দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় : কেবলমাত্র গানে গানে

দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমার প্রথম দেখা আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির ছাত্রী হয়ে তাঁর আসা। খুলনা থেকে। দৌলতপুরে বি.এল কলেজের ছাপ নিয়ে। তখন শিক্ষা ও সংস্কৃতির আবহ ছিল খুলনায় প্রাণবন্ত। মহেশ্বরপাশায় সুবোধ মজুমদার স্বয়ং একটা ইনস্টিটিউশন। অঙ্কশাস্ত্রের সর্বজনমান্য অধ্যাপক, কিন্তু আরো গভীরভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে প্রাণবান সমন্বয়ের ধারক। সেখানে কেন্দ্রভূমিতে রবীন্দ্রনাথ। উদার আভিজাত্যে ধারণ করে প্রবহমান ঐশ্বর্যে মুক্তির অনর্গল বার্তা। তবে স্বেচ্ছাচারী নয়। সৌজন্যে সমদর্শিতায় পরিপূর্ণ মানবিক-যাত্রাপথে আনন্দগানের অনুসারী। শহরে সাংস্কৃতির ও প্রগতিশীল ভাবনার সংগঠন হয়ে দেখা দিয়েছিল ‘সন্দীপন।’ সাধন ঘোষ, নাজিম মাহমুদ, হাসান আজিজুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, এঁরা ছিলেন তার প্রাণপুরুষ। এমন আবহে এঁদের সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠেছেন দীপা। যদ্দূর জানি, কোথাও বাঁধা পড়ে নয়, আপন মুক্তির আলোয় আলোয়। পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষা-মূল্যবোধও সহায় হয়েছিল।

যখন তিনি এলেন, তখন-তখনই এসব জানিনি। তিনিও বোধহয় ছিলেন অন্তর্মুখী। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য নিয়ে পড়া – দূরত্ব আপনা থেকেই একটা তৈরি হয়। আবোল-তাবোল কথা বলে আধা-মফস্বলী উজবুক সাজার ভয় একটা কাজ করে। বাধাটা আপনিই সরে গেল একদিন। তাঁর বা আমার কোনো একক ইচ্ছায় নয়। তাঁরই গানের প্রতিভার অনর্গল ধারায়।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যায় বিশেষ সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল অনেক প্রত্যাশার একটা অনুষ্ঠান। অস্থায়ী মঞ্চ গড়ে খোলা মাঠে চেয়ার পেতে প্রয়োজন হলে মাথার ওপর ত্রিপল টানিয়ে সারা হতো আসরের ব্যবস্থা। নাচ-গানের প্রতিভা আছে এমন ছেলেমেয়েদের জড়ো করে, অথবা, তারা নিজেরাই জড়ো হয়ে, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তাঁর তত্ত্বাবধানে একটা পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনা ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ডক্টর সুব্রত মজুমদার তখন বিলেত থেকে ফিরে এসেছেন। শিল্পীদের গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন তিনিই। সেই তখন থেকে তিনি থাকতে এমন সার্বিক পরিচালনায় আর কারো কথা কখনো ভাবা যেত না। তা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যে কোনো সংগীতানুষ্ঠানেই। খুলনার সঙ্গে যোগসূত্র আমাদের অজান্তেই একটা তৈরি হয়। অঙ্কশাস্ত্রে যেমন, তেমন সংগীতেও বাবা সুবোধ মজুমদারের স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরাধিকার বর্তায় সুব্রতর গানের প্রতিভায়। সাংস্কৃতিক মেজাজেও। দীপাকে তিনি আগে থেকে চিনতেন। আবার যোগাযোগ ঘটলো সরস্বতী পুজোয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগে।

সময়টা ১৯৬৯-৭০, কোনো এক মাঘমাসের। তখন আমাদের বাঙালি অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তুঙ্গে। আর তাতে রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি ‘ঠাকুরদা’র মতো তিনি নিজেই এক কল্প-বাস্তবের নায়ক। তাঁর গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আমরা আরো বেশি করে গানে-গানে তাঁকে আঁকড়ে ধরি। ওই গানের মুক্তি যেন বাঙালি সত্তারও মানবতায় পূর্ণ স্নান। বহু পুণ্যের ফল। এর হাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও ঝড় তোলে। ঠিক হয়, সরস্বতী পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবির শাপমোচন গীতিনাট্যের নিবেদন হবে প্রধান আকর্ষণ। সবটা সুব্রত সামলাবেন, এ ভরসা আছে। আর এখানেই ঘটে আমাদের সবার সামনে দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব। সুব্রত তাঁর গানের প্রতিভার পরিচয় আগেই পেয়েছেন। তাই পুরো আস্থা নিয়ে রানিকণ্ঠের সব গান গাওয়ালেন তাঁকে দিয়ে। আর তাতেই পেল অনুষ্ঠান পূর্ণপ্রাণের সফলতা। হয়তো সবাই জানেন, শাপমোচন রবীন্দ্রনাথের কোনো পূর্বপরিকল্পিত গীতিনাট্য ছিল না। তাঁর আগে লেখা প্রাসঙ্গিক বিবিধ গান প্রতিনিধিস্থানীয় বিভিন্ন গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে বসিয়ে একে পূর্ণাঙ্গ মহিমায় সাজানো হয়। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রজয়ন্তী ছাত্রছাত্রী উৎসব পরিষদ এর প্রথম মঞ্চায়ন করে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে। গানের আবেদন একে কালজয়ী করে। এখানেও তা সাড়া জাগায়। প্রধানত দীপার গাওয়া গানের কল্যাণে। তিনি তখন আর শুধুই ছাত্রী নন, অনেকের কল্পজগতে দেবী।

তাঁর গান শোনার সুযোগ পরে অবাধ হয় ডক্টর সুব্রত মজুমদারের কল্যাণে। পারিবারিক ঐতিহ্যে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাঁর বাসাতে তিনি চালু করেন নিত্যদিন অনির্ধারিত গানের আসর। গলায় সুর থাকলে যে কেউ সেখানে ভিড়তে পারতো অনায়াসে। দীপাও আসতেন কখনো-কখনো। আমার মতো তাল-কানারাও কেউ-কেউ ছুটত অবারিত দ্বার পেয়ে। ‘মর্ত কাছে স্বর্গ যা চায়’, তাও জুটত যখন সুব্রতর দুই দিদি, উমা মজুমদার ও মুক্তি মজুমদার – তাঁর মতো আমরাও বলতাম, রাঙাদি ও ছুটুদি, ভাইকে দেখতে আসতেন। তাঁদের গলায় ছিল সরস্বতীর নিত্যনিবাস। দীপারও। ওঁরা আমাদের তুরীয়ানন্দে মাতিয়ে বিভোর করে রাখতেন।

তবে দেশ তখন চলেছে ক্রান্তিকালের দিকে। জড়িয়ে পড়েছি আমরা সবাই। সত্তর সালে দীপার মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা অনির্দিষ্টকাল পিছিয়ে গেল। একাত্তরে মুক্তিসংগ্রাম। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে সবার ছিটকে পড়া। বাইরে গিয়েও লড়াই। দীপা ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। হার না মানার শপথ। সেই সঙ্গে বিপুল দুঃখবরণ। প্রত্যাশিত। অপ্রত্যাশিতও। এই সময়েই দীপা ভিড়ের ভেতরে মাকে হারিয়ে ফেলেন। আর ফিরে পাননি। তাঁর লেখা আমার একাত্তরে এর বিষাদ এখনো আচ্ছন্নতা ছড়ায়। অনিশ্চিত পথ তাঁদের জীবনের ছক বদলে দেয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে দীপার প্রথম চিন্তা, এলোমেলো সংসার গুছিয়ে তোলা। ভাই-বোনদের ভেতর তিনিই বড়। পরে তিন ভাই – ভার্গব, ভাস্বর ও শাশ্বত। সবাই ছাত্র। সম্ভাবনা যেন তাদের হারিয়ে না যায়। তাঁর প্রথম কাজ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে এম.এ. পরীক্ষার পাট চোকানো। এবং তারপরেই কর্মজীবনে থিতু হওয়া। নিশ্চয়ই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। ইংরেজিতে মাস্টার্স করে সরকারি কলেজে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলেন। বাড়তি সুবিধা, তাঁকে খুলনা ছেড়ে আর কোথাও যেতে হলো না। ওইখানেই তাঁর নিয়োগ। এক কলেজ থেকে আরেক কলেজে বদলি হয়েছেন। ওই এলাকাতেই। পেশাগত কর্মজীবনে ইতি টেনেছেন কলেজ অধ্যক্ষের পদে আসীন হয়ে। সাধারণ মাপে সফলই বলা যায়। এদিকে ভাইয়েরাও নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিল্পকলায় সবার টান। হয়তো পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেই। বাচিকশিল্পে ভাস্বর তো এখন দেশে অন্যতম সেরা। তিন ভাইয়েরই নিশ্চিন্ত সংসার। প্রতিভার পরম্পরা সচল তাদের সন্তানদের ভেতর। কেউ এখানেই; কেউ বা সুদূর আমেরিকায়। দীপা আছেন আগের মতোই। খুলনায়।

তারপরেও একটা আক্ষেপ থেকে যায়। পাঁচ দশক আগে যাঁর কণ্ঠমাধুর্যে আমরা প্রেরণা ও পরিতৃপ্তির আশ্রয় খুঁজে পেতাম, সুদূরে বিলীন হওয়াই কি তাঁর নিয়তি? সত্য কথা, খুলনা বেতারে তিনি বিপুল গৌরবে গান গেয়েছেন – যতদিন গলা সহযোগিতা করেছে, ততদিন। কিন্তু এখন তা বিমুখ। বিস্মৃতিই কি তবে দীপার নিয়তি?

হয়তো বিষয়টি তাঁকেও ভাবায়। তাই মেধার অন্য পথেও তিনি পা ফেলেন। সসংকোচে নয়, স্বতঃস্ফূর্তও নয়। তবে অনায়াস দক্ষতায়। এ তাঁর লেখালেখি। তাতে ‘মননের মধু’ যতটা আছে, সহজ আবেগের অভাবও ততটাই। বোঝা যায়, সস্তা জনপ্রিয়তায় ভাসায় তাঁর বিরূপতা আছে। নিজস্ব লেখার ব্যক্তিত্ব কিন্তু ফোটে। প্রথম বই, নহি নটী, নহি শুধু দাসী। নামে চমক আছে। ব্যক্তিত্বে মর্যাদার ঘোষণা আছে। তবে লেখা মোটেই আক্রমণাত্মক নয়। সুস্থ সংযমে বাঁধা শোভন রচনা। নারীর আপন ভাগ্য নিয়ে নানা দিক থেকে নানা কথা বলা যায়। সংগত অভিযোগও অকাট্য। এখানে লেখাগুলোতে তেমন স্বর অপ্রাসঙ্গিক। এমনকি আলাদা করে নারী বাস্তবতায় দৃষ্টি আকর্ষণও বিরল। অনুমান, এই সহজ সমতা আত্মস্থ করে তাঁর ভাবনার রূপায়ণ। লেখাগুলোর অনপেক্ষ সিদ্ধি মন কাড়ে। তাঁর দ্বিতীয় বই আমার একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের গনগনে আঁচে পুড়তে পুড়তে নিরাপদ ঠিকানায় পৌঁছেও বিরাট দুঃখের অভিজ্ঞতা স্মৃতির সম্বল করে ফেরা, এর বর্ণনা এখানে নিরাসক্ত, কোথাও কোনো অতিরঞ্জন নেই, আমাদের চেতনায় তবু ছাপ ফেলে। মাথা নত করি।

তাঁর তৃতীয় বইটি ছেপে বেরিয়েছে গত বছর। ‘সাহিত্যপ্রকাশ’ থেকে। আবার তিনি ফিরেছেন গানে। গলায় না হলেও কথায়। নাম, গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি – সঙ্গে একটি উপশিরোনাম : সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধ। এই বইটি নিয়েই এখানে কিছু বলার চেষ্টা। এতক্ষণ তারই ভনিতা। আসলে মাত্রাজ্ঞান লোপ পেলে যা হয়, তাই। ‘তোমরা যা বলো তাই বলো, আমার লাগে না মনে।’

দুই

পাছে পরে খেই হারিয়ে ভুলে যাই, তাই শুরুতেই বলে ফেলি, দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গদ্য আমাকে মুগ্ধ করে। শান্ত, সংযত, শ্রীময়ী, সম্পূর্ণ। তারা-ভরা আকাশের নিচে গাছের ডালে-ডালে-পাতায়-পাতায় ফুটে ওঠা-ফুটে থাকা, অথবা শিশিরভেজা ভোরবেলায় চারপাশে মাটিতে ঝরেপড়া শিউলি ফুলের মতো তার হালকা সৌরভ, স্নিগ্ধ মাধুর্য ও অমলিন বিস্তার। ভাষার আভিজাত্য কিন্তু অটুট থাকে। এ-বইতেও তেমন। বোধহয়, বিষয় মহিমাতে আভার দ্যুতি চেতনায় ছড়ায় আরো বেশি।

অবশ্য গানের ব্যাকরণ নিয়ে – সরাসরি রাগ-রাগিণী-তাল-লয়-রূপ-বৈচিত্র্য নিয়ে তিনি আলোচনায় বসেননি। ভালোই করেছেন। এ-ব্যাপারে আমার মতো অশিক্ষিতরাও পড়তে পারে। ওস্তাদ যাঁরা, আভাসে-ইঙ্গিতেই হয়তো তাঁরা বলার কথাটি বুঝে নেবেন। কিছুই বঞ্চিত হবেন না। আমরা কিন্তু নিজেদের জায়গা থেকে অনেক কিছু আহরণ করি। কৃতজ্ঞ থাকি। অতৃপ্তিও একটু-আধটু থেকে যায় না, তা নয়। মনে হয়, বলার কথা বোধহয়, আরো ছিল।

প্রত্যাশামতো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রসংগীতই এখানে আলোচনার মুখ্য বিষয়। তবে তা-ই সব নয়। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত – এঁদের গান নিয়েও তাঁর কথা এখানে পাই। ১৮৬১ থেকে ১৮৭১-এর ভেতরে জন্মেছেন এঁরা ক’জন। আরো পাই নিধুবাবুর গান নিয়ে সহৃদয় আলোচনা। তিনি এঁদের পূর্বসূরি।

বিষয়ভাবনা মাথায় রেখে বইটি দুই ভাগে সাজানো। প্রথম ভাগের শিরোনাম ‘সীমার মাঝে অসীম’। এতে পাই রবীন্দ্রনাথকে। ধারাবাহিক সূচি : ১. রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণের গান, ২. পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে, ৩. দুঃখের গান, দুঃখ জয়ের গান, ৪. পরজে বাজে বাঁশি, ৫. আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে, ৬. যোগাযোগ : কুমুর গান, ৭. ছিন্নপত্রাবলীল চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচিন্তা, ৮. সাহানা : বসন্তের গোধূলি রাগ, ৯. পূর্বকথা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনুবাদ : দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রমাঁ রলাঁর মধ্যে সংগীত বিষয়ে কথোপকথন, অনুবাদ : দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দ্বিতীয় ভাগের শিরোনাম, ‘বাংলা গানের ধারাবৃত্ত’। পরপর সাজানো প্রবন্ধমালা : ১. নিধুবাবুর গান : সময় ও সমাজের প্রতিচ্ছবি, ২. দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান, ৩. ওগো দুঃখ সুখের সাথী, সঙ্গী দিনরাতি সঙ্গীত মোর, ৪. রজনীকান্ত সেন : জীবন ও গান। অনুমান, রামনিধি গুপ্তের (জন্ম ১৭৪১) অনুশীলিত গানে ভাব ও রুচির বিকাশমানতাকে পশ্চাৎপটে রেখে ১৮৬১-৭১, এই দশ বছরে যে-চারজন ক্ষণজন্মা সংগীতসাধকের আবির্ভাব ঘটে তাঁদের ওপর তিনি আলো ফেলেছেন। অবশ্য দীপ্তিমান সূর্যের মতো আকর্ষণের কেন্দ্রভূমিতে প্রায় সবটাই রবীন্দ্রনাথ।

আমি কিন্তু শুরু করি নিধুবাবু, বা রামনিধি গুপ্তর ওপর লেখাটি নিয়ে। তাঁর বিষয়ে যে প্রায় কিছুই জানতাম না, এটা তার একটা বড় কারণ। তাছাড়া ওই সময়টার বিশৃঙ্খল ভাঙাচোরা বাস্তবতায় প্রতিভার বিকাশও যে কেমন ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে, বাইরের ঘনঘটায়, ঠোকাঠুকিতে কেমন দিগি¦দিকে হারিয়েও যায়, তার এক আক্ষেপ-জাগানো উদাহরণ তাঁর জীবন ও কীর্তির স্মরণ ও বিস্মরণ। জন্ম তাঁর কলকাতায় এমন এক সময়ে, যখন ওই শহরের শৈশবে তা প্রায় নামগোত্রহীন। সাতানব্বই বছর বয়সে যখন তাঁর জীবনাবসান, তখন সেই একই শহর হয়ে উঠছে গোটা দেশের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রস্থল। জীবন কেটেছে তাঁর খ্যাতি-অখ্যাতির ধারাবাহিকতায়। তা-ও কতটা তিনি নিজে বুঝেছেন, আর কতটা উত্তরকালের বিবেচনায় পুনর্নির্মাণ, বলা মুশকিল। তবু তাঁর সৃষ্টিতে লেগে থাকে যুগসন্ধিক্ষণের ও যুগান্তরের ছাপ। তাঁর কীর্তিমহিমা এতে বিচিত্র রং ছড়ায়। আমাদের চেতনায় কিঞ্চিৎ মায়া বোধহয় লেগে থাকে।

জীবনের প্রথম ভাগে পৌনঃপুনিক শোকে বিপর্যস্ত নিধুবাবু বাংলার বাইরে ছাপরায় বেশ কিছুকাল কাটিয়ে আসেন। দীপা জানাচ্ছেন, ‘শোকে তিনি এতটাই কাতর হয়ে পড়েছিলেন যে, সেই থেকে তিনি সাংসারিক সুখ সম্বন্ধে একেবারেই আসক্তিহীন হয়ে পড়েন। ঐশ্বর্য, বৈষয়িক জীবন কোনোভাবেই তাঁকে আর আকর্ষণ করতে পারছিল না। ধরে নেওয়া যেতে পারে, এই শোক কাটিয়ে উঠতেই সংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ ও আসক্তি বেড়ে যায়। …’ অনুমান, ছাপরায় থাকাকালেই তিনি টপ্পা-অঙ্গের উচ্চাঙ্গসংগীতে সিদ্ধি লাভ করেন। এতটাই যে, নিধুবাবু নামের সঙ্গে টপ্পা অবিচ্ছেদ্য জড়িয়ে যায়। আমার মতো যারা গান জানে না বা বোঝে না, তাদের কানেও ‘নিধুবাবুর টপ্পা’ – এই শব্দবদ্ধ অবিচ্ছেদ্য থেকে গেছে।

তখন সুরকার-গীতিকার-গায়ক, এসবে তফাত হতো সামান্যই। বিশ শতকের গোড়াতে ছিল এমনটিই চল। বেতারের যুগে এসে দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে। স্বরলিপি তৈরির শুরু অবশ্য উনিশ শতকেই। গীতিকার নিধুবাবুরও যে আলাদা গুরুত্ব থাকবে, এটাও তাই স্বাভাবিক। দীপা কটি উদাহরণ দিয়েছেন। বিষয় প্রায় সবই ইহজাগতিক, একই সঙ্গে রুচির মর্যাদা অক্ষুণ্ন। যেমন :

১.     নানান দেশে নানান ভাষা

       বিনে স্বদেশীয় ভাষা পূরে কি আশা

                    কত নদী সরোবর

                  কিবা ফল চাতকীর

       ধারাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?

২.     ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে

       আমার স্বভাব এই তোমা বই আর জানিনে

       বিধুর মুখে মধুর হাসি দেখতে বড় ভালবাসি

       তাই তোমারে দেখতে আসি দেখা দিতে আসিনে।

৩.     প্রেম মোর অতি প্রিয় হে, তুমি আমারে তেজো না,

       যদি রাত্রিদিন কর জ্বালাতন ভালো সে যাতনা।

এদের আবেদন আজো অফুরান। তবে টপ্পায় গাইবার দিন বোধহয় গত। আমি তো শুনতে পাই না, এতে আক্ষেপ বাড়ে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো বিখ্যাত গান টপ্পায় বাঁধা। দীপাকে সামনে বসিয়ে সাহানা দেবী গেয়েছেন। আমিও শুনেছি। বেতারে। তুলনাহীন। টপ্পার বিন্দুবিসর্গ জানি না। কিন্তু সাহানা দেবীর গাওয়া গানগুলো ভোলা যায় না। অনুমান, নিধুবাবুর গানেও ছিল, তেমন সম্মোহন। একটা প্রচলিত কথা, ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়।’ গানের বেলায় কথা-সুর নিশ্চয় থেকে যায়। কিন্তু স্থান-কাল-পরিবেশ মিলিয়ে পূর্ণপ্রাণের বিস্ময় থাকে না। নিধুবাবুর বেলাতেও, মনে হয়, এমনই ঘটে। আরো কিছু, নতুন কিছু মানুষকে টানে। প্রত্যেকের মৃত্যু অনিবার্য হলেও মানুষের চলা থামে না। যাত্রাপথে গানের সুর ক্রমাগত পাল্টায়। আনন্দে। বিষাদেও। হারিয়ে ফেলার, হারিয়ে যাবার আক্ষেপ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চলে। যদিও ব্যক্তি মানবী বা ব্যক্তি মানবের স্মৃতির সীমার অতীতে আরো দূরে তা সরে যায়।

দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ বা রজনীকান্তর গান এখনো বাজে। এই সময়ের শিল্পীর সামনে বসে শোনার সুযোগ মাঝে মাঝে পাই। দীপার লেখায় এদের স্বরূপ ঠিকই ফোটে। তাঁদের যাপিত জীবনে বিড়ম্বনা বা সীমাবদ্ধতার দিকটিও। দ্বিজেন্দ্রলালের গানে কথায় ও সুরে ওজস্বিতা এখনো কানে রোমাঞ্চ জাগায়। তাঁর হাসির গান নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট। বিলিতি সুরের মিশ্রণে কোথাও কোথাও বাড়তি মাত্রা যোগ হয়। মোটেই অস্বাভাবিক মনে হয় না। তবে তাঁর কথা ও সুরের ছাঁচ যেন ছকে বাঁধা। বৈচিত্রের বিস্ময়ে কোথাও কি ঘাটতি থেকে যায়? তাৎক্ষণিক উপভোগে অবশ্য কোনো বাধা আসে না। মন মজে। রজনীকান্তর গানও এই রকম। এমনকি কোনো শিক্ষিত সৃষ্টিশীলতার আকুতিও তাতে ধরা পড়ে না। সরলতা, স্বতঃস্ফূর্ততা, দুঃখ-শোকে-অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত হয়েও ঈশ্বরে প্রবল নিষ্ঠা, সেগুলোই তাঁর গানে এক ধরনের অনাবিল আবেদন সৃষ্টি করে। তা শতভাগ খাঁটি। আত্মহারা প্রাণে আকুল আবেগে তাঁর গীত রচনা, গান গাওয়া। এতে সীমাবদ্ধতা আছে, ভাবে পৌনঃপুনিকতা আছে; কিন্তু কোনো ওপর-চালাকি নেই। দীপা তাঁর গানের ঐশ্বর্য ও সীমাবদ্ধতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরুপায় জীবনে আকুলতার যোগরেখাটা গভীর সহমর্মিতায়, কিন্তু নিস্পৃহ সমদর্শিতায়, সামনে এনেছেন। আমাদের মনেও সাড়া জাগে। ব্যক্তিগত জীবনের বিপন্নতা অতুলপ্রসাদের গানে প্রবল ছায়াপাত ঘটায়। তারপরেও কথা ও সুরে তার আবেদনই আমার মনে হয়, অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী। গানের সংখ্যা দিয়ে তাঁর মান বিচার কতটা কাজে আসে, জানি না। তবে অতুলপ্রসাদ স্বল্পপ্রজ যদি হয়েও থাকেন, তারপরেও, মনে হয়, চেতনার গভীরে অনেক বেশি দাগ কাটেন। গানের মায়া সহজে মোছে না। সুরে সূক্ষ্ম কারুকাজ হয়তো আকর্ষণ বাড়ায়। দুটো মিলে আমাদের তিনি ঋণী করে রাখেন। অবশ্য এসব এক আনাড়ি শ্রোতার অভিজ্ঞতা থেকে বলা। কোনো মূল্য আরোপের দাবি করি না।

বলেছি, প্রথম পর্বে সবটাই রবীন্দ্রনাথ। আসলে এইখানেই বিষয়ের মূল ভাব ও মূল সুর বাঁধা হয়ে যায়। তাঁর অনুশীলনে প্রাথমিকতাও এই ভাবনাকে ঘিরে। সুরটা ধরা পড়ে ‘সীমার মাঝে অসীম’ – উপশিরোনামে। একদিকে ব্যক্তিচেতনায় বিশ্ব-মহাবিশ্ব, অন্যদিকে বর্ণগন্ধছন্দোময় সামগ্র্যের অন্তহীন প্রসারমানতার নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ। জন্ম-মৃত্যু-অনুরাগ-বিরাগ-ক্ষমা-হিংসা-ধ্বংস-সৃষ্টি, সবই কালের বিরতিহীন ধারাবাহিকতায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অসংখ্য বন্ধনে-মুক্তিতে  রূপে-রূপান্তরে আসক্তিহীন অনিবার্যতায় প্রশ্নাতীত মীমাংসার অথবা অমীমাংসার বিপুল তাড়নায় চলমান। রবীন্দ্রনাথের একক অনুভবে এই সবকিছু যে অভিঘাত হানে, তারই অদম্য পরিণাম তাঁর গান, তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির সমাহার। দীপা এখানে চোখ রেখেছেন মর্ত্যে পূর্ণপ্রাণের লীলায় উৎসারিত তাঁর গানের ঝরনাধারায়। এবং সবটাই ‘মানুষের সীমানায়’।

প্রথম লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণের গান’। মনে হয়, মাস-মরসুম ভাগ করে গানকে যে সাজাই, তা যতটা প্রত্যেক্ষের, তার চেয়ে বেশি অন্তরের। তারপরেও প্রকৃতির বাস্তবতায় বিচিত্র ভাবনারাশির মনোজাগতিক স্বরূপের বহুবর্ণিল উদ্ভাস আমাদের চেতনায় আলাদা-আলাদা অনুভবের চিত্রশালা সাজায়। পরস্পরবিচ্ছিন্ন নয়। এক থেকে অন্যে বিরতিহীন চলায়। আহ্নিক থেকে বার্ষিকে; বার্ষিক থেকে দিগন্তে। ঋতু ও মনের সাঙ্গীকরণ যে মায়া রচনা করে, তার আশ্চর্য মাধুরী ধরা পড়ে বিশেষ করে প্রকৃতি-চিহ্নিত গানে। কোনো জলচল বিভাজনে নয়, মুক্ত বিহঙ্গের উড়ে চলা, অথবা মহাসাগরীয় স্রোতের দিগ্দর্শন যেমন, অনেকটা তেমন। এইসব গানে মনোভূমির বিস্তার রবীন্দ্রনাথে অনন্য। সেখানেও আবার ‘বর্ষার রূপ’ মানবের মনে ফুটিয়ে তোলায় তাঁর সিদ্ধি প্রবাদতুল্য।

দীপা এটা মেনেও শ্রাবণের গানে তাঁকে আরো বিশেষের মহিমায় আলাদা করেছেন। পড়ার পর আমারও মনে হলো, শ্রাবণ তাঁকে যতটা অভিভূত করেছিল, আষাঢ় ততটা নয়। কারণ কি শুধুই নৈসর্গিক অভিঘাত? নাকি শব্দ-ব্যঞ্জনাও একটা ব্যাপার? শ্রাবণ শব্দে যে-ঝংকার আছে, বর্ষার অনুষঙ্গী যে যুক্ত বর্ণের অভিঘাত আছে, আষাঢ়ে তা নেই। জানি ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে -’ প্রবাদতুল্য। কিন্তু খেয়াল করি, শেষে যুক্তবর্ণে (স্য) বাড়ানো হয়েছে তার গরিমা। ধ্বনির গাম্ভীর্য ধরে রাখা গেছে। পূর্বাপর সামঞ্জস্যতা।

এই সব শ্রাবণের গানে বর্ষার অনুপুঙ্খ দৃশ্যকল্পে ধ্বনিময়তার সান্দ্র অনুভব আছে, স্মৃতির বিনম্র সঞ্চয়ে পবিত্র বিষাদ আছে, নৈকট্যে-দূরত্বে অন্তহীন তরঙ্গের ব্যাকুলতা আছে। দীপার উপস্থাপনায় তাদের সত্য-স্বরূপের দেখা মেলে। আমাদের চেতনায় সঞ্চয় বাড়ে। ‘দুঃখ-সুখের লক্ষ ধারা’ এক বিন্দুতে স্থায়ী হবার পথ খোঁজে। ক্ষণিক অভিজ্ঞতার আশায়, চরিতার্থতায়, এমনকি ব্যর্থতায় মূল্য-সংযোজন ঘটে। যুগ থেকে যুগান্তে বার্তা ছড়ায়। চিত্ত প্রসারিত হয়। নিবিড় সুখ-গভীর দুঃখ সঙ্গে সঙ্গে চলে। একা ব্যক্তির শুধু নয়। অনেকের আলাদা-আলাদা, এবং পরিণামে মিলিত প্রবাহে। দীপার লেখা আমাদের তৃষ্ণা মেটায় – তৃষ্ণা জাগায়। মর্ত-মানবীর, মর্ত-মানবের ক্ষণিক জীবনে ‘নিশীতে বিলীন’ হয় কায়াহীন স্বপ্ন। ‘দূরপথে তার দীপ শিখা’ যেন এক ‘রক্তিম মরীচিকা’র অনিঃশেষ ‘করুণ মিনতি।’ ধাবমান সময়ের পরতে-পরতে মিশে থাকে। তাতেও অমৃতের স্বাদ। রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণের গানে তৃপ্তি-অতৃপ্তি মেশা তার অনিঃশেষ সঞ্চয়।

তাঁর প্রেমের, দুঃখের, বা, দুঃখজয়ের গানের বাণীকেও দীপা একই রকম আত্মস্থ করেন। প্রেমের অনুভব কোথাও-কোথাও অনির্বচনীয় আবেদন জাগায়। যেমন ‘- কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ -’ গানটি। বৈপরীত্যের অভিঘাত দুঃসহ কাতর হয়ে বাজে। অনুভব কিন্তু প্রাণ পায়। সত্যস্য সত্যম্ হয়ে ধরা দেয়। থাকে। আকুল হৃদয়ে অভিঘাতের রেশ যদিও বেজে চলে। যে নিঃস্ব করে, সে-ই ভিক্ষা চায়। ওই চাওয়া পূরণে আবার তারই কাছে হাতপাতা, এই ভাব-কল্পনা আমাদের অনুভবের সব সীমা অতিক্রম করে – এবং সবটাই গভীর থেকে গভীরতর অফুরান মাধুর্যে :

আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ।

হেরো মম প্রাণমন যৌবন নব করপুটতলে পড়ে আছে তব –

            ভিখারি আমার ভিখারি,

হায় আরো যদি চাও মোরে কিছু দাও, ফিরে আমি দিব তাই ॥

এই গানের সংহত আবেগ অসীমে ছড়ায়। প্রেম এখানে পূর্ণপ্রাণের সমর্পণ হয়ে, আবার তাকেই ফিরে পাবার আকুতিতে দ্বিধাহীন প্রার্থনায় সমে এসে পৌঁছে। দুঃসাহসী চিত্ররূপে কোনো খাদ নেই। মর্ত্য-মাধুরী কল্পস্বর্গে সম্ভাবনার অশেষকেও ছাড়িয়ে যায়; কিন্তু মানুষী বাস্তবতাই তার উৎসে এবং চলমানতার ধারায় সবটুকুতে। কথায়-সুরে অসামান্য সমন্বয়ে এ-গান রবীন্দ্রসংগীতের সেরার-সেরার তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নেয়।

‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’ – গানটির প্রথম চরণ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। বিস্ময়ের মর্মাহুতির জন্য তখন সাগ্রহ অপেক্ষা। কিন্তু এই চতুষ্পদী পরিণামে চেতনায় কোনো বিপ্লব ঘটায় না। এক পরমার্থিক প্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় গানটির পরিসমাপ্তি। আমরা ধাতস্থই থাকি।

‘আমার মল্লিকা বনে -’ গানটি আমার মনেও অচরিতার্থতার বেদনা জাগায়। তা এর ধাপে-ধাপে বিচ্ছেদে অবসানে। হয়তো সে-কারণেই এর মাধুর্য অফুরান। এই আশায় অঞ্জলি পেতে অপেক্ষা। তরুণী ঊষার ডালে শিশিরে শিশিরে ফুল ‘ছলোছলি’ সে চলে যেতে চায়। শ্রান্ত মল্লিকা করুণ লতাতেই ঝরো-ঝরো হয়। অঞ্জলি পেতে বসে থাকা বুঝি বিফলেই যায়।

‘- কুমুরগান’-এ পদে পদে তার স্বপ্নভঙ্গ। ‘আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা’ই বুঝি তার নিয়তি। এর অকরুণ পাঠ আমাদেরও আর্ত করে। কিন্তু সে পিছন ফেরে না। হারও মানে না। ‘আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা’য় গানের সুরে তার ‘মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে’। এ-গান শুধু গলায় নয়, সব বেসুরো বাস্তবতায় আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে বিশ্বপ্রকৃতির হয়ে ওঠার প্রাণজাগানো প্রকৃত ছন্দে তাল মেলাবার প্রত্যয়েও। দীপা কুমুর গানে ‘দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন’ ব্রতের এই তাৎপর্য ‘নিশীথিনী-সম’ গৌরবে গভীর মমতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

তাঁর ‘পরজে বাজে বাঁশি’ – অধ্যায়ের সম্মোহনী আলোচনা নিয়ে কিছু বলার অধিকার আমার নেই। ‘পরজ’ শব্দটি শুধু কানে শুনেছি। অর্থ বা ব্যঞ্জনা কিছুই জানি না। আসলে গানের জগতের হালচাল সবটাই আমার কাছে এক রহস্যময় বিস্ময়। আমি একেবারেই হটাবাহার। বাকি লেখাগুলো আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, এইটুকুই শুধু বলবার।

তবে একটা বিষয় আমাকে ভাবনায় ফেলে। দীপার বইটির নাম গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি। এই ‘তোমায়’ বলতে কাকে বোঝায়? অথবা তা কী? বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের একচ্ছত্র অধিকারী, সর্বময় অস্তিত্বের থাকা-না থাকার কারণ বা প্রেরণা, তাই? অথবা তেমন কিছু? যেন কর্তা-কর্ম সম্পর্কের কর্তা? এসব থেকে আসে ঈশ্বরের ধারণা। মানুষ যত কম স্বাবলম্বী, ঈশ্বর তত প্রবল। জীবন-মৃত্যুর সীমাবদ্ধতায় মানুষ অসহায়, কিন্তু সীমার বাইরে চিরকালের

স্বপ্ন-কল্পনায় আকাক্সক্ষার বিস্তার, নশ্বরতায় অবিনশ্বর মুক্তির আয়োজন। পূর্ণপ্রাণে চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছার নিষ্পত্তি। অপ্রেমে নয়, প্রেমে; বিনষ্টিতে নয়, কল্যাণে। ঈশ্বরে এই প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটে মর্ত্য-মানুষের জীবনাচরণে। যেন তা সাক্ষী গোপাল, অথবা, অদৃষ্টের নিয়ন্তা, তাই মর্তের চেতনায় তাতেই অমর্ত্যশরণ। সর্বোত্তম শ্রেয় ভাবনারও তাকেই জড়িয়ে পূর্ণতা। যদিও সেই পূর্ণতা বাস্তবের বিষয় নিরপেক্ষ।

ঈশ্বরের ভাবরূপ রবীন্দ্রনাথেও ছড়ানো। গানে তার প্রকাশ অনিরুদ্ধ। পূজা, প্রকৃতি বা প্রেম, সবেতেই তা মিশে আছে একাকার হয়ে। আলাদা করে ছেঁকে নিয়ে তারে চিনি, বা, না-চিনি। এই ঈশ্বরকেই, অনুমান, খুঁজেছেন দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বইটিতে। এবং তা সংগীতবিষয়ক প্রবন্ধে তাঁকে অনুভবে ফুটিয়ে তোলার আকুতি নিয়ে।

কিন্তু প্রতিরোধ খাড়া করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অনপেক্ষ সর্বগুণান্বিত ঈশ্বরের চলতি ধারণাকেই তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৩০ সালে আইনস্টাইনের সঙ্গে বিখ্যাত কথোপকথনে তিনি দ্ব্যর্থহীন বলেন, ঈশ্বর মানবচৈতন্যে আপন সত্তাকে অর্থময় করার তাগিদে তার আপন নিরুপায় আর্তির ফসল। মর্ত্য-বিশ্বে মানুষ না থাকলে সেখানে ঈশ্বরও নেই। তার থাকা-না-থাকা, দুই-ই অবান্তর। পূর্ণ-অপূর্ণর ধারণা মানুষের সৃষ্টি। এবং তা তার নশ্বর জীবনের অনিবার্যতায় সত্য-কল্যাণ ও সুন্দরের আপেক্ষিক প্রাসঙ্গিকতাকে সুস্থির করার লক্ষ্যে। মানববাস্তবতার শুরু থেকে এই প্রয়াসই প্রসারিত আগামীর সমস্ত সম্ভাবনায় পথ খোঁজায়।

হয়তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিকলায় বরাবর এমন ছিলেন না। স্থান-কাল-পরিবেশের বৃত্ত তাঁর প্রাথমিক চেতনায় উত্তরাধিকার সূত্রে আশ্রয় পেয়েছে। পরে স্বজ্ঞা তাঁকে পথ দেখিয়েছে। কোনো অভ্যাসের দাস তিনি হননি। ঈশ্বর তাই তাঁর কাছে কোনো স্থিরবিন্দু নয়। ‘তুমি’ও ক্রমবিকাশমান এক উপলব্ধির চলমান ধারা। শব্দ বা চিত্রময়তায় তাকে একক গরিমায় স্থির ভাবার কোনো কারণ নেই। কবির নাম ও স্বর্বনাম স্বয়ং আমাদের নানা পথে টানে। গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি বলায় আমরা তা হলে কোনো স্থির প্রতিমা দর্শনের আশায় ছুটি না। অথবা, প্রতিমা একক হলেও তা হতে পারে দশপ্রহরণধারিণী; কিংবা অসংখ্য অভিজ্ঞান একীকরণে ফুটে উঠতে পারে কোনো বিশেষ প্রাণময়ী রূপ। ‘তুমি’ তাই সংজ্ঞার্থেই বিবিধের অনুসারী। খোঁজার দায় স্রষ্টার নয়, যারা তার মুখোমুখি, তাদের।

উনিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভগ্নহৃদয় কাব্যগ্রন্থ শ্রীমতী হে-নামের আড়ালে যাঁকে উৎসর্গ করে লেখেন ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা।’ পাঁচ বছরের মাথায় তাঁর আকস্মিক অকালমৃত্যু কবির জীবনে এক ক্রান্তিকারী ঘটনা। জীবনস্মৃতিতে এ-প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, দীপাও উদ্ধৃতি দেন, ‘… এই দুঃসহ দুঃখের ভিতর দিয়া আমার মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে একটা আকস্মিক আনন্দের হাওয়া বহিতে লাগিল, … জীবন যে একেবারে অবিচলিত নিশ্চিত নহে, এই দুঃখের সংবাদেই মনের ভার লঘু হইয়া গেল।’ চিত্তের এই স্বাধীনতা চৈতন্যকে তাঁর প্রসারিত করে। মহাকাশে নক্ষত্রমণ্ডলীর স্থান পরিবর্তনের মতো। কিন্তু ‘ধ্রুবতারা’ আজীবন একই রকম জ্বলজ্বল করে। হয়তো কল্পপ্রতিমা তার আরো গভীরে, আরো ওপরে আলো ছড়ায়। বলাকায় ‘ছবি’ ও ‘শা-জাহান’ কবিতাদুটোর উৎস, অনুমান, মনোজগতের একই আলোড়ন। রচনাকালের ব্যবধান মাত্র এগারো দিন। তফাত, পাত্র-পাত্রীর কল্পরূপে জায়গা বদল! বদল ব্যক্তিতাতেও। ‘ছবি’ কবিতার অনুভবে বাস্তবের অভিঘাত সহজেই চেনা যায়, কিন্তু ‘শা-জাহান’-এ তাজমহল কি স্বয়ং কবির প্রতিরূপ নয়? আর শা-জাহান কি নয় তাঁর উনিশ বছরে চেনা সেই ‘ধ্রুবতারা’রই নতুন প্রতিমা? চেনা-জানার রহস্য ঘনায় আরো অনেক কবিতায়, গানেও। যেমন, ‘আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে -’ গানে (১৯১০, গীতাঞ্জলি), ‘আকাশপ্রদীপ’-এ ‘বধূ’, ‘শ্যামা’, ‘কাঁচা আম’ (১৯৩৮-৩৯) কবিতায়। আভাস রেখে যায় অসংখ্য সৃষ্টিকলায়, ছবি আঁকাতেও। ‘অন্তরে-বাহিরে’ তাঁর মানসী প্রতিমা এই ‘তুমি’তে সব একীভূত হয়। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে এর সন্ধান নিরর্থক। তবে মহাবিশ্বে-মহাকাশে, অণুতে-পরমাণুতে থেকে যেতে পারে তার আভা। দীপার ‘তুমি’তে কে, কী, কেন – এ-প্রশ্ন কিন্তু আমার থেকে যায়। প্রথাগত ভাবনায় তৃপ্তি মেলে না। তা একরকম হাল ছেড়ে দেওয়া। তারপরেও এ-বইতে ভাব ও ভাষার শান্ত-শোভন সমন্বয়, মেধার ঐশ্বর্য আমাদের শ্রদ্ধা জাগায়। মন জাগে। আরো চায়। ১৮৬১ থেকে ১৮৭১, এই দশ বছরে বাংলায় যে অবিস্মরণীয় সংগীতপ্রতিভার আবির্ভাব এবং পশ্চাৎপটে নিধুবাবুর টপ্পার যে যুগলাঞ্ছিত সৃষ্টিকলার করুণ-রঙিন আয়োজন, সবমিলিয়ে এঁদের অবদানের মার্জিত উপস্থাপনের সামনে আমরা নত হই। কিন্তু বাংলাগানের সজীব ধারায় আরো কিছু থেকে যায়। তাদের মূল্যও অশেষ। যেমন, পদাবলী, শ্যামাসংগীত, বাউলগান, মর্সিয়া, ভাটিয়ালি। আমাদের খোঁজ এসবেও যেন ছড়ায়।