হাসনাতভাইয়ের জন্য লেখা হলো পর

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘ঢাকা ক্লাবে’। সন্ধ্যাবেলায় সেখানে অনেক লেখক ও টিভি নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রী একত্রিত হয়েছেন। আবুল হাসনাতও ছিলেন। মানে আমাদের সবার প্রিয় হাসনাতভাই। এক ফাঁকে আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন, ‘কালি ও কলম নামে আমরা একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আবুল খায়ের লিটুর ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ থেকে পত্রিকাটি বেরোবে। আমাদের সঙ্গে আনিসুজ্জামান স্যারও আছেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রথম সংখ্যা থেকেই দুটো ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপবো। দুই বাংলার দুজন লেখকের। কলকাতা থেকে লিখবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর বাংলাদেশের আপনি। সুনীলদার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এখন আপনাকে বললাম। কাল থেকেই লিখতে বসে যাবেন।’

ঠিক বিশ বছর আগের কথা। ২০০৩ সাল। 

হাসনাতভাইয়ের কথা বলা, ভদ্রতা ও বিনয়ের কোনো তুলনা নেই। আমি বহুবার বহু জায়গায় বলেছি, হাসনাতভাই আমার দিকে চোখ তুলে না তাকালে ইমদাদুল হক মিলন নামে কোনো লেখকের জন্মই হতো না। আমাকে প্রথম ছায়া দিয়েছিলেন তিনি, তারপর রফিক আজাদ। এই দুজন মানুষ আমাকে কিছু বলেছেন, আর আমি তা শুনিনি এমন ইতিহাস নেই। অতি নম্র বিনীত ভঙ্গিতেই সেই সন্ধ্যায় উপন্যাস লেখার কথা বললেন হাসনাতভাই। কিন্তু আমার মনে হলো তিনি আমাকে আদেশ করছেন। তাঁর আদেশ মান্য করতেই হবে। তখন অন্যান্য লেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আমি সব সময়ই একসঙ্গে দু-তিনটি লেখা লিখি। হয়তো একটি উপন্যাস লিখছি, সেই ফাঁকে একটা গল্প লিখলাম। আবার হয়তো একটা ছোটদের লেখা লিখলাম। কিন্তু হাসনাতভাই বলেছেন! যেনতেন লেখা দিয়ে তাঁকে ভোলানো যাবে না। 

কী লিখব? হাসনাতভাই তো আছেনই, তার ওপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পাশাপাশি লিখতে হবে। উদ্ভ্রান্তের মতো
দু-তিনটা দিন কেটে গেল। কিছুই মাথায় আসে না। রাতে ঠিকঠাকমতো ঘুমাতেই পারি না। ভোরবেলা হাঁটতে গেছি রমনা পার্কে। এই একটা নিজস্ব সময় আমার। একা একা হাঁটতে হাঁটতে বহুদিন বহু গল্প-উপন্যাসের থিম পেয়ে গেছি। সেদিনও পেলাম। 

ছেলেবেলায়, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বিক্রমপুরের কাজিরপাগলা এ. টি. ইনস্টিটিউশনে পড়েছি। এ. টি. মানে অভয় তালুকদার। কাজিরপাগলা অভয় তালকুদার ইনস্টিটিউশন। ভদ্রলোক ওই এলাকার জমিদার ছিলেন। একশ বছর আগে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই পরিবারের মেয়ে দিপালী নাগ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের নামকরা শিল্পী। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে স্কুলটির শতবর্ষপূর্তি হলো। তিন দিনের বিশাল উৎসব। আয়োজকদের মধ্যে আমিও ছিলাম। স্কুলটির শতবর্ষ উপলক্ষে তালুকদার পরিবার ও স্কুলের পশ্চিমবঙ্গ প্রবাসী কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রাক্তন ছাত্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দিপালী নাগও এসেছিলেন তাঁর গানের দল নিয়ে। দেশভাগের পর এই মানুষগুলোর অনেকেই আর তখনকার পূর্ব পাকিস্তান আর তার পরের স্বাধীন বাংলাদেশে কখনো আসেননি। নিজের ফেলে যাওয়া দেশ, গ্রাম আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁদের যে কী আবেগ, লিখে বোঝানো মুশকিল। বেশ কয়েকদিন এই মানুষগুলোর সঙ্গে থেকে আমি অনুভব করেছিলাম নিজস্ব মাটির মায়া কোন পর্যায়ের হতে পারে মানুষের।

সেই মনোরম ভোরবেলায় রমনা পার্কের গাছপালার ফাঁকফোঁকর দিয়ে, হাওয়ায় ভাসা ফুলের গন্ধ নিতে নিতে হঠাৎই মনে হলো এই মানুষগুলোকে নিয়েই তো উপন্যাস লেখা যায়। একদার যে-মাটিতে তিনি জন্মেছেন, যে-আকাশের তলায় মাথা তুলেছেন, যে-নদীর হাওয়ায় শ্বাস নিয়েছেন, যে-ফুলের গন্ধ আর পাখির গান আর যে-গাছের ছায়ার মধ্যে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, চারপাশের যেসব মানুষের স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসায় রক্তে দোলা লেগেছে, ভালোবাসার চিরকালীন বন্ধনে যে-মানুষরা তাকে বেঁধে রেখেছিলেন, রাজনীতির পাকচক্র তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নিজস্ব মাটি ছেড়ে তাদেরকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে যেতে হয়েছে। এত এত বছর পর সেই মাটিতে তাঁরা ফিরে এসেছেন ঠিকই, আপন মানুষের কাছেই ফিরে এসেছেন, কিন্তু তারপরও এই মাটি, এই দেশ, প্রকৃতি, আকাশ, নদী ও মানুষগুলো প্রকৃত অর্থে তাঁদের পর হয়ে গেছে।

এই মানুষগুলোকে নিয়েই বিক্রমপুর ও দেশভাগের পটভূমিতে হাসনাতভাইয়ের জন্য লিখতে শুরু করলাম পর উপন্যাসটি। প্রথম সংখ্যা থেকেই অতিযত্নে কালি ও কলম এ-উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ছাপতে লাগলেন হাসনাতভাই। এই লেখা লিখতে গিয়ে কোনো কোনো মাসে কী যে ভুগিয়েছি হাসনাতভাইকে। একটা সময়ে কিস্তি দেওয়ার সময় হলে তিনি আর আমাকে ফোন করতেন না। ফোন করতেন আমার দীর্ঘদিনের সহকারী শাহীনকে। শাহীন আমাকে তাগিদ দিতো। তারপরও কোনো কোনো পর্বে এত ফাঁকিঝুঁকি দিয়েছি, এখন ভাবলে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হাসনাতভাই কখনো কিছু বলতেন না। একদিন আনিসুজ্জামান স্যারের স্ত্রী ফোন করে বলেছিলেন, ‘তোমার লেখাটা আমি নিয়মিত পড়ি। লেখায় আরেকটু যত্ন নিও।’ এ এক মায়ের মতো ভালবাসায় সন্তানকে মৃদু সচেতন করার চেষ্টা। আমার সৌভাগ্য এই জীবনে বহু মানুষের ভালোবাসা আমি পেয়েছি, তাঁরা আমার মাথার ওপর ছায়াবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন তাঁদের একজন, ভাবিও তাই। 

একদিন আনিসুজ্জামান স্যারের ফ্ল্যাটে গিয়েছি। কী যে যত্নে আর মমতায় ভাবি গাজরের হালুয়া খাওয়ালেন। সেই স্বাদ আমৃত্যু আমার জিভে লেগে থাকবে। স্যার চলে গেছেন, ভাবি আছেন। এখনো আমার কোনো কোনো লেখা পড়ে তিনি ফোন করেন। অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর কথা শুনি। ভাবির মতো মানুষরাই লেখক-শিল্পীদের এগিয়ে যাওয়ার পথটি দেখান। 

উপন্যাস শেষ হওয়ার পর হাসনাতভাই একদিন বললেন, ‘বই করার সময় উপন্যাসটি ভালোভাবে সম্পাদনা করবেন।’ প্রকৃত সম্পাদকের মতোই কথা। কারণ তিনি জানতেন লেখা চলাকালীন লেখাটির ত্রুটির কথা বললে সে লেখা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। এজন্য তখন বলেননি। আমি তাঁর কথা মাথায় রেখে বই করার সময় পর উপন্যাসের কয়েকটি অধ্যায় নতুন করে লিখেছি। বাংলাদেশ ও ভারত থেকে বইটির বেশ কয়েকটি সংস্করণ বেরিয়েছে। সেই বইয়ের দিকে তাকালেই হাসনাতভাইয়ের কথা মনে পড়ে। চলে গিয়েও তিনি আমার মাথার উপরে রয়ে গেছেন, হৃদয়ে রয়ে গেছেন। তাঁর যাওয়া তো নয় যাওয়া। 

কালি ও কলম পত্রিকার ২০ বছর পূর্তিতে অনেক অনেক শুভ কামনা। পত্রিকাটি দীর্ঘজীবী হোক।