ধর্মান্ধতা আর অজ্ঞতা এমন ছেঁাঁয়াচে রোগ যা যুগে যুগে ধ্বংস করেছে সভ্যতার অনেক নির্মাণ। মানবিক সত্তা বিকাশকে নানাভাবে করেছে অবদমিত। আজকেও তা রুদ্ধ করে চলেছে মুক্তচিন্তার চর্চাকে। ঢাকার সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমিতে গত ১২ই মে সন্ধ্যায় প্রদর্শিত মাংকি ট্রায়াল নাটকে এমনই এক ভাবব্যঞ্জনা ফুটে উঠছিল। বিচারের নামে প্রহসনে মুক্তবুদ্ধিচর্চার পথকে রুদ্ধ করার নির্মম কাহিনি জীবন্ত হয়ে উঠছিল নাটকের নানা দৃশ্যে। মাংকি ট্রায়াল প্রযোজনা করেছে নাট্যদল ‘বাতিঘর’। নির্দেশনা দিয়েছেন দলের সদস্য সঞ্জয় সরকার মুক্তনীল। শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী হয়। ওই প্রদর্শনীর ওপর ভিত্তি করে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এর নাট্যবস্তু, নাট্যায়ন, উপস্থাপন বৈচিত্র্য, মঞ্চ-আলো-অভিনয়, নান্দনিকতা ও দর্শকের উপযোগিতার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ইতিহাসের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত বাতিঘরের মাংকি ট্রায়াল। খ্রিষ্টান গোঁড়া ধর্মযাজকরা মধ্যযুগে ইউরোপীয় মানবজীবনকে করে তুলেছিলেন নারকীয়। আধুনিক যুগে এসেও তারা মানুষের মুক্তচিন্তা ও বিকাশকে করেছেন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত। গ্যালিলিও, ব্রুনোর ঘটনা সকলেই জানেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার এক প্রদেশের স্কুলের এক শিক্ষককে কাঠগড়ায় দাঁড় হতে হয়েছিল ক্লাসে ডারউইনের বিবর্তনবাদ শেখানোর ‘অপরাধে’। খ্রিষ্টধর্মীয় সৃষ্টিবাদের বিপরীত সে-তত্ত্ব। শিক্ষকের বিচারের নামে সেখানে চলে ধর্মীয় প্রহসন। সেদেশের বাটলার অ্যাক্ট অনুযায়ী তাঁকে দণ্ডিত করা হয়। ইতিহাসে যা Scopes Monkey Trial নামে পরিচিত। এ নিয়ে নানামুখী গল্প, গ্রন্থ, সিনেমা ও থিয়েটার নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে বাতিঘর নাট্যদল সেই বিতর্কনির্ভর আখ্যানটি মাংকি ট্রায়াল শিরোনামে মঞ্চে এনেছে। এ-নাটকটি স্কুলশিক্ষকের এই ছোট্ট বিচারকে কেন্দ্র করে হয়ে উঠেছে ধর্মীয় অন্ধত্বের বিপরীতে বুদ্ধিবাদ ও সাম্যবাদের লড়াই।
বিংশ শতকের শুরুর দিকে প্রবর্তিত বাটলার অ্যাক্ট মানুষের মুক্তবুদ্ধিচর্চায় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল।
নাট্য-উপস্থাপনে দুই আইনজীবীর বিতর্কই প্রধান হয়ে উঠেছে। নাটকটি শুরু হয় ধর্ম ও বিজ্ঞানের বাইনারি অপজিশনের মধ্য দিয়ে। মঞ্চের একদিকে ধর্মীয় প্রার্থনা ও বাইবেলের সৃষ্টিবাদের ভাষণ। অন্যদিকে স্কুলের দুই শিক্ষার্থীর পোকা নিয়ে খেলা, অর্থাৎ বিবর্তনবাদের চর্চা। ধর্মযাজক যখন বলতে থাকেন, পৃথিবী মাত্র কয়েকদিনে তৈরি হয়েছে, পরক্ষণেই শিক্ষার্থীর সংলাপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পৃথিবী বিবর্তনের ধারায় তৈরি। তখন ছেলেটি পোকা দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।
হাওয়ার্ড : এতে ভয়ের কী আছে? তুমি তো একসময় কীটই ছিলে।
মেলিন্ডা : কখনোই না।
হাওয়ার্ড : অবশ্যই ছিলে! যখন পুরো পৃথিবী পানিতে ঢাকা ছিল, কীটপতঙ্গ আর কাদামাটি ছাড়া কিছুই ছিল না। তুমি আর তোমার পুরো পরিবার কীটপতঙ্গই ছিলে।
মেলিন্ডা : দাঁড়াও এক্ষুনি গিয়ে আমি আমার বাবাকে সব বলে দিচ্ছি, তখন বাবা তোমাকে না …
হাওয়ার্ড : তোমার বাবাও একটা পোকা ছিল।
নির্দেশক সাদা পোশাকে মাথা-মুখ ঢাকা ক্ষীণ আলো হাতে মানবজাতির প্রতীকী মঞ্চালংকার তৈরি করেছেন। মঞ্চে যখন ধর্মীয় আবহ তুঙ্গে, তখন যেন আলো ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যাওয়ার নৈর্ব্যক্তিক এনলাইটমেন্টেরই আহ্বান। প্রথম দৃশ্যেই একদিকে ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব এবং অন্যদিকে বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বনির্ভর গাঁথুনিতে নাট্যগল্প গতি পায়।
কেইটস নামে স্কুলশিক্ষক জেলখানায় বন্দি। মঞ্চটি সাজানো হয়েছে আদালতের আদলে। আদালতের ওপর ‘রিড দ্য বাইবেল’ লেখা। বাটলার আইনভঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচারের জন্য তখন সমবেত জনতা। আদালত প্রাঙ্গণ ভিড়ে ঠাসা। অন্যদিকে অভিযুক্ত শিক্ষককে ভালোবাসে গোঁড়া ধর্মযাজকের কন্যা। যাজককন্যা রেইচেলকে কেইটস জানায় – ‘হান্টার্স সিভিক বায়োলজি বইটা হাতে আসার পর, আমার ধারণা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। একজন শিক্ষক হিসেবে বিজ্ঞান ক্লাসে ওটা পড়ানো, আমার কাছে বড় দায়িত্ব মনে হয়েছে। চ্যাপ্টার-১৭, ডারইউনস ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’। ওখানে বলা হয়েছে, মানুষ শুধুই ফুলদানিতে আটকে থাকা ছোট জেরানিয়াম ফুল না … জীবনের সৃষ্টি, একটা সুদীর্ঘ ঘটনা। মাত্র সাতদিনে সব তৈরি হয়ে যায়নি …’
বাটলার অ্যাক্ট অনুসারে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার শুরু হয়। আসামির পক্ষে উপস্থিত হন মুক্তচিন্তাচর্চায় বিশ্বাসী বিশিষ্ট আইনজীবী হেনরি ড্রামন্ড। বিপরীতে রাষ্ট্রপক্ষের ধর্মপ্রাণ আইনজীবী হ্যারিসন ব্র্যাডি। হেনরি ড্রামন্ড প্রথমেই জানিয়ে দেন আদালতের ওপরে ‘বাইবেল পড়ো’ যে বিজ্ঞাপনটা ঝুলছে ওটা নামিয়ে ফেলতে। যদি নামানো না হয় তবে সেখানে যেন বড় অক্ষরে লেখা থাকে ‘ডারউইন পড়ো’। এমনই শ্লেষাত্মক সংলাপে নাট্যাঙ্কের গতি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। হেনরি ড্রামন্ডের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় যেন যুক্তি, বিজ্ঞান ও মনুষ্যত্বের পরিচয়ই ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। অপরপক্ষে নাস্তিক্য যেন উসকে উঠতে না পারে সেজন্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ব্র্যাডির অক্লান্ত প্রচেষ্টা। স্কুলের প্রায় প্রত্যেক ছাত্রের একে একে সাক্ষ্য নেওয়া হয়। শিক্ষক কেইটস সংশ্লিষ্ট নানাজনেরও সাক্ষ্য নেওয়া হয়। মাঝখানে ভিন্নমুখী নানা দৃশ্য কাহিনিকে আরো নাটকীয় করে তোলে। নানা যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে চিন্তার প্রবাহ বাড়তে থাকে। ১০ মিনিটের বিরতিসহ প্রায় দুই ঘণ্টাধিক সময় টানটান উত্তেজনায় দৃশ্যের পর দৃশ্যে দর্শক পিনপতন নীরবতায় নাটকটি উপভোগ করেন। মঞ্চটি ছিল সুনির্দিষ্ট প্রসেনিয়াম আর্চে সীমাবদ্ধ।
গল্পটি খুবই ছোট্ট। কিন্তু এ-ছোট বিষয় যখন হয়ে ওঠে মানবতার আদর্শ, তখন গল্পের মূল সুরটি সর্বজনীন গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। নাটকটির বৃত্তকৌশলেও সরলরূপের ছাপ আছে। কিন্তু ওই যে চিন্তার মাহাত্ম্য, তা নাটকটিকে করে তুলেছে অনন্য। গল্পের কাহিনিতে একক কোনো ট্র্যাজেডি গড়ার পরিবর্তে নানা মাত্রার বিমোক্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। নাটকে চিন্তার সঙ্গে গল্পের, নায়কের ট্র্যাজেডির সঙ্গে দুই আইনজ্ঞের ট্র্যাজেডির রূপ পরিগ্রহ লাভ করেছে। এ-নাটকে ধর্মকে যুক্তির মাপকাঠিতে দাঁড় করানো হয়েছে। তাই বলে ধর্মকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার মানসে নয়। মোহের তাণ্ডবের বিপরীতে বস্তুসত্যের অন্বেষণ। তবে এটাও সত্য যে, ধর্মও জীবনকে সুশৃঙ্খল রাখার একটি সহজ পথ। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম। তাই ধর্ম-নৈতিকতার শিক্ষাকে কিন্তু অবজ্ঞা করে ফেলে দেওয়া যায় না।
এ-নাটকের নামকরণে ব্যঙ্গ রয়েছে। মাংকি ট্রায়াল শিরোনামে পরিহাস করা হয়েছে বিচারের নামে এ-আয়োজনকে। নাটকটিতে চরিত্রগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হেনরি ড্রামন্ড, ম্যাথিউ ম্যারিসন ব্র্যাডি, সারাহ ব্র্যাডি, বার্স্ট্রম কেইটস প্রমুখ বিংশ শতকের বাটলার আইনের অধীনের চরিত্র। নাটকের প্রধান ১৬টি চরিত্রই যেন সমাজের নানা রূপের প্রতিচ্ছবি। সামাজিক স্তরবিন্যাসে গভীর পার্থক্য। মন-রুচি-চিন্তা-দর্শন একই ভূমিতে একই সময়ে কী পৃথক! ম্যাথিউ ম্যারিসন ব্র্যাডি জীবনের সর্বস্ব দিয়ে যেমন ধর্মের প্রচলিত সত্যকে ধরে রাখতে উন্মুখ, তেমনি হেনরি ড্রামন্ড প্রস্তুত মুক্তবুদ্ধির চর্চার স্বাধীনতায় জীবন সঁপে দিতে। দুজন পরস্পরের গভীর বন্ধু হলেও দুজনের অবস্থান চিন্তার দু-মেরুতে। মানবসম্পর্কের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও দুজন বিপরীত দুই রীতির ঝাণ্ডাবাহক। হেনরি ড্রামন্ড বলেন –
‘আপনারা কি বুঝতে পারছেন না যে, আজ যদি আইন করে বিবর্তনবাদকে স্কুলে পড়ানো অপরাধ হিসেবে প্রমাণ করা যায়, তাহলে কোনো একদিন তা পড়াই অপরাধ হয়ে যাবে। এর পরে লেখাপড়া আর বই-পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হবে। … আর সর্বশেষ ধর্মকেই লেলিয়ে দেওয়া হবে ধর্মের বিরুদ্ধে! এই ধ্বংস কোনোদিন থামবে না।’
অপরদিকে ম্যাথিউ ম্যারিসন ব্র্যাডিও কম জাঁদরেল নন। ব্র্যাডি বলে ওঠেন – ‘আমি বলতে চাই, এই ধর্মবিরোধী বিবর্তনবাদী, নাস্তিকেরা সমাজে বিষ ছড়াচ্ছে। আমি এই আইনসভায় জোর দাবি জানাচ্ছি, সমাজ থেকে এই বিষাক্ত কীটগুলোকে সমূলে উৎপাটন করা হোক। আজ যদি আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, আমি বলে দিচ্ছি, এরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঈশ্বরবিরোধী বিজ্ঞানের কুশিক্ষা দেবে। তাই … আমি ব্রার্টাম কেইটসকে দোষী সাব্যস্ত করে তার কঠিন শাস্তি দাবি করছি। যাতে করে পুরো পৃথিবী দেখে আর বলে, আজকের এই কোর্ট ন্যায় ধর্মের পক্ষে রায় দিয়ে পুরো মানবজাতির কল্যাণে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বয়ে এনেছে।’
যাকে কেন্দ্র করে ঘটনার আবর্তন সেই শিক্ষক কেইটস একজন সাধারণ সহজ-সরল মানুষ। রাজনীতির এসব তর্ক-বিতর্কে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন। একজন জ্ঞানান্বেষী সাধারণ চরিত্র। যুক্তিবাদের মাধ্যমে সত্যকে দাঁড় করানোর পক্ষপাতী – ‘আমি এখন বুঝতে পারছি না কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক! আমি শুধু শিশুদের মনটা খুলে দিতে চেয়েছিলাম। ওদের আমি এমন জ্ঞান দিতে চেয়েছিলাম যা ভবিষ্যতে ওদের কাজে দেবে।’
হেনরি ড্রামন্ড আরো জানান, যতদিন পর্যন্ত যাজকরা স্বর্গলাভের স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষকে অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা এবং ঘৃণার চাদরে মুড়ে রাখবে, ততদিন পর্যন্ত ড্রামন্ডদের এ-লড়াই চলবে। এমন একদিন আসবে যখন এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা মুক্তচিন্তার আলোতে লজ্জায় কুঁকড়ে মারা যাবে। শুধু আজ ভয় এই যে, ততদিনে এই ধর্মযাজকরা এই পৃথিবীটাকে না জাহান্নাম বানিয়ে ফেলে!
নাট্যদ্বন্দ্বই অভিনয়ে প্রাণসঞ্চার করেছে। অভিনেতাদের ক্রিয়াগুলি হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত। অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রাভিনয় প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। মঞ্চ-ব্যবহারে কখনো কখনো জড়তা লক্ষ করা গেলেও প্রতিটি চরিত্র ছিল মানানসই। কৃত্রিমতার বিপরীতে প্রতিশ্রুতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, তবে মঞ্চটির পূর্ণ ব্যবহার ও স্থান-কাল-পাত্রের সুনির্দিষ্টতা নিয়ে আরো ভাবার অবকাশ আছে। স্তানিসøাভস্কির বাস্তববাদী চরিত্রাভিনয় রীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এ-নাটকে। হেনরি ড্রামন্ড চরিত্রে নির্দেশক মুক্তনীলের সংলাপ ছিল সাবলীল। বাচনরীতি, সুস্পষ্ট উচ্চারণ ও বিতর্ক দর্শকের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশেও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। অন্য আইনজীবী ম্যাথিউ হ্যারিসন ব্র্যাডি চরিত্রে খালিদ হাসান রুমির চরিত্র নির্মাণে সাত্ত্বিক বিশ্বাসের যথেষ্ট পরিচয় মেলে। সংলাপ প্রক্ষেপণ, ছেদ-ঝোঁক ও স্বরের নিপুণতায় আবেগের চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর মৃত্যু হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করেছে। এ-নাটকে সারাহ ব্র্র্যাডি চরিত্রে তারানা তাবাসসুম চেরী, বার্ট্রাম কেইটস চরিত্রে সঞ্জয় গোস্বামী, ই কে হর্নবেক চরিত্রে সাদ্দাম রহমান, রেভারেন্ড জেরেমাইয়া ব্রাউন চরিত্রে স্মরণ বিশ্বাস, রেইচেল ব্রাউন চরিত্রে মৃধা অয়োমী, জর্জ চরিত্রে সঞ্জয় হালদার, মিকার চরিত্রে ইয়াসির আরাফাত, টম ড্যাভেনপোর্ট চরিত্রে জর্জ দীপ্ত, ব্যানিস্টার চরিত্রে রাজু আহমেদ, জর্জ সিলার্স চরিত্রে নাসির প্রিয়, হাওয়ার্ড চরিত্রে রাজা আকন ও মেলিন্ডা চরিত্রে সাবিহা তাসনিম মাসুমা অভিনয় করেছেন। আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন তানজিল আহমেদ, মঞ্চবিন্যাসে রহমান মুফিজ, আবহসংগীতে সাদ্দাম রহমান ও মুহাইমিন অঞ্জন এবং পোশাক পরিকল্পনায় শাহানা জয় ও রুম্মান শারু।
বাতিঘর তারুণ্যদীপ্ত নাট্যদল। তাদের অন্যান্য প্রযোজনার মধ্যেও চিন্তাচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। বাতিঘরের অলিখিত উপাখ্যান যেমন ইতিহাসের কথা বলে তেমনি র্যাডক্লিফ লাইন, ঊর্ণাজাল বিধ্বস্ত মানবতার কথা বলে।
নির্দেশক সঞ্জয় সরকার মুক্তনীল মাংকি ট্রায়াল নির্মাণে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য থেকে গল্পের গাঁথুনি নির্মাণ করেছেন। অতিপরিচিত ও প্রচলিত কাহিনিকাঠামো গ্রহণ করেছেন বলেই সম্ভবত নাট্যরূপ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। মুক্তনীলের নির্মাণে গল্পের মাত্রা ও সংলাপের বৈদগ্ধ্যে নাটকটি যাত্রা করেছে নতুন চিন্তায়। ধর্মীয় অন্ধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কীভাবে যুক্তিবাদ-মানবতাবাদের জয় হয়, তা নাটকীয় আলেখ্যে দৃশ্য ও সংলাপের অনুপম গাঁথুনিতে তুলে ধরেছেন তিনি। টানটান উত্তেজনায় প্রাচীন-মধ্যযুগ থেকে শুরু করে অতিসাম্প্রতিক দর্শন-বিজ্ঞান-আধুনিকতা, মানবতা ও যুক্তিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মানবজীবনের জয়লাভকেই প্রধান করে তুলেছেন মুক্তনীল।
নাটকের প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে দুই আইনজীবীর দ্বন্দ্ব। প্রায় প্রতিটি সংলাপেই রয়েছে দ্বান্দ্বিক বিমোক্ষণ। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বিচারগান বা কবিগানের মতো আধুনিক আদালতের সংলাপাত্মক দ্বন্দ্ব দর্শককে আকৃষ্ট না করে পারে না। অধিকাংশ সংলাপই বেশ দীর্ঘ। তবে প্রক্ষেপণে তা যেন জীবনঘনিষ্ঠতার বন্ধনে আবদ্ধ। আদালতে প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমেও ফুটে উঠেছে সত্যের রূপ।
নাটকটি দৃশ্যনির্ভর নয়, সংলাপনির্ভর। সংলাপের কাছে গল্পও যেন কখনো কখনো হার মেনেছে। দার্শনিক হেগেলের মতো দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে যেন জীবন ও জগতের সত্য খোঁজা –
ব্রাডি : আমি বলছি সে কী করার চেষ্টার করেছে! সে সমস্ত মানুষকে বাইবেলের ওপর বিশ্বাস, ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস এবং ধর্মের বিশ্বাসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।
ড্রামন্ড : আপনি খুব ভালো করে জানেন আপনি ভুল বলছেন। তাছাড়া এই মামলায় আমার ব্যক্তিদর্শন মোটেও বিবেচ্য নয়। আমি শুধু সেই নির্বোধদের আটকানোর চেষ্টা করছি যারা তাদের ধর্মান্ধতা, মৌলবাদিতা আর মূর্খতা দিয়ে শিক্ষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানকে নিজেদের মতো করে চালানোর চেষ্টা করেছেন।
স্থান-কাল-ঘটনার দৃশ্য নির্মাণে আলোর কার্যকরী ভূমিকা দেখা গেলেও বিচারদৃশ্যগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজনে নানামুখী আবেদন তৈরি করতে পারতো। কিছু কিছু দৃশ্যে আলো আবেগিক রূপে বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত কেইসট ও তাঁর প্রেমিকার মুহূর্তগুলিতে।
সময় ও স্থানকে ধারণ করে বাস্তববাদী পোশাক ব্যবহৃত হয়েছে। যাকে কেন্দ্র করে নাটকের গল্প সেই শিক্ষক চরিত্রে সঞ্জয় গোস্বামী সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট ও সাধারণ জুতা পরিধান করেছেন, যা একজন সহজ-সরল শিক্ষক চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আইনজীবী চরিত্রে মুক্তনীল ও খালিদ হাসান রুমি প্রথাগত আইনজীবীর কালো উর্দি পরেছেন। খালিদ হাসান রুমি ধর্মীয় প্রতীক বোঝাতে চরিত্রে নানা প্রপস ব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে মুক্তনীল আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করেননি। অন্যান্য চরিত্রও সহজসাধ্য রূপেই নিজেদের উপস্থাপন করেছেন। নির্দেশক নাট্য-উপস্থাপনায় বিশেষ কোনো ফর্ম নিরীক্ষার আশ্রয় নেননি। মঞ্চসজ্জাটি ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল। নাটকের টিমওয়ার্কও ছিল যথেষ্ট সংবেদনশীল। নির্দেশক মনে করেন, কোনো দেশ কোনো একটি ধর্মের, বর্ণের কিংবা গোষ্ঠীর হতে পারে না। ভিন্নমতকে অগ্রাহ্য করতে পারি যুক্তি দিয়ে, অস্ত্র কিংবা আইন দিয়ে নয়। নির্দেশক বাস্তববাদী উপস্থাপনার সঙ্গে প্রতীকী নানা ইমেজের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। মঞ্চের দৃশ্য নির্মাণে ইঙ্গিতধর্মী নানা উপকরণ ব্যবহার করেছেন। আইনি প্রক্রিয়ায় নানা তর্কের মাধ্যমে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র, সাম্যবাদী জীবনবোধ মুখ্য হয়ে উঠেছে। যে-আইন জ্ঞান বিকাশের বিরোধী, সে-আইন বন্ধ করা উচিত। নাটকের শেষে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধর্মকে অশ্রদ্ধা নয়, অন্ধত্ব-কুসংস্কারকে ছাড়িয়ে যুক্তিবাদ ও মানবতাবোধে জয়ী হতে হবে।
ছবি লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.