স্বরূপসন্ধানী আনিসুজ্জামান

অভিভাবকতুল্য ড. আনিসুজ্জামানকে হারিয়ে এক শূন্যতা প্রতিনিয়ত যেভাবে আমাদের গ্রাস করছে তা সহজে দূর হবার নয়। আমরা সকলে জানি, ভাষা-আন্দোলনের সময় যখন তাঁর বয়স মাত্র পনেরো বছর, তখন থেকেই তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ এক মানুষ। আমৃত্যু তাঁর জীবনসাধনা, বাঙালিত্বের চর্চা ও জাতীয় সংকটকালে ওঁর ভূমিকা বাঙালি সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছে একটি উদার, সহিষ্ণু, বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সঞ্জীবিত ও আলোড়িত করতে। তাঁর বহুমুখিন কর্ম এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে যে-শক্তি জুগিয়েছে তা হয়ে উঠেছে অনুকরণীয়। তাঁর মতো আর কেউ নেই, তিনিই ছিলেন একক এবং নিঃসঙ্গ। সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসঞ্চার, গণতন্ত্র ও একটি শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য তাঁর অবিচলিত উদ্যোগ ও দৃঢ় কর্ম বাঙালিকে সতত প্রাণিত করছে।
আনিসুজ্জামানের গবেষণা কীভাবে শিখরস্পর্শী, জিজ্ঞাসামুখর ও গতানুগতিক ধ্যান-ধারণার প্রচল ছিঁড়ে নবীন আলোকে দীপিত করেছে এ-অঞ্চলের গবেষকদের, এ-ও আজ আগ্রহের বিষয়। ওঁর রচিত মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, স্বরূপের সন্ধানে, পুরোনো বাংলা গদ্য এবং ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য – এদেশের গবেষণায় ও ভাবনার জগতে যে নবীন মাত্রা সঞ্চার করেছে, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এনেছে ব্যাপ্তি এবং ভাবুকতার কোরককেন্দ্র হয়ে উঠেছে; এ-ও এক অনুসন্ধানের বিষয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য অভিসন্দর্ভটি লেখক সংঘ প্রকাশনী থেকে বেরোলে এদেশের বিদ্যাজগতে নবতরঙ্গের সূচনা করেছিল। গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন মুনীর চৌধুরী। অভিসন্দর্ভটি তাঁর শিক্ষকমণ্ডলীর কয়েকজন পাঠ করে অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিভার বহুমাত্রিক স্ফুরণ এই গ্রন্থটিতে পরিস্ফুট হয়েছিল।
দীর্ঘদিন থেকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মুসলিমদের অবদানকে মর্যাদা প্রদান করা হয়নি। যদিও সুকুমার সেন মুসলিমদের অবদানকে ছুঁয়ে গেছেন। আনিসুজ্জামানের এই গ্রন্থে বিস্তারিত তো বটেই বাংলা সাহিত্যে অমুসলিম ধারার পাশাপাশি মুসলিমদের অবদানকেও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সঙ্গে উঠে এসেছে রাজনীতি, সমাজ ও ইতিহাস। তিনি সতর্ক গবেষক, তথ্যের দিকেও ছিল তাঁর যথাযথ মনোযোগ, যে-মনোযোগ তাঁকে অনন্য গবেষক করে তুলেছিল। এ-অঞ্চলের সমাজজীবনে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির অনুষঙ্গ ও ভাবনা, বাঙালিত্বের সংকট ও সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ যাপন-অনুসন্ধান তাঁর অন্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল। উল্লিখিত বহুমুখিন কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মনীষার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।
১৭৫৭-১৯১৮ এই কালসীমায় বাঙালি মুসলমান সমাজের (সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও অর্থনীতি) সাহিত্যকর্মের অবস্থান ও বাংলা গদ্যের বিকাশ নিয়ে তাঁর অসাধারণ গবেষণা তাঁকে অগ্রণী অ্যাকাডেমিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল – এ ছাপিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজ নির্মাণেরও এক অনন্য রূপকার। দেশের মানুষের মর্মবেদনায় কাতর আনিসুজ্জামান এই কর্মের মধ্য দিয়ে এক প্রতিষ্ঠানেও পরিণত হয়ে উঠেছিলেন।
দেশের সংকটকালে তাঁর ভূমিকা প্রাণিত করেছিল বহুজনকে; বাঙালির আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান থেকে যে-যাত্রা শুরু হয়েছিল তা প্রবাহিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি হয়ে ওঠেন প্রাণসঞ্চারী এক সংগঠক। কতভাবেই না মুক্তিযুদ্ধে তিনি সহায়তা করেছেন – শরণার্থীদের ত্রাণে, কখনো ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায়, কখনো মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা বিভাগে, কখনো সংবিধানের বাংলা অনুবাদে।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম। তখন দেখেছি কত ছাত্রকে দীক্ষিত করেছেন সাহিত্যের রস গ্রহণে ও রুচি নির্মাণে। ষাটের দশকের মধ্যপর্যায়ে তাঁর কাছে পাঠ নিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্র। কখনো দেশ-আত্মার মর্মবেদনা উপলব্ধির জন্য আহ্বানও করেছেন। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেদের জীবন ও মননকে কোনো কোনো শিক্ষার্থী করে তুলেছেন শাণিত। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু হয়েছে তাঁর কর্ম। এই কর্ম নানাভাবে, নানাদিকে প্রসারিত হয়েছে। আমরা যাঁরা দীক্ষা গ্রহণ করেছিলাম তাঁর কাছে, কত কিছু যে পেয়েছি তা বিস্তারিত বলার নয়।
রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠায়, কখনো বাঙালির স্বরূপচেতনার আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আনিসুজ্জামান। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পূর্ব বাংলার মননজীবীরা এক বিবৃতির মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। আনিসুজ্জামান ছিলেন এ-বিবৃতি সংগ্রহের অন্যতম উদ্যোগী। পরবর্তীকালে তাঁরই সম্পাদনায় বেরোলো রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটিতে ধরা আছে পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্রচর্চার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত। ষাটের দশকে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র-বিষয়ে যেসব জিজ্ঞাসায় বাঙালির হৃদয় মথিত ও আন্দোলিত হয়েছিল এ-প্রসঙ্গে অনেকখানি জুড়ে আছে এই বই। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির জীবনে যে-কতভাবে প্রাসঙ্গিক : তাঁর সমাজচিন্তা, সমাজভাবনা, নন্দনবিশ্ব এবং মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর মূল্যায়ন – কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এই অনন্য সংকলনে। রবীন্দ্রবিরোধিতার রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রতিবাদেই যে এই রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ সে-কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারিত না হলেও খুব সহজ দৃষ্টিপাতে পাঠক তা উপলব্ধি করেছিল।
বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি কোনো দিনও সংকটমুক্ত থাকেনি; কতভাবে যে বিপর্যস্ত হয়েছে। এই বিপর্যয়কালে তাঁকে দেখি প্রতিবাদী ভূমিকায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পাননি বলে ১৯৬৯ সালে তিনি চলে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে সেখানে চলে গেলেও আমাদের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ছিন্ন হয়নি। চট্টগ্রামে গিয়েও তিনি স্বভাব-মাধুর্যে ও পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ে মর্যাদার আসন অর্জন করেন এবং অচিরেই প্রগতিশীল যে-কোনো সাংস্কৃতিক প্রয়াসের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের জোয়ারের যে-ছোঁয়া লেগেছিল প্রবলভাবে চট্টগ্রামে, তা তাঁকে শুধু উদ্বুদ্ধই করেনি, দায়বোধে বাংলাদেশ-নির্মাণের বৃহত্তর সংগ্রামেও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তিনি তখন সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রামের ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সৃজনশীল ও মননশীল লেখকরা পরামর্শ গ্রহণের জন্য তাঁর কাছে ছুটে যেতেন।
প্রগতিশীল ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্বের দায় বহন করায় পরবর্তীকাল থেকে তাঁর স্নেহ পেয়ে আমি নিজেকে আজো ভাগ্যবান বলে মনে করি। তারপর তো তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পথযাত্রা : গণসাহিত্য পত্রিকা যখন ১৯৭২ সালে বেরোলো, আমরা তখন তাঁকে উপদেষ্টা হওয়ার জন্য অনুরোধ করি, তিনি এক কথায় সম্মতি জানান। এছাড়া শত ব্যস্ততার মধ্যেও সংবাদে আমি কোনো বিষয়ে লিখতে অনুরোধ করলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেননি। দৈনিক সংবাদে নিয়মিত লেখা, যে-কোনো জাতীয় সংকটকালে তাঁর নেতৃত্বের দায় বহন আমাদের প্রাণিত করেছে রুদ্ধ পথ পাড়ি দিতে। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ও গোপাল হালদারের প্রয়াণের পর তিনি তাঁদের নিয়ে দুটি অসাধারণ প্রবন্ধ লেখেন আমাদের অনুরোধে, তা সংবাদে প্রকাশিত হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসার পর তাঁর কর্ম আরো প্রসারিত হয়। শুধু সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক আন্দোলন নয়, সামাজিক আন্দোলনেও তিনি ক্রমে নেতৃত্বের দায় বহন করেন। পঁচাত্তর-উত্তরকালে সামাজিক নৈরাশ্যে এ-অঞ্চলের বাঙালির জীবনে যে-বিপর্যয় নেমে এসেছিল তখন আমরা দেখি সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ যে-দায় নিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন, আনিসুজ্জামান ঢাকায় চলে আসায় সে-প্রয়াসে আরো বেগ সঞ্চারিত হয়েছিল। জিয়াউর-এরশাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিশেষত বাঙালিত্ব ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে অনেকেই অদম্য ও সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও দেশ-পরিচালনায় ধর্মনিরপেক্ষতা ম্লান ও ধূসর হলে সেক্ষেত্রেও তিনি লেখনী ধারণ করেন ও বক্তৃতায় সোচ্চার হন।
আনিসুজ্জামান এই আন্দোলনে হয়ে ওঠেন এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব। বিশেষত এরশাদ আমলে যে স্বৈরাচারবিরোধী সামাজিক, ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই সময়ে একদিন কারফিউ ভেঙে যখন রাস্তায় মিছিল করেন, তখন তিনিও তাতে অংশ নেন এবং পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসার পর তিনি আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের (আপসো) (Afro-Asian People’s Solidarity Organisation Ñ AAPSO) সভাপতি হন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. সাইদুর রহমান। কমিউনিস্ট পার্টি-নিয়ন্ত্রিত এই সংগঠনটিতে এই দুজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সংগঠনটির একদা সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট নাগরিক ও দেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি সক্রিয় করে তোলেন ড. আনিসুজ্জামান ও ডা. সাইদুর রহমান – গণজমায়েত ও নানা বিষয়ে সেমিনার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আফ্রো-এশীয় দেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সহমর্মিতা ও প্যালেস্টাইনে নিগৃহীত মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকায় অনুষ্ঠান হতে থাকে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে প্রতিবাদী সমাবেশ হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের নেতা দীর্ঘদিন বন্দি নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে। এই সমাবেশে বক্তব্যের পর একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়েছিল। আমি এই সংগঠনের সঙ্গে তখন গভীরভাবে যুক্ত ছিলাম।
আনিসুজ্জামানের ঔদার্যে ও কর্মপ্রবাহে, তাঁর অংশগ্রহণে এই সংগঠনটি গণসংহতি আন্দোলনের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। প্রগতিশীল কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও তিনি যুক্ত করেন এই সংগঠনের পতাকাতলে এবং তাঁর ফুলার রোডের বাসভবন হয়ে ওঠে সংগঠনটির আপিস।
আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদ ১৯৯১ সালে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংহতি সভা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ওই বছরের জুলাই থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয় এবং গণসংহতি পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে নবউদ্যমে কায়রো ও মস্কোয় উপদেশকমণ্ডলীর যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আগস্ট মাসে কায়রো থেকে স্থায়ী সেক্রেটারিয়েটের প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় আসেন চিত্ত বিশ্বাস।
আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের কর্মসূচির আওতায় ১৯৯১ সালের ১৮-২০ ডিসেম্বর ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে সার্ক দেশসমূহের সংগঠনটির জাতীয় কমিটিগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা এই হোটেলেই অবস্থান করেছিলেন। হোটেল পূর্বাণী তখন অভিজাত চরিত্র নিয়ে উজ্জ্বল ছিল। তিনদিনব্যাপী এই পরামর্শ সভার থিম ছিল ‘দক্ষিণ এশিয়ার সংহতি, শান্তি ও উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত নব্বইয়ের দশক’। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিরা এবং আপসোর জেনারেল সেক্রেটারি ও ডেপুটি সেক্রেটারি এবং পার্মান্যান্ট সেক্রেটারিয়েটের কয়েকজন প্রতিনিধি এই পরামর্শ সভায় অংশগ্রহণ করেন।
এই সভার জন্য ড. আনিসুজ্জামান ও ডা. সাইদুর রহমান প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। অর্থ সংগ্রহ ও বিজ্ঞাপন দিয়ে সহায়তা করে বেক্সিমকো, ডানকান ব্রাদার্স, অ্যাপেক্স ট্যানারিজ, অ্যাকুয়াটিক শিপিং, কৃষি ব্যাংক, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, আইএফসি ব্যাংক, ইসলাম গ্রুপ, ইসলামী ব্যাংক, ইস্পাহানী গ্রুপ, জনতা ব্যাংকসহ বহু প্রতিষ্ঠান।
তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলনে আটটি অধিবেশনে দেশ-বিদেশের প্রায় চল্লিশজন প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ অংশগ্রহণ করেন। সমাপনী অধিবেশনে ‘ঢাকা ঘোষণা’ পাঠ করা হয়। ঘোষণাটির খসড়াকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার জন্য ড. আনিসুজ্জামানের ঐকান্তিক প্রয়াস ছিল। সাব-কমিটিতে এই ঘোষণার মর্ম নিয়ে, শব্দ ও বক্তব্য নিয়ে কিছুটা তর্ক হয়েছিল। ড. আনিসুজ্জামানের হস্তক্ষেপে সেই তর্কের নিরসন হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষা, উন্নয়ন, মানবাধিকারের কথা গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছিল এই সম্মেলনের আটটি অধিবেশনে ও ঘোষণায়। এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন আপসোর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরী আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সম্পাদক চিত্ত বিশ্বাসসহ ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান থেকে মোট কুড়িজন প্রতিনিধি। কলকাতা থেকে আগত প্রতিনিধিদলের মধ্যে প্রতিক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক স্বপ্না দেব এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং একটি অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছিলেন। সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী। উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন কায়রো থেকে আগত নূরী আবদুর রাজ্জাক। সভায় সভাপতিত্ব করেন ড. আনিসুজ্জামান। বছরদেড়েক পরে তাঁরই সম্পাদনায় কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদে এই সম্মেলনে পঠিত প্রবন্ধগুচ্ছ নিয়ে একটি গ্রন্থ SAARC Co-operation : A People’s Perspective ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল সন্ধানী প্রকাশনী থেকে গাজী শাহাবুদ্দিন ও কাইয়ুম চৌধুরীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আন্তরিক আনুকূল্যে মুক্তিযুদ্ধের একটি গল্প সংকলন। আমি গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলাম। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ছোটগল্পের একটি উল্লেখযোগ্য সংকলন। আমি চট্টগ্রামে ড. আনিসুজ্জামানকে চিঠি লিখেছিলাম এই সংকলনের জন্য একটি ভূমিকা লিখে দিতে। তিনি ত্বরিত উত্তর দেন, আমি দুদিন বাদে যেন ওঁর বড় বোনের বাড়ি কাকরাইলে দেখা করি। তিনি ঢাকায় আসছেন বলেও জানান। গল্পগুলোর তিনি প্রুফ চান ও বলেন, আমিও যেন একটি ভূমিকা লিখি। সপ্তাহখানেক বাদে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ডাকযোগে ভূমিকা লিখে প্রেরণ করেন।
আমি ভূমিকাটি পাঠ করে অভিভূত হই এবং গ্রন্থটির অনেক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল আনিসুজ্জামান-লিখিত এই ভূমিকা। ভূমিকাটির সূচনা অংশ তুলে দিলাম। তাঁর সরস গদ্য ও বিষয়ের গুণে ভূমিকাটি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর চেতনাকে তুলে ধরেছিল।
সেই এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জীবনে, আমাদের ইতিহাসে। এত সুসময় আর কখনো আসেনি, এত দুঃসময় আর কখনো দেখিনি আমরা। বর্বরের নিষ্ঠুর আঘাত যখন অকস্মাৎ নেমে এসেছিল বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে, তখন কি শুধু অশ্রু আর রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল তার বুক? বিন্দু বিন্দু স্বেদধারা হয়ে নেমেছিল কঠোর শ্রমে, শক্ত হয়েছিল দেহের পেশি সংকল্পের দৃঢ়তায়। রাত্রির অন্ধকারে নিজের হাতে কবর খুঁড়ে স্বামীকে শুইয়ে দিয়েছিল স্ত্রী; মা সাজিয়ে দিয়েছিল পুত্রকে রণসজ্জায়, ধর্ষিতা বোনের স্তব্ধ চোখে চোখ রেখে নীরব প্রতিজ্ঞায় জ্বলে উঠেছিল ভাই। ‘লাউয়ের সবুজ মাচা, নদী, মাঠ, কলাইয়ের খেত আর পুকুরের ঘাট’ পেছনে ফেলে ছিন্নমূল মানুষ ছুটেছিল নিরাপত্তার সন্ধানে। কলম ফেলে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল ছাত্র, লাঙল ফেলে চাষি, হাতিয়ার ফেলে মজুর। নারী তুলে ধরেছিল মায়াঘেরা সেই পতাকা – যা শোকের অশ্রু মোছাবে, একত্র হবার জায়গা করে দেবে, কখনো নত হবে না। সেই দুরন্ত উত্তেজনায় শোকাবহ সৃষ্টিচঞ্চল দিনগুলোর গাথা লেখা আছে ফসলের দগ্ধ ক্ষেতে, গৃহের ভগ্নস্তূপে, গাছের গুলিবিদ্ধ পাতায়। লেখা আছে ঝোপ-ঝাড়ে, যার আড়াল থেকে মুক্তিযোদ্ধা হনন করেছিল পুত্রকে; আছে নদীর বিস্তারে যার গভীর থেকে বেরিয়ে এসে গেরিলা আচমকা ব্যর্থ করে দিয়েছিল ঘাতকের কূট চক্রান্তকে; আছে উন্মুক্ত প্রান্তর, শহিদের রক্তে যা উর্বর হয়েছিল। আর সেই গাথা লেখা হয়েছে আমাদের কবিতায় ও গানে, গল্পে ও উপন্যাসে, নাটকে ও ইতিহাসে।
কালি ও কলমে
২০০৪ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের যখন কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং আমাকে ডেকে পাঠান, পরে শুনেছি, ড. আনিসুজ্জামানের অনুমোদনেই আমার সম্পাদক হওয়া সম্ভব হয়ে উঠেছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যামিনীর প্রকাশনা উৎসবে আমার বন্ধু ও সুহৃদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাকে আবুল খায়ের ও লুভা নাহিদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বলেন। আনিসুজ্জামানের এই অনুমোদন আমার জীবন ও মননকে আমূল পালটে দিয়েছিল। আনিসুজ্জামান প্রস্তাবিত পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, সেজন্য আমি দ্বিধা করিনি। আমি সংবাদের দীর্ঘদিনের স্থায়ী চাকরি ছেড়ে একটি নবগঠিত প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি – এ নিয়ে আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করেছিলেন। এই পত্রিকায় যোগদানের পর আনিসুজ্জামানের আনুকূল্য আমাকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি রুচি প্রসারিত চেতনায় প্রত্যক্ষ করার দীক্ষা দিয়েছিল। তিনি ছিলেন কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। সংবাদে সাহিত্য সম্পাদনা সম্পর্কে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বে তাঁর সান্নিধ্যে এসে সম্পাদনাগুণ ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। নবীন ও সম্ভাবনাময় কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি ছিল তাঁর সহজাত দুর্বলতা। সর্বদা তিনি তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছেন কালি ও কলমে লিখতে। লেখা ও লেখার বিষয়ে অভিনিবেশ, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তথ্য যাচাই, লেখকের বক্তব্য সম্পর্কে একজন সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত – এ-সম্পর্কে আমাকে নতুন করে দীক্ষা দিয়েছেন তিনি। রচনা নির্বাচনে কোনো সংকট দেখা দিলে যৌথ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতাম আমরা। কালি ও কলম সম্পাদকমণ্ডলীর যৌথ কর্ম এবং আনিসুজ্জামানের অভিভাবকত্বে ও প্রযত্নে কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকা হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা। জন্মলগ্নে আমরা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা স্থির করেছিলাম, কালি ও কলম সাহিত্য পত্রিকাটি হবে বাংলা ভাষার সাহিত্য পত্রিকা, সেজন্য পশ্চিমবঙ্গের সৃজনশীল ও মননশীল লেখকদের লেখাও আমরা ছাপব। অনেক বিরূপতা ও সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে এই সম্পাদনা-নীতির জন্য। তবু আমরা সে-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি। এক্ষেত্রে আনিসুজ্জামান যে-নীতি ও আদর্শের চিন্তা করেছিলেন আমরা তা সর্বাবস্থায় মান্যজ্ঞান করার চেষ্টা করেছি।
পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত কলকাতাতে, পত্রিকাটি আদৃত হচ্ছে। এই সময়ে দেখেছি কলকাতার সারস্বত সমাজেও তিনি সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব ও গবেষকের মর্যাদা পেয়েছেন তাঁর চিন্তার গভীরতা ও বিশ্লেষণের দক্ষতার জন্য। তাঁর স্বভাবমাধুর্য অনেক মানুষকে আকর্ষণ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের মননজগতে তিনি তাঁর গবেষণাকর্মের জন্য যে মর্যাদা ও সম্মান অর্জন করেছিলেন তাও ছিল তাৎপর্যময় ও বিরল। তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন তাঁর উদারনৈতিক চিন্তাধারা ও বাঙালি জীবনের ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদী ধারার ভাবুক হিসেবে। আমার তো কেবলই মনে হতো, ড. আনিসুজ্জামানকে পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও বিদ্যাচর্চার মানুষেরা অনেক অধিক গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি ও অনুধাবন করত। তাঁর অন্বেষার মধ্যে দেখতে পেয়েছিল ব্যাপক অর্থে এক আধুনিক গবেষকের বৈশিষ্ট্য। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত একদা তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ‘একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রবন্ধকার’ বলে।
বিশেষত ভাবুক ও ভারতের জাতীয় অধ্যাপক এবং বাঙালির ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা ড. নীহাররঞ্জন রায়, স্বপন মজুমদার ও মানব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে সমকালীন মননজগতের শ্রেষ্ঠ গবেষকের মর্যাদা দিয়েছিলেন। স্বপন মজুমদারের মতো বহুগুণের অধিকারী মানুষ সত্যিই বিরল। তাঁর পাণ্ডিত্যখ্যাতি উচ্চতা অর্জন করেছিল। গবেষণায় ছিল প্রবল তৃষ্ণা, কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা। স্বপন মজুমদার ছিলেন কলকাতায় আনিসুজ্জামানের অকৃত্রিম বন্ধু ও তাঁর পাণ্ডিত্যের অনুরাগী। অন্যদিকে রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ আবু সয়ীদ আইয়ুবের স্নেহধন্য ও নিত্যদিনের সঙ্গী।
বিদেশ থেকে, সম্ভবত অক্সফোর্ড থেকে আনিসুজ্জামান ও স্বপন মজুমদারের সম্পাদনায় একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হবার কথা ছিল। কাজের অগ্রগতিও হয়েছিল। সেজন্য স্বপন মজুমদার ঢাকায় এসেছেন কয়েকবার। আমাদের দুর্ভাগ্য, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আকস্মিকই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্ট। সেই থেকে এখন পর্যন্ত তিনি শয্যাশায়ী। এই পণ্ডিত ও বিদ্যাচর্চার মানুষের এহেন অবস্থায় আনিসুজ্জামান হৃদয়ে খুব আঘাত পেয়েছিলেন। বন্ধু ও প্রাবন্ধিক হায়াৎ মামুদের সৌজন্যে তাঁর সঙ্গেও আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল। ঢাকায় এলেই তাঁর সঙ্গে আমরা সান্ধ্য-আড্ডা দিয়েছি পুরান ঢাকায়। বিশেষত পুরানা পল্টন ও ওয়ারী নিয়েও তাঁর কৌতূহলের অন্ত ছিল না। আনিসুজ্জামান যতবারই কলকাতায় গেছেন, ঢাকা ফেরার পথে বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় কলকাতার বিধান শিশু উদ্যানের ফ্ল্যাটে চলৎশক্তিহীন ও বাকরহিত স্বপন মজুমদারকে একবার দেখে আসতেন।
তিনি পশ্চিমবঙ্গের বহু তরুণ গবেষককে গবেষণাকর্মে অনুসন্ধান, তত্ত্ব ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে দীক্ষা দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কাজের সূত্রে বেশ কয়েকবার কলকাতা ও আগরতলা ভ্রমণ করেছি। আগরতলায়ও তিনি সম্মান পেয়েছেন সেখানকার বিদ্যাচর্চা ও সৃজনশীল উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট অনুজ বন্ধুদের। এই শহরের প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে খবর পেলেই চলে আসতেন তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাঁর সান্নিধ্যে অনেকেই প্রীতি ও প্রসন্নবোধ করেছেন। কলকাতায় তাঁর বন্ধুমণ্ডলী ছিল বৃহৎ; বহু বিচিত্র বন্ধুজনকে সঙ্গ দিয়ে আনিসুজ্জামান তাঁদের চলার পথে রেখাপাত করেছেন। সকলেই যে খ্যাতিমান গবেষক বা পাণ্ডিত্যখ্যাতিতে উজ্জ্বল ছিলেন, তা নয়।
২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন আগরতলার বিশিষ্ট সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। শুধু যে সাংবাদিক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরি করে দিনের পর দিন সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন তা নয়, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তাঁর গৃহটি অনেক যোদ্ধার জন্য অবারিত ছিল এবং বহুজনকে তিনি আশ্রয় ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই বন্ধু ও সুহৃদে পরিণত হয়েছিলেন। বহু মুক্তিযোদ্ধা এ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ঢাকায় এসে পৌঁছলে ড. আনিসুজ্জামান ওঁর স্ত্রীকে সান্ত্বনা ও মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানকে যথাযথ সম্মান জানানোর জন্য অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, অন্যদিনের নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহ নাসের ও আমাকে নিয়ে একদিনের জন্য হলেও আগরতলা যাবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আমি তাঁকে জানাই, আমার আগরতলার ভিসা নেই। সেদিন হাইকমিশনের ভিসা বিভাগের ছুটি। ভিসা পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তিনি আমার পাসপোর্ট নিয়ে সেই বন্ধের দিনেই ভিসা সংগ্রহ করেন। পরদিন আমরা চারজনে মাজহারের গাড়িচালনা ও ব্যবস্থাপনায় আগরতলায় যাই। সদ্য স্বামীহারা অনিল ভট্টাচার্যের স্ত্রী বাংলাদেশের মানুষজনকে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আনিসুজ্জামানের এই স্বভাবসৌজন্য বহু মানুষের দুঃখ, কষ্ট ও মৃত্যুশোক লাঘব করেছিল। সেই সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্য আমাদের হোটেলে অনেকেই এলেন। সেই আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন শহরের বিখ্যাত ব্যবহারজীবী শুভাশিষ তলাপাত্র (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) ও অরুণোদয় সাহা (আগরতলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য)। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত চলেছিল এ-আড্ডা। অনেকের নাম আজ আর মনে নেই। কিন্তু সকলেই তাঁর সান্নিধ্য পাবার জন্য এবং সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ে আলাপচারিতায় উন্মুখ হয়েছিলেন।
আগরতলার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে তাঁর সংযোগ হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সাবরুম সীমান্ত দিয়ে তিনি আগরতলায় প্রবেশ করেছিলেন। সেখানে আশ্রয় নেওয়ার পরই তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। ’৭১-এ তাঁর নানামুখিন কর্মপ্রবাহের বিস্তারিত বিবরণ আছে আনিসুজ্জামান লিখিত আমার একাত্তর গ্রন্থে। ২৬ এপ্রিল সীমান্ত অতিক্রমের পর তিনি কিছুদিন ছিলেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একটি পরিত্যক্ত হোস্টেলে। সে-সময়ে তাঁর আগরতলায় আশ্রয় গ্রহণের কয়েকদিনের যে-ছবি এঁকেছেন আমার একাত্তর গ্রন্থে তাও খুব হৃদয়গ্রাহী ও তথ্যসমৃদ্ধ। সেখানে পাই জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, মাহবুব আলী চাষী ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে। যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের মনোভঙ্গি কী ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর বিবরণে। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক সাবরুম সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরাও তাঁর বর্ণনায় সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন।
শিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগ গভীর ছিল। চিত্রকলার নানা প্রবণতা সম্পর্কে তাঁর জিজ্ঞাসাও কতটা প্রখর ছিল তা আলাপচারিতা ও চিত্রকলার প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ শুনে উপলব্ধি করেছি। নবীন ও প্রবীণ চিত্রকরদের বহু প্রদর্শনী তিনি উদ্বোধন করেছেন। এসব প্রদর্শনীতে তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী ও অর্থবোধক ভাষণ দিয়েছেন। এসব ভাষণে পরিস্ফুট হয়ে উঠত চিত্রকলার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা। বহু নবীন চিত্রকর তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে পথ চলেছে। বহুজনকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সম্মিলনে নিজস্ব চিত্রশৈলী গঠন করতে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ ছিল বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। এই আনন্দঘন দিনটিকে স্মরণ ও উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে এ-বছরকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই আলোকে কালি ও কলমের বিগত জানুয়ারি ২০২০ সংখ্যাটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য সংখ্যা। এই বিশেষ সংখ্যাটির প্রস্তুতিপর্বে আনিসুজ্জামানের শরীর ছিল ব্যাধিজর্জর। তবু তিনি এসেছেন আমাদের আপিসে এবং দু-একটি লেখা সম্পাদনা করেছেন ও লেখকের তথ্যবিভ্রাট সংশোধন করে দিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য সংখ্যার প্রস্তুতিপর্বে তাঁর উপদেশ ছিল আমার পাথেয়।

শুধু আত্মস্মৃতি নয়, সময়েরও দর্পণ
প্রথমা প্রকাশন থেকে তাঁর স্মৃতিকথাভিত্তিক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল বিপুলা পৃথিবী শিরোনামে। এটি তাঁর স্মৃতিকথার তৃতীয় খণ্ড। শৈশব থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়ের কথা তিনি লিখেছেন কাল নিরবধি গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন আমার একাত্তর গ্রন্থে। আর ৫১৮ পৃষ্ঠার বিপুলা পৃথিবী স্মৃতিকথায় লিখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের (১৯৭২-২০০০) কথা। গ্রন্থ-প্রারম্ভে লেখকের ‘নিবেদন’ অংশে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কী ছিল তাঁর অভিপ্রায় : ‘… নিজের সম্পর্কে জানানোটা জরুরি নয় কিন্তু যা দেখেছি, যা শুনেছি, তার অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ।’
বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সময়টি নানাদিক থেকে পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি ছিল। সময়টি ছিল বহু সমস্যায় দীর্ণ ও কণ্টকিত। যে-কোনো সৃজনশীল সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ মানুষকে এ-সময়ে নিজের সঙ্গে, কখনো সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অবস্থান কোথায় তা বুঝে নিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হলেও দেশ ও বিদেশের নানা চক্রান্তের ফলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যা ও পরবর্তীকালে ক্যু-পালটা ক্যু এবং সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল অফিসারদের হত্যা খুবই হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে। এই সময় বলবৎ ছিল সামরিক শাসন। দেশ, সমাজ ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে, রাষ্ট্রের অঙ্গীকার ও মূলনীতিকে উচ্ছেদ করার প্রয়াস হয়েছিল। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল মননজীবী নাগরিকদের কষ্ট ও হৃদয়ের যন্ত্রণা বড় বেশি পীড়িত করেছিল দৈনন্দিন জীবনকে।
তাঁর স্মৃতিকথা কখনোই তাঁর আত্মস্মৃতি নয়, বরং তাঁর সময়ের সমাজদর্পণ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটি ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল হয়ে উঠেছে। আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধকালে ও স্বাধীনতার পরে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা পাঠ রচনায় তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। যুক্ত হন প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে। অনেক ঘটনা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই স্মৃতিকথায় তিনি স্থান দিয়েছেন অপ্রিয় কিছু বিষয়কেও। পাঠক সেগুলো থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন সমাজ-প্রগতিকে বাধা দিতে সে-সময়ে পরিপার্শ্ব থেকেও কত রকমের বিরূপতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। সেসঙ্গে চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথাও এই গ্রন্থে রয়েছে।
কারা ছিলেন এই পর্বের কুশীলব, দেশের অভ্যন্তরে কীভাবে চক্রান্ত হয়েছিল, সে-কথাও সবিস্তার উল্লেখ করেছেন আনিসুজ্জামান। তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে এমন কিছু কথা বলেছেন যা খুব যথাযথ।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর একদিকে জাতি ও রাষ্ট্রের বিকাশে যে অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা অচিরেই বিনষ্ট হয়েছিল। চক্রান্ত করে এই বিকাশকে কেন রুদ্ধ করা হয়েছিল, এই গ্রন্থের স্মৃতিচারণের সঙ্গে নির্মোহভাবে তা বিশ্লেষণ করেছেন। আনিসুজ্জামানের বইটি এ-কথা উপলব্ধি করতে শেখাল যে, আত্মকথায় ব্যক্তির উন্মোচন হয়। এই উন্মোচন সময় ও পরিপার্শ্বকে ধারণ করে এমন কিছু চিহ্ন রেখে যায়, যা অমোচনীয় হয়ে গেঁথে থাকে। উপলব্ধি ও বোধের ক্ষেত্রে নবীন মাত্রা যোগ করে।
আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সাহিত্যভুবনের বৃহত্তর পরিমণ্ডলের এমন এক ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে এই অঙ্গনের। যে-কোনো পাঠক সময় ও কালের নানা ঘটনাবলির আস্বাদ পাবেন এই গ্রন্থে। এই সংকটের তীব্রতা গ্রহণ কিংবা বর্জন করবেন বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজবিকাশের ধারাকে উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ করায় কেউ প্রয়াসী হলে তাঁকে এই সময়খণ্ডকে জানতে হবে। এ নিয়ে নানাধরনের বিভ্রান্তি আছে এবং সত্যিকার ঘটনাকে আড়াল করার প্রয়াসও আছে। সেদিক থেকে আনিসুজ্জামানের নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ এবং গ্রন্থে বর্ণিত সময়খণ্ডে ব্যক্তি ও সমাজের সংকট উন্মোচন কখনো বা প্রসঙ্গত অতীতকে ফিরে দেখা ও ভবিষ্যতের দিকে দৃকপাত খুবই জরুরি।
বিপুলা পৃথিবীর এক অংশে আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘এসব লেখার এই এক দায়। সামনের কথা লিখতে শুরু করলে পেছনের কথা আবার ভিড় করে আসে। তখন ফিরে তাকাতে হয়।’ লেখককে যেমন রচনার ধারাবাহিকতা রক্ষায় পেছনে ফিরে তাকানোর বিড়ম্বনা সইতে হয়, তেমনই আজকের পাঠক ও অনাগত পাঠককে এগিয়ে চলার সানন্দে ফিরে তাকাতে হবে বইটির দিকে। তাঁর স্মৃতিকথার আলোচ্য সময়পরিধি বাংলাদেশের বাঙালির জন্য মসৃণ ছিল না। দ্বন্দ্ব, দোলাচল এবং সামাজিক অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে একটি জাতি দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পথ নির্মাণ করে চলেছে। এই পথচলা, সম্ভাবনা নির্মাণ ও সৃষ্টির কথা আছে এই তিনটি গ্রন্থে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও মৌল প্রত্যয় উপলব্ধির জন্য ভিন্ন তাৎপর্যে বিপুলা পৃথিবী অবশ্যই পাঠ্য, এমন কথা হয়তো বলা যায়।

তাঁর কোনো খেদ ছিল না
২০১৭ সালে আশি বছরের জন্মদিন উদ্‌যাপনকালে তিনি যে সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী বক্তব্য দেন তাতে এই প্রজ্ঞাবান মানুষটির জীবনদর্শন, অঙ্গীকার ও দায় ভিন্ন চেতনা নিয়ে প্রতিফলিত হয়েছিল। ড. আনিসুজ্জামানের বিনয় ও সৌজন্য ছিল অনুকরণযোগ্য ও শিক্ষণীয়। আমরা তাঁর এই বক্তব্যে বিদ্যাবত্তায় নিয়োজিত দীর্ঘদিনের সাধনার যেমন পরিচয় পাই, তেমনি দীর্ঘদিনের জীবনযাপনের প্রত্যয়দীপ্ত এক দলিল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন –
ফেব্রুয়ারি মাসে আমার জীবনের আশি বছর পূর্ণ হলো। এতদিনে নিজেকে বিজ্ঞ বলে দাবি করার সুযোগ পাওয়া গেল।
সত্তর বছর বয়স্ক লোকের শোক সংবাদ পড়ি কাগজে : বার্ধক্যজনিত রোগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আমি তো আশি পেরোলাম, আমার ক্ষেত্রে কী বলা হবে? অতিবার্ধক্যজনিত? অথচ নিজেকে আমি বৃদ্ধ ভাবতে পারি না। জীবনতৃষ্ণার দিক দিয়ে আমি এখনো তরুণ, তবে আধুনিক প্রযুক্তির সামনে দাঁড়ালেই বুঝতে পারি, আমি মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য।
বহুকাল আগে একটি রুশ একাঙ্কিকার বাংলা ভাষ্য রচনা করেছিলাম। তাতে নায়ক এক জায়গায় দৃপ্তকণ্ঠে বলছে, ‘শুধু দীর্ঘজীবনের কোনো বিশেষত্ব নেই যদি না জীবনে চমৎকারিত্ব থাকে।’ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে এসে সে-ই আবার বলেছিল, ‘বেঁচে থাকার চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে!’ আট দশক ধরে আমি যে সেই আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছি, তা আমার পরম সৌভাগ্য। নিজের সুদীর্ঘ জীবনের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন দেখি কতজনের কাছে সে জীবন ঋণে ভরা। প্রত্যেক মানুষেরই প্রথম ঋণ পিতা-মাতার কাছে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। নিজের জীবনের উদাহরণ নিয়ে আব্বা আমাকে সময়ানুবর্তিতা শিখিয়েছিলেন। মা শিখিয়েছিলেন সত্যানুবর্তিতা। জীবনে যে এ দুয়ের ব্যত্যয় করিনি এমন কথা বললে মায়ের শিক্ষাকে অপমান করা হবে। দেশ ও ভাষার প্রতি মায়ের ছিল বিশেষ অনুরাগ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাকে ও আমার এক দঙ্গল বন্ধুকে পেটভরে খাইয়ে মা রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন, আমাদের কাউকে পুলিশ ধরলে কী করতে হবে। ভাষা-আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনার গড়ে উঠলে আব্বাকে নিয়ে মা সেখানে গিয়েছিলেন এবং আমার মৃত এক ছোট বোনের স্মারকস্বরূপ যে-সোনার হারটি তাঁর কাছে সঞ্চিত ছিল, শহিদ মিনারে তা নিবেদন করে এসেছিলেন।
ভাষা-আন্দোলনের অল্পকাল পরে আমি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি। সে সংযোগ বছরপাঁচেকের বেশি স্থায়ী হয়নি। তবে ওই সময় বামপন্থার যে-শিক্ষালাভ করেছিলাম, তা জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালের জন্য গঠন করে দিয়েছিল। ওই শিক্ষা না পেলে আমি আজকের আমি হতে পারতাম না।
জগন্নাথ কলেজে অজিতকুমার গুহ ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর কাছ থেকে প্রথম পেয়েছিলাম রবীন্দ্র-সাহিত্যের শৃঙ্খলাবদ্ধ পাঠ। নারায়ণচন্দ্র সাহা জাগিয়েছিলেন ইতিহাসে আগ্রহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র স্নেহ ও উৎসাহ পেয়েছি। মুহাম্মদ আবদুল হাই দিয়েছিলেন গবেষণার প্রবর্তনা। মুনীর চৌধুরীর সাহিত্যরুচি ও জীবনবোধ আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর যাঁর শ্রেণিকক্ষের ছাত্র না হয়েও তাঁর অফুরন্ত জ্ঞানভাণ্ডারের অকৃপণদানে সমৃদ্ধ হয়েছি, তিনি আব্দুর রাজ্জাক। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের প্রীতি ও শুভেচ্ছা আমাকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছে।
আমার বিদেশি বন্ধুদের মধ্যে আনোয়ার আবদেল-মালেকের কথা বিশেষ করে বলতে চাই। পাঁচ বছর ধরে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করে পৃথিবীর নানা দেশে যাওয়ার ও নানা বিষয়ের পণ্ডিতদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং আমার নিজের বিদ্যায়তনিক শৃঙ্খলার বাইরে অনুশীলন করার প্রেরণা দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে আরো দুটি কথা বলি। আমি একবার তিন মাস প্যারিসে থেকে তাঁর সঙ্গে মিলে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করি। বয়োজ্যেষ্ঠ বলে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম আগে দিয়েছিলাম, নিজের নাম পরে। বইটা যখন লন্ডনে ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশ পেল, তখন দেখলাম, আমার নাম প্রথমে, আনোয়ার আবদেল-মালেকের নাম শেষে। জামাল আবদেল নাসেরের শাসনকালে আনোয়ার আবদেল-মালেক মিশর ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যেতে বাধ্য হন। প্যারিসে তাঁর ড্রইংরুমে প্রথম ঢুকে দেখলাম, ম্যান্টেলপিসের ওপরে নাসেরের প্রতিকৃতি বাঁধিয়ে রাখা। আমি আনোয়ারকে বললাম, নাসের না আপনাকে দেশছাড়া করেছেন? তিনি বললেন, নাসের আমার প্রতি অন্যায় করেছেন; কিন্তু তিনি দেশের জন্য যা করেছেন, কোনো মিশরীয় তা কখনো ভুলতে পারবে না। এমন মানুষের সাহচর্য চিত্তবৃত্তির প্রসার না ঘটিয়ে পারে না।
আগের কথায় ফিরে যাই। আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকেও যে আমি কিছু শিখিনি, তা নয়। তবে তাদের নিরন্তর ভালোবাসা এবং আমার অধিকাংশ সহকর্মীর সমর্থন আমার শিক্ষকজীবনের চলার পথ সুগম করেছে। আমার সন্তানেরা কখনো আমার সাধ্যাতীত কিছুর দাবি জানিয়ে আমাকে বিব্রত করেনি। পারিবারিক জীবনের সকল দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার স্ত্রী আমাকে নিজের মতো চলার ও কাজ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। তারপরও আমার যতটা করার ছিল, আমি তা করতে পারিনি। জীবনের শেষদিকে এসে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আফসোস করতেন, ‘আপনি তো আর লেখাপড়া করলেন না!’ তাঁর মতো মানুষের প্রত্যাশা যে আমি পূরণ করতে পারিনি, তা আমার জন্য দুঃখের বিষয়। ভেবে দেখেছি, আশানুরূপ কিছু করতে না পারার তিনটে কারণ আছে আমার। সামাজিক অঙ্গীকার পূরণের চেষ্টা, আমার স্বাভাবিক আলস্য এবং অস্বাভাবিক আড্ডাপ্রিয়তা। সামাজিক কর্তব্যবোধ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেজন্য সময় দেওয়াটা আমি কখনোই সময়ের অপচয় মনে করতে পারিনে। নিজের আলস্য অবশ্য ক্ষমার অযোগ্য। আমার বন্ধুচক্র বিশাল : তাদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার জীবনের প্রশান্তির একটা বড় উৎস। তাই যদি বলি, কোনো খেদ নেই, তা হলে মিথ্যে বলা হবে না।
আমি শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম – সেক্ষেত্রে প্রাপ্যের অধিক লাভ করেছি। আমি সারাজীবন ছাত্র থাকতে চেয়েছিলাম – আমার যথাসাধ্য শিখতে চেষ্টা করেছি। জীবনে চলার পথে অপ্রত্যাশিত আঘাত যে পাইনি তা নয়, কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি। আমার খেদ থাকার কথা নয়।
তারপরও খেদের কথা একটু বলি। বাংলা একাডেমির পরিকল্পিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা – এটি অবশ্য আমার একার ওপর নির্ভর করে না এবং আমার কয়েক দশকের পরিকল্পিত পুরনো বাংলা গদ্য-সংকলনের কাজ যদি শেষ করে না যেতে পারি, তা হলে আমার দুঃখ রয়ে যাবে।
যাঁরা আজকের এই অবিস্মরণীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তাঁদের সকলকে বিশেষ করে, উদ্‌যাপন-কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের, চন্দ্রাবতী একাডেমী এবং এই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক-প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। এই সভার সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, বক্তাদের সহৃদয়তার জন্য, সংগীতশিল্পীদের অংশগ্রহণের জন্য, সঞ্চালককে তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য এবং আপনারা যাঁরা উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানের পূর্ণতা সাধন করেছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ। শিশু-শিল্পীদের ভালোবাসা। আজ যে বইটি প্রকাশ পেল, তার জন্য সম্পাদক ও লেখক ও প্রকাশকের কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম। আমার নিন্দুকেরা যদি একটি রচনা-সংকলনের সময় ও সুযোগ পেতেন, তবে আমার পরিচয় সম্পূর্ণ হতো।
এখন আমার আর কী চাইবার আছে! আসলে মানুষের চাওয়া শেষ নেই। আমি চাইব, আপনাদের ভালোবাসা যেন আমার বাকি দিনগুলো ঘিরে রাখে।
বাংলাদেশের মাটিতে আমি জন্মগ্রহণ করিনি। তবে এই মাটিই যেন আমার শেষ আশ্রয় হয়, এই আমার অন্তিম প্রার্থনা।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়, আশি বছরের জন্মদিনে তাঁর এই বক্তৃতা এবং সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবন-দর্শন, মানব-কল্যাণে তাঁর নিবেদন, পিতা-মাতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং পরিপার্শ্ব নিয়ে ভাবনার যে প্রকাশ তা আমাদের এই মানুষটির দায় ও ব্যক্তিস্বরূপকে গভীরভাবে চিনিয়ে দেয়। সারাজীবন গবেষণা ও মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ব্যাপৃত ছিলেন বহুধারার কর্মে। তাঁর সঙ্গে আমার রাষ্ট্র ও সমাজের অসংগতি এবং সাম্প্রদায়িকতার উত্থান নিয়ে ভাববিনিময় হতো। এ নিয়ে বিচলিত বোধ করলেও কোনোদিন হতাশা প্রকাশ করেননি। হয়তো মানবধর্মে তাঁর আস্থা ছিল।
শৈশবকালে কলকাতায় ড. আনিসুজ্জামান দেখেছিলেন নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ-কালের শ্রেষ্ঠ এক দার্শনিক ও ভাবুক অমর্ত্য সেনও ঢাকায় দাঙ্গার বীভৎস রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একজন দেখেছিলেন হতদরিদ্র দুধবিক্রেতাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে, অন্যজন দেখেছিলেন এক রাজমিস্ত্রিকে নৃশংসভাবে হত্যার দৃশ্য। সেই যে এক হৃদয়ক্ষত ও অভিজ্ঞতা, তা নিয়ে সমগ্র জীবন ভেবেছেন তাঁরা। মানবিক সমাজ নির্মাণ ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির আলোছায়ার প্রতি শ্রদ্ধা ও উপলব্ধি তাঁদের ভাবনালোকে বোধকরি নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছিল।