ইশ্কুলে যাবার পথে সেই বিষণ্ন রেললাইন, দুই সতীনের মতো পাশাপাশি অথচ গায়ে গায়ে চিরফারাক, গনগনে রোদ্দুর আর অসূয়া নিয়ে জাজ্বল্যমান সারা দিনমান, কঠিন হৃদয়হীন দুটো টানা ল¤¦া ইস্পাতের পাত। লাইনের হুই ওপারপানে ধাঙড়দের ঝুপড়ি, পোড়া কয়লার ডাঁই, নাকের পোঁটা বের করা ইল্লিবিল্লি কালো কালো ন্যাংটোপুঁটু আর গুমুতমাড়গোলানো বুঁদ গেরেম্ভারী বাতাস। সেই বাতাসের ক্বলিজা চিরে মাঝে মাঝে ফিক দিয়ে ওঠা নারকীয় মৃত্যুচিৎকার আঠালো রক্তের মতো টানা হিম ধরানো থেকে থেকে দমক মারা গোঙানি। এগারো বছরের মানাফের চোখের উপর সারাদিন ভাসমান আগুনে লাল লোহার শিক, শূকরের থলথলে পাঁজরবাগে ফোঁড়ানো আমূল, বিজাতীয় আর্তনাদ, ডিমা ডিমা ডিডিম ডিম ঢোলকের বোল, মাতাল ধাঙড়দের খেউড় আর রোদভাজা ঝাঁ ঝাঁ লু’য়ের ঝাপট। এগারো বছরের মানাফ, এই বেওয়ারিশি বয়েসে একলা কিশোররা কোথায় গল্পের বই পড়ে খালামনিদের নেশায় মজে মার্বেল জমায় পায়খানায় বসে হস্তমৈথুন রপ্ত করে, তা না ইশ্কুল থেকে ঘরে ফিরে একদিন এক ঝিমদুপুরে লোহার শিক তাতিয়ে লাল বানিয়ে ঘুমন্ত গর্ভিনী বেড়ালের ভরাপেটে ফুঁড়ে দিল। মাদী বেড়ালটা ঘোলারঙা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছিল মানাফের মুখের দিকে। গ -র্ -র্ -র্ ! বুকভেদী যন্ত্রণার ঘষা আওয়াজ। খামখা খতম করে দিলে আমাকে? আমি কী করেছি? এ কী তুমি ছোটভাইয়া! দার্শনিকের চোখমুখ নিয়ে বেড়ালের অপঘাতমৃত্যু দেখতে থাকে কিশোর মানাফ। লাল শিক কালো হয়ে গেছে ততক্ষণে। টেনে বের করে আনে অল্প আয়াসে। পনীরের ডেলার ভিতর থেকে চাকু বার করে আনে যেমন স্বল্পায়াশে। রক্তের পাতলা লাল কাদা। সিঁড়ির নিচে ভাঙা মুরগির খাঁচায় তালগোল পাকানো ছেঁড়া তোশক। উপচানো তুলোর ভেতর গুঁজে দেয় বাসি শিক। ইলিশের ঝোল মেখে ভাত খেতে বসে মানাফ।
মানাফ এক আধফোঁটা বা তারিয়ে তারিয়ে ফুটে উঠতে থাকা ভাঁটিফুল যেমন বা। এই কৈশোরক জালিবেলায়, নাকের নিচে নম্র রোমরেখার ডাবজলসদৃশ আভাস, দুচোখের কোণায় এখনো মাতৃজরায়ুর কোমল মায়াজল ও নাসারন্ধ্রে বাদল-উঘারিত ভাঁটফুলেরই বড় আপন স্থূল মদির গন্ধ। কে না গলতে চাইবে কাজীবাড়ির এই খুব চুপচাপ আপনগোঁজা মেয়েলি ছেলেটিকে নিয়ে দুদণ্ড খানিক নখরাবাজিতে ভুলতে? বাড়ি থেকে ছাড়িয়ে একটু হেঁটে গেলে বাঁদিকে ওধারে পোড়ো মাঠ, একেবারেই উচ্ছন্নে যাওয়া ফাঁকা সুমসাম। একটা ভাঙা বাড়িতে তক্ষকদল কিলবিল করে, লালু মাস্তান খুনজখম করে এসে ফাটা শানের উপর শুয়ে পায়ের ডিম নাচায়, তক্ষকদের কটকট কটাশ গান শোনে। চান্দিফাটা দুপুরে ওপরতলার শাহী আপা নিচেয় নেমে এসে মানাফের সামনে খামি দিয়ে দাঁড়ায়, দুমিনিট তিনমিনিট, কোনো কথা বলার দরকার হয় না, বাড়ির গেট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে যায়। মানাফ তাকিয়ে দেখে চারপাশ ফাঁকা। মা তার দুঃখী মাজননী ভেতরের ঘরে বসে নিত্যনৈমিত্তিক কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত। এই কাঁথা তার বাবা রাউজান কাজীর বৈধ লাম্পট্যের চিরআকসি¥ক অবদান। ছোটবউ কোহিনুরকে নিয়ে তার ভরভরাট সংসারমহল চাঁদনীপাড়ায় চারতলা বিল্ডিংয়ে। প্রতিমাসে একবার করে আসে গাড়িভর্তি বাজারঘাট নিয়ে পাড়ামহল্লায় ঝাঁ চকচক চেকনাইয়ের জানান দিতে দিতে, পাড়ার উঠতি বেকারদের কাজের লোভানি দিয়ে, মানাফ ও ভাইবোনদের মজার মজার দিশী গিফ্ট্ গছিয়ে, আর কয়েকটা রাত বড়গিন্নী মেরুন বেগমের ঢালাও জমিন চষে পাতোখোলা বানিয়ে প্রতি বছর একটি করে বীজ রুয়ে রেখে যায়। তার বেশির ভাগই আঁতুড়ে নিকেশ যায়, ক্বচিৎ একটিদুটি টিকে গিয়ে ঝড়েজলে ফনফনিয়ে ওঠে। টিকুক না টিকুক, নাড়ির নিধিধন বলে তো কথা, মেরুন প্রতি খ্যাপে একেবারে বুনো অপত্যে উদরের খালাসপর জাতকের জন্যে ছোট ছোট কাঁথা পিরেন ইত্যাদি সেলাইয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। লালনীলসবুজ সুতোর বিনুনিতে কত সব চিত্রকথা কত রঙমেশাল স্বপ্নের তালিতাপ্পি! দুচোখে নেমে আসে শ্বাস মেশানো বাহ্যলোপী ঘোর। সেই ঘোরের ছায়ায় বাইরের দৃশ্য ব্যাকসিনে চলে যায় আর মানাফ চুরি চুরি উৎকণ্ঠায় গেট পার হয়, একদমে দৌড়ে আসে শাপ লাগা বাড়ির সীমানা চৌহদ্দিতে। সেখানে শাহী তাকে ইতলবেতল ঝুমঝুমের গপ্পো শুনিয়ে বশ করে, দুষ্টুমি করে কানের লতি কামড়ে দেয়, কষা ঝাল মেশানো আমমাখার ভাগ দেয়, বলে বড় হলে মানাফকে নিয়ে একদিন একেবারে নিঃসাড়ে সেঁধিয়ে যাবে সীতামাতার অতল পাতালে। রাতের বেলা ঘরে ঢুকে বেকার ছোটমামা তার বুকদুটো পাম্প করে করে ফুলিয়ে দেয়। একদিন শাহী খবর দেয়, হেই শোন্ শোন্ – ছোটমামা না একটা ডব্কীরে বিয়া করে আনছে – নতুন ছোটমামী রে – বোকাডা বুঝলিনে? অখন নতুন জিনিস পাম্প … এফ্ … বাঁচোয়া বাব্বা …! রোজ রোজ কাঁহাতক … এঁঃ, দাঁতে কী গন্ধো – গু – গু …..! এই মনু ! মামামামী বেজিবেজি খেল খেলে রোজ দুপুরে খাইয়াদাইয়া দোরে খিল দিয়ে – দেখবি মনু – যাবি আমার লগে কাইলকা ……. এহে হে হে – দেখবি খেল ইংরেজি/ মামামামী বেজিবেজি! হেই যাঃ – দেখবি কোথ্থনে – কপাটে আগল দিয়া খেলে না? মারবো চাঁটি না – ভূত – জানলার জোড়ে ফুকর আছে না? বোলতা ঢোকে আকছার। মদ্দামাগীতে কাপড় খুলে এ মা গো! তাই – তাই নাকি – তা কী করে তারপর শাহী আপা? দেখবি? দেখবি তুই? কইবিনি তো কাউকে? চ উই ভাঙা বাড়ির বগলে সেঁধুই। না বাবা ডর করে, চন্দন রায়ের বেম্মোদত্যি ওইখানে আস্তানা গাড়ছে। মা বলে, সন্ধের পরে ওইখানে তার চোখ জ্বলে গোল্লা গোল্লা। হুঁঃ! দত্যি না হাথি! চ আয় দেখবি মজা! কিন্তু কী ফের! দুই আনাড়ির সেই দুপুরকার বেজিবেজি খেলার ক্লাইম্যাক্স-মুহূর্তে সেদিন হঠাৎ ভুস করে ব্রহ্মদত্যি এসে হাজির। আনগ্ন জোড়ের দিকে দৃষ্টি হেনে বিস¥য়ে ঈর্ষায় অবিশ্বাসে ও সব শেষে দৈত্যোচিৎ উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, বসন ছাড়ারও তর সয় না। মানাফকে নড়া ধরে টেনে তুলে প্রথমে দাঁড় করিয়ে দেয়। তুই রাউজান কাজীর পোলা না? অ্যাঁ! এই বয়েসে ইশ্কুল ছাইড়া রসচোঁ – অ্যাঁ – অ্যাঁ – কী হাল বাংলাদেশের অ্যাঁ! ঘাড়ে রামধাক্কা পোঁদে লাথ্থি, য্যাঃ! ফাট্ – শালা পিচ্চি নাগর! হাফপ্যান্টের গুটলি বুকে সেঁটে নিয়ে বাইরের ইট ওঠা বারান্দায় থুবড়ে পড়ে মানাফ। সেখানেই মাথামুখ জাব্ড়ে থেকে ঘরের ভিতরের ডুকরানি শুনতে পায়; আপনে আমার বাপ লালুভাই – ছাইড়া দিন লালুভাই – ও রে বাব্বা – ও মা গো – আল্লাআল্লাআল্লা …!
ছোট এই শহর, আঁতখসা এলোপাতাড়ি প্রাচীন। নাম জংগীরপাড়। ঢাকার কোচ এখানে থামে, দৈনিক কাগজ আসে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির স্থানীয় সব কাবাবমেহাড্ডি লায়েকরা আছে, দুতিনটে প্রাইভেট কার ও জিপ, ডিশ অ্যানটেনা, আবার মাগীপট্টিও। পুব ঘেঁষে লক্ষ্মীমতী নদী হংসভাসী। দারুণ চোত – বোশেখেও তাপঅনুতাপ নেই। মুখ গুঁজে কুল কুল নিরিবিলি বয়। চাঁদমারীর পেছনে যে ঘাসে ছাওয়া টিলা, মানাফ সেখানে সন্ধেবেলা একলা একা এসে বসে থাকে। সেই ক্লাশ ফাইভের অবোধ দিনগুলি থেকে। লালুর লাথি খেয়ে তোবড়ানো পাছা নিয়ে। এই তার পীঠআসনটিতে এসে অবতার হয়ে বসে থেকে থেকে শেষে ঘূর্ণী – দ’য়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ইত্যাকার সব বেচয়েন প্রশ্ন খরাপীড়িত ডানকুনিঝাঁকের মতো ঠুকরে ঠুকরে খাবি খাচ্ছিল: শাহী আপার শরীরখান কি বেহেশতের মোম দিয়ে বানানো … শাদা মাখনের মধ্যিখানে গোলাপি বোতাম … শাদা জমির নাবালে ঝিলিক দেওয়া পশমের কালো চেরাগ … লালু প্রকাশ্যে একে-৫৭ ঝুলিয়ে গলি গলি মহড়া মারে, ওসিকে চ্যাপ্টা বোতল আনার জন্যে তলব হাঁকে, প্যান্ডেলে উঠে এমপির পাশে বসে ফুলের মালা নেবার জন্যে গলা বাড়িয়ে দেয়, ঐ একে-৫৭-এর মালিকানা নিতে কতগুলো বছর আর ধৈর্য গুণতে হবে …. লালুর নুনু কেটে দেবে গোড়া ধরে পেঁচিয়ে যত্তো মোটা হোক … আর শালা … ভেসে বেরিয়ে যাবে এই পায়খানার চাড়ির গুলজার ফাঁসিয়ে কোনো আকাশঘেঁষা হাওরে একেবারে নিস্তরণ নিস্তলে সেখানে সতী মৃগেলরা কুমারীদেহ লালন করে আর সৃষ্টির আদি শ্যাওলা লালন করে ডাঁই ডাঁই কালো কেশদাম, সেখানে অনন্ত কালের ভিসা বাগিয়ে নিতে পারলে দুচোখের তৃষ্ণা নিয়ে তালডিঙির গলুইতে জমে বসে আমৃত্যু অপার্থিব সব মিশ্র রমণ – অক্লান্ত শৃঙ্গার – চর্বচোষ্যলেহ্যপেয়র ছয়লাপ গাদ গাদ উদ্গার – এইসব মধ্যবিত্ত মরিয়া ইচ্ছেপূরণ দেখতে থাকবে। চুণের নৌকো ভেসে যায় উদাসীন সংসার নিয়ে, পাটাতনের থামকো চুলোয় কড়া হলুদমাখানো ইলিশ রান্নার ম ম, বৈশাখি গুমটে নেতানো ওপারের বিষাদ মাখা ঝুপসি আর এপারের বিকার ও ব্যভিচার ও অন্তঃনাশের হাঁটুর তলায় জিম্মি ধুকধুকি শহর আর ছোটমা কোহিনুর মাথা শুঁকে বলে, তোরে আমি বেরিস্টার বানাবো। দেখিস বাপের মতো মাক্ষীচোষ হবিনি খবদ্দার – ছোটমাকে হাওরে জলেআকশে নিয়ে যাবো আমি আর বাবা রাউজান কাজীর চারতলা বিল্ডিংয়ে উঠে যাবে না কসি¥নকালে। কেন যাবে ? সূতিকারুগীর মতো হংসভাসী বয়ে চলে বিন বিন ঘিন ঘিন, ধুলোজমা ময়লা রাত, হাতপা কামড়ানো অষ্টাবক্র মধ্যবিত্তের নিশিগ্লানি। বেলেজ্যোছনার ফুসলানিতে পড়ে হামিরদিয়ার কদমতেলীর খটমহল ঘোড়া যার নাম ‘বাহা রে দুলদুল’ ডানা মুড়ে টকাটক হেঁটে পার হয়ে যায় হংসভাসী। ওপারে তিন কিলোমিটার দূরে ভানুগাঁতী গ্রাম থেকে আদাইড়া লেঠেলের বাদামি ফারা ফারা ঘোড়া ‘মীরচান’- ঋতুমতী মীরচান নৈশ বাতাসে স্বরসোয়ারী ডাক পাঠায়: চিঁ – হিঁ – হিঁ – হিঁ -! ওপারে গ্রামের সবুজ ঝাড় আর কিছু কিছু মিনমিনে মুখচোরা আলো দেখা যাচ্ছে। চাষি, রংমিস্ত্রি, দুধের পাইকের, খুচরো মুদিদোকানদার, ইউনিয়নকাউন্সিলের কমিশনার, হাতুড়ে হোমিওডাক্তার, থানার দালাল, হাফেজ সাহেবের বোতলে পোরা কোহ্কাফের জ্যান্ত জ্বীন … সব একসঙ্গে বাস করে। এপারে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি সব শালারা মেরে ফাঁক করে। নেতা থানা আর লালু মাস্তান তিনসুমুন্ধির টিকি এক গেরোতে বাঁধা। আকাশের ধোবানীল কালচে হয়ে যেতে যেতে, ইরিব্বাস – কখন যে মেটে হাঁড়ির পোড়া পাছার মতো হুমদোকালোপনা হয়ে এল, ফিনিক ফিনিক রোশনি ছাড়ে চাঁদ তা নেই, পুক পুক করে তারা জ্বলে হেথাহোথা আনতাউড়ি তারো পাত্তা নেই, হাঁসভাসী (প্রাকৃতজনদের লব্জে লব্জে হংসভাসীর হাল যা হবার) নদীর ঘেরাও দিকদিগন্তটুক ঘিরে গাঢ় কৃষ্ণপক্ষ, মানাফ চেতনে অবচেতন। আঁ … আঁ … আঁইহাঁহাঁ আল্লারসুল – এই আউলা জানটা আমার এর কোঁখে অন্দরে কী যে ছুরিবেঁধা দরদ! রক্ত ঝুঁঝে ঝুঁঝে -! আঃ! বেঁচে আছে কি শাহী আপা? গলায় দড়ি দিলে তো চাউর হয়ে যেত এদ্দিনে। এই তেকেলে শহরে হয়ত দড়ি জোটাতে পারেনি, হয়ত গতরের খুন বা তারো চেয়ে খতরনক লাজশরমের মাথা খেয়ে যথাযোগ্য পোক্ত দড়ির নাগালে পৌঁছিয়ে পেরে ওঠেনি। হায় রে বেজিখেলা – হায় সেই ক্ষীরনহরের বেহেশতী বাগিচা!
এই একখান মাত্র আক্কেলগোত্তা খেয়েই দেখ-না-দেখ সেয়ানা যৌবনে উত্রে গেল মানাফ। বছরকয়েকের মধ্যে তলপেটের নিচুতে ভারি কালো পশম, বিনা অ্যালার্জিতে বুকের আগাপাশতলা পাগলা বাতাস। পড়াশোনা লাটে। মা চৈতন ওঝাকে এনে কবচ করায় ঘরবন্দ দেওয়ায়। বাওঝাড়া তন্ত্রমন্ত্রে দেয়ালে দেয়ালে গমকগিটকিরি। রাউজান কাজী শখের ভিজিটে এসে মানাফের ঘাড়ে রদ্দা কষায়, হাঁকার দেয় : সাবালেগ হইছেন? মোচ উঠিছে? বাপের নামে – ইয়ে …! প্রকাশ থাকে যে, মানাফ ইতোমধ্যে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্টে প্রমোটেড ব্যক্তিত্ব। জিলেট রেজরে উল্টো টান মেরে দাড়িমোচের দংগলে ম্যাচিয়োর্ড টোন বের করে এনেছে। ক’দিন আগেও শ্মশানের ফাঁকা পাকুড়গাছে ঠেস দিয়ে বসে দিনেদুপুরে আবুল হাসনাতের সচিত্র যৌনবিজ্ঞান পড়ত। ইদানীং ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি কাটাতে বোনবাড়িতে এসে রায়হান তাকে মার্কস্-এংগেল্সে হাতেখড়ি দিয়ে গেছে। শেখ মুজিব বুর্জোয়া ডিকটেটর, জিয়া-এরশাদ সামরিক ডিকটেটর, খালেদা-হাসিনা ভূয়া গণতন্ত্রী, সব কটা গণশত্রু। পিপল্স্ লিডারশিপ নেই দেশে। সব মিডিয়ার তৈরি হিরো। চার হাতপায়ে লুটেপুটে খাচ্ছে। বিপ্লব বের করে আনতে হবে শ্রমজীবী মানুষের মধ্য থেকে। এখন শুধু প্রস্তুতি বছরের পর বছর ধরে, দুচারটে হাঁসমুরগির গলা ছিঁড়ে, দুচারজন চিমটেচিমসের গলা কেটে থানার সামনে বোমা ফাটিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বা সর্বহারা পার্টির নামে জিন্দাবাদ তুলে অন্ধকারে মিশে যাওয়া। বাংলাদেশের আদর্শবাদী তরুণরা চাকরির ক্রাইসিসে ভুগে ভুগে আন্ডারগ্রাউন্ড সর্বহারা ক্যাডারে নাম এনরোল করায়। হাতে আর্মস্ পেলে সন্ত্রাসী বনে যেতে বাধ্য হয়। অন্যরা মৌলবাদী এক নয়া গ্রুপ বাংলাভাইয়ের দুরমুস পার্টিতে নাম লিখিয়ে জংগীজেহাদী বনে যায়। একজন সাঁতারু ডাইভ দেয়ার আগমুহূর্তে জল থেকে পনেরো ফ্টু উপরে ডাইভিং স্ট্যান্ডের ঠিক জিরো পয়েন্টে সুইমিং পুলের দিকে পিছন ফিরে আকাশে দুহাতের দুডানা মেলে দিয়ে দুপায়ের দুই বুড়ো আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে তির তির করে কাঁপতে থাকে, যৌবনের জিরো জাংকচারে দাঁড়িয়ে পড়ে মানাফও তেমনি ব্রীড়াধ্বস্ত দুরু দুরু। জন্মদাতা রাউজান কাজী পেশায় কন্ট্রাক্টর চরিত্রে লম্পট স্বভাবে ভীতু রাজনীতিতে কারেন্টগামী। তার জৈবাচারের প্রকট সিম্পটম : রোজ রাতে খাওয়ার শেষ পর্বে একবাটি রসমালাই খাওয়ার অভ্যেস তার, একেবারে তলেমূলে চেটেপুটে, ছানাপোনারা টেরিয়ে টেরিয়ে চায়, ঠোঁট চাটে, ড্যাম কেয়ার, গোল্লায় যাগ্গে সব, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, টাকাটা কামায় কে – গতরের লোহু পানি করে – তাছাড়া ফুট্টুস হলেই তো …! এদানীং মুসিবত হয়েছে দুইনিতম্ব আর ভুঁড়ির বেড় নিয়ে। বেঁটেখাটো হওয়ার দোষে সাইডে তেল জমে গেছে বেআন্দাজ। ফলত শৌচকর্মের বেলায় পাছা হাতে পায় না। বাথরুমে খর্চা করে কমোড বসানোর মাজেজা এটি বটে।
এই ডোলমুড়ি দিয়ে টিকে থাকা মিনি শহরে পাদেরও পাঁচকান আছে। কানাকানি হতে হতে তিল তাল হয় গরু আকাশে ওড়ে। রাউজান কাজীর সাগরেদ পট্লা মিয়া তার অধস্তনদের কাছে হাত-পা নেড়ে চোখে কান্চি মেরে জানান দেয় : কেউ শুনলে কিন্তু শিরকোতল … হুঁশ্যার! লালু মাস্তান পাঁচ লাখ টাকার চান্দা কেলেম করছে আমগোর রাজোনছারের ঠেঁই। আরেরেরে ফলনামারীর দল! মোটে নাড়ি চুলকাইবি না – হুঁশ্যার – কথা আরো আছে … লালুভাই মাস্তান গদ্দীর পরে ল্যাটকানো ডাহিন পাশে একে ফিফটিসেভেন আঁইরেব্বাস্ ঊরাতে চাপড় মারি ডেক্লার দেলে টেকা না পাইলে বিবি কোহিনুর নয়তো কোলের গ্যাদা পোলাডা যেডা হোক তুইলা নিয়া যাবোগা। বুঝস অখন, বেব্সা ক্রাচিন – বীচি মাতায়!
কায়দামতো টেনশনে ঠেকে গেলে পরে তবে না বান্দা আদমী বাবাজীর দেহমনের ভেতরকার ধাত ঠিকরে বেরিয়ে আসে। রীতব্যাভারগুলো বাগ মানতে চায় না মালিকের। আলাভুলা ন্যালাঝোলা। পড়শীরা চোখ টিপে বলে কাছাখোলা। রাউজান কাজীর মাশাল্লা সেই হালাত এখন। কোহিনুর বিবিকে তুলে নিয়ে যাবে এটা কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছে। এই নাদুসনুদুস মাংসল মহিলাটি গাহাতপামাথা বানিয়ে দিতে ওস্তাদ। টাচস্টোন। ঘুম পাড়িয়ে দেয়। গভীর রাতে ঠোঁটের নিচে হলুদ পুরু সর জমা দুধের বাটি ধরে ঢোঁকে ঢোঁকে গিলিয়ে দেয়। আর চেতে গেলে মাখালাদের মতো খিস্তি ছোটায় : ভাতার না হাটখোলার নাঙ আমার! আজ রাইতে উঠিস ক্যানো খাটে, জাঁতি দিয়া আঁইটা কেলা গোড়া ধরে …! আহা কী অম্রেতো গাঙপারের মেইয়েলোকের সাচা বচনে! মিঠা পানের পিচকারি! কই যাইগা আল্লামালেক? কিন্তু কোহিনুর তো স্রেফ রসঢলকী অমৃতকলসী নয়, দেড় বছরের কন্যা শাফিয়ারার গর্ভধারিণী মাজননীও বটে। শাফির মধ্যকপালে সিকিসাইজ হামি খেয়ে রাজন কাজীর কোলে বসিয়ে দিয়ে তার বাপের দেশের সেই বিখ্যাত সুরেলা কুয়োল ধরা কান্না জুড়ে দেয় : আমি গ্যালে গ্যালামগে পতিধোন গো! বড়োবিজান আছেন। টেকা আছে সেন্দুকে, তেসরি বিবি এইনে হাউশ মেটাইবেন। কিন্তুক আমার শাফিমা গেইলে কই পাবো গো খসম? কন – কন- জবাব দেন আমারে। শাফি বাপের কোলে বসে মায়ের চিবুকে আঙুল বুলোয়, কচি আঙুলের ডগা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে যায়। পরমেশ্বরের এসব টকঝাল লীলা বোঝে সাধ্যি কার? রাউজান কাজী তার ভাজন ব্যাটা মানাফকে গালি না দিয়ে ডাকতে জানে না। মানাফ দিনরাত বইখাতায় মুখ গুঁজে বসে থাকে। খবিস ঈর্ষায় কুতকুতিয়ে তাকায় রাউজান। ট্যাঁ ফো করে না, কারণ বহুৎ বুজর্গ এলেমদার হেডমাস্টার সাহেব বলেন, পোলার আপনের বেরেন এক্সেলেন! এখন আবার র্পেফেসাররা বলে, মানাফ কলেজের বেস্ট বয়! রাউজানের এত যে জনমভর টাকার খাই টাকার পুড়ুনি, ছেলের লেখাপড়ায় গাঁটের কড়ির অপচয় নেই বরং স্কলারশিপ আর ট্যুইশনির টাকায় মাকে শাড়ি দিনে দেবার পরও দেড়ী রয়ে যায় তাও মাক্খীচোষ রাউজান কাজীর রগ কটকটায়। বাম ঊরুর পেল্লায় গোলাপি বাগী নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নাপিতবাড়ি যায় মানাফ। পরামাণিক-কাম-সার্জন বংকানাপিত নামমাত্র ফি নিয়ে অস্তর করে দেয়। তাতে রাউজানের এসে যায় না কিস্সু। ব্যাংক থেকে হক না হক টাকা তুলে এনে গভীর রাতে গুনতে বসে। গুনে গুনে টাবুটুবু ভুঁড়ির পাশটিতে সাজিয়ে রাখে। আহা! কী সে নুরানী বাৎসল্য ঝরে পড়ে নজর উপ্চিয়ে! সিন্দুকে তুলে রেখে বেড়পাক দিয়ে শুয়ে থাকে বেঁটেবাঁটকুল মানুষটা। পরদিন সকালে গোসল সেরে সাজুগুজু করে তরকারির থলির মধ্যে পাঁচশ টাকার বান্ডিলগুলো পুরে নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে জমা করে দিয়ে আসে। তো এই যে অপত্যদায়হীন এমন একখান অর্থকামুক সাড়ে হারামজাদা মার্কা লোক, দেখুন কী কাণ্ড অসৈরণ, বছরদেড়ী ছুঁড়িটাকে বুকে চেপে ধরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লেগেছে, ন্যালাক্ষ্যাপার হেদিয়ে মরা, চক্ষু ফাটে তো জল সরে না, যেহেতু টাকা জিনিসটাই ধম্মোমোক্ষসর্বস্ব তার কাছে। কন্যারত্ন কেন, নিজের জান বাঁচানোর ফরজ পালনের গরজেও লালু মাস্তানের দাবি মোতাবেক পাঁচলাখ তো দূরের কথা দশখানা পাঁচশ টাকার পাত্তি যে হাতে ধরে ছাড়বে এ-রকম ঘটনা তার নিজের কল্পনাতেই মালুম আসে না।
এ শহরে খুনের ঘটনা নতুন আরেকটি যোগ হলো তবে। রাউজান কাজীর হত্যাসংবাদ টক অব দ্য টাউন। কে প্রথম লাশ আবিষ্কার করে সে-নিয়ে বিতর্ক চলছে দিনভর। তবে অনেস্টলি স্পিকিং, কৃতিত্বটা তার ন্যাওটা কুকুর আকু ওরফে আকিম ও রিকশাচালক জোহরকে ভাগাভাগি করে দেওয়া যেতে পারে। তখন ভোর ফুটে গেছে ভালোমতন। আগের রাতের নিম্নচাপ, তিন নম্বর সতর্কসংকেত, দূরাগত মেঘের ধূসর একটুখানি কানাৎ, পথে পথে পাবলিক তখনো হন্যে হয়ে চলাচল শুরু করেনি। একটা তেলিকদমের আবডালে পাছা ঝুলিয়ে যুৎসই কাম সেরে জলখরচের মতলবে হাঁসভাসীর দিকে পাঁচকদম এগিয়ে … ওঃ … আকুর সে কী নদীমুখো চিৎকার, – পারলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাঝনদীতে। জলখরচ বকেয়া রেখে মানবিক কৌতূহলাক্রান্ত জোহর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে একেবারে স্পটে চলে আসে। ইয়া রাসুল! আধান্যাংটা রাউজান কাজী, জংগীরপাড় শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ঠিকাদার জনাব রাউজান আলী কাজী নদীতীরে রক্তেকাদায় ঘাড় মুচড়ে চিৎপটাং। লুংগি ফর্দাফাই, আন্ডারউইয়ারের হাঁমুখে চিলতেমতন রোদ্দুর ঢুকে পড়ে মহাশরমকাতর, বুকে গুলি ঠ্যাঙে গুলি জবাইফাঁক গলা, সে বড় হিমজমাট চালচিত্র সন্দেহ সেই। লাশ পুলিশে ছোঁবার আগেই কোহিনুর বিবি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বেয়াকুল হাহাক্কারে চিক্কুরে … আঃ গো … আশমান চেরে জমিন ফাটে নদী কান্দে জারেজার : সেই তো আপনে গ্যালেন চইলা টেকার টেকাধন রইল পড়িয়া গো পতিধন … টেকা চাইল টেকা দিলেন না ক্যান … ও মোর আল্লামাবুদ গো সাঁই … ও মোর …! এদিকে আরেক হ্যাপা, সুরতহাল রিপোর্ট লিখতে গিয়ে পুলিশের কলম আটকে যায়, পয়লা নম্বর দেখাসাক্ষী জোহর গাজী ফেরার। আছোঁচা পোঁদে সেই যে পগারপার আর টিকিটি নেই। গোদের পরে অধিকন্তু বিষফোড়া এই যে, কোহিনুর বিবি একজন এএসআই পুংগবের জেরার মুখে বলে বসে, লালু গুণ্ডা মাঝরাতে এসে হামলে পড়ে, হাতে ঝকঝকে অস্তর মুখে কালো কাপড়, শাফির বাজানকে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে যায়। সঙ্গে বোয়ালের গালের মতো থোৎনামুখো ওসি আ ফ ম আবজাল হোসাইন দাঁত কিড়মিড় করে খিঁচিয়ে ওঠে, কী প্রলাপ বকছেন! এই বললেন আসামির মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল আবার বলছেন নামে চিনতে পেরেছেন। অল ফিকটিশাস! এনছানদ্দি নামে যে হেঁপো রুগীটি পুলিশের খোঁচর, চোখ টিপে ঠোঁট কেলিয়ে বলে, অধিক শোকে ভাবীজানের মগজ শট হয়া গ্যাছেগা। ওনার কতা ধইরেন না ছার। মানাফ তাড়াতাড়ি ছোটমাকে পুলিশের আঠারো ঘায়ের ছোঁয়া থেকে সরিয়ে আড়ালে নিয়ে যায়।
গোটা শহর আড়মোড়া ভেঙে হঠাৎ জেগে ওঠে রাউজান কাজীর হত্যাকাণ্ডে। পুলিশের চাপে এজাহার-লিস্টে ঢোকানো সম্ভব হয় না লালু মাস্তানের নাম। চিরাচরিত ডাকাতি ও খুনের কেস। পুলিশের সন্দেহতালিকায় একগাদা ফালতু নিরীহর নাম। রিকশাঅলা জোহর গাজীকে শ্বশুরবাড়ি ভুজগাঁ থেকে পাকড়াও করে আনে। পিটিয়ে আলুবস্তা বানিয়ে হাজতে ফেলে রাখে। জোহরের বউ কানের মাকড়ি গলার হাঁসলি বেচে স্বামীর মুক্তি কিনে আনে। আরো যে ধন বেচে তা কহতব্য নয়। সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাউজান কাজীর সাগরেদ ছুটে খাঁর নাম ছিল দুই নম্বরে। বেচারা একটা না-হিঁজড়ে আধামাগী টাইপের যৎসামান্য প্রাণী। চোখে সুর্মা টানে মাজা বেঁকিয়ে চলে গলায় রুপোর মাদুলি। থার্ড ডিগ্রি চালিয়ে তার হাড্ডিগুড্ডি চুর চুর করে দেয়। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে শেষ নিশ্বাসটা পড়ে তার কঁকিয়ে কঁকিয়ে। লালু মাস্তান বুকটান দিয়ে র্যালা মেরে হেঁটে যায় মানাফের বাড়ির সামনে দিয়ে। তার গোঁ ধরা টার্গেট এই বিল্ডিংয়ের দোতলাবাসিনী তন্বী কন্যা শাহানারা ওরফে শাহী। বাঘে একবার রক্তের স্বাদ চাখলে ফিরে ফিরে থাবা চাটে।
রাউজানহত্যা এইবার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার মওকায় পরিণত হয়ে ওঠে। জাতীয় দৈনিকে লেখালেখি চলতে থাকে। বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক লিডারদের নেতৃত্বে শহরের যুবসমাজ মিছিল বের করে, থানা ঘেরাও করে, লালু মাস্তানের মোটর সাইকেল জ্বালিয়ে দেয়। পিস্তলের ফাঁকা গুলির জোরে সটকে পড়তে পারে লালু। অবশেষে পুলিশ বাধ্য হয় মাস্তানকে গ্রেফতার করতে। বোয়ালমুখো ওসি আফম আবজাল হোসাইন তাকে চেয়ারে বসিয়ে আদাবারজ পোঁছে গোল্ডফ্লেক অফার করে হেঁহে হেঁহে চোয়াল ঝুলিয়ে বুকে ঠেসে ধরে। লালুর মাড়িতে ময়লা নাকে ঘা চাহনিতে ইবলিস। গোঁপের ডগা শুঁড়ের মতো উঁচিয়ে ভেদকথা ব্যক্ত করে : বুজলেননি ওছিছাব, কায়কারবার তুইলা দিবো ঠাওরাই। এই সব কী ঘোড়ার ডিস্টাপ অ্যারাইজ করে ফি দিন! আমরা কি ভাইসা … গতর খাটাই না? আমার লোক মাস মাস পাত্তি দিতাছে না? এই মাসেও শালার …। ওসি তাকে সসম্মানে নিরাপত্তা সেলে চালান করে। মাত্র তিনঘণ্টার মেয়াদ। বিকেলের দিকে সরকারি এমপি তথা সাংসদ খবিরুদ্দিন মিয়া স্বয়ং থানায় এসে লালুকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। শোনা যাচ্ছে, তারপর থেকে লালু উক্ত সাংসদ সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করছে। পিএ দেহরক্ষী কিছু একটা যা হোক। ওই রাতেই শাহীর বাবা ব্যাংককর্মচারী সোবহান সাহেবের মাইল্ড স্ট্রোক ঘটে। হেতু ফ্যাকাশে নিউজপ্রিন্টে বলপেন দিয়ে লেখা কয়েকটি মাত্র লাইন : প্রাণেরশোরী শাহী তুমি আগামী পশুদিন দোসোরা জস্টি বিষ্যুৎবার দিবা দুইটায় চন্দররায়ের পোড়োবাড়িতে আসিবা অবশ্যই অবশ্যই। নচেত্ কিন্তু তুলিয়া আনিবো। বেআদবি না হয়। ইতি ইয়োর লাভার। শাহী তো বাড়ি থেকে বাইরে পা বাড়ায় না। কলেজ বন্ধ করেছে। ক্বচিৎ দোতলার রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো ভরসন্ধেয় ছাদে উঠে আকাশের পানে তাকিয়ে আকাশপাতাল ভাবে। মংগলবারের বিকেলবেলায় শাহী খোলা চুলে বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে কুকুরের কামড়াকামড়ি দেখছিল। ঠিক তক্ষুনি ইটের টুকরোয় বাঁধা চোতাটি উড়ে এসে তার কপালে পড়ে। কথাগুলো এক নিমেষে পড়ে নিয়েই মাথা টাল খেয়ে বারান্দার উপর ঘুরে পড়ে যায় শাহী। তারপর হিস্টিরিয়া রুগীর মতো তড়পানি। তার হাতের মুঠো টিপে খসিয়ে প্রেমপত্তরটি উদ্ধার করেন বাবা সোবহান সাহেব। তখন তখন তাঁরও পতন ও খিঁচুনি। তবে সময়মতো ডাক্তার জুটে যায়, এই রক্ষে।
স্বামীর শোকে মেরুন বেগম নিরেট পাথর। চোখের পানিও নহর কাটতে ভুলে গেছে। টলটলে পাথর – পাথরের বল। যে স্বামী তাকে সঙ্গবঞ্চিত রেখেছে জীবনের মধুর দিনগুলোয়, যে স্বামী তাকে নিছক জৈবাচারের যন্ত্র হিসেবে আবিবাহকাল ব্যবহার করে এসেছে, যার ভোগান্ধতার রোলার মেরুন ও মেরুনের বাচ্চাকাচ্চাদের কচি ফুসফুসের উপর দিয়ে ইরাকে ব্রুট মার্কিনি ফৌজদের ট্যাংকের মতো ম’দো নেশার ঘোরে দাপটে দাবিয়ে যাচ্ছে, সেই তারি জন্যে মেরুনের বুকের ভিতর মুষলমুদ্গর। গলা দিয়ে আওয়াজ ফোটে না। পান্তা-চিংড়ির ভর্তা শলা পাকিয়ে পড়ে থেকে শুকোয়, শেষে নীল মাছিতে ডিম পাড়ে। গভীর রাতে হল্কুম খুঁড়ে একই কৈফিয়ৎ ছুড়ে মারে : ইয়া মাওলা! আর কত? খাওনপরনের আজাব শইলে সহ্য হয় না। অখন খুঁটি বিনে খাড়ামু কদ্দিন? আমারে তেনার দ্যাশে লইয়া যান গো পরোয়ার দেগার! তাই হলো। এক রাতে হিঁচকি টানতে টানতে ফাঁপরে পড়ে যায় মেরুন, নিচের শ্বাস টেনে তুলতে গিয়ে ফুসফুসের ঝিল্লি ফেল করে বসে। লাস্ট স্পিচ-এর কত রকমফের শোনা গেছে অদ্যাবধি! মেরুনেরটা কম নয় : বাবা মানাফ, তুই দেখিস … বেহেশতে যাইয়ে তেনার লগে …!
মানাফের শ্বাসক্রিয়ায় একটি অদৃশ্য কুফা কিছুর আছর পড়ে যায়। যেন একটা রোমশ অপচ্ছায়া তার দেহের ছায়া ঘিরে ডানা সেঁটে রেখেছে। যা কিছু স্রোতময়, কোলাহল-উৎসব-উদ্যম সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। সংসারের ব্যস্ততা বন্ধুদের পাল্লাপাল্লি বয়েসের শিভালরি স-ব সব কিছু থেকে খারিজ। কী ভীষণ নেতি তাদের হংসভাসীর ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা, বাঁচার ধুকধুকি! এটা একটা মৃতের শহর, মৃত্যু এখানে নখ সেঁটে টুঁটি কামড়ে বসত করে প্রাণ ধারণ করে। মানাফের যাবতীয় উষ্ণতা হরণ করে নেয় আদিগন্ত ব্যেপে থাকা এক অদৃশ্য শীতল জেলি। কলেজে এখনো নিয়মিত যাওয়াআসা করে, থার্ড বেঞ্চের নির্ধারিত কোণাটিতে বসে লেকচার শোনে। ক্লাশের ফাঁকে দীর্ঘ বৈঠক চলে মুকতাদিরের সঙ্গে। মুকতাদির বলে, নিছক আর্ম্স্ তো একটা ব্লাইন্ড ফোর্স – একটা মেট্যাল মেশিন। অস্ত্রকে চালায় যে বাম রাজনীতি, তোমারে তার ওরিয়েন্টেশন লইতে হবে। চলো একদিন দারাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করবা। সব লাইনে এসে যাবে।
শেষ পর্যন্ত একদিন এক শুক্লারাতে মুকতাদিরের সঙ্গে অভিসারে বেরিয়ে পড়ে মানাফ। নিষিদ্ধ রাজনীতি নিষিদ্ধ অস্ত্র এ সবের উপর কার না আকর্ষণ থাকে? বিশেষত এই পেশি টাটিয়ে ওঠার বয়েসে। হংসভাসীর দুকিলোমিটার দক্ষিণে নাবালের দিকে একটা মরা সোঁতা ভারিয়ে চলে গেছে আফরাবিলের দিকে। সোঁতাটি মরাংচে কিন্তু নামটি গালভরা : ভবনদী। ইংরেজ আমল থেকেই এলাকাটি পরিত্যক্ত। তখন স্বদেশী বিপ্লবীদের ঘাঁটি ছিল, এখন সর্বহারা বিপ্লবীরা ঘাঁটি গেড়েছে। মুকতাদিরের ঝাঁকড়া চুল শতনাগের মতো ফনফনিয়ে উঠেছে চাঁদনীতে। পুঁইশ পুঁইশ শব্দ লগি ঠেলার। জলে চাঁদের সিঁড়ি। মৃদু হাওয়ায় নলখাগড়ার মাথা বাড়ানো। জলের উপর দিয়ে ডগরা মাছের সাঁতরিয়ে পারাপার – র্র্র্ছ …। একপারে আমনভুঁই অন্য পারে আদিম অরণ্য। সব জুড়ে আধো অন্ধকারের আকাশজোড়া শরীরী রহস্য। ডিঙির পাটাতনে রুদ্ধশ্বাস মানাফ। উদগ্র কৌতূহলে জীবন্ত দুটি চোখ। এই অস্বাভাবিক অভিযান, নিশ্চয় গভীর তাৎপর্য রয়েছে এই এমন দুঃসাহসিকভাবে ঘর ছেড়ে চলে আসার। মুকতাদির সিগ্রেট টানতে টানতে প্রশ্ন করে : কী রে, বুক হালকা হালকা লাগে না এরকম খোলামেলা জায়গায় আইসা? কেউ কারুর মুখ দেখতে পায় না। মানাফের জবাব শোনা যায় : আমার তো ভার ভার ঠ্যাকে। হেসে ওঠে মুকতাদির। জলে জ্বলন্ত সিগ্রেট ছুড়ে দিয়ে বলে, ও প্রথম প্রথম ওরকম হয়। সয়ে যাইবে দেখিস।
নিশাগ্রস্ত নদী ও নিসর্গের বুকের উপর আসন নিয়ে মানাফ স্পষ্ট অনুভব করে, ভরাপ্রাণ কোনো প্রণোদনায় সাড়া দেবার জন্যে স্পন্দিত হয়ে উঠেছে সারা স্নায়ু। প্রাকযৌবন রোমান্টিক ফ্রেম যে নিয়মে তার মনকে ঘিরে গড়ে ওঠার কথা, বহু আগেই সেখানে বলিরেখা পড়ে গেছে বাস্তবের নানারকম তিক্ত শাসনে। লোকচ্ছিন্ন একধরনের ছায়াচ্ছন্ন নির্জনতা তার আশ্রয়। বিচিত্র এই যে, আজকের এই মমতা মাখা নিস্তব্ধতা তার সেই নির্লিপ্ত মনটাকে অদ্ভুতভাবে সবাক করে তুলতে চাচ্ছে। চিরকালের চেপে থাকা ঘোলা বাষ্পচাপ সরে গেছে একটু একটু করে। মানাফ উবু হয়ে হাত দিয়ে ভারানির জল ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ভবনদী নামের মরাংচে এই সোঁতার জল খুনসুটি করে, হেসে ওঠে খল খল করে। ভরা কটালের রাত। জোয়ারের জল তীরের ঘাসজমি ছুুঁয়ে ছল ছল করছে। কালো গাইয়ের শাদা দুধের মতো নির্মল চাঁদের জোয়ার নির্মল নিকষিত ক্যানভাস। তীরে কালোমাথা বেশ বড় একটা গাছ। বট নয়, অন্ধকার গাঢ় হতো তাহলে। শিরিস বা অশ্বথ হবে। তার গুঁড়িতে ডিঙি বেঁধে ফেলতে ফেলতে মুকতাদির বলে, এসে গেছি।
পায়ে চলা পথের পাশে ছোট টলঘর, ঝাঁপ ফেলা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে বোঝা যায় ভেতরে আলো জ্বলছে। চিকন গলায় মারেফতী গাইছে কেউ। স্বরটা খোনা খোনা। শূন্য স্তব্ধ সময় সামান্য উদাস বাতাস … দারুণভাবে খাপ খেয়ে যাওয়া এই প্রাকৃত সুর অলৌকিক কথা : ভোলা মন / জোয়ার এখন / পাড়ি দিবা আর কতখন। বন্ধ ঝাঁপের পিঠে মৃদু চাপড়ের মতো তিনটে থাবা মারে মুকতাদির। তাইতেই গান থেমে যায়। মুকতাদির গলা নরম করে বলে, দারাভাই ও দারাভাই! আমি মুকু। পেছনের দিকে টিনের দরজা খোলার শব্দ হয়। ডাক আসে সরু গলায়, চলে এসো। পেছন দিক ঘুরে এসে ঘরে ঢুকে পড়ে দুজনে, সন্দেহ নেই এটা একটা পথচলতি গ্রামীণ দোকানঘর। ডিপার্টমেন্ট্যাল স্টোরের আদি আদিম মডেল। কালি পড়া হ্যারিকেনের উস্কে দেওয়া আলো প্রকট করে তুলেছে যাবতীয় পণ্যসম্ভার : খাতাকাগজকন্ডোম থেকে লেড়ো বিস্কুট – সব কিসিম। একজনই মানুষ কেবল ভিতরে। অর্থাৎ খোনাগলার মারেফতী গায়ক ইনিই। কী দশাসই ফিগার! বাংলাভাইয়ের মতো বুকজোড়া দাড়ি। ঘাড়েগর্দানে সমান। লম্বায় পোনে ছফুটের কম নয়। স্যান্ডো গেঞ্জিতে রেস্লার রকির মতো লাগছে। মানুষটাকে মুহূর্তের মধ্যে ভালো লেগে যায় তার মায়াভরা আলাপের জন্যে। আপনি মানাফ তো? ঠিক বলেছি কিনা? মুকতাদিরের ফ্রেন্ড, আমারো ফ্রেন্ড। মানাফ হেসে বলে, খুব সঠিক দারাভাই। তবে আপনার বন্ধু হবার মতো যোগ্যতা আমার একটুও নেই। একটা বইপোকা অকেজো ছেলে আমি। দারা নিজের ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে ফিস ফিস করে বলে, প্লিজ কারেক্ট ইয়োরসেল্ফ্। আমি এখানে দারা নই, আমার লোক্যাল নেম পরাণ সেখ। অবশ্য আপনার গাইড মুকু নিজেই এই ভুল করে বসেছে ঘরে না ঢুকতেই। মুকতাদির কানে হাত দিয়ে মাপ চায় : বিচ্ছিরি ভুল হয়ে গেছে পরাণভাই! দিস ইজ দ্য ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট টাইম, কথা দিচ্ছি। পরাণ বালিশের তলা থেকে রিভলবার বের করে তিন আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে হাসতে হাসতে বলে, এটা থার্ড টাইম ভাই। এর পরের বার কিন্তু – যাক্গে বাদ দাও ওসব কচকচি – কী খাবে বলো? গেস্ট নিয়ে এলে গরিবের দোরে। বলতে বলতে বয়েম থেকে বিস্কুট আর বাতাসা বের করে দেয়। মানাফ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, গ্রামসংস্কৃতির বিলীয়মান স্যাম্প্ল্ গুড়ের তৈরি সেই আদিঅকৃত্রিম বাতাসা।
কথা পরাণই শুরু করে প্রথম : মাবাবা চলে গেছেন, আপনি এখন …। তাকে শেষ করতে না দিয়ে মুকতাদির দ্রুত বলে ওঠে, না পরাণভাই, আপনি যা ভাবছেন মোটেই তা নয়। ও মোটেই মুক্ত নয়। সৎভাইবোনদের কথা না হয় বাদ দিলাম, ওর নিজের ছোটভাইবোনগুলো সব অখন ওর ঘাড়ে। কিন্তু কথা হচ্ছে তা বলে চব্বিশ ঘণ্টা সেক্লুডেড হয়ে থাকতে হবে? আমি রোজ বোঝাইতেছি। অখন ধুয়ো তুলছে পরীক্ষা দেবে না। পরাণ দাড়িতে মুঠো ঢুকিয়ে চোখটান মেরে বলে, আপনার তো হাত-পা বাঁধা মানাফভাই। নড়াচড়ার জো নেই। না হলে বলতাম, চলে আসুন ক্যাম্পে, বিপ্লবীর খাতায় নাম লেখান। মানাফ কিছুটা তাচ্ছিল্য কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বলে, আপনারা তো চারু মজুমদারের কনভার্ট, ব্ল¬াইন্ড অ্যান্ড মেকানিক্যাল। ওর এই স্পষ্টবাদিতায় স্তম্ভিত হয়ে যায় মুকতাদির। হাত উঁচু করে বারণের ভঙ্গিতে। তাকে আমল না দিয়ে পরাণ ধীর ভাবে বলে, কথাটা কি একটা ধরতাই বুলি হয়ে গেল না ভাইয়া? আরেকটু তলিয়ে দেখতে তো বাধা নেই। চারু মজুমদারের পক্ষে-বিপক্ষে গত তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর ধরে অনেক থিসিস-অ্যান্টিথিসিসের জন্ম হয়েছে। নিজস্ব একটা সিদ্ধান্তে বা ন্যূনপক্ষে একটা মতামতে পৌঁছুনোর আগে আপনাকে সেগুলো ঘেঁটে দেখতে হবে। আপনার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। তো যা বলছিলাম আর কী। প্রথমেই মানতে হবে, চারু মজুমদার একটা বিশেষ সময়ের বিশেষ পরিস্থিতির বা কন্ডিশনের প্রোডাক্ট। তাঁর অতিবিপ্লবী চরমপন্থা পার্টলি অ্যাপ্লিকেবল ছিল সে-সময়ের তরাই এলাকার সামন্তশোষিত কৃষকশ্রেণীর মধ্যে। অ্যান্ড ইট ওয়াজ ও টোট্যাল ফেইলিয়োর অ্যামং দ্য মিড্ল ক্লাস এলিট ড্রিমারস অব আরবান প্লেসেজ। আমি বিশেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইনটেলেকচুয়্যাল রোমান্টিক যুবকদের কথা বলছি। তারা শহরে ও শহরতলীতে বসে কৃষিবিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছে, ঠিক বললাম না বুঝি, স্বপ্ন দেখানো হয়েছে তাদের। এবং পরিণামে সেই সব তরুণ জিনিয়াস, একটা দেশের সেরা সম্পদ, পুলিশের গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। আদর্শের মৃত্যু নেই। কিন্তু অপচিত রক্তের পূরণ হবে কীসে? কে করবে ক্ষতিপূরণ? কমরেড চারু মজুমদারের বিপ্লবী আদর্শ মহান ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর রণকৌশল বাস্তবসম্মত লাইনে ছিল বলে আমি অন্তত মেনে নিতে পারিনি। আমাদের জরাজীর্ণ গ্রাম ও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনুন্নত কৃষিজীবীসমাজকে তাতিয়ে এনে শহরঘেরাও বিপ্লব ঘটানো একটা অ্যাবসার্ড আইডিয়া। আমাদের গ্রামবাসী ইমোশনালি স্পর্শকাতর। তাদেরকে মোটিভেট না করেই খতমঅভিযানে নেমে গলাকাটা লাইন শুরু করে দিলে তারাই উইচহান্ট করে পিটিয়ে মারবে। এই সব নিয়ে মতভেদ হবার ফলে আগের পার্টি ছেড়ে চলে আসতে হলো আমাকে। এখানেও দ্বন্দ্ব চলছে নিজেদের মধ্যে। আমি বোঝাতে পারছিনে কমরেডদের : মিডল্ক্লাশ রোমান্টিকতাকে রাশ ছেড়ে দিলে হয় হঠকারিতা এসে পড়বে, না হয়ত অ্যানার্কিজমে পর্যবসিত হবে। কমরেড পরাণ ভিতরের উৎসাহে কথা বলে চলেছে। তার এই সব গুরুতর আলোচনায় মনে মনে ক্লান্ত হয়ে ওঠে মানাফ। সেটা লক্ষ করে মুকতাদির বলে, এ-সব তাত্ত্বিক তর্কাতর্কি এখন ওর মাথায় ঢুকবে না। সময় লাগবে। মানাফ খোলাখুলি স্বীকার করে, বইয়ে লেখা থিয়োরিটিয়োরি, সত্যি বলছি, অনেক কিছু আমার মাথায় ঢুকতে চায় না। ভারী মুশকিল! পরাণ হেসে বলে, প্রথম প্রথম আমার মাথায়ও কি ঢুকতো ভাই? বরং এক কাজ করো না কেন? নিরেট প্রবন্ধট্রবন্ধ না পড়ে কাহিনীমূলক লেখা পড়ে দেখতে পারো। বর্ণনার ভেতর দিয়ে সারবস্তুটা সামনে উঠে আসবে। আচ্ছা, খুব হালে বেরুনো একটা বইয়ের নাম করছি। বাসুদেব মুখোপাধ্যায়ের লেখা পোনেছ’শ পৃষ্ঠার উপন্যাস, নাম দুরন্ত, কলকাতার পাভলভ ইনস্টিটিউট থেকে গতবছর অর্থাৎ ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে বেরিয়েছে। ব্লার্বে বইয়ের পরিচিতিতে বলা হয়েছে : নকশালবাড়ির কৃষকসংগ্রামের আলেখ্য। অথচ লেখক পেশায় মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ! কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত মানবমন পত্রিকার সম্পাদক। পেছনের প্রচ্ছদে উপন্যাসটিকে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির ও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে মন্তব্য করা হয়েছে। এই বইয়ে দেখা যাচ্ছে, মূল নেতা চারু মজুমদার এক উচ্চাকাক্সক্ষী স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। সারা জীবন তিনি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে গেছেন, অথচ জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে তাঁর অসুস্থ অবস্থায় বিছানায়। পক্ষান্তরে, তাঁর পার্টিকমরেড কানু সান্যাল ডি-ক্লাশ্ড্ হয়ে কৃষকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। সমগ্র তরাইয়ের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত সংগ্রামের ডাক দিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন উল্কার মতো। চারু মজুমদারের লিমিটেশনগুলো ঠাহর করতে না পারলে আমরা তাঁর সঠিক মূল্যায়নে পৌঁছুতে ব্যর্থ হবো। বইটার শেষের দিকে এ-প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু মূল্যবান বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমি আপনাকে পড়ে শোনাবো। বলতে বলতে পরাণ বাঁশের বাখারির আসন থেকে উঠে পড়ে। কিছু বইখাতা রাখা ছিল বেড়ার গায়ে ঝোলানো একটা ময়লা তক্তায়। পরাণ একটা মোটা বই টেনে বের করে। ধুলো মুছে মানাফের হাতে দেয়। দারুণ কৌতূহল নিয়ে বইটা উল্টেপাল্টে দেখে মানাফ। মেটেরঙা মলাট। হ্যারিকেনের ঘোলা আলোয় আরো ম্যাটমেটে লাগছে। সারা প্রচ্ছদ জুড়ে প্যারিস-প্রবাসী বাংলাদেশের শিল্পী শাহাবুদ্দিনের স্টাইলে আঁকা দুটি হ্রেষারত দুরন্ত ঘোড়ার মুখ। অদ্ভুত ব্যাপার, বইয়ের ভেতরে কোথাও শিল্পীর নাম নেই। ওর হাত থেকে চেয়ে নিয়ে পাতা ওল্টাতে থাকে পরাণ। চোখে কখন জানি চশমা এঁটে নিয়েছে। শেষের দিকে এক জায়গায় এসে নিশ্চিন্ত হয়। নিবিষ্ট স্বরে বলে, দুজনেই শুনুন। ৫৪৬ পৃষ্ঠা থেকে শুরু করি। পার্টিতে শেষের দিকে ক্রমশ ক্ষোভ ও হতাশা জমে উঠতে থাকে। কোনো কোনো মিটিঙে সেগুলো আত্মসমালোচনা-আত্মশুদ্ধিরূপে প্রকাশ পায়। কেউ কেউ অভিযোগ করে, চারুবাবু পার্টিতে ‘কর্তৃত্ববাদ’ চালাচ্ছেন ও ‘উগ্র-বামপন্থা’ লাইনকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি ‘ভ্রাতৃত্বমূলক’ সমালোচনা পাঠায়। কিন্তু বিপ্লবে ভাঁটা পড়ে যাবে বলে সে-সমালোচনা পার্টিমিটিঙে উপস্থাপন করতে দেননি চারুবাবু। সৌরেন বসু চীন থেকে ফিরে আসার পর ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত পার্টিকমরেডদের মধ্যে সেই চীনাসমালোচনা তুলবার জন্য বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। সৌরেন বসুকে কানু সান্যালের সঙ্গে বিশাখাপত্তনম জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাঁরা অন্যান্য বন্দি কমরেডদের সঙ্গে চীনাদলিল নিয়ে আলোচনা করেন। পরে সেখান থেকে কানু সান্যাল, চৌধুরী তেজেশ্বর রাও, সৌরেন বসু, নাগভূষণ পট্টনায়েক, কোল্লা ভেংকাইয়া ও ভুবনমোহন পট্টনায়েক; মোট এই ছ’জন বন্দি কমরেডের সইসহ সাইক্লোস্টাইল কাগজের উপর ইংরেজিতে লেখা একটা আবেদনপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই দলিলের সঙ্গে চীনাপার্টির সমালোচনাও সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। ছয়কমরেড এই সমালোচনার ভিত্তিতে কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসেন। সেই সিদ্ধান্তগুলোও তাঁরা তাঁদের আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন। তাঁরা আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন এগুলোর গঠনমূলক আলোচনা হোক পার্টিমিটিঙে। কিন্তু তা হতে দেওয়া হয়নি। মুকতাদির কিছুটা উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করে, চীনাপার্টির সেই ভ্রাতৃত্বমূলক সমালোচনায় আদতে কী ছিল আপনি দেখেছেন পরাণভাই? পরাণ ঈষৎ হেসে সামান্য কেশে উত্তর দেয়, এতদিনে কি আর চাপা থাকে এই সব লিটারেচার? বামপন্থী গবেষকরা তো আর চুপ করে বসে নেই। পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে এসব নিয়ে। এ-বইয়েও তার কিছু নজির রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। ৫৬৩ পৃষ্ঠা থেকে পড়ে শোনানো যাক: “চীনাপার্টি বলছে, ভারতের এই বিপ্লবী পার্টির মধ্যে তারা স্পষ্ট অতি-বামপন্থী ক্রিয়াকলাপের ঝোঁক দেখতে পাচ্ছে। এজন্য তারা সাবধান করে দিচ্ছে, পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদ যেমন বিপদ তেমনি বিপদ অতি-বামপন্থা। এছাড়া তারা বলছে, এক দেশের পার্টির চেয়ারম্যানকে অন্য দেশের পার্টির চেয়ারম্যান বললে ওই দেশকে অপমান করা হয় এবং তার জাতীয়তাবোধের মর্যাদায় আঘাত করা হয়। … সব বুর্জোয়াদের মুৎসুদ্দি বলে অচ্ছুৎ করলে চলবে না। খোলা সংগঠন থাকবে আবার গোপন সংগঠনও থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিহত্যার রাজনীতি কখনো কোনো বিপ্লবী পার্টির রাজনীতি হতে পারে না। এটা কখনোই চেয়ারম্যান মাওয়ের শিক্ষা ‘ওয়ার অফ অ্যানিহিলেশন’ নয়, একে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চীনা বিপ্লবের প্রয়োজনে যে গেরিলা যুদ্ধের ব্যবহার হয়েছে, তা একটা মিলিটারি যুদ্ধের অঙ্গ এবং তা জাপ-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু আপনাদের গেরিলা যুদ্ধ দেখা যাচ্ছে শুধু ব্যক্তিহত্যার রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। … বিপ্লবী কর্তৃত্ব সংগঠনের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়, ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এই পার্টি তার দেশের মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য যে-লড়াইটা শুরু করেছে, তাকে নীতিগতভাবে চীনাপার্টি সমর্থন জানায়; কিন্তু যে-রাস্তায় পার্টি চলছে তাকে চীনাপার্টি সমর্থন করে না -।” এই বইয়ের ৪৯৪ পৃষ্ঠায় পার্টির মধ্যেকার অতিরিক্ত সন্ত্রাসপ্রবণতা-প্রসঙ্গে সুশীতল রায়চৌধুরী কানু সান্যালকে বলছেন, “এখন প্রতিদিন শুনি, ‘অ্যাকশন’, ‘খতম অভিযান’ – বহু নিরীহ, নির্দোষ মানুষ, ছোট ছোট ছেলেরা প্রাণ হারাচ্ছে। এ এক্কেবারে ব্যক্তিগত সন্ত্রাস!” ৫৬৬ পৃষ্ঠায় এক কমরেড অন্য কমরেডকে বলছেন, ‘সত্তরের দশক হলো মুক্তির দশকের বদলে মৃত্যুর দশক।’ ৫৭৫ পৃষ্ঠায় আরেক কমরেড তাঁর ছেলেবেলার গল্পের রূপকচ্ছলে চারুবাবুর বিপ্লবের শেষ প্রাপ্তিটাকে তুলে ধরেছেন এভাবে : “একদিন সব বন্ধুরা ভোরের অন্ধকারে পানি হাতড়াচ্ছে আর একে অপরকে জিজ্ঞাসা করছে কেউ কিছু পেয়েছে কি-না। পঞ্চানন দেখছে অনেকক্ষণ ধরে তার এক বন্ধু খালেক জলের মধ্যে ঝুঁকে কী একটা জিনিস নাড়াচাড়া করছে। তখন বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করে, ‘খালেক, তাল পালেক?’ তার সেই বন্ধু বেশ কিছুক্ষণ নাড়াচাড়ার পর মন্তব্য করে, ‘পালেক, লেকিন খোক্কা!’ অর্থাৎ একটা তাল সে পেয়েছে বটে; কিন্তু তার ভেতরটা পোকায় খেয়ে নিয়েছে।… আমাদেরও সেই অবস্থা বুঝেছ ভায়া, একটা কিছু পেয়েছি নিশ্চয়ই; কিন্তু তা পোকায় খাওয়া – খোক্কা! আবার ভাবি, এত লোকের এত আত্মত্যাগ তা কী আর সবটাই বিফলে যায়!” বিহ্বল হয়ে পরাণের দীর্ঘ বয়ান শুনে যাচ্ছিল মানাফ ও মুকতাদির। ঠিক এই জায়গাটিতে এসে দুই বন্ধু প্রায় একই সঙ্গে বলে ওঠে, আমরাও তো সেই কথা বলি, এত বড় বিপ্লবী আন্দোলন, এর কি কোনো সুকৃতি রইল না? আপনারা কীসের উপর দাঁড়িয়ে তাহলে? আর এই যে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে আরো আরো আন্ডারগ্রাউন্ড সব সশস্ত্র পার্টি, এরা? একটু হেসে স্নেহের স্বরে বলে পরাণ, এতগুলো প্রশ্ন, একসঙ্গে তো জবাব দেয়া যাবে না। একটা একটা করে শুরু করা যাক। একটা কথা আছে না? শহীদের রক্ত বৃথা যায় না। নক্শাল আন্দোলন আমাদের ঝিমিয়ে পড়া জনগণকে বিপ্লবী মন্ত্রে নতুন করে দীক্ষা দিয়ে গেছে। বিশেষ করে, যুবসমাজকে আদর্শের জন্যে ত্যাগী ও সাহসী করে তুলেছে। শোষক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নক্শালবাড়ির শিক্ষা মহামূল্যবান। যুবশক্তির অমিত ক্ষাত্র তেজকে আজ এনজিওর টোপ গিলিয়ে ঢোঁড়া বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। পৃথিবীতে বাম পরাশক্তি আজ খোজা হয়ে গেছে দশাবৈগুণ্যে। ঠিকই। তবু আমি মনে করি, তৃতীয় বিশ্বের গরিব ও শোষিত দেশগুলোর মুক্তিআন্দোলনে বামধারার বিপ্লবের এখনো পর্যন্ত কোনো বিকল্প নেই। মেহনতী মানুষের অস্তিত্ব জুড়ে দেশীবিদেশী পুঁজির যে মহাজনি আগ্রাসন, একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমেই তার উচ্ছেদ সাধন করা সম্ভবপর। এখানেই আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি ও তার গোপন তৎপরতার কথা এসে পড়ে। কারণ গণতন্ত্রের মুখোশধারী ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতালোভী দলগুলো এবং তাদের লুটেরা সরকার কোনোদিন কোনো সশস্ত্র বিপ্লবকে সহ্য করতে পারে না। জনগণের সঙ্গে গোপন সূত্রবন্ধন গড়ে তোলার জন্যে আমাদের পার্টির নিজস্ব অ্যাকশনলাইন আছে। পেটিবুর্জোয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেও আমাদের সহায়ক শক্তি রয়েছে। আমাদের আপাতঃরণকৌশল অবশ্যই গেরিলা লড়াই। তবে তার জন্যে ভালো প্রশিক্ষণ দিয়ে বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। আমার এ-সব পরিকল্পনায় সরলীকরণের ঝোঁক বেরিয়ে পড়তে পারে যদি সরেজমিনে বাস্তব প্রয়োগের প্রমাণ তুলে ধরা না হয়। সে-সব তো দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ব্যাপার। আজ এই ঘরোয়া বৈঠকের পরিসরে আমি তোমাদের মনে কতটুকু প্রত্যয়ের শিকড় গেড়ে দিতে পারি? পার্টিতে জয়েন করতে হবে, কাজে নামতে হবে, সেটাই হবে সত্যিকার হাতেকলমে ব্যাখ্যা। যদিও হাইকম্যান্ডের কোনো কোনো পদক্ষেপে আমি মনে মনে সায় দিতে কুণ্ঠাবোধ করি। তবু পার্টিডিসিপ্লিন বলে তো কথা। কোনো কোনো ক্যাডারের কার্যকলাপও পার্টির সুনামের জন্যে হানিকর। দেখা যাক। হয়ত একদিন প্রতিবাদী ভূমিকায় নামতে হবে আমাকেই। কে জানে? একটি দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করে নেয় পরাণ, দুই বন্ধুর নজর এড়ায় না। হয়ত এখানেই থেমে যেত পরাণ। কিন্তু তাকে আজ কথায় পেয়ে বসেছে। দুই জুনিয়র অনুরাগীর সঙ্গ তাকে মুখর করে তোলে : আমাদের এটা একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি। কোনো তাঁবেদারি নয়। ছোট তবে স্বাধীন একটা দল। নাম বামগণবিপ্লবী পার্টি, সংক্ষেপে বাগপা। মানাফ বিজ্ঞের মতো মন্তব্য ছুড়ে মারে, লোকে যাকে সর্বহারা পার্টি বলে। পরাণ ধৈর্য নিয়ে বলে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন আজ শতধা বিভক্ত। সব ক’টি আন্ডারগ্রাউন্ড। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নাম। সাধারণ জনগণ সবগুলোকে মিলিয়ে গড় নাম দিয়েছে সর্বহারা। মতাদর্শে খুব যে একটা ফারাক তা বলা যাবে না। শেষ পর্যন্ত গণবিপ্লব কাম্য সবার। নেতৃত্বের কোন্দল, পেটিবুর্জোয়া ইগোকমপ্লেক্স, ফিউড্যাল ওনারশিপ কমপ্লেক্স, স্বার্থ-অর্থ এসব নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি – বিচিত্র সব কারণে এত দল-উপদল গজিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য আমি মনে করি, আমাদের বাগপা একটা সাচ্চা বিপ্লবী পার্টি, তাই শত্রুও বেশি আমাদের আর তারা বেশির ভাগই বামপন্থী বন্ধুর দল। নিতান্ত কৌতূহলী হয়ে মানাফ প্রশ্ন করে, আপনারা কি সংসদীয় নির্বাচনে যেতে চান না? ঠোঁট বিকৃত করে পরাণ হতাশ ভঙ্গিতে জবাব দেয়, জবাব দিতে গিয়ে হাত নেড়ে মাছি তাড়ায়, কী হবে এসব ভুয়া গণতন্ত্রে, বলুন তো? দেখলেন তো, গত তিরিশ-বত্রিশ বছরের পরিণামটা? দেশ হয়েছে পারিবারিক সম্পত্তি। ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য যাবতীয় সম্পদ লুট। জনগণ অছিলামাত্র। আর নির্বাচন হচ্ছে লুটেরা তৈরি হবার কৃৎকৌশল। এই লুটেরা রাজনীতিক শাসকদের খপ্পরে এখন দেশের বারো আনা ধনসম্পদ। পাশের দেশে নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জেতার পর আপামর জনতার প্রাণের দাবি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ সেধে অন্য নেতাকে ডেকে এনে ছেড়ে দেয়, এরকম নজির, এই মূল্যবোধ দেখেছেন কোথাও কখনো? আমরা সে-সব শিক্ষা নিতে ভুলে যাই, এটাই নিদারুণ কষ্টের অভিজ্ঞতা! বেদনার নীল ছোপ দেগে বসে তিনটি সহমর্মী মানুষের মুখে। দুমিনিট চুপচাপ। বাইরে ধূলিঝড় উঠেছে। ঘরের বেড়া মাচা সব মচমচ করে। কালদীঘেড়ি পাখি কঁক কঁক করে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় শিরীষের বাসা থেকে। আর এই সময় নাছোড়বান্দা মানাফ ছাত্রের মতো শেষ প্রশ্নটি তুলে ধরে : কিন্তু পরাণভাই, নির্বাচন এলে তো জনগণ নাচতে নাচতে তাদেরই ভোট দিতে ছোটে? ক্ষোভে ফেটে পড়ে পরাণ। খোনা গলা হঠাৎ করে পুরু ভার ভার হয়ে ওঠে : সেটাই তো কথা। লক্ষ করে দেখবেন, এই সব নাচাকোঁদা ভোটারবাহিনী অধিকাংশই অশিক্ষিত হুজুগে মাতওয়ালা দল, যাদের ব্যক্তিত্ব-মূল্যবোধ-সচেতনতা হিমাংকে ঝিম ধরে আছে। আরো ভালো করে লক্ষ করে থাকবেন, সচেতন শিক্ষিত সমাজের খুব কম অংশই আস্থা নিয়ে ভোট দিতে যায়। দলবাজদের কথা অবশ্য আলাদা ব্যাপার। একটু থেমে বুকের ভেতরের জমানো ভাপ ছেড়ে দেয় পরাণ। কালি পড়া হ্যারিকেনের দিকে চোখ রেখে নিঃশব্দে হাসে, হাসির বাঁক ঠোঁটে আটকে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে থাকে : গণআন্দোলন – কথায় কথায় গণআন্দোলনের ডাক দেয়, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। হুঁঃ! জনগণ এদের ভাড়াটে সৈনিক কি-না, যে ডাক দিলে অমনি লাঠিসোঁটা নিয়ে রে রে করে তেড়ে এসে এক ধাক্কায় গদি উলটে দেবে? বাপ-স্বামীর নাম ভাঙিয়ে আন্দোলন উস্কিয়ে তোলা বা ধরে রাখা কোনোটাই টেকসই নয়। জনগণকে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে চেতিয়ে তোলা যাচ্ছে না। সবরকম পুঁজি শেষ। এসব দলের শাসন দেখে দেখে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে পাবলিক। এখন বাধ্য হয়ে শেষ অস্ত্র হরতাল চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ তো শেখ-ভাসানীর আগ্নেয় আমল নয়। হরতাল এখন একটা চাপিয়ে-দেয়া বাধ্যবাধকতা। নিজেদের সহায়সম্পদ বাঁচানোর জন্য লোকজন দোকানপাট বন্ধ রাখে, গাড়িঘোড়া বের করে না। ঘরে বসে ক্রিকেট দেখে টিভিতে। রিকশাঅলা মিন্তিমজুর দোকানদাররা মনে মনে গাল দেয়। হরতাল সফল করার জন্যে জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি ছাড়া হয়। প্রকৃত গণশত্রু এখন এরাই। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের সঙ্গে এদের কোনো নাড়ির সম্পর্ক নেই। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এদেরই পায়রাবি করে খুদকুঁড়োর লোভে।
কথায় কথায় বেড়ে চলেছে রাতের প্রহর। বাঁশের বাখারির ঢেউ ঢেউ বাতা। তার উপর বেতীবোনা পাটি। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে থেকে পাছার তেকোণা হাড় টাটিয়ে ওঠে মানাফের। তবে পরাণের কথাগুলো বোমার স্প্লিন্টার, একেবারে পাঁজরে ঢুকে যায়। বালিশের ওপাশটায় মোবাইল ফোন বেজে ওঠে সহসা। এখানে এ জিনিসের অস্তিত্ব কল্পনায় আসেনি এতক্ষণ। তবে কিনা পুক পুক করে আলো জ্বেলে নিজেকে জানান দিচ্ছে দিব্যি। পরাণ কানের কাছে ধরে রেখে চাপা স্বরে বার্তাবিনিময় করছে। ফোন বন্ধ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে, রাত কিন্তু ঢের হয়ে গেল। কী, থেকে যাবে? ডিমসেদ্ধ আলুভর্তা – হাঃ – হাঃ হাঃ! কাজের কথা তো কিছুই হলো না। একটু ব্যস্তভাবে মুকতাদির না না করতে থাকে, আজ আসি পরাণভাই। মানাফরে আনছিলাম আপনার সঙ্গে পরিচয় করায়া দিতে। আপনিও বলে দিছিলেন ওরে আনতে। যাচ্ছেতাই পারিবারিক ধকল যাইতেছে ওর ওপর দিয়া। হঠাৎ উত্তেজনার বশে বলে ওঠে মানাফ, আমারে একটা আর্মস্ দিবেন পরাণভাই? পরাণ অবাক হয়ে ভ্র কুঁচকে প্রশ্ন করে, অর্থাৎ? কালিগোলা লণ্ঠনের ভুসো আলো না হয়ে বিদ্যুতের আলো হলে পরিষ্কার দেখা যেত, মানাফের মুখের দুই চোপা রক্তচাপে লাল হয়ে উঠেছে। গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, লালুরে খুন করবো আমি – নিজের হাতে খুন করবো – আই মাস্ট কিল দ্যাট বাস্টার্ড! পরাণ সরে এসে তার ঘাড়ে হাত রাখে। কানের লতিতে নিশ্বাস ফেলে বলে, তোমার চোখ বলে দেয় তুমি পারবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। রাজনীতির পাঠটা সারো আগে, তারপর আর্মস্। ফার্স্ট পলিটিসাইজ দ্য গানম্যান দেন গান ইটসেল্স্ উইল ফিক্স্ ইট্স্ ওওন টার্গেট। মানাফ অধীর উত্তেজনায় বলে, আমি দেরি সহ্য করতে পারতাছিনা পরাণভাই। লালুরে আগে আগে শেষ কইরা দিতে না পারলে আরো অনেক ফ্যামিলি ধ্বংস হয়া যাইবো। ওকে বাধা দিয়ে পরাণ বলে, ক’টা লালুকে খতম করবে তুমি ভাইয়া? এই আমলের প্রশাসন লালুদের পুষছে। সরকার বদল হয়ে নতুন সরকার আসবে। নতুন গডফাদাররা লালু মাস্তানদের হটিয়ে কালু মাস্তানদের গড়ে তুলবে। অথবা লালুরাই ভোল পাল্টিয়ে কালু ক্যাডার হয়ে যাবে।
পরাণের প্রত্যয়দৃঢ় গলা : এই শয়তানী চক্রটাকে উচ্ছেদ করতে হবে সবাই মিলে, তাই নয় কি? একেবারে খালের তীর অব্দি চলে আসে কথা বলতে বলতে। বিদায় জানানোর আগে ধাতব গলায় উচ্চারণ করে, লালু আমাদের হিটলিস্টে আছে, বলে দিলাম।
ভাঁটির টান শুরু হয়ে গেছে। ডিঙি আপনিই ছুটে চলেছে। গলুইতে বৈঠা ধরে বসে গুনগুন করছে মুকতাদির। আকাশ থেকে আলো গলে পড়ছে। রাতের আলোআঁধারী সব অহিত দৃশ্য লোপ করে দিয়েছে। কনুইতে ঠেকনো বাধিয়ে আবিষ্ট ভঙ্গিতে বসে রয়েছে মানাফ। অস্ফুট নিশ্বাসে স্বগতোক্তি করে : কী হালকা হাওয়া! আআঃ -!
ভাইবোনসহ মানাফ একদিন বাপের নতুন বাড়িতে উঠে আসে। ঠিক উঠে আসে বলা যাবে না, পরিস্থিতিবৈগুণ্যে উঠে আসতে হয়। কলেজ থেকে ফিরে এসে দেখে, গেটে তালা লটকানো। ওপরতলা থেকে খবর পাওয়া গেল, ছোটবিবি স্বয়ং গাড়ি নিয়ে এসেছিল। সবাইকে তার সঙ্গে ওবাড়িতে নিয়ে গেছে। ওকেও বলে গেছে চলে যেতে। এই ছোটমা-টিকে মোটামুটি চেনা হয়ে গেছে মানাফের। বড়লোকের বিটি তো, আপনপর বিচার নেই, দয়ার শরীর। ভালোই তো, সৎমায়ের সুবাদে নাবালক ভাইবোনদের একটা হিল্লে হয়ে গেলে রক্ষে। মানাফের মুখে ছোটমা ডাকটা আসে না, মেইয়ে বলে। বিকেলে ওবাড়িতে গিয়ে হাজির হয় মানাফ। কই গো মেইয়ে ভাত দেন বলে হাঁক দিতে কোহিনুর ছুটে আসে। আসো আসো বাপো আমার! ডানা ঝাপটানো মুরগির মতো তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কী কোমল সুগন্ধী কোহিনুরের আমিষ শরীর! উদগ্র যৌবনের এই সর্বব্যাপী প্রত্যক্ষতায় নিমেষের তন্দ্রা ছেয়ে ধরে মানাফের নীতিচেতনাকে। বিশ্বলোপ ঘটে তার। মুহূর্ত মাত্র। তার পরপর টের পায়, তরল বিস্ফোরণ ঘটে গেছে জাঙ্গিয়ার অন্তরালে। চোখের জলে ভাসন্ত কোহিনুরের বাঁধন খসিয়ে নেয় নিঃশব্দে। টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে কথা বলে চলে কোহিনুর : কলেজ হইতে আসতে এত দেরি হইল? আমি বলে দুফার হইতে বাপোর সখের টাকিভর্তা বেতাংচিচকিরি রা’ন্ধা লয়া বইয়া আছি। শাহী বলেনি আমার কথা? ফিরা গিয়া আর কাজ নাইগা ঐ ছাড়াবাড়িতে। এইখানে জায়গা কম নাকি? দোতালার ঘরে বইটই সব সাজায়া রাখছি। এখান থাইকা কলেজ করবা। দোতলার কামরায় ঢুকে চমৎকৃত মানাফ। বইপত্তর জামাকাপড় সব পাট পাট করে সাজানো। খোলা জানালায় থমথমে আকাশ। দূরে মাজাবাঁকা হংসভাসী। দারুণ একটা স্বস্তিকর মুক্তি! দক্ষিণ্যের দাননয়, পাওনা ধন। কোহিনুরের প্রতি প্রসন্নতায় ভিজে ওঠে মন। কেমন এক মান্ষেতা ভরা শান্তিপ্রিয় নারী! সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকাটা পছন্দ।
সন্ধের পর হংসভাসীর তীরে ঘুরতে বেরোয় মানাফ। বেদিমতো একটি টিলা বেছে নিয়ে তার উপর বসে পড়ে। ধানবোঝাই নৌকো ভেসে যাচ্ছে পাল তুলে দিয়ে। চাপা চাপা গুমরানো আবেগে ফুলে ওঠা তালি দেয়া মামুলি কাপড়ের পাল। আকাক্সক্ষায় স্ফীত। বাতাসের প্রশ্রয় পেয়ে মনের আগল খুলে গেছে। সাদা পাখিরা ইলিমিলি আলাপচারিতায় মুখর। সোনার ঘড়ার গলায় পেঁচিয়ে মনসার কালোবরণ কেউটে। ভেতরে কুবেরের মোহর। একটি মোহর আজ টুপ করে লাফিয়ে মানাফের বুকপকেটে সেঁধিয়ে গেছে। পাপের বিষে তার নীলাভ শিরায় নীল শিহরণ বয়ে যায়। কোহিনুরকে ভালোবাসবে সে, মাতৃজ্ঞানেও ভালোবাসা যায়। কোহিনুরের চাহিদামতো এখন থেকে এখানে থেকেই কলেজে যাওয়া-আসা করবে। কলেজ থেকে ফিরে এসে বাপের গদিতে বসবে। ব্যবসা দেখাশোনা করবে। কোহিনুরের আজকের আদিখ্যেতা একটা সতর্কসংকেত। হোক না অপত্যকাঙাল আদিম অভিপ্রকাশ। তবু মানাফকে গুটিয়ে নিতে হবে প্রথম থেকেই। শাহীর স্বর্গদ্বার তাকে বিনা অভিষেকে প্রত্যাহত করেছে। পৌরুষের অভিমান ও পাপবোধের ব্রীড়া শামুকের খোলসের মতো শক্ত চাড়া জমিয়ে তোলে তার ব্যক্তিত্বের অদ্যোপান্তে। তবু শীর্ণ এক নদীর নাগরিক পটভূমিতে এলিয়ে বসে ভাবনাবিষে জারেজার হয়ে যেতে থাকে একটি প্রায়াধুনিক যুবকের মন। এ-শরীর নিয়ে আমি এখন কী করতে পারি? আমার মন কূরে নিচ্ছে অনিশ্চিত অভীষ্টের নিরন্তর যন্ত্রণায়। বিয়েশাদী না করতেই সংসার একটা খাটো খুঁটোয় বাঁধা রশি, মাথায় ফাঁস, ফাঁসের মধ্যে তার ঠ্যাং, ততোধিক কী জটিল এই মফঃস্বল শহর, ঘিনঘিনে পচা কুণ্ড , আবর্তহীন গ্যাস, দূষিত দুর্গন্ধী নীল, ময়ালের পাক, সমস্ত স্নায়ুমূল বেড় দিয়ে। সারাক্ষণ খাবি খেয়ে হাঁপি তুলে এই কি বেঁচে থাকা? লঘু পায়ে মেঘ ঘনিয়ে আসে মাথার উপর। জ্যৈষ্ঠের জলীয় বাষ্পে ভরা মেঘ। গা-জ্বলা বাতাস। ভারগ্রস্ত সন্ধ্যা। কুটুমামু মানাফের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আসছে। কোহিনুরের বড়ভাই। বিপত্নীক বিসংসারী। কোহিনুরের সংসারে ঠাঁইগাড়া। কোহিনুরেরই মতো পরোপকারী নির্ঝঞ্ঝাট। অ ভাগনা! আম খাবা না? বাড়ি আসো। কোহি কা’ট্টা রাখছে। মানাফের ডানা ধরে টান মারে কুটুমামা। যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে চায়ের মতো। রাতে পড়ার টেবিলে এসে খাবার তাগিদ দিয়ে যায় কোহিনুর : খাতি আসো তো! অতো পড়লে বেরেন শট্ হয়া যাবে। বিএডা পাশ করে গদিতে বসো পারমেন্ট হয়া। আর লাগবে না। খাবে কেডা অ্যাতো? কিসির অভাবে অতো পড়ার কাম? সদ্যোবিধবা নারীর অফুরন্ত মাতৃত্বরস। সদ্যএতিম যুবকের অক্লান্ত জীবনজিজ্ঞাসা। লেনিনের বায়োগ্রাফির পাতা মুড়ে উঠে পড়ে মানাফ।
শহরের চাঁদনীপাড়ার কাজীবিল্ডিংয়ে এক সাঁঝরাতে পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায়। এই সব নীলরঙা জিপগাড়ি চোরপায়ে চলে, স্পটে এসে রণপায়ে কোঁদে। একজন দারোগার নেতৃত্বে তিনজন কনস্টেবল গট গট করে উপরে উঠে যায়। এদের এই নৈশ অভিযান সম্পূর্ণ আঁচের বাইরে। থতমত মানাফ তড়িঘড়ি মার্কসবাদী লিটারেচার সব ব্যাগে পুরে পিঠে বেঁধে নেয়। তারপর পেছনদরজা দিয়ে বেরিয়ে পানির পাইপ বেয়ে অন্ধকারে হাওয়া হয়ে যায়। দরজায় লাঠি ঠুকে আগমন জানান দেয় দারোগা। দরজা খোলাই ছিল। ভুস করে ভিতরে ঢুকে পড়ে সবাই। ছোট বাচ্চাকে বুকের দুধ দিচ্ছে কোহিনুর। অ্যায় খোদা! হোয়াট এ চাঁদমারানী সিন! মনে মনে সাহিত্য কপ্চায় দারোগা ফাজেলআলী। এ অধিকার তার বিদ্যাগত। যেহেতু বি এ-তে স্পেশ্যাল বেঙ্গলি ছিল এবং তদুপরি ক্লাশমেট আশামণিকে উদ্দেশ্য করে আধুনিক কবিতাও লিখত। ঝট করে নিজেকে সামলে নেয় কোহিনুর। ফুঁসে উঠে বলে, আপনেরা ক্যা ঘরের মধ্যি? ঘাবড়ে গিয়ে মা বলে বসে ফাজেলআলী, আমরা ঘর সার্চ করবো মা। ক্যা? আমরা কি চোর না ধাইড়? অরেন্ট আনছেন? ওয়ারেন্ট লাগবে না। উপরের নির্দেশ। কাজী সাহেবের বড়ছেলে মানাফ কাজী কই? তার নামে কমপ্লেন আছে। এইবার খেপে ওঠে কোহিনুর। দারোগার সামনে আঙুল তুলে চড়া গলায় বলে, আমার ছাবালের চরিত্র দুগ্ধের অধিক শাদা। খবরদার! তার পরে কালি দিবেন না। না কালি দেবে না! দারোগাও খেপে যায়, মানাফ কাজী খারাপ দলে কানেকটেড। ঘরে আর্মস্ রাখে। কোহিনুর তবু আড়িতর্ক তোলে, আমার ছাবাল কার সাথে মেশে কী খায় তা আমি জানি না, উনি জানেন? এঁঃ! দুজন কনস্টেবল ঘরবাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসে দারোগার সামনে হাত উল্টিয়ে ঠোঁট ভ্যাটকায়। দারোগা বলে, সরি! কোহিনুর কোনো সরিতে দমবার মেয়ে নয়। ছিল্লা মেরে বলে, অস্তর পাইবেন কই? আমার ছাবালের উচ্চ বেরেন। দিনরাত বই মুখে দিয়া -। দারোগা হাসে বেকুবের মতো। একজন কনস্টেবল তার কানে কানে বলে, ঘাঁটানোর কাম নাই ছার। ছিফেলতলীর খাঁ-বাড়ির মাইয়ে। তেনার বাপচাচারা ব্যাবাক সরকারি পার্টির লিডার। পুলিশের কানেকথাও উচ্চগ্রামে বাঁধা। কোহিনুরের কান স্পর্শ করে। পুনরপি ছিল্লা মারার কারণ ঘটে তার দিক দিয়ে : আমার বাপের বাড়ি গাবাইতে গ্যালে গিট্ঠুখেল দ্যাখাইয়া দিবোগা।
পরদিন খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে কলেজে যায় মানাফ। তার সব চেয়ে প্রিয় স্যার পলিটিক্যাল সায়েন্সের টিসি ওরফে তোশারফ চৌধুরী। শুধু সেই একটি ক্লাশ করে এসে লাইব্রেরিরুমে বসে আছে চুপচাপ। দূরে টেবিলে নিউজপেপার পড়ছিল একই ইয়ারের ফারহান। উঠে এসে নিঃশব্দে মানাফের পাশে বসে পড়ে। এই বন্ধুটিকে বেশ পছন্দ মানাফের। বাবা সরকারি দলের এমপি হলেও সে দালালি করে না। বামরাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে মুকতাদির-মানাফের সঙ্গে শেয়ার করে। ভিতরের কথা না ভেঙে শুধু জানায়, একটা ষড়যন্ত্র চলছে মানাফকে নিয়ে। ফারহানের বাবা খবিরউদ্দিন এমপি জড়িয়ে পড়েছেন। লালু মাস্তান প্রায়-রাতে আসা-যাওয়া করছে তাঁর কাছে। মানাফের উচিৎ আজই এমপি-র সঙ্গে দেখা করা। এদিকে টেনশনের চোটে রাতে ফিট হয়ে পড়ে কোহিনুর। সারারাত হ্যাঁ-না-এর মধ্যে টানাপোড়েন করতে করতে হাল ছেড়ে দেয় মানাফ। সকালে কলেজে যাবার আগে এমপি-র বাড়ি যায়। খবিরউদ্দিন সরকারি দলের সাংসদ কিন্তু কোনো রংরেজীমার্কা গুমর নেই। কথা বলতে ভালোবাসেন, অন্যদেরও কথা বলতে দেন। তবে কি-না চাম্চারা ডাইনেবাঁয়েপেছনে সারাক্ষণ কিচিরমিচির করার তালে আছে। কেউ কেউ বাড়িয়ে বলার ঝোঁকে ইঁদুরকে হাতি বলে চালিয়ে দিতে চায়। কেউ ফিরিফোকটে দুটো পয়সা মেরে খায়। খবির মিয়া নিজের হাতে দোরস্ত করেন তাদের, যদি ধরা পড়ে। খেদোক্তি করেন, মানুষ করতি পারলাম না। মানাফ তাঁর পিয়ারা দোস্তো রাউজান কাজীর ছেলে। কলেজের ফার্স্ট বয়। কিন্তু গোপন তথ্য, হালে বখে যেতে বসেছে। তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান ফারহানের কানে বদরাজনীতির ফুসমন্তর ঢোকানোর তালে আছে। এই ঠ্যাঁটা ছেলেকে কী করে শহরছাড়া করতে হয় তাঁর জানা আছে। তবু জনপ্রতিনিধি বলে কথা। দেখা দিলেন কথা বললেন, তবে আধঘণ্টা বাইরে বসিয়ে রেখে তার পর। ঢের ঢের এলেম দিলেন মানাফকে : তোমরাই এ-শহরের মাথা, ইউ আর দ্য নেক্সট জেনারেশান আই মিন নতুন প্রজন্ম, আমরা দুই পুরুষের আই মিন ডাবল জেনারেশান এমপি, ফারহান আই মিন মাই সান, সেও হবে এমপি, তুমি বাড়ি চইলা যাও ল্যাখাপড়া করোগে, থানার ব্যাপারটা আমি দেখতাছি, হ্যালো থানা – থানা – ওসি সাহেব? – ওলায়কুম, আর হ্যাঁ ভাবিসাহেবারে আমার সালাম দিয়েন – জী ওসি সাহেব এনিটাইম ইউ কাম -। মানাফের পিছু পিছু একটা চৌকোমুখো লোক, আকামানো, ক্ষুধিত চোখ, কাটা দাগ বাঁ কপালে, থানার সোর্স, নাম কেফাতুল্লা, সুড় সুড় করে হেঁটে চলে আসে। মুখের কাছে মুখ এনে আসল তথ্য আউট করে : লালু মিয়া আপনেরে ছাড়বো না, মাঢার করবো, থানায় টেকা দিছে, এমপি সাবরে মন্তর পড়াইছে লালু, শাহেনারা বেগম সেই যে আপনেগো পুরানবাড়ির দোতালার পরী হ্যারে প্রেম করে লালু, অখন হেই কইন্যা আপনের পরে উইক, এখনে আপনের নেজস্ব জানডা লইয়া কাইটা পড়াই ফরজ, হেভি রিস্ক্ এইসব জানাজানিতে – বোঝতেই পারতেছেন মানাফ মিয়া আমি অঢিনারি পাবলিক…। ক্ষুধিত চোখ শুকনো মুখ। দশটা টাকা দিয়ে বিদেয় করে মানাফ।
বাড়ি ফিরে এসে ভীষণ অস্বস্তি। এমন যে উঠতি বয়েসকাল, ভীষণ ভীই-ষ-ণ মূলোচ্ছিন্ন মনে হয় গোটা অস্তিত্ব। সামনে তিনমাস পর বি এ পরীক্ষা। কত আশা নিয়ে বসে আছেন প্রিন্সিপ্যাল, টিসি স্যার, এমন কি ঘরের মধ্যে ‘মেইয়ে’ কোহিনুর পর্যন্ত। শাহী আপা ওর চেয়ে বয়েসে সিনিয়র – অ্যাবসার্ড! কৌমার্য ভাঙার সেই অর্ধসমাপ্ত খেলা – হ্যাঁ, খেলাই তো, মধুর খেলা – থ্যাংক য়ু শাহী আপা, তা বলে প্রেম? তোমার সাথে? ধ্যু-উ-স্!
দুদিন পর শুক্কুরবারের বিকেলবেলা। পুরনো বাড়ি যাবার জন্যে বেরিয়ে পড়ে মানাফ। বেশ কিছু নোট পড়ে আছে ওখানে। পরীক্ষার আগে নিয়ে আসার দরকার। কিন্তু বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বাঘ, মনে হয় দূর থেকে তাকে দেখতে পেয়েছে। মাটি খুঁড়ছে জুতোর ডগা দিয়ে। এখনো সন্ধে ঘনায়নি। মানাফও দেখতে পেয়েছে ওকে। এত শিগগির মোকাবিলা হয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি। না-কি ফিরে যাবে? কিন্তু এত নাগালের মধ্যে এসে পিছু ফিরলে পেয়ে বসবে পরে। পায়ে পায়ে হেঁটে একেবারে সামনে চলে আসে। চোখ আগুনের গোলা, নিচের ঠোঁটে কামড়ে বসা দাঁত, সারা মুখমণ্ডলে অজাচারের চিহ্ন। হঠাৎ চোখ ছোট করে নেকো স্বরে বলে, ভবনদীর সোঁতা বাইয়া কই গিছিলেন দুই বন্ধুতে মিইলা? আমরাওনি যাইতে পারি? মাথার মধ্যে সল্তে জ্বলে ওঠে মানাফের। কড়া গলায় চিৎকার করে ওঠে, সে কৈফিয়ৎ তোমারে দেয়া লাগবে? ইউ মার্ডারার! এবারে সত্যিই গর্জে ওঠে বাঘ, চুপ ব্যাটা কমুনিস! শালা বুদ্ধিজীবী! তোর বুদ্ধিরে আমি…! থ্যাপ্ – হড়াৎ করে খানিক কাশিমাখা থুথু ছুড়ে মারে মানাফ ওই বিকৃত মুখের উপর। সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত চলে যায় সেই পাশবিক দুর্বৃত্তের। চূড়ান্ত ঘটনাটা ঘটতে গিয়ে বাধা পড়ে যায় নারীকণ্ঠের তীক্ষè আর্তনাদে : না – না – লালুভাই – স্টপ – স্টপ! ওপরতলা থেকে ব্যাকুল গলায় নিষেধ ছুড়ে দিচ্ছে শাহী। সে-নিষেধে আজ্ঞা এবং উদ্বেগ দুইই মেশানো। মানাফের বিস্ময়ের আরো কিছু বাকি ছিল। পকেট থেকে হাত বের করে আনে লালু। ইলেকট্রিফায়েড জন্তুর মতো মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়। নারী রহস্যময়ী : সেই প্রাচীন আপ্তবাক্য আওড়ায় মানাফ। শাহী আপা! তোমাকে কি ঘৃণা…?
আজ হোক কাল হোক লালু যে একদিন বদলা নেবে, সে তো নিশ্চিতই। কিন্তু তা বলে এত শিগগির? জুন মাস পড়ে গেছে। কর্মচারীদের মাইনে ও অন্যান্য খরচের জন্যে ব্যাংক থেকে চল্লিশ হাজার টাকা তুলে এনেছিল মানাফ নিজে। সঙ্গে কুটুমামু। হঠাৎ দুই মোটরসাইকেল এসে পথ আটকে দেয়। চার আরোহীর একই পোশাক, নীল জিন্সের জ্যাকেট, কালো সানগ্লাস, পিস্তল। লাথি মেরে গাড়ির দরজা ভেঙে ফেলে। শার্টের কলার ধরে টেনে বের করে আনে মানাফকে। কুটুমামা গায়ে হাত দেয়ার সুযোগ দেয় না। নিজে থেকেই সুড়ুৎ করে বেরিয়ে আসে। টেরই পায় না, পাজামা ভিজিয়ে ফেলেছে। একজন গাড়ির সিটে রাখা টাকার ব্যাগ তুলে আনে। সবটাই কম্যান্ডো স্টাইলে। লালু মাস্তান পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তিন পা এগিয়ে আসে। বাঁ হাতে সানগ্লাস খুলে ফেলে। সরাসরি চোখ রাখে মানাফের চোখে। সপাটে চড় কষায় তার বাঁ গালে। মানাফ ঘুরে পড়ে যায় মাটিতে। কুটুমামাও লাট্টুর মতো ঘুল্লি দিয়ে বসে পড়ে রাস্তার উপর। মানাফের চুল ধরে টেনে তোলে লালু। দাঁতে দাঁত ঘষে বিশ্রী বকা দিয়ে বলে, – আজ কিছু কইবো না। যে জিভ্ভা দিয়া ছ্যাপ ফিকছস, সেই জিভ্ভা আমি কাইটা লইয়া কুত্তারে খাওয়াইমু। বাড়ি যায়া সৎমায়ের দুধ চোষগে।
এমপি সাহেব ঘটনা বিস্তারিত শুনে তালুতে জিভ ঠেকিয়ে চ্চুক্ চ্চুক্ শব্দ করেন। আফসোস করে বলেন, বেচারার কেবলই লস যাইতেছে! বাপটা মরলো হেই দিন, অখন আবার দ্যাখো। তিনি ঘন ঘন থানায় ফোন করেন। টাকা উদ্ধারের জন্য ওসিকে কড়া নির্দেশ দেন। ওসি সাহেব মানাফের কোনো বেফাঁস কথার ছুতো ধরে হঠাৎ চটে যা। তেরিয়া হয়ে বলে, দ্যাখেন মানাফ সাহেব, আপনি বি এ ক্যান্ডিডেট আমিও বি এ পাশ। আপনি যদি এই ল্যাংগুয়েজে টক করেন আমার লগে, দেন আই কান্ট্ হেল্প্। সরি!
চল্লিশ হাজার টাকা পূরণ করতে রীতিমতো বেগ পেতে হলো মানাফকে। ঘটনা শুনে মুকতাদির সঙ্গে সঙ্গে কাজীবাড়ি চলে আসে। সাথে ডা: ফারাজী। প্রয়োজনীয় ফার্স্ট-এইড দিয়ে ডাক্তার চলে যান। কোহিনুরের হাহুতাশ না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় দুই বন্ধুকে। তারপর দরজা আটকে দিয়ে শুরু হয় শলা-পরামর্শ। মুকতাদির তিরস্কার করে বলে, অখন তো আর একটা রাতও নষ্ট করা চলবে না। যে কোনো সময় মারা পড়বি তুই। থানাপুলিশএমপি সব লালুর বেনিফিশিয়ারি। কে বাঁচাবে তোরে? কী স্ট্রেংথ্ আছে তোর? মুকতাদিরের বাস্তব যুক্তি ও নিজের অসহায় দশা – দুইই স্বীকার করে মানাফ। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে দুহাত উল্টিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। খেদের সঙ্গে বলে, অগত্যা তাইই কর তাইলে, যদি ভালো বুঝিস। দে ফোন কইরা। বি এ-টা আর পাশ হইলো না রে! মুকতাদির অভয় দিয়ে বলে, পরীক্ষা আটকাইতাছে কোথায়? তুই বড় পেসিমিস্ট! বলতে বলতে পকেট থেকে মোবাইল ফোনসেট বের করে। নির্দিষ্ট নাম্বার টিপতেই ওধার থেকে ভেসে আসে কমরেড পরাণের কণ্ঠস্বর।
জুন-জুলাই দুটো মাসের ভ্যাপসা গরমে লোকজন অতিষ্ঠ। আকাশে স্থায়ী মেঘ, প্রায় সার্বক্ষণিক বর্ষণ, তবু তারই মধ্যে গায়ের চামড়া ওদলানো অসহ্য গরম। সব জ্বলে যায়। তদুপরি, বোঁটকা দুর্গন্ধ। আমের খোসা কাঁঠালের ভুচড়ো নীল গুয়েমাছি; – সব কিছু পচে মিশে মহাগুলজার। এসব দুর্ভোগ তবু গা সওয়া হয়ে যায়। কিন্তু যে পচা রক্ত দূষিত মল বিকৃত জিঘাংসা সমাজদেহের শিরায় বয়ে চলেছে, তার জাঁতাচাপ দুঃসহ, এবং দুরারোগ্যও। এই গণ্ডশহর এখন পরিচিত সন্ত্রাসনগরী হিসেবে। একাত্তরের পরে যারা জন্মেছে, তাদের কাছে এখনকার এই গুলিগোলার আওয়াজ এক অবৈধ বিভীষিকা। তখন মানুষের মনে একটা নির্ধারিত আদর্শবোধ জীয়নো ছিল, ছিল চাপা প্রত্যাশা। এখন এই নিত্যদিনের রক্তপাত, নিত্যরাতের ঘুমছুট ত্রাস, এর থেকে উদ্ধারের নিদান কেউ বাৎলাতে পারছে না। পাতের উপর খসে পড়ে এককোপে নামিয়ে দেয়া কল্লা, ভাতেঝোলেরক্তে মাখামাখি, জ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে চিরতরে গুম, মোটা টাকা চাঁদার দাবিতে হুমকি দিয়ে চিঠি, মেয়েদের তুলে নিয়ে বেদম ধর্ষণ, ঘাটমাঝি-রিকশাওয়ালা তোলা আদায়ের জ্বালায় উত্ত্যক্ত; এই হলো নৈমিত্তিক চালচিত্র। মায়েরা অবাধ্য শিশুদের ভয় দেখায় : ওই লালু মাস্তান আসে। এই নিরুদ্ধার পিঁজরাপোল থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ ঢুঁড়ে পায় না ভুক্তভোগী মানুষ। থানা কেস নেয় না, নিলে তদন্তরিপোর্ট হাল্কা করে লেখে, আসামি জামিনে বেরিয়ে আসে, চার্জশিটে মূল আসামির নাম থাকে না, থাকলেও ফাইন্যাল রিপোর্টে পার পেয়ে যায়। রাজনৈতিক কর্তারা সব কিছু দেখেশুনেবুঝে শেষে শিবনেত্র হয়ে বসে থাকে।
রাত দেড়প্রহর। একপশলা ভারি বর্ষণের পর আকাশে বেচারা চাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছে। গাছের পাতায় চিক চিক করছে জলকণা। কাদা বাঁচিয়ে পথ হেঁটে আসছে মানাফ। মুকতাদিরের রুমে বসে আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গেছে। হঠাৎ একেবারে সামনেই দুই মূর্তিমান আবলুস জোয়ান খাড়া। মুঠোয় রামদা-কুড়ুল। অস্ত্রের ধাতু চল্কে উঠছে চাঁদের আলোয়। হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে ডান হাতের কনুইয়ের সাইডের ছোট একটা টুকরো উড়ে যায়। দ্বিতীয় কোপ শূন্যে ঝুলন্ত থাকতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মানাফের পায়ে অস্বাভাবিক গতিবল সঞ্চার করে। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে সে। পেছনে দুই পেশাদার খুনি। জনহীন রাস্তা, থমথমে জ্যোছ্না, রক্তলোল ভবিতব্য। কালান্তক রাত মাথায় নিয়ে বনবাদাড় ভেঙে ছুটে যাচ্ছে শিকার। প্রাণটুকু বাঁচানোর প্রাণপণ তাগিদ। রামদায়ের ডগায় তার পেছনকার জিন্সের প্যান্ট ফালা। সামনেই পুরনো এক হিন্দুবাড়ি। মালিক আলুপট্টির ব্যবসায়ী। খোলা গেট পেয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে পড়ে মানাফ। ঝুল খাটিয়ে ছুটে বাড়ির পেছন দিকে চলে আসে। লাফিয়ে দেয়াল ভিঙোতে গিয়ে হাঁটু ছড়ে যায়। শ্যাওলার স্থায়ী সবুজ দাগ পড়ে নীল জিন্সে। পেছনে চারপাঁচটা বিল্ডিংয়ের পরই টিসি স্যার ওরফে তোশারফ চৌধুরীর বাসাবাড়ি। মানাফ উন্মাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে দরজার উপর। তোশারফ চৌধুরী প্রথমটায় ভয় পেয়ে ভেতর থেকে দরজা ঠেসে রাখেন। পরে মানাফের গলা চিনতে পেরে খুলে দেন। রক্তাক্ত মানাফ তাঁকে জড়িয়ে ধরেই চেতনা হারায়। আততায়ীদুজন আলুব্যবসায়ীর কাঠের দরজা রামদায়ের কোপে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে গজরাতে গজরাতে ফিরে যায়।
এই ঘটনার ঠিক দুদিন পরেই মুকতাদিরের মোবাইলে ভবনদীর ওপার থেকে গ্রিন সিগন্যাল আসে। মানাফকে নিয়ে চলে এসো ইমিডিয়েটলি। পরাণ সেখ। শেষরাতের দিকে খুব চুপিচুপি নৌকোয় উঠে বসে ওরা তিনজন : মুকতাদির, মানাফ, পট্লা মিয়া। এবারে আর ডিঙিনৌকো নয়, ছইঅলা পান্সি। আগাগলুইয়ে রাউজান কাজীর সেকেলে গাদাবন্দুক হাতে পট্লা মিয়া। পাছগলুইয়ে বৈঠা হাতে মুকতাদির। ছইয়ের উপর হোগলার চাচ বিছানো, তার উপর কোহিনুরের দেয়া ফুলকাঁথা পেতে দিয়েছে পট্লা মিয়া। বালিশের উপরও নকশি আঁকা ওয়াড়। মাথা পেতে শুয়ে আছে মানাফ, লাশের মতো নিথর, ধ্বস্ত-নিঃশেষিত। পায়ের কাছে চিঁড়ের টিন, পাশে গুড়ের কলস, কোহিনুরের উতলা প্রাণস্পর্শ। মাথার কাছে কালো ট্রাংক। বইপত্তর ভরা। শুধু যে স্থানিক হিসেবে বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে তাই নয়, মনের দিক দিয়েও মানাফ আজ একেবারেই উদ্বাস্তু। চিরটাকাল আত্মগত মানুষ সে। আবেগের বুদ্বুদ বাইরে ফোটার আগেই ভিতর থেকে নিঃস্ব নিস্তেজ হয়ে যায়। তার এই বাইশ বছরের জীবনযৌবনে অশ্রুপাতের ঘটনা একবারটি মাত্র ঘটেছে। নিজের মাতৃবিয়োগের উপলক্ষে। বাপের মৃত্যু তাকে কাঁদাতে পারেনি। চাপমুক্ত করেছিল বটে। ডাক্তার কাটা কনুই ড্রেসিং করেছে বিনা অ্যানাস্থেসিয়ায়, একবিন্দু জল গড়াতে দেয়নি চোখ থেকে, এমনই ইচ্ছাশাসন। অথচ সেই তাকে আজ বিমাতা কোহিনুর কেঁদে কাঁদিয়ে দুব্লা করে দিল। বিদায় নেবার সময় মানাফ উবু হয়ে তার পা ছুঁতে চেয়েছিল। কোহিনুর ছুঁতে দেয়নি, বরং বাপো – মোর বাপো রে – বলে বুকে জড়িয়ে ধরে সে কী ডুকরানি! না তো, এবারে আর কোনো তরল স্খলনে বিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়নি মানাফকে। বরং কামগন্ধহীন স্নেহরসের ফল্গুধারায় প্লাবিত হয়ে গেছে তার আমূল অন্তরাত্মা। বইগুলোও কোহিনুরেরই গুছিয়ে দেয়া : একটা দিনও নষ্ট করবা না, মনে থাকবে তো? তিনমাস পরে বি এ পরীক্ষা। আর মনে পড়ে যায় ছোট ভাইবোনগুলোর মুখ, বিশেষ করে, শাফিয়ারা ক’মাসের মধ্যে বড় ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল তার। আসার সময় টের পেতে দেয়নি কাউকে। সবাই ঘুমিয়ে।
শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবার দুইদিন পর খবর আসে লালুর কানে। সাগরেদদের সাংগঠনিক ব্যর্থতার জন্যে তুলকালাম কাণ্ড বাধায় লালু। ফাটাজসীমের রিভলবার কেড়ে নেয়। এক কেজি ওজনের থাপ্পড়ে চ’তেঘুল্লি খাইয়ে দেয় বেঁড়েকোদাকে। একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে পর পর তিনদিন টহল দেয় কাজীবাড়ির সমুখ দিয়ে। আর শহরের মোড়ে মোড়ে, বিশেষ করে চাঁদনীপাড়ার প্রতি বাঁকে কড়া নজরদারি বসায়। কাকপক্ষী রা কাড়তে সাহস পায় না। কাজীবাড়ির গেট তিনদিন বন্ধ থাকে। হিংস্র আক্রোশে গুলবাঘা একা একা মোচ মচকায় থাবা চাটে।
আকাশের ভাবগতিক সন্দেহজনক। যে-কোনো সময় বাতাস ছাড়বে যে-কোনো সময় ঢল নামবে। তখন রাত সবে একপ্রহর। অন্ধকার মোষকালো। হংসভাসী থেকে দ্যাওদত্যি উঠে এল। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ল, গাছ ওপড়াল, ঘরের চালা দিকশূন্য হলো। ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল থানার সেকেলে কোঠাবাড়ি। বারান্দার খুঁটিসহ টিনের চাল উড়ে যায়। দেয়ালের আলগা প্লাস্টার খসে পড়ে। আগুনের ঝিলিক ও কানফাটানো আওয়াজে বেদিক সমস্ত সেপাইশাস্ত্রী। গুলি ছুড়তে থাকে এলোপাতাড়ি। মহাবীর ওসি আবজাল একছুটে বাথরুমে গিয়ে সেঁধোয় এবং সেখানে আপনঅজান্তে লুজমোশনে লটকে যায়। বিস্ফোরণের পাঁচ মিনিটের মধ্যে কনস্টেবল শুকুরআলীর গায়ে একটা পলিথিনের বড় প্যাকেট উড়ে এসে পড়ে। সেই বিশেষ সন্ত্রস্ত মুহূর্তে আগন্তুক-জিনিসটি আতঙ্ক বাড়িয়ে দেয়। ভিতরে বোমাটোমা থাকলেও থাকতে পারে। খুব সাবধানে তুলে এনে টেবিলে রাখা হয়। বড়সাহেব এসে খুলবেন, তাঁরই হক, এটা ক্রিটিক্যাল আওয়ার। বড়সাহেব ল্যাট্রিন থেকে উঠে এসে প্যাকেটটির দিকে তাকিয়ে থাকেন, চোখে গুরুত্বপূর্ণ তল্লাশি রোখ, ভীত ও পেশাদারি যুগপৎ। অধস্তনদের সামনাসামনি কিছুটা মানহানিকর বটে। ফলত ফল্স্ আস্ফালনে খুলতে শুরু করে পলিথিনে জড়ানো রশি। ক্রমশ উন্মোচিত হয় বেশ কয়েকমিটার লংক্লথের শাদা থান, ভাঁজের মধ্যে পিনবদ্ধ বিজ্ঞপ্তি : জনাব ওসি সাহেব! লালু মাস্তানের ঘিমাখন মেলা দিন খেয়ে খেয়ে ভুঁড়িতে চর্বি জমিয়ে ফেলেছেন। লালু শীঘ্র হাওয়া হইয়া যাইবে। কাফনের কাপড় পাঠালাম সেই সঙ্গে শেষ বিরিয়ানি খাইয়া লইবার জন্য ১০০০ টাকা (কাফনের ভাঁজের ভিতর দ্রষ্টব্য)। লাল সেলাম। দুনিয়ার মজদুর এক হও। বাম গণবিপ্লবী পার্টি জিন্দাবাদ। মার্কস-লেনিন জিন্দাবাদ। মাও সে তুঙ জিন্দাবাদ। ইতি – বাম গণবিপ্লবী পার্টির পক্ষে। বাস্তবিক দুভাঁজ পরেই বেরিয়ে পড়ে দুটো করকরে পাঁচশো টাকার নোট। ও আল্লাঃ! এপারেও সর্বহারা? চিক্কুর দিয়ে চেয়ারের হাতল চেপে ধরে ওসি আ ফ ম আবজাল হোসাইন এবং স্বতঃস্ফূর্ত লুজমোশন তাকে আবারো বাথরুমে ধাবিত হতে প্ররোচিত করে।
ঠিক একই রাতে একই সময়ে অত্র এলাকার এমপি খবিরউদ্দিনের গেটের ভিতর দ্বিতীয় পলিথিন-প্যাকেটটি এসে ছিটকে পড়ে। ভেতরে সেই কয়েকমিটার শাদা লংক্লথ, হাতে লেখা চোতা ও আখেরী খানার মূল্য বাবদ একহাজার টাকা। চোতাটির ভাষা প্রণিধানযোগ্য : মাননীয় সাংসদ সাহেব ! আপনি জনগণের ধনসম্পদ শোষণ করে টাকার কুমীর হয়েছেন। লালুর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। তাকে দিয়ে অনেক কুকর্ম করিয়েছেন। এখন সে-সবের পাই পাই হিসাব দিতে হইবে। আপনাকে পার্টির হাইকম্যান্ড মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছে। এই দণ্ড যথাশীঘ্র কার্যকর করা হবে। তদুদ্দেশ্যে কাফনের কাপড় পাঠাইলাম। কাজে লাগিবে। আর মাত্র ১০০০ টাকা আখেরী খানা খাইয়া লইবার জন্য। লাল সেলাম। বাম গণবিপ্লবী পার্টি জিন্দাবাদ। মার্ক্স্-লেনিন জিন্দাবাদ। মাও সে তুঙ জিন্দাবাদ। দুনিয়ার মজদুর এক হও। ইতি – বাম গণবিপ্লবী পার্টির পক্ষে। এই চিঠি পড়ে প্রথমটায় বেশ খানিকক্ষণ তেড়িবেড়ি করতে থাকেন খবিরউদ্দিন। হাজার হলেও এত বড় একটা কনস্টিট্যুয়েন্সির নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। দোর্দণ্ড প্রতাপ। কী? আমারে হুমকি? আমি সরকারি দলের সাংসদ! এই এলাকায় আমার সুপ্রিম পাওয়ার! হাঁসভাসীর ওপারের ওই সব সর্বহারা তো? ওদের সঙ্গে যোগ দেছে রাজন কাজীর হারামজাদা পোলা মানাফডা। আইচ্ছা, আমিও দেখে নিমুয়ানে। এঁঃ! মাও সে তুঙ কালাইছেন! আমার বালেশ্বর বাল! কিন্তু এই বিক্রম দীর্ঘস্থায়ী হতে পায় না অপরাধচেতনার অন্তরীন দুর্বলতার দরুন। অচিরেই বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসে খবিরউদ্দিনের। পরিবার সম্পত্তি নিজের প্রাণধন; কে না চায় এ-সবের নিরাপত্তা? সুতরাং গানম্যানের সংখ্যা বাড়ে। থানায় মানাফ কাজীকে একনম্বর আসামি করে জিডি হয়। লালু মাস্তান বিতাড়িত হয়, শুধু এমপি ভবন থেকে নয়, শহরের ত্রিসীমানা থেকে।
লালুর বিতাড়নপর্ব ডাবল অ্যাকসিলারেশনের প্রয়োগে ত্বরান্বিত হয়। প্রথম চোটটা জোটে তার এতকালের পেয়ারে ইয়ার ও একান্ত বিশ্বাসভাজন ওসি আবজাল হোসাইনের দিক থেকে। দ্বিতীয় রামধাক্কা লাগান লালু যাঁর চিরবশংবদ যাঁর জলহাওয়া খেয়ে বেড়ে বেড়ে আজ ডাকসাঁইটেটি হয়ে উঠেছে, তার সেই গডফাদার জনাব খবিরউদ্দিন ডাবল এমপি-র তরফ থেকে। তবে তার আগেই এক কৃষ্ণপক্ষীয় মধ্যরাতে লালুর অপ্রতিহত মাস্তানি সর্বপ্রথম এক কেলেঙ্কারীজনক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। হংসভাসীতে বাঁধা শ্যালো নৌকোয় এসে ওঠে ওরা, মানে সংখ্যায় তিনজন মাত্র : লালু আর তার দুই স্যাঙাত ফাটাজসীম বেঁড়েকোদা। ফাটাজসীম বেরুবার আগে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল। আবহাওয়ার বেজার দশার অজুহাত তুলে আজ রাতটা রয়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু লালু তো চোরচোট্টা নয় যে তাকে ধর্মের কাহিনী শুনতে হবে। সে হচ্ছে মাস্তান ডাকাত। আল্লা মিয়া এক বোবাকালা জীব, তার সত্যিকারের সহায় শয়তান। শয়তানে ভর দেয়া মানুষেরাই দ্রুত সাফল্য লাভ করে। ম্যান্দরা মাইরা গেছস তাই না? ল ওঠ, আইজ সাঁই মাল দেবানি। ওরা নৌকোয় উঠে পড়ে। খোলের মধ্যে কালো জাল মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল তারা চারজন। কালো পোশাক কালো মুখোশ। হঠাৎ ¯িপ্রংয়ের মতো অন্ধকার ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে চারমূর্তি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনজনের হাতে তিনজোড়া হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দেয়। এই হ্যান্ডকাফ ও লাইট মেশিনগান থানালুটের সম্পত্তি। চোখের পলকে তিনজনের তিনটে আর্মস্ ছিনিয়ে নেয়া হয়। লালুর একে-৪৭টিও। শহরে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় বসে মাস্তানি চালানো এক কথা, আর প্রশিক্ষিত গেরিলাদের চ্যালেঞ্জ ফেস করা অন্য কথা। কোনোরকম বাধা দেবারই সুযোগ করে উঠতে পারে না। তার আগেই তিনজনকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে পাটাতনে ফেলে রাখা হয়। একজন মুখোশধারী লালুর নাকের ডগায় একখানা দোধারী ছোরা ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, এতকাল অনেক নিরীহ মানুষেরজানমালের ক্ষতি করেছো। তোমার খেল খতম আজ থেকে। একেবারে শেষ করে দিচ্ছি না। বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে মৃত্যুর স্বাদ দেয়া হবে। আপাতত শুধু একটামাত্র আলামত রেখে দিচ্ছি তোমার শরীরে। বাবাদের গিয়ে দেখাবে আর যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে, পিচ্চি মাস্তানরা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলাবলি করবে, শুধু এককান কেন? দু’কান কাটা না কেন? একজন মুখোশধারী লালুর মাথা পাটাতনের কাঠের উপর চেপে ধরে। অন্যজন ঘাড়েপিঠে হাঁটু দিয়ে ঠেসে রাখে। লালু গোঁ গোঁ করে গজরাতে থাকে। তৃতীয় মুখোশধারী তার চোখের উপর নাতিদীর্ঘ ছোরাটি তুলে ধরে। ফিনফিনে বাতাস, ফিশফিশে বৃষ্টি, টাটকা কাঁচা অন্ধকার, শ্যালো মেশিনের যান্ত্রিক গুঞ্জন আর ছয়ব্যাটারির টর্চের আলোর সরল ব্লেড। বিস্ফারিত চোখের উপর ছোরার ডগার অমোঘ মতলব লক্ষ করতে থাকে লালু। ওর বাঁ কানের নিচের লতির নরম মাংস কুচ করে কেটে নেয় ছোরা। ‘যা ফোট্’, তিনজনকে পাছায় লাথি মেরে নদীতে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়।
নতুন লেবাসে পুরনো লালু মাস্তানের আবির্ভাব ঘটে শহরে। কানকাটা বিদেশী টুপি গলায় রঙিন রুমাল চোখে সানগ্লাস হাতে অ্যাটাচি; এ এক আনকোরা লালু সন্দেহ নেই। নতুন সুরতে প্রথমেই মোলাকাত করতে গিয়েছিল থানাস্টাফের সঙ্গে। তার বহুৎদিনের রোয়াবদাপটের ক্ষেত্র এই থানাকম্পাউন্ড। বদনসীব! বড় চোট খেতে হলো এই চেনা জায়গাটিতে এসে আজ। দরজার কনস্টেবল তাকে দেখে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁত বের করার চেষ্টা করে। হাসি আসে না। ডিউটিঅফিসার চশমার আড়াল দিয়ে ঠাণ্ডা চোখে তাকায়, চিনতে চেষ্টা করে। কুলুপ আঁটা মুখে শব্দ নেই। উঠে দাঁড়ায় না, হাসে না, সালাম করে চেয়ার এগিয়ে দেয় না। একজন এএসআই কৃপা করে প্রশ্নের উত্তর দেয়, বড়সাহেবের শরীর খারাপ, বেডরেস্ট। জোট পাকানো সামূহিক শীতল ঔদ্ধত্য। রাতারাতি ভোলবদল। থ মেরে যায় লালু। কম্পাউন্ডের বাইরে বেরিয়ে আসার মুখে খুঁটোয় বাঁধা বড়সাহেবের মুলতানি গাইটি হেমলিয়ে বলে, যা ফোটগে! জবাবে লালু দাঁত খিঁচিয়ে বলে, তোর মাকে…! এই প্রাথমিক চোট সামলে ওঠার আগেই রামধাক্কাটি খেতে হলো সেই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিটির কাছ থেকে যিনি তাকে একেবারে গোড়া থেকে পেলেপুষে উত্থানেউন্মেষে এই এত বড় মাস্তানটি করে গড়ে তুলেছেন। কিন্তু বিধি বাম! গডফাদারটির মনে ওর নয়ালেবাস বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হলো আজ। বরং ওকে দেখামাত্র খেপে ফায়ার। এমনিতে তো ঠাণ্ডাগরমজনিত ইনফ্লুয়েঞ্জায় কাহিল দশা। মুখের দুপাশের ও থুতনির মাংস ফুলে ডুমো লাল। চোখ রক্তাভ। তাঁর প্রথম বচন : তুই ক্যা? তোরে আমি কইছি আইতে? একেবারে বেধড়ক সম্ভাষণ। মুখে কথা সরে না লালুর। কুঁকড়েমুকড়ে বসে থাকে একটি টেরে। কিছুটা নার্ভাস তবে নাছোড়বান্দা। নানারকম দেনদরবার ফয়সালা করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন এমপি সাহেব। একটুখানি ফাঁপ সরানোর আয়েসে গলা উঁচিয়ে সামনে তাকান। পুরাতন ভৃত্যের মতো তাঁর সেই চিরবশ্য মাস্ল্ম্যান তেমনি দেহ গুঁজে বসে আছে সোফার মধ্যে। চোখে চোখ পড়তে কাঠগলায় বলে, জরুরি বাৎ আছে আপনের লগে। খরচোখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নেন। শেষ দর্শনার্থী উঠে গেছে এই একটু আগে। দহলিজ সম্পূর্ণ ফাঁকা এখন। লালুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ক। প্রশ্রয় পেয়ে কাছে এগিয়ে আসতে যায়। এমপি ঈষৎ বেদরদী স্বরে বলেন, ক – ওইখান থাইকে ক, হোনতেছি। থানায় এটুকু সুযোগও পায়নি লালু। সেখানে বসে থেকেই বয়ান শুরু করে। আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা। সে-রাতের ব্যর্থ অভিযান, সর্বহারাদের হাতে তাদের নাকানিচোবানি, একে-৫৭ খোয়া যাওয়া, এমন কি কান কাটা যাওয়া অবধি সব-স-ব। এই মুহূর্তে তার হাতে ফ্রেশ আর্মস্ চাই, যতখানি না তার নিজের জন্যে দরকার, তার চেয়ে ঢের বেশি দরকার এমপি সাহেবের নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে, কেননা লালুই তাঁর বরাবরকার পরীক্ষিত নিরাপত্তা। লালুর হাতে অস্ত্র মানেই এমপি সাহেব নিরাপদ। তাকে এখনই আরেকটি ভারি অস্ত্রের ব্যবস্থা…! লালুকে কথা শেষ করতে দেন না খবিরউদ্দিন। খেঁকিয়ে ওঠেন মাঝপথে, এঃ! হেভি আম্র্স্! আর্ম্স্ কি বৃক্ষের কৎব্যাল? কোনো প্রয়োজন নাই – তোরেই প্রয়োজন নাই আর। তুই চইলা যা। লালু শিউরে ওঠে এরকম দিগদারি কথা শুনে। আধবুড়ো মানুষটার কি মাথাটাল হতে বসেছে? কী, বলে কী এ-সব? জী আমারে লাগবে না মানে? এইডা কী কন? এমপি সপাটে জবাব দেন, হ, সাচাই কই, তুই চইলা যা। তোরে আর কাম নাই আমার। হকচকিয়ে যায় লালু। এ অসৈরণ আলাপের কী মানে হতে পারে? ছার! কী হলোডা কী আপনের? এই সব আনতাউড়ি কথা কইলেই হলো এই কঠিন কালে? ওপারে ওদিক সর্বহারারা চেতছে। অখনেই তো আমারে বেশি করে দরকার আপনের। আমি নাইলে ক্যাডা সামাল দেবে এই…? লাফ দিয়ে ওঠেন এমপি, হেই কারণেই তো কইলাম তুই অখন শহর ছাইড়া যাবি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএ ফোন করছে। এদিকে রেকর্ডসন্ত্রাস। তোর নামে কমপ্লেইন গেছে। স্পেশ্যাল ফোর্স আসতেছে। ওইসব সর্বহারাটর্বহারা হোগার মধ্যি যাবোগা। তুই আর ক্যাচাল বাধাবি না। আইজই শহর ছাড়বি। টেকা যা লাগে দিতাছি। থানার নাফরমানিতে সেদিন লালুর পায়ের তলা থেকে চারআনা মাটি সরে গেছে। তার আগে চারআনা মাটি সরে গেছে মুঠো থেকে একে-৪৭ রাইফেলটি খোয়া যাওয়ায়। আজ এমপি খবিরউদ্দিন তাকে ত্যাগ করায়, উপরন্তু শহরত্যাগের নির্দেশ পাওয়ায়, লালু মাস্তান খুব স্পষ্ট টের পায় বাকি আটআনা মাটিও পায়ের তলা থেকে সাঁৎ করে ধসে গেল। হাবুডুবু দশা। ক্ষীণ গলায় বলে, শহরের বাইরি আমি কই যাইবোগা কন? ভুঁই নাই – জমি নাই -! যথেষ্ট প্রেমযোগে সাজেস্ট করেন এমপি, তুই রাঙার চরে চইলা যা। সেইখানে ঘরখান খালি পইড়া আছে আমার। পাকা দেয়াল টিনির চাল পুর্ষ্কণী গাছগাছালি – চাষবাস করবি খাবিদাবি বিয়াশাদী করবি পোলাপান ফুটাইবি….হাঃ হাঃ…!
অতঃপর জংগীরপাড় নামের এই উৎপীড়িত শহর ভারমুক্ত হলো। চাঁটিবাঁটিসহ কানকাটা লালু মাস্তান রাঙার চরের ঠিকানায় রওনা হয়ে গেল। নিরস্ত্র নিঃসঙ্গ নিরালম্ব।
কিন্তু সময়ের কড়ি গুনবে কে? সে তার নিজেরই গরজে সৃষ্টি করে নেয় নিমিত্তের দায়ভাগী নতুনজনকে। জংগীরপাড় শহরের বহুদর্শী পাবলিক অনন্তর প্রত্যক্ষ করে, অতিঅচিরে ঠোঁটফাটা দালু মাস্তানের অভ্যুত্থান। অতিদ্রুত সে তার আর্মস্ ও ক্যাডারবাহিনীসহ দখল নিয়ে নেয় ঘাটকোর্টথানাপ্রশাসন প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি স্পটের।
তবে সে-কাহিনী বারান্তরে। ২৮.৫.২০০৪


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.