হাইকুর নান্দনিকতা

হাসনাত আবদুল হাই

হাইকু পৃথিবীর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কাব্যরূপ। তিনটি সংক্ষিপ্ত লাইনে ১৭টি সিলেবল নিয়ে এর গঠন। প্রথম লাইনে পাঁচটি, দ্বিতীয় লাইনে সাতটি আর শেষের লাইনে আটটি সিলেবল দিয়ে তৈরি হাইকুর অবয়ব। শব্দগত এই শৃঙ্খলা কেবল জাপানিতেই নিশ্চিত করা সম্ভব, যার জন্য ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষায় হাইকু তিন লাইনে লেখা হলেও ১৭ সিলেবলের শর্ত প্রায় ক্ষেত্রেই পূরণ করা যায় না। আদিতে হাইকুর নাম ছিল ‘হোক্কু’, যার অর্থ ছিল ‘রেঙ্গা’ নামক পরস্পর সংযুক্ত লাইনসংবলিত কবিতার প্রথম ভাগ। ‘রেঙ্গা’ ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা, যার উৎপত্তি হয় ৩১ সিলেবলের ‘ওয়াকা’ কবিতাকে ৩৭ এবং ১৪ সিলেবলে বিভক্ত করে। গঠনগত বৈশিষ্ট্যের মতো ‘কিগো’ বা ঋতু বিষয়ে কোথাও হাইকুর প্রধান চরিত্র হিসেবে বিবেচিত। হাইকু লেখার সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি হাইকুতেই ঋতুর প্রতি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কের আভাস বা ইঙ্গিতের ব্যবহার থাকা বাঞ্ছনীয়। বিখ্যাত হাইকু কবি, যাকে হাইকুর প্রাণপুরুষও বলা হয়ে থাকে, বাশোর মত অনুযায়ী, প্রতি হাইকু কবিতাতেই প্রকৃতির স্পর্শ থাকতে হবে। যেহেতু প্রকৃতি ঋতুনির্ভর সেজন্য হাইকুর ভেতর ঋতুর প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন। এমনকি যখন ব্যক্তিগত আবেগকে কেন্দ্র করে হাইকু লেখা হয়, সেখানেও ঋতুর ইঙ্গিত প্রত্যাশা করা হয় এজন্য যে, যখনই আবেগটি হাইকুতে রূপান্তরিত হয় ব্যক্তিগত আবেগ আর প্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এভাবে বিশেষ আবেগ বা অভিজ্ঞতাকে প্রকৃতির মাধ্যমে সর্বজনীন করে তোলা হাইকুর বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত।

হাইকু-মানসিকতার অধিকারী হতে হলে, একজন কবি বা ব্যক্তিকে অভিজ্ঞতার জন্যই একটি অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রস্ত্তত থাকতে হয়। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে হাইকু মানসিকতা অকৃত্রিম থাকে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে দ্রষ্টার সম্পূর্ণ অভিন্নতা অর্জন এবং একাত্মতা লাভ প্রয়োজন। বিষয়ের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তা মিশে অভিন্ন হয়ে গেলেই ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতি গৌণ হয়ে যায় এবং প্রকৃতি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করে বিশ্বজনীনতায় পৌঁছে দিতে পারে। মানুষের জীবনে দুঃখ, বেদনা এবং নিঃসঙ্গতা অনিবার্য বলে এসব ব্যক্তিগত অনুভূতিকে প্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে রূপান্তরিত করে অতিক্রমণ সম্ভব। সাধারণ অনুভূতি মহৎ বা নিগূঢ় চিন্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে এ-প্রক্রিয়ায়। হাইকুর সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ, ব্যক্তিক থেকে নৈর্ব্যক্তিকে  রূপান্তরের এই ক্ষমতার জন্যই অনেকটা কেবল লেখা শেষে নয়, লেখার শুরু থেকে আত্মার শান্তির আর মনের প্রশান্তি অর্জনের এক নির্মল মাধ্যম হাইকু পড়া আর লেখা।

জাপানের পুরনো এবং আধুনিক সব কবিতার মধ্যে হাইকুই সবচেয়ে জনপ্রিয়। সপ্তদশ শতকে এর যে-যাত্রা শুরু হয়েছে তার ওপর আজ পর্যন্ত যবনিকাপাত হয়নি। বর্তমান সময়েও জাপানে হাইকুর চর্চা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি শহরে হাইকু ক্লাব রয়েছে যার সদস্যরা নিয়মিত মিলিত হয়ে কবিতা পাঠ করে শোনায়। প্রকাশিত হাইকু-পত্রিকার সংখ্যাও অনেক। জাপানি এবং ইংরেজি পত্রিকায় হাইকু ছাপার জন্য প্রতি মাসে স্থান নির্ধারিত থাকে। জাপান অতিক্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাইকু কবিতা লেখা হয়ে আসছে। টোকিওতে হাইকু মিউজিয়াম আছে, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হাইকুর ওপর বই এবং পত্রিকা সংরক্ষিত রয়েছে। আর কোনো সাহিত্যিক ফর্ম নিয়ে এমন ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্দোলন ও চর্চা হয়নি।

হাইকু কেবল একটি সাময়িক শখের বিষয় নয়, এটি একটি অধ্যবসায় এবং নিরন্তর চর্চা যার পেছনে রয়েছে গভীর মনোনিবেশ এবং প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সংলাপ। দৈনন্দিন জীবনের বড় বড় ঘটনার পাশাপাশি প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে যে আকস্মিক এবং সাধারণ অনুভূতির সঞ্চার হয় তাই-ই হয়ে ওঠে অসামান্য অনুভূতির উৎস। আপাতসরল অর্থের পেছনে প্রচ্ছন্ন থাকে জীবন, প্রকৃতি ও বিশ্বমন্ডল সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি। এর ফলে হাইকুতে প্রকৃতিপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা এবং দার্শনিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। হাইকুর বিভিন্ন পরতে অর্থের যে-বিভিন্নতা তার মধ্যে ঐক্যসূত্র থাকে, যার জন্য একটি পরতের অর্থ থেকে পরবর্তী পরতের অর্থের দিকে যাত্রা হয় সহজ ও স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে হাইকুর অর্থোদ্ধার ধ্যানের পর্যায়ে পড়ে। এই ধ্যান মানুষকে বিবাগী করে না, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির ভিত্তিতে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এই প্রশান্তিকেই বলা হয়েছে হাইকু অভিজ্ঞতা যা হাইকু মানসিকতার সৃষ্টি।

 

প্রথম হাইকু কবিতা

ঠিক কবে প্রথম হাইকু কবিতা লেখা হয়েছে সে-সম্বন্ধে নির্ভরশীল তথ্য নেই। এক হিসাবে ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে হাইকু লেখা শুরু হয়। প্রথম যে-কবিতাটি ছাপা হয় সেটি স্থান পায় হায়াকুনিন ইস্সু (১২৩৫) শীর্ষক বিখ্যাত টাংকা কবিতার সংকলনে। এই কবি ছিলেন ফুজিওয়ারা নো সাদাই-এ যিনি সংকলনটি গ্রন্থণা করেন। এই সংকলনে স্থান পেয়েছে যেসব হাইকু তার সবই ওই শ্রেণিভুক্ত হওয়ার দাবি রাখে না। নিচের যে-হাইকুটি সাদাই-এ লিখেছেন তার মধ্যে হাইকুর মেজাজ কিছুটা রয়েছে :

চেরি ফুলের পাপড়ি

বাতাসে নড়ছে ফুর্তিতে

ধেয়ে আসে ঝড়।

 

হাইকু কবিতা জনপ্রিয় হতে আরো আড়াইশো বছর লেগেছিল। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে দুই খ্যাতনামা হাইকু কবি ছিলেন মরিটাকে (১৪৫২-১৫৪০) এবং সোকানে (১৪৬৫-১৫৫৩)। মরিটাকির একটি হাইকু ছিল এমন :

পড়ে যাওয়া পাপড়ি আসে উড়ে

আগের ডালে ডালে

ওহ্! প্রজাপতি সব।

সোকানের হাইকুতে চাতুর্যের প্রকাশ রয়েছে। যেমন :

যদি চাঁদের এক পাশে

হাতল লাগায় কেউ

চমৎকার হাতপাখা হবে।

বিশেষজ্ঞরা ওপরের কবিতাকে হাইকু বলেননি কেননা, এখানে কোনো আবেগ প্রকাশিত হয়নি।

পরবর্তী একশ বছরে আশি কাগা শাসনের অবসান হয় এবং সেইসঙ্গে যবনিকাপাত ঘটে গৃহযুদ্ধের। সাময়িকভাবে টয়োটমি হিদোওশির সংক্ষিপ্ত শাসনের শেষে প্রতিষ্ঠিত হয় তোকুগাওয়া শোগুনের সামরিক শাসন। এই সময়টা এমন ছিল না যখন সূক্ষ্ম অনুভূতি-নির্ভর কবিতা লেখা যেতে পারত যার জন্য হাইকু চর্চায় উন্নতি না হয়ে কিছুটা অবনতিই হয়। হাইকু লেখা তখন অবসরে শৌখিন বিষয়ের চর্চা হয়ে দাঁড়ায় যেখানে কবি জটিলভাবে স্বকীয়তা প্রকাশের প্রয়াস পায়। যেমন, তোকুগাওয়া পর্বের প্রধান হাইকু কবি তেইতোকু নববর্ষ উদ্যাপনে (গাভী বর্ষ-১৬৫৩) :

সকাল বেলা, জমানো বরফ

ঝরে, গাভী বর্ষ

তছনছ করে দেয়।

কবিতাটিতে কৌশল ও চাতুর্য প্রাধান্য পেয়েছে যার জন্য এটি হাইকু স্বভাবের নয়। সেই সময়ে লেখা সব হাইকু কবিতাই এই ধরনের ছিল না এবং তেইতোকু কবিসুলভ মানসিকতা নিয়ে হাইকু লিখেছেন যদিও তাঁর মধ্যে পরিহাস করার প্রবণতা ছিল কবিত্বের চেয়ে বেশি। তাঁর লেখা উৎকৃষ্ট হাইকুর মধ্যে রয়েছে :

ওহ, উৎসুগি

একসঙ্গেই দেখায়

বরফ, চাঁদ আর ফুটন্ত ফুল।

বরফ, চাঁদ এবং ফুল সৌন্দর্যের ত্রিরত্ন। উৎসুগির ঝোপে ছোট সাদা ফুলগুলো চাঁদের আলোয় সাদা বরফের মতো দেখায়। ‘চন্দ্রালোকে উৎসুগি’ কথাটিও প্রচলিত অর্থে সৌন্দর্যের প্রতীক। কবিতাটিতে স্নিগ্ধতা আছে, নতুনত্বও দেখা যায় কিন্তু হাইকু-রসিকরা একে সেরা ধরনের কিছু বলে মনে করেননি। এখানে তারা স্বতঃস্ফূর্ততা খুঁজে পাননি। তোকুগাওয়া হিদোয়োশি টয়োটোমি শাসনের সময় যে-গৃহযুদ্ধ চলে তার শেষে তোকুগাওয়া পর্বে কঠোরভাবে আরোপিত শান্তির পরিস্থিতি নতুন করে হাইকু লেখার পরিবেশ ও মানসিকতা সৃষ্টি করে। তেইতোকুর শিষ্য তেইশিতসু ইয়োশিনিতে সর্বজননন্দিত চেরি ব্লসম দেখে আসার পর তাকে যখন প্রশ্ন করা হয় তিনি কি দেখার পর হাইকু লিখেছেন, তখন তার উত্তর ছিল :

ওহ!

শুধু ফুটন্ত ফুলে আবৃত

ইয়োশিনোর পাহাড়।

এখানে হাইকু কবিতার নির্যাস রয়েছে বলে মনে করেছেন অনেকে। কিন্তু তবু হাইকুর প্রকৃত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে সোয়েন নামক কবির প্রতিষ্ঠিত দানরিন স্কুলের (১৬৬০) জন্য। সোয়েন এবং এই স্কুলের কবিদের কবিতাই হাইকুর সম্ভাবনা সম্বন্ধে আভাস দিয়েছিল। নীতিবাচক দৃষ্টভঙ্গি সত্ত্বেও সোয়েনের নিচের কবিতায় হাইকুর প্রকৃত জগতের দরজা খুলে যায় :

শিশিরকণা, ছোট এবং কোমল

যেখানে খুশি পড়ে

নির্বোধের মতো।

এই কবিতার সঙ্গে আগে উল্লিখিত কবিতাগুলির পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। আগের কবিতায় কবির মনোভাব কথায় অবিকল প্রকাশ করা হয়েছে। সোয়েনের ওপরের কবিতায় তেমনভাবে করা হয়নি, কেননা তা কঠিন। এখানে যে-সৌন্দর্যের উল্লেখ তা অনির্বচনীয়। সোয়েনের কবিতায় শিশিরকণা সর্বত্র পড়ার উল্লেখ আছে যার সঙ্গে মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবনের তুলনা করা যায় এবং যদিও কবিতাটিতে এই সব অর্থ একত্রিত করার প্রচেষ্টা আছে কিন্তু তা সফল হয় না। এই অপূর্ণতাই হাইকু চরিত্র।

 

চার হাইকু কবি

সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত হাইকু কবিতার উৎকর্ষ সাধিত হয় চারজন কবির লেখায়। এঁদের কবিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে হাইকু কবিতার নান্দনিকতা, সৌন্দর্যবোধ এবং দার্শনিকতা। হাইকু কবিতার ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে এঁদেরই কাব্যচর্চায়। আধুনিক হাইকু কবিদের কাছে এই চারজন আদর্শ হাইকু কবি এবং সেই জন্য তাঁরা স্মরণীয় এবং অনুসরণীয়।

 

মাতসুও বাশো (১৬৪৪-৯৪)

১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তোকুগাওয়া শোগুনের সামরিক সরকারের সময় শান্তিপূর্ণ জাপান বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। এই পর্বেই ১৬৪৪ সালে জন্ম নেন মাতসুও বাশো, হাইকু কবিতার সম্রাট। তাঁর সমকালে কবি-প্রতিভা বিকাশের উপযোগী পরিবেশ ছিল। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য জীবন ছিল স্থিতিশীল এবং সুরক্ষিত। সামুরাই যোদ্ধা শ্রেণিযুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতে না পেরে শিল্পকলার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সময় পায়। এই শিল্পকলার মধ্যে কবিতাই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। আট বছর বয়সে বাশোকে এক অভিজাত প্রভুর দুর্গে তার ছেলে সেনজিনের সহচর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বাশো তাঁর প্রভু/ সহচর সেনজিনের এবং সেনজিন তাঁর প্রভু কিগিনের কাছ থেকে কবিতা লেখা শেখেন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা লেখা হয় তেরো বছর বয়সে। কবিতাটি ছিল সমকালীন কবিতার ক্যারিকেচার, যার জন্য এর কাব্যমূল্য খুব বেশি ছিল না। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাশোর প্রভু সেনগিনের মৃত্যু হয়। ভগ্নহৃদয়ে বাশো কোয়াসান মঠে গিয়ে সাংসারিক জীবন ত্যাগ করেন। এর বিশ বছর পর তিনি যখন তাঁর প্রাক্তন প্রভুর দুর্গে যান এবং যে চেরি গাছের নিচে তাঁরা খেলা করতেন সেখানে দাঁড়ান, তখন যে-কবিতাটি লেখা হয় তা এই :

অনেক, অনেক বিষয়

মনে পড়ে যায়

চেরির ফুটন্ত ফুল।

এরপর বাশো কিয়োতো শহরে গিয়ে কিগিনের অধীনে হাইকু লেখার চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি নিজের হাইকু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তখনো তাঁর কবি-প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়েনি। তিনি এই সময় হাইকু ছাড়াও ‘রেঙ্গা’ কবিতা লেখেন। ১৬৭৯ সালে তিনি নতুন শৈলীর অনুসরণে প্রথম হাইকু লেখেন :

শুকিয়ে যাওয়া ডাল

কাক বসে আছে

হেমন্তের সন্ধ্যা।

এই হাইকুতে আঙ্গিকগত দুটি বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য এটি আদর্শ হাইকু হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রথমত, সার্বিক মানসিকতা এবং আবেগ একটি দৃশ্যের নিরাভরণ বর্ণনায় প্রকাশ করা হয়েছে। এই বর্ণনা পরিণত হয়েছে একটি চিত্রে। দ্বিতীয়ত, যে-দুটি অংশ নিয়ে হাইকুটি সম্পূর্ণ হয়েছে তাদের একের সঙ্গে অন্যের তুলনা করা হয়েছে। উপমা কিংবা রূপকের সাহায্যে এই তুলনা করা হয়নি, দুটি পৃথক ঘটনার উল্লেখে যে-ঘটনাগুলি স্বনির্ভর। এই আঙ্গিকেই বলা হয়েছে অভ্যন্তরীণ তুলনার নীতি যেখানে পার্থক্য এবং সাদৃশ্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হেমন্তের শুষ্ক বিবর্ণ প্রকৃতিতে কাকের মতো কালো সন্ধ্যার সূচনা হয়েছে, শুধু এই কথা বলা হচ্ছে না। কাকের ক্ষুদ্র কালো অবয়বের সঙ্গে অনাগত কালো রাত্রির বিশাল অন্ধকারের সহাবস্থানের প্রতিও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এই আঙ্গিক হাইকু কবিতায় গভীরতা সৃষ্টি করে যে-গভীরতা থেকে সূক্ষ্ম চিন্তা এবং কল্পনা গড়ে ওঠে। বাশো নিজে সব সময় ‘অভ্যন্তরীণ তুলনার’ এই আঙ্গিক অনুসরণ করেননি কিন্তু তাঁর পরবর্তী হাইকুতে অভ্যন্তরীণ তুলনার অন্তত ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন চেরি ব্লসমবিষয়ক হাইকুতে চেরি ব্লসমকে তুলনার পটভূমি এবং তারা কী স্মরণ করায়, উভয় বিষয় মনে করিয়ে দেয়।

কাকের ওপর লেখা হাইকুটি যখন লেখা হয় বাশো আপাতদৃষ্টিতে যেসব বস্ত্ত সুন্দর নয়, সেখানে সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করছিলেন। দুই বছর পর ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আসে। তিনি ঘোষণা করেন যে, জীবন বড় বেশি জাগতিক বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। এই উপলব্ধির পর তিনি ধ্যানের মাধ্যমে জেন বৌদ্ধধর্মের অনুশীলন শুরু করেন। এরপর জীবনের শেষ দশ বছরে তাঁর সবচেয়ে সুন্দর ও অর্থময় হাইকুগুলি লেখা হয়। ১৬৮৬ সালে তিনি জাপানি ভাষায় লেখা সবচেয়ে পরিচিত হাইকুটি লেখেন যা তাঁর নিজের কাছেই কাব্যচর্চায় এক বড় মোড় নেওয়া বলে মনে হয়েছে। হাইকুটি প্রতারকভাবে সরল, অনুবাদে এই রকম :

পুরনো পুকুর

ব্যাঙের ঝাঁপ

পানির শব্দ।

অনেক পন্ডিত-সমালোচক এই হাইকুটিতে গভীর এবং উচ্চমার্গীয় অর্থের সন্ধান পেয়েছেন। আবার কারো কাছে একে মনে হয়েছে রহস্যাবৃত ধাঁধার মতো। বাশো যখন কাছেই ব্যাঙের লাফের শব্দ শোনেন, সেই সময় সঙ্গে সঙ্গে হাইকুর শেষের দুটি লাইন মনে আসে বলে সে দুটি সমাপ্তিসূচক বলে ধরা হয়। শিষ্যদের সঙ্গে আলাপের পর তিনি প্রথম লাইন হিসেবে যোগ করেন ‘পুরনো পুকুর’। আঙ্গিকের দিক দিয়ে হাইকুটি ‘কাক’বিষয়ক হাইকুর মতো কিন্তু কাক এবং হেমন্তের সন্ধ্যার তুলনায় পুরনো পুকুর এবং হঠাৎ শব্দের মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ তুলনাটি’ আরো গভীর ও সূক্ষ্ম। কবিতাটি জীবন সম্বন্ধে যে-দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণার সৃষ্টি করে তা ‘কাক’ হাইকুতে দেখা যায় না। যদি বাশো একমাত্র এই হাইকুটি লিখতেন তাহলে এর ভেতরই হাইকুর সব গভীর অর্থ তিনি রেখেছেন কিনা সেই মর্মে জল্পনা-কল্পনা হতে পারত। কিন্তু বাশো যে পরবর্তী অধিকাংশ হাইকুতে সচেতন বা অর্ধসচেতনভাবে হাইকুর সব অর্থ নিহিত রেখেছেন তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এই হাইকুগুলি যতই পড়া যায় তাদের প্রতিটিতে গভীর অর্থের উপস্থিতি উপলব্ধি হয়। এমনও মনে হয় যে, তাদের সবগুলির সমাহারে হাইকু সমগ্রতা পেয়েছে। জাপানিদের মতে, বাশো জেন বৌদ্ধধর্ম দ্বারা এত অনুপ্রাণিত হন যে, প্রতিটি কবিতায় এর প্রভাব পড়েছে। হয়তো এই ব্যাখ্যা সঠিক কিন্তু কেউ জেন-চেতনা কী তার ব্যাখ্যা দেননি। জেন ধর্মে বোধি লাভ বা সাতোরি অর্জন একটি শক্তিশালী আবেগের অনুভব করা সমান যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। একে বলা হয়েছে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা। খ্রিষ্টান ধর্মের বিশেষজ্ঞদের মতে একে বলা যায় প্রকৃতিভিত্তিক মরমিয়াবাদ। যারা জেন ধর্মের অনুসারী নন, তারা বাশোর জীবনে ও কবিতায় এই চেতনার ভূমিকা সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর জেন চেতনার বৈশিষ্ট্য এবং পরিচায়ক হিসেবে যা মনে করা হয় তার মধ্যে রয়েছে জীবনতৃষ্ণা, প্রতিটি মুহূর্ত পূর্ণভাবে ব্যবহার করা, প্রাকৃতিক বস্ত্ততেও এর প্রভাব উপলব্ধি করা, কিছুই বিচ্ছিন্ন নয় বলে ভাবা, সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, সহানুভূতির ব্যাপকতা, সব ধরনের সম্পর্ক সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ সচেতনতা। এসব বৈশিষ্ট্য এবং গুণ জেন ধর্ম-উদ্ভূত কিনা তা জোর করে বলা না গেলেও বাশোর হাইকুতে তাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে নিঃসন্দিহান হওয়া যায়। কিন্তু জেন চেতনা যাই হোক না কেন তার সংখ্যাগরিষ্ঠ হাইকু ধর্মবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত নয় বলেই মনে হয়। এগুলি বাস্তব দৃশ্য এবং ঘটনার সরল বর্ণনা যেখানে এইটুকু তথ্যই দেওয়া হয়েছে যার ভিত্তিতে পাঠক বাশোর ভূমিকা নিয়ে তার আবেগগুলি উপলব্ধি করতে পারে।

সারাসিনো কিকো নামের গদ্যের বই ছাড়াও বাশো গদ্যে অন্যান্য বই লিখেছেন। এর মধ্যে বিখ্যাত হলো ন্যারো রোডস ইন ওকু যেখানে তিনি পদব্রজে ছয় মাস গ্রামাঞ্চলে যাত্রা অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন গদ্যে এবং কবিতায়। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এদো থেকে যাত্রা করে আইসের সূর্যদেবীর মন্দিরে শেষ হয় এই যাত্রা। বইটিতে তার পঞ্চাশটি হাইকু আছে যার অধিকাংশই বিখ্যাত হয়ে গেছে। বইটি জাপানি সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন বলে বিবেচিত।

১৬৯৪ সালে বাশোর মৃত্যু হয়, তখন তিনি দেশের ভেতর ভ্রাম্যমাণ। অসুস্থ অবস্থায় রাত্রিযাপন করে তিনি শিষ্যদের সকালে কাছে ডেকে রাতে দেখা স্বপ্নের ভিত্তিতে লেখা তাঁর শেষ হাইকুটি শোনান :

ভ্রমণে বেরিয়ে, অসুখ,

মাঠে মাঠে সবকিছু বিশুষ্ক

স্বপ্ন তবুও হেঁটে যায়।

এর চেয়ে হৃদয়স্পর্শী বিদায় বেলার উপহার আর কিছু হতে পারত না।

 

তানিগুচি বুশো (১৭১৫-৮৩)

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হাইকু জগতের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন তানিগুচি বুশো। তাঁর খ্যাতি ছিল বাশোর সমতুল্য। তাঁর জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না; লেখা কবিতার ভিত্তিতেই তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে অনুমান করতে হয়। জাপানি সমালোচকদের মতে, বাশো এবং বুশো দুজনেই ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। তারা দুজনে দুই ভিন্ন মেরুর মানুষ ছিলেন, অন্তত কবি হিসেবে। বুশোর প্রতিভা ছিল বহুমুখী, কোনো অর্থেই তিনি মরমিয়া ছিলেন না এবং জাগতিক বিষয়ে উদাসীনও নয়। বাশোকে যদি বলা হয় মুক্তা, বুশোকে তুলনা করতে হয় হীরকখন্ডের সঙ্গে।

বহুরূপী হওয়ার জন্যই বুশোর যে-কোনো হাইকুকে প্রতিনিধিত্বমূলক বলা কঠিন। কিন্তু একই বিষয়ে লেখা দুটি হাইকু বিবেচনা করলে তাঁর কবিতার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। এই প্রসঙ্গে প্লাম ফুলের ওপর লেখা হাইকুর দৃষ্টান্ত দেওয়া  যায় :

প্লাম গাছে ফুটন্ত ফুল

সুগন্ধ কি উপরে উঠছে?

চাঁদের চারিদিকে গোল বৃত্ত।

কবিতাটিতে চমৎকার কল্পনা আছে, একটি আকর্ষণীয় চিত্র অাঁকা হয়েছে। এর পাশেই একই বিষয়ে লেখা হাইকুটি এমন :

প্লাম ফুল ফুটেছে

বারবনিতারা কিনছে নতুন ওড়না

বেশ্যালয়ের একটি ঘরে।

এখানে একটি বর্ণিল দৃশ্যের ছবি অাঁকা হয়েছে, কোনো অস্পষ্টতার আশ্রয় না নিয়ে। হাইকু বৈশিষ্ট্য শেষের কবিতায় সেজন্য কিছুটা কম।

বসন্তের বৃষ্টি নিয়ে বুশো তিরিশটি কবিতা লিখেছিলেন। মে-জুন মাসের বৃষ্টির তুলনায় বসন্তের বৃষ্টি বেশ শান্ত এবং কোমল। এ-বিষয়ে লেখা দুটি কবিতা :

বসন্তের বৃষ্টি

একসঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত

খড়ের রেইনকোট আর ছাতা।

রেইনকোটটি অবশ্যই একজন পুরুষ পড়েছে, ছাতাটি মেয়ের হাতে, এটা মনে রাখলে চিত্রটি পূর্ণতা পায়। একই বিষয়ে দ্বিতীয় কবিতা :

বসন্তের বৃষ্টি

গাড়িতে দুজনে বসে

প্রিয় সঙ্গিনীর ফিসফিস স্বর।

যে-দুটি চরিত্রের উল্লেখ করা হয়েছে কবিতায় তারা অভিজাত শ্রেণির কেননা, গাড়িতে তারাই চড়তো। দ্বিতীয় হাইকুর তুলনায় প্রথমটি চিত্রগুণে এবং ব্যঞ্জনায় অনেক সুন্দর।

ওপরের দৃষ্টান্ত বুশোর কবিতায় বৈচিত্র্য সম্বন্ধে সব ধারণা দেয় না, কিন্তু হাইকুগুলি পড়ে বাশোর সঙ্গে তাঁর পার্থক্য বেশ বোঝা যায়। তাঁর কবিতায়ও গভীরতা আছে, কিন্তু বাশোর হাইকুর মতো নয়। যদি দার্শনিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বুশোর হাইকুর তাহলে তা সঙ্গে-সঙ্গে গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। তবে বুশোর অনেক কবিতাই প্রকৃতির সৌন্দর্য, রহস্যময়তা এবং তার জন্য বিস্ময় প্রকাশ করে লেখা। কিন্তু এই উপলব্ধি এতটাই কথার ব্যঞ্জনার ওপর নির্ভর করে যে-অনুবাদে তা হারিয়ে যায়। যে হাইকু আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করা যায় তার সম্বন্ধেও এই কথা বলা চলে :

চেরি ফুল চলে গেছে

গাছের ভেতর একটি মন্দির

এখন সেটাই চেরির কথা বলে।

এই হাইকুতে কিছুটা বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আছে, কিন্তু কাব্যিক দ্যোতনা তা অতিক্রম করে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বুশোর দর্শন সম্বন্ধে অল্পই জানা যায় কেননা, তাঁর কবিতা এবং কিছু চিত্রকর্মের বাইরে তিনি বিশেষ কিছু বলেননি। তিনি যে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির শোভা উপভোগ করেছেন তা বেশ বোঝা যায়, যদিও একজন দর্শক হিসেবে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য কীভাবে উপভোগ করা যাবে সে-সম্বন্ধে তাঁর নিজের ধারণা ছিল :

চেরি ফুল দেখতে এলাম

গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ি

কোনো কাজ নেই।

এখানে প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য খুব বাড়াবাড়ি করার কথা বলা হয়নি, জাপানি সৌন্দর্যবোধের যা একটা বৈশিষ্ট্য। মনে হয় তিনি বলছেন অবসর উপভোগের জন্য চেরি ফুল দেখার প্রয়োজন হয় না, কবিতা লেখারও না।

বুশো তাঁর কবিতার বিষয়ের মতো আঙ্গিক নিয়েও সমানভাবে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আঙ্গিকের ওপর তাঁর পরিপূর্ণ দখল ছিল এবং এর ব্যবহারে ছিল অগাধ তৃপ্তি। তাঁর আগের কোনো হাইকু কবির তুলনায় এই আঙ্গিকের ওপর ভিত্তি করে তিনি শব্দ, বর্ণ এবং পাশাপাশি একই ধ্বনির ব্যবহার (ওনোমাটো পোইয়া) করেছেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁর বেশ কিছু উৎকৃষ্ট কবিতার অনুবাদ কঠিন হয়ে পড়েছে। যেমন :

দিনের বেলায়, ‘দিন চলে যাও’

‘অন্ধকার থেকে আলোয় এসো’

বাতিগুলো তাই বলছে।

মূল জাপানিতে কবিতাটির যে-সৌন্দর্য তা এখানে পাওয়া যায় না। তাঁর একটি হাইকু যার অনুবাদ প্রায় দুষ্কর সেটি এমন :

বসন্তের সমুদ্র

সারা দিন ওঠানামা

খুব শান্ত হয়ে।

জাপানিতে ‘হিনেমস নোটারি নোটারি কোনায়’ বাক্যবন্ধে যে-সংগীত বা ছন্দ তা অনুবাদে আনা যায় না।

বুশো ধ্বনিকে অর্থের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়েছেন যে হাইকুটি লেখার পর তা এত বিদ্ঘুটে মনে হয়, একে হাইকু বলা যাবে কিনা এ বিষয়ে সংশয় জাগে :

চাঁদের আলোয় পশ্চিমে পারাপার

পুব দিকে চেরি ফুলের ছায়া

ধীরে ধীরে যায়।

এই হাইকুতে ৫, ৭, ৫ সিলেবলের পরিবর্তে ১১, ৮, ৫ সিলেবল রয়েছে। এই কবিতায় অর্থের যে-সমান্তরলতা তার সঙ্গে চীনা কবিতার মিল বেশ স্পষ্ট। অনেক কবি এই হাইকুর উল্লেখ করে বলেছেন, হাইকু ৫, ৭, ৫ সিলেবলের নাও হতে পারে। বলা বাহুল্য, এই মত সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি।

বুশোর কৃতিত্ব তিনি খুব অল্প কথায় বিষয়গুলি ব্যক্ত করেছেন। যেমন, একটি হাইকু :

উপহার দিতে এসেছে

ট্রাউট মাছ, ভেতরে না ঢুকে চলে যায়

মধ্যরাতের বন্ধ ফটক।

কবিতাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন লিখেছেন, কোনো ব্যক্তির গৃহে প্রবেশের ফটকে আমরা প্রথমে মধ্যরাতে কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। গৃহস্বামী উঠে দেখেন চেনা একজন ট্রাউট মাছ তাকে উপহার দিতে এনেছে। যদিও তাকে ভেতরে আসতে বলা হয়, সেই বন্ধু অনেক রাত হওয়ার কারণে চলে যায়। এই চিত্রটি পাঠককে নির্মাণ করে নিতে হয় এবং চিত্রটি সম্পূর্ণ হওয়ার পর যে-অনুভূতি জেগে থাকে তা হলো বন্ধুত্বের এবং সঙ্গদানের।

বুশো একই আঙ্গিক ব্যবহার করেন বেশ সার্থকভাবে অন্য এক কবিতায় :

‘রাতের আবাস’

ডাক দেয় তরবারি রেখে

বাতাসে ওড়ে বরফ।

এখানে বাতাসে ওড়া বরফ তিনটি কাজ করে : (ক) ঋতুর পটভূমি সৃষ্টি, (খ) আগন্তুকের সঙ্গে ভেতরে ঢোকা, (গ) আগন্তুকের সঙ্গে গৃহের মালিকের তুলনা এবং তার সঙ্গে আগন্তুকের।

বুশো একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন যার জন্য তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল গভীর। তাঁর হাইকুর পরিবেশ আকর্ষণীয় চিত্র অাঁকে সাবলীল গতিতে। কিন্তু বিদেশিদের জন্য এসব হাইকুর চিত্রময়তা উপভোগ করতে হলে জাপানি চিত্রকলা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে হবে। যেমন এই কবিতায় :

একটা লাইন ধরে তারা ঘোরে

বুনো হাঁসগুলো, পাহাড়ের পাদদেশে

চাঁদ যেন সিলমোহর অাঁকা।

শুধু পড়ে বোঝার উপায় নেই যে, হাঁসগুলো সমান্তরালে উড়ছে না, নেমে আসছে পাহাড়ের উঁচু থেকে, যদিও তাদের অবস্থান চাঁদ এবং পাহাড়ের পাদদেশের ওপরে। জাপানি চিত্রকলায় দৃশ্যের এমন বৈশিষ্ট্য থাকে যা না জানা থাকলে হাইকুটির দৃশ্যগত সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন।

 

ইস্সা (১৭৬২-১৮২৬)

সব হাইকু কবির মধ্যে ইস্সা ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তিনি বাশোর মতো সন্তপুরুষ ছিলেন না, বুশোর মতো হরফের কৌশলী কারিগরও না। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই একজন মানবিক হৃদয়ের মানুষ। বাশো যদিও শ্রদ্ধার পাত্র তাঁর হাইকুর দার্শনিকতা তাঁর উপলব্ধিতে প্রয়াসসাধ্য করে। আর বুশোর প্রতিভা উজ্জ্বল হলেও তিনি বেশ নিরাসক্তভাবে কাব্যচর্চা করে গিয়েছেন যার জন্য জনপ্রিয় হতে পারেননি। ইস্সা তাঁর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেসব হাইকু লিখেছেন তার মাধ্যমে নিজের হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছেন যার জন্য হতে পেরেছেন পাঠকপ্রিয়।

ইস্সার শৈশব ছিল বেশ দুঃখের এবং কষ্টের। মাতৃস্নেহ-বঞ্চিত তাঁকে ভুগতে হয়েছে দারিদ্রে্যর কশাঘাতে। কথিত আছে, শৈশবে তাঁর ছেঁড়া কাপড় দেখে ছেলেমেয়েরা তাঁকে খেলায় নেয়নি। একা বসে থাকতে তিনি ছোট একটা চড়ুইয়ের বাচ্চা দেখতে পান যার অবস্থা দেখে তার খুব মায়া হয়। তখন তাঁর তেরো বছর বয়স, তিনি লেখেন :

এসো, আমরা এক সঙ্গে খেলি

ওহে বাচ্চা চড়ুই

মাতৃহীন তুমি।

কবিতাটি লেখার পরই তিনি কেঁদে ফেলেন। নয় বছর বয়সেই তিনি এমন হাইকু লিখেছিলেন কিনা সে-বিষয়ে কোনো নিশ্চিতি নেই। চোদ্দো বছর বয়সে তাঁর বাবা তাঁকে বাড়ির বাইরে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর বিশ বছর তিনি বাইরে ছিলেন, বেশিরভাগই এদোতে। কখনো উৎফুল্ল, কখনো বিষণ্ণ থেকেছেন তিনি। দারিদ্র্য পিছু ছাড়েনি তাঁর। ১৮১১ সালে বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি পেলেও সৎমা ও ভাইদের ষড়যন্ত্রে তেরো বছর পর্যন্ত তা উপভোগ করতে পারেননি। তিনি এদোয় ফিরে যান এবং কবি হিসেবে তাঁর বিকশিত প্রতিভা প্রশংসা অর্জন করে। কিন্তু বাড়ির জন্য পিছুটান তাঁকে কয়েকবারই নিজের গ্রামে নিয়ে যায়। একবার গ্রামে যাওয়ার পর তিনি লেখেন :

যেখানে আমার জন্ম

যেখানে আমি আসি, যেসব স্পর্শ করি

কেবলই কাঁটার ফুল।

এখানে ইস্সা তাঁর মনের বেদনার কথা বলছেন, একই শিরোনামে লেখা হাইকুতে বুশো বিজ্ঞ লোকের মতো তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যা তুলনায় অনুজ্জ্বল। শেষ পর্যন্ত ইস্সা পৈতৃক সম্পত্তি পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে এদো ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে আসেন। তখন তিনি নতুন মানুষ, তাঁর মনের ভেতরকার তৃপ্তি চলে গিয়েছে। গ্রামের বাড়িতে প্রথম নববর্ষে লেখা তাঁর হাইকু :

একটা অদ্ভুত, বড় অদ্ভুত ব্যাপার

যে ঘরে আমি জন্মাই

আজ সকালে সেখানে বসন্ত।

তাঁর পারিবারিক জীবন সুখের ছিল না, অল্প বয়সে স্ত্রী মারা যান, তারপর পাঁচটি সন্তান। নিজেও প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। একটি মৃত সন্তানের উদ্দেশে লেখা হাইকু ছিল এই রকম :

শিশির মুছে যায়

‘পৃথিবীটা নোঙরা

এখানে আমাদের করার কিছু নেই।’

প্রথম লাইনটি একটি ধর্মগ্রন্থ থেকে নেওয়া। জীবনের নশ্বরতার সঙ্গে শিশিরকণার অস্থায়ীত্বের তুলনা করা হয়েছে এখানে। কিন্তু ইস্সা বিশ্বজনীন চিন্তায় প্রবেশ করেননি, তাঁর চিন্তার লক্ষ্য ছিল মৃত সন্তান।

ইস্সার অসুখী মানসিকতার পেছনে কেবল জীবনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা ছিল না, দার্শনিক এবং ধর্মীয় অস্থিরতাও এর পেছনে কাজ করেছে। তিনি বুশোর মতো নিরাসক্ত হতে পারেননি। সমকালীন বৌদ্ধধর্মে তিনি শান্তি খুঁজে পাননি। প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত কোনো কিছুই তাঁকে শান্তি দিতে পারেনি। জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে ‘ডেথ-পোয়েম’ নামে পরিচিত হাইকুতে :

হাত ধোয়ার পাত্র থেকে

হাত ধোয়ার পাত্রে আমার যাত্রা

শুধুই জটিলতা।

কবিতাটির দুটি অর্থ আছে। প্রথমত তিনি বলতে চেয়েছেন, সারাজীবন আমি অর্থহীন কাজ করেছি। দ্বিতীয় অর্থটি গভীর। এখানে তিনি বলছেন যে, জীবনের অর্থ আছে, কিন্তু তা বোঝার উপায় নেই।

ইস্সা পিওর ল্যান্ড বৌদ্ধধর্মের সদস্য ছিলেন এবং ধর্মপ্রাণ হয়ে জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন। আমিদা বৌদ্ধের জন্য অসীম ভালোবাসার মিশ্রণ ঘটেছিল তাঁর প্রিয় সব দুর্বল প্রাণীর সঙ্গে : শিশু, বিভিন্ন প্রাণী, পোকামাকড়। এদের সম্বন্ধে লেখা হাইকুতে তিনি যে বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন সেই উপলব্ধি হয় পাঠকের। যেমন :

শুকনো ব্যাঙ

লড়াই বন্ধ করো না

ইস্সা এখানে আছে।

তিনি অবশ্য আমিদা বৌদ্ধের প্রচলিত পদ্ধতির অনুসারীদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি। তাঁর ধারণায় তারা আমিদা বুদ্ধের শিক্ষা বিকৃত করে আচারসর্বস্ব হয়ে গিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস থেকে যেসব ধর্মভিত্তিক হাইকু লেখেন সেখানে এই প্রতীতি রয়েছে যে, আমিদা বুদ্ধকে বিশ্বাস করাই প্রকৃত ধর্ম। এই ধর্মীয় চেতনা থেকে লেখা তাঁর একটি হাইকু :

শিশির অশ্রুর সঙ্গে মিশে আছে

ঘুঘুরা প্রার্থনা করে মৃদু স্বরে

বুদ্ধই পরিত্রাতা।

ইস্সা সমাজ-সচেতন ছিলেন। সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ তিনি মানতে পারেননি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। সামন্তপ্রভুদের তিনি খুব একটা পাত্তা দিতেন না, ময়লা এবং ছেঁড়া কাপড় পরে ঘুরতেন সাধারণ মানুষের একজন হয়ে। এসব ছাড়া সামাজিক সাম্য আনার জন্য বাস্তবে কিছু করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। তাঁর কিছু হাইকু সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লেখা :

একজন সামন্তপ্রভু

কে তাকে ঘোড়া থেকে নামায়?

চেরি ফুল।

এক অর্থে চেরি ফুল এখানে সাম্যের প্রতীক। তার কাছে সবাই সমান। তার সৌন্দর্য দেখতে সামন্তপ্রভুকেও ঘোড়া থেকে নামতে হয়। কিন্তু এর অন্য অর্থও আছে। সামন্তপ্রভুকে দেখলে সাধারণ মানুষকে যে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তে হতো তাঁর ইঙ্গিতও রয়েছে এখানে। হাইকুটি দ্ব্যর্থবোধক।

শৈলীর প্রসঙ্গে ইস্সার কথা বলতে গিয়ে একজন সমালোচক বিউসা সুমোদা বলেছেন, তাঁর হাইকু দ্বি-মাত্রিক যার বিপরীতে বাশো লিখেছেন ত্রি-মাতৃক হাইকু। ইস্সার দ্বি-মাত্রিক হাইকুর দৃষ্টান্ত :

বরফ গলছে

গ্রাম ভেসে যাচ্ছে –

অসংখ্য শিশু।

প্রথম দুই লাইনে যে-অর্থ তা প্রাকৃতিক দুর্যোগের, তৃতীয় লাইন যুক্ত হতেই উৎসবের মাত্রা এসে গেল। গ্রাম ভেসে গিয়েছে বরফগলা পানিতে নয়, অসংখ্য শিশুর ভিড়ে।

ইস্সা যে খুব কৌশলী হয়ে হরফের কারিগরি করেছেন, তা নয়। দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে অনেক সময় তিনি জটিলতার সৃষ্টি অবশ্য করেছেন। যেমন :

মানুষ? বলতে পারি না;

একটাও সোজা হয়ে দাঁড়ানো কাকতাড়ুয়া

দেখি না এখন।

 

শিকি (১৮৬৭-১৯০২)

ঊনবিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময়ই ছিল হাইকুর জন্য খারাপ সময়। যখন ইস্সা মারা যান, তিনি কোনো স্কুল রেখে যাননি। আর বুশোর অনুসারীরা তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হওয়ার জন্য একধরনের মেকি কবিতাচর্চায় ঝুঁকে পড়ে। শতকের শেষ দিকে এই মেকি হাইকুচর্চার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় সামাওকা শিকির নেতৃত্বে। জাপান তখন ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, পুরনো প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির সঙ্গে পাশ্চাত্য থেকে আনা ধ্যান-ধারণার সংঘর্ষ চলছিল। প্রশিক্ষণ এবং মেজাজ, দুই দিক দিয়েই শিকি নতুন সাহিত্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কৈশোরে সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল এবং নানা ধরনের উত্থান ও বিপ্লবের সতর্কবাণী শোনা যাচ্ছিল। ১৮৭৭ সালে সাতশুমা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে এই অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটে। তার আগেই শিকি বেশ কয়েকটি স্কুলে ভর্তি হয়েছেন এবং পড়েছেন, তাঁর শিক্ষার ধারাবাহিকতা কমই ছিল। কৈশোরের এসব অভিজ্ঞতা তাঁর ভেতর সৃষ্টি করেছিল অস্থিরতা, যা পরবর্তীকালে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে যায়।

শিকি মাত্র এগারো বছর বয়সেই লেখা শুরু করেন এবং ষোলো বছর পর্যন্ত পারিবারিক পরিমন্ডলে হাইকুচর্চা অব্যাহত রাখেন। এরপর তিনি টোকিও চলে যান এবং সেখানে হাইকু প্রশিক্ষণ নেওয়ায় মনোনিবেশ করেন। স্কুল-কলেজের পড়া অসমাপ্ত রেখে তিনি নিহোন পত্রিকায় যোগ দেন। এই পত্রিকায় তাঁর লেখা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক বছরের মধ্যে তিনি ‘বাশোর সমালোচনা’ শীর্ষক হাইকু লিখে সাড়া জাগিয়ে ফেলেন। কবিতাটিতে তিনি সরাসরি বাশোকে আক্রমণ করেননি, কেবল পুরনো ঐতিহ্যের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরোধিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, বাশোর চার-পঞ্চমাংশ কবিতাই গুণগতভাবে নিম্নমানের, যে-মন্তব্য অনেকের কাছে অবিমৃষ্যকারিতার সমান বলে মনে হয়েছে। এই বিতর্কের ফলে তাঁর লেখা রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। পরে অবশ্য শিকি বাশো সম্পর্কে তাঁর মতামত সংশোধন করেছিলেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে লেখালেখির মাধ্যমে শিকি একটি অনুসারী দল গড়ে তোলেন। এদের লক্ষ্য ছিল অতীতের জ্যেষ্ঠ কবিরা হাইকু লেখা সম্বন্ধে যেসব রীতি ও পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন তার বিরোধিতা করা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নতুন কিছু করার বাসনা। দুশো বছর আগে রানমেটসু নামে এক হাইকু কবি লিখেছিলেন :

হলুদ ক্রিসেনথিমাম!

হলুদ সাদা ক্রিসেনথিমাম! অন্যসব নাম –

আর যদি না থাকতো!

শিকি এর উত্তরে লিখলেন :

ক্রিসেনথিমাম! সত্য বটে

হলুদ, সাদা – কিন্তু আমি চাই

একটি লাল রঙেরও।

শিকি শুধু অতীত ঐতিহ্যের বিরোধিতা নয়, নতুন স্কুলও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তাঁর এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। নতুন কবিদের তাঁর দেওয়া উপদেশের মধ্যে ছিল :

(ক) পুরনো নিয়মকানুন নিয়ে ভেবো না। ব্যাকরণ নিয়েও মাথা ঘামানোর কিছু নেই। বানান ইত্যাদিও গৌণ।

(খ) পুরনো কবিদের লেখা পড়ো এই কথা মনে রেখে যে, তাঁদের লেখায় ভালো-মন্দ দুই-ই আছে।

(গ) দেখবে সাধারণ কবিতা সরাসরি বক্তব্য রাখে না, মেকিভাবে ভাংচুর করে আকার বিকৃত করে।

(ঘ) নিজেকে তৃপ্তি দেওয়ার জন্য লেখ।

দেখা যাচ্ছে তাঁর সব উপদেশের লক্ষ্যই হলো, স্বাভাবিক হওয়া। এই কথাই বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে।

যারা হাইকু লিখতে জানে কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের উদ্দেশে তিনি লেখেন : (ক) দৃষ্টিকোণকে মনে রাখবে। বড় বস্ত্ত বড়, কিন্তু ক্ষুদ্র বস্ত্তও বড় হতে পারে যদি কাছে থেকে দেখা হয়; (খ) সূক্ষ্মতার অনুশীলন করতে হবে। এটি ১৭ সিলেবলের ভেতর মানবিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োগ করা নাও যেতে পারে। সূক্ষ্মতার নীতি প্রাকৃতিক বস্ত্তর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়; (গ) হাইকু খুব যুক্তিসংগত কাব্যরূপ নয়, ভাসা ভাসাভাবে কোনো যুক্তিতর্কের অবতারণা না করাই সমীচীন; (ঘ) শব্দগুলির শক্ত করে বাঁধুনি দাও, কোনো কিছুই অপ্রাসঙ্গিক হলে স্থান পাওয়া উচিত হবে না; (ঙ) ক্রিয়া, এডভার্ব এবং প্রিপজিশন যত পারা যায় ছেঁটে ফেলতে হবে; (চ) কল্পিত চিত্র এবং বাস্তব, দুই-ই ব্যবহার করতে হবে, তবে বাস্তবতাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

তৃতীয় শ্রেণির হাইকু কবি, যাঁরা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত তাঁদের দেওয়া শিকির উপদেশ আরো আকর্ষণীয় অব্যক্ত কথার জন্য, ব্যক্ত বক্তব্যের জন্য ততটা নয় : (ক) যখনই পারো নতুন হাইকুর ওপর লেখা ভালো সব বই পড়ো। তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতে থাকো; (খ) সব ধরনের হাইকু সম্বন্ধে জানতে চাও কিন্তু নিজের শৈলী তৈরি করো; (গ) কবিতার উপকরণ নিজেই সরাসরি সংগ্রহ করো, পুরনো হাইকু থেকে নেবে না; (ঘ) সাহিত্যের অন্য শাখা সম্বন্ধেও কিছু জানার চেষ্টা করো; (ঙ) সমস্ত শিল্পকর্ম সম্বন্ধে কিছু জানা থাকা প্রয়োজন।

হাইকুচর্চায় যে-অবনতি ঘটেছিল তার জন্যই শিকির এসব উপদেশ। তাঁর উপদেশের ফলাফল ভালোই হয়েছিল।

১৮০৫ সালে চীন দেশ থেকে ফেরার পর তাঁর হাইকুর স্কুল, নিহোন, স্বীকৃতি পায়। এর দুবছর পর তিনি এবং তাঁর সহচররা হোতোতো গিসু (দি কাক্কু) নামে একটি প্রভাবশালী মাসিক হাইকু-পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৯৭ সালে শিকি বুশোর ওপর একটি প্রবন্ধ লেখেন যেখানে তাঁর সঙ্গে বাশোর তুলনা করা হয়। তাঁর মতে, বাশোর অনেক কবিতা মাঝারি মানের হলেও বুশোর সব হাইকুই উঁচু মানের। এই মূল্যায়নের যুক্তি প্রদর্শনে তিনি বলেন, বুশোর কবিতায় মেকি চরিত্র থাকলেও তিনি ছিলেন সচেতনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষাশীল এবং শৈলী-নির্মাণে ওস্তাদ। তাঁর নতুন স্কুলের জন্য তিনি বুশোকেই উত্তম আদর্শ ও মডেল বলে গ্রহণ করেন। শিকি নিজে বুশোর আঙ্গিক দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন এবং তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা বুশোর অনুকরণে লেখা। এগুলি অন্ধ অনুকরণ ছিল না। যেমন :

‑ মন্দিরের ঘণ্টায়

বসেছে প্রজাপতি

গভীর ঘুম তার।

– বুশো

মন্দিরের ঘণ্টায়

জোনাকি বসেছে

করছে ঝলমল।

– শিকি

দুটি হাইকুর আঙ্গিক একই, কিন্তু যে-অনুভূতি তারা বহন করে সেগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বুশোর কবিতায় প্রজাপতির ভূমিকা সীমিত, সেটি নিদ্রাচ্ছন্ন, জড়ো। শিকির হাইকুতে জোনাকি পোকা সক্রিয়, সেটি ঝলমলিয়ে চলেছে, সৌন্দর্যকে ছড়িয়ে দিয়ে। প্রথমটিতে সৌন্দর্য বরফজমাট, দ্বিতীয়টিতে তা সংক্রামক।

শিকি যে বাশোর কবিতা পছন্দ করতে পারেননি, তার কারণ বাশোর মানসিকতা পছন্দের ছিল না। শিকির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল অস্থিরতা, বাশো ভালোবাসতেন প্রশান্তি, সৌন্দর্যের শান্ত-সমাহিত রূপ। কারো মতে, ধর্ম সম্বন্ধে শিকির নিরপেক্ষতা তাঁকে বাশোর প্রতি নিষ্পৃহ করে তোলে। কিন্তু এটাই প্রধান কারণ হতে পারে না কেননা, অন্য যারা ধর্মনিরপেক্ষ কবি তারা জেন বৌদ্ধধর্ম প্রভাবান্বিত বাশোর কবিতা প্রশংসা করেছেন। অবশ্য শিকি যে ধর্মনিরপেক্ষতায় শান্তি পেয়েছেন তাও নয়। ধর্মে বিশ্বাসহীনতা তাঁর কাছে বিষাদ এবং নির্লিপ্তির কারণ বলে মনে হয়েছে। যেমন :

হেমন্তের বাতাস :

আমার কোনো ঈশ্বর নেই

নেই কোনো বুদ্ধ।

এখানে এক ধরনের অনুতাপ এবং দুঃখ প্রকাশ আছে। তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে তিনি যন্ত্রণায় ভুগেছেন, মেরুদন্ডের অসুস্থতাও তাঁকে শয্যাশায়ী করে রেখেছে। দুঃখভারাক্রান্ত হলেও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কবিতা লিখেছেন, কবিতার নতুন পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এই সময় তাঁর লেখায় শারীরিক যন্ত্রণার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন :

জীবন্ত চোখগুলি দেখে

তারা কি এসেছে খুঁটে দেখতে

চঞ্চল মাছিগুলো।

আবার মৃত্যুচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে কোনো কবিতায় :

পাশের ঘরের বাতি

সেটাও নিভে গেল – এখন

কেবলই ঠান্ডা রাত।

শিকি ১৯০২ সালে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মারা যান। তিনি ছিলেন হাইকুর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। তিনি চাইতেন কবির সংখ্যা বৃদ্ধি পাক, আরো কবিতা লেখা হোক কিন্তু সেসব হতে হবে উঁচুমানের। শুধু আঙ্গিক ভালো হলে চলবে না, সেসব হতে হবে সুন্দর আবেগের স্বাক্ষর। তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক। জাপানের প্রকৃতি, তার জনগণ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ছিল তাঁর প্রিয়। অন্য যে-কোনো হাইকু কবির তুলনায় তিনি এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত এবং সচেতনভাবে কবিতা লিখেছেন। জাপান বিষয়ে লেখা তাঁর হাইকু শ্রেষ্ঠ কবিতার অন্যতম। এগুলিতে তাঁর আবেগ কেবল মৌলিক ছিল না, প্রবলভাবে শক্তিশালীও ছিল।

 

আধুনিক হাইকু

আধুনিককালে জাপানে হাইকুচর্চা অব্যাহত রয়েছে যদিও বিভিন্ন ধরনের কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে এবং ভিন্নধারার কবিদের সংখ্যা কম নয়। বেশ কিছু কবি এখনো ট্রাডিশনাল ‘টাংকা’ (দুটি হাইকু কবিতার চেয়ে আকারে ছোট) কবিতা লিখছে। এই ‘টাংকা’ই ছিল সপ্তম শতাব্দী থেকে লেখা জাপানি সাহিত্যে প্রধান লিরিক কবিতা। ইউরোপ-আমেরিকার মতো জাপানেও লিমেরিক জাতীয় কবিতা লেখা হয়। লোকসংগীতভিত্তিক কবিতাও লেখেন কেউ কেউ। গত দেড়শো বছরে গদ্য কবিতা লেখার চর্চা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একেই মূলধারা মনে করা হয়। এসব সত্ত্বেও হাইকু শুধু টিকে নেই, বেশ সাবলীল গতিতে এগিয়ে চলেছে। এর কারণ কী? একটা উত্তর হলো, হাইকুতে যে বাক-চাতুর্য তা সকলের কৌতূহলের বিষয়। দ্বিতীয় কারণ হলো, এর সংক্ষিপ্ততা, যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। সংক্ষিপ্ততার মধ্যে যে নিগূঢ় অর্থ নিহিত তার উপলব্ধি লাভ অনেককেই মানসিক তৃপ্তি দেয়, মননকেও সন্তুষ্ট করে। আরেকটি কারণ হলো, হাইকু কথোপকথনের সময় উল্লেখ করা যায় অনায়াসে সামাজিকতা ক্ষুণ্ণ না করে।

সময়ের সঙ্গে হাইকুরও পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিক জীবনের জটিলতা এর মধ্যে এখন প্রতিফলিত। হাইকু কেবল প্রকৃতির অবলোকন ও পর্যবেক্ষণ নয় এবং সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই সৌন্দর্য উপলব্ধি অথবা তার বিশেষ অভিব্যক্তির অর্থোদ্ধার করা নয়। আগেও অবশ্য হাইকু প্রকৃতিসর্বস্ব ছিল না। আধুনিক জীবন যতই ব্যাপ্তি পেয়েছে অভিজ্ঞতার পরিধি ও চরিত্রও প্রসারিত হয়েছে। মানুষের সংবেদনশীলতার সীমা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি হাইকুর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা, দৃশ্য ও কল্পনা ধারণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সংগতি রেখে হাইকুও আধুনিক হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনে হাইকুর নান্দনিকতার বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্যবোধের ভিত্তির সংশোধন হয়নি। হাইকু লেখার পদ্ধতি, অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ এবং অগভীর অর্থময়তা এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। হাইকুর মূল্যায়নে তাই তার সনাতন নান্দনিকতা এবং সৌন্দর্যবোধ এখনো প্রাসঙ্গিক।

 

হাইকুর নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যবোধ

হাইকুর নান্দনিকতার মূল ভিত্তি এর সংক্ষিপ্ততা। ১৭টি সিলেবলে হাইকু লেখার শর্ত যদিও জাপানি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় সম্ভব হয় না, তিন লাইনে যত সম্ভব কম সিলেবল ব্যবহার করে হাইকুর বক্তব্য প্রকাশের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় জাপানি ছাড়া অন্য ভাষায়। একটি ধারণা, ভাব, অনুভূতির অভিজ্ঞতা কম শব্দ দ্বারা প্রকাশ করার মধ্যেই রয়েছে এর সৌনদর্য। আপাতদৃষ্টিতেই এই সৌন্দর্য ধরা পড়ে, অর্থোপলব্ধির আগেই। সুন্দর একটি ভাবনা অথবা দুঃখবোধ যখন কম কথাতেই ব্যাক্ত হয়, তার দ্যোতনা সরাসরি পৌঁছে যায় অন্যের কাছে। সুন্দর ভাবনা এবং দুঃখবোধ প্রকাশ, উভয় ক্ষেত্রেই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সৌন্দর্যবোধের সৃষ্টি করে বিষয়নিরপেক্ষ হয়ে। ইংরেজিতে যেমন বলা হয়েছে, সংক্ষিপ্ততা বুদ্ধিমত্তার সারাৎসার, এও অনেকটা সেরকম। হাইকুর নান্দনিকতার বিচারে তাই প্রথমেই দেখা হয় এটি সংক্ষিপ্ত কিনা।

একটি হাইকুর বিভিন্ন অর্থ হতে পারে, তার কোনোটিই উপেক্ষণীয় নয়। যে-হাইকুর অর্থের বিভিন্ন স্তর রয়েছে সেটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বলা হয়। বাশোর অনেক হাইকুতে অর্থ দুই কিংবা তিন স্তরে উপলব্ধি করা যায়। হাইকুর এই নান্দনিকতা এক ধরনের দার্শনিকতার আবহ সৃষ্টি করে। হাইকু বর্ণনায় সরলতা থাকতে পারে কিন্তু সেই সরলতা অর্থে প্রতিফলিত হলে সেটি উঁচু ধরনের সৃষ্টি হবে না। ধোঁয়াশা কিংবা ধাঁধা সৃষ্টি নয়, পর্যবেক্ষণের বিষয়ে গভীরতর অর্থের অনুসন্ধানে আগ্রহী করে তোলাই হাইকুর উদ্দেশ্য। এখানেই হাইকুর অভিজ্ঞতার সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতার পার্থক্য।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাইকু প্রকৃতিনির্ভর। প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রকৃতির অন্তর্গত প্রাণী ও কীটপতঙ্গের উপস্থিতি এবং তাদের আচরণ হাইকু অভিজ্ঞতায় ‘মুহূর্ত’ সৃষ্টি করে। এর পরিবর্তন হয় প্রতিটি ঋতুতে কেননা, ঋতুর পরিবর্তনে দৃশ্য-বর্ণ-গন্ধের এমনকি স্পর্শের পরিবর্তন হয়। প্রকৃতির বর্ণনায় ঋতুর উল্লেখ সেজন্য হাইকু লেখার একটি আবশ্যকীয় শর্ত। এই শর্ত যত পরোক্ষে এবং ইঙ্গিতে দেওয়া যায় হাইকুর নান্দনিকতার মান সেই অনুপাতে উন্নত হয়।

প্রাকৃতিক দৃশ্য ঋতুভিত্তিক হওয়ার জন্য দৃশ্যের পরিবর্তন হয়। ফুল ফোটে, ফুল ঝরে যায়, চারা থেকে গাছ বড় হয়, প্রাচীন হয়ে গেলে ভেঙে পড়ে। ঋতুর বিবর্তনে দৃশ্যের চক্রাকার পরিবর্তন হয়, যার জন্য প্রকৃতিতে প্রায় সবকিছুই পরিবর্তনশীল এবং সাময়িক মনে হয়। এমনকি পাহাড় ও নদীর মতো স্থায়ী দৃশ্যও পারিপার্শ্বিকের পরিবর্তনে দেখতে অন্যরকম হয়। ঋতুর জন্য প্রকৃতির অন্তর্গত পরিবর্তন অস্থায়িত্বের সাময়িক উপস্থিতির উপলব্ধি সৃষ্টি করে, এমনকি এই অস্থায়িত্ব এবং সাময়িক উপস্থিতিকে মৃত্যু ও ধ্বংসের সমতুল্য মনে করা যেতে পারে। যে-ফুল ঝরে যাবে, তার সৌন্দর্য অনবদ্য হলেও সাময়িক। সেই সাময়িক সৌন্দর্য দেখেই দর্শকের তৃপ্তি ও আনন্দ। কিন্তু সেইসঙ্গে অস্থায়িত্ব এবং সাময়িক উপস্থিতির উপলব্ধি যখন মনে আসে সেই সময় এক ধরনের বিষাদগ্রস্ততায় আচ্ছন্ন হতে হয়। এই বেদনার অনুভূতিকেই বলা হয়েছে ‘মনো নো আওয়ারে’, ইংরেজিতে দি স্যাডনেস অফ থিংস, বাংলায় ‘অস্থায়ী সৌন্দর্যের জন্য বেদনাবোধ’। সৌন্দর্যের জন্য  তৃপ্তি এবং আনন্দলাভের অপর পিঠেই রয়েছে এই বেদনাবোধ যার জন্য এটি সার্বিক সৌন্দর্যবোধের অংশ। হাইকু কবিতায় চেরি ফুল ফোটা এবং ঝরে যাওয়া, দিনের শেষে ঘনায়মান রাত্রি, একাকী কোনো পাখির ডাক প্রায়ই উল্লিখিত হয়েছে যার জন্য মনো নো আওয়ারেকে হাইকুর নান্দনিকতার অপরিহার্য অংশ বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এই ধরনের হাইকু যে-অনুভূতি প্রকাশ করতে চায় সেখানে সৌন্দর্যের জন্য বেদনাবোধ ছাড়া আনন্দ লাভ সম্ভব হয় না।

প্রকৃতিতে অনেক কিছু দেখেই একাকিত্বের কথা মনে পড়তে পারে। যেমন, পাতা ঝরা একটি গাছ, বরফজমাট একটি নদী ইত্যাদি। হাইকুতে একাকিত্ববোধের ধারণা বেশ সাধারণ এবং প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু এই বোধ নান্দনিকতার ভিত্তিতে হতে হলে তা নৈর্ব্যক্তিকের পর্যায়ে থাকতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তির আবেগনির্ভর না হয়ে সেই একাকিত্ববোধ জেগে উঠবে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। একাকিত্ববোধের উৎস নির্ধারণ তাই হাইকুর সৌন্দর্যবোধ উপভোগের জন্য প্রয়োজনীয়। ইতিপূর্বে উল্লিখিত বাশোর এক হাইকুতে শীতের অরণ্যে মন্দিরের দৃশ্য-বর্ণনায় এমন নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতির কথাই বলা হয়েছে।

 

বাশোর নান্দনিকতাবোধ

নিজে উঁচুমানের কবি হওয়া ছাড়াও বাশো হাইকুর শিক্ষকতা করেছেন; তাঁর ছাত্ররা জাপানের সর্বত্র ছিল। অন্য কবিদের সঙ্গে পার্থক্য রেখে তিনি এবং তাঁর কবি-ছাত্ররা কয়েকটি কাব্যনীতি বা কাব্য-শৃঙ্খলা অনুসরণ করতেন। তাঁর অনুসারীদের সেজন্য ‘শোমোন’ বা বাশো স্কুলের ছাত্র বলা হতো। বাশোর কাব্যচিন্তা-পরবর্তী কয়েক শতকে মূলধারার প্রতিনিধিত্ব করেছে। বলা বাহুল্য এই ধারণাটি ছিল রক্ষণশীল এবং প্রাচীনপন্থী। বাশো অবশ্য নিজে হাইকুর কোনো তত্ত্ব তৈরি করেননি। তিনি কবিদের স্বাধীন চর্চা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু তাঁর কবিতা সম্বন্ধে কিছু নির্দিষ্ট ধারণা ছিল। তাঁর ছাত্র এবং শিষ্যরা আলোচনার ভিত্তিতে হাইকু সম্বন্ধে বাশোর ধারণা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। শিষ্যদের এসব লেখার সঙ্গে বাশোর নিজের ডায়েরি, প্রবন্ধ, চিঠি এবং স্মৃতিচারণমূলক লেখা যুক্ত করলে হাইকু সম্বন্ধে তাঁর ধারণা প্রসঙ্গে মোটামুটি একটা উপসংহারে পৌঁছানো যায়। এসব ধারণার মধ্যে ছিল কাব্যচিন্তা বা কাব্য-চেতনা, সাবি, শিওরি, কৃশকায় বা মেদহীনের বৈশিষ্ট্য, সুগন্ধ, প্রেরণা, অনুচিন্তা, সারল্য, কম্পমানতা এবং হালকা ওজন যা শোমোন স্কুলের ছাত্রদের লেখায় প্রায়ই দেখা যেতো।

ধারণাগুলির মধ্যে কাব্যচিন্তা, বা কাব্য-চেতনাই ছিল প্রধান এবং অন্যগুলিকে বলা যায় এর বিভিন্ন রূপ। বাশোর এক শিষ্য বলেছিলেন, হাইকুর রূপ হাজার বছর অপরিবর্তিত থাকবে। আরেক শিষ্য বলেছিলেন, হাইকুর শৈলী সময়ের সঙ্গে বদলায়। এঁদের উভয়ের বক্তব্যের সঙ্গে বাশো একমত ছিলেন। তাঁর মতে, হাইকুর সব শৈলী এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত : একটির বৈশিষ্ট্য স্থান-কাল অতিক্রম করে যাওয়া; দ্বিতীয়টি সমকালের রুচির সঙ্গে যুক্ত। প্রথমটিতে বিশ্বজনীনতা আছে, দ্বিতীয়টিতে সজীবতা; উভয়ই আকর্ষণীয়। বাশো মনে করতেন, দুটি শ্রেণি অন্তিমে ঐক্যবদ্ধ হয় কাব্য-চেতনার ভিত্তিতে। বাশো কাব্য-চেতনাকে কবিতা ছাড়াও অন্যান্য শিল্পকর্মে ক্রিয়াশীল দেখেছেন। এভাবে কাব্য-চেতনার ওপর ভিত্তি করে বাশো আদিম সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছেছিলেন।

কাব্য-চেতনার দুটি দিক ছিল, একদিকে ছিল উঁচু মার্গের আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছানো এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে প্রবেশ। প্রথমটিতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব রয়েছে, যার ব্যঞ্জনা হলো শুচিতা, নির্জনতা এবং সংসার বৈরাগ্যের চরিত্র। মধ্যযুগে জাপানি শিল্পীদের কাছে এসব গুণ আরাধ্য ছিল। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে ভোগবাদ, আনন্দ-উল্লাসের জগৎ যা নব্য জাপানে জনপ্রিয় হচ্ছিল। দুটির মধ্যে বিরোধ ছিল কিন্তু বাশোর জীবনদর্শন এই বিরোধিতা অতিক্রম করে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যেখানে পরস্পরবিরোধী মূল্যবোধ দুটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে জড়িত হয়ে অগ্রসর হয়েছে। প্রথম শ্রেণির মূল্যবোধ কবিদের উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক চেতনায় উন্নীত করেছে, যেখানে রয়েছে সাবি, শিওরি, কৃশকায় হওয়ার বৈশিষ্ট্য, অনুপ্রেরণা ইত্যাদি। দ্বিতীয় শ্রেণির মূল্যবোধ যা সাধারণ মানুষের আয়ত্তে ছিল তার মধ্যে ছিল সারল্য এবং হালকা স্বভাব। দুটি মূল্যবোধই তাৎপর্যপূর্ণ কেননা, দুটি দ্বারাই বাশোর কল্পিত হাইকু কাব্য-তত্ত্ব সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।

বাশোর কাব্য-তত্ত্বের মধ্যে ‘সাবি’ সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বাশো ‘সাবিশি’ শব্দটি ব্যবহার করলেও ‘সাবি’ প্রায় ব্যবহারই করেননি। ‘সাবি’ অবশ্য ‘সাবিশি’ থেকেই উদ্ভূত। ‘সাবিশি’র অর্থ একাকিত্ব বা নির্জনতা, যা একজন মানুষের মনের অবস্থার কথা বলে। কিন্তু বাশো ‘সাবি’ বা ‘সাবিশি’র অর্থকে সীমিতভাবে দেখেছেন। যেমন :

একাকিত্ব –

ফুটন্ত ফুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে

একটি সাইপ্রেস গাছ।

সময় বসন্তকাল, ফুল ফুটেছে কিন্তু এই সজীবতা ও ঔজ্জ্বল্যের মধ্যে একটি ছন্দপতন ঘটেছে, সাইপ্রেস গাছটি একাকী দাঁড়িয়ে। এখানে একাকিত্ব কোনো ব্যক্তির অন্তরের নয়, এটি নৈর্ব্যক্তিক, প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৃষ্টি। ‘সাবি’ এই ধরনের বস্ত্তগত, আবেগ-নিরপেক্ষ একাকিত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘সাবি’ প্রকৃতিতে যে একাকিত্বের রূপ তাঁর প্রতি আলোকপাত করে। বাশো তাঁর হাইকুতে একাকিত্বকে নৈর্ব্যক্তিক অর্থে ব্যবহার করেছেন যার বিপরীতে রয়েছে দুঃখ, শোক, বেদনাবোধ। মানুষ দুঃখ-শোক ভুলতে পারে যখন নৈর্ব্যক্তিক পরিপ্রেক্ষিতে একাকিত্বের কথা ভাবে। বাশোর একটি হাইকুতে এটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে :

আমার দুঃখভরা মন –

একাকিত্ব বুঝতে দাও

ওহে, কোকিল।

কবি প্রথম লাইনে মনের দুঃখে কাতর, কিন্তু কোকিলের নিজের দুঃখবোধ নেই কেননা, সে প্রকৃতির সঙ্গলাভ করেছে। কবি চাইছেন কোকিল তার ডাক দিয়ে তাঁকে নৈর্ব্যক্তিক একাকিত্বের জগতে নিয়ে যাক।

আগেই বলা হয়েছে, হাইকুর অন্যতম প্রধান বিষয় একাকিত্ব, সেজন্য এর নান্দনিকতা সম্বন্ধে বাশোর দেওয়া ব্যাখ্যা প্রাসঙ্গিক তো বটেই, গ্রহণযোগ্য কেননা, এই ব্যাখ্যা দুঃখ ভুলতে সাহায্য করে। দুঃখ সহ্য করা কঠিন, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক একাকিত্ব আনন্দের। ‘সাবি’ এমন একাকিত্বকেই বোঝায়। ‘সাবি’র একাকিত্ব ব্যক্তিমানুষের নয় যে দুঃখভারাক্রান্ত এবং শোকগ্রস্ত। ‘সাবি’র একাকিত্ব রাতের বেলা গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার মতো অথবা শুকনো পাথরের ভেতর থেকে ঘাসফড়িংয়ের একাকী নিঃসঙ্গ ডাক। প্রকৃতিতে আবেগ নেই কিন্তু জীবন আছে যার দ্বারা পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই নৈর্ব্যক্তিক পরিবেশ যেখানে একাকিত্ব আছে তার মধ্যেই ‘সাবি’র উপস্থিতি।

‘সাবি’ শব্দে যে-একাকিত্বের ব্যঞ্জনা তার উৎস জীবনের প্রতি কবির দৃষ্টিভঙ্গিতে। শিওরি একাকিত্ব সৃষ্টি করে কবিতার নির্মিত শরীর থেকে। প্রথমটি কবির দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত, দ্বিতীয়টি তাঁর কবিতার আঙ্গিকের সঙ্গে। তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু হাইকু কবিতায় ‘একাকিত্বের’ ধারণা বেশ সাধারণ এবং প্রায়ই দেখা যায় সেজন্য তার নান্দনিক ব্যাখ্যা মনে রাখা প্রয়োজন।

হাইকু কবিকে কেবল উচ্চতর মার্গের আধ্যাত্মিকতায় উপনীত হয়ে নৈর্ব্যক্তিক একাকিত্বের মতো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখলে চলবে না, তাঁকে সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবনের সঙ্গেও সংগতি রেখে কবিতা লিখতে হবে, এই ছিল বাশোর অভিমত। হাইকুর সঙ্গে অন্য শ্রেণির কবিতার পার্থক্য হলো এই যে, হাইকুর বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সবকিছুই স্থান পায় যার সবই সুন্দর এবং চৌকস নাও হতে পারে। হাইকু বিষয়ের মধ্যে পাখি, ফুল, চাঁদ থাকবে আবার নোংরা কাক, পাখির বিষ্ঠাও থাকতে পারে, কেননা সবই প্রকৃতির অংশ। একইভাবে হাইকু জীবনের ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুশ্রী সবকিছুই লেখার বিষয় বলে মনে করে। হাইকুর নান্দনিকতা বিচারে এই বিষয়টি ভুলে গেলে তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় না। হাইকু একই সঙ্গে জেন ধর্ম প্রভাবান্বিত এবং সেক্যুলার, সে-কথাও ভুলে থাকার উপায় নেই।

 

কেনেথ ইয়াসুদার ব্যাখ্যা

কেনেথ ইয়াসুদা তাঁর দি জাপানিজ হাইকু বইতে হাইকুর বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন এবং সেসবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নান্দনিকতার বিষয় এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি বেনেদেত্তো ক্রোচে, জন ডিইএ প্রমুখ নন্দনতাত্ত্বিকের লেখার অনুসরণে হাইকুর নন্দনতত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন।

কোনো বস্ত্ত বা প্রাণীকে দেখে তার প্রতি কৌতূহলী হওয়ার অর্থ তার সৌন্দর্য দ্বারা আকৃষ্ট হওয়া নয় অথবা সেটি দেখে ব্যক্তির ওপর কী প্রভাব পড়েছে তা জানাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। আগ্রহের সৃষ্টি হওয়াটাই নন্দনতাত্ত্বিক, এসথেটিক অভিজ্ঞতা, কেনেথ ইয়াসুদার মতে। একেই তিনি বলেছেন হাইকু দৃষ্টিভঙ্গি। হাইকু দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে অভিজ্ঞতার জন্যই অভিজ্ঞতা অর্জনের মানসিক প্রস্ত্ততি থাকে, আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এখানে আবেগের স্থান নেই। অভিজ্ঞতার বাস্তবতার কাছে লালিত মননশীল ধারণা সমর্পণে যে বিনয় এবং আন্তরিকতা ‘হাইকু দৃষ্টিভঙ্গি’ তার ওপর ভিত্তি করে গঠিত। হাইকু দৃষ্টিভঙ্গি অভিজ্ঞতার জন্য এমন একটা প্রস্ত্ততি যা নান্দনিক হতে পারে। কিন্তু হাইকু দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতা অর্জন কোনো কার্যকারণের ওপর ভিত্তি করে নয়। হাইকু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কোনো কিছুর প্রতি তাকালেই নান্দনিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হবে না। এটা কেবল একটা প্রস্ত্ততি যা সফলভাবে সমাপ্ত নাও হতে পারে।

নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নান্দনিক অভিজ্ঞতার অবশ্যই সম্পর্ক রয়েছে এবং এই দুটি সহাবস্থানও করে। কেবল যা মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো হাইকু দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই একটি অভিজ্ঞতা নান্দনিক হয় না। তাহলে নান্দনিক অভিজ্ঞতা কী? এটি এমন অভিজ্ঞতা যা অর্জনের সময় ব্যক্তি যা দেখে বা শোনে সেই অভিজ্ঞতা থেকে পৃথক হয়ে নিজের সম্বন্ধে সচেতন থাকতে পারে না। ইয়াসুদা এরপর বলেছেন, নান্দনিক অভিজ্ঞতা সঙ্গে সঙ্গেই ভাষায় রূপান্তর হতে পারে না, তার জন্য প্রয়োজন ‘হাইকু মুহূর্তের’। ‘হাইকু মুহূর্ত’ একধরনের নান্দনিক মুহূর্ত, এমন মুহূর্ত যখন যেসব শব্দ নান্দনিক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করেছে সেসব এবং অভিজ্ঞতা নিজেই একাকার হয়ে যেতে পারে। ‘হাইকু মুহূর্তের’ চরিত্র সময় নিরপেক্ষ এবং এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি চিরন্তন। এই মুহূর্তে মানুষ এবং তার পরিবেশ একীভূত হয়ে যায়। তখন কোনো সময়জ্ঞান থাকে না।

নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার পর যখন সংশ্লিষ্ট বিষয়টির এবং তার গুণাবলি নিয়ে কবির চিন্তা-ভাবনা সম্পূর্ণ হবে এবং গুণাবলি উপলব্ধি পূর্ণ হবে তখন আসবে ‘হাইকু মুহূর্ত’। এই মুহূর্তে অথবা এর অব্যবহিত আগে কবির অনুভূতি নির্বানা-তুল্য এক বোধির সঞ্চার করে যখন কবির স্বভাব এবং প্রকৃতি অভিন্ন হয়ে যায়। এই মুহূর্ত সব শিল্পে একই ধরনের। এই মুহূর্তের অভিজ্ঞতার ফলাফলের রেশ থেকে যাবে যার জন্য বাশো বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা হলো ফিরে যাওয়া’।

কেনেথ ইয়াসুদার মূল তিনটি নীতিকে হাইকুর পদ্ধতি বলাই ভালো, এখানে বর্ণনার মাধ্যমে হাইকু অভিজ্ঞতা অর্জনের উল্লেখ হয়েছে। তবে ‘হাইকু মুহূর্ত’ কি নান্দনিক অভিজ্ঞতার পর আসে, না এটি যুগপৎ ঘটে, সে-বিষয়টি ভাবার অবকাশ রাখে। ইয়াসুদা হাইকুর নন্দনতত্ত্বে অতটা ব্যাখ্যা করেননি, যতটা করেছেন হাইকু লেখার পদ্ধতি নিয়ে। তিনি উপায় এবং ফলাফলকে পৃথক করে না দেখে একত্রে দেখেছেন যা বেশ ব্যতিক্রমী এবং কিছুটা জটিলও বটে।

হাইকুর নান্দনিকতার বিচারে বিভিন্ন ধারণা ও নীতির ব্যবহার করা হয়েছে। হাইকু পদ্ধতি এদের তুলনায় পৃথক, তবে পদ্ধতি জানা থাকলে নীতি ও ধারণার ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্টভাবে অবহিত হওয়া যায়।

 

তথ্য

১.         প্রবন্ধের হাইকুগুলি লেখক ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

২.         ‘টাংকা’ আক্ষরিক অর্থে সংক্ষিপ্ত কবিতা। ৩১ (একত্রিশ) সিলেবলের এই কবিতায় পাঁচটি লাইনে সিলেবলগুলি ৫-৭-৫-৭-৭ সংখ্যায় বিভক্ত। সপ্তম শতাব্দী থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ‘টাংকা’ প্রধান ক্লাসিক্যাল কবিতার রূপ। অষ্টম শতকের ‘মনইয়োশু’ কবিতার সংকলনে ৩১ সিলেবলের ছোট ‘টাংকা’ কবিতাকে দীর্ঘ আকারের ‘চোকা’ বা ‘নাগাচিতা’ কবিতা থেকে পার্থক্য করার জন্য ‘টাংকা’ নামটি ব্যবহার করা হয়। অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে ‘চোকা’ এবং অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ ট্রাডিশনাল কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ‘টাংকা’ই টিকে থাকে জাপানি ভাষায় লেখা পরিশীলিত প্রকৃতির কবিতা হিসেবে এবং ১২০০ বছর পর্যন্ত তার প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ ছিল। এই জন্য ‘টাংকা’ আর ‘ওয়াকা’কে সমার্থক মনে করা হয়। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের পর ‘টাংকা’ ‘ওয়াকা’র ৩১ সিলেবলের কবিতার স্থান অধিকার করে নেয়।

৩.         মেইজি পর্বের (১৮৬৮-১৯১২) আগে ৩১ সিলেবলের যে-কবিতা লেখা হতো সেসব ‘ওয়াকা’ নামে পরিচিত। এই পর্বের পর যাঁরা ৩১ সিলেবলের কবিতা লেখেন, তাঁরা সবাই ‘টাংকা’ কবির শ্রেণিভুক্ত। ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময় রাজদরবারের সদস্যদের হাতে ‘ওয়াকা’র চর্চা জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘ওয়াকার’ একটি বৈশিষ্ট্য এর লিরিকধর্মিতা। এর কারণ হিসেবে জাপানিদের বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্কের তুলনায় মন্ময়তার প্রতি আকর্ষণকে শনাক্ত করা হয়েছে।

৪.         ‘রেংগার’ অর্থ সংযুক্ত কবিতা যেখানে একটি কবিতার এক অংশের (১৭ সিলেবল) সঙ্গে অন্য কবির লেখা ৭ অথবা তার অধিক সিলেবলের দুটি কবিতা যুক্ত করা হতো। ‘রেংগা’ ছিল কবিতা লেখার একটি যৌথ প্রয়াস। কখনো দুই অংশের কবিতা একাধিক কবিদের দ্বারাও লেখা হতো।  ৫-৭-৫ এবং ৭-৭ সিলেবলের একটি কবিতা ওতোমো নো ইয়াকামোচি নামে রাজদরবারের এক সদস্য এক মেয়ে সন্ন্যাসীর যৌথভাবে লেখা ওয়াকা, মনইয়োশু কাব্য সংকলনে (অষ্টম শতকের মাঝামাঝি) অন্তর্ভুক্ত হয়। একেই মনে করা হয় ‘রেংগা’র সবচেয়ে পুরনো দৃষ্টান্ত। হেইয়ান পর্বের শেষের দিকে (৭৯৪-১১৮৫) ‘রেংগা’ লেখার চর্চা বৃদ্ধি পায় এবং অনেক রেংগা সংকলনভুক্ত হয়। যে-সমাবেশে রেংগা লেখা হতো তার নাম ছিল ‘যা’ অথবা, ‘হাইমোকি’ এবং অংশগ্রহণকারী কবিদের যৌথভাবে বলা হতো ‘রেনজি’। আটজনের একটি দলকে মনে করা হতো ‘রেংগা’ লেখার জন্য উপযুক্ত সংখ্যা।

 

গ্রন্থপঞ্জি

১.         আর এইচ ব্লাইথ, আ হিস্ট্রি অব হাইকুু, দ্বিতীয় খন্ড।

২.         বাওনেস, জিওফ্রে এবং থোওয়াইট, অ্যান্থনি, দ্য পেঙ্গুইন বুক অব জাপানিজ ভার্সেস, ১৯৬৪।

৩,         কার্টার, স্টিভেন (সম্পাদক), ট্রাডিশনাল জাপানিজ পোয়েট্রি, অ্যান এন্থলজি, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯১।

৪.         হেন্ডারসন, হ্যারল্ড জি, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু হাইকু : অ্যান এন্থলজি অব পোয়েমস্ ফ্রম বাশো টু শিকি, নিউইয়র্ক, ডাবলডে অ্যাঙ্কর বুক্স, ১৯৫৮।

৫.         হিগিনসন, উইলিয়ম জে, দি হাইকু সিজন্স, কোডানসা ইন্টারন্যাশনাল টোকিও, ১৯৯৬।

৬.         উয়েদা মাকোতো, মডার্ন জাপানিজ ভার্সেস, টরন্টো ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৬।

৭.         ইয়াসুদা, কেনেথ, দি জাপানিজ হাইকু : অ্যান অ্যান্থলজি, চার্লস ই টাটল কোম্পানি, টোকিও, ১৯৫৭, ১৯৭৩, ১৯৯১।

৮.         হিউম, ন্যান্সি জি, জাপানিজ এসথেটিক্স অ্যান্ড কালচার, আ রিডার, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ১৯৯৫।

৯.             তোশিহিহিকো অ্যান্ড তোয়ো ইজুৎসু, দি থিওরি অব বিউটি ইন দি ক্লাসিক্যাল এসথেটিক্স অব জাপান, মার্টিনাস নিজহফ পাবলিশার্স, দি হেগ, ১৯৮১।