সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা নির্মাণকলায় বৈচিত্র্যবিলাসী

আবিদ আনোয়ার
কথাসাহিত্য ও নাটক রচনার প্রাবল্যে কবি হিসেবে সৈয়দ শামসুল হক আলোচিত হয়েছেন কম। একই সঙ্গে
কথাসাহিত্য ও কবিতার চর্চা করেন এমন লেখকের কবি-পরিচিতি যে-কারণে কিছুটা ঢাকা পড়ে যায় তা হলো, কবিতার পাঠক সব দেশেই অত্যন্ত কম এবং একই ব্যক্তির হাতে রচিত গল্প-উপন্যাসের পাঠকের সংখ্যা বেশি বলে তিনি বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন কথাশিল্পী হিসেবে। সৈয়দ হকের বেলায় তা-ই ঘটেছে। বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাসসহ বহুকিছু লিখেছেন বলে অজস্র উজ্জ্বল কবিতা রচনা করেও কবি হিসেবে আলোচিত হয়েছেন তাঁর সহযাত্রী কবিদের চেয়ে কম।
পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে বৈচিত্র্যবিলাসী কবি সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর এই বিচিত্রতা কবিতার বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে নির্মাণশৈলীতেও প্রতিফলিত। নির্দ্বিধায় বলা যায়, পঞ্চাশের অন্য তিন প্রধান কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও শহীদ কাদরীর তুলনায় সৈয়দ শামসুল হক নিয়তই নতুনত্বকে আলিঙ্গন করতে সচেষ্ট ছিলেন।
মনে পড়ে, ড. হুমায়ুন আজাদ যখন শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা বইটিতে শামসুর রাহমানকে পঞ্চাশের একক ঐশ্বর্যশালী কবি বলে শেরপার মতো শিখরস্পর্শী প্রমাণ করায় চেষ্টিত ছিলেন, তখন সৈয়দ হক ‘শেরপা নিঃসঙ্গ নয়’ বলে একটা প্রতিবাদী লেখা লিখেছিলেন। পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে নিজের অস্তিত্বের জানান দিতেই মূলত তিনি সেই লেখাটি লিখেছিলেন। তাঁর এই আত্মবিশ্বাস বিনা কারণে তৈরি হয়নি। তিনিও পঞ্চাশের দশকের একজন অত্যন্ত শক্তিমান কবি।
সম্প্রতি চারুলিপি প্রকাশন থেকে চার খ-ে সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার নির্মাণশৈলী বিষয়ক আ   লোচনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে এমন পাঁচটি কাব্যনাট্য : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবন, এখানে এখন, গণনায়ক এবং ঈর্ষাও প্রকাশিত হয়েছে একই প্রকাশনা সংস্থা থেকে। আমার আলোচনার জন্য উপাত্ত সংগ্রহের অবলম্বন এখন এগুলোই কিন্তু মূল গ্রন্থগুলোর শিরোনাম মুছে দিয়ে কবি নিজেই আলোচকদের কাজটাকে কঠিন করে তুলেছেন। একটি ধারানুক্রমিক আলোচনার জন্য মূল গ্রন্থগুলোর ওপর নির্ভর করাও যাচ্ছে না; কারণ প্রবেশলগ্নের মূল গ্রন্থের অনেক কবিতা তিনি বাদ দিয়ে নতুন কবিতা যোজনা করেছেন। এ-বিষয়ে কবি একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন প্রথম খ-ের ভূমিকারূপী তাঁর ‘প্রসঙ্গ-কথা’য় :
পর্বে পর্বে আমার যে কবিতার বইগুলো বেরিয়েছে ১৯৬১ থেকে, সংকলন করতে বসে তাদের বই-নামেই বিভক্ত রাখবার এবং সনাক্ত করবার দরকার তখনো দেখি নি, এখনো দেখছি না। একজন কবির কবিতাকে তার অবিচ্ছিন্ন সৃষ্টি-প্রবাহেই দেখা ভালো। তারপরও, অগ্রগমন বলে একটা কথা আছে; তাই কিছু কিছু কবিতার নিচে তারিখ দেয়া হলো এবারে। পুরানো খাতাগুলো খুঁজে দেখে যতটা সন্ধান পাওয়া গেছে, তারিখ বসিয়েছি।
আমি আমার আলোচনায় সেই তারিখগুলো নয়, বরং কবিতা মুদ্রণের ক্রম অনুসরণ করে অগ্রসর হয়েছি এবং কবির কবিতাসমগ্রে মূল গ্রন্থের নাম নেই বলে আমাকেও কেবল কবিতার নাম দিয়েই কর্ম সারতে হচ্ছে – গ্রন্থসূত্র উল্লে­খ করতে পারছি না, কবির উপরোক্ত ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। তবে, বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা, পরাণের গহীন ভিতর এবং কাব্যনাটকগুলোর নামোল্লে­খ অনিবার্য বলেই করতে হয়েছে।
যদিও কবির নিজের ভাষায় ‘পর্বে পর্বে’ বের-হওয়া তাঁর কবিতার বইগুলোকে ‘বই-নামেই বিভক্ত রাখবার এবং সনাক্ত করবার দরকার’ মনে করেননি তিনি, আলোচনার সুবিধার্থে আমি তাঁর কবিতাসমগ্রের একেকটি খ-কেই একেকটি পর্ব হিসেবে ধরে নিয়েছি। তবে, বিপত্তির শিকার হয়েছি তৃতীয় খ-ের অনেক স্থানে প্রথম খ-ের অনেক কবিতার পুনরাবৃত্তি দেখে। কিছু কিছু কবিতার পুনর্মুদ্রণ অবশ্য ইচ্ছাকৃত, কারণ এগুলোকে বলা হয়েছে ‘দ্বিতীয় পাঠ’। আমি যে মুদ্রণপ্রমাদজনিত পুনরাবৃত্তির কথা বলছি তা এগুলো সম্পর্কে নয়। আগের খ-গুলোতে মুদ্রিত অনেক কবিতা তৃতীয় খ-ে ছাপা হয়েছে কোনোরূপ পরিবর্তন ছাড়াই। তাই, এগুলোকে ‘দ্বিতীয় পাঠ’ অভিধায় গ্রহণ করা যায় না। এমন মারাত্মক মুদ্রণপ্রমাদ কখনো আমার চোখে পড়েনি অন্য কারো কবিতা-সংকলনে।
সৈয়দ হকের সমগ্র কবিতার বিবেচনায় তিনি এদেশের মাটি-মানুষ-রাজনীতি ও সমাজলগ্ন হলেও প্রথম দিককার রচনায় কেবলই ছিলেন অন্তর্মুখিনতা, আত্মজৈবনিকতা ও নান্দনিকতায় নিবিষ্ট, যেমন ছিলেন বেশ কিছুকাল শামসুর রাহমান। এরপর সৈয়দ হকের কবিতায় জনজীবন, রাজনীতি ও সমাজলগ্নতা ঘুরে-ঘুরে এসেছে অর্থাৎ ফাঁকে-ফাঁকে আত্মজৈবনিকতা, প্রেম ও নান্দনিকতার চর্চা করে আবারো জনজীবন ও সমাজলগ্নতার দিকে ঝুঁকেছেন তিনি।
একটিমাত্র দীর্ঘ কবিতা নিয়ে প্রকাশিত বৈশাখে রচিত পংক্তিমালার পর্যায় পর্যন্ত তাঁর মানসলোকে ক্রিয়াশীল ছিল এই অন্তর্মুখিনতা। বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা একটি মনোলগজাতীয় দীর্ঘ কবিতা, যার কথক একজন কবি, যিনি তাঁর কৈশোর ও যৌবনের নানা ঘটনার অনুষঙ্গ, নান্দনিক ভাবনা এবং অল্পবিস্তর সমাজের কথাও প্রকাশ করেছেন এমন এক ভঙ্গিতে, যাকে আমরা পশ্চিমাদের ভাষায় ‘স্ট্রিম অব কনশাসনেস’ বলে জানি। মনোলগের ভঙ্গিতেই তিনি এই গ্রন্থে আত্মজৈবনিকতার সঙ্গে সুকৌশলে ব্রিটিশশাসিত বাংলার এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বিরাজমান সামাজিক অস্থিরতার চিত্র এঁকেছেন কিছু পরিমাণে এবং সে-বিবেচনায় এই পর্ব থেকেই তাঁর কবিতায় জনজীবনলগ্নতা খানিকটা আভাসিত হয়ে ওঠে। এরপর খুব দ্রুতই তিনি হয়ে ওঠেন প্রবলভাবে বহির্মুখী। একপর্যায়ে এসে অন্তর্মুখী শামসুর রাহমানও বহির্মুখীনতা ও সমাজভাবনায় জারিত হয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর সেই মোড়-ফেরা প্রতিফলিত হয়েছে কেবল মানসলোকের বিবর্তনে; সৈয়দ হকের বহির্মুখীনতা তথা সমাজভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর ভাষাভঙ্গি এবং নির্মাণকলার বিবর্তনেও। জনজীবনের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ শুধু নয়, জনজীবনে প্রচলিত ভাষাকেও তিনি নতুন মর্যাদা দান করেছেন পরাণের গহীন ভিতর গ্রন্থভুক্ত উজ্জ্বল কিছু সনেটে এবং পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ও নূরলদীনের সারাজীবন নামে দুটি কাব্যনাট্যের সংলাপে। অন্য তিনটি কাব্যনাটক – এখানে এখন, গণনায়ক ও ঈর্ষার সংলাপে ব্যবহৃত হয়েছে মানবাংলা। বলা বাহুল্য, কাব্যনাট্য কবিতারই সম্প্রসারণ। তবু কবিতার নির্মাণকলার এই বিশ্লে­ষণে আমি এই কবির পাঁচটি কাব্যনাটকের একটিকেও বিবেচনায় রাখিনি লেখাটির কলেবর বৃদ্ধিকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। শুধু এটুকু বলে দিই : মধ্যযুগে পালাগান রচয়িতাগণ যে ভাঙা পয়ার ও শিথিল স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করতেন সৈয়দ হকও তাঁর কাব্যনাট্যের সংলাপ রচনায় এই দুটি ছন্দে অপার স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। আঞ্চলিক ভাষায় বহু অভাবনীয় রূপকল্প ব্যবহৃত হয়েছে, যার বিস্তৃত আলোচনা ভিন্ন পরিসর দাবি করে। বলা প্রয়োজন, কবিতায় এ-ধরনের লোকভাষার আদি প্রবর্তক কবি আহসান হাবীব। প্রমাণস্বরূপ তাঁর দুটি কবিতা : ‘হক নাম ভরসা’ ও ‘ছহি জঙ্গেনামা’ থেকে অংশবিশেষের উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক মনে করছি :
পুরনো লাঙল আর কাস্তে হাতে লয়ে
কসম খেয়েছি আর বলেছি হে ভাই,
এসো সবে, এইগুলা আবার শানাই
আবার জিগরকাটা রক্ত দিয়ে লাল
বানাই। এগুলা হোক ঢাল-তরোয়াল
তাদের গর্দান কাটো, যারা আচম্বিতে
আমাদের জিন্দেগীর শান কেড়ে নিতে
ফন্দি করে…
(‘হক নাম ভরসা’, ছায়া হরিণ)

জ্বি হুজুর, আমি সেই হুজ্জত সরদার।
জান নিয়ে বেঁচে আছি পাক-পরওয়ার
খোদাওন্দ করিমের পরম ফজলে।
তবে কি না এলাহির লানতের ফলে
হয়েছে এমন হাল। হাড়-মাংসহীন
আমি সেই খাকছার হুজ্জত কমিন।

হুজ্জত সরদার আমি মানুন একিন।
ফখর করি না কিছু ছিল একদিন
যেদিন নেজার কোপ ফিরেছে এ বুকে
মওতের সামনেতে গেছি তাল ঠুকে
দু’চার বাঘের বল ছিল কব্জায়
ডর-ভয় বলে কিছু ছিল না ছিনায়।
(‘ছহি জঙ্গেনামা’, ছায়া হরিণ)
লক্ষ করা গেছে, সৈয়দ হকের কবিত্বশক্তি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। নতুনত্বের সন্ধানে এই কবি এক দিগন্ত থেকে ধাবিত হয়েছেন আরেক দিগন্তের দিকে। সময়ের সঙ্গে সৈয়দ হকের কবিত্বশক্তি ক্রমশই উজ্জ্বলতর হয়েছে – অন্য অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে যার উলটোটা।
কবিতাসমগ্রের চতুর্থ খ-ে সংকলিত অনুবাদ কবিতাগুলোও আমার আলোচনার বাইরে রয়ে গেল। এই খ-ে সংকলিত
হয়েছে উর্দু গজলের অনুবাদ বা অনুসৃজন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর কবিতা এবং হাফিজের কবিতার অনুবাদ। চতুর্থ খ-ে সংকলিত শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত কবিতাগুলোও সংগত কারণেই আমার আলোচনায় স্থান পায়নি। অতএব, কাব্যসমগ্রের প্রথম তিন খ-ে সংকলিত কবিতাগুলো নিয়েই এই আলোচনা।
নির্মাণকলা-সংক্রান্ত মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে এই কবির মানসলোকের ক্রমবিবর্তনের কিছুটা চিত্র তুলে ধরা যাক।
বলেছি : প্রবেশলগ্নের রচনায় সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন অন্তর্মুখিনতা, আত্মজৈবনিকতা ও নান্দনিকতায় নিবিষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রেমের কবিতাও এই শ্রেণিভুক্ত। সৈয়দ হকের প্রবেশলগ্নের কিছু রচনাকর্ম থেকে এসব অন্তর্মুখী, আত্মজৈবনিক কবিতার কিছু উদাহরণ :
জ্যোৎস্নারাতে ঘাস খায় কিবরিয়ার ঘোড়া।
বাদামি গ্রীবার রোদে চাঁদ মাখামাখি;
ঘাস খায় – ঘাস নিয়ে খেলা করে ঘোড়া –
সারারাত চাঁদের সহিস
আলোর আঙুলে তার কেশর বুলায়।
(‘চিত্রকর কিবরিয়ার পটে ঘোড়াটিকে দেখে’)

আবার ফিরবে বলে গিয়েছে যে, ফেরে না সে আর।
আর তাই ঢেউ ওঠে ঢেউ পড়ে তোমার আত্মায়
বড় – বড় – ছোট – ছোট – ঢেউ
(‘সমুদ্রকে’)

আমাকে ফেলে কোথায় তুমি যাবে?
যেখানে যাও অন্ধ বন, লক্ষ তারার রাত,
ব্যথার মতো বাতাস বয়ে যাবে।
আমাকে তুমি এড়িয়ে বলো কেমন করে রবে?
(‘আমাকে ফেলে’)

সরল রৈখিক নীল কঠিন ইস্পাত
হয়তো নোয়াতে পারো। কিন্তু কবিতার
সাথে নদীর তুলনা কেউ কেউ দিয়ে
থাকলেও আসলে সে স্বপ্ন-ভাগিরথী
শরীরে ধরে না জল। তরল হীরক
প্রতিভার সরোবর থেকে কলকণ্ঠে
নেমে আসে পিঙ্গল জটায়, পৃথিবীকে
শস্যের সংবাদ দিয়ে অন্তর্গত হয়
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা)
বলা প্রয়োজন : বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা রচিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। এর অব্যবহিত পরের সময়টি উত্তাল ছিল নানা রাজনৈতিক আন্দোলন, গণবিস্ফোরণ এবং মুক্তিযুদ্ধের কারণে। একান্ত আত্মজৈবনিক কবিও এই সময়টিতে বহির্মুখী না-হয়ে পারেননি। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটেছে। ‘খাদ্য ও খাদক’, ‘আমিও বাংলার লোক’, ‘এশিয়ায় যদি তোমার জন্ম’, ‘তেসরা ফেব্রুয়ারী ১৯৭০’ , ‘পহেলা মার্চ ১৯৭১’, ‘প্রেস রিপোর্টারকে’, ‘দুপুরে হঠাৎ কারফিউ’, ‘একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অসমাপ্ত কবিতা’, ‘অদ্ভুত আগন্তুক’, ‘সবাইকে সে এখন জিজ্ঞেস করে’, ‘বেতারে নির্বাসিত গায়কের গান শুনে’, ‘তা কিছু নতুন কথা নয়’, ‘এ কেমন মহামারী’, ‘জগন্নাথ হল’, ‘অবরুদ্ধ শহরে চতুর্থ মাস’, ‘বদলে গেছে সব’, ‘ফেলে আসা গ্রাম’, ‘গেরিলা’, ‘উদ্বাস্তু শিবিরে যখন সবাই ঘুমে’, ‘সাংবাদিক সম্মেলন’ – এমন বেশকিছু কবিতায় সৈয়দ হককে প্রথমবারের মতো বহির্মুখী, জনজীবনসংলগ্ন হতে দেখা যায়। এগুলোতে গ্রেফতার, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ পাকিস্তানি সেনাদের নানা বর্বরতার চিত্র অংকিত হয়েছে। কয়েকটি উদ্ধৃতি :
মায়ের সমস্ত সুঘ্রাণ নিয়ে যে-কিশোর পড়ে থাকত
নিবিষ্ট সব বইয়ের পাতায়, তুমি কি জানো
বারুদের চড়চড়ে গন্ধে সে এখন পাঠ নয়, রচনা করছে
ইতিহাস? –
(‘তেসরা ফেব্রুয়ারী ১৯৭০’)

দ্যাখো, আমি নিরস্ত্র। কিন্তু
আমার আছে সেই অস্ত্র যা নিঃশেষিত হয় না,
প্রতি ব্যবহারে তীক্ষè থেকে তীক্ষèতর হয়ে ওঠে –
(‘পহেলা মার্চ ১৯৭১’)

বারান্দায় পড়ে আছে লাশ। নীল এক নির্বোধ মাছি।
তারও চেয়ে নির্বোধ কুকুর ডাকে রাস্তায়, রোদ্দুরের গুলিবিদ্ধ
রাজপথ খাকি হয়ে যায়
(‘দুপুরে হঠাৎ কারফিউ’)

কাকডাকা দুপুরে সৈনিকেরা শস্যক্ষেত ভাঙে।
চাঁদ-ওঠা রাত্তিরে নামে গেরিলার সতর্ক প্রপাত
(‘ফেলে আসা গ্রামে’)
মুক্তিযুদ্ধের পর জনজীবনসংলগ্নতা ছেড়ে আবারো সৈয়দ হক তাঁর অন্তর্লোকে ডুব দেন; এ-পর্যায়ে ক্ষণকালের জন্য প্রবেশলগ্নের মতোই প্রেমসহ আত্মজৈবনিকতা ও নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ কবিতা রচনায় নিবিষ্ট হন তিনি :
কখনো কবিকে তুমি খুব কাছে নিয়ো না তোমার,
দিয়ো না দরোজা খুলে তোমার বাড়ির
… … …
জামার বোতাম যদি খোলা থাকে লাগিয়ে দিয়ো না
(‘কখনো কবিকে’)

একজনদের বাড়িতে আমার যাবার ইচ্ছে করে –
যেখানে গেলেই গান শোনা যায়
বুকের বাগানে ফুল ধরে যায়
যেখানে দিনের নগ্নœ শরীরে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে
(‘ইচ্ছা, ইচ্ছা’)

সে তৈরী করে তারা আমার শরীরে
তার ভেজা ঠোঁটে পর্দাটানা অন্ধকারে আর
আমি নীল হয়ে পড়ে থাকি বিছানায়
এবং চাঁদের মতো আমার জঙ্ঘা থেকে বেরুতে থাকে জোছ্না
(‘স্থিরচিত্র’)

এ-পর্যায়ে, মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক বছর, কবির এই জনজীবনবিচ্ছিন্নতা ছিল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এর অব্যবহিত পর বিষয়বস্তুর বিবেচনায় অন্তর্মুখীনতা, নান্দনিকতা ও প্রেমকে বেছে নিলেও ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই কবি সমাজলগ্ন হয়ে ওঠেন এই অর্থে যে, কলকাতাকেন্দ্রিক মানবাংলার পরিবর্তে তিনি বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে কবিতায় ব্যবহার করতে শুরু করেন, যাকে পশ্চিম বাংলার লোকজন অবজ্ঞামিশ্রিত ‘বাঙাল ভাষা’ বলে অভিহিত করেন। আমাদের কবিতায় এই ভাষাকে ব্যবহার করে সৈয়দ হক দেখিয়ে দিয়েছেন, কলকাতাকেন্দ্রিক শান্তিপুরি মানবাংলা আমাদের কবিতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। এই ভাষাভঙ্গির পথপ্রদর্শক অবশ্য তাঁর অগ্রজ কবি আহসান হাবীব, যা আগেই উদ্ধৃতিসহ দেখিয়েছি। সৈয়দ হক তাঁর পরাণের গহীন ভিতর শিরোনামের ৩৩টি সনেটে, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় এবং নূরলদীনের সারাজীবন নামের দুটি কাব্যনাট্যে এই ভাষা-ব্যবহারে অতুলনীয় নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।
বলেছি : সৈয়দ হকের মানসলোকে অন্তর্মুখিনতা ও বহির্মুখীনতা পর্যায়ক্রমে ঘুরে-ঘুরে এসেছে। এর মানে কিছুকাল অন্তর্মুখীনতার চর্চা করে আবারো বহির্মুখীনতাকে আলিঙ্গন করেছে তাঁর কবিতা এবং সংবেদনশীলতার এই পালাবদলে বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে এদেশে সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনাবলি। কবিতাসমগ্রের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খ-ের কবিতাগুলোতেও ঘটেছে এই পালাবদলের ঘটনা। সংবেদনশীলতার সঙ্গে বদলে গেছে নির্মাণকলাও।

ছন্দপ্রকরণ
সৈয়দ হক সব ছন্দে পারদর্শী ছিলেন তাঁর প্রবেশলগ্নেই। তবে, প্রথম খ-ের কবিতাগুলোয় মাত্রাবৃত্ত এবং স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত কম। এই পর্বে অক্ষরবৃত্ত ছন্দই ছিল তাঁর কবিতার প্রধান বাহন এবং পঞ্চাশের অন্য তিন প্রধান কবির তুলনায় প্রবেশলগ্নে বেশি পরিমাণে গদ্যরীতির কবিতা লিখেছেন তিনি; কিন্তু ক্রমান্বয়ে বৃত্তীয় ছন্দের চর্চা বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং অন্ত্যমিল প্রয়োগের দিকে প্রবলভাবেই ঝুঁকেছেন। এর উলটোটা ঘটেছে শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের বেলায়। এঁরা কবিজীবনের প্রধান পর্যায়টি পার হয়ে শেষ জীবনে প্রবলভাবে ঝুঁকেছেন সহজসাধ্য গদ্যরীতির দিকে।
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আজতক কবিতায় গদ্যরীতির চর্চা অব্যাহত, কিন্তু কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই বলে ছন্দবিষয়ক আলোচনায় গদ্যকবিতাকে বিশ্লেষণ করে দেখানোর কিছু নেই, কেবল এর উল্লেখই যথেষ্ট।
সৈয়দ হকের কবিতাসমগ্রের প্রথম খ-ে সংকলিত অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতাগুলোয় সমপার্বিক এবং অসমপার্বিক এই দুই ধরনের পঙ্ক্তিবিন্যাসই চোখে পড়ে। যেসব কবিতা সমপার্বিক পঙ্ক্তিবিশিষ্ট অর্থাৎ যেসব কবিতার সকল পঙ্ক্তিতে সমানসংখ্যক পর্ব রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট। প্রথম খ-ের অনেক অক্ষরবৃত্তীয় কবিতায় পঙ্ক্তিগুলো মুক্তকের আকারে সাজানো হয়েছে অর্থাৎ দীর্ঘ পঙ্ক্তির সঙ্গে হ্রস্ব পঙ্ক্তির মিশ্রণ ঘটেছে :
আমি তো দেখি নি চাঁদ কুয়াশায় অবিশ্বাস্য ফানুসের মতো,
ছিঁড়েও আনি নি কোনো লোকশ্রুত দর্শনের ফল,
অথবা যাই নি কারো ঘুমের সংসারে
অনন্তর ঘুম যাবো বলে –
(‘পুরনো প্রাসাদ-৫’, প্রথম খ-)

এত হাড়,
এত পাঁক,
এত তপ্ত পুকুরের জল
দুধ তো কবেই নেই, নষ্ট স্তন, দাঁতে নষ্ট বোঁটা।
(‘বাড়ির স্বপ্ন দেখে মাঝরাতে যখন আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল’, প্রথম খ-)

দুপুর ছিঁড়েছে ঠোঁট,
ধড় মু-ু রক্তে ভেসে যায়;
মানিকগঞ্জের বুকে কালিগঙ্গা ভীষণ একাকী
(‘দুুপুর ছিঁড়েছে ঠোঁট’, দ্বিতীয় খ-)

এই তিনটি উদ্ধৃতিতে লক্ষণীয় যে, মুক্তক অক্ষরবৃত্তের বিন্যাসেও বৈচিত্র্যের জন্য বিভিন্নভাবে পঙ্ক্তি সাজানো হয়েছে। এই তিনটি কবিতাংশ সৈয়দ হকের অক্ষরবৃত্তীয় রচনার শারীরকাঠামোর প্রতিনিধিত্বকারী।
এই কবির অক্ষরবৃত্তীয় রচনায় অজস্র মুক্তকের ভিড়ে সমপার্বিক পঙ্ক্তিবিন্যাসের প্রথম দৃষ্টান্ত মেলে ‘আমাদের পরিশ্রমী ধান’ এবং ‘গিয়েছে ভাটায়’ শিরোনামের দুটি ছোট কবিতায়, যার প্রতিটি পঙ্ক্তি অপ্রচলিত ১০-মাত্রার। ‘রঙ’, ‘প্রশ্ন’, আঁধারে হঠাৎ’, ‘রক্তমাখা’ এবং আরো কয়েকটি কবিতায় পূর্বাপর ১০-মাত্রার পঙ্ক্তি রয়েছে। আমাদের কবিতায় এই আঙ্গিক অত্যন্ত বিরল।
সমপার্বিক পঙ্ক্তির কবিতাগুলোয় চোখে পড়ে ১৮-মাত্রার প্রাধান্য, যা প্রায় সব আধুনিক কবিরই প্রিয় চাল। প্রথম খ-ে পরাণের গহীন ভিতর সনেটগুচ্ছের ৩৩টি কবিতার আগে ‘মহিলাকে, শিল্পীর উত্তর’, ‘কবিতা ২৩৯’, ‘আমিও বাংলার লোক’, ‘কৃপণ’ – এই চারটিমাত্র বিচ্ছিন্ন কবিতায় পূর্বাপর ১৮-মাত্রা ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘কবিতা ২৩৯’, ‘আমিও বাংলার লোক’, ‘কৃপণ’ – এই তিনটি চতুর্দশপদীর কিন্তু স্তবকবিন্যাস ভিন্ন ভিন্ন। কোনোটিতে প্রথম স্তবক ৬-পঙ্ক্তির, কোনোটিতে প্রথম স্তবক ৮-পঙ্ক্তির, আবার কোনোটিতে প্রথম স্তবক ১২-পঙ্ক্তির। লক্ষণীয় যে, পরাণের গহীন ভিতর সনেটগুচ্ছের কোনোটিতেই প্রচলিত সনেটীয় আঙ্গিকের অষ্টক ও ষটকে ভাগ করা হয়নি। ১৪ পঙ্ক্তির সবগুলোই এক-স্তবকে বিন্যস্ত হয়েছে। মিলের বিন্যাসেও বৈচিত্র্য রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিলগুলো কখকখ প্রকৃতির অর্থাৎ প্রথম পঙ্ক্তির সঙ্গে তৃতীয় পঙ্ক্তির, দ্বিতীয় পঙ্ক্তির সঙ্গে চতুর্থ পঙ্ক্তির মিল রক্ষিত হয়েছে। কোনোটিতে কখগকখগ, কোনোটিতে কখখক এবং কেবল ৩১ নম্বর সনেটে কক প্রকৃতির মিল রয়েছে। দু-একটিতে মিলগুলো বহুদূরবর্তী। এই বৈচিত্র্যের কিছু উদাহরণ :
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।
(অন্ত্যমিলের বৈশিষ্ট্য : কখকখ)

আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছন নিয়া ক্যান অন্য ধান খ্যাত রোয়? –
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান
(অন্ত্যমিলের বৈশিষ্ট্য : কখকখ)

কে করে পরশ তার জীবনের এত জটিলতা?
তোমার অধিক টান দেয় বৃক্ষ দেয় বিষলতা;
একবার আমারে আছাড় দিয়া সোজা করে ফের
আমারই মতন যারা বেশুমার সন্তান মায়ের।
(অন্ত্যমিলের বৈশিষ্ট্য : কক)
পরাণের গহীন ভিতরভুক্ত ২১ নম্বর সনেটে মিলগুলো বহু দূরবর্তী। প্রথম পঙ্ক্তির সঙ্গে পঞ্চম পঙ্ক্তির, দ্বিতীয় পঙ্ক্তির সঙ্গে ষষ্ঠ পঙ্ক্তির, তৃতীয় পঙ্ক্তির সঙ্গে সপ্তম পঙ্ক্তির এবং চতুর্থ পঙ্ক্তির সঙ্গে অষ্টম পঙ্্ক্তির মিল দেওয়া হয়েছে, যাকে কখগঘকখগঘ
প্রকৃতির মিল বলা চলে :
হাজার দক্ষিণ দিকে যাও তুমি গাঙের মোহানা
পাও যদি কইও আমারে। আমি না অনেক দিন
আমার যৈবন আমি মোহানার খোঁজে না দিলাম,
তাও তারে দেখি নাই, শুনি আছে ধলা গাঙচিল,
মাছের পাহারা ঘেরা খিজিরের অতল আস্তানা,
আছে তার ইশারায় আগুনের দেহ এক জ্বীন –
যদি ইচ্ছা করে তার অসম্ভব নাই কোনো কাম,
যারে না পাইতে পারি তারও সাথে দিতে পারে মিল।
প্রথম খ-ে এর পর ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত চোখে পড়ে একমাত্র ‘হাটা’ নামের একটি ছোট্ট (৪-পঙ্ক্তির) কবিতায়।
দ্বিতীয় খ-ে ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় রচনা সুপ্রচুর। নিচের তালিকাই সাক্ষ্য দেবে এই ছন্দে সৈয়দ হক কতটা আসক্ত ছিলেন এবং এ-ধরনের রচনায় মিল প্রয়োগের দিকে তাঁর ঝোঁক কতটা প্রবল ছিল :
‘নাভিমূলে ভস্মাধার’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘বিরুদ্ধ কালের কবিতা’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘হাতে এক মরা পাখি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘অস্তিত্ব পথিক আমি’ (মিলহীন দীর্ঘ কবিতা),‘এখনো অনেক রাত’ (মিলহীন চতুর্দশপদী), ‘এবার সংঘর্ষ ভোলো’ (মিলহীন ২০ পঙ্ক্তির), ‘নৈশভোজে রক্তপাত’ (সমিল ২৪ পঙ্ক্তির), ‘এখনি কবির কাল’ (সমিল ১৮ পঙ্ক্তির), ‘কবি চন্দ্রাবতী আজো’ (সমিল ২০ পঙ্ক্তির), ‘জলযাত্রা’ (অন্ত্যমিলহীন দীর্ঘ কবিতা), ‘জন্মদিনের কবিতা’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ওরা কি তুমি ও আমি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘অমা চন্দ্রিমার কাল’ (সমিল ১৮ পঙ্িক্তর), ‘যখন নৌকোর চোখ’ (সমিল ১৮ পঙ্ক্তির), ‘একাত্তরের চিঠি’ (অন্ত্যমিলহীন দীর্ঘ কবিতা), ‘আমিও তো যাবো’ (অন্ত্যমিলহীন দীর্ঘ কবিতা, ‘হারজিৎ’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘কালাকাল’ (সমিল ১৮ পঙ্ক্তির), ‘লাশ’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘খিস্তি’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘লখিন্দর’ (সমিল ৮ পঙ্ক্তির), ‘সাহেব বেগম’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘ডাক’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘মিঠাজল’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘ক্যামেরা’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘ইঁদুর’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘জ্যামিতি’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘প্রেমের গর্ভের জলে’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘ভেতরে বৈশাখ নিয়ে’ (সমিল ৮ পঙ্ক্তির), ‘বৃষ্টি পড়ে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘সুফিয়া কামালের জন্মদিনে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ধরো, কিছু পাপ করা গেলো’ (সমিল ১৮ পঙ্ক্তির), ‘অথচ উদ্দেশ্য ছিলো’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘বনি আদম’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘অথচ আমরা’ (সমিল ১৬ পঙ্ক্তির), ‘আমিও বাড়াই হাত’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘যে জানে সে জানে’ (সমিল ১০ পঙ্ক্তির), ‘করো তুমি এমন আঁধার’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘সংবাদ’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘এ ছাড়া আর কি আছে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ভেঙে পড়ে বুকের পাঁজর’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘যদি ভালোবেসে থাকো’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘তখন জননী রূপে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ইদানীং রাত নামে’ (সমিল চতুর্দশপদী). ‘তবুও গাধারা’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘আরো কিছু কথা ছিলো’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ডাকছি’ (সমিল ৪ পঙ্ক্তির), ‘এখন অনেক রাত’ (সমিল ২০ পঙ্ক্তির), ‘রুবাই ১ থেকে ৬’ (সমিল-প্রতিটি ৪ পঙ্ক্তির), ‘তবুও গানের কলি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘বিকেলে’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা)।
তৃতীয় খ-ে অর্থাৎ শেষ পর্বে এসে ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় রচনা এবং মিল প্রয়োগের এই প্রবণতা আরো বেড়ে যায় (প্রমাণ হিসেবে নিচের তালিকা দ্রষ্টব্য) :
‘ভালোবাসার রাতে’ (৭১টি কবিতার গুচ্ছ; সবগুলো সমিল চতুর্দশপদী), ‘বাল্যপ্রেমকথা’ (২০টি কবিতার গুচ্ছ; সবগুলো সমিল ২০ পঙ্ক্তির), ‘ভালোবাসার দিনে’ (সিরিজের ৩টি সমিল ৬ পঙ্ক্তির; সিরিজের ২টি সমিল চতুর্দশপদী), ‘তোমার নক্ষত্র এই রক্তের লোহিতে’ (সিরিজের ১৬টি সমিল ১২ পঙ্ক্তির; ১টি সমিল ১৬ পঙ্ক্তির; ১টি সমিল ১০ পঙ্ক্তির), ‘আমার চোখে তোমার ছবি’ (সিরিজের ১টি সমিল চতুর্দশপদী), ‘নক্ষত্রের নিচে ভাসমান’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘তবুও কবিতা তুমি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘আজ রাতে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘তখনও সুগন্ধ নেই’ (সমিল ১০ পঙ্ক্তির), ‘বাংলা ভাষার প্রতি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘জাম হাতে দাঁড়িয়ে’ (সমিল ৮ পঙক্তির), ‘সত্য এই দেখেন গালিব’ (সমিল ৮ পঙ্ক্তির), ‘জানাজাযাত্রীদের প্রতি গালিব’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘সাকীর প্রতি গালিব’ (সমিল ১৬ পঙ্ক্তির) ‘গালিবকে প্রাণিত করে নওরোজ এভাবে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘লিখতে লিখতে তাকিয়ে দেখেন গালিব’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘বাঙালি কবির প্রতি’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘বাংলার কবিকে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘যোদ্ধা হয়ে উঠি আমি’ (সমিল ১৬ পঙ্ক্তির), ‘আমন্ত্রণ’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘যদিবা দাঁড়াও এসে’ (সমিল ১৮ পঙ্ক্তির), ‘ওয়াহিদুল হক : প্রয়াণ ১৪১৩’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘তোমাকেই ভালোবেসে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘অনেক সুধাকে আমি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ওতেই যা মিটে যায়’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘পুতুলনাচ’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘একটি জীবন’ (সমিল ২ পঙ্ক্তির), ‘শুয়ে আছে একা’ (সমিল ৪ পঙ্ক্তির), ‘কিন্তু স্বর্গবাক্’ (সমিল ১০ পঙ্ক্তির), ‘সমাধিফলক’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘এখনো তো শেষ নয়’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘তারপর’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘জিল্ল­ুর রহমান সিদ্দিকী : তাঁর আশিতম জন্মদিনে’ (সমিল ২৪ পঙ্ক্তির), ‘মোহনের জন্যে পঙ্ক্তি কতিপয়’ (সমিল ২৪ পঙ্ক্তির), ‘বৃষ্টি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘এইসব বিপরীতে’ (সমিল ১০ পঙ্ক্তির), ‘আজও রয়ে গেছে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘কিন্তু মাথা তুলে দেখি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘লোকটি’ (সমিল ৪ পঙ্ক্তির), ‘তবু বুঝি থেকে যাবো’ (অন্ত্যমিলহীন ১১ পঙ্ক্তির), ‘কথা কয়ে ওঠো হে মানব’ (অন্ত্যমিলহীন ১৭ পঙ্ক্তির), ‘বাংলা ও বাঙালি’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘যতই দূরত্বে যাক’ (সমিল ১০ পঙ্ক্তির), ‘আড্ডা থেকে উঠে যেতে যেতে’ (সমিল ২০ পঙ্ক্তির), ‘তারা যে ফোটাতে পারে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘সান্ধ্য পঙ্ক্তি কতিপয়’ (সমিল ২৪ পঙ্ক্তির), ‘কবি আর তার কণ্ঠস্বর’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘ফিরে দেখি অভিধা আবার’ (সমিল ১৬ পঙ্ক্তির), ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ (অন্ত্যমিলহীন দীর্ঘ কবিতা), ‘এই যে ছায়াটি’ (সমিল ৮ পঙ্ক্তির), ‘পারি নাই আমি চলে যেতে’ (সমিল চতুর্দশপদী), ‘তবুও তবুও’ (সমিল চতুর্দশপদী)।
উপরোক্ত কবিতাগুলোয় পঙ্ক্তির সংখ্যা উল্লেখ করলাম এ-কথা বলার জন্য যে, অনেকগুলোতেই পঙ্ক্তির সংখ্যা ১৪-এর কাছাকাছি। ফলে, প্রকৃত অর্থে এগুলো হয়ে উঠেছে আদি সনেটীয় আঙ্গিকেরই সম্প্রসারণ কিংবা সংকোচন। এছাড়াও কিছু কিছু কবিতায় ১৮-মাত্রার পঙ্ক্তিকে ভেঙে একাধিক পঙ্ক্তিতে সাজানো হয়েছে। তবু পাঠের সময় সনেটীয় ধ্বনিই শ্রুত হয়। এমন একটি উদাহরণ :
বসেছিলো দু’টি পাখি
একদিন
অপার অমেয়।
দেখেছিলো একজন,
ঠোঁটে ঠোঁট
রেখেছিলো সেও।
পাখি তো পাখির মতো,
মানুষেরা
পাখি হতে চায়।
দারুণ কুয়াশা আজ –
ভালোবাসা?
ছবি কুয়াশায়।
(‘এই শীতে’, তৃতীয় খ-)
তিরিশোত্তর কালে ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্ত এবং জীবনানন্দীয় ২২, ২৬ ও ৩০-মাত্রার দৌরাত্ম্যে ১৪-মাত্রার আদি পয়ার প্রায় মরতে বসেছিল। বলা চলে, সৈয়দ শামসুল হক একে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। অজস্র কবিতা তিনি ১৪-মাত্রার আদি পয়ারে লিখেছেন এবং অধিকাংশই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট। শুরু করেছিলেন প্রবেশলগ্ন পার হওয়ার কিছু পরে লেখা বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা দিয়ে। এর পর তার জের হিসেবে অচিরেই লিখেছেন ‘খাদ্য ও খাদক’ (এক-দুই; দুটোই সমিল)। দীর্ঘ বিরতির পর পর আদি পয়ারের চর্চা করলেও সব মিলিয়ে এই ছন্দে রচিত কবিতার সংখ্যা তাঁর অনেক। আমাদের আধুনিকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি এই আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন। পাঠককে এ-বিষয়ে ধারণা দেওয়ার জন্য আবারো তালিকার আশ্রয় নিলাম। নিচের তালিকায় ১৪-মাত্রার আদি পয়ারের কবিতাগুলো কবিতাসমগ্রের তিন খ- থেকেই চয়িত হলো :
‘অধোগামী দিনের পঞ্জিকা (২৮টি কবিতার সিরিজ; সবগুলোই সমিল), ‘ভালোবাসার দিনে’ (সিরিজের ১১টি; সবগুলোই সমিল), ‘তোমার নক্ষত্র এই রক্তের লোহিতে’ (সিরিজের ৪টি সবগুলোই সমিল), ‘আমার চোখে তোমার ছবি’ (সিরিজের ২টি সমিল), ‘আগে এবং পরে’ (সমিল), ‘নিজের হাতে নিজের আঁকা ছবি’ (অন্ত্যমিলহীন দীর্ঘ কবিতা), ‘কারণটা এও হতে পারে’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘অথবা দেখেছ’ (সমিল), ‘হে কবি’ (সমিল), ‘বিযাবান’ (সমিল), ‘করাল বৈশাখ’ (সমিল), ‘কাল-পূর্ণিমায়’ (সমিল), ‘কিন্তু একি!’ (সমিল) ‘জন্মদিনের ভোরে’ (মিলহীন দীর্ঘ কবিতা), ‘খিদে’ (সমিল), ‘খুন’ (সমিল), ‘মাংস’ (সমিল), ‘পরস্পর’ (সমিল), ‘ছায়া’ (সমিল), ‘নিহত জীবন’ (সমিল), ‘তবু চলেই চলি’ (সমিল), ‘সশস্ত্র আমিও’ (সমিল), ‘আঙুরের জন্যে খুব’ (সমিল), ‘উড়ে যাই’, ‘সাতান্নর স্মৃতিকথা ‘দাস্তামবু’ লিখছেন গালিব’ (অন্ত্যমিলহীন দীর্ঘ কবিতা), ‘বালিকা’ (সমিল), ‘ওয়াহিদুল হক : জয়ন্তী ১৪০২’ (সমিল), ‘তবু শব্দ প্রপেলার’ (সমিল), ‘আমি তো সামান্য লোক’ (সমিল), ‘সে তো আমাদেরই’ (সমিল), ‘এখনো টেবিলে’ (সমিল)।
আগে দেখিয়েছি কী করে ১৮-মাত্রার অক্ষরবৃত্তীয় পঙ্ক্তিকে ভেঙে একাধিক পঙ্ক্তিতে সাজিয়েছেন এই কবি। একইভাবে ১৪-মাত্রার আদি পয়ারের পঙ্ক্তিকেও খ-িত করে সাজিয়েছেন কয়েক স্থানে, যেমন :
রুটি যদি নাই জোটে –
দুঃখ শেঁকে খাবো।
তৃষ্ণায় অসাড় জিহ্বা
অশ্রুতে ভেজাবো
(‘গালিবের স্বগতোক্তি’)
কাগজের ফুল ছিলো
কাগজ ছিলো না
সোনার কলম ছিলো
কলম ছিলো না
(‘ছিলো, ছিলো না’)
সৈয়দ হকের দীর্ঘ পঙ্ক্তির অক্ষরবৃত্তে রয়েছে প্রধানত ২২ ও ২৬ মাত্রার চাল। পূর্বাপর নিটোল ৩০-মাত্রার চাল চোখে পড়ে না। তবে, অনেক মুক্তক অক্ষরবৃত্তে বিক্ষিপ্ত ৩০-মাত্রার পঙ্ক্তি রয়েছে।
২২-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত হয়েছে ‘একটি হাত প্রসারিত’ (সমিল), ‘আমাকেও হতে বলো’ (সমিল), ‘রাত যখন সাড়ে তিনটে’ (সমিল), ‘বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে’ (মিলহীন), ‘এ জীবন অশুভের বিরুদ্ধে নাটক’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘চৌদ্দ শতকের শেষ সূর্য’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘নতুন শতাব্দীর প্রথম দিনে’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘কবন্ধ’ (সমিল), ‘সবুজ টমাটো’ (সমিল), ‘পাখা’ (সমিল), ‘আবার দাঁড়িয়ে যাই’ (সমিল), ‘মাতৃদুধের প্রতি’ (সমিল), ‘যুগান্তর’ (সমিল), ‘ফেরদৌসী মজুমদার : তাঁর জন্মদিনে’ (সমিল), ‘কবিজন্ম’ (সমিল), ‘নোট বই থেকে’ (সিরিজের প্রথম কবিতাটি সমিল)। ২২-মাত্রা অভিমুখী ‘সময়ের লাল কালো তাস’ কবিতাটির দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে ২৬-মাত্রা এবং
তৃতীয় পঙ্ক্তিতে অপ্রচলিত ২৪-মাত্রা চালিয়ে দেওয়ায় কিছুটা ধ্বনিগত বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। একে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত বলারও উপায় নেই, কারণ মুক্তকে অসম মাত্রার পঙ্ক্তি থাকলেও ধ্বনিবিন্যাসের সংগীতটুকু বিঘিœত হয় না। ‘ঘুণপোকা’ কবিতাটির কেবল শেষ পঙ্ক্তি ১৮-মাত্রার, বাকিসব ২২-মাত্রার। কিন্তু এখানে এটি শেষ পঙ্ক্তি বিধায় ধ্বনিগত কোনো বিপর্যয় তৈরি হয়নি।
উল্লে­খ্য যে, ২২-মাত্রার কবিতাগুলোরও কয়েকটি চতুর্দশপদী (সনেটীয়) আঙ্গিকে বিন্যস্ত।
নিটোল ২৬-মাত্রার অক্ষরবৃত্তে রচিত হয়েছে দুটিমাত্র কবিতা : অন্ত্যমিলযুক্ত ‘তুমি তো আমার নও’ এবং মিলহীন ‘রাত্রির প্রতি’। তবে, ধ্বনিবিন্যাসের বিবেচনায় ২৬-মাত্রায় রচিত একটি কবিতার পঙ্ক্তিকে খ-িত করে একাধিক পঙ্ক্তিতে সাজানো হয়েছে :
কখনো দেখেছো তুমি কীভাবে দিঘির বুকে
ভেঙে যায় সামান্য ঢিলেই?
দেখেছো নিশ্চয় তুমি বালিকা বেলায়, তবু
বুক পেতে দিলে আমাকেই –
(‘ঢিল’)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত সৈয়দ হকের কবিতায় আছে ৫, ৬ ও ৭-মাত্রার চাল; মাত্রাবৃত্তীয় ৪-মাত্রার চাল আমার চোখে পড়েছে একটিমাত্র কবিতায় – এটি ‘ভালোবাসার দিনে’ সিরিজ কবিতার ৫০ নম্বরযুক্ত অন্ত্যমিলবিশিষ্ট কবিতাটি :
ভাই যদি ভালোবাসা, বোন তার বিরহ।
যে-সুতোয় বাঁধা তারা আসলেই কী দৃঢ়?
বন্ধন ছিন্ন কে করে কার সাধ্য!
দুজনেই পরে পরে আসতেই বাধ্য
… … …
সে কথা কি কানে তোলে – কারো বুঝি কানে যায়?
কালা তাই প্রেমিকের ডাকনাম বাংলায়!
অনেক কবিতায় ৫-মাত্রার প্রাধান্য থাকলেও হঠাৎ দু-একটি পর্বে স্বরবৃত্তীয় ৪-মাত্রা ব্যবহার করার ফলে এগুলো আর মাত্রাবৃত্তীয় থাকেনি, হয়ে উঠেছে মিশ্রছন্দ, যাকে কেউ-কেউ ‘স্বরমাত্রিক’ ছন্দ বলে থাকেন। এ-ছন্দের বৈশিষ্ট্য হলো, মিশ্রপর্ব থাকলেও বিশুদ্ধ ধ্বনিপ্রবাহ অক্ষুণœ থাকে। কয়েকটি উদাহরণ (দাগাঙ্কিত পর্বগুলোতে স্বরবৃত্তীয় চাল লক্ষণীয়) :
দেয়ালগিরি অন্ধ তমসায়।
কেননা তার পেছনে তবু ছোটে
মাছের মতো নর্তকীদের চোখ
যদিও চিড় মোহন মিনারেটে
(‘যদিও চিড়’)

আমাকে তুমি কঠিন জাগরণে
রেখেছ, যেন তীব্র তলোয়ার
বেরিয়ে পড়ে থমকে আছে খাড়া –
কেবল এক রক্ত ঈষদুষ্ণ
ছিনিয়ে নিতে পারবে বুঝি ধার।
এমন তুমি শত্রু আমার সখী
(‘তুমি’)

এখনো তুমি আকাশলীন,
ধুলোর বুকে আমি।
নদীর ঢেউ ভাঙছে পাড়,
দু’চোখ দূরগামী।
প্রতীক্ষার নির্জনতা
ভাঙবে তুমি এলে
ফুটবে তারা আকাশ ভরে
তোমার ডানা মেলে
(‘আমার চোখে তোমার ছবি-২’)
ওপরের দাগাঙ্কিত পর্বগুলোতে স্বরবৃত্তীয় ৪-মাত্রা ব্যবহৃত হয়েছে বলেই এগুলো স্বরমাত্রিক ছন্দ পেয়েছে – নাহলে নিটোল ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দ পেত। একই কারণে নিটোল ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তের বদলে স্বরমাত্রিক ছন্দ পেয়েছে ‘আমাকে ফেলে’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘আরক যেন’ (সমিল), ‘তুমি’ (সমিল), ‘প্রভু’ (সমিল), ‘বলো না তুমি, নাই’ (সমিল), ‘কালো গোলাপের স্তব’ (সমিল), ‘এখন দূরে ডাকছে কেউ’ (সমিল), ‘যদিও চিড়’ (সমিল), ‘মানব জীবন’ (সমিল), ‘চারণ একলব্য’ (সমিল), ‘এখন তবে’ (সমিল), ‘আবার তবে প্রথম থেকে’ (সমিল), ‘কবির সংজ্ঞা’ (সমিল), ‘মুড মেলোডি’ (স্তবকের শেষ দুই পঙ্ক্তিতে মিল, শেষ স্তবকে কখগঘখঘ), ‘সেই বাড়িতে’ (সমিল), ‘দেখিই না কী হয়’ (সমিল), ‘উৎসন্নের দাদন নিয়ে‘ (সমিল), ‘বৃষ্টি কালো’ (সমিল), ‘আত্মপ্রতিকৃতি’ (সমিল), ‘তুমি আমার বুকের মধ্যে’ (সমিল), ‘তাকেই আমি লিখবো চিঠি’ (সমিল), ‘প্রশ্ন’ (সমিল), ‘ভাঙতে ভাঙতে’ (সমিল), ‘আবার হবে’ (সমিল), ‘দুয়ার বন্ধ থাক’ (সমিল), ‘বিমানযাত্রা’ (সমিল), ‘তোমার নক্ষত্র এই রক্তের লোহিতে’ (সিরিজের ১ নম্ব^রটি মিলহীন, ৫, ৮, ১৫, ১৮, ৩৮, ৪৩ নম্বরের কবিতাগুলো অন্ত্যমিলযুক্ত), ‘নূপুর’ (সমিল), ‘আমার চোখে তোমার ছবি’ (সিরিজের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১৩, ১৪, ১৫ নম্বরযুক্ত কবিতাগুলোর সবগুলোই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট), ‘তীব্রতায় আমার ভালোবাসা’ (সমিল), ‘জ্যোছ্না রাতে সবাই বনে’ (সমিল), ‘পাবো কি ফিরে’ (সমিল), ‘এখনো আমি’ (সমিল), ‘চন্দ্রমাখা ঢেউ’ (সমিল), ‘আমার বুকে কালো গোলাপ’ (সমিল), ‘এসো’ (সমিল), ‘এখন ও তখন’ (সমিল), ‘ভুবনডাঙা ভাঙছি আমি’ (সমিল), ‘দাঁড়িয়ে আছি’ (সমিল), ‘দরোজা খোলো’ (সমিল), ‘এখন শুধু’ (সমিল), ‘স্বপ্নগুলো ঘুমের চোখে’ (সমিল), ‘শিশুটি যুবক হবে’ (আংশিক মিল), ‘যতই তুমি’ (সমিল), ‘আমি যখন দাঁড়িয়ে আছি’ (সমিল), ‘এবার তবে তোমার সাথেই’ (সমিল)। অতএব, সৈয়দ হকের রচনায় নিটোল ৫-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় রচনা অবশিষ্ট থাকল কেবল দুটি : ‘এবং দ্রোহ’ (সমিল), এবং ‘আমার চোখে তোমার ছবি’ (সিরিজের প্রথমটি; এটিও অন্ত্যমিলবিশিষ্ট)।
নবীন পাঠকদের জন্য বলে দেওয়া প্রয়োজন : যেসব স্বরবৃত্তসদৃশ কবিতায় ৫-মাত্রার পর্বের প্রাধান্য দেখা যাবে এবং স্বরবৃত্তীয় নিয়মে গুনতে গেলে প্রায়শই ৩-মাত্রার পর্ব পাওয়া যাবে কিন্তু তা পাঁচটি বর্ণের সমন্বয়ে তৈরি হবে, তাকেই স্বরমাত্রিক ছন্দের কবিতা বলে গণ্য করতে হয়।
৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় কবিতায় সাধারণত একটি গুরুগম্ভীর সাংগীতিক ধ্বনিপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। সৈয়দ হক তাঁর অনেক কবিতায় ৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তে অভাবনীয় অতি-আটপৌরে বিষয় ও ভাবনাকে প্রায় গদ্যরীতিসদৃশ প্রকাশভঙ্গি ব্যবহার করে ৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তকে নতুনত্ব দান করার চেষ্টা করেছেন :
আরে, একি দেখি! কোথা থেকে ঢল বাড়ছে তো বাড়ছেই
তলিয়ে যাচ্ছে বড় রাস্তাটা রাজধানী অভিমুখে।
অচিরেই বুঝি এভিনিউগুলো ভাসাবে এ পানি তোড়
(‘বুঝে নিন তবে, মহোদয়গণ, দৃশ্য বদল হচ্ছে’)

রবি ঠাকুরের পায়ে কবিতার বই উৎসর্গ কি করা যায়?
হয়তো বা যায় যায়, হয়তো যায় না – নুনে জিভ আজ পুড়ে যায়।
(‘বুকের লবণ আর চোখের ম্যাজিক’)

ট্রেন আসবার কথা ছিলো রাত দশটায়।
কাল-আমলকি মুখ-গহ্বর কষ্টায়
এই ট্রেনে তার আসবার ছিলো কথা।
বুুকে উদ্বেগ, জিহ্বার নীরবতা।
(‘এখনো তো যোদ্ধাই’)

বন্ধু, এ বাসে বসবার মতো কোনো সিট খালি নেই,
ঝুলবার মতো রডগুলো সব হাতে হাত ঠাসাঠাসি ।
আমি ডেগ দিই; তুমি তো বন্ধু, যাত্রী আমার পূর্বেই;
দুলছিলে তুমি, আমি দুললাম, দুলছি তো পাশাপাশি
(‘চলো পায়ে পায়ে’)

মালিবাগে আমি, তুমি গুলশানে – পাড়া দুটো এক শহরেই;
বিশ মিনিটেই পৌঁছুতে পারি বেবি ট্যাকসিতে উঠলেই।
ভাড়াও তেমন বেশি কিছু নয় – পঞ্চাশ টাকা বড়জোর।
অথচ কি দূর এখন দু’জনে – ব্যবধান কত দুস্তর।
(‘প্রেমে যে প্রেমিক’)
একই প্রকৃতির বেশ কয়েকটি কবিতাংশ উদ্ধৃত হলো এ-কথা বলার জন্য যে, এত আটপৌরে বিষয়কে সচরাচর ৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তে অন্ত্যমিলসহ পরিবেশন করা হয় না। সৈয়দ হকের এই কাজটিও প্রশংসনীয় এবং বৈচিত্র্যের দাবিদার।
এই কবির ৬-মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় রচনার একটি তালিকা এরকম :
‘কন্যার প্রতি’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘বুঝে নিন তবে, মহোদয়গণ, দৃশ্য বদল হচ্ছে’ (মিলহীন), ‘বুকের লবণ আর চোখের ম্যাজিক : উৎসর্গ’ (সমিল), ‘তবু আমিও প্রেমিক’ (সমিল), ‘এখনো তো যোদ্ধাই’ (সমিল), ‘মুখোশে ঢাকা জননীর গাথা’ (মিলহীন), ‘ইচ্ছা, ইচ্ছা’ (সমিল), ‘থেমে আছি পথে’ (সমিল), ‘চলো পায়ে পায়ে’ (সমিল), ‘মনে করো’ (সমিল), ‘প্রেমে যে প্রেমিক’ (সমিল), ‘আমাকেই’ (সমিল), ‘প্রার্থনা’ (সমিল), ‘তবুও তো আমি’ (সমিল), ‘শূন্য পেয়ালা’ (সমিল), ‘হালখাতার গান’ (সমিল), ‘ফাগুনের গান’ (সমিল), ‘মার্চের গান’ (সমিল), ‘ইভা পেরনের সুরে গাওয়া গান’ (সমিল), ‘বন্ধু, তোমার পত্রের উত্তরে’ (সমিল), ‘শেষ জিজ্ঞাসা’ (সমিল), ‘কখনো এমন দিন এসে যায়’ (সমিল), ‘ভালোবাসার দিনে’ (সিরিজের ১৮, ৪৪, ৬৮ নম্বরযুক্ত কবিতাগুলো সমিল), ‘তোমার নক্ষত্র এই রক্তের লোহিতে’ (সিরিজের ২, ৩, ৬ নম্বরযুক্ত কবিতাগুলো সমিল), ‘এই ক্রন্দন’ (সমিল), ‘আজ এই রাতে’ (সমিল), ‘বৃষ্টিভেজা দিনে’ (সমিল), ‘আমার চোখে তোমার ছবি’ (সিরিজের ১২ নম্বরযুক্ত কবিতাটি সমিল)।
কবিতাসমগ্রের তিন খ-ে দুটিমাত্র কবিতা পাওয়া গেছে, যা ৭-মাত্রার মাত্রাবৃত্তে রচিত : একটি ‘প্রেমিকের গাথা’ অন্যটি ‘না নির্বোধ, না মহাপুরুষ’ সিরিজের ৭ নম্বর টুকরোটি। তারই একাংশ :
তুলনা নেই তার রমণীকুলে
অনিন্দিত তার ক্ষুদ্র দেহ
যেন তা একমুঠো করতে পারি
দারুণ বিকারের অন্ধকারে
‘প্রেমিকের গাথা’ কবিতায় অবশ্য একটি পর্বে মাত্রাবিন্যাস অতিরেকদুষ্ট, অর্থাৎ নিচের উদ্ধৃতাংশে দাগাঙ্কিত পর্বে ৮-মাত্রা
প্রশ্নবিদ্ধ :
এমন দয়াবান প্রশস্ত বক্ষের পুরুষ তিনি ছাড়া কেউ নেই,
যেমন লোকে বলে – দানের সংবাদ রাখে না দক্ষিণ বাহু তার;
স্বরবৃত্তীয় রচনায়ও সৈয়দ হক অতিমাত্রার আটপৌরে ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করে অগ্রসরমানতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর স্বরবৃত্তীয় রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বুনোবৃষ্টির গান’ (অন্ত্যমিলহীন), ‘আত্মার মৃত্যু ও কবি যা দেখেছে’, ‘কাঁদছিলো, কেউ কাঁদছিলো’ (সমিল), ‘আমার এত তাড়া কেন তারই একটা আভাস দেবার চেষ্টায়’ (মিলহীন), ‘পা বাড়াবার মন্ত্র’ (মিলহীন), ‘ একেই বুঝি মানুষ বলে’ (সমিল), ‘চেতাও যদি’ (সমিল), ‘লুটিয়ে থাকা শাড়ি’ (সমিল), ‘দেখতে আসেন মহিলা এক’ (সমিল), ‘তুমি তো আছোই’ (সমিল), ‘সেই পাখিটি’ (অর্ধমিল), ‘তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে’ (পূর্বাপর একই শব্দের মিল), ‘এখন আমি’ (সমিল), ‘আকবর হোসেনের জন্য গান’ (সমিল), ‘তখন ছিলো, এখন নেই’ (মিলহীন), ‘ভেতর থেকে বেরিয়ে দেখি’ (সমিল), ‘ও কবি’ (সমিল), ‘দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা মানুষের গান’ (সমিল), ‘ঘুমিয়ে থাকার গান’ (সমিল), ‘লবণ’ (সমিল), ‘আআ’ (সমিল), ‘শরীর’ (সমিল), ‘নিরুদ্দেশ’ (সমিল), ‘বন্ধু, তুমি কেমন আছো’ (মিলহীন), ‘সালতামামির বিবরণ’ (বিক্ষিপ্ত মিল), ‘মোমের আলোয় গান’ (সমিল দীর্ঘ কবিতা), ‘যুগল শিখা অগ্নি’ (সমিল), ‘সূর্য ওঠার আগেই’ (সমিল), ‘টুঙ্গিপাড়ায়’ (সমিল), ‘গত বছরের দিকে তাকিয়ে’ (সমিল), ‘অনেক দেখে অনেক শিখে’ (সমিল), ‘নইলে আঁধার’ (সমিল), ‘কবির মর্যাদা’ (সমিল), ভিক্ষা নয় কবির সম্মানী’ (সমিল), ‘হঠাৎ কবি জওক’ (সমিল), ‘স্বাধীনতা দিবস : ২০০৭’ (সমিল), ‘ডাকছি’ (সমিল). ‘তুমিই শুধু তুমি’ (সমিল), ‘খাঁচা’ (সমিল), ‘ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে’ (মিলহীন), ‘ব্রহ্মপুত্রে পা ধুয়েছি’ (সমিল), ‘দৈবে যদি ঘটে’ (সমিল), ‘এবার নেবো মিষ্টিজল’ (সমিল), ‘ভালোবাসার দিনে’ (সিরিজের ৫, ৬, ৭, ৮, ১৩, ১৪, ২০, ২৬, ২৮, ৩০, ৩৩, ৩৪, ৩৭, ৪৮, ৫৫, ৬৭ সবগুলোই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট)।
মিল প্রয়োগের তথ্যসহ বৃত্তীয় ছন্দে লেখা কবিতাগুলোর প্রায় পূর্ণাঙ্গ তালিকা দেওয়ার চেষ্টা করেছি এজন্যে যে, পাঠক একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন, এই কবি সব ধরনের ছন্দেই পারদর্শী ছিলেন এবং মিল প্রয়োগের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল প্রবল। এই ঝোঁক ক্রমান্বয়ে বেড়েছে কারণ তৃতীয় খ-ের কবিতাগুলোয় মিল প্রয়োগের দৃষ্টান্ত মেলে বেশি।
মুুক্তকের আকারে পঙ্ক্তি সাজানো হয়েছে সবচেয়ে বেশি অক্ষরবৃত্তীয় রচনায়; মাত্রাবৃত্তীয় রচনায় রয়েছে সমপার্বিক বা সমমাত্রিক পঙ্ক্তিবিন্যাসের প্রাধান্য। স্বরবৃত্তীয় কয়েকটি কবিতায় মুক্তক রীতির পঙ্ক্তিবিন্যাস চোখে পড়ে। এই তালিকাগুলোর বাইরে রয়ে গেছে মুক্তক অক্ষরবৃত্তে রচিত অজস্র কবিতা, যার অনেকগুলোই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট, বিশেষ করে প্রথম পর্বের পরের কবিতাগুলো। মিলের প্রতি এই কবির আসক্তি বোঝা যায় যখন দেখি বেশকিছু গদ্যরীতির কবিতায়ও মিল প্রয়োগ করেন। ‘এক আশ্চর্য সঙ্গমের স্মৃতি’ শিরোনামধারী কবিতাগুচ্ছের ১৪টিই গদ্যরীতিতে রচিত কিন্তু সবগুলোই অন্ত্যমিলবিশিষ্ট। এছাড়া আরো বহু গদ্যকবিতায় মিল ব্যবহার করা হয়েছে। ‘শিমূল ইউসুফ : দীপান্বিতা’ নামের কবিতাটি বেশ দীর্ঘ একটি গদ্যকবিতা, যাতে পূর্বাপর অন্ত্যমিল রক্ষিত হয়েছে :
শিমূল, আমার বোনটি, তোমার জন্মদিন! তোমাকে দেবার মতো উপহার
আমি খুঁজে চলেছি। ঘুরেছি কত বিপণীতে, চষে ফেলেছি বাজার –
ফুল সে তো আছেই, উন্নত তোমার গ্রীবার মতো রজনীগন্ধার
একটি স্তবক কিম্বা লাল গোলাপের তোড়া?
উত্তরীয় সে তো তুমি পেয়েই গেছো মানুষের ভালোবাসার তাঁতে বয়ন করা
সেই কবে থেকেই, ওটাও না হয় থাক।
শপিং মলে বেজে চলেছে সঙ্গীত, কলরব করছে যুবতীদের রঙিন পোশাক….
বিশ শতকের প্রারম্ভে গিয়ম অ্যাপোলিনিয়রের নেতৃত্বে একদল ফরাসি কবি ক্যালিগ্রাফিক কবিতা রচনায় মেতে ওঠেন। তাঁরা কবিতার শব্দ এবং পঙ্ক্তিগুলো এমনভাবে সাজাতেন যে, বর্ণিত বস্তুর একটি মূর্ত অবয়ব তৈরি হতো। এ-ধরনের কবিতাকে বলা হয় ক্যালিগ্রাম আর এ-শিল্পটিকে বলা হয় ক্যালিগ্রাফি। ক্যালিগ্রামকে বাংলায় আমরা নকশি-কবিতা বলতে পারি। আমাদের দেশে সৈয়দ হকই প্রথম ব্যাপকভাবে ক্যালিগ্রাফির চর্চা করেছেন এবং দক্ষতাও দেখিয়েছেন। তাঁর ‘গেরিলা’ ‘ক্যালিগ্রামটি সবচেয়ে সফল বলে আমি মনে করি। অস্ত্র তাক-করা একজন গেরিলার সতর্ক অগ্রগমন মূর্ত হয়েছে এটিতে। এছাড়া উল্লে­খযোগ্য একটি পিস্তলের আদলে সাজানো ‘বস্তুর আকার’ কবিতাটি এবং ‘অদ্ভুত আগন্তুক’ কবিতাটি, যাতে মূর্ত হয়েছে একটি মাছের অবয়ব। বিক্ষিপ্তভাবে অন্য কয়েকটি কবিতায় তিনি পালতোলা নৌকার চিত্র; জলপতনের চিত্র; পাখির অধোগমন, পালকের পতন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নকশা তৈরির প্রয়াস পেয়েছেন।

চিত্র ও চিত্রকল্প
‘চিত্রকল্পই কবিত্ব’ এই সেø­াগান ও বিশ্বাস এখন বিশ্বব্যাপ্ত। অথচ প্রাচীন আলংকারিকগণ, কি প্রতীচ্যের কি প্রাচ্যের, চিত্রকল্পকে কবিতার কোনো অলংকার বলে গণ্য করেননি। এজরা পাউন্ড ও এমি লাওয়েলের নেতৃত্বে বিশ শতকের শুরুতেই ‘চিত্রকল্পবাদ’ নামে যে-আন্দোলন হয়ে গেল তার ফসল হিসেবে চিত্রকল্পই এখন হয়ে উঠেছে কবিতার প্রধান শিল্প-উপাদান। কবিতার অনেক চিত্র ‘চিত্রকল্পত্ব’ অর্জন করে না সত্য, তবু সুনির্মিত কোনো কোনো বিশ্বস্ত জীবনচিত্রও পাঠকের চৈতন্যকে আলোড়িত করে। মজার বিষয় হচ্ছে, কবিতার নতুন রূপকল্প হিসেবে চিত্রকল্পের সঙ্গে প্রাচীন অলংকারশাস্ত্রীগণ যা নির্দেশ করেছেন তার কোনো বিরোধ নেই। এর কারণ চিত্রকল্পও নির্মিত হয় কোনো চৈতন্যপ্রসারী উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক ও সমাসোক্তির সহযোগে। এমনকি অন্যাসক্ত এবং অতিশয়োক্তির মতো নগণ্য অলংকারকে ধারণ করেও কোনো-কোনো চিত্র চিত্রকল্পত্ব অর্জন করতে পারে, যদি তা সেভাবে নির্মিত হয়। আবার পাঠকচৈতন্যকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে না এমন সাধারণ উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ও সমাসোক্তিবাহী চিত্রের সবই চিত্রকল্পত্ব অর্জন করতে পারে না। প্রতীকবাহী চিত্র সবক্ষেত্রেই চিত্রকল্পের মর্যাদা পায়। কারো কবিতায় রূপকল্পের সন্ধানে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, প্রতীক, সমাসোক্তি, অন্যাসক্ত, অতিশয়োক্তি ইত্যাদির আলাদা তালিকা প্রণয়ন না-করে চিত্র ও চিত্রকল্পের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলেই অল্পকথায়ও অনেক বোঝানো যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তাই, সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার রূপকল্পবিষয়ক আলোচনায় আমি এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেছি। পাঠক, লক্ষ করবেন নিচের তালিকাটি নিছক তালিকাই নয় – উদ্ধৃতির পর তৃতীয় বন্ধনীতে কবিতার শিরোনাম উল্লে­খপূর্বক বলা হয়েছে এটি নিছক বিশ্বস্ত চিত্র নাকি চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে এবং প্রতিতুলনাজাত কোন অলংকারকে নির্ভর করে তা নির্মিত হয়েছে; ক্ষেত্রবিশেষে এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নানা ধরনের মন্তব্য। এই কবির বিপুল রচনাসম্ভার থেকে মুদ্রণের ধারাক্রম রক্ষা করে কেবল অত্যুজ্জ্বল চিত্র ও চিত্রকল্পগুলোই চয়িত হলো। ফলে, প্রথম-প্রথম অতি সরল চিত্র থেকে শেষদিকে জটিল চিত্রকল্পের দেখা পেতে পারেন পাঠক। এই কবির রচনায় অল্পবিস্তর যেসব পরাবাস্তব চিত্রকল্প চোখে পড়ে সেগুলোও এই তালিকায় কিছু ব্যাখ্যাসহ অন্তর্ভুক্ত হলো। এই তালিকাধর্মী আলোচনার আশ্রয় না-নিলে সৈয়দ হকের কবিতার অলংকারবিষয়ক আলোচনা আরো দীর্ঘ হতো: লেখাটির কলেবর না-বাড়ানোর তাগিদেই আমি এই তালিকাধর্মী বিশ্লেষণের আশ্রয় নিয়েছি :
দুরন্ত এক বাতাস নাড়ে বুনো চালতা ফল – হৃদয় যেন
[‘বুনোবৃষ্টির গান’ : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প; কারণ চালতা ফলের সঙ্গে হৃদয়ের প্রতিতুলনা আর দুরন্ত বাতাস প্রেমের প্রতিতুলনা সহযোগে তৈরি হয়েছে এই চিত্রকল্প]

দিগন্তে স্বপ্নের মতো সূর্য ডুবে যায়
(‘প্রার্থনা’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

কুটিকুটি জ্যোৎস্নার শরীর
(‘চিত্রকর কিবরিয়ার পটে ঘোড়াটিকে দেখে’ : বিশ্বস্ত চিত্র, চিত্রকল্প নয়, যদিও কুটিকুটি বিশেষণটি একটি শীর্ণ অন্যাসক্ত)

আমি দাঁতে ছিঁড়ে চলি সারারাত
শব্দের – শুধু শব্দের অনুপম ঘাস
(‘চিত্রকর কিবরিয়ার পটে ঘোড়াটিকে দেখে’ : ‘অনুপম ঘাস’ এই সাধারণ অন্যাসক্ত নিয়েই চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে কবির সঙ্গে ঘোড়ার প্রচ্ছন্নœ প্রতিতুলনায়)

প্রাচীন প্রাণীর মতো বিস্মৃতির মত্ত এক মাছ
(‘সমুদ্রকে’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

এ সন্ধ্যা অতিক্রান্ত বন্দরের জাহাজের মতো
একে একে আলো জ্বলে পুরনো প্রাসাদে
(‘পুরনো প্রাসাদ-১’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

আমি তো দেখি নি চাঁদ কুয়াশায় অবিশ্বাস্য ফানুসের মতো
(‘পুরনো প্রাসাদ-৫’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

একটি অলিন্দে তার স্বগতোক্তি করে প্রদক্ষিণ
(‘মহিলাকে, শিল্পীর উত্তর’ : সমাসোক্তিবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

আমি এক অন্ধকার অরণ্যের মতো
(‘বস্তুত অরণ্য আমি’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

অতীতকালের মস্ত বড় মুখ
হা-খোলা এক বিরাট গরুর মত
(‘আত্মার মৃত্যু ও কবি যা দেখেছে’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

মাছের মতো নর্তকীদের চোখ
(‘যদিও চিড়’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

সন্ন্যাসী ছেঁড়ে আক্রোশে ফল যুগল স্তনের মতো
ক্ষুধার তাড়ায়
(‘কন্যার প্রতি’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

মরা সাপের মতো পড়ে আছে একফালি রোদ
(‘স্কেচ’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

একেকটা পাতার নগ্নতা মেলে ধরলো
রমণীর মতো
(‘কবিতা ২১৩’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

যখন তুমি আধেক মুখ তোলো
ছড়ায় যেন চন্দ্রালোকের তাপ
(‘তুমি’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

স্বর্গীয় ফলের মতো ডাকছে ওই চাঁদ
(‘কবিতা ২১৯’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

বাদামি থলের মুখ ছিটকে খুলে পড়ে গেছে
অজস্র রুপার টাকা কঠিন চত্বরে
(‘কবিতা ২৪০’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

কাফনের মতো বিচ্ছুরিত হচ্ছে জোছনা
কবি শোনেন যা উচ্চারিত হয় না –
যেমন নদীর অতলে মহাশোল গল্প শোনে তরঙ্গের
(‘কবিতা ২২০’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প, চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে কারণ চিত্রটি ব্যাপক চৈতন্যপ্রসারী – কবির সঙ্গে মহাশোলের প্রতিতুলনা ছাড়াও প্রচ্ছন্ন অন্য একটি প্রতিতুলনা আছে; মহাশোল শোনে তরঙ্গের গল্প, কবি শোনেন জীবন-তরঙ্গের ধ্বনি ও গল্প]
আকাশের একপ্রান্ত থেকে উড়ে গেলো চিল
বিন্দু বিন্দু চিল
(‘শূন্য প্রেক্ষাগৃহে’ : বিশ্বস্ত চিত্র, চিত্রকল্প নয়)

আমার হৃদয় থেকে
আশ্চর্য নদীর মতো কী যেন বেরোয়
(‘কিন্তু আসে একদিন’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প, কিছুটা পরাবাস্তবিক)

শব্দ-ছন্দ-অলংকার ঝুমঝুম করে চলে পেছনে আমার
যেমন মেলার দিকে দুপুরের রোদ ছিঁড়ে যায় বাজীকর,
তার সঙ্গে পোষাজন্তু লাল জামা পরে।
(‘একটি গাথার সূচনা ও মৃত্যু’ : উপমাবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়, তবু কেবল চিত্র হিসেবেই অনবদ্য; কবিতাটির একাংশে আছে (এখানে উদ্ধৃত নয়) মায়ের হাত ধরে ছোট বালকের হেঁটে যাওয়ার পরিচিত দৃশ্য। পোষাজন্তুটি বাজিকরের বাঁদর বই কিছু নয়; তাই, এর সঙ্গে বালকের প্রতিতুলনাটি আদরমিশ্রিত)

জননী, শ্যামল তুমি বুকে দোলে রুপোর হাঁসুলি –
রাতের আকাশে যেন চাঁদ খেলা করে
(‘একটি গাথার সূচনা ও মৃত্যু’ : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প)

নক্ষত্র ঝিকমিক করে ওঠে অন্ধকারে
আমার স্বপ্নের যেন অযুত ঘোড়া শুয়ে আছে
(‘দারা শিকোহ্র স্বগতগুচ্ছ-১’ : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প)

ময়ূরের শব যেন রমণীর অসার আলাপ
(‘দারা শিকোহ্র স্বগতগুচ্ছ-৩’ : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প)

সারাদিন ইস্টিশানে ট্রেন পড়ে পড়ে
পল্টুর দাদুর মতো ঝিমোয় রোদ্দুরে
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

সে লাটিম ঘোরে আজো।
ত্রিকালের পথে পথে পাগলা মেহের
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : সমান্তরাল রূপকাশ্রিত চিত্রকল্প; রবীন্দ্রনাথের একটি ছোটগল্পের ঐতিহ্য ব্যবহার করা হয়েছে)

মহেশ্বর তামাকের ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়
স্বপ্নের তালুকে যাবো, আর গাঢ় চোখে
দেখবো বিরাট রুই যেন ঊরুগুলো
হলঘরে কিলবিল করে ঝাঁকি নাচে
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প; পরাচিত্র হতে পারত, যদি না ‘মহেশ্বর তামাক’ বা গাঁজা খাওয়ার প্রসঙ্গ না-থাকত। পরাবাস্তবতা জন্ম নেয় সচেতন মনের ওপর অবচেতনের অসতর্ক স্বতঃস্ফূর্ততায়; নেশার ঘোরে দেখলাম বা দেখব কিংবা স্বপ্নে দেখলাম বলে যা দেখা হয় তা পরাবাস্তবিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে)

আমার আঙুল থেকে ক্রমাগত দেখি
ঝরছে অনবরত চেতনার ফুল
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : রূপকাশ্রিত পরাবাস্তব চিত্রকল্প)

দোলে, ডেমরায় শনশন ঘোরে, ওঠে
সাঁকো শূন্য মার্গে, বিহ্বল ছাগল-গাধা
উড়ে যায় গ্রামের মাথায়
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : সমাসোক্তিবাহী চিত্র, চিত্রকল্প নয়; আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও এটি চিত্রকল্প বা পরাচিত্র হয়ে ওঠেনি; কারণ এটি ভয়াবহ টর্নেডোর একটি বিশ্বস্ত চিত্র)

তাকে মনে হয় দলছুট নীলগাই
সারাদিন একা একা মালভূমি চষে
এখন দাঁড়িয়ে আছে তরঙ্গিত মেঘে
শিং তুলে
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : উৎপ্রেক্ষাবাহী পরাবাস্তব চিত্রকল্প)

সবুজ টেবিলে
ডিমের কুসুম ভাসে যেন যমুনায়
রাধার যৌবন দুটি
(বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প)

আমার সমস্ত চৈতন্যে অগণন সাপ
পিচ্ছিল পেটে অনবরত ওঠা-নামা করে
আমাকে না-কাটে না ছাড়ে
(‘তা কিছু নতুন কথা নয়’ : প্রতীকী পরাবাস্তব চিত্রকল্প)

একটা ধূসর পাখি শহরের মাথার ওপর বোমারুর চক্কর কাটে
(‘সন্ধ্যাস্তব’ : রূপকাশ্রিত চিত্রকল্প)

জুতোর ভেতর থেকে বেরুচ্ছে লক্ষ প্রজাপতির দল
(‘দুপুর একটা এগারোয়’ : প্রতীকবাহী পরাবাস্তব চিত্রকল্প)

চাঁদের দিকে ধাবমান যে ধবল ঘোড়া
হঠাৎ তার পিঠে দেখছি সুনীল এক আরোহী
(‘ঘুমের ভেতর থেকে উদ্ভূত’ : প্রতীকবাহী পরাবাস্তব চিত্রকল্প)

জানালার ভেতর দিয়ে হঠাৎ উড়ে এলো একজোড়া চোখ
(‘চোখ, দুটি চোখ’ : পরাচিত্র)

আমি মৃত এক নক্ষত্রের কক্ষপথে
বন্দী কোনো জ্যোতির্ময় পাথরের মতো
(‘নিজের হাতে নিজের আঁকা ছবি’ : উপমাবাহী চিত্রকল্প)

অকস্মাৎ প্রাগৈতিহাসিক পাখি বিকট চিৎকার করে উঠবেই আজ
যেন রাক্ষুসে ডিমে দিচ্ছিলো তা
(‘আমার শহর-৩’ : উৎপ্রেক্ষাবাহী চিত্রকল্প)

আয়নাটিকে একটুখানি কাৎ করো তো কাৎ
তোমার মুখ গড়িয়ে পড়–ক হাতে আমার, এই যে আমার হাত
(‘ডাকছি’ : পরাচিত্র; আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে কোনো অলংকার নেই; কিন্তু আয়না থেকে প্রতিবিম্বের কল্পিত প্রপাত একটি সমাসোক্তিবাহী চিত্র উপহার দেয়)
এই উদ্ধৃতিগুলো রচনাকালের ধারাক্রম রক্ষা করে চয়িত হয়েছে। তাই লক্ষযোগ্য যে, প্রতীক ও চিত্রকল্পের ব্যবহার সৈয়দ হকের কবিতায় ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছিল। তবু সার্বিকভাবে সৈয়দ হকের কবিতায় ব্যবহৃত এ-ধরনের চিত্র ও চিত্রকল্প জরিপ করে দেখা গেছে প্রতীকবাহী চিত্রকল্প খুবই কম, যে-ক্ষেত্রে অগ্রগামী শামসুর রাহমানের কবিতা। সৈয়দ হকের কবিতায় বেশি রয়েছে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ও সমাসোক্তিবাহী চিত্র ও চিত্রকল্প। তবে, যেসব চিত্র চিত্রকল্পত্ব অর্জন করেনি তার মধ্যেও অনেকগুলো কেবল চিত্র হিসেবেই অনবদ্য হয়ে উঠেছে বলে মনে করি। একটি উদাহরণ : ‘খিদে’ নামের একটি কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি ‘ধবল পূর্ণিমা রাতে সাঁতরায় হাঁস’। শাস্ত্রীয় সংজ্ঞামতে এটি নিছক একটি চিত্র, চিত্রকল্প নয়। কিন্তু এই চিত্র এতটাই চৈতন্যপ্রসারী যে, জোছনা-রাতের আধো-অন্ধকারে বিচরণশীল হাঁসটিও যেন কিছুটা বিমূর্ত ও স্বপ্নিল হয়ে ওঠে এবং দৃশ্যমান একটি প্রাকৃতিক চিত্রও দৃশ্যকল্প হয়ে ওঠার গৌরব অর্জন করতে চায়। উল্লেখ্য যে, যত কম শব্দে একটি চিত্র বা চিত্রকল্প নির্মিত হয়, ততই তার উজ্জ্বলতা ও শিল্পমূল্য বেড়ে যায়, যা ঘটেছে এই চিত্রটিতে; পাঁচটিমাত্র শব্দে আপাত বর্ণনাত্মক, অলংকারহীন একটি উক্তিও ধারণ করেছে চিত্রময়তা, যা আধুনিক কালের নিরিখে কবিত্বশক্তির প্রধান পরিচায়ক। 