আনিসুজ্জামানকে স্মরণ

কালি ও কলম পত্রিকার প্রস্তাবক যে-সভা কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় তাতে আমি আহূত হয়েছিলাম। চিঠিটা এসেছিল আনিসুজ্জামানের কাছ থেকে। কী কারণে মনে নেই আমি তাতে যেয়ে উঠতে পারিনি। আনিসুজ্জামান লিখছেন, তার একটা আলাদা দাম ছিল। অন্তত এটা যে কোনও হেলাফেলার ব্যাপার হতে যাচ্ছে না, কোনও অভিনব স্ফুলিঙ্গ মাত্র, তা নিশ্চিত লেগেছিল। মুরলীধর বসুর কালিকলম-এর কথা শুনেছি, কল্লোল-এর সঙ্গে যার নাম করা হত সেই কালিকলম; কিন্তু তার স্মৃতি উদ্রেক করেও যে এটা তার পুনরাবর্তন হবে না সেই ইঙ্গিত ছিল তার দ্বন্দ্বনিরূপণে। জিজ্ঞেস করা হয়নি, কিন্তু ওই কৃতি কি আনিসুজ্জামানেরই নয় যাতে আমাদের বর্তমান আধুনিকতা অতীত আধুনিকতার উত্তরাধিকারী হয়? আবার ওই ‘ও’টাকেও তো হতে হবে ভবিষ্যমুখী। অনেক বড়ো কাজ করেছেন আনিসুজ্জামান, কিন্তু এই কাজের জন্যও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

কলকাতায় সভা, কারণ ওই বাংলা এই বাংলা দুই বাংলার লেখাই এতে থাকবে। আর এমন এক মাসিক পত্রিকা যাতে সমকালীন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ সবই প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে, রসের ধারা যেমন বইবে তেমনি ভাবও হবে ঘনসংবদ্ধ – উত্থিত হবে সংবেদন-মননের যুগ্ম ধ্বজা – সেইসঙ্গে এসে জুড়বে বহির্বিশ্ব, তরজমায়-তরজমায়, আলোচনায়-আলোচনায়। এমনিই নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন আনিসুজ্জামান। তাঁর কাছে এই ঋণ আমাদের যারা বাংলা পড়ি। দুই বাংলায় মিলে এমনতর পত্রিকা বোধহয় শেষ ছিল প্রতিক্ষণ।

আনিসুজ্জামানের কাছে বাংলাভাষা যে দুই বাংলারই শিরাধমনী তার আরেক প্রমাণ পাওয়া গেল যখন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে সম্পাদক করে, কালি ও কলম-এর এক কলকাতা সংস্করণও বেরোতে শুরু করল – একই পত্রিকা ঢাকা ও কলকাতা দু-জায়গা থেকেই। আনিসুজ্জামানের ডাকা প্রবেশক সভার ঘট পূর্ণ হল। কিন্তু আমাদেরই দুর্ভাগ্য যে এই দ্বৈতাদ্বৈত বেশিদিন টিকল না। যাই হোক, [আমায় লেখা] বুদ্ধদেব বসুর কিছু চিঠি আমার কাছে ছিল। পরপর দুই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় সেগুলি কালি ও কলমই ছাপল। সোৎসাহে, আমাকে কৃতজ্ঞ করে। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায়ও প্রতিভা বসুর কতিপয় ও রাজেশ্বরী দত্তের একটি চিঠি ছেপেছে। যুগপৎ আনিসুজ্জামান ও সম্প্রতিপ্রয়াত আবুল হাসনাতের স্মৃতি শিরোধার্য করে কালি ও কলম-এর হাতেই সেগুলি তুলে দিয়েছিলাম।

যাকে ঘনিষ্ঠতা বলে তা আমার ঠিক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে ছিল না। তবে অনেক দিনের পরিচয় আর বয়সের সামীপ্যও একটা পারস্পরিক হৃদ্যতা দিয়েছিল। দেখা হলেই স্নেহের বিকিরণ হত। আমি বরাবরই তাঁর গুণগ্রাহী, যেমন তাঁর বিদ্যাবত্তায় তেমনি তাঁর রচনার বৈভবে মুগ্ধ। আমার বন্ধু শিশিরকুমার দাশের (১৯৩৬-২০০৩) সঙ্গে এক আপেক্ষিক সংগতি তাঁর ছিল, জানি না তাঁদের কখনও দেখা হয়েছিল কিনা। শিশিরকুমার দাশ ও আনিসুজ্জামান উভয়েরই তরুণ বন্ধু স্বপন মজুমদার হয়তো বলতে পারতেন। কিন্তু তিনিও তো আর নেই।