ইথিওপিয়ায় – দানাকিল ডিপ্রেশনের ট্রেডিং পোস্টে

শিলাপাথর ছড়ানো বৃক্ষহীন টিলার ঢালে আছে আবালা গ্রামের পানীয়জলের একমাত্র উৎস। ভোরবিহানে ওখান থেকে ফিরে আসি গালগামোশ সরাইয়ে। সামান্য জায়গা – তবে পাহাড়ি পথ, তাই হাঁপ ধরে গেছে। আঙিনায় পাতা চারপাইতে বসি। উটের চামড়া সুতানলি সাপের মতো সরু করে কেটে তা দিয়ে বুনে তৈরি চারপাইটি। তাতে ভিন্ন কোনো জানোয়ারের চামড়া দিয়ে মোড়া তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসা দিব্যি আরামদায়ক।

আমাদের মেহমানখানার পোশাকি নাম হচ্ছে আলী নাজ্জাস গালগামোশ সরাই। এর স্বত্বাধিকারীর আলী নাজ্জাস ভোরবেলা ঘোড়ায় চেপে বেরিয়েছেন, আশপাশের বস্তি থেকে মুরগি কিংবা আণ্ডা জোগাড় করতে। কারণ, আমরা পর্যটকবৃন্দ – গেল ছয়দিন ধরে ইনজিরা রুটি গোউট স্টুতে চুবিয়ে খেয়ে বেঁচে আছি। আমাদের এক নারী সহযাত্রী, মার্কিন দেশের ক্যারোল,  কাল রাতে মুখে তেমন কিছু তোলেননি। তার বক্তব্য হচ্ছে, ছাগলের মাংস খেতে খেতে তার পাগল হওয়ার দশা হয়েছে। ক্যারোলের স্বামী জিম কড়িপাতি দিয়ে ভোরবিহানে আলী নাজ্জাসকে পাঠিয়েছেন মুরগি কিনতে। তিনি রওনা হওয়ার আগে নাখোশ-মুখে জানিয়েছেন, ইথিওপিয়ার এ-অঞ্চলে মুর্গা-মুরগি সহজলভ্য নয়, তবে চাইলে অস্ট্রিচ পাখির মাংস পাওয়া যেতে পারে।

গালগামোশ সরাইয়ে বড়সড় একটি কামরায় জনা আষ্টেক মেহমানের জন্য মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে একত্রে শোয়ার বন্দোবস্ত আছে। আঙিনার খোলা চুলায় রান্নাবান্নার আয়োজন। আমি এ-মুহূর্তে যে-চারপাইয়ে বসে আছি, ওখানে আসন পেড়ে বসে খানাপিনা করতে হয়।

ইথিওপিয়ার দানাকিল ডিপ্রেশন নামে পরিচিত এ মরু-অঞ্চলে পানীয়জলের তীব্র সংকট। আমরা সকলে ক্যারি করছি উচ্চমূল্যে কেনা ওয়াটার বটলের একাধিক ক্রেট। কিন্তু স্থানীয় আম-আদমিরা কী হালতে পানি সংগ্রহ করছে, তা সরেজমিন দেখার ইচ্ছায় আমি ভোরবিহানে চলে গিয়েছিলাম আবালা গ্রামের একমাত্র জলঝোরায়।

 আবালা গ্রামটিকে পর্যটক-পুস্তকে ট্রেডিং পোস্ট বলে উল্লেখ করা হয়। এখানে ছাগল ছাড়া অন্য কোনো পণ্য বিকিকিনি হয় বলে মনে হয় না। জলঝোরায় যাওয়ার পথে দেখা হয়েছে আফার গোত্রের রাখাল বালকদের সঙ্গে। ছাগলের পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এরা সকলে। পাহাড়ে বৃক্ষলতা, ঘাস-বাঁশ-পাতা কিছু নেই। তাই ঠিক বোধগম্য হয়নি ক্রমাগত চেঁ-বেঁ করা জানোয়ারগুলো আদতে কী খেয়ে বেঁচে থাকে? জলঝোরা ঘিরে চলছিল কিশোরী মেয়েদের জটলা, মনে হচ্ছিল, এরা যতটা না পানি তুলছিল, গুলতানিতে মেতেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি। তবে ফেরার পথে তাদের পিঠে জ্যারিক্যানের বোঝা দেখে ধারণা করেছি, ভারবহনই তাদের নিয়তি, এদের জীবনে লেখাপড়ার তেমন কোনো স্থান নেই। আবালা গ্রামে মসজিদ ও গির্জা আছে, আছে বয়েজ স্কুল, সেনাশিবির এবং দোকানপাট, যা নেই তা হচ্ছে বালিকা স্কুল। শিক্ষার জন্য চুলবুল করা কিশোরীরা বিদ্যালয়গামী হোক, আফার গোত্রের কড়া ধাঁচের ময়-মুরব্বিরা তা চান না।

সুবেহ সাদিকের আজানের শব্দে আজ ঘুম ভাঙে। তারপর আমি একাকী রওনা হই জলঝোরাটি দেখতে। ফেরার পথে আকাশিয়া জাতীয় কাঁটাঝোপের পাশে আমার সহযাত্রী জিমকে বেফানা হালতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। পেশায় মিউজিশিয়ান জিম তার বছরতিনেক আগে বিবাহিত স্ত্রী ক্যারোলের ন্যাওটা হয়ে জিন্দেগিতে পয়লাবারের মতো মার্কিন দেশের বাইরে সফর করছেন। দাম্পত্য জীবনে একজনের কুলটা হাওয়া কারো কাছে আপত্তিকর হতে পারে, কিন্তু ন্যাওটা হওয়াটা অপরাধ নয়। তবে জিম সহযাত্রী পর্যটকদের সঙ্গে আটপৌরে বাতচিতে, ক্যারোলের প্রতি তার দৈহিক অনুরাগের বিশদ বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক আনুগত্য প্রকাশ করে হালফিল মজাকের পাত্র হয়ে উঠছেন। বয়সে তিনি ক্যারোলের চেয়ে বছর-পাঁচেকের কনিষ্ঠ। জিম কাঁটাঝোপের পাশে এমন অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন যে, তার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ভদ্রসন্তান পাসপোর্ট ও ক্রেডিট কার্ড দুই-ই হারিয়েছেন।

আমি দাঁড়িয়ে পড়ে জানতে চাই, ‘হোয়াট দ্য হেল ইজ গোয়িং অন?’ জিম রা কাড়েন না। বিরক্ত হয়ে গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলি, ‘বাপু – কী সমাচার?’ জবাবে তিনি জানান, আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী, ক্যারোল ভালোবাসে ফুল, তাই তিনি তালাশ করছেন পুষ্পের। আমি বলতে চাই, ইথিওপিয়ার এই মরু-অঞ্চলে শ্যামল পত্রলতার আক্রায় বিলা হয়ে – চাইলে তালুর অবশিষ্ট চুল ছেঁড়া যায়, কিন্তু ফুল কুড়ানো যায় না। আমার বক্তব্য মনেই থেকে যায়, মুখ দিয়ে বহির্গত হওয়ার সুযোগ পায় না। একটি আওয়ারা গোছের রঙচটা উট এসে জিমের টেকো মাথার ওপর দিয়ে কাঁটা ঝোপে মুখ দেয়। দীর্ঘগ্রীবা এ-জানোয়ারের আচমকা উপস্থিতিতে চমকে উঠে ‘জিসাস ক্রাইস্ট’ আওয়াজ দিয়ে জিম পা-কয়েক পিছিয়ে আসেন।

আমি তাকে সরাইতে ফিরে যেতে অনুরোধ করি, তিনি চকচকে চাঁদিতে হাত বুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘লুক ম্যান, ক্যারোলের কাছে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ, অ্যামং মেনি থিংস, শি টট মি হাউ টু মেক লাভ উইথ অ্যা ওয়োম্যান প্রপারলি।’ শিক্ষাটা যে পুরুষদের জিন্দেগিতে অত্যন্ত জরুরি, এছাড়া ঈপ্সিত দয়িতার বন্দেগি করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়, এ-বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে উৎসাহ দিই, ‘জিম, ফুল-টুলের ধান্দা আজ বাদ দাও। বরং ক্যারোলের কাছ থেকে যা শিখেছো তা মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করো।’ আমার প্রস্তাবে তিনি পজিটিভভাবে সাড়া না দিয়ে মিনমিনিয়ে নালিশ জানান, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড … নো ওয়ান হ্যাজ অ্যানি প্রাইভেসি ইন দিস স্টুপিড সরাই।’ আমরা পর্যটক পঞ্চজন একই কামরায় একত্রে নিশিযাপন করছি – এহেন পরিস্থিতি জিমের পক্ষে ক্যারোলের প্রতি রোমান্টিক হওয়ার পথে অন্তরায় বিশেষ।

আবালা গ্রামের একমাত্র গির্জায় ঢংঢং করে আওয়াজ হয়। তাতে আমার নীরব প্রতিফলনের সূত্র কেটে যায়। চোখ তুলে দেখি, পানির চৌবাচ্চার পাশে ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলগামেরা আমারি। মেয়েটি আলী নাজ্জাস গালগামোশের তৃতীয় পত্নী। সরাইয়ে গেস্টদের জন্য রান্নাবান্না ও ভোরবেলা গাধার পিঠে জ্যারিক্যান চাপিয়ে পানি আনা ইত্যাদি তার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আমারি এমন ভঙ্গিতে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে আছে যে, মনে হয়, তার বিষাদের সঙ্গে মিশে গেছে একধরনের বিস্ময়। আমার দৃষ্টিপাতে সচেতন হয়ে তরুণীটি এগিয়ে এসে আমাকে গোসলখানার দিকে ইশারা করে।

আমি ইথিওপিয়ার দানাকিল ডিপ্রেশন বলে পরিচিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে সপ্তাহদিন ধরে সফর করছি। এদিকে পানীয়জল অত্যন্ত দুর্লভ। দিনচারেক আগে অন্য পর্যটকদের সঙ্গে মিলেঝুলে স্নান করেছি একটি লবণ হ্রদে। পরিণতিতে গায়ের চামড়ায় নুন শুকিয়ে চড়চড়ে হয়ে আছে। গোসলের সম্ভাবনা অনুধাবন করতে পেরে, অন্য সহযাত্রীদের সুযোগ নেওয়ার আগেই স্বার্থপরের মতো আমি দ্রুতগতিতে স্নানাগারে ঢুকি।

অ্যানামেলের মগ দিয়ে ঘাড়ে-মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে, আমার শরীর জুড়ানোর সঙ্গে আমারি নামে আফার গোত্রের এক তরুণীর হাড়ভাঙা খাটুনির সম্পর্কের কথা ভাবি। ভোরবিহানে – আমি সড়কে নামারও আগে সম্ভবত সে জলঝোরাতে গিয়েছে। চৌবাচ্চাভর্তি জল সংগ্রহ করতে তাকে কম-সে-কম পাঁচবার যাওয়া-আসা করতে হয়েছে। বিদেশ বিভুঁইয়ে এটি একটি বিরল সাহায্য; কিন্তু ভাষাগত ব্যবধানের জন্য চাইলেও তাকে আমি ধন্যবাদ দিতে পারবো না। তাকে কোনো উপহার দিতে গেলে অবধারিতভাবে হবো স্বামী নাজ্জাস গালগামোশের উষ্মার কারণ। এ-ব্যাপারে আমাদের পর্যটন গাইড মুলাগেটা নাগাসি ফিসফিসিয়ে আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।

আমি সাবান মাখতে মাখতে তার আরেকটি শোভন আচরণ নিয়ে ভাবি। দানাকিল ডিপ্রেশনের মরুবালুকায় খানিকটা ট্র্যাক করে আমার পায়ে ফোস্কা পড়েছে। গেল রাতে আঙিনায় বসে মোজা খুলে তাতে হাত বুলাচ্ছিলাম। বিরাট একটি হামানদিস্তায় কিছু চূর্ণ করতে করতে আমারি তা খেয়াল করে। কিছুক্ষণ পর নীরবে সে একটি গামলায় লবণ মেশানো গরম জল নিয়ে আসে। এ-অঞ্চলে পানীয়জল সম্পদ বিশেষ, ব্যবহার করতে হয় সংযতভাবে, জলের অভাবে হামেশা বাধে দাঙ্গা-হাঙ্গামা।

তোয়ালে টেনে নিয়ে শরীর ডলি, সঙ্গে সঙ্গে আমার করোটিতে একটি আইডিয়া খেলে যায়। মনে হয়, চাইলে আমারিকে নিয়ে আমি অল্প কথায় একটি ছোটগল্প মুসাবিদা করতে পারি। তার দিনযাপন সম্পর্কে কিছু কথা আমার কানে এসেছে অন্য এক সহযাত্রী পর্যটক ডারোথির কাছ থেকে। জাতিসত্তায় ব্রিটিশ রমণী ডারোথি হালফিল বসবাস করছেন জিব্রালটারে। পেশায় এনথ্রোপলজিস্ট এ-নারী ইথিওপিয়ায় বছরতিনেক ফিল্ড রিসার্চ করেছেন। স্থানীয় ভাষা আমারিক ভালোই বলেন। ডারোথি এবার ফিরে এসেছেন, দানাকিল ডিপ্রেশনের আশপাশে বাসরত আফার গোত্রের সামাজিক রীতি-রেওয়াজ নিয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে। গালগামোশ সরাইতে পা দিয়েই তিনি গাইড মুলাগেটা নাগাসিকে চুপিসারে ইন্টারভিউ করে জেনে নিয়েছেন আলী নাজ্জাসের তিন স্ত্রী সম্পর্কে অঢেল তথ্যাদি।

নিকট-অতীতে আলগামেরা আমারি ছিল নাজ্জাস গালগামোশের এক দেশওয়ালি সুহৃদের স্ত্রী। তার সুহৃদ একদিন কী কারণে জানি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে তালাক দেন। বিকাল বেলা মেজাজ ঠান্ডা হলে তাকে ফের বিবাহ করতে চান। আফার সংস্কৃতিতে যত সহজে তালাক দেওয়া যায়, তত সহজে পুনরায় বিয়ে করা যায় না। তো বিধানের জন্য গালগামোশের দোস্ত মসজিদের ইমামের শরণাপন্ন হন। ইমাম সাহেব হিল্লা পালনের ফতোয়া দেন।

বিশ্বস্ত দোস্ত আলী নাজ্জাস গালগামোশের সঙ্গে সেদিন সন্ধ্যায় তালাকপ্রাপ্ত আমারির আকদ্ হয়। কড়ার হয় যে, বাসর রাত কাটিয়ে হিল্লার মেয়াদ শেষ হলে পর গালগামোশ তাকে তালাক দেবেন। অতঃপর মেয়েটি ফের বিবাহিত হবে তার সাবেক স্বামীর সঙ্গে। কথা অনুযায়ী একদিন পর দোস্ত গালগামোশের দুয়ারে হাজির হন প্রাক্তন স্ত্রী আমারিকে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু গালগামোশ হিল্লা নেওয়া নারীকে ফিরিয়ে না দিয়ে দোস্তকে গোল্লায় যেতে বলেন। তিনি অজুহাত দেন যে, ভিন্ন পুরুষের স্পর্শপ্রাপ্ত নারীটিকে উটের দুধ, মধু, দুর্মূল্য জাফরান, ঘি ও আরো কী কী দিয়ে পরিশুদ্ধ করে তিনি শয্যা পেতেছেন। এই পিউরিফিকেশন প্রক্রিয়ায় তার খরচাদি হয়েছে বিস্তর।

অতঃপর তাদের মধ্যে বাধে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। রক্তারক্তি হয়, কিন্তু পরিশেষে বিজয়ী হন গালগামোশ। তিনি সামান্য আহত হলেও দোস্তকে ছুরিকাঘাতে ব্যাপকভাবে জখম করতে সমর্থ হন। আমারি পার্মানেন্টলি তার করতলগত হয় বটে, তবে দোস্তের পরিবারের সঙ্গে তার দুশমনী আজ অবধি বহাল আছে। এ-কারণে আলী নাজ্জাস গালগামোশ আফার গোত্রের পুরুষদের রেওয়াজমাফিক হাতিয়ার জাইল বা কাটাইলের মতো দেখতে ধারালো ছুরিকা ছাড়াও কোমরবন্ধে পিস্তল ঝুলিয়ে চলাফেরা করেন।

গোসল করে ঝরঝরে হয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি। গালগামোশ সরাইয়ের একদিকে বাস করছে আলী নাজ্জাসের তিন পত্নী ও হরেক সাইজের গোটা আষ্টেক বালবাচ্চা। আমি গলিপথে পা দিতেই, তার তিন বালক-পুত্র দরোজার সামনে থেকে একসঙ্গে ‘ইয়া সুলতান’ বলে আওয়াজ দেয়। একটি লেখাপড়া করতে করতে পরিষ্কার ইংরেজিতে ডিমান্ড করে, ‘গিভ অ্যাস ক্যান্ডি।’ এদের ইতিমধ্যে আমি বারদুয়েক চকোলেট ও কাঠিলজেন্স দিয়েছি, তাই বলি, ‘নো, হ্যাভ নো ক্যান্ডি।’ জবাবে বিরক্ত হয়ে তারা ভ্যাঙায়। একটি বালক আলজিভ অবধি বের করলে, আমি ফুচুৎ করে তার ছবি তুলে আবালা গ্রামের বাজারের দিকে মেলা দিই।

গলির গোড়া থেকে শুরু হয়েছে আবালা গ্রামের গাছ-বৃক্ষ ও ডালপালাহীন ট্রেডিং পোস্টের বিস্তার। পাথুরে একটি পাহাড়ের তলায় রাজসড়কটির দু-পাশে গরিবি হালতের কয়েকটি ক্রেতাহীন দোকানপাট ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ে না। দুটি ট্রাক ও মূলত পর্যটক ক্যারি করা দু-একটি গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো যানবাহনও নেই। এলাকাটি মিলিটারিশাসিত। কাছে প্রতিকূল দেশ ইরিত্রিয়ার সীমান্ত। দুটি দেশের মধ্যে একাধিকবার হয়ে গেছে যুদ্ধবিগ্রহ। আফার কিছু তরুণ স্বাধীনতার পণ করে যাপন করছে গেরিলাদের ভ্রাম্যমাণ লুকোছাপা জীবন।  এদের দমন করে শান্তি বজায় রাখতে সর্বত্র আছে মিলিটারি চেক পয়েন্টস। ভোরবিহানে আবালার বাজারে সেনানীদের টহল দিতে না দেখে আমি স্বস্তিবোধ করি।

চলে আসি মসজিদের দেয়ালের কাছে। ফুটপাতের ওপর গোল হয়ে বসে জনাকয়েক মানুষ গুল্পগুজব করছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে তারা চোখ তুলে তাজ্জব হয়ে তাকান! আমি তাদের সালাম দিই, সবাই একসঙ্গে শোরগোল করে জবাব দেন, ‘আলুকুম সালুম ও রহমোতুম।’ বচনের ভিন্নতায় ভড়কে গিয়ে আমি হে হে করে তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যাই।

গাইড মুলাগেটা নাগাসিকে নিয়ে আমি গতকাল এ-মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ি। তারপর ইমাম সাহেবের সঙ্গেও আফার গোত্র সম্পর্কে কথাবার্তা হয়। জানতে পারি, আফার সম্প্রদায়ের মানুষজন ইথিওপিয়া ছাড়া পাশের দুটি দেশ ইরিত্রিয়া ও জিবুতিতে বসবাস করছেন। কিছু আফার আম-আদমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন সোমালিয়ায়। ইমাম জোর দিয়ে দাবি করেন, তাদের বংশলতিকার শিকড়ে আছেন পয়গম্বর হজরত নুহ (আ.)। আফাররা তাঁর পুত্র হাম-এর বংশধর। একসময় আফারদের ছিল একাধিক রাজ্য, এবং প্রতিটি শাসিত হতো কোনো না কোনো পরহেজগার সুলতান দ্বারা।

আমি আবালা ট্রেডিং পোস্ট সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি কোনো দ্বিধা না করে বলেন, তাঁর গোত্র যুগ যুগ ধরে যোদ্ধা জাতি হিসেবে পরিচিত। এক জামানায় পরাজিত গোত্রের বন্দি নারী-পুরুষদের এ-বাজারে নিলাম ডেকে বিক্রি করা হতো। ক্রেতাকুলের সওদাগররা আসতেন ইয়েমেন থেকে। উটের কাফেলা পরিচালনায়ও আফার গোত্রের ক্যারাভান মাস্টারদের দক্ষতা অপরিসীম। তারা আরব সওদাগরদের হয়ে বন্দি ক্রীতদাসদের জাজিরাতুল আরবে পৌঁছে দিত। ফেরার সময় উটের পিঠে চাপিয়ে নিয়ে আসতো মধ্যপ্রাচ্যের নানাবিধ সওদা, যা বিক্রি হতো এ-বাজারে।

মসজিদের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইমাম সাহেবের দেওয়া তথ্য নিয়ে ভাবছিলাম। ত্রয়োদশ শতকে আন্দুলিশিয়ান ঐতিহাসিক, কবি ও পর্যটক ইবনে সাইদ আলা মাগরিবি তাঁর কিতাব আল জুগরাফিয়া গ্রন্থে এ-এলাকায় ক্রীতদাস ব্যবসা সম্পর্কে বিশদ উল্লেখ করেছেন। বালু ও ভাঙা পাথরের স্তূপে খেলারত ছেলেমেয়েরা ‘ইয়া ক্যান্ডি ইয়া ক্যান্ডি’ আওয়াজ দিয়ে আমার দিকে ধেয়ে এলে, আমার নীরব ভাবনার সূত্র ছিঁড়ে যায়। তারা অ্যাগ্রেসিভভাবে ক্যান্ডি ডিমান্ড করে। আমি বিরক্ত হয়ে বলি – ‘নো হ্যাভ নো ক্যান্ডি।’ তারা ভাঙা পাথরের টুকরো তুলে ঢিল ছোড়ার ভঙ্গিতে আমাকে ধাওয়া করে। আমি রাজসড়ক ছেড়ে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ি গ্রামের গলিতে।

একটি বড়সড় ছেলে দৌড়ে এসে আমার দিকে থুতু ছুড়ে বলে, ‘ফাক ইউ – ব্লাডি সাকার।’ ভাবি – ইংরেজদের উচ্ছিষ্ট এ-খবিস লবজটি তো এ-ছেলে বেশ দক্ষতার সঙ্গে শিখেছে। আন্দাজ করি, ইবনে বতুতা বা হিউয়েন সাংকে এ-ধরনের উৎপাতের মোকাবিলা করতে হয়নি। ছুড়ে দেওয়া একটি পাথর এসে আমার চশমার পাশ দিয়ে পন্ করে উড়ে যায়। আমি সামনে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবি, পাহাড়িপথে গাড়ির ক্রমাগত জারকিংয়ে বমন উদ্রেকের মতো ভ্রমণও হাফফিল বিস্বাদ হয়ে উঠেছে।

আরো কয়েকটি ছেলেমেয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উট কিংবা গর্দভের বিষ্টার শুকনা চাকলা নিয়ে আমাকে অ্যামবুশ করতে এগিয়ে আসে। আতঙ্কে আমার ‘ইয়া নফসি’ পাঠ করার উপক্রম হয়। গলির অন্য মাথা থেকে মুশকিল আসানের মতো এগিয়ে আসেন মসজিদের ইমাম আগনফর মোহাম্মদ মুরাকুচি। তাতে চিলের ছায়া দেখতে পাওয়া মুরগির ছানাপোনার মতো বাচ্চাগুলো দ্রুত পালিয়ে যায়। আমি তাঁকে তাজিমের সঙ্গে সালাম দিই। তিনি থেমে হাত নেড়ে জবাব দিয়ে ফের আগ বাড়েন। গেল রাতে বাদ-মাগরিব গাইড মুলাগেটাকে নিয়ে আমি মক্তবের লাগোয়া চালাঘরে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছি। তখন তিনি দেয়ালে ঝোলানো হরেকরকমের কাঁটাওয়ালা লাঠি, বেত ও চামড়ার চাবুক দেখিয়েছিলেন। এ-হাতিয়ারগুলো ইমাম মুরাকুচি হামেশা ব্যবহার করে থাকেন মক্তবে শিক্ষাদানের সহায়ক হিসেবে। আমি তাঁর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, মক্তবের বেধড়ক বেত্রাঘাতেও কিন্তু ছেলেমেয়েদের বেতমিজি দূর হয়নি।

বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড ও ইরিত্রিয়ার সঙ্গে লড়াই-বিড়াইজনিত কারণে ইথিওপিয়ার এ-অঞ্চলে চলছে লাগাতার মর্শাল ল’। কোনো উন্নয়ন সংস্থা সচরাচর এখানে কাজ করতে চায় না। বছরচারেক আগে নাকি একটি ইতালিয়ান এনজিও সরকারের অনুমতি নিয়ে এদিকে প্রকল্প করতে চেয়েছিল। প্রথমে তারা গ্রামের বালিকাদের জন্য একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক স্কুল খোলে। ইমাম মুরাকুচি এতে ব্যাপকভাবে বিরাগভাজন হন। অতঃপর তারা ডিপ টিউবওয়েল খুঁড়তে গেলে তিনি এর বিরুদ্ধে পরিষ্কার ফতোয়া দেন। আফার সম্প্রদায়ের মোড়ল-মুরব্বিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, কলের পানি পানে সোমত্থ মেয়েদের শুধু গর্ভপাতই নয়, পুরুষদেরও নপুংসক হওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। তো আফার গোত্রপতিরা খেপে গিয়ে, এনজিও ওয়ার্কারদের গলায় মৃত গাধার চামরের মতো দেখতে লেঙ্গুড় ঝুলিয়ে দিয়ে তাদের এলাকাছাড়া করে। এ-কাহিনিটি আমি শুনি আদ্দিস আবাবায় – এক ইতালিয়ান এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টরের মুখে।

আমাদের গাইড মুলাগেটা ভারী করিৎকর্মা। চর্বে-চালাকের মতো হামেশা পর্যটকদের তুষ্ট করার ফন্দি আটেন। আমি ইমাম মুরাকুচির জবানবন্দি নিতে চাচ্ছি জানতে পেরে তিনি ফিসফিসিয়ে স্রেফ টাকার অংকটি জানান। আমি তা কবুল করে নিয়ে তার সঙ্গে বেরোই মসজিদ-অভিযানে। প্রথমে বাজার থেকে খরিদ করি লুঙ্গি ও গোলমোল একটি কিস্তি টুপি। ইমাম সাহেব পছন্দ করেন খেজুর, মধু ও ঘি। দোকানে এসব পণ্য পাওয়া যায় সহজে। আফারদের ভাষাতে প্রচলিত আছে প্রচুর আরবি শব্দ। তারা উষ্ট্রদুগ্ধের থিকথিকে ক্বাথকে আমাদের মতো ঘি বলে থাকে। বস্তুটি স্বাদে মুখরোচক নয়, তবে দামে সস্তা। খাদ্য ছাড়া রোগ নিরাময়, গাত্রে মর্দন থেকে সংগম অবধি এর ব্যবহার বিস্তৃত। এসব উপহারের সঙ্গে নগদ কড়ি জুড়ে দিয়ে মসজিদের বারান্দায় ইমাম সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।

লুঙ্গিপরা বাঙালি মুসলমানের জন্মগত ক্রিডেনশিয়েলে সন্তুষ্ট হন না তিনি। ভাইবা নেওয়ার মতো নানাবিধ প্রশ্ন করেন। জানতে চান, আমরা কীভাবে কলেমা পাঠ করি? আমি উচ্চারণ করে শোনাই। পরের প্রশ্নে তিনি খোলাফায়ে রাশেদিনের চার খলিফার নাম শুনতে চান। আমি ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় এ-পরীক্ষায়ও সফলভাবে উত্তীর্ণ হই। তিনি অতঃপর আতরের শিশি খুলে, আমাকে কদুর তেলের মতো উৎকট গন্ধঅলা লালচে তরলের সামান্য একটু অফার করে মসজিদের ভেতরে ঢোকার পারমিশন দেন।

নামাজের পর আমরা কথাবার্তা বলতে মক্তব সংলগ্ন চালাঘরে বসি। কামরাটির দেয়াল থেকে আংটায় ঝুলছে নানা রঙের তাগা ও প্রচুর পরিমাণে তাবিজের ধাতব কবজ। ইমাম টুলে রাখা গামলাভর্তি পানির দিকে তাকিয়ে আমাকে কলেমা শাহাদত পড়তে বলেন। তিনি বাটি থেকে ঘৃত আঙুলে তুলে, দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে তা মাখিয়ে দেন আমার কপালে। মুলাগেটার ব্যাখ্যায় বুঝতে পারি, ইমাম জানতে পেরেছেন যে, দিনচারেক পর আমি ‘অ্যারতে ওলে’ নামক একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভা-কুণ্ড দেখতে যাচ্ছি, জায়গাটি হরেক কিসিমের অশরীরী কবন্ধে কিলবিল করছে। চর্মচক্ষে সচরাচর দেখা যায় না বটে, কিন্তু তাদের আছর কপালে লাগলে তা থেকে নিরাময় লাভ দুরূহ। ইমাম পবিত্র কোরান শরিফের একটি আয়াত পড়ে তার রেফারেন্স দিয়ে বলেন, আল্লাহপাক জিনদের সৃষ্টি করেছেন প্রজ্জ্বলন্ত অগ্নি থেকে। এরা আগুনের সরোবরে বসবাস করতে পছন্দ করে। অ্যারতে ওলের লাভা-কুণ্ডটি হচ্ছে তাদের আবাসিক এলাকাবিশেষ। খোদ জিনের বাদশাহ ওখান থেকে পরিচালনা করেন তার প্রশাসন। গায়েবি প্রতিষেধক ছাড়া আগুনের রাজ্যে ঢুকে পড়াটা হবে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের মতো।

ঘৃতের মালিশে আমার কপাল জবজবে হয়ে ওঠে। ভুরু বেয়ে তা ঝরে ফোঁটায় ফোঁটায়। আমার অস্বস্তি দেখে ইমাম তার চিটচিটে গামছাখানা বাড়িয়ে দেন। বস্ত্রটি সম্ভবত খচ্ছড়ের লোম দিয়ে বোনা। ডলাডলির সময় মনে হয় – কপালে শিরিষ কাগজ ঘষছি। ইমাম বড়সড় একটি কবজ আমার হাতে তুলে দিলে – মুলাগেটা ফিসফিসিয়ে এ জিন প্রতিরোধক রিচুয়েলের জন্য হাদিয়ার অংকটি বলে। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার হাতে টাকা তুলে দিয়ে দুটি সওয়ালের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করি। ইমাম সাহেব হাসিমুখে সম্মতি দেন।

আমি মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর মতামত শুনতে চাই। তিনি চটে উঠে তড়বড় করে বেশ কিছু কথাবার্তা বলেন। প্রচুর সময় নিয়ে মুলাগেটা যে তর্জমা করে তার সারাংশ হচ্ছে, নারীশিক্ষার প্রচারকারী বিদেশি সাহায্যকারী সংস্থা সম্পর্কে তো হাদিস-কালামে পরিষ্কারভাবে ‘সাফ হারাম’ বলা হয়েছে। এ-খোদাদাদ নিষেধাজ্ঞা না মেনে বালিকাদের স্কুলে পাঠালে, এরা যা শিখবে তা হলো, শরীরের সুগোল রেখা প্রস্ফুটিত করে, আঁটোসাঁটোভাবে জড়িয়ে সানাফিল নামক রঙিন র‌্যাপ-আরাউন্ড ড্রেস পরা, তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নাম করে নিতম্ব দুলিয়ে ড্যান্স করা। পিতামাতার উচিত তেরো-চৌদ্দো বছরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বালিকাদের চটজলদি বিবাহ দেওয়া। তিনি লেহেন দিয়ে একটি হাদিস তেলাওয়াত করে তাঁর জবাবের কনক্লুশনে বলেন, ‘কম বয়সে বালিকাদের তলপেট থাকে সন্তান ধারণের জন্য প্রশস্ত।’

ইমাম সাহেব বাটি থেকে খানিকটা ঘৃত তুলে নিয়ে দু-হাতে ডলে তা শুঁকে শুঁকে সম্ভবত ক্রোধ প্রশমন করেন। তারপর আঙুল দিয়ে দাড়ি আচমন করতে করতে জানতে চান, সংখ্যায় আমার স্ত্রী কতজন এবং বালবাচ্চা কয়টি? জবাবে আমি শাহাদাত আঙুল তুলে ইশারায় এক জানালে ভারি স্নেহের স্বরে তিনি উপদেশ দেন। মুলাগেটার তর্জমায় বুঝতে পারি, বিবাহিত বিবির সংখ্যা একাধিক হলে সংসারে বাচ্চাকাচ্চা হবে প্রচুর। আখেরে তা কাজেও লাগবে, বিশেষ করে ছেলেসন্তান। গোটা কয়েক ছেলে হলে, একটি হয়তো কাফেলায় উটচালকের কাজ করলো, অন্যটি ছাগলের দেখভাল করবে, তৃতীয়টি শুরু করবে বাজারে নুনের তেজারতি। অবশ্য মেয়েশিশু হলেও খারাপ কিছু না, বরের বাবাদের কাছ থেকে আদায় করা যাবে ব্যাপক ব্রাইড প্রাইস।

আমি এবার প্রশ্নের বিষয়বস্তু বদলিয়ে অনুরোধ করি, এ এলাকায় কে কার সঙ্গে কী কারণে যুদ্ধে লিপ্ত আছে, গেরিলাদের দাবি কী, তা একটু ব্যাখ্যা করে বলার জন্য। ইমাম চোখ কুঁচকে বেশকিছু কথাবার্তা জোর দিয়ে বলেন। কিন্তু বুঝিয়ে বলতে গিয়ে মুলাগেটা এমন ভজঘট করে যে, তৎক্ষণাৎ তৈরি হয় তর্জমা-সংকট, ঠিক বুঝতে পারি না – কে কার প্রতিপক্ষ, এবং কী কারণে অঘোষিতভাবে চলছে লাগাতার সামরিক তৎপরতা। পরিস্থিতির বর্ণনা করে ইমাম বারবার ‘গন্ধেগার’ বলে একটি শব্দ উচ্চারণ করেন, আন্দাজ করি – সমস্ত কিছু ধুলায় অন্ধকার, আর আলাপ করে বিশেষ কিছু জানা যাবে না। তাই ‘শোকরান’ বলে আমি বিদায় নিই।

ইমাম আগনফর মুরাকুচির সঙ্গে গেল রাতে আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে ভাবতে  ভাবতে চলে এসেছি গলির শেষ মাথায়। আমাদের পরবর্তী প্রোগ্রাম – একটি রিফিউজি ক্যাম্পে যাওয়া। মুলাগেটা নাগাসি স্থানীয় মিলিটারি কমান্ডারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পারমিশন নিতে গেছে। শরণার্থী শিবিরে যদি যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলেও ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে যাত্রা শুরু হবে না। সরাইতে ফিরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সুরুজের তেজ এখনো তেতে ওঠেনি। ভাবি, একটু ঘুরপথে ফের বাজারে ঢুকি। আই মাস্ট ট্রাই মাই লাক, শিশুরা হয়তো পর্যটককে একবার ধাওয়া দিয়ে এখন পরিশ্রান্ত, আমি আবার আক্রান্ত নাও হতে পারি।

রাজসড়কে ফিরে এসে বাজারের সর্বত্র চোখ ফেলে সাবধানে স্ক্যান করি। বেতমিজ বাচ্চাগুলো যেন জাদুবলে উবে গেছে, কোথাও তাদের সাড়াশব্দ না পেয়ে বড় আনন্দ হয়। গাধায় টানা একটি গাড়ি খটখটিয়ে ধুলো উড়িয়ে আগে বাড়ছে। তাতে জবাই করা উটের অর্ধাংশ, টুপটাপ করে ঝরছে রক্ত। কোচওয়ানের রংচঙে লুঙ্গির ওপরে পেঁচিয়ে পরা চামড়ার পেটি থেকে ঝুলছে একখানা ঝলমলে জাইল বা আফারদের পৌরুষব্যঞ্জক পরিচিতি বাঁকানো ছুরিকা। গাধার গাড়ি খানিক দূরে যেতেই দেখি, সড়কের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ডারোথি। তার খিকড়ানো চুলের প্রান্ত লোহিত ও সোনালি রঙের হাইলাইলে রঞ্জিত। ডারোথি এক-পা দু-পা করে আগ বাড়ছেন, দমকা হাওয়ায় উড়ছে তার দীর্ঘ কেশরাশি; হাইলাইটে মরু-সূর্যের রোশনি পড়ে মহিলার মস্তকটি হয়ে উঠেছে শবেবরাতের ফুলঝুরির মতো বিচ্ছুরণে বর্ণময়। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে তার অপেক্ষা করি।

পেশাদার এনথ্রোপলজিস্ট ডারোথির ঠান্ডা মাথায় রিস্ক-সংকুল পর্যটনের পরিকল্পনা করার দক্ষতা প্রচুর।

ইথিওপিয়ার মেইনস্ট্রিমের ভাষা আমারিক তিনি বলেন বেশ ভালোই। তবে শরাব পানে আবেগপ্রবণ হলে পাগলামি করেন সীমিত মাত্রায়। দিনতিনেক আগে আমরা একত্রে দানাকিলের একটি লবণ হ্রদে ঘুরপাক করি। নুনের চরাচরব্যাপী শুভ্র স্তরের ওপর সবুজাভ জল গোধূলিতে বর্ণবহুল হয়ে উঠেছিল। তখন তিনি ওজো নামে একটি কড়া ধাচের গ্রিক আরক নিজে পান করে বাকিটুকু সহযাত্রীদের অকাতরে বিলিয়ে দেন। সল্ট লেকের আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত চরম, ১২২ ডিগ্রি ফরেনহাইটের গরমে লবেজান হয়ে ডারোথি লবণাক্ত জলে চুবাচুবিও করেন খানিকটা।

তিনি পরে ছিলেন সানাফিল নামে সুতি বস্ত্রের র‌্যাপ আরাউন্ড ড্রেস। আর্দ্রতায় তা ভেদ করে তার ইয়োগা করা দেহটি খাজুরাহের দেয়াল কুঁদে তৈরি মূর্তিটির মতো প্রবল হয়ে উঠেছিল। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরুষ পর্যটকদের দু-একজনও তাদের ব্যাকপ্যাক থেকে বের করেছিলেন কনিয়াক কিংবা হুইস্কির ফ্লাস্ক। ফের পান করে মহিলা জলভরা নুনের উপত্যকায় উপস্থাপন করেছিলেন, ইথিওপিয়ার অ্যাপিল ছড়ানো তরুণীদের প্রিয় জিনাইল নৃত্য। এ-নাচে কাঁধের নিচে ঊর্ধ্বাঙ্গ জুড়ে তৈরি হয় ক্রমাগত কম্পন, সঙ্গে কোমরের দোলও উল্লেখযোগ্য। গেল রাতে ইমাম মুরাকুচি আফার গোত্রের কিশোরীদের সানাফিল পরে জিনাইল ড্যান্সে মশগুল হওয়ার বিষয়ে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছিলেন।

বাজারের এদিকে ডারোথির আসতে বিস্তর দেরি হচ্ছে। মহিলা এত ধীরে হাঁটছেন কেন? অধৈর্য হয়ে বিষয়টি বোঝার জন্য ফের নিরিখ করে তার দিকে তাকাই। মনে হয়, ডারোথি প্রতিটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে নোটবুকে কিছু একটা টুকছেন এবং ঘরদুয়ারের স্কেচ করে নিচ্ছেন। গেল রাতে লণ্ঠনের আলোয় সাঁওতালদের বিবাহসংক্রান্ত রীতি-রিচুয়েল নিয়ে তার লেখা একটি প্রবন্ধ পড়েছি। যেভাবে তিনি সাঁওতাল গ্রামের সামগ্রিক পরিবেশের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে ফুটে উঠেছে তার ডিটেইলড পর্যবেক্ষণের দক্ষতা। বিহারের সাঁওতাল পরগনার একটি গ্রামে ডাটা কালেকশনের জন্য ছিলেন মাসতিনেকের মতো। বছরের বাকি সাত মাস তিনি ঘুরে বেড়ান ভারতের নানা জায়গায়, বাস করেন বিবিধ আশ্রমে। ইয়োগা ছাড়া হরেক কিসিমের তন্ত্রমন্ত্রের সঙ্গে সম্ভবত ডারোথির সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে ওই সময়। ভোরে ইয়োগা-ম্যাটে শিরদাড়া খাড়া করে বসে খোনা স্বরে ডারোথি পাঠ করেন গায়ত্রী মন্ত্র। তারপর ষড়যন্ত্রে মাতেন গাইডের সঙ্গে। আজকে রিফিউজি ক্যাম্পে যাওয়ার আইডিয়াটা আমার, অন্য সহযাত্রী ক্যারোল তাতে সমর্থন জুগিয়েছেন, কিন্তু উদ্যোগ কিছু নেননি। ডারোথি গাইডকে ফুসলিয়ে, কড়িপাতি দিয়ে পাঠিয়েছেন মিলিটারি ক্যাম্পে পারমিশনের জন্য।

হাওয়ায় উলুলঝুলুল হওয়া চুলে লালচে সোনালি ফুলঝুরি উড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসেন ডারোথি। তার গলায় রুদ্রাক্ষের সুদীর্ঘ মালা, তিনি এমন ছন্নের মতো চারদিকে তাকাচ্ছেন, মনে হয়, খ্রিষ্টীয়-মঠে তপজপ করতে গিয়ে কোনো নান বুঝিবা হারিয়ে ফেলেছেন নিজস্ব বাইবেল। জানতে চাই, ‘হোয়াট ইজ দ্য ম্যাটার?’ জবাবে তিনি জানান যে, কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না তার থার্ম ফ্লাস্কটি। মহিলার ক্রমাগত চা পান করে নিশি জাগরণ করার অভ্যাস আছে, অ্যাকাডেমিক অর্জন এ-কারণে তার অশেষ। চলার পথেও ডারোথি বহন করেন থার্ম-ফ্লাস্কভর্তি বেজায় বিস্বাদ ব্ল্যাক টি। সমাধান হিসেবে বলি, একটি ফ্লাস্ক কিনে নিলেই তো হয়। ঠিক কনভিন্সড না হয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বলেন, এ জ্বলা-পুড়া জায়গায় জরুরি কিছু পাওয়া যাবে কি? গতকাল আমি একটি মুদি কাম মনোহারি দোকান থেকে লুঙ্গি কেনার সময় ওখানে মেলামাইনের তৈরি চায়ের পেয়ালা-পিরিচ দেখেছি । ভরসা দিয়ে বলি, ‘লেটস গো দ্যাট ডিরেকশন, ডারোথি।’ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাকে অবলোকন করে তিনি আমার সঙ্গে রওনা হন।

আমরা এসে পড়ি বাজারের এক মনমরা গলিতে। এখানে কাদামাটির ঘরদুয়ারের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ও বসে বেশ কতগুলো গাধা। ডারোথি রাখালদের সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলেন, জানতে পারি – জায়গাটি ভারবাহী জন্তুদের ডংকি-স্টপের মতো। চাইলে এখান থেকে একটি গর্দভ ভাড়া করে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া যায়। বাজার থেকে পাইকারি হারে কেনা সদাইপাতি বহনেও এদের অবদান অসামান্য। খানিক দূর দিয়ে জোড়া গাধার পিঠে রাজ্যের খড়িকাঠ চাপিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাখাল। ডারোথির মাথায় ফের স্কেচ করার বাই চাপে। তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে পেন্সিল দিয়ে ক্লিপবোর্ডে গাঁথা কাগজে আঁকিবুকি করেন। বারুণীর মেলায়, কাচ-বসানো বাক্সে বায়োস্কোপ দেখার মতো তাকে ঘিরে জমে বালক-বালিকাদের ভিড়।

ডারোথি অতঃপর পথশিশুদের হাতে ডজনখানেক টিপকলম তুলে দিয়ে আগ বাড়েন। পেছন থেকে সমবেত কণ্ঠে শোরগোল ওঠে, ‘হিপ হিপ হুররে …।’ ফুটবল মাঠে গোলে সিদ্ধকাম হলে আনন্দ প্রকাশের যে আওয়াজটির সঙ্গে আমি আশৈশব পরিচিত, তার সৃজনশীল ব্যবহার দেখে বড্ড প্রীত হই।

দোকানের পথে দেখা হয় ক্যারোল ও তার স্বামী জিমের সঙ্গে। ক্যারোল যুক্তরাষ্ট্রে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন প্রকল্পে কাজ করতেন। ট্রাম্প প্রশাসন এ-ধরনের কর্মসূচি থেকে সরকারি অনুদান তুলে নিলে মহিলা চাকরিচ্যুত হন। একসময় তিনি ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষতাড়িত রিফিউজিদের বাসস্থান ও কর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন। তখন ইথিওপিয়ার কিছু শরণার্থীর সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তার আন্তরিক সম্পর্ক। মহিলা জীবনে কখনো যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সফর করেননি। ইথিওপিয়ানদের দিনযাপন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের জন্য স্বামী জিমকে সঙ্গী করে এদেশে এসেছেন।

দানাকিল ডিপ্রেশনের এ-অঞ্চলে পর্যটনী ইনফ্রাস্ট্রাকচার তথা পেশাদারিভাবে পরিচালিত গেস্টহাউস ইত্যাদির ভীষণ অভাব ও প্রচণ্ড গরমে ভ্রমণ অত্যন্ত স্ট্রেসফুল। তাই বিদেশ সফরে ক্যারোল তেমন কিছু উপভোগ করছেন না, শুধু অভিযোগ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এ-মুহূর্তে তিনি বয়োকনিষ্ঠ স্বামী জিমের হাতটি স্নেহভরে জাপটে ধরে হাঁটছেন। ক্যারোল সিল্কের ফুলতোলা টপের সঙ্গে বাহারি স্কার্ট পরে খোশমেজাজে আছেন দেখে খুশি হই। তার খয়েরি রঙের আভা ছড়ানো ব্রুনেট চুলের গুচ্ছ চূড়া করে বাঁধায় তাকে দেখাচ্ছে কমবয়স্ক তরুণীর মতো। খোঁপার গোলাকার বানে গাঁথা কাঁটাসহ সবুজ পাতার গুচ্ছও সাজগোজে যুক্ত করেছে সৃজনশীল ব্যঞ্জনা।

উৎসাহের সঙ্গে আওয়াজ দিই, ‘লুকিং ফেবুলাস, ক্যারোল।’ জবাবে জানতে পারি, বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপনে নাছোড়বান্দা জিম ফুলের ধান্দা ছাড়েননি। তবে পুষ্প সংগ্রহ করতে না পেরে অতঃপর দয়িতার চূড়ো-চুলে গুঁজে দিয়েছেন কাঁটাওয়ালা পাতা। শুধু কী তাই, একটি পর্যটনী পুস্তক থেকে ঝলমলে বেগুনি বুনোফুলের ছবি, দাড়ি কামানোর ক্ষুর দিয়ে কেটে তা ব্রোচের মতো করে আটকে দিয়েছেন প্রিয় পত্নীর টপে। আমাদের তারিফের জবাবে ক্যারোল জিমের গর্দানে এমন স্নেহভরে হাত বোলান যে, মনে হয়, নীরবে বলতে চাচ্ছেন, এরকম অনুগত হ্যাজবেন্ড পেলে মেয়েদের ভালো না বেসে উপায় আছে কি?

আমরা একত্রে রওনা হই মুদি ও মনোহারি দোকানের দিকে। যেতে যেতে ক্যারোল জিমের পিটে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘টেল দেম হোয়াট এলজ্ ইউ ডিড ফর মি টুডে?’ জিম প্রেমপত্র লিখে জননীর কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো লাজুক মুখে হাসেন, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। বিরক্ত হয়ে ক্যারোল নিজেই স্কুপটি ভাঙেন, ‘মাই সুপার সুইট হ্যাজবেন্ড রোউট অ্যা সং ফর মি, আই গেস্ ইউ অল নো হি ইজ অ্যা ট্যালেন্টেড সং-রাইটার।’ জিমের প্রতিভা সম্পর্কে আমি বিলক্ষণ অবগত, তাই ইংরেজি কেতায় আওয়াজ দিই, ‘কুল, দ্যাট ইজ ইনডিড ভেরি কিউট।’

মুদিদোকানটির সাজসজ্জা এতই সাদামাটা যে, তার সামনে এসে বিস্ময়ে ক্যারোলের চোয়াল ঝুলে গিয়ে বোয়াল মাছের মতো বেঢপ আকৃতি ধারণ করে। দোকানঘরটিকে কিন্তু জিমের দারুণ লাগে। তিনি ‘হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল লুকিং গ্রোসারি’ বলে ক্যামেরায় ফটাফট তুলে নেন একাধিক আলোকচিত্র। ঢোকার সময় চৌকাঠের পাথরে মৃদুভাবে উষ্টা খেয়ে ক্যারোলের মুখ দিয়ে বেরোয় ‘শিট।’

গাইড মুলাগেটা নাগাসিকেও পাওয়া যায় ভেতরে। মিলিটারি ক্যাম্পে পারমিশন নেওয়ার কাজটি সেরে মাত্র ফিরে এসেছেন, আমাদের ভরসা দিয়ে বলেন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গাড়ি এসে আমাদের পিক করে নিয়ে যাবে রিফিউজি ক্যাম্পে। সঙ্গে যাবে বন্দুকধারী চারজন সৈনিক। তাদের রাহাখরচের অংক নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হই না তেমন।

দোকানদারের গোলগাল চেহারার মেয়েটি এসে নাগাসির হাতে তুলে দেয় এক পেয়ালা চা। পরিচয় হয় দোকানি আলী নুর গালগামোসের সঙ্গে। জানতে পারি, সম্পর্কে তিনি আলী নাজ্জাসের বৈমাত্রেয় ভাই। ভদ্রলোক একটি গোলাকার পাথর ঘুরিয়ে শান দিচ্ছেন জাইল বা আফার পুরুষদের কোমরে ঝোলানোর ছুরিকা। ভোঁতা ছুরি বহন করা অপয়াবিশেষ, তাই আফার তরুণরা ছুরির ধার কমে গেলে এখানে জমা দিয়ে যায়, সামান্য পয়সার বিনিময়ে তিনি তা ধারালো করে দেন।

দোকানটিতে প্লাস্টিকের বাসন-বর্তন, পুতুল, টর্চ ও লণ্ঠন এবং আগরবাতি, এমন কী চীনদেশে নির্মিত থার্ম ফ্লাস্কও পাওয়া যায়। বস্তুটি খরিদ করতে পেরে ডারোথির চোখমুখ থেকে বেরোয় চাপা উল্লাস। মেঝেতে অনেকগুলো টুকরিতে রাখা টেফ নামে এক ধরনের শস্যবীজ। ইথিওপিয়ান  খাবারের স্টেপোল হচ্ছে টেফের ময়দা দিয়ে তৈরি বিরাট আকারের চাপাতির মতো দেখতে ইনজিরা রুটি। ক্যারোল উবু হয়ে মোবাইল দিয়ে শস্যবীজ টেফের ছবি তুলতে শুরু করেন। এতে বেজায় বঙ্কিম হয়ে আসে তার ভরাট হিপ। জিম ওইদিকে ইশারা দিয়ে ফিসফিসিয়ে আমাকে বলেন, ‘ইজ নট শি লুক সেক্সি অ্যান্ড শার্প ফ্রম দিস অ্যাঙ্গেল?’ আমি মুখখানা গম্ভীর করে ভিন্ন দিকে তাকাই। অতীতে আমি পরস্ত্রীর দেহসৌষ্ঠবের তারিফ করে স্বামীদের বিরাগভাজন হয়েছি। ভাবি, এ-ধরনের প্রলোভন থেকে দূরে থাকাই উত্তম।

দোকানের দেয়াল থেকে ঝুলছে উট ও ছাগলের রোদে শুকানো খটখটে করোটি। গাইড নাগাসি জানান যে, মৃতপশুর মন্ত্রপূত একটি মাথা দেয়ালে ঝোলালে ভূত-প্রেতের অনুপ্রবেশ রোধ করা যায় অনায়াসে। তিনি ক্যারোলকে বারবার শল্লা দেন উটের একটি কল্লা কিনে নেওয়ার জন্য। ক্যারোল বিরক্ত হয়ে তার কটা চোখে এমন কটকটিয়ে তাকান যে, মনে হয় তিনি বলতে চাচ্ছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হে, ভূতের মতো অদ্ভুত কিছু আমাদের রেসিডেন্সে ঢুকতে চাইলে আমরা এফবিআই ডাকতে পারি, ওরা ভূত-প্রেতকে ঘেটি ধরে গোয়ানতামানবে-তে পাঠাবে।

নাগাসি মহিলার উষ্মা ইগনোর করে একটি মাথা কিনে নেওয়ার জন্য ঝুলাঝুলি করেন। তাকে অ্যাভোয়েড করার অসিলায় মহিলা আমার দিকে ফিরে জানতে চান, ‘হাউ অ্যাবাউট অ্যা লুঙ্গি ফর মাই হ্যান্ডসাম হ্যাজবেন্ড, জিম।’ ব্যাটাছেলেরা মেয়েদের সামনে কৌপিনের মতো স্বল্প ঝুলের শর্টস পরে ঘুরপাক করুক, বিষয়টা আমার পছন্দ হয় না। আমি ক্যারোলকে একটি চক্রাবক্রা লুঙ্গি চুজ করতে সাহায্য করি। বস্ত্রটি কীভাবে কোমরে প্যাঁচাবেন, এ নিয়ে জিম দারুণ চ্যালেঞ্জে পড়ে টাক চুলকান। আমি অভয় দিয়ে বলি, নো প্রবলেম, সরাইখানাতে পৌঁছামাত্র আমি লুঙ্গি পরার ওপর ক্র্যাশ কোর্স করে দেবো।

রিফিউজি ক্যাম্পের মানুষজনদের জন্য আমি কিছু কিনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিই। ডারোথি কয়েক ডজন টিপকলম কিনছেন, তিনি বালিকাদের জন্য এক তাড়া সস্তা রঙচঙে কানের দুল কেনার কথা বলেন। আমি রাজি হই না। জিম জানতে চান, শতখানেক কাঠিলজেন্স কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়। ক্যারোল ভ্রূকুটিতে তাকে শাটাপ করে দিয়ে বলেন, ‘হাউ অ্যাবাউট দিস? … উই অল কালেকটিভলি বাই সাম ব্যাগস্ অব টেফ।’ প্রস্তাবটি আমার পছন্দ হয়। দামদর করে আমরা চার বস্তা টেফ কিনি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, টেফের ভারি ছালাগুলো কীভাবে টেনে সরাইখানায় নেওয়া যায়? জিম উৎসাহের সঙ্গে দুটি গাধা ভাড়া করার প্রস্তাব দেন। ক্যারোল কঠোর ভ্রূকুটিতে ফের তাকে মিইয়ে দিয়ে তারস্বরে মুলাগেটা নাগাসিকে তলব করেন। দোকানের পেছন থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন ট্রে ভর্তি চা ও ভাজা টেফ বীজ নিয়ে। তাতে চুমুক দিয়ে ক্যারোলের মুখ শামুকের খোলের মতো বন্ধ হয়ে যায়। দোকানদার আলী নুর এগিয়ে এসে জানান যে, চা নামক এ-ভেষজ আরকের ঔষধিগুণ প্রচুর। পান করতে করতে ভাবি, আফার-টি বাংলাদেশে আমদানি করতে পারলে উষ্ণ তরলটি অতি সহজে চিরতার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। নাগাসি চাকুস করে চায়ে চুমুক দিয়ে সকলকে আশ্বস্ত করেন, টেফের ছালা ক্যারি করার জন্য গাধা বা খচ্চর ভাড়া করার কোনো প্রয়োজন নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের পিক করতে আসছে একটি মোটরকার, ড্রাইভার না হয় দোকান থেকে তুলে নেবে টেফের বস্তা। দোকানদার আলী নুরকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বেরিয়ে আসি মুদি কাম মনোহারি স্টোর থেকে।