হামদি বে

আবুল হাসনাত

কলকাতায় প্রাজ্ঞজন ও অগ্রজসম বন্ধু সুবীর রায় চৌধুরীর বাড়িতে এক আড্ডায় হামদি বে সম্পর্কে জেনেছিলাম। বড়ই মৃদু ও শ্রদ্ধামিশ্রিত ছিল সে-উচ্চারণ। গড়পড়তা মানুষের বাইরে এবং মনেপ্রাণে সাহিত্য-অন্তপ্রাণ হামদি বে। কিন্তু মূলত ডাকসাইটে এক সাংবাদিক, ইংরেজি সাংবাদিকতায় কত না তাঁর অর্জন! স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষের সর্বাধিক খ্যাতিমান ও আলোচিত দুই সংবাদপত্র টাইমস অব ইন্ডিয়া আর দ্য স্টেটসম্যানে কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে কাজ করেছেন বাংলা দৈনিক আজকালে।

কলকাতার সৃজনশীল লেখকদের সঙ্গে সখ্য আর পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি, এই ভুবনে বিচরণ, বৈচিত্র্যময় গ্রন্থ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা, নানা রকম গ্রন্থের রস গ্রহণের জন্য সদা-উন্মুখ হামদি সারস্বত সমাজে এই বিবিধ কারণে প্রিয় ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। নির্বাচিত বন্ধুবৃত্তে তাঁর সরব উপস্থিতি প্রাণসঞ্চার করত সকলের।

সেদিনের আড্ডায় কে যেন বলছিলেন মধ্যাহ্নে তাঁর পানাসক্তির কথা। নিয়মিত যান একটি পানশালায়। কোনোদিন পা টলেনি, মননে চিড় ধরেনি, চিন্তা এতটুকুও এলোমেলো হয়নি। পক্ষী, নিসর্গ ও পর্বত-প্রেমিক এই মানুষটির বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ ছিল। সমাজ-নিরীক্ষণেও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।

দুপুর গড়িয়ে গেলে যান কার্যালয়ে। ততক্ষণে ভেবে নিয়েছেন কী লিখবেন। যা-ই লিখুন, সম্পাদকও জানতেন, হামদি বে-র কলম থেকে যে-রচনা বেরোবে তা হয়ে উঠবে স্বর্ণপ্রভাময়। কি বক্তব্যে, কি রসবোধে, গদ্যে এবং বিশ্লেষণে। অথচ এই হামদি বে একসময় স্টেটসম্যানে অপরিহার্য  থাকলেও পরবর্তীকালে ক্ষুদ্র পছন্দ-অপছন্দের কারণে এবং ইংরেজদের কাছ থেকে মালিকানা বদল হওয়ায় স্টেটসম্যান ছেড়ে আসতে হয় তাঁকে। কলকাতার সংবাদপত্রের জগৎ বড়ই বিচিত্রমুখী আবার অন্যদিকে গন্ডিবদ্ধ। খোলা হাওয়া নেই তার অলিন্দে। ইংরেজ আমল থেকে কত বিস্তৃত পরিসরের ঐতিহ্যবাহী তার জগৎ। কখনো-সখনো প্রতিভার কদর করলেও একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ক্ষুদ্রতা এবং লেখনীর স্বাধীনতা-বিষয়ে আদর্শিক কত সংঘাত খ্যাতিমান সাংবাদিকদেরও আহত করে। এমনকি নানা দ্বন্দ্বের কারণে সাংবাদিকতার পেশা ছেড়েও দিতে হয়েছে অনেককে। এর ব্যত্যয় হয়নি এখনো। এই সংবাদপত্রের জগৎ নিয়ে অসামান্য এক গ্রন্থ লিখেছেন খ্যাতনামা সাংবাদিক প্রতাপকুমার রায় পদ্মপত্রে জলবিন্দু শিরোনামে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। এই গ্রন্থে আমরা যেমন পাই এক আলোকচ্ছটা, তেমনি আছে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সংবাদপত্রে অবাঙালি পুঁজি-ব্যবসায়ীদের আধিপত্য এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কথা। এ নিয়ে হামদি দ্বিতীয় প্রেস কমিশনে যে-জবানবন্দি দেন তা জাজ্বল্যমান হয়ে উঠছে উপমহাদেশের সংবাদপত্র-পরিচালনায়। সাংবাদিক হামদি বে বলেছিলেন, ভারতে সাংবাদিকতা বিজ্ঞাপনদাতাদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞাপনের ছায়া যেন সম্পাদকীয় পাতায় না পড়ে। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রের নীতিনির্ধারণে এই বিজ্ঞাপনদাতা-গোষ্ঠীরই এখন প্রাধান্য এবং ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ শঙ্খ ঘোষের এই আলোকপাত আমাদের বিমূঢ় ও বিষণ্ণ করে তুললেও প্রভাতী সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনেই মুখ ঢেকে দেয়।

ষাট বছর আগে তিরিশের দশকের অসামান্য এক মানুষ ও আধুনিক সাহিত্যের রুচি নির্মাণের অগ্রণী এক ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু সাংবাদিকতা ও সাহিত্য বিষয়ক এক প্রবন্ধে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের দৌরাত্ম্য নিয়ে যে-কথা বলেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, প্রতিপত্তিতে বিজ্ঞাপন আজ সংবাদ ও সম্পাদকীয় স্তম্ভের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।

এই নিয়ন্ত্রণ এখন কি বৃদ্ধি পেয়েছে, না কমেছে? মিডিয়ায় করপোরেট সংস্কৃতির প্রবল উপস্থিতি সংবাদপত্রের বিকাশ ও মিডিয়ার স্বাধীনতার পথকে কি রুদ্ধ করছে? তর্ক করে এ-প্রসঙ্গে অনেক কথাই আজ বলা যায়।

হামদির এই দূরদৃষ্টি এবং সংবাদপত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মালিক-সম্পাদকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি কতই না সুদূরপ্রসারী ছিল। কালের প্রবাহে তা সত্য হয়ে উঠল।

উর্দুভাষী এই মানুষটির জন্ম হয়েছিল ১৯১৫ সালে বিহারের ছাপড়ায়। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন পাটনা কলেজে। সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয় রয়টারে। দেশ বিভাজনের পর অভিভাবকরা চলে গেলেন পাকিস্তানে। তিনি থেকে গেলেন ভারতে। তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করেছিলেন কোনো সৃজনশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, ঔদার্যগুণসম্পন্ন মানুষের জন্য পাকিস্তান আদর্শ রাষ্ট্র নয়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতা কোনো উদারনৈতিক ভাবের জন্ম দেবে না। তিনি চল্লিশের দশকে সেই বিহার থেকে এই মনোভঙ্গি ধারণ করে যে শিকড়হীন হলেন তার জন্য কোনোদিন অনুতাপ করেননি। কলকাতা তাঁকে যে নির্ভরতা, প্রশান্তি ও বন্ধুবৃত্ত দিয়েছিল, তা হয়ে উঠেছিল তাঁর বেঁচে থাকার জন্য পরম সহায়।

মানবেন্দ্রনাথের যুক্তিবাদ হামদির ওপর প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল। মানবেন্দ্রের রাজনৈতিক বোধ, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ নিরীক্ষণ ও সাংস্কৃতিক রুচি তাঁর সময়কালের বহু সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীর মধ্যে বিলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর পত্রিকা মাক্সসিয়ান ওয়ে এবং রাজনৈতিক দৃষ্টি, তাঁর যুক্তি ও বিজ্ঞানচেতনায় অনেকেই আলোড়িত হয়েছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা শিবনারায়ণ রায়ের মতো প্রাজ্ঞজনও সমগ্র জীবন মানবেন্দ্রনাথ ও এলেন রায়ের বন্ধুতা এবং রাজনৈতিক দর্শনে আস্থাশীল ছিলেন। হামদি পরিণত বয়সে মানবেন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ হামদির রুচি, সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনকে করে তুলেছিলেন ভবঘুরে থেকে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলায় পূর্ণ ও নানা জিজ্ঞাসায় আলোড়িত এবং সত্যসন্ধানী যুক্তিনিষ্ঠ এক সাংবাদিকে।

হামদি বে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কৈশোর-উত্তীর্ণ সময়ে। তাঁর সাংবাদিকতার মনোভঙ্গি যে বৈচিত্র্যসন্ধানী এবং কত চ্যালেঞ্জিং ছিল, সম্প্রতি সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রকাশিত তাঁর দুশো ঊনচল্লিশ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ বে অফ বেঙ্গল হাতে নিয়ে সে-সম্পর্কে নানা কথা মনে পড়ল।

আপিসের কাজে ভারতবর্ষের নানা স্থান ভ্রমণ করেছেন তিনি। এই ভ্রমণ যদিও শুধু ভ্রমণ ছিল না। রয়টার্সের প্রতিনিধি হয়ে তিনি মাউন্ট এভারেস্টের ওপর বিমান চালনায় ‘স্কুইপ’ নিউজ করেছেন। আলোচ্য বইটিতে তাঁর পঁয়ষট্টি রচনা স্থান পেয়েছে। এসব রচনার বিষয় খুবই বিচিত্র। এখানে তাঁর অভিজ্ঞতার এমন এক সমৃদ্ধ ভুবনের সাক্ষাৎ পাই আমরা যে, যে-কোনো পাঠকও জ্ঞানে, বিষয়ের গভীরতায় ও প্রেমে হয়ে উঠবেন ঋদ্ধ। সাংবাদিক হওয়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের সঙ্গে নৈকট্যের ফলে কত না ‘স্কুইপ’ নিউজ করেছেন তিনি। সৃজনশীল সাংবাদিকতার ধর্ম হচ্ছে কী কেন ও কোথায় এবং অনুসন্ধান আর অনুসন্ধানী হয়ে ওঠা। হামদি বে এই অনুসন্ধানে, তথ্যতৃষ্ণায় ও সত্য-সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। অনুজদের এ বিষয়ে দীক্ষা দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রের কাজ যে অন্য যে-কোনো পেশা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং চ্যালেঞ্জিং, এ তিনি সঞ্চারিত করেছেন উত্তরকালের সাংবাদিকদের মধ্যে।

তিনি ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করতেন। যদিও কলকাতা ও বাংলাভাষার প্রতি তাঁর প্রীতি খুবই আগ্রহসঞ্চারী হয়ে উঠেছিল এবং তাঁর মনন ও জীবনের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও কলকাতা অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গিয়েছিল। গ্রন্থভুক্ত ইংরেজি প্রবন্ধগুচ্ছ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মীনাক্ষী দত্ত। মীনাক্ষী দত্তের পরিচয় সুবিদিত, বুদ্ধদেব বসুর কন্যা এবং সাহিত্যের এক অনুরাগী মানুষ। অনুবাদকর্মেও যে তিনি যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত – এও প্রমাণিত হয়েছে বহু আগেই। ডাক্তার জিভাগোর কবিতাগুচ্ছ অনুবাদে তিনি আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সাহিত্য-পরিমন্ডলে হয়ে ওঠেন শ্রদ্ধেয় ও আলোচিত। মীনাক্ষীর এ আলোচ্য গ্রন্থের অনুবাদ শুধু স্বচ্ছন্দ নয়, তা পাঠ করতে করতে কোনো সময়ই মনে হয়নি গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় লেখা। কোথাও কোনো আড়ষ্টতা নেই। অনুবাদের গুণে প্রতিটি রচনা হয়ে ওঠে প্রসাদগুণসম্পন্ন। একবার শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, বাংলাদেশের চবিবশটি টিভি চ্যানেলে ও প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্রে কর্মরত যে অসংখ্য তরুণ সাংবাদিক পেশার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কাজ করছেন, তাঁদের জন্য এ-গ্রন্থটি অবশ্যপাঠ্য এবং নানা কারণে মূল্যবান হবে। সাংবাদিকতায় যে দায়বোধের লক্ষণ আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের বেশ কিছু নারী সাংবাদিকের মধ্যে, -গ্রন্থপাঠে তাঁরা লাভবান হবে এবং এই পেশাগত বোধ ও অঙ্গীকার নবীন আলোকে উন্মোচিত হবে – এ-ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই।

বইটির আরেক সম্পদ মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তের অসামান্য দুটি ভূমিকা। সখ্যের ও পরস্পরনির্ভরতার বৃত্ত ছাপিয়েও পাঠক পেয়ে যান হামদি বে-র ব্যক্তিস্বরূপ, সাংবাদিকতায় নিষ্ঠা, কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বিচরণ, পরিযায়ী পাখি, সুন্দরবনে বিপদসংকুল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, বৃক্ষ, তাঁর মানবিক গুণাবলি, সাহিত্য-রুচি, বন্ধুত্বের গভীর বিশ্বাস ও আস্থা। যতবার এ দুটি ভূমিকা পাঠ করি, আমরা বৃহত্তর এক ভুবনে প্রবেশ করি। সম্পূর্ণ ভিন্নভাষী ও ভিন্নধর্মী মানুষের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুতার দিগন্ত যে কত অতলস্পর্শী ছিল এবং হামদির জীবনকে অন্তিম মুহূর্তেও নির্ভরতা ও বন্ধুত্ব কত প্রাণসঞ্চারী করে তুলেছিল এই দুটি ভূমিকা পাঠ করলে তা উপলব্ধি করা যায়। একই সঙ্গে আমার কাছে জ্যোতির্ময় ও মীনাক্ষীর হৃদয়বত্তা ও ঔদার্য নতুন জ্ঞানে উন্মোচিত হয়। মনে দূঢ়মূল প্রত্যয় জন্মে, মানবিক সম্পর্কের ভিত্তি তো এমনই হওয়ার কথা।

হামদি বে-র মৃত্যুর পরে তাঁর দুই বন্ধু তাঁর অর্জন ও তাঁর প্রিয় কসমোপলিটান শহর কলকাতায় তাঁর পদচারণা নিয়ে দুটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। দুটি রচনাই হীরের দ্যুতি নিয়ে  ঝলমল করে উঠেছিল। এই দুটি নিবন্ধ ছিল মনোগ্রাহী শ্রদ্ধাজ্ঞাপক রচনা। কলকাতার আনন্দবাজার আর আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এই দুটি রচনা হামদি বে সম্পর্কে আমার হৃদয়ে অমোচনীয় হয়ে আছে।

সংবাদ-সংগ্রহের জন্য হামদি বে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গেছেন। যত না তাগিদ ছিল আপিসের, তার অধিক অন্তঃপ্রেরণা তিনি পেয়েছেন সংবাদ-সংগ্রহ ও হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত সাংবাদিকতার অনুসন্ধানী বোধ ও জিজ্ঞাসা থেকে। নতুন কিছু করার জন্য কত বিচিত্র ধরনের কাজ করেছেন তিনি। খবর সংগ্রহের জন্য আসাম, সুন্দরবন, মনিপুরসহ ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গেছেন। এই ছুটে যাওয়া এবং নিরন্তর পরিশ্রম করা বিফলে যায়নি। এতে তাঁর অভিজ্ঞতার দিগন্ত যেমন বিস্তৃত হয়েছে, তেমনি তার পাঠানো প্রতিবেদনে পাঠকও লাভবান হয়েছেন। গ্রন্থে কত না রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কত না ভিন্ন ভুবনের মানুষজনের কথা আছে।

তিরিশের কবি বিষ্ণু দে বলেছেন, সংবাদ মূলত কাব্য। কত ব্যঞ্জনাময় ও গভীরতাসঞ্চারী এই উক্তি। হামদি বে-লিখিত এই বইটির নিবন্ধগুচ্ছে এই অনুষঙ্গের প্রসারিত এক চেতনা দেখতে পাই।

তাঁর কর্মপ্রবাহ, নিরন্তর পরিশ্রম ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তিনি শুধু শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেননি, তাঁর কাছ থেকে এ-সম্পর্কিত জ্ঞান ও শিক্ষা গ্রহণ করে এবং আলোকিত হয়ে অনেকেই সংবাদপত্রের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

আপিসে খবর পাঠিয়েছেন তিনি শত প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে। তাতে রাজনৈতিক বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নানা ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ। হামদি বে যে কত বড়মাপের সাংবাদিক ছিলেন এই রচনাসমূহ ভিন্ন মাত্রা নিয়ে তা উন্মোচিত করেছে। হামদি বে-র খ্যাতি ও সাংবাদিকতায় দক্ষতা তাঁর জীবৎকালেই ভারতবর্ষের সাংবাদিকতার ভুবনে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছিল।

গ্রন্থে জ্যোতির্ময়ের ভূমিকাটি শুধু অসামান্য নয়, খুবই হৃদয়গ্রাহী। এই সেই জ্যোতির্ময় – তর্কপ্রবণ, নাগরিক অধিকারপ্রতিষ্ঠায় অগ্রসৈনিক এবং যাঁর পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি, বহু বিষয়ে তাঁর আগ্রহ কলকাতার বুদ্ধিবাদী মহলে তাঁকে বিশেষ  এক আসন দিয়েছিল। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী হলেও কলকাতার সৃজনশীল ভুবনে এখনো তাঁর কিংবদন্তিতুল্য উপস্থিতি। বহু সান্ধ্য-আড্ডায় জ্যোতি-প্রসঙ্গ প্রাণবন্ত করে অনেক বন্ধু ও সখাকে। কে যেন বলেছিল, জ্যোতি নেই; কলকাতার আলো নিভে গেল। হামদি বে-র নৈঃসঙ্গ্যে জ্যোতির্ময়-মীনাক্ষীর সখ্য এবং পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান এক অভিনব মাত্রা সঞ্চার করেছিল। এমন বন্ধুতা এবং নির্ভরতা সহসা চোখে পড়ে না। এই সখ্যের সূত্রেই হামদি দীর্ঘদিন বসবাস করেছেন মীনাক্ষী-জ্যোতির্ময় দত্তের প্রযত্নে, তাঁদেরই বাসভবনে। হামদির মৃত্যু হলে তাঁর ইচ্ছানুসারে মীনাক্ষীই শ্মশানে মুখাগ্নি করেছিলেন। মুসলিমদের দাহ হয় না, রীতিবিরুদ্ধ এ-কাজটি সম্ভব করেছিলেন জ্যোতি-মীনাক্ষীর সঙ্গে আজকাল পত্রিকার কর্মীবৃন্দ।

আসলে কলকাতা এমনই এক কসমোপলিটান শহর, যাকে ভালোবাসে তাকে সে আগলে রাখে, ত্যাগ করে না। বাউন্ডুলে, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, বহু ধর্ম, নিত্যদিনের জীবনসংগ্রাম, বোহেমিয়ান, নারীসঙ্গ, গড়ের  মাঠের উদার ঐশ্বর্য, নদীর ধারের প্রেমকুঞ্জ, পার্ক স্ট্রিটের ক্যাবারে নর্তকী, ক্লাইভ স্ট্রিটের চাঁদ, সুরাসক্তি আর দারিদ্র্যলাঞ্ছিত এই শহর থেকে যে মানুষ রস সঞ্চয় করতে জানে, সে এই শহরেরই অধিপতি হয়ে ওঠে, এখানেই তাঁর মন ও মনন প্রোথিত হয়ে যায়। এই শহরের বিচিত্রমুখী অনুষঙ্গে, বিশ্বনাগরিকতার স্বাদ গ্রহণ করে সে নানাভাবে। অন্যদিকে কলকাতার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, নাট্যাঙ্গন, কফি হাউস, বইপাড়া আর পাশ্চাত্যের শিক্ষায় শিক্ষিত বোধ যা দেয়, তা গ্রহণ-বর্জনে জীবন ও মনন বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে।

অবাঙালি হামদি বে-র জীবন ও মননকে এই বোধই সমৃদ্ধ করেছিল। যদিও একক ও নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রায়, স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার পর তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যাবতীয় সহায়-সম্পদ বিক্রি করে থিতু হয়েছিলেন কলকাতায়। সাংবাদিকতা যুবক বয়সে তাঁর ধমনিতে যেভাবে মিশে গিয়েছিল, তা আমৃত্যুই লালন করেছেন তিনি, হয়ে উঠেছিলেন সাংবাদিকতার শিক্ষক আর অন্যদিকে সংবাদপত্রের প্রাণময় এক ব্যক্তিত্ব।

এই বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী, – তিরিশের প্রভাবসঞ্চারী কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই পঙ্ক্তিটি হামদি বে-র জীবন পর্যালোচনা করলে খুবই সত্য ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আমার কাছে। এই একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গ্যকে তিনি কি ঘোচাতে পেরেছিলেন? জ্যোতির্ময়-মীনাক্ষীর সঙ্গ ও তাঁর বন্ধুবৃত্ত এবং পেশাগত দায় ও অঙ্গীকার বিরতিহীন পালনের পরও আধুনিক মানুষের বোধ ও একাকিত্বে বিচ্ছিন্নতা প্রসঙ্গে কথা থেকেই  যায়।

বইটি প্রকাশ করে সাহিত্য প্রকাশ অনেক বড় কাজ করেছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রসারে এ-ধরনের কাজ প্রণম্য হয়ে ওঠে।