ইসমাইল কাদারে কেন গুরুত্বপূর্ণ লেখক? 

ইসমাইল কাদারে সমকালের অন্যতম শীর্ষ লেখক। তাঁর এই খ্যাতির কারণ, তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মহান গল্পকার এবং অসংখ্য চিত্তাকর্ষক চমকপ্রদ গল্পের স্রষ্টা।

কাদারে এমনভাবে গল্প বলতেন যে তাঁর গল্পবলার সঙ্গে তুলনা হতে পারে ফরাসি ঔপন্যাসিক বালজাকের। বালজাক তাঁর রচনাকে শুধু একটি স্থান প্যারি এবং একটি বিশেষ সময় – ১৮২০-এর দশকে (ফরাসি কয়েকটি প্রদেশ এবং রেনেসাঁতে) সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু কাদারে আমাদের সর্বত্র, অর্থাৎ প্রাচীন মিশর, আধুনিক চীন, বাল্টিক পর্যটন কেন্দ্র, মস্কো, অস্ট্রিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। তাঁর ছিল অনেকটা জুলে ভার্নের মতো বিশ্বভ্রমণের অবিস্মরণীয় ক্ষমতা।

আপনি যদি ইসমাইল কাদারের অভিনিবিষ্ট পাঠক হন, তাহলে মানবিক সভ্যতার লিপি উদ্ভাবন এবং লিখন আবিষ্কারের কাল থেকে সমস্ত কালের কথা তাঁর লেখালেখিতে পাবেন। মিসরের দ্বিতীয় ফারাও খুফু থেকে সর্বশেষ ‘বিশাল পিরামিড’ নির্মাণ; আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট শাসক এনভার হোজ্জা থেকে পশ্চিম ইউরোপের অব্যবহিত ঘটনাপুঞ্জ এবং সাম্যবাদের পতন – সবকিছুই ছুঁয়ে গেছেন তিনি।

তবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পটভূমিতেই সবচেয়ে বেশি গল্প লিখেছেন কাদারে। ‘ব্রোকেন এপ্রিল’-এর গল্পটি লেখা হয়েছে ১৯৩০ দশকের পটভূমিতে। চল্লিশের দশকের গল্প হচ্ছে ‘ক্রনিকল ইন স্টোন’। পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন ‘দ্য জেনারেল অফ দ্য ডেড আর্মি’। ১৯৭০-এর দশকের আখ্যান হচ্ছে ‘অ্যাগামেমননের কন্যা’। এই গল্পগুলি আখ্যান-প্রিজমের বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠককে আলবেনিয়া ও বিশ্বের কল্পিত ঐতিহাসিক বাস্তবতায় নিয়ে যায়। পাওয়া যায় ভাবনা ও চিন্তনের নানান মাত্রা। এসব কারণেই পাঠকেরা কাদারের উপন্যাস পড়তে প্রলুব্ধ হন। পড়ে আনন্দ পান। আমি নিজেও এই একই কারণে কাদারের লেখা কিছু পড়েছি, কী বিষয়আশয়, কী অভিনব কিন্তু চমকপ্রদ প্রকাশ, তাঁর আখ্যানগুলি যেমন ভাবায় তেমনি পড়তে ভালো লাগে। এ-কারণেই কাদারের লেখা আমার খুব পছন্দের।

দুই

আমরা যে-পৃথিবীতে বাস করি কাদারে সেই পৃথিবীর সমান্তরালে আরেকটি মহাবিশ্ব নির্মাণ করেছেন। এই দুই পৃথিবীর সমীপবর্তিতা, সংযোগ, সংঘাত ইত্যাদির মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেই আখ্যানগুলি রচনা করেছেন। এটি আসলে সাহিত্যের মাধ্যমে নির্মিত বিশ্বসমগ্র।

কী মনে হয়, বিষয়টি অভিনব নয়? আসলেই তাই, একইসঙ্গে তাঁর লেখা হয়ে উঠেছে অভিনব আর অভূতপূর্ব একজন ভাবুকের মহান আখ্যানবিশ্ব।

এখানেই শেষ নয়। কাদারে একজন পরিপূর্ণ সাহিত্যিক। গল্প লেখা ছাড়াও আরো অনেক কিছু লিখেছেন। তিনি নাট্যকার ও প্রাবন্ধিকও। কিছুদিন সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। দীর্ঘ লেখক-জীবনের শুরুতে আধুনিক আলবেনিয়ার নতুন মহান কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু বাইরের পৃথিবীর ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকেরা তাঁকে একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে চেনেন। ঔপন্যাসিক হিসেবেই তাঁর প্রতিষ্ঠা। এটাই স্বাভাবিক, কারণ, তাঁর লেখালেখির সবচেয়ে বড় অংশ উপন্যাস আকারেই প্রকাশিত হয়েছে।

কিন্তু কাদারের কৃতিত্ব এইখানে যে, তিনি শুধু একধরনের উপন্যাস লেখেননি। তাঁর কিছু গল্প, আকারে বেশ ছোট – অণুগল্প। তবে বিষয়আশয়ের দিক থেকে গভীর। ‘দ্য ড্রিম কুরিয়ার‘ মাত্র পাঁচ পৃষ্ঠার একটি গল্প; কিন্তু এমন দুর্দান্ত গল্প যে, সেটি পাঁচশো পৃষ্ঠা বা আরও বেশি দীর্ঘ হতে পারত। এর পাশাপাশি আছে ‘অ্যাগামেমননের কন্যা’র মতো দীর্ঘ ছোটগল্প। লিখেছেন এমন কিছু উপন্যাস যাকে তিনি ‘মাইক্রোনভেল’ অথবা ‘অণু-আখ্যান’ বলতে পছন্দ করতেন। দ্য ফ্লাইট অব দ্য স্টর্ক হচ্ছে তাঁর এরকম একটি অণু-উপন্যাস। তবে যে-উপন্যাসগুলির জন্য তিনি খ্যাতিমান সেগুলির আকার বড়ো, অর্থাৎ প্রামাণ্য আকারের উপন্যাস। ব্রোকেন এপ্রিল, দ্য কনসার্ট এবং দ্য গ্রেট উইন্টার হচ্ছে সেই ধরনের তিনটি উপন্যাস। ফলে, প্রথাগত যে-উপন্যাস, যে-উপন্যাসের আখ্যানশৈলীগত একটি নির্দিষ্ট ধরন আছে, তাকে অনুসরণ করেও এই উপন্যাসের মধ্যেই অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য এনেছেন। এই কাজগুলির মধ্যেই তিনি বিশ্ববৈচিত্র্যের সন্ধান করেছেন এবং তাঁর কল্পিত ও বাস্তবের বিশ্বসমগ্রকে ধারণ করবার চেষ্টা করেছেন।

তিন

ইসমাইল কাদারেকে আপনি একজন আত্মজৈবনিক লেখক হিসেবে পড়তে পারেন যিনি শুধু হোজ্জার শাসনাধীনে আলবেনিয়ার একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবনযাপন করে গেছেন। লিখে গেছেন নিজের জীবনের কথা। কিন্তু কাদারে আলবেনিয়ার মধ্যে থেকেও আলবেনিয়াতে সীমাবদ্ধ থাকেননি, অসংখ্যা স্থানজুড়ে স্থানিক পরিভ্রমণের জন্যও তাঁর উপন্যাসগুলি বেশ উল্লেখযোগ্য। কাদারের এই বিভিন্ন স্থান ও কালের ধারণার মধ্যে অবশ্যই কিছু সত্যতা আছে। মহাবিশ্বের নির্দিষ্ট স্থান এবং সময়ের স্থানচ্যুতি ঘটিয়েছেন তিনি। কিন্তু কাদারে পড়ার সময় আপনাকে এর খুঁটিনাটি জানার প্রয়োজন হবে না। খেয়াল করারও দরকার নেই কোন পটভূমিতে আর কোন পরিবেশে গল্পটি লেখা হয়েছে। আপনি সহজ ও স্বচ্ছন্দভাবে গল্পগুলি কেবল গল্প হিসেবে পড়তে পারবেন। তিনি আপনাকে ভূতের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারেন, নববধূদের মধ্যে যারা উড়ন্ত ঘোড়ায় চড়ে রাতারাতি শত শত মাইল পাড়ি দেয়, কবর থেকে উঠে আসা মৃতদেহ … এরকম অনেক ঘটনা ও চরিত্রের মুখোমুখি হবার মূহূর্তে আপনার মতো আধুনিক যুক্তিবাদী পাঠকের কাছে সেসব হয়তো আকর্ষণীয় মনে হবে না। কিন্তু তিনি যখন আধুনিক মনন এবং স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিথ এবং লোককাহিনির নিপূণ সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গল্পটি উপস্থান করেন, তখন সেই গল্পের প্রতি আকৃষ্ট হতেই হয়। আমার অন্তত পড়তে পড়তে এমনটাই মনে হয়েছে। তিনি নিঃসন্দেহে একজন অসাধারণ গল্পলিখিয়ে। কাদেরের এই আখ্যান-মহাবিশ্বের অনেকগুলি স্তর রয়েছে, যার মধ্যে অযৌক্তিক, অতীন্দ্রিয় এবং অদ্ভুত অনেককিছু ঘটতে থাকে।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং অব্যাহতভাবে যে-অনুষঙ্গটি তাঁর উপন্যাসে উপস্থিত থাকে সেটি হচ্ছে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনি। তাঁর ঝোঁক গ্রিক পুরাণের প্রতি, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কোনো পৌরাণিক কাহিনি নয়, পুরাণের যে-অংশটি আধুনিক পারিবারিক জীবন ও রাজনীতিকে নাটকীয় করে তোলে, ঘৃণা এবং নেশা জাগায়, কলুষিত করে, ক্ষমতার ভয়ংকর ছবি তুলে ধরে, সেই অংশটুকু তিনি গ্রহণ করেছেন।

দ্বিতীয় যে-বিষয়টি তাঁর লেখায় সবসময় উপস্থিত থাকে সেটি হলো বলকান লোককাহিনি। তখন তাঁকে শুধু আলবেনীয় নয়, ‘বলকান’ অঞ্চলের মহান প্রতিনিধি বলে মনে হয়। কেননা, তিনি যে-লোককাহিনিগুলি ব্যবহার করেছেন তা শুধু আলবেনিয়ার নয়, সমগ্র বলকান অঞ্চলের লোককাহিনি। প্রকৃতপক্ষে, বলকান সংস্কৃতির এই যে নৃতাত্ত্বিক উৎস, তার প্রতি কাদেরের ছিল দুর্মর আকর্ষণ। এরই চমকপ্রদ প্রকাশ আপনি দেখতে পাবেন তাঁর লেখা ‘দ্য ফাইল অন এইচ’ শীর্ষক রচনায়। সেখানে তিনি এই নৃতাত্ত্বিক বিষয়টিকে দারুণভাবে নাটকীয় করে তুলেছেন। ত্রিশের দশকে আলবেনিয়ার সীমান্তে কয়েকজন আমেরিকান লোকসংস্কৃতিবিদ যে-সাংস্কৃতিক শোষণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক শোষণের ওপর ভিত্তি করে এটি রচিত।

এবার তাঁর তৃতীয় প্রভাবশালী বৈশিষ্ট্যটি আমি উল্লেখ করছি। তিনি প্রায় প্রতিটি গল্পে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে পরম্পরিত করে উপস্থাপন করেছেন। তবে সেই সম্পর্ক তাৎক্ষণিক বা দলীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে স্থাপিত নয়, বরং সেই রাজনীতি হলো বিস্তৃত গভীর মানবিক রাজনীতি। কীভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তি অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায়, সেটাই ছিল তাঁর লেখার কেন্দ্রবিন্দু।

ইসমাইল কাদারের জগতের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। একে আপনি ‘কাদারিয়া’ বা ‘কাদারিয়াবাদ’ বলে আখ্যায়িত করতে পারেন। এটি এতটাই অভিনব যে, নিজগুণে বিশেষত্ব অর্জন করে ফেলেছে। আবহাওয়া, হ্যাঁ, আবহাওয়া – কাদারের রচনায় আক্ষরিক অর্থেই আবহাওয়ার বিষয়টি সর্বদাই ভয়ংকর। তুলনামূলকভাবে স্কটল্যান্ডের জলবায়ু তাঁর লেখায় ইতালির রিভেরার মতো মসৃণ। তবে সরল অর্থে এর ব্যবহার করেননি কাদারে। একজন পাঠক হিসেবে আপনি দ্রুত কাদারের জলবায়ু সংকেতের (প্রতীক) হাস্যকর মাত্রাটা (কুয়াশা, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, তুষার, ঠান্ডা, মেঘলা পরিবেশ) ধরে ফেলতে পারবেন। আলবেনিয়ার জলবায়ু আসলেই স্কটল্যান্ডের লোচ লোমোদ লেক ও পার্কের তুলনায় অনেকটা ইতালির রিভেরার মতো। উপন্যাসের জন্য এই পরিবেশ আদর্শ পরিবেশ নয়, কিন্তু এই পরিবেশই ইঙ্গিত দেবে বুঝিয়ে দেবে, কাদারের লেখা গল্পের পরিণাম সুখকর হবে না। শুধু তাই নয় এই পরিবেশ আরও অনেককিছুর ইঙ্গিত দেবে। আপনি ইতালির  পরিবেশ অনুসারে ভাবতে পারবেন, কোনো এক স্বর্ণকেশী কুমারী হয়তো একটা ট্রাকে চেপে স্নিগ্ধ রোদ্দুওে ঝলমল পথে পাকা সোনালি শস্য নিয়ে চলেছে। কিন্তু কাদারে এরকম কোনো বিভ্রমের মধ্য দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করতে চাননি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রেও প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল, কিন্তু তার প্রভাবে কাদারে আলবেনিয়ায় এরকম পরিবেশের কথা কল্পনাও করেননি। এটাই হচ্ছে তাঁর লেখার বাস্তব দিক। সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন তিনি। একটি অনন্য সমালোচনামূলক অবস্থান তৈরি করার জন্য সবকিছুতে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর। এই পথটাকেই সঠিক মনে করেছেন তিনি।

চার

অভিনিবেশ সহকারে কাদারে পড়লে দেখতে পাবেন, তাঁর সৃষ্ট অনেক মানবচরিত্র নিশ্চিত নয় যে তারা ঘুমিয়ে আছে, না কি  জেগে। তাঁর চরিত্রদের অভ্যন্তরীণ জীবনের কথা অনেকটা এইভাবে শুরু  হয়েছে : ‘মনে হচ্ছিল যে …’, ‘সে নিশ্চিত ছিল না যে আসলে …’ ইত্যাদি। তিনি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছেন, কী দেখাচ্ছেন না, বলছেন কী বলছেন না – কখনো স্পষ্ট করেননি
(এ-প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল শহীদুল জহিরের ন্যারেটিভের কথা)। ফলে, তাঁর লেখা পড়ে আপনি কখনো কিংবদন্তির পুনর্নির্মাণের অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন, যেটা ঘটেছে দ্য ঘোস্ট রাইডার উপন্যাসে; আবার কখনো
আধা-ঐতিহাসিক রচনা পাঠের অভিজ্ঞতা ঘটবে আপনার দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মির মতো স্বপ্নকল্পনাময় উপন্যাস পড়লে। কাদারে অব্যাহতভাবে আমাদের জাগরণ আর স্বপ্নের দুঃসহ বিভ্রমের মধ্যে রেখে কাহিনিকে এগিয়ে নেন। পড়তে পড়তে তখন একবার আপনার মনে হবে জীবন বুঝি স্বপ্ন, আরেকবার মনে হবে মহাদুঃস্বপ্ন। 

তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ‘প্যালেস অফ ড্রিমস’ (প্রথমে নাম ছিল ‘দ্য এমপ্লয়ি অব দ্য প্যালেস অব ড্রিমস’) হলো কাদারের কল্পিত আখ্যানবিশ্বের কেন্দ্রীয় রচনা। একটি অশুভ এবং অপ্রত্যাশিত স্বৈরাচারী সমাজের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই উপন্যাসের পটভূমি। এখানেই স্বাপ্নিক কিছু মানুষ সুন্দর স্বপ্ন দেখতে চায়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে স্থাপিত একজন সংবেদনশীল বিভ্রান্ত যুবক সত্যিই জানে না সে কী করছে, কিসের পেছনে সে দৌড়াচ্ছে। সবটাই স্বপ্ন।

ফলে দেখা যাবে, আপনি এরকম ভীত, কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের মুখোমুখি হলে এর প্রতি আকৃষ্ট হবেন না। বৃষ্টি আর তুষারপাত হয় এরকম স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃশ্যের মধ্যে না থেকে মানসিকভাবে আপনি আরও দূরে চলে যেতে চাইবেন, অর্থাৎ আপনাকে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের মধ্যে নিয়ে যাবেন কাদারে । আমি নির্দ্বিধায় বলব, কাদারে সত্যিই চমকপ্রদ একজন সিরিয়াস লেখক। তাঁর লেখা পড়লে আপনি ক্রমশ নিজেকে একটা সমান্তরাল মহাবিশে^র গভীরে ডুবন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করবেন। কিন্তু যখনই এটি ঘটবে, আপনি বিমূঢ় বিস্মিত হয়ে লক্ষ করবেন যে, ভাষিক আর আখ্যানগত দিক থেকে অবিস্মরণীয় এক জগতে চলে এসেছেন। বিস্ময়কর, কাদারের লেখা যারা অনুবাদ করেছেন, তাঁদের অনুবাদেও এই বিষয়গুলি যথাযথভাবে অনূদিত হয়েছে।

পাঁচ

কাদারে একাধিকবার বলেছিলেন, তাঁর পাঠক এবং সমালোচকদের তাঁর লেখার পটভূমির প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দেওয়ার দরকার নেই। কাদারের এই কথার প্রেক্ষাপটে আমি বলব, কাদারের গল্পবলার ভঙ্গি এবং তিনি যে গল্পগুলি বলেছেন, গত ষাট বছরে আলবেনিয়ায় বা বিশ্বে সামাজিক, ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটলেও তাঁর নিজের লেখার ধরন এবং বিষয়আশয়ের তেমন একটা পরিবর্তন ঘটেনি। লেখক-জীবনের শুরু থেকেই তাঁর কাল্পনিক পৃথিবী ও আখ্যানবিশ্ব পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠছিল, অর্থাৎ একজন পরিণত লেখক হিসেবেই তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। এরপর তিনি যে চল্লিশ বা পঞ্চাশটির মতো গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন, তা একটি বৃহত্তর, সুসংগত, অপরিবর্তনীয় সমগ্রের টুকরো টুকরো অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

কাদারের রচনাবলি এই ইঙ্গিত দেয় যে, কী পদ্ধতি, কী স্থান, কী বস্তুপুঞ্জ, কী গল্প, কী পৌরাণিক উল্লেখ – সবকিছুই নান্দনিক সুসংগতি নিয়ে গড়ে উঠতে পারে। সেই দক্ষতা তাঁর ছিল। এভাবেই একটির পর একটি লেখা তিনি রচনা করে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’-এর একটি প্রতীক সরাসরি খুঁজে পাওয়া যাবে ‘থ্রি-আর্চড ব্রিজ’-এ। ‘দ্য ফাইল অন এইচ’-এ এমন একটি সরাইখানা আছে যা পরে আরও কয়েকটি গল্পে দেখা যাবে। ‘দ্য ব্লাইন্ডিং অর্ডারে’র এক যুবক পরে প্যালেস অব ড্রিমসের নায়ক হয়ে উঠবে। এই উপন্যাসেই একটি মৌখিক মহাকাব্যের অভিনয়াংশ আছে যা দ্য ফাইল অন এইচ-এ ফিরে আসে। বালজাকের দ্য হিউম্যান কমেডিতে যেভাবে বিভিন্ন চরিত্রের পুনরাবির্ভাব ঘটেছে, কাদারের এই উপন্যাসেও সেটা দেখতে পাচ্ছি। তবে কাদারে অনেক বেশি সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণভাবে এটি ব্যবহার করেছেন। এই সূক্ষ্ণতা ঘটেছে কারণ কাদারের উপন্যাস বালজাকের মতো সরল ন্যারেটিভধর্মী উপন্যাস নয়। গল্প সরল বর্ণনা ধরে অগ্রসর হয় না। বর্ণনা ও কাহিনির অভিনবত্বের কারণে তাঁর চরিত্রগুলির ব্যবহার অভিনব। নিঃসন্দেহে এটি একটি চিত্তাকর্ষক কৃতিত্ব, এর অর্থ হলো, আপনি যে-গল্পটি পড়বেন সেটি কেবল একটি গল্প নয় – আপনার স্মৃতি ও বোধকে জাগিয়ে তুলবার আখ্যান ও ডিসকোর্স। আপনার সামগ্রিকভাবে এই অনুভূতি ও প্রতীতী জন্মাবে যে, আপনি সত্যি-সত্যিই একটি গল্পের মধ্যে আছেন, আছেন স্বপ্নকল্পনাময় অন্য ভুবনে।

অবশ্যই, বলতে দ্বিধা নেই, আপনি কাদারে যত বেশি পড়বেন, ততই তাঁর লেখার অসংখ্য বহুমুখী প্রান্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবেন। কাদারের কাজগুলি এমনই, নানান দিকে ছড়ানো, বহুচারি, আবার ঐক্যসূত্রও দুর্লক্ষ নয়। দুঃখজনক হলো, তাঁর সমগ্র রচনার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ইংরেজি অনুবাদে পাওয়া যায়, ম্যান বুকার পুরস্কার (২০০৫) পাওয়ার পর বাংলায় দুতিনটি উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। সবচেয়ে ভালো হবে যদি ফরাসি ভাষাটা আপনার অধিগত থাকে। আমি দু-বছর চেষ্টা করে ফরাসি ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান যতটুকু অর্জন করেছিলাম, চর্চার অভাবে অচিরেই তা ভুলে গেছি। তবে আপনি যদি আলবেনীয় ভাষা শিখতে পারেন, তাহলে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের একজন মহান লেখক কাদারের লেখার আস্বাদ আপনি পেয়ে যাবেন নিঃসন্দেহে। কাদারে এখন প্রয়াত, আশা করছি ব্রিটিশ ও আমেরিকার প্রকাশকরা এবার তাঁর সমস্ত লেখা অনুবাদ করার প্রকল্প হাতে নেবেন এবং সেই অনুবাদগুলি আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে।

তাঁর মৃত্যুতে বিশ্ব একজন মহান কথক বা আখ্যান রচয়িতাকে হারালো। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও টুপি-খোলা অভিবাদন।