ্টে পড়লেও আর এ-বাড়িতে ফিরছে না।

হঠাৎ ইবসেনের আ ডল্স হাউসের কথা মনে পড়ল। নাটকটিতে নোরা ছেড়ে যাচ্ছে তার স্বামী টরভ্যাল্ডকে। নির্গমনের সময় নোরা দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বাড়ি ছাড়ে। জর্জ বার্নার্ড শ যাকে বিশেষিত করেছেন – ‘The slamming of door that shook Europe’। দেবারতির গৃহত্যাগেও এমনই হাড়কাঁপান ধাক্কা লাগে। মনে হয়, পরিবারের সীমানায় যে-সামন্ততান্ত্রিকতা, দুর্নীতি চলে, তার সব দড়ি-দড়া, কড়িবরগা ভেঙে পড়ছে। বহিরঙ্গে কোথাও কোনো চিৎকার নেই, প্রায় নীরব অথচ কত বাঙ্ময়! নোরার শেষ অঙ্কে বলা কথার মতোই, বোঝা যায়, দেবারতি তার নিজস্ব identity খুঁজে পেয়েছে। তার নিজের জীবনের রূপকার সে নিজেই।

রাজপাট। গঙ্গা-ভাগীরথীর তটস্থ আধুনিক মুর্শিদাবাদের প্রেক্ষাপটে সমসময়ের রাজনীতি আর তথাকথিত রাজনীতিকদের পিশুন-প্রবৃত্তির আবহে রচিত এক ধ্রুপদাঙ্গের উপন্যাস। গভীর পরিশ্রমে, প্রত্যক্ষ স্থানিক অভিজ্ঞতার নির্ভরে নির্মিত ৮০৪ পাতার এ-আখ্যানের চলন, বিষয়, তিলোত্তমার অন্যান্য কাজের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রথমভাগেই আমরা দেখা পাই ময়না বৈষ্ণবীর, যার পূর্বাশ্রমের নাম ময়নামতী হালদার – ‘পানের রসে লাল ঠোঁট বৈষ্ণবীর। কপালে ও নাকে গঙ্গামাটির অলকা-তিলকা। গলায় তুলসীর মালা। হাতেও তেমনই মালা জড়ানো। পরনে আধময়লা সাদা শাড়িটি। কাঁধে ছোট কালো ঝোলায় ভিক্ষের চাল এবং হয়তো আরো অন্য কিছু। ত্বকে হালকা ভাঁজ পড়েছে বৈষ্ণবীর। অথচ শরীর টানটান। তীব্র।’ বৈষ্ণবী খঞ্জনি বাজিয়ে গান গেয়ে মাধুকরী করে বেড়ায়। গঙ্গার মতোই সে প্রবহমান। ঝোলায় পাওয়া দানের মতোই তাঁর সংগ্রহে জমে ওঠে বিভিন্ন গৃহস্থের গল্প। পঞ্চবুধুরি শ্রীপাটে অন্য এক শিষ্যের প্রতি শ্রীকৃষ্ণপাদ মহারাজের আচরণে ব্যথিত হয়ে, গুরুর অনুমতিতে মাধুকরী করে দান সংগ্রহ করবার অজুহাত দেখিয়ে বৈষ্ণবী সেই আশ্রম ছেড়ে চলে আসে হরিহরপাড়ার উপান্তে ঘোষপাড়ার বৈষ্ণব মঠে। এখানে থেকেই ময়না মাধুকরীতে যায়। ঘুরে বেড়ায় পরিপার্শ্বের গ্রামগুলিতে – তেকোনা, চতুষ্কোনা, ভগবানগোলা, বাঁশুলি, কালান্তর, গোমুন্ডি। সেসব গ্রামের গৃহস্থ পরিবারগুলি ময়নাকে ভালোবাসে খুব। তারা আপন করে নেয় তাকে।

একদিন কমলি নামে এক দুর্ভাগার সঙ্গে কথা বলে ময়না আবিষ্কার করে, ঘোষপাড়ার মঠে বলরাম বাবাজির নির্দেশনায় চলছে দেহব্যবসা, নারীপাচার। ময়না বৈষ্ণবী ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। হরিহরপাড়ার চাটুজ্যেবাড়িতে বসে ময়নার এই দুঃখ-কাহিনির শ্রোতা হন বাড়ির নয়াঠাকুমা আর চার তরুণ – মোহনলাল, সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, হারাধন সরকার ও রেজাউল মন্ডল। প্রতিবাদী সিদ্ধার্থের নেতৃত্বে মানুষ সংগঠিত হয় মঠের পাপাচারের বিরুদ্ধে। পুলিশে অভিযোগ করা হয়। ফলস্বরূপ, মঠ কর্তৃপক্ষের চক্রান্তে মাধুকরীরত ময়না বৈষ্ণবীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। বিক্ষোভ কমে না। বাড়ে। সিদ্ধার্থ রাজনৈতিক বিশ্বাসে সিপিএম কিন্তু তার কোনো রাজনৈতিক গোঁড়ামি নেই। অনেককে নিয়ে পথ চলতে চায় সে। রাজনীতির কাজের পাশাপাশি ভাঙন-প্লাবনপীড়িত গ্রামের সাধারণ মানুষকে প্লাবন নিয়ন্ত্রণ আর ভাঙন প্রতিরোধ বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলে সে। তাদের জানায় নদীকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পন্থা। মুক্তমনের মানুষ সিদ্ধার্থ সিপিএমে থাকতে পারে না। দল ছাড়ে। কংগ্রেস ডাকে তাকে। বিজেপিতে যোগ দেবে না সে। কিন্তু সে তার নিজের মতো পথ চলে। তৌফিক তার সঙ্গী। নিজের মতো পথ চলতে চাইলে যা হয়, প্রত্যেক দলই তাকে ভয় করে। উপড়ে ফেলতে চায়। যে-খুন সে করেনি, সেই খুনে তাকে জড়িয়ে গ্রেফতার করার আয়োজন শুরু হয়। নীলমাধবের সঙ্গে দেখা হয় সিদ্ধার্থের। নীলমাধব সশস্ত্র বিপ্লবী। তার স্বপ্ন সমাজবদলের। সিদ্ধার্থ তোলে সেই চিরকালীন প্রশ্ন – ‘হিংস্রতা কি হিংস্রতা নাশ করতে পারে’। দুলুক্ষ্যাপা তার সঞ্চয়ভরা ঝুলি উপহার দেয় সিদ্ধার্থকে – ‘তুমিই তো আমাদের পথ দেখাবে বাবা। তোমার টানে টানে আমরাও তোমার পিছু ছাড়ব না।’ সিদ্ধার্থ হয়ে যায় সাধারণ মানুষের নির্ভরতার জায়গা, জনগণের প্রতিবাদী মুখ। এই প্রতিবাদ, যা ছড়িয়ে যাবে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে।

এই বৃহদাকারের উপন্যাসে প্রাসঙ্গিকভাবেই স্থান পেয়েছে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, ভূগোল, নদীপ্রকৃতি, বাউলদের নানান (কু) আচার। ওই জনপদের নানান বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে এই ধ্রুপদী আখ্যানে। তথাকথিত, বাজার-চলতি রাজনীতিকদের ভন্ডামি, তার নীতিহীন হিংস্রতাও উন্মোচিত হয় আমাদের সামনে। সিদ্ধার্থ চরিত্রটি আকর্ষক। বঞ্চিত মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর সৎ আবেগে পূর্ণ এই শুভ্র মানুষটিকে যখন বাজারি রাজনীতিকদের বিপ্রতীপে স্থাপন করা হয়, ওই রাজনীতির কারবারিদের কালো দিকগুলি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এই উপন্যাসের জাত আলাদা। প্রথম থেকেই, ময়না বৈষ্ণবীর খুনের পরেই, সিদ্ধার্থের মানসিকতায় বোঝা যাচ্ছে, অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে এবার সংগঠন গড়ার লক্ষ্যে এগোবে মানুষ। গণজাগরণের উদ্বোধন হবে এবার। এ-ধরনের সৃজনে, যাকে বলা হয় উদ্দেশ্যমূলক বা পক্ষপাতমূলক রচনা, আশঙ্কা থাকে             শিল্পরসহানির। তখন সেই রচনা পাঠ আর নান্দনিক অভিজ্ঞতা হয় না। নিজের বিশ্বাস, মনোভাব, অবস্থান ব্যক্ত করবার তাগিদে লেখক প্রায়শই হারিয়ে ফেলেন শিল্পবোধের ভরকেন্দ্রটিকে। তখন সেই সৃজন হয়ে দাঁড়ায় নিছক সংবাদ বা প্রচারপত্র। যাঁরা উদ্দেশ্যমূলক লেখার প্রবক্তা, সেই এঙ্গেলস, লেনিন, ট্রটস্কি, মাও থেকে জর্জ অরওয়েল সবাই এ-বিষয়ে লেখকদের সতর্ক করেছেন। শিল্প, ট্রটস্কি বলছেন, এমনই হবে যেন, ‘…it enriches the spiritual experience of the individual and the community, it refines feelings, makes it more flexible, more  responsive, it enlarges the volume of thought in advance…’। মাও জে-ডং বলছেন আরো স্পষ্ট ভাষায় – ‘শিল্পকর্ম রাজনৈতিক দিক থেকে যতই প্রগতিশীল হোক না, শৈল্পিকগুণের অভাবে তা শক্তিহীন হয়ে পড়ে। অতএব, আমরা যেমনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে ভুল শিল্পকর্মের বিরোধিতা করি, তেমনি তথাকথিত ‘প্রচারপত্র-স্লোগান রীতির’ ঝোঁক, যা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ভুল কিন্তু শিল্পকর্মে শক্তিহীন, তারও বিরোধিতা করি।’ আর এক বিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল লিখছেন – ‘আমি যা করতে চেয়েছি তা হলো রাজনৈতিক লেখনীকে শিল্পরূপ দান। আমি সবসময় লিখতে শুরু করি একটি পক্ষপাতমূলক অবস্থান থেকে, একটি অন্যায় অবিচারের অনুভূতি থেকে। আমি যখন লিখতে বসি, কখনো নিজেকে বলি না, ‘আমি একটি শিল্প রচনা করতে চলেছি’, আমি লিখি কারণ আমি চাই কোনো অসত্যের মুখোশ খুলে দিতে, কোনো ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমার কথা লোকে শুনুক। কিন্তু আমি কোনো বই, এমনকি কোনো সাময়িকপত্রের জন্য দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে পারতাম না যদি না তা এক নান্দনিক অভিজ্ঞতাও হতো।’

এই মাপকাঠিতে তিলোত্তমার রাজপাট, আমাদের বলতে কোনো দ্বিধা নেই, এক সুনিপুণ কৃতি, অপূর্ব নান্দনিক অভিজ্ঞতা।

 

তিলোত্তমার গদ্যভঙ্গি, জীবনবোধ, ঘটনা নির্মাণের কুশলতা নিয়ে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা গেল, যদিও এমন টুকরো কথায় তার সমগ্রতা বোঝানো শক্ত। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী – ‘সমগ্র পটের মধ্যে যে-ছবি আছে পটটাকে ছিঁড়ে তার বিচার করা চলে না – অন্তত সেটা আর্টের বিচার নয়… বিচারশক্তির প্রেস্টিজ শাসনশক্তির প্রেস্টিজের চেয়ে অনেক বেশি।’ অতএব, আর ছেঁড়া-খোঁড়া নয়! কিছু কথা বলে এ-লেখা  শেষ করব।

তবে শুধু কি গদ্যভঙ্গির জন্যই, তা সে যতই সুষমানিটোল হোক না কেন, কিংবা শুধু কি জীবনবোধের জন্য, তা সে যতই প্রাণদায়ী হোক না কেন, অথবা নির্মাণ-কুশলতার জন্যই, তা সে যতই সহজ সিঁড়িভাঙা হোক না কেন, আমরা তিলোত্তমাকে অভিবাদন জানাব? না, কখনো নয়। এর পরে যা থাকলে রচনা স্মরণীয় হয়ে ওঠে, সেই না-বলা কথা জগৎটিও তিলোত্তমায় আছে।

যে-কোনো সৎসাহিত্য আমাদের প্ররোচিত করে সাদা-কালোতে বলা-কথার বাইরে না-বলার রঙিন জগতে প্রবেশ করতে। তিলোত্তমার উপন্যাসেও আমরা পেয়ে যাই আমাদের সেই বাইরের মনের থেকে অন্দরের মনে যাওয়ার হাতছানি! আমরা ঋ উপন্যাসের বিনতার একটি মুখচ্ছবি কল্পনা করবার চেষ্টা করি – তার শান্ত মুখ, দীঘল দুই চোখও এমনিতে শান্ত, কিন্তু কখনো বজ্রের দ্যুতি খেলে যায় সেই শান্ত পুষ্করিণীতে। একতারার দেবারতির হাত কি হলুদমাখা? গরমকালে তার কপালের টিপ কি লেপটে গেছে? গরম তেল ছিটকে তার হাতের উপরিভাগে যে-ফোস্কা পড়েছে, তাতে হাত বুলোতে ইচ্ছে করে পরম মমতায়। ভট্টাচার্যবাড়ি ত্যাগের সময় আমাদেরও তার পাশে পথ চলতে ইচ্ছা হয়। রাজপাটের ময়না বৈষ্ণবীর গাত্রবর্ণ নিশ্চয়ই তামাটে। মাঝারি উচ্চতা বোধহয়। তার দার্শনিক চোখ নিশ্চয়ই কখনো কৌতুকময় হয়ে ওঠে। মানুষটি হয়তো নরম মনের কিন্তু চাপের মুখে সে নিশ্চয়ই বেতসবৃত্তি করে না। প্রহাণের সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় মেয়ে শ্রীকে আর একটু বোঝালে কেমন হতো? আমরা সবাই তো সেই আদিম যৌনতার ভগ্নাংশ রক্তে বয়ে নিয়ে চলেছি এখনো! চাঁদের গায়ে চাঁদের শ্রুতি, যার পর্যবেক্ষণক্ষমতা অসামান্য, কি দেখতে ছোটখাটো? সে কি অল্পসল্প তোতলা, যা পরবর্তীকালে ঠিক হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই অদম্য তার প্রাণশক্তি, ধৈর্যও নিশ্চয় কিছু কম নয়। তিলোত্তমার উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি এমনই ‘বলা এবং না-বলার অপরূপ ছন্দ’।

সবশেষে ‘চিরকালের প্রশ্নটি’ যদি রবীন্দ্রনাথ ছুড়ে দেন – ‘হে গুণী, কোন অপূর্ব রূপটি তুমি সকল কালের জন্য সৃষ্টি করলে?’, আমরা এগিয়ে দেব মুক্তমনের দেবারতিকে, যাকে অনুগমন               করবে নীল-মাধবী-শিবানন্দ সংসারের অন্তর্লীন সামন্ততান্ত্রিকতার চিহ্ন হিসেবে। যাবে শ্রুতি, দেবরূপা বয়ঃসন্ধির দর্শন নিয়ে এবং অবশ্যই ময়না বৈষ্ণবী, যে নাকি আধুনিক আবিলতার  শিকার। আমি নিশ্চিত সেই প্রাজ্ঞ মানুষটি তাদের অভ্যর্থনা করবেন।