দুই দশকের সাহিত্যযাত্রা

কালি ও কলমের দুই দশক পূর্ণ হলো। যে-কোনো সাহিত্য সাময়িকীর জন্যে এই দীর্ঘ সময়ের টানা প্রকাশনা নিঃসন্দেহে এক মাইলফলক। এখানে একটু স্মরণ করা যায় যে, কালি-কলম নামে একটি সাহিত্যপত্র ছিল অবিভক্ত বাংলায়, প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে, প্রকাশকাল ১৯২৬। শুরুতে সম্পাদক ছিলেন তিনজন – মুরালীধর বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। তবে শেষের দুই কথাসাহিত্যিক একে একে এটি ছেড়ে গেলে মুরালীধর বসু একাই পত্রিকাটি চার বছর চালিয়েছিলেন।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পরে কলকাতা থেকে দুটি বাংলা সাহিত্যপত্র ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় – সে দুটি হলো মওলানা আকরম খাঁ-সম্পাদিত মোহাম্মদী (১৯০৩) ও মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন-সম্পাদিত সওগাত (১৯২১)। তবে এ-দুটি পত্রিকা সাহিত্যের পাশাপাশি মুসলিম জাগরণের কাজও করেছে। তাই হয়তো দুটি পত্রিকায়ই নানা বিষয়ে সচিত্র ফিচারও প্রকাশিত হতো। তবে পরবর্তীকালে যখন মুসলিম সমাজেও প্রগতির হাওয়া লেগেছে তখন আকরম খাঁ এবং তাঁর পত্রিকা রক্ষণশীলতার পক্ষ নিয়ে যুগের দাবি পূরণে পিছিয়ে পড়েছিল।

আমাদের স্বাধীনতার পরে প্রকাশিত হয়েছিল গণসাহিত্য, ১৯৭২ সালে, সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং এটি প্রায় এক দশক টিকেছিল। স্বাধীনতার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস না কাটতেই পঁচাত্তরের ঘটনা এবং পট-পরিবর্তন হয়ে গেল। তখন প্রতিরোধের আবহে নিয়মিত বড় কাগজ চালিয়ে যাওয়া ছিল কঠিন; সেই প্রেক্ষাপটে জোয়ার এসেছিল প্রতিবাদী ছোট কাগজের। এই পরিবেশের মধ্যেই এসে গেছে মোবাইল ও স্মার্ট ফোনের যুগ। তার মধ্যেই বেঙ্গল উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করল মাসিক সাহিত্যপত্র কালি ও কলম – নতুন প্রযুক্তি বিপ্লবের, বিশ্বায়নের, মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলের মধ্যে।

এর আগে থেকেই সাহিত্যচর্চার আধার হয়ে উঠেছে দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতা। স্বাধীনতার পর থেকেই সাহিত্যপত্রিকার অস্তিত্ব-সংকট দেখা দিয়েছিল। এর মধ্যেই গণসাহিত্যের পাশাপাশি অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সুন্দরম দীর্ঘদিন চলেছে, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী-সম্পাদিত দীপঙ্কর স্বল্পায়ু হলেও সাহিত্যসেবী পাঠকের সমাদর পেয়েছিল। তার আগেই বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচর্চার প্রথমদিককার এবং দীর্ঘকালের বড় নির্ভর সওগাত ও মোহাম্মদীর প্রকাশ বন্ধ হয়েছিল।

এক সময়ে দৈনিকের সাহিত্যপাতার বাইরে সাহিত্যের বড় আশ্রয় হয়ে উঠেছিল ছোট পত্রিকা। দুই-তিন দশক আগের মতো সংখ্যায় অত বেশি না হলেও ছোট কাগজ এখনো বেরুচ্ছে, কোনো-কোনোটির আকার পৃষ্ঠাসংখ্যায় বিস্ময়করভাবে বড়। তবে ইদানীং সামাজিক মাধ্যম সাহিত্যের বাহন হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয়। সামাজিক মাধ্যমের আগ্রাসী বিকাশ বড়-ছোট সব কাগজের পথের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ব্যবহার ও আসক্তি নবীন প্রজন্মকে ছাপিয়ে প্রায় সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে সৃজনশীল সাহিত্যপত্রিকার চেয়ে বরং প্রবন্ধ, কলাম বা ফিচার সংবলিত নানা বিষয়ভিত্তিক পত্রিকার প্রকাশনা বেড়েছে। প্রবন্ধের বিষয়ও সাহিত্যের চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

দুই

বাঙালি বহুকাল কেবল সাহিত্যেই বুঁদ হয়ে ছিল। উনিশ শতকে সাহিত্যের বাইরে বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চা হয়েছে, কখনো কখনো তা অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব বা সমাজতত্ত্বের আঙিনায় বিচরণ করেছে। কিন্তু সংখ্যায় বা পরিসরে তা বেশি নয়। বাঙালি পাঠক গল্প-উপন্যাসে আসক্ত ছিল। সেকালে পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাস একটি আবশ্যিক উপচার ছিল। শিক্ষিত পরিবারে সাহিত্যপত্রিকার গ্রাহক হওয়ার রেওয়াজ ছিল। তাদের কাছে পত্রিকা পৌঁছাত ডাকযোগে। বাড়ির মেয়েদের পত্রিকার গল্প-উপন্যাসের স্বাদ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যেত। সেকালে নারীরা লিখতে পেরেছেন সামান্য, কিন্তু তাঁরা পড়েছেন ঢের। সেই মন্থর নাগরিক বা মফস্বলের কিংবা গ্রামীণ জীবনে অবসর ছিল প্রচুর – হয়তো গার্হস্থ্য কর্মের চাপের কারণে পুরুষের চেয়ে নারীর জীবনে অবকাশ ছিল কম। তবুও নানা লেখায় উঠে আসে দিনের প্রথমার্ধের কাজ শেষে অলস দুপুরে দিবানিদ্রা এড়িয়ে কোনো কোনো গিন্নির উপন্যাস পড়ার স্মৃতিচারণ। আমার মা এবং তাঁর বয়েসি অনেক মহিলাকেই দেখেছি যাঁরা নিয়মিতই উপন্যাস পড়তেন। বঙ্কিম-শরৎচন্দ্র ছিলেন তাঁদের প্রিয়, পরের বিভূতি-তারাশঙ্করকেও তাঁরা ভালোবেসেছেন, আরও পরের সমরেশ-সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ (মজুমদার) পড়তেও দেখা গেছে। তুলনায় সেই প্রজন্ম বাংলাদেশের কথাসাহিত্য পড়েছেন কম।

অবশ্য আমরা কথা বলছি সাহিত্যপত্রিকা নিয়ে। স্বাধীনতার পরে কবি-সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের মৃত্যুর পরে সমকাল বন্ধ হয়ে যায়। নতুন রূপে প্রকাশের চেষ্টা সংগত কারণেই সফল হয়নি। আসলে সমকাল ছিল সিকান্দার আবু জাফরেরই জেদ ও খেয়ালের ফসল। এই ধরনের মানুষের শূন্যতা পূরণযোগ্য নয়। আর তরুণদের সাহিত্যপত্র কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিজেই একসময় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারও সংগত কারণ ছিল। যে সাহিত্যিক লক্ষ্য ও উৎসাহ নিয়ে পথ চলছিলেন তার পরিবর্তন ও তাতে ভাটার টান দেখা দিলে তিনি জবরদস্তি কিছু করতে চাননি। বামপন্থীদের কাগজ পূর্বোল্লিখিত গণসাহিত্যও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারও সংগত কারণ হতে পারে বামপন্থার ক্রমাগত শক্তিক্ষয় এবং অন্দরে শক্তিমান লেখকের অভাব।

তিন

সাহিত্যভিত্তিক নিয়মিত পত্রিকা এখন একমাত্র কালি ও কলম, বাকি সবই ছোট কাগজের মধ্যেই পড়ে। আমাদের অভিজ্ঞতায় সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ হলো কষ্টসাধ্য এক কাজ। লেখা সংগ্রহ যেমন দুরূহ তেমনি কঠিন হলো বিজ্ঞাপন সংগ্রহ বা আর্থিক দায় মেটানো। প্রেসের দায় মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়মিত প্রকাশনা বন্ধ হয়ে পত্রিকা অনিয়মিত হয়ে পড়লে একসময় কাগজ বন্ধ হয়ে গেছে। এ-ই হলো সাহিত্যপত্রিকার জীবনচক্র – উৎসাহ-সংগ্রাম-অনটন-ইস্তফা। তার মধ্যে যখন পড়ি যে, দেশভাগের আগে বড় বড় লেখকরা সাহিত্যপত্রিকায় চাকরি করতেন জীবিকার প্রয়োজনে, তখন বেশ অবাক হই। বাবার আত্মজীবনী রেখাচিত্রে পড়েছি যে, কলকাতায় তিনি সওগাত পত্রিকায় চাকরি পেয়েছিলেন লেখেক প্রেমেন্দ্র মিত্র দীর্ঘ ছুটিতে থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিকালের জন্যে। এ প্রসঙ্গে মোদ্দা কথা হলো, একটি সাহিত্যপত্রিকা কীভাবে সম্পাদক, তাঁর সহকারী, প্রুফ রিডারসহ অন্যদের বেতন চালিয়ে গেছে তা আমার জন্যে এক বিস্ময়ের ব্যাপার।

সেকালে ছোট-বড় জমিদারদের অনেকেই ছিলেন সাহিত্যামোদী, দেশীয় রাজন্যদের মধ্যেও সাহিত্য-শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতার মনোভাব ছিল, তাঁদের কেউ কেউ নিজেরাও সাহিত্যচর্চা করেছেন, শিল্পের নানা শাখায় দক্ষও  ছিলেন অনেকে। জমিদার বা জমিকেন্দ্রিক অভিজাতদের যুগের অবসান হলে নতুন বিকাশমান শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থার ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। প্রথম পর্বে তাঁদের মধ্যেও জমিদারদের মতোই সাহিত্য ও সাহিত্যবিষয়ক এবং কলাচর্চা ও কলা-প্রীতি লক্ষ্য করা যায়। ক্রমে এ-ধরনের পৃষ্ঠপোষকেরা বিলীন না হলেও বিলীয়মান হয়েছেন। স্বাধীন দেশে বুদ্ধিমান উদ্যোগী মানুষের জন্যে উচ্চাভিলাষ পূরণের যেসব বৈধ এবং বহুতর অবৈধ এবং পড়ে-পাওয়া-সুযোগ হাজির হয়েছিল তাতে বড়লোকের আভিজাত্যের লালন সম্ভব ছিল না, সাহিত্য-শিল্পের চর্চায় এতে পৃষ্ঠপোষকের ধারাবাহিকতার অভাবে পড়ে। এই অরাজক অব্যবস্থার  ছাপ পড়ে সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে।

এই রকম দুঃসময়ে উদ্যোক্তা ও কলারসিক আবুল খায়ের লিটু যে মাসিক সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটি যে সাহসী বা দুঃসাহসী পদক্ষেপ তাতে সন্দেহ নেই। সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক পদে ও অন্যান্য দায়িত্বে সম্মানজনক বেতন এবং লেখকদের সম্মানী দিয়ে কুড়ি বছর পার করা কোন কলারসিক কবে পেরেছেন তা আমার জানা নেই। তাঁকে অভিবাদন ও অভিনন্দন জানাতে হয়। কেননা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় বিনিয়োগ ও ব্যয়ের অংক বোঝা-বোঝানো মুশকিল, কেবল অন্তর দিয়েই বুঝে নিতে হয়। তবে তিনি তো কলারসিক হিসেবে বরাবরই সাহস-দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন, দিচ্ছেন। উল্লেখ করা দরকার তাঁরই আগ্রহে বেঙ্গল থেকে চারুকলা বিষয়ে মূল্যবান সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে, শিশুদের জন্যেও চমৎকার ম্যাগাজিন বেরিয়েছিল। কালি ও কলমের ক্ষেত্রে হয়তো প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে পাওয়ায় তাঁর অনেকটা সুবিধা হয়েছিল। সঙ্গে সংবাদের সাপ্তাহিক সাহিত্যসাময়িকী-খ্যাত এবং গণসাহিত্যের মতো পত্রিকার অভিজ্ঞ সম্পাদক আবুল হাসনাতকে নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে পেয়ে কাজটা সহজ হয়েছে। প্রধান সম্পাদকের পরামর্শে আরো কয়েকজন অভিজ্ঞ মানুষও তিনি কালি ও কলমের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারপর থেকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় পত্রিকাটি মাসিক হিসেবে নিয়মিতই প্রকাশিত হচ্ছে।

চার

শুরুর দিকে আমার মনে এ-পত্রিকার সাফল্য নিয়ে সংশয় ছিল। আনিস স্যারের কাজের এবং খ্যাতির ক্ষেত্র মূলত অধ্যাপনায়, গবেষণায় এবং প্রবন্ধ রচনায়। হাসনাতভাইয়ের এ-কাজে অভিজ্ঞতা থাকলেও দেশের একটি প্রধান সাহিত্যপত্রিকা দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সংশয় ছিল মনে। কারণ সেই বঙ্গদর্শন-সাধনা-ভারতবর্ষ থেকে কল্লোল-পরিচয়-কবিতা এবং সমকাল-পূর্বমেঘ-কণ্ঠস্বর-এর মতো বিশুদ্ধ সাহিত্যপত্রিকা মূলত সৃজনশীল লেখক-সাহিত্যিকদের তত্ত্বাবধানে-সম্পাদনায় সফল হয়েছিল। পত্রিকা ঘিরে লেখক-কবি-সাহিত্যিক-চিন্তাবিদদের আড্ডার কথাও আমরা জানি। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কল্লোল যুগ, সাগরময় ঘোষের সম্পাদকের বৈঠকে বা শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের পরিচয়ের আড্ডা পাঠের আনন্দময় স্মৃতি ভোলার নয়। সাধারণত এ-ধরনের আড্ডার মধ্যমণি হন সম্পাদক স্বয়ং। কিন্তু কালি ও কলমের প্রধান সম্পাদক এবং সম্পাদক আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন নিজেদের গণ্ডিতে, বারোয়ারি বা মুক্ত আড্ডায় তেমন অভ্যস্ত নন বলেই জানি। তাঁরা দুজনেই  আড্ডাবাজ-সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন না – তার ওপর (সম্প্রতি দপ্তর স্থানান্তরিত হওয়ার আগে) অনেককালই পত্রিকার অফিস ছিল লেখকদের স্বাভাবিক চলাচলের আওতার বাইরে। না কালি ও কলম দপ্তরে এখনো সাহিত্যিক আড্ডা হয় বলে আমি শুনিনি। তবে সেই অভাব মিটিয়ে পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে সেটাই বড় কথা।

কালি ও কলম প্রথম থেকেই এক ব্যতিক্রমী কাজ করেছে। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে যুগপৎ ঢাকা ও কলকাতা থেকে। সেখানেও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো বর্ষীয়ান কবি এর সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তবে ততদিনে তাঁর বয়স হয়েছিল এবং দীর্ঘদিন আনন্দবাজার গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে নিছক সাহিত্যপত্রিকার যে কালচার দেড়শ বছরে বাংলায় গড়ে উঠেছিল, তা নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়তো তাঁর পক্ষেও সম্ভব ছিল না।

পাঁচ

তবে আসল কথা হলো সাহিত্যের জগতে অর্থাৎ বাংলাদেশের এবং বাংলা সাহিত্যে কালি ও কলম কতটা যোগ করতে পারছে, একে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, কালি ও কলম এদেশের নিয়মিত সাহিত্যপত্রিকার অভাব মোচন করেছে। হয়তো একদিন গবেষকরা সন্ধান করে দেখবেন সাহিত্যপত্রিকা যে জীবনরসের, জীবননাট্যের, জীবনবৈচিত্র্যের সন্ধান দেয় তার জোগান কালি ও কলম কতটা দিতে পেরেছে। ততদিন আমরা অপেক্ষা করব।

অধুনা বাংলাদেশে সামাজিক জীবনেই রসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সমাজে যেমন খোলা মনের অট্টহাসি শোনা যায় কম, তেমনি সমঝদার ও রসিকজনের বুদ্ধিদীপ্ত হাসির দেখাও কদাচিৎ মেলে। আবার যতটুকু সৃষ্টি হয় তার আলোচনা কিংবা সমালোচনারও অভাব ব্যাপক। বলা যায়, বাংলাদেশে কি সাহিত্য কি শিল্পকলার নানা শাখায় প্রকৃত সমালোচনাসাহিত্যের ধারা গড়ে ওঠেনি। সাধারণত বই, চিত্রপ্রদর্শনী, চলচ্চিত্র, সংগীতানুষ্ঠানের পরিচিতিমূলক আলোচনা দেখা যায়। এর মধ্যে বরং নাটকের সিরিয়াস আলোচনা কিছু হলেও পাওয়া যায় এবং তা বেশি প্রকাশিত হচ্ছে কালি ও কলমে। সমাজে রুচিবোধের যেমন তেমনি রসবোধেরও ঘাটতি চলছে। একমাত্র সাহিত্য, প্রকৃত সৃজনশীল সাহিত্যই পারে তার চাহিদা তৈরি ও চর্চার প্রস্তুতি গড়ে দিতে। আর তা ঘটলে তখন নানাদিক থেকে রসের ভিয়েনে উপযুক্ত জোগান আসবে। এ-কথাও বলতে চাই, সামগ্রিকভাবে মানুষের বেদনশীলতার ঘাটতি চলছে, যথার্থ দুঃখবোধের অনটন চলছে। বাঙালি-প্রাণ যেমন অনাবিল হাসির প্রেরণা পায় না, তেমনি তার প্রাণ তেমন করে আর কেঁদেও ওঠে না। এসবই জীবনবোধ ও জীবনরসের অভাবেরই চিত্র। মানুষ জীবন যাপন করছে, ভোগ করছে, কিন্তু জীবনকে উপভোগ ও উদ্যাপন করতে শিখছে না। এমনটা যে ঘটছে তার মূল কারণ সাহিত্যপাঠের অভাব এবং সমকালে তেমন সাহিত্যের সরবরাহে ঘাটতি। সাহিত্যই জীবনবোধের ভূমি তৈরি করে দেয়, তাতে পুষ্ট মনে নানা কলার রসাস্বাদনের আগ্রহ প্রাণিত হয়ে ওঠে সহজে। যখন তরুণ-পাঠক সাহিত্যের ধ্রুপদী ভাণ্ডারের সন্ধান পাবে, তাতে মনটাও পাকাবে-রাঙাবে তখনই তার মন প্রস্তুত হবে, উদ্গ্রীব হয়ে উঠবে সমকালীন সাহিত্যের উষ্ণ অন্তরঙ্গ গভীর ব্যাপ্ত নানান স্বাদ গ্রহণে।

সহজে বলা যায় কালি ও কলম-এর পক্ষে একা এ অভাব মোচনের কাজে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়, পারা সত্যিই কঠিন। তবে সেই সঙ্গে এ-কথাও বলব, কালি ও কলমকেও সাহিত্যের রসের সন্ধানে এবং রসিক স্রষ্টাদের সন্ধানে অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

শেষে বলব, দেশে সাহিত্য পাঠের এবং সাহিত্য সৃষ্টির জোয়ার দরকার। দরকার আরো আরো সাহিত্যপত্রিকা, সাহিত্যের আড্ডা, পাঠচক্র এবং পরিশীলিত মেধাবী সমালোচনা সাহিত্য। এসব উদ্যোগকে কেবল আপন বৃত্তে আবদ্ধ বা বুঁদ হয়ে থাকলে চলবে না, চাই আন্তর্জাতিক বৈশ্বিক যোগাযোগ। জ্ঞান সবসময়ই বিশ্বজনীন, যদিও সাহিত্য ও কলাসমূহের থাকবে আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শিকড়। কিন্তু তার বিকাশ ও বিস্তার ঘটাতে হবে বৈশ্বিক চিত্রপটকে জেনে, আত্মস্থ ও ধারণ করে। ফলে পত্রিকা হোক, আড্ডা  হোক তা যেন আঞ্চলিক বা মফস্বলি বৃত্তে বাঁধা না পড়ে; আলোচনার, ভাবনার, প্রকাশের গভীরতা, উচ্চতা ও ব্যাপ্তি যেন বিশ্বমানকে ছুঁতে পারে তার ভিত্তি, প্রস্তুতি ও চর্চা চাই। কালি ও কলম যেন তারুণ্যকে, উদীয়মানদের সেই জমিনটি দিতে পারে – এটাই কামনা।