আনিসুজ্জামানের চিন্তাধারার বিষয়-আশয়

আনিসুজ্জামান (১৯৩৭-২০২০) ছিলেন সংস্কৃতি ও ইতিহাস-সচেতন লেখক-গবেষক-শিক্ষক ও মানবাধিকারমনস্ক চিন্তাবিদ। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সদালাপী, সজ্জন ও রুচিমান ভদ্রলোক। ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকার জন্যে এরচেয়ে বেশি গুণাবলি আর কী থাকতে পারে! এইসব বিষয় নিয়ে বিশদভাবে লিখতে গেলে একখানি বড়োসড়ো জীবনীগ্রন্থই লেখা প্রয়োজন। কিন্তু সদ্যপ্রয়াত হলেন তিনি, এখনো শোকজনিত আবেগ ও কাতরতামুক্ত মানসিক স্থৈর্য আমাদের অনায়ত্ত। তাই তাঁর লেখাপত্র, গবেষণা ও ভাবনার প্রধান এলাকা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি, বাংলা অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও ঔপনিবেশিক আমলের নানা কূট ও শঠতাপূর্ণ সাম্প্রদায়িক ও ধর্মপ্রবণ ঘটনাসমূহ ইতিহাসে কী রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং তার প্রভাবে খ্যাতকীর্তি কোন কোন ঐতিহাসিক কী পরিমাণ বিভ্রান্ত-বিচলিত হয়েছেন আনিসুজ্জামানের লেখায় তার তীব্র তীক্ষ্ণ রূপ যেমন আমরা পাই, তেমনি সূক্ষ্ম কিন্তু কৌতুকময় ভঙ্গিতে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিকের চিন্তায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রতি পক্ষপাত এবং ওই দৃষ্টিভঙ্গিজাত ইতিহাস-ব্যাখ্যার নির্বুদ্ধিতাকেও তিনি জোরালো তথ্য ও যুক্তিসিদ্ধ ভাষ্যে করে তোলেন দীপ্র। আমরা আনিসুজ্জামানের লেখা থেকে এর উদাহরণ তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন : ‘রাজনৈতিক ইতিহাসে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ প্রাচীনকাল, মুসলমান আমল মধ্যযুগ এবং ইংরেজ শাসনামল আধুনিক যুগ বলে চিহ্নিত। এই প্রচলিত পর্বভাগ কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এতো গুরুত্ব লাভ করেছে যে, যদুনাথ সরকারের মতো ইতিহাসবিদ অনায়াসে বলতে পেরেছেন যে, ‘On 23rd June 1757, the middle ages of India ended and her modern age began.’ কোনো ঐতিহাসিক যুগান্তরের একেবারে সঠিক তারিখ আর কেউ নির্দিষ্ট করেছেন কি না সন্দেহ! যদুনাথের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে, শুধু দিন নয়, ক্ষণও তিনি স্পষ্ট করে নির্দেশ করতে পারতেন : ২৩শে জুন ১৭৫৭, বেলা চারটেয়।’সূক্ষ্মদর্শী চিন্তক আনিসুজ্জামানের শেষ লাইনটিতে ব্যক্ত শ্লেষ সচেতন ইতিহাসনিষ্ঠ পাঠক উপভোগ করবেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যদুনাথ সরকারে মতো ডাকসাইটে ঐতিহাসিকের ইতিহাসবোধের ব্যর্থতাও বিশ্লেষণ করেছেন যুক্তিপূর্ণ ও আধুনিক তাত্ত্বিক দৃষ্টান্তসহযোগে। তিনি লিখেছেন : ‘যুগান্তরের এই সময়সীমা যদুনাথ সরকার যে সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের জন্যে প্রয়োগ করেছিলেন সে কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না।’কিন্তু ভারতবর্ষের প্রচলিত ইতিহাস চর্চায় তিন পর্বের এই যুগ-বিভাগ যে অবৈজ্ঞানিক, বিভ্রান্তিকর এবং ভুল ব্যাখ্যার নামান্তর সে-বিষয়ে আনিসুজ্জামান বলেছেন : ‘… ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্ব-ইতিহাসে মানবসভ্যতাকে যেভাবে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগে বিন্যস্ত করা হয়েছে, সেই আদর্শই প্রযুক্ত হয়েছে ভারতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে।’ উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্য ইতিহাস-চর্চার মূলে ছিল ইউরোপকেন্দ্রিক মানবসভ্যতা বিবেচনার নিরিখ। ইউরোপীয় সভ্যতা-বিচারের প্যারাডাইম (paradigm) ভারতবর্ষের ইতিহাস বিচারে প্রয়োগ করা হলে ইউরোপের দুঃসময় যেহেতু তাদের মধ্যযুগ হিসেবে চিহ্নিত, তাই ভারতবর্ষ, চীন এবং আরবের ওই সময় সমৃদ্ধির কাল হলেও মধ্যযুগ হিসেবে গণ্য হবে। আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘আর যে-সময়ে ইউরোপ বিশ্বজয়ে বেরিয়েছে, উপনিবেশ স্থাপন করেছে দিকে দিকে, সেই সময়টা শুধু ইউরোপের জন্যে নয়, যে-সব দেশ তখন উপনিবেশে পরিণত হয়েছে, তাদের জন্যেও গৌরবময় আধুনিক যুগ বলে বিবেচিত।’ওই বক্তব্যের পর হয়তো একটু ঠাট্টার সুরেই বলেছেন : ‘ভারতে মধ্যযুগের অবসানের জন্যে কয়েকশো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে – ইউরোপীয় শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত।’ যদুনাথ সরকারের ইতিহাস-বিচার যে সেকেলে এবং গুরুতর তথ্য-বিভ্রান্তিকর তা বোঝাতে তিনি রামকৃষ্ণ মুখার্জি, তপন রায় চৌধুরী, ইরফান হাবিব, অনুপম সেন প্রমুখের শরণ নিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের সামাজিক পরিবর্তনের যেসব বৈশিষ্ট্য অভিনব বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে তার কিছু কিছু লক্ষণ ইংরেজ শাসনের পূর্বেও দেখা গেছে।’

দুই
আনিসুজ্জামান পড়াশোনা করেছেন বিপুল বিষয়ে, যা পড়েছেন, তা অনুপুঙ্খভাবেই পড়েছেন। ফলে, তিনি অধীত বিষয় প্রকাশ করতে পারতেন সীমিতসংখ্যক শব্দে, স্বল্পতম বাক্যে এবং আকর্ষণীয় গদ্যে। তাই ‘Brevity is the soul of wit’ বলে যে ইংরেজি ভাষায় একটি কথা আছে আনিসুজ্জামানের লেখা বা বক্তৃতা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু তাই বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের অভাব নেই তাঁর লেখায়। একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার এবং সে-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহুমুখী প্রতিভাধর পণ্ডিত সুকুমার সেন বিষয়ে একটি স্মৃতিতর্পণমূলক ছোট লেখা লিখেছেন তিনি। অথচ ড. সেনের জীবন ও কর্মের মূল কথাগুলো তো সেখানে আছেই, তাছাড়াও আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র, কিন্তু মানুষটিকে তাঁর পরিপূর্ণ সত্তায় এবং গভীরতর অনুভবে উপলব্ধির জন্য যা অপরিহার্য তা তিনি কী সুনিপুণ দক্ষতায় ও অনুপমভঙ্গিতেই না লিপিবদ্ধ করেছেন। আমরা সেই বিষয়সমূহই এখন বিশেষভাবে তুলে ধরবো।
রচনাটি আনিসুজ্জামান শুরু করেছেন এভাবে : ‘সুকুমার সেন চলে গেলেন পরিণত বয়সে। জ্ঞানের জগৎকে যা দেবার তা এরই মধ্যে তিনি দিয়েছেন তাঁর বিচিত্র সাধনায়, বিপুল কর্মযজ্ঞে। … কী বিশালই না ছিল তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র। বৈদিক ভাষার ব্যাকরণ থেকে বাঙালি মেয়েদের কথ্যভাষার ভঙ্গি, রামায়ণ, মহাভারত-এর পূর্বকথা, প্রাচীন ফার্সি অনুশাসন থেকে বৌদ্ধ-সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্য, সংহিতা ও ব্রাহ্মণের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ, গোয়েন্দা কাহিনির ইতিবৃত্ত, পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থ সম্পাদনা, স্থান নামের অনুসন্ধান, ব্যুৎপত্তিগত অভিধান সংকলন। গল্প লিখেছেন তিনি, রচনা করেছেন আত্মকাহিনী। তাঁর কৌতূহলের শেষ ছিল না, সীমা ছিল না পাণ্ডিত্যের।’
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উপর্যুক্ত তালিকায় ড. সেনের লেখাপত্রের একটা পূর্ণ চিত্র যে ধরিয়ে দিয়েছেন তা কিন্তু নয়। সুকুমার সেন যে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সংস্কৃত, বাংলা ও গণিতে লেটার পেয়েছিলেন বা এম.এ. থিসিস লিখে একশতে ৯৬ নম্বর পেয়েছিলেন তার জন্যে পাঠক যাতে তাঁকে বিস্ময়কর প্রতিভা হিসেবে সমীহ করতে পারে সেটাও লেখকের লক্ষ্য নয়, কিন্তু তাঁকে বহুবিদ্যজ্ঞ (polymath) হিসেবে দেখার জায়গাটা আনিসুজ্জামান অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানে খুঁজে বের করেছেন; বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের সেই জায়গাগুলোই আমাদের দৃষ্টিতে এনেছেন।
ড. সুকুমার সেনের সেই অলোকসামান্য মেধা ও সূক্ষ্মদর্শী পাণ্ডিত্যের কয়েকটি বিষয় আনিসুজ্জামান তুলে ধরেছেন তা থেকে কিছুটা উদ্ধার করে পেশ করি।
সুকুমার সেন সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি.এ. পাশ করেন; কিন্তু এম. এ. করেন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে। এ-বিষয়ে তাঁর শিক্ষক ছিলেন যশস্বী পণ্ডিত জাহাঙ্গির সোরাবজি তারাপুরওয়ালা এবং অপর খ্যাতকীর্তি পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটেছিল তাঁর তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের এম.এ. পরীক্ষায়। প্রশ্নপত্র করেছিলেন সুনীতিকুমার স্বয়ং। পরীক্ষার খাতায় সেই প্রশ্নপত্রে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার একটি পুনর্গঠিত শব্দের বানানের ভুল ধরেছিলেন পরাৎপর ওই মহাপণ্ডিতের ছাত্র সুকুমার সেন। সুনীতিকুমার এই ঘটনায় খুশি হয়ে তাঁর ছাত্র সুকুমার সেনের অসাধারণ মেধার প্রশংসা করেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কাছে।
সুকুমার সেন ছাত্রজীবনেই বহু গুরুত্বপূর্ণ মেডেল, স্বর্ণপদক পুরস্কার পেয়েছেন; আনিসুজ্জামানের লেখায় তার বিবরণ আছে। সে-সব বিষয়ে তাঁর মতো মেধাবী ছাত্র অন্য ডিসিপ্লিনেও পাওয়া যাবে; কিন্তু জ্ঞানকাণ্ডের এতো বিচিত্র বিষয়ে অতুলনীয় অধিকার ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণশক্তির অধিকারী পণ্ডিত মেলা ভার। ড. সেন এম.এ. পাশ করেন ১৯২৩-এ। এম.এ.-তে থিসিস লিখেছিলেন ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ বিশেষ্য পদের বিন্যাস বিষয়ে। পরের বছর প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়েছিলেন খুব সম্ভব কাঠক-সংহিতায় কারকের ব্যবহার সম্পর্কে অভিসন্দর্ভ লিখে। কৃতী পুরুষ সুকুমার সেনের গৌরবোজ্জ্বল কৃতি ও কীর্তির কথা বলে আসল গৌরবের জায়গাটা উল্লেখ করেছেন আনিসুজ্জামান পরিশেষে এভাবে : ‘দেশ-বিদেশের বহু পণ্ডিতের কাছ থেকে তিনি অকৃপণ স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েছেন – তবে তরুণ বয়সে এ. বি কিথের সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে এবং লুই রুনুর সংস্কৃত ব্যাকরণে তাঁর প্রবন্ধের উল্লেখ অবিস্মরণীয় সম্মান বলে আমার মনে হয়।’
আনিসুজ্জামান মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠায় আরো বিস্তৃত পরিসরে সুকুমার সেনের অসাধারণ সব রচনার পরিচয় লিখেছেন, তার কিছুটা আমাদের জানা। তাই সে-বিষয়ে আমরা বিস্তারে যাব না। তবে তিনি ওই কিংবদন্তিপ্রতিম পণ্ডিতের আর একটি মৌলিক অবদান সম্পর্কে যা লিখেছেন সে-সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করেই বর্তমান রচনার এ-অংশের ইতি টানবো। আনিসুজ্জামান বলেছেন : ‘সুকুমার সেনের গবেষণার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় তিনি প্রবেশ করেন : ‘এ হিস্ট্রি অফ ব্রজবুলি লিটারেচার’ (১৯৩৫) লিখে। এখন পর্যন্ত এ-বিষয়ে এটি প্রামাণ্য বই। ব্রজবুলি যে বাংলার একটি উপভাষা; এ কথা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রথমে ১৯৩০ সালে লেখা একটি বাংলা প্রবন্ধে, তারপর এই ইংরেজি গ্রন্থে। এ বইয়ের ভূমিকায় তিনি বৈষ্ণব পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা চেয়েছেন এই বলে, ‘যা প্রধানতঃ ধর্ম-সাহিত্য, তাকে তিনি ইহজাগতিক সাহিত্যের মতো সাধারণ ও ঐতিহাসিকভাবে বিচার করেছেন – এ বিচার হয়তো ভক্তদের চোখে বর্জনীয় – এমনকি অপবিত্রকরণের শামিল বলে বিবেচিত হতে পারে।’ ভক্তরা সে-বই পড়ে কী বলেছিলেন জানি না, তবে এই ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি সুকুমার সেনের সকল রচনারই মৌলিক বৈশিষ্ট্য। বিদ্যাপতিগোষ্ঠী ও বৈষ্ণবীয় নিবন্ধ সম্পর্কে এ কথা অনায়াসে বলা যায়, রামকথার পূর্ব-ইতিহাস ও ভারতকথার গ্রন্থিমোচন সম্পর্কেও তাই।’ আমরা বলতে চাই, তাঁর ক্ল্যাসিক গ্রন্থ বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসও তেমনি। তাঁদের কালে এবং বঙ্গভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ভেদবুদ্ধির সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুকুমার সেনের এই ইহজাগতিক চিন্তাভাবনায় দৃঢ় অবস্থান আমাদেরকে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় অবনত করে।
ড. যদুনাথ সরকার ও ড. সুকুমার সেন দুজনই বড়ো মাপের পণ্ডিত। হয়তো কালগত পার্থক্যই তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও পৃথক করে দিয়েছে।

তিন
বাংলা, বাঙালিত্ব, বঙ্গবিভাগ, হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতা এমন বহু বিষয়ে খ্যাতনামা বাঙালি লেখকদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আনিসুজ্জামান গভীরভাবে ভেবেছেন এবং তাকে সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর একাধিক লেখায়। যাঁরা এ-বিষয় অনুপুঙ্খভাবে জানতে চান বা আনিসুজ্জামানের মানসজগৎ ও বিশ্ববীক্ষা (world view) ও সাংস্কৃতিক দর্শন বুঝতে চান তাঁদেরকে আমরা তাঁর ইহজাগতিকতা বইটি যত্ন ও গুরুত্বের সঙ্গে পড়তে বলবো। শুধু তাই নয়, মানসিক স্বচ্ছতা, চিন্তাশীলতা, শুভবুদ্ধি ও মানবিক শ্রেয়বোধ বিকশিত করার লক্ষ্যে বাঙালি পাঠককে এই বইটি তাঁর পড়ার টেবিলে রাখতে এবং নিত্যদিন এ-বই থেকে একটা না একটা লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়তে অনুরোধ করবো। প্রকৃত শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান, জাগ্রতমনের অধিকারী এবং বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষ হওয়ার জন্য এ-বই পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
এবার আমরা ইহজাগতিকতা বইটির মাধ্যমে একই সঙ্গে আনিসুজ্জামানকে পাঠ করবো এবং তাঁরই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলোকে কতক বিখ্যাত বাঙালি লেখকের সমাজ-সংস্কৃতি, জাতি ও মনুষ্য ভাবনার সারাৎসার অনুধাবনে প্রয়াসী হবো।
আমাদের যৌবনের সূচনায় কাজী আবদুল ওদুদের শাশ্বতবঙ্গ এবং সৈয়দ মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতিকথা আমরা একাগ্র মনোযোগে পড়তাম। একালের তরুণদের আধুনিক চিন্তা-ভাবনার দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করার জন্যে আনিসুজ্জামানের ইহজাগতিকতা বইটি অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি। ড. আনিসুজ্জামান ছিলেন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক এবং নিরন্তর সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সক্রিয়তাবাদী ভাবুক। বহুল পাঠ ও প্রগতিশীল মানবপন্থী চিন্তাধারার এই লেখকের এ-বই আধুনিক, মানবিক ও বহুত্ববাদী-চিন্তাঋদ্ধ নাগরিক (civil) মানুষ তৈরির দিকনির্দেশক এক আকর গ্রন্থ।
ইহজাগতিকতা বই থেকে আনিসুজ্জামানের কিছু বক্তব্য এই অংশে মুখবন্ধ হিসেবে চয়ন করি। তিনি বলেছেন : ‘ভাষা, সংস্কৃতি ও দেশের সঙ্গে নিজেকে সচেতনভাবে যুক্ত করার প্রয়াস জোরালোভাবে দেখা দিল উনিশ শতক থেকে। এ-প্রক্রিয়া চলে এসেছে ধারাবাহিকভাবে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের (১৮১২-৫৯) স্বদেশপ্রেম ও নিজভাষাপ্রীতি এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-৭৩) বঙ্গভাষাস্তুতির কথা আমাদের সবার জানা আছে। তবে বাঙালি জীবনের নানাদিক নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আমরা প্রথম পাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) হাতে। উনিশ শতকের নব্যবাবু সম্পর্কে বঙ্কিমের শ্লেষোক্তির কথা আপাতত উহ্য থাক। গভীরতর ভাব নিয়ে কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির ঐক্য ও বহুত্ব উপলব্ধির প্রয়াস পেয়েছিলেন’ (পৃ ৮০, ইহজাগতিকতা)।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বঙ্কিমচন্দ্রের বাঙালির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে যে-বক্তব্য আছে তার যে-অংশ তিনি উদ্ধৃত করেছেন আমরা তা আরো সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করছি : ‘এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে আমরা চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আর্য্য, দ্বিতীয় অনার্য্য হিন্দু, তৃতীয় আর্য্যানার্য্য হিন্দু, আর তিনের বার এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারিভাগ পরস্পর হইতে পৃথক থাকে’ (পৃ ৮০)। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ছাড়াও বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস প্রসঙ্গে যে-গুরুত্বপূর্ণ মত বঙ্কিম প্রকাশ করেছেন তা এরকম : ‘পরাধীন রাজ্যের যে দুর্দশা ঘটে স্বাধীন পাঠানদিগের রাজ্যে বাঙ্গালীর সে-দুর্দশা ঘটে নাই। … পাঠান শাসনামলে বাঙ্গালীর মানসিক দীপ্তি অধিকতর উজ্জ্বল হইয়াছিল …। এই দুই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর মানসিক জ্যোতিতে বাঙ্গালীর যেরূপ মুখোজ্জ্বল হইয়াছিল, সেরূপ তৎপূর্বে বা তৎপরে আর কখনও হয় নাই’ (পৃ ৮০)। পাঠানরা তো মুসলিম; তাদের শাসনামল সম্পর্কে এই আত্যন্তিক প্রশংসায় বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে একটু নতুন করে ভাবতেই হয়।
একটু দীর্ঘ হলেও আনিসুজ্জামান কর্তৃক উদ্ধৃত বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্যের পরবর্তী অংশটুকু তুলে না ধরলে বঙ্কিমচন্দ্রের কথিত মুসলিম-বিদ্বেষের স্বরূপ বোঝা যাবে না। সেজন্যেই সেই অংশটুকুর উল্লেখ অপরিহার্য বলে মনে করি। উদ্ধৃত অংশ : ‘… মোগল পাঠানের মধ্যে আমরা মোগলের অধিক সম্পদ দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া মোগলের জয় গাইয়া থাকি, কিন্তু মোগলই আমাদের শত্রু, পাঠান আমাদের মিত্র। মোগলের অধিকারের পর হইতে ইংরেজের শাসন পর্যন্ত একখানি ভাল গ্রন্থ বঙ্গদেশে জন্মে নাই। যেদিন হইতে দিল্লীর মোগলের সাম্রাজ্যে যুক্ত হইয়া বাঙ্গালা দুরবস্থা প্রাপ্ত হইল, সেইদিন হইতে বাঙ্গালীর ধন আর বাঙ্গালীর রহিল না; দিল্লী বা আগ্রার ব্যয়নির্ব্বাহার্থে প্রেরিত হইতে লাগিল। বাঙ্গালার হিন্দুর অনেক কীর্তি আছে, পাঠানের অনেক কীর্তির চিহ্ন পাওয়া যায়, শত বৎসর মাত্রে ইংরেজ অনেক কীর্তি স্থাপন করিয়াছে, কিন্তু বাঙ্গালায় মোগলের কোন কীর্তি কেহ দেখিয়াছে?’
উপর্যুক্ত উদ্ধৃতির পর আনিসুজ্জামান মন্তব্য করেছেন : ‘এইখানে বঙ্কিমচন্দ্রের যে কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদীর কণ্ঠস্বর। বঙ্কিমচন্দ্র সকল সময়ে এই ভাবের পোষকতা করেননি, এও সত্য। তবে তাঁর যে দুটি উদ্ধৃতি এখানে ব্যবহার করেছি, তার ভিত্তিতে রয়েছে বাংলার ভাষা, অঞ্চল ও মানুষ।’
ড. আনিসুজ্জামান বাংলা, বাঙালি ও বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের যে-দুটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন আমরা ভাষার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার পক্ষেও তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য পেয়েছি। উদাহরণ : ১২৮০ সনের পৌষ সংখ্যা বঙ্গদর্শনে প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তিনি লেখেন : ‘বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানের দেশ – একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানে এক্ষণে পৃথক, পরস্পরের সহিত সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গালার প্রকৃত উন্নতির জন্যে নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য জন্মে। যতদিন উচ্চশ্রেণীর মুসলমানের এমত গর্ব থাকিবে যে, তাঁহারা ভিন্নদেশীয়, বাঙ্গালা তাঁহাদের ভাষা নহে, তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু-ফারসীর চালনা করিবেন, ততদিন সে ঐক্য জন্মিবে না। কেননা, জাতীয় ঐক্যের মূল ভাষার একতা।’ (পশ্চিমবঙ্গ-বঙ্কিম সংখ্যা, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, প.বঙ্গ সরকার ১৪০২)। সে-সময়ে উচ্চ শ্রেণির মুসলমানের ওই দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে যদি বঙ্কিম ক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের শাসন সম্পর্কে তাঁর প্রশংসাবাক্যও বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্যের সঙ্গে লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে ষোড়শ শতকের (অর্থাৎ মোগল আমলের) বাঙালি মুসলমান কবি সৈয়দ সুলতান এবং সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিমের মোগল শাসকদের অনুগত বাঙালিদের বাংলা ভাষার বিরোধিতার নিন্দায় লেখা বহুল আলোচিত দুই কবিতার কথা স্মরণে রাখলে বঙ্কিমের উপর্যুক্ত বক্তব্য বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেন এবং কাদের অপপ্রয়াসে ব্যর্থ হয়েছে তা নতুন তাৎপর্যে জ্বলে ওঠে।

চার
আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘বাংলার ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস’ – কথাটা রবীন্দ্রনাথের। বিদেশি শাসক শুধু নয়, দেশীয় বড়ো রাজনৈতিক দল ও শক্তি এবং নানা স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বাংলার অখণ্ডতা চায়নি। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধিতার মাধ্যমে শেষ চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথের গান ছিল এর প্রধান শক্তি। আন্দোলনের মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা। পরে পূর্ব বাংলায়ও তার ‘গতি ও গভীরতা ছিল’ অনেক বেশি, – বলেছেন আনিসুজ্জামান। এতে তিনি এটাও বলেছেন : ‘বাংলার মুসলমান জননেতা ও ধর্ম প্রচারক এবং মুসলমান পরিচালিত পত্র-পত্রিকা ও সংগঠনও এতে যোগ দেয়। তবে বঙ্গভঙ্গকেই সমর্থন করেছিল বেশিরভাগ মুসলমান। … মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধীরে ধীরে শুধু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে সরে গেল, তা নয়, অনেকে এর বিরুদ্ধে প্রবলভাবে দাঁড়াল। এতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী নেতা শুধু অবাক হননি, হতাশও হয়েছিলেন।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হতাশ না হয়ে বিষয়টি কেন এমন হলো, তা গভীরভাবে চিন্তা করে তার যথার্থ কারণ নির্ণয় করে লিখেছিলেন : ‘ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানে আমাদের বক্তারা যখন মুসলমান কৃষিসম্প্রদায়ের চিত্ত আকর্ষণ করিতে পারেন নাই তখন তাহারা অত্যন্ত রাগ করিয়াছিলেন। এ কথা তাঁহারা মনেও চিন্তা করেন নাই যে, আমরা যে মুসলমানদের অথবা আমাদের দেশের জনসাধারণের যথার্থ হিতৈষী তাহার কোনো প্রমাণ কোনোদিন দিই নাই; অতএব তাহারা আমাদের হিতৈষিকতায় সন্দেহবোধ করিলে তাহাদিগকে দোষী করা যায় না’ (পৃ ৮৩)। রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই এই অসাধারণ উপলব্ধি সম্ভব। জীবনের কতটা ভেতরে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিপাতের ক্ষমতা থাকলে সত্যের স্বরূপ এভাবে উন্মোচন করা যায় সে-বিষয়টি তো আমরা মহামতি রবীন্দ্রনাথের কাছেই প্রত্যাশা করি।
উনিশ শতকে নবোত্থিত নগরবাসী ‘ভদ্রলোকদের’ জীবনদৃষ্টি ও গ্রামীণ চাষি-মজুরদের প্রতি অমন ব্যবহারের ফলেই তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন বৃহত্তর জনজীবন থেকে। তার রেশ রয়ে যাওয়ায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যে-সূচনা হয়েছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের ভুল, সাম্প্রদায়িক ও উচ্চ শ্রেণিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য উনিশ শতকের মুসলিম সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রভাব পড়তে শুরু করে সাধারণ মুসলিম ও নিম্নবর্গের হিন্দুদের ওপর। সামাজিক তল ও পাটাতনে যখন এমন অবস্থা তখন ১৯০৫-এ কলকাতায় গড়ে ওঠে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, বিখ্যাত নগরবাসী হিন্দু বাঙালির নেতৃত্বে। তার এক বছর পরই মুসলিম নবাব-নাইট জমিদারদের নেতৃত্বে ১৯০৬-এ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় রীতিমতো মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন, মুসলিম লীগ। এ-বিষয়ে হিন্দু অভিজাত বাঙালির ব্যর্থতার কারণ যে রবীন্দ্রনাথ চোখে আঙুল দিয়ে উপর্যুক্ত বক্তব্যে দেখিয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সে-বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

পাঁচ
আধুনিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মুসলিম মনস্তত্ত্বের আলোকে বাংলা ও ভারতীয় ইতিহাস বোঝার জন্যে তাঁর পিএইচ.ডি অভিসন্দর্ভ মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য যেমন গুরুত্বের সঙ্গে পড়তে হবে, তেমনি তিনি কীভাবে বহুত্ববাদী ইহজাগতিক চর্চা ও যুক্তিবাদী জীবনদর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলেন তা যথাযথভাবে অনুধাবনের জন্যে তাঁর পূর্ব বাংলার ভাষা-আন্দোলন, পাকিস্তানবাদ-বিরোধী সংগ্রাম ও শিক্ষকতা জীবনের আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে বুঝে নিতে হবে। সেই সঙ্গে তাঁর স্বরূপের সন্ধানে ও ইহজাগতিকতা বইয়ের ‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব’, ‘বাংলাদেশের ধর্ম, রাজনীতি ও বহুত্ববাদ’ এবং ‘বাঙালির আত্মপরিচয়’ শীর্ষক রচনাসমূহ যত্নের সঙ্গে পাঠ বিশেষ জরুরি।
ইহজাগতিকতাবাদের চিন্তাধারা কেমন হয় তার একটি উদাহরণ তিনি রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাসের জগমোহন প্রসঙ্গ থেকে তুলে ধরেছেন। উদাহরণটা এরকম : ‘বাড়িতে পাড়ার মুসলমান চামারদের ডেকে এনে তিনি ভোজ খাওয়াবার ব্যবস্থা করায় তার ভাই আপত্তি করেছিলেন। উত্তরে জগমোহন বলেছিলেন : ‘ব্রাহ্মরা নিরাকার মানে, তাহাকে চোখে দেখা যায় না। তোমরা সাকার মান, তাহাকে কানে শোনা যায় না। আমরা সজীবকে মানি; তাহাকে চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায় – তাহাকে বিশ্বাস না করিয়া থাকা যায় না। …
‘হাঁ, আমার এই চামার মুসলমান দেবতা। তাহাদের আশ্চর্য এই এক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইবে, তাহাদের সামনে ভোগের সামগ্রী দিলে তাহারা অনায়াসে সেটা হাতে করিয়া তুলিয়া খাইয়া ফেলে। তোমার কোনো দেবতা তাহা পারে না। আমি সেই আশ্চর্য রহস্য দেখিতে ভালোবাসি, তাই আমার ঠাকুরকে আমার ঘরে ডাকিয়াছি। দেবতাকে দেখিবার চোখ যদি তোমার অন্ধ না হইত তবে তুমি খুশি হইতে।’
এ-লেখার শুরুতে আমরা দেখেছি আনিসুজ্জামান ইতিহাস চিন্তায় ঔপনিবেশিক (colonial) ও উত্তর-ঔপনিবেশিক (post-colonial) চিন্তার কথা মনে রেখেই আমাদের ইতিহাস ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, উপনিবেশগুলির ইতিহাসে ইতিবাচক বা গৌরবময় অথবা সংরক্ষণের উপযোগী কিছু থাকতে পারে না। হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রচয়িতা জেমস মিল ছিলেন এই ভাবধারার মানুষ। … মিল ও মেকলেরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের স্তম্ভস্বরূপে। … তাঁরা পৃথিবীকে ভাগ করে ফেলেন কেন্দ্রে (centre) ও প্রান্তে (periphery); মানবসংস্কৃতিকেও যেমনি বিভক্ত করেন মুখ্য ও গৌণে – নিজেরটা মুখ্য এবং অন্যেরটা (other) গৌণে। একটি অর্থাৎ মুখ্যটি প্রাধান্যবিস্তার করবে – অন্যটি অধীন হয়ে থাকবে।’ এই ঔপনিবেশিক ধারণায় ভারতের অধীনতা যৌক্তিক। আনিসুজ্জামান আমাদের এর বিকল্প ইহজাগতিক ও এশীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নতুন রূপের অনুসন্ধানী ছিলেন। এই চিন্তা এডওয়ার্ড সাঈদের প্রাচ্যবাদ (orientalism) থেকে এলেও আনিসুজ্জামান আমাদের এই বঙ্গীয়-বিশ্বে তা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ব্যবহার করেছেন। সদাজাগ্রত মনের অধিকারী এবং সাংস্কৃতিক মার্জিত রূপ, সিভিল সমাজের বোধ ও মানবিক চৈতন্যের দীপ্রতায় বিশ্বাসী আনিসুজ্জামান তাঁর প্রজন্মের বিদ্বানদের মধ্যে চিন্তাচেতনায় উত্তরাধুনিকতারও অনুসরণ প্রত্যাশী ছিলেন।