ইহজাগতিকতা ও আহমদ শরীফ

শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও সমাজ রূপান্তরকামী বুদ্ধিজীবী-বহুমাত্রিক পরিচয়ে ভূষিত আহমদ শরীফ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তাবিদ। বর্তমান প্রবন্ধের লক্ষ্য তাঁর বহুমাত্রিক পরিচয়ের স্বরূপ উন্মোচন নয়। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য আহমদ শরীফের জীবনদর্শনের ভরকেন্দ্রটিকে চিহ্নিত করা। এই ভরকেন্দ্রের নাম ইহজাগতিকতা। সেক্যুলারিজম বা ইহজাগতিকতা রেনেসাঁসের মৌল বৈশিষ্ট্য।

সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগ থেকে বাণিজ্যিক ধনতন্ত্রে উত্তরণের আর্থসামাজিক পটভূমিতে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল সেটিই ইতিহাসে রেনেসাঁস হিসেবে বিখ্যাত। চার্চশাসিত ভূমিনির্ভর মধ্যযুগীয় সমাজ রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। অন্ধবিশ^াসের পরিবর্তে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি, অলৌকিকতার পরিবর্তে ইহজাগতিকতা, ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে মানবমুখিনতা ও সৌন্দর্যচর্চা প্রাধান্য পায়। মানুষ হয়ে ওঠে সমস্ত কিছুর মানদণ্ড। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভাষায়,

‘প্রকৃতি জগৎ এবং বাস্তব জগতের মধ্য দিয়ে, প্রকৃতি জগতের নিয়ম দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে এই ‘মানুষ’কে। ফুটিয়ে তুলতে হবে, ‘মানুষ’ – এই বাস্তবটিকে – ফুলের মতো করে তার সমস্ত দিক পরিব্যাপ্ত করে।’ রেনেসাঁসের এটিই প্রথম প্রকাশ যার মূল প্রত্যয় ছিল মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলা। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে নতুন যুগের আদর্শ হিসেবে রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটে, যা অলৌকিক ও দৈবের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকে ‘মানুষ’ করে তুলল।

রেনেসাঁসই ধর্মযাজকদের প্রতাপান্বিত ঔদ্ধত্যের থাবা থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের মুক্তি ঘটায়, সামন্ততান্ত্রিক স্থবিরতার অবসান ঘটিয়ে মানুষকে নতুন নতুন দেশের পথসন্ধানে ভৌগোলিক অভিযানের অভিযাত্রী করে তোলে। রেনেসাঁসের পথ ধরেই আসে রিফরমেশন ও এনলাইটেনমেন্ট। রিফরমেশন বা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ধর্মব্যাখ্যায় পাদরি ও যাজক সংঘের একচেটিয়া অধিকার বাতিল করে দিয়ে প্রত্যেকটি মানুষের বিবেকের স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়। এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়ন এমনভাবে যুক্তির আলোকোজ্জ্বল মশালটিকে উচ্চে তুলে ধরে যাতে যুক্তিহীন বিশ্বাস ও কুসংস্কারের অন্ধকার ক্রমেই ম্লান হয়ে যেতে থাকে।

রেনেসাঁসে মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার অতুলনীয় বিস্ফোরণ ঘটে। রেনেসাঁসের পীঠস্থান ইতালি। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইতালিতে রেনেসাঁসের উজ্জ্বল সূচনা ও অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে রিফরমেশন, ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ বিপ্লব ও চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে। ইতালিতে রেনেসাঁসের সময় প্রাধান্য পেয়েছিল সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যচর্চা, জার্মানিতে রিফরমেশনের সময় প্রাধান্য পায় আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতা। মধ্যযুগে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। রেনেসাঁস সে স্থানে অধিষ্ঠিত করে সংস্কৃতিকে। বেকন ও গ্যালিলিওর প্রভাবে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। মানবসভ্যতার এই ধারাবাহিক অগ্রগতির যাত্রাবিন্দু হচ্ছে রেনেসাঁস। তাই রেনেসাঁসকে বলা হয়েছে ‘মানব সভ্যতার প্রথম বসন্ত’।

রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে ইউরোপ একদিকে বিশ^জগৎকে এবং অন্যদিকে মানবপ্রকৃতিকে আবিষ্কার করে। এই আবিষ্কার কোনো বিশেষ মুহূর্তে কোনো বিশেষ ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হয়নি। কয়েক শতাব্দী ধরে প্রবল প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আত্মবিকাশের ভেতর দিয়ে ইউরোপের মানসের যুগান্তকারী পুনরুজ্জীবন ঘটে। পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪) রেনেসাঁসের প্রথম প্রবক্তা হিসেবে বিখ্যাত। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে রেনেসাঁস আরো সমৃদ্ধ হয় অসামান্য সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, ভাস্কর ও বিজ্ঞানীদের কল্যাণে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও, আরিওবস্তা, রাবলে, রসাঁর, সর্ভান্তিজ, মার্লো, ভান এবং শেক্সপিয়র উল্লেখযোগ্য। শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভান মাইক, বত্তিচেলি, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মিকেলেঞ্জেলো, তিশিয়ান, রাফায়েল, এল গ্রেকো স্বনামধন্য। দর্শন ও যুক্তিশীল রচনার জন্য আলোচিত ছিলেন লোরেঞ্জোভালা, মার্সিলিও ও ফিচিনো, পাম্পনাজি, মেকিয়াভেলি এবং ফ্রান্সিস বেকন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন কোপারনিকাস, কেপলার ও গ্যালিলিও। এই অসামান্য প্রতিভাবান পুরুষেরাই ছিলেন রেনেসাঁসের নির্মাতা। তাঁদের ভূমিকার কারণে ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটে এবং আধুনিক সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।

‘রেনেসাঁস’ ফরাসি শব্দ। এর অর্থ পুনর্জন্ম। প্রাচীন গ্রিসে মানবসভ্যতার যে উজ্জ্বল বিকাশ ঘটেছিল, মধ্যযুগে তার অন্তর্ধান ঘটে অন্ধকারের গ্রাসে। রেনেসাঁসকে তাই অভিহিত করা হয়েছে ‘রিভাইভ্যাল অফ ক্লাসিক্যাল লার্নিং’ হিসেবে। গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাচীন রোমান-বিদ্যার নিবিড় চর্চায় নিরত হন পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালির বিদ্বজ্জন ও শিল্পীরা। ফলে চার্চশাসিত গতানুগতিক জীবনধারায় দেখা দেয় নতুন জীবনস্পন্দন, নতুন জীবনবোধ।

রেনেসাঁসের প্রবক্তাগণ প্রাচীন গ্রিক-বিদ্যা ও লাতিন-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন সংগত কারণেই। চার্চ-শাসিত মধ্যযুগ ধর্মীয় বিধিনিষেধের নিগড়ে মানুষ ও তার সংস্কৃতিকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছিল। প্রাচীন গ্রিক-সংস্কৃতির মধ্যে মানুষ দেখতে পেল মুক্ত মানবতার আদর্শ। মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের প্রয়োজনে সে হাত বাড়াল প্রাচীন-বিদ্যার দিকে। মধ্যযুগ মানুষের সামনে এনে দিয়েছিল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সেখানে রেনেসাঁস সমস্ত হৃদয় ও ঐশ্বর্য দিয়ে জীবন সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ও জীবনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত করে। নেতিবাদী মধ্যযুগ থেকে ইতিবাদী আধুনিক যুগে উত্তরণের ক্রান্তিকালীন সাংস্কৃতিক বিচ্ছুরণের নামই রেনেসাঁস।

তৎকালীন ইতালির আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে রেনেসাঁস ছিল নতুন যুগের বার্তাবাহক, ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনাকারী। এই পরিবর্তনে প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলেন ইতালির দুই শ্রেণির মানুষ – হিউম্যানিস্ট ও আর্টিস্ট। হিউম্যানিস্টরা তাঁদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভা ও ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে নতুন যুগকে আবাহন করেছিলেন, আর্টিস্টরা ব্যবহার করেছিলেন তাঁদের ছেনি-হাতুড়ি ও রংতুলি। একদলের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছিল মননশীলতার জগৎ, অন্যদল তৈরি করেছিলেন নান্দনিকতার শিল্পিত ভুবন। ইতালির নতুন ধনিক-বণিক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা নীতিশুষ্ক, দৈবনির্ভর, ভীতু ও নেতিবাচক জীবনবোধের পরিবর্তে সম্ভাবনাময় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত জীবনবাদী জীবনদর্শন রচনা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায়, ‘রেনেসাঁস এসেছিল মানুষকে সর্বদেশে সর্বপ্রকারে মুক্ত করতে। শাস্ত্রের হাত থেকে, দেবতার হাত থেকে, গুরুর হাত থেকে, পুরোহিতের হাত থেকে, কুসংস্কারের হাত থেকে, কুপ্রথার হাত থেকে, অধীনতার হাত থেকে, অসাম্যের হাত থেকে।’

রেনেসাঁস সম্পর্কে এই নাতিদীর্ঘ আলোচনার কারণ হচ্ছে রেনেসাঁসের প্রতি আহমদ শরীফের গভীর অনুরাগ। তাঁর ইহজাগতিক জীবনদর্শনের মূলে কাজ করেছে রেনেসাঁস চেতনা। বুর্খহার্ট রেনেসাঁস সংক্রান্ত বিখ্যাত বইয়ে রেনেসাঁসকে ব্যক্তি প্রতিভার বিস্ফোরণের যুগ বলে অভিহিত করেছিলেন। ‘রেনেসাঁস চাই’ প্রবন্ধে আহমদ শরীফ লিখেছেন – ‘রেনেসাঁস ব্যক্তিক বটে, কিন্তু তার প্রভাব দৈশিক, সামাজিক,  সাংস্কৃতিক,  মানবিক ও রাষ্ট্রিক। তৃতীয় বিশ্বে যেন আরো বহু বহু কাল রেনেসাঁস প্রতিরুদ্ধ থাকবে মধ্যযুগের  ইউরোপে বিজ্ঞানচর্চার মতোই। অথচ রেনেসাঁস না হলে আমরা অঙ্গে ব্যবহারিক জীবনে অনুকৃত জীবন যাপনই করব, মৌলিক আবিষ্কারে, উদ্ভাবনে, সৃষ্টিতে,  নির্মাণে থাকব বঞ্চিত। আমরা বেঁচে থাকব, টিকে থাকব, কিন্তু মনুষ্যত্বে মানবিক বোধে, মানবতার প্রসারে, মনে-মগজে-মননে-মনীষায় উন্নত হব না কখনো।’

ইহজাগতিকতাবাদী ছিলেন বলেই আহমদ শরীফ কখনো অন্ধ কুসংস্কার বা পারলৌকিক জগতে বিশ্বাসী ছিলেন না। মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর ব্রত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির অবিচল অনুশীলন করেছিলেন তিনি। তাঁর সাহসী ও স্পষ্টভাষী বক্তব্যের জন্য উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে ফাঁসি দাবি করেছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি নিজের বাসায় স্বেচ্ছাবন্দি হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন মত প্রকাশ করা থেকে নিজেকে কখনো বিরত রাখেননি। ইহজাগতিকতার অনিবার্য অনুষঙ্গ যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা, মানবমুখিনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও আধুনিকতা। আহমদ শরীফের জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে এই বৈশিষ্ট্যগুলির উজ্জ্বল সম্মিলন দৃশ্যমান হয়।

‘আমার চেতনায় জীবন ও জগৎ’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন – ‘প্রাণী হিসেবে মানুষের জীবন স্থানের, কালের, কর্মের, আচারের ও আচরণের সীমায় নিবদ্ধ বটে, তবে তার মা-বাপ-ভাই-বোন-সন্তানের প্রতি মমতায়, দায়িত্বচেতনায় ও কর্তব্যবোধে যেমন, তেমনি মানুষ নির্বিশেষের প্রতি চিন্তায়-চেতনায়-অনুভবে বিশ্বমানবিক আত্মীয়তাবোধ ও ঐহিক কল্যাণকামিতা অনুশীলনের মধ্যেই রয়েছে তার সংস্কৃতির ও মানবতার পরিচয়। কেননা  আজকের যন্ত্রযুগে ও যন্ত্রজগতে ব্যক্তিক জীবনও বৈশ্বিক চেতনাসম্পৃক্ত আন্তর্জাতিক সম্বন্ধনির্ভর। ব্যক্তি মানুষকে তাই ইহবাদী তথা ঐহিক শ্রেয় ও শান্তিবাদী হতেই হবে।’

আহমদ শরীফের ইহজাগতিকতার ভিত্তি ছিল যুক্তিবাদ। যুক্তির কষ্টি পাথরে যাচাই না করে তিনি কোনো কিছুকে সত্য বলে গ্রহণ করতেন না। যুক্তির প্রধান শক্র অন্ধবিশ্বাস।  অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে চিরকাল আক্রমণ করেছেন তিনি। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে  – ‘মানুষ বিশ্বাস-সংস্কার অনুসারে চলে। তাদের ভূতে ও ভগবানে বিশ্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ওই বিশ্বাসই তাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নিয়তিবাদী হয়, অদৃষ্টবাদী হয়। নতুন ব্যবস্থার জন্যে তাই আঘাত করা দরকার বিশ্বাসের দুর্গে। প্রথম লেখা থেকে আজ পর্যন্ত আমি মানুষের পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার-নিয়ম-শাস্ত্র-প্রচলিত আইন-কানুন সবকিছুকে আঘাত করেছি। বিশ্বাসের দুর্গে আঘাত করেছি, কেননা বিশ^াস হচ্ছে যুক্তির অভাব।’

গত শতাব্দীর বিশের দশকে ঢাকায় সংঘটিত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন আহমদ শরীফ। সেই আন্দোলনের মুখপাত্র শিখার মর্মবাণী ছিল, জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট মুক্তি সেখানে অসম্ভব। এটি আহমদ শরীফেরও চিন্তার নির্যাস। তাই তিনি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক। ইহজাগতিকতা ও বুদ্ধির মুক্তিকে তিনি বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন – ‘বুদ্ধির মুক্তির সহজ মানে দাঁড়ায় আশৈশব লালিত পরিবারের, পরিবেশের, শাস্ত্রের, সমাজের, দেশের ও কালের লোকপ্রচলিত বিশ্বাস-সংস্কার, আচারআচরণ যেগুলো নীতি-নিয়ম,
রীতি-রেওয়াজ, প্রথা-পদ্ধতি, শাস্ত্র-আচার, পালা-পার্বণ প্রভৃতি সমকালীন জীবনযাত্রায় তথা ইহজাগতিক চিন্তা চেতনার কর্মে আচরণে হৃত উপযোগ ও বাধা শুরু সেগুলো সহজে পরিহার করার শক্তি-সাহস ও বিবেচনাশক্তি অর্জন করা। … দেশের কালের সমাজের ইহজাগতিক চেতনাঋদ্ধ হয়ে মানুষের প্রয়োজনে যথাসময়ে নতুনকে সৃষ্টি করার, পুরনোকে বর্জন করার, নতুনকে গ্রহণ-বরণ করার শক্তির নামই যুক্তি বুদ্ধি নির্দ্বিধায় শ্রেয়কে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করাই বুদ্ধির মুক্তির লক্ষণ।’

ইহজাগতিকতা বা সেক্যুলারিজমের পক্ষে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন আহমদ শরীফ। ধর্মান্ধতা,  সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদমুক্ত সমাজ গড়তে হলে সেক্যুলারিজমের বিকল্প নেই – এই ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মচর্চার বিযুক্ততাই সেক্যুলারিজমের মূল কথা। ‘সেক্যুলারিজমের বিকল্প নেই’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন – ‘সেক্যুলার রাষ্ট্র মানুষের মর্ত্যজীবনের চাহিদা মেটায়, তাকে স্বর্গে প্রেরণের দায়িত্ব বা অভিভাবকত্ব নেয় না। জাত জন্ম বর্ণ ধর্ম ভাষা অঞ্চল নিবাস যোগ্যতা নির্বিশেষে মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবে জানা এবং গ্রহণ-বরণ করাই মানবতা, উদারতা, যুক্তিমানবতা, সহিষ্ণুতা ও সৌজন্য। সেক্যুলারিজম নাগরিকদের এসব গুণের বিকাশের সহায়ক। আধুনিকতম গণতন্ত্র মাত্রকেই সেক্যুলার হতেই হবে, নইলে রাষ্ট্রিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলাগত সমস্যা-সংকটমুক্ত হওয়া যাবে না।’

আহমদ শরীফের অগণিত প্রবন্ধের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম দেখলে তাঁর ইহজাগতিক জীবনদর্শনের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় – ‘মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা আবশ্যিক’, ‘বুদ্ধির মুক্তি’, ‘আমার চেতনায় জীবন ও জগৎ’, ‘বিজ্ঞান বনাম বিশ^াস’, ‘আধুনিকতার অপর নাম বিজ্ঞানমনস্কতা’, ‘রেনেসাঁস চাই’, ‘বিজ্ঞানবিমুখতা আত্মপ্রতারণার নামান্তর’, ‘মৌলবাদ ও সেক্যুলার সংস্কৃতি’, ‘সম্প্রীতি নয়, সেক্যুলারিজমই সমাধান’, ‘মানসমুক্তি নিহিত বিজ্ঞানের তথ্যে আস্থায় আর যুক্তিনিষ্ঠায়’, ‘সেক্যুলারিজমের বিকল্প নেই’, ‘সাম্প্রদায়িকতা বিমুক্তির উপায় কি’, ‘মৌলবাদ সমর্থনযোগ্য নয় কেন’ প্রভৃতি।

আহমদ শরীফের জীবনদর্শনের অন্যতম ধারক তাঁর ডায়েরি ভাববুদবুদ। ডায়েরিতে এই মনীষীর মানবতাবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। গভীর মানবপ্রীতি তাঁর জীবনদর্শনের অংশ ছিল। বিভিন্ন স্থূল কারণে মানুষে মানুষে বিভেদের দেয়াল তাঁকে ক্ষুব্ধ করেছে। ১৫ই মার্চ ১৯৯১-এ তিনি লিখেছেন – ‘মানুষে মানুষে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া, সে-বেড়া শাস্ত্রের, স্থানের, ভাষার, মতের, পথের বিত্তের, বিদ্যার, বিশ্বাসের, সংস্কারের সাংস্কৃতিক ও আচারের পার্থক্যজাত ঘৃণা, অবজ্ঞা স্বাতন্ত্র্যচেতনা প্রসূত। তাই মানুষ মিলতে পারছে না কোথাও।’

আহমদ শরীফের এই উপলব্ধি ইহজাগতিকতার প্রেরণাজাত। মাত্র তিনটি বাক্যে নিজের বিশ্বাসের জগৎ উন্মোচন করেছেন ৬ই আগস্ট ১৯৯৩০-এর দিনলিপিতে – ‘আমরা ঐহিক জীবনবাদী। অন্যকথায় মর্ত্যজীবনবাদী। এর পূর্বের বা পরের কোনো অস্তিত্বে আমাদের আস্থা নেই।’

কথা ও কাজে অভিন্নতার উদাহরণ কম ব্যক্তির জীবনেই দেখা যায়। আহমদ শরীফ এর উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর ইহলৌকিক, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার জোরালো প্রকাশ দেখি জীবনের শেষ প্রান্তেও। জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে যৌবনের বিশ্বাস ভুলে গিয়ে বিপরীত বিশ্বাস আঁকড়ে ধরার উদাহরণ বাঙালি চিন্তকদের মধ্যে বিরল নয়। আহমদ শরীফ এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের মরদেহ দানের অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেন তিনি। চোখ দুটি দান করেছিলেন সন্ধানীকে। অসিয়তনামায় তিনি লিখেছিলেন – ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণপ্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরে কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।’

এ বিষয়ে কবি শামসুর রাহমানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য – ‘যখন আমরা বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অনেক অধ্যাপক ও ছাত্রের মধ্যে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা এবং ধর্মান্ধতা দেখে হতবাক হয়ে যাই তখন ড. আহমদ শরীফের বিজ্ঞানমনস্কতা ও অসামান্য অগ্রসর চেতনার পরিচয় পেয়ে এই প্রগতিশীল ব্যক্তির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তিনি শুধু কথায় তাঁর অগ্রসর মানসের পরিচয় দেননি কাজেও তা প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে যাতে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান না হয় এবং তাঁর মরণোত্তর চোখ দুটি সন্ধানী এবং মৃতদেহ বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগকে দান করার জন্য একটি উইল করে যান। সংবাদপত্রে পড়েছি মহৎপ্রাণ ড. আহমদ শরীফের দুই চোখের দুটি কর্নিয়া দুজন অন্ধ ব্যক্তির চোখে বসানো হয়েছে। এই দুজনের মধ্যে একজনের নামের আগে হাফেজ শব্দটি রয়েছে। আখেরে একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মহান মুরতাদের দান করা চোখ একজন হাফেজের কাজে লাগল। ড. আহমদ শরীফ যা যা দেখতেন অবিকল সেসবই কি দেখছেন এখন সেই হাফেজ সাহেব? হ্যাঁ দেখছেন ঠিকই, কিন্তু ড. আহমদ শরীফ যেভাবে দেখতেন, সেভাবে তিনি দেখতে পাবেন না। অনেক কিছুই তিনি দেখেও বুঝতে পারবেন না আমাদের শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক-লেখকের মতো। কারণ, যে চেতনার অধিকারী তিনি ছিলেন সেই চেতনা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের নেই।’

আহমদ শরীফের ইহজাগতিক দর্শন ও জীবনাচরণ রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র জগমোহনের কথা মনে করিয়ে দেয়। জগমোহন ছিলেন নাস্তিক। এই চরিত্র রূপায়ণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ‘জগমোহনের নাস্তিক ধর্মের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল লোকের ভালো করা; সেই ভালো করার মধ্যে অন্য যে-কোনো রস থাক একটা প্রধান রস ছিল এই যে, নাস্তিকের পক্ষে লোকের ভালো করার মধ্যে নিছক নিজের লোকসান ছাড়া আর কিছুই নাই – তাহাতে না আছে পুণ্য, না আছে পুরস্কার, না আছে কোনো দেবতা বা শাস্ত্রের বকশিশের বিজ্ঞাপন বা চোখরাঙানি। যদি কেহ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিত, প্রচুরতম লোকের প্রভূততম সুখ সাধনে আপনার গরজটা কী? তিনি বলিতেন কোনো গরজ নাই, সেইটেই আমার সবচেয়ে বড় গরজ। তিনি সতীশকে বলিতেন, দেখো বাবা আমরা নাস্তিক, সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে। আমরা কিছু মানি না বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।’

কল্পিত চরিত্র জগমোহনের বাস্তব রূপ যেন আহমদ শরীফ। ইহজাগতিকতাবাদী আহমদ শরীফ পরকাল বা স্বর্গ-নরকে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু মানুষের ভালো করার ব্রত তিনি শুধু জীবদ্দশায় নয়, মৃত্যুর পরেও পালন করেছেন। এর চেয়ে বড় ধর্ম আর কী হতে পারে? এ ধর্ম মানুষের ধর্ম, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – লোকের ভালো করার ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্মমোহ’ কবিতায়ও মানুষের ভালো করার অঙ্গীকার দেখতে পাই –

ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে,

অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।

নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,

ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।

শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে জ্ঞানের আলো ,

শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।

আহমদ শরীফ শাস্ত্র মানতেন না, তবে মানুষের ভালো যে তিনি মানতেন এর প্রমাণ তাঁর ইহজাগতিক জীবনসাধনায় বারবার দিয়ে গেছেন।