সেগুনবাগিচার সারমেয়

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গাড়িটা ডানে মোড় নেয়। ফজল খেয়াল করে, একটা সাদা-কালো ছোপ কুকুর তার গাড়ির পেছনে ভেক ভেক করে তেড়ে আসছে। বেশ অনেকটা দৌড়ে রণে-ভঙ্গ।

ফজল চালককে বলে : হারুন, কুকুরটা গাড়ির পেছনে কেন দৌড় দিলো বলো তো?

স্যার, গতকালও পেছনে এসেছিল, আপনি খেয়াল করেননি।

কিন্তু কেন?

ঠিক আছে স্যার, আমি জানার চেষ্টা করব।

ফজল মনে করতে থাকে, কী কারণ হতে পারে। কুকুরটাকে দুর্নীীত দমন কমিশন অফিসের সামনে শুয়ে থাকতে দেখেছে। কী হলো ওর? পাগল হয়ে যায়নি তো? তাহলে তো মারাত্মক হবে কাউকে যদি কামড়ায়। মনে মনে সে কুকুর সম্বন্ধে যেটুকু  জ্ঞান আছে তা নিয়ে পর্যালোচনা করে চলে। এখন তো

আশ্বিন-কার্তিক মাস নয়। যে-সময় কুকুরের পাগল হওয়ার একটা কারণ থাকে। এখন তো মাত্র পৌষ। বসন্ত আসতেও দেরি। সবদিকে প্রকৃতির মধ্যে যখন একটা নবীন সুর লাগবে। এ-সময় কুকুরটা এমন আচরণ করছে কেন!

আপাতত তার কুকুর-মনোবিশ্লেষণ-মন এসব ঝেড়ে ফেলতে চায়। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় সমস্যা আছে। গাজায় ইসরায়েলের রণতূর্য … ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ … কত পাগলামি চলছে বিশ^ জুড়ে … তার সারমেয়চিন্তা তো তুচ্ছ। অতি তুচ্ছ। মনকে সে বর্তমানে সঁপে দিতে চায়। লোকে বলে না, আপনি বাঁচলে, বাপের নাম। সে নিজের বাঁচার চিন্তা করতে থাকে। অবসর গ্রহণের পর যে-কটা টাকা পেয়েছিল তার একটা অংশ পোস্টাল সঞ্চয়পত্রে নিয়োগ করে। অবসরপ্রাপ্ত বলে সাধারণ লোক থেকে দেড় শতাংশ বেশি পেত। আজ তা-ও সরকারের

যক্ষ-হাতে পড়েছে। সেখান থেকে কেটে নেয় সাড়ে তিন শতাংশ। নিম্নমধ্যবিত্তে অনেক দিন হলো পৌঁছেছে। গাড়িটা মনে হয় এবার পরিত্যাগ করার সময় এসে গেছে। তারই ইশারা কি কুকুরটাও দিচ্ছে? অন্তরীক্ষ থেকে তার নিশানা কি পৌঁছে দিচ্ছে সৃষ্টিকর্তা? সে অবশ্য এসব কাকতালীয় চিন্তায় বিশ^াসী নয়। কার্যকারণ তার কাছে মূল মন্ত্র। সমাজ-কাঠামোতে যারা উপরে বসে আছে, তারা অনেক সময় এজেন্টদের পাঠায় এমন বিশ^াসীদের ভয় দেখাতে। এখন কি কুকুরটাও সেই ভূমিকায়? কিন্তু ও-বেচারা তো মানুষের প্রথম প্রাণী-বন্ধু। সে কেন এমন আচরণ করবে! তার আচরণের ভাণ্ডারে এটা বিপরীতধর্মী। একমাত্র মস্তিষ্কের বিকৃতি না ঘটলে।

রাতে সে ড্রাইভার হারুনের কাছ থেকে জানতে পারে কোন একটা সাদা রঙের গাড়ি কুকুরটার লেজের ওপর দিয়ে চলে যায় Ñ তারপর থেকে এখান দিয়ে কোনো সাদা গাড়ি দেখলেই কুকুরটা তেড়ে যায়।

ফজল বেশ মজা পায়। সে ভাবে, কুকুরের লেজ বড় সম্মানের অঙ্গ। তার ওপর দিয়ে যাওয়া, খুব বড় ধরনের অপরাধ। কুকুরের মানহানি। কারণ কুকুর পরাজয় স্বীকার করে লেজ গুটিয়ে। লেজ ওদের পদমর্যাদার চিহ্ন Ñ অনেকটা রাষ্ট্রের বড় কর্তাদের গাড়ির ফ্ল্যাগের মতো।

কুকুরের চিন্তা তার অবসরপ্রাপ্ত অলস মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে থাকে। একসময় তাদের একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল। অবশ্য ওটা কুকুর নয় Ñ কুত্তি। তার বাবা আদর করে নাম দিয়েছিলেন : কুইনি Ñ মানে ছোটরানি। অ্যালসেশিয়ান খুব ভালো জাতের কুকুর। রীতিমতো সভ্য। লোককে পারলে কামড় দেয় না। নেকড়ের মতো চেহারা নিয়ে লাফ দিয়ে বুকের ওপর পা তুলে দাঁড়ায়। মানুষের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। টেরিয়র হলে বিপদ ছিল। কামড় বসাত। বারো বছর বেঁচে ছিল কুইনি। ওটা বাড়িতে একজনকেই প্রধান মনিব বলে মানত। আর তিনি ছিলেন মা। মা যা বলতেন শুনত। রীতিমতো বেড়াল হয়ে যেত। অন্যদের মানত, কিন্তু দু’নম্বর জায়গায় বসিয়ে।

আমরা বিকেলে ওকে মাঠে নিয়ে গিয়ে নানা রকম খেলা শেখাতাম। বল বা কাঠি ছুড়ে দিয়ে নিয়ে আসা। বল উপরে ছুড়লে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই মুখে পোরা। আবার আমাদের কাছে নিয়ে আসা। মানে আবার ছোড়, আমি ধরব। খুব পাকা খেলোয়াড় হয়ে গিয়েছিল।

ওর হাঁকডাকে চোর তো দূরের কথা বাড়িতে ভিখিরি পর্যন্ত আসত না। অতিথি-অভ্যাগতরা বুঝেশুনে দরজায় দাঁড়াত। আমরা অবশ্য বেশিরভাগ সময় কুইনিকে বেঁধে রাখতাম। তেমন বিপত্তি কোনোদিন হয়নি। শুধু বাবার বন্ধু টেন্ডুচাচা, যার কাছ থেকে আমরা কুইনিকে এনেছিলাম তিনি বাসায় এলে অবশ্যই হাঁক দিয়ে বলতেন, কুকুর বান্ধা আছে?

 বেশিরভাগ সময় মা ঘর থেকে হাসতে হাসতে জবাব দিতেন, হ্যাঁ ভাই, বান্ধা আছে। এভাবে তাদের দেবর-ভাবির জবাব দেওয়া-নেওয়া চলত।

সেগুনবাগিচা ঢাকা শহরের খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বোর্ডের সব দপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ভূ-তাত্ত্বিক অধিদপ্তর … এভাবে বেশ বড় বড় সব দপ্তরের সমাহার। প্রায় শহরের কেন্দ্রবিন্দু বলা চলে।

শহরে একসময় বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছিল। তখন পৌর দপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় : পোষা কুকুরের গলায় বেল্ট বেঁধে দিতে। না হয় রাস্তা থেকে পৌরকর্মীরা ধরে নিয়ে যেতে পারে।

কুকুর ধরা অভিযান চোখের সামনে দেখেছে ফজল। হাতে সাঁড়াশি নিয়ে কর্মীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো কুকুর দেখলে আস্তে করে গিয়ে কোমরে সাঁড়াশির প্যাঁচ বসিয়ে দিত। আর অন্য কর্মীরা খাঁচা নিয়ে হাজির। তারের জালঘেরা খাঁচায় পুরে ফেলত।

এভাবে নিয়ে যেত নিমতলি পুলিশ ফাঁড়িতে। ওখানে ইনজেকশন দিয়ে মারা হতো। কোন কোন সময় ইনজেকশনের অভাবে পিটিয়ে মারার দৃশ্যও তার চোখে পড়ে।

সে দাঁড়াতে পারত না। প্রাণঘাতি চিৎকার তুলত কুকুরগুলো। সে কানে হাত চাপা দিয়ে দ্রুত পুলিশফাঁড়ি অতিক্রম করত।

আজো সে-চিৎকার তার কানে লেগে আছে। ভাবতে চায় না; কিন্তু এই ঘটনাটা তাকে ভাবনার ভাণ্ডারে ফেলে দেয়।

 সেগুনবাগিচায় সে প্রায় বিশ বছর বাস করছে। স্বাধীনতার আগে অঞ্চলটি ঢাকা শহরের একটি অভিজাত অঞ্চল ছিল। ধানমন্ডি-গুলশান সৃষ্টির পর নম্বর হারাতে থাকে। এর ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক, লেখক, চিন্তাবিদ কাজী মোতাহার হোসেনের

বসবাস-ভবন। তাঁর পরিবারের অনেকেই গুণী ব্যক্তিত্ব। এখানে বাস করতেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহেদুর রহিম। নামী প্রকৌশলী ব্যক্তিত্ব আবদুল জব্বার। অর্থনীতিবিদ ও রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী আনিসুর রহমান।

 সেগুনবাগিচার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ছিল একটি নালা। সংযুক্ত ছিল মতিঝিলে। আজ তা অদৃশ্য। ছিল সংগীত মহাবিদ্যালয়ের প্রাচীন ঢংয়ের দোতলা ভবন। বর্তমানে এর পাশে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দুর্নীতি দমন কমিশন সেই পাকিস্তানি আমল থেকেই ছিল। স্বাধীনতার পর এর ওপরতলাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। অধুনা গড়ে উঠেছে প্রায় ত্রিশতলা ইন্টেলিজেন্স ভবন। এর পাশে মাতৃভাষা ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের ভবন। বর্ধিত হয়েছে সেন্ট মেরি ক্যাথিড্রেল।

পরিবেশের বদলও কম নয়। শব্দদূষণ এখন নিত্যসঙ্গী। প্রায় দিন-রাত সমান।

বিশেষ করে দুটি সংস্থায় ঘেরটোপের মধ্যে বেড়ে ওঠা কুকুর দলের উষ্মার প্রকাশ।

গভীর রাতে কুকুররা দল বেঁধে মারামারি করে। একপক্ষ দুর্নীতি দমন কমিশন, অন্যপক্ষ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। রাস্তার কুকুররা বেশ নিরাপত্তা পেয়েছে এই দু-সংস্থার সীমানা ঘেরাটোপের মধ্যে।

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে ফজল কোনো হদিস করতে পারে না কিসের বিবাদ ওদের।

মাঝে মাঝে শোনে দু-একটা কুকুর উচ্চরবে করুণ সুর তুলে ডেকে চলেছে। তার মন খারাপ হয়ে যায় নিশিরাতের এই সুরে। কুকুর অমঙ্গলের কথা আগে ভাগে জানতে পারে। তাদের সামনে কি কোনো বিপদ এগিয়ে আসছে? কে জানে!

সন্ধ্যারাতেও অনেক সময় এমন করুণ সুরে কাঁদে। আশপাশের বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা ওদের ভ্যাঙায়। সবাই একসঙ্গে সুর তোলে।  তখন ফজলের মনে হয়, গোটা সেগুনবাগিচা যেন সারমেয় প্রজাতি হয়ে গেছে। তার নিজেরও অংশ নিতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু বয়স বাধা হয়ে দাঁড়ায়। না হয় সে-ও অংশগ্রহণ করত।

গভীর রাতের কান্নার সুরটা শুধু সে একা শোনে না অন্যরাও শোনে তা সে

 জানবে কী করে? শুধু নিজেকে অংশীদার হিসেবে নিশ্চিত বলতে পারে।

মাঝে মাঝে গভীর রাতেও দু-দল ঝগড়া পাকায়। পাতলা ঘুম ফজল জেগে ওঠে, আর বিরক্ত হয়। এত রাতে কেন যে ওরা ঝগড়া করে ভেবে পায় না। না আছে সামনে কোনো খাবার। না চোর-ডাকাত। ওরা নিজেদের মধ্যে এমন ঘোঁট কেন যে পাকায়! সাধে কি লোকে কথায় কথায় বলে কুকুর কোথাকার!

পাভলভের কুকুরের অনেক দাম। কন্ডিশনড রিফ্লেক্স উদ্ধারের কাজে রুশ বিজ্ঞানী কুকুরকে নেয় মাধ্যম। লালবাতি জে¦লে দেয় খাবারের আগে। এভাবে চলতে থাকে। পরে দেখা যায় অসময়ে লালবাতি জ¦াললেও খাবারের জন্যে কুকুরটির লালাগ্রন্থিতে লালা কাটে।

শিল্পকলা আর দুর্নীতির কুকুরগুলো কীভাবে কন্ডিশনড বা শর্তাধীনতায় বেড়ে উঠছে তাহলে তা নিয়ে তো গবেষণা করতে হয়! এ-কাজ তো অনেক কঠিন। জীববিজ্ঞান জানতে হবে। আগে কে কী নিয়ে এ-ব্যাপারে গবেষণা করেছে তার হদিস … এ তো এক মহাভারত। আর এ-কাজে আর্থিক সহায়তাই বা করবে কে? রাশিয়ান একটি মেয়ে কুকুর তো

পৃথিবীবিখ্যাত হয়ে যায়; নভোচারীদের সঙ্গে। পরীক্ষার জন্যে মহাশূন্যে কুকুরটিকে একা পাঠানো হয়। কুকুরটির নাম লাইকা।

মহাকাশে বেশ কিছুদিন বেঁচে ছিল লাইকা, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মারা যায়।

তারপর ইউরি গ্যাপারিনকে নিয়ে পাঠানো হয় প্রথম মহাকাশযান। স্পুটনিক। পরীক্ষা সফল। রাশিয়ার

জয়-জয়াকার। তা দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পিছিয়ে থাকতে পারেনি। তারা চাঁদে সরাসরি মানুষ পাঠায়।

কুকুরের কথা মনে হলেই চলে আসে লুই পাস্তুরের নাম, যিনি জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেন।

কুকুর নিয়ে চিন্তা করতে থাকায় ফজলের প্রায় নিশিরাতে ঘুম ভাঙে। আগে ওদের চিৎকারেও ঘুম ভাঙত না। আজকাল অল্প শোরগোলে নিদ টুটে যায়। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা হয়ত ততটা ছিন্ন নয়, কিন্তু তার কাছে বেশি মনে হয়।

সে তার বাল্যে চলে যায়। মামাবাড়ি তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল। একে তো ওখানে জন্ম। তাছাড়া পৈতৃক ভিটে দারিদ্র্যপীড়িত বলে বেশিরভাগ সময় কাটত মামাবাড়ির গ্রামে। তার এক মামা ছিল আলতাফ নামে। খুব হাসিখুশি। সবরকম খেলাধুলায় ছিল পারদর্শী। ব্যায়ামপুষ্ট দেহ। সবাইকে নিয়ে খেলাধুলায় মত্ত

থাকত। তাকে খুব স্নেহ করত। সেই মামার একটা কুকুর ছিল। টমি। প্রভুভক্ত। মাঠে শেয়াল দেখা গেলে মামা টমিকে ডাক দিত। তারপর বলত … লিইও … অর্থাৎ পিছু নে। টমি দিত খিঁচে দৌড়। কিন্তু শেয়াল ধরতে কোনোদিন দেখেনি। শেয়াল প্রাণপণে দৌড়ে বড় খালের ওপারে। টমি এই খাল পার হতো না। এটাই ছিল গ্রামের শেষ সীমানা। ভিন গাঁয়ে পা দিত না টমি। শেয়ালও প্রাণ পেয়ে বাঁচত।

তার সেই বাল্যকালে দেশ ভাগ হয়ে গেল। সে মা-বাবার সঙ্গে পূর্ববঙ্গে চলে আসে। এখানেই বাবা-মার কবর দিয়েছে। নিজের জন্যেও বাড়িতে বলে রেখেছে কোথায় মাটি চায়।

গভীর রাতে এসব ফেলে আসা দিনগুলো মনে ভিড় করে। মানুষ মনে হয় অতীত নিয়ে ভাবতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। চলে আত্মকণ্ডুয়ন।

আজকের সেগুনবাগিচা তার কাছে অচেনা ছিল। তারা শহরের ভিন্ন প্রান্তে বাস করত। পাশে এক বাস কোম্পানি গ্যারাজ করে তাদের কেনা জায়গার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলল। ওই জায়গা সেই বাস কোম্পানির কাছেই বিক্রি করে তারা সেগুনবাগিচায় ফ্ল্যাটে। প্রায় একযুগ পার হয়ে গেছে। সে ভাবে একবার মানুষ চৌদ্দপুরুষের ভিটে ছাড়া হলে তার কপালে মনে হয় এমনটাই ঘটে। বারবার উদ্বাস্তু হতে হয়। এখনো তার মন কাঁদে নিজের ফেলে আসা গ্রামের জন্যে।

কুকুরের দ্বন্দ্ব তাকে গভীর রাতে এসব ভাবার সুযোগ করে দেয়। প্রাণীপ্রেমী ফজল এসব রাস্তার কুকুরের জন্যে সব সময় দুঃখবোধ করে। যেমন রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামলে যখন অসহায় পঙ্গু ও দুস্থ মানুষদের জানলায় টোকা দিয়ে ভিক্ষে চাইতে দেখে। এ-ব্যাপারে সে একবার প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ফেসবুকে। তার প্রস্তাব ছিল দেশে একটা প্রকল্প নেওয়া হোক যে আগামী পনেরো বছরে ভিখিরিমুক্ত দেশ গড়ে তুলব। সবই বৃথা। আজ পর্যন্ত কোনো জায়গা থেকে তার আবেদনের সাড়া মেলেনি। কেউ কোনো রকম কমেন্টও করেনি। এই নিরুত্তরের উত্তর সে ভাবতে চায় না। কী হবে উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে।

দান-ধ্যান বন্ধ হলে লোকে সালাম পাবে কী করে? ভিক্ষা দিয়ে স্বর্গে যাওয়ার সহজ রাস্তাটাই বা কে ছাড়তে চায়। আর এসব ভাবাটাও অনুচিত। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে এটা তো সহজ পরিণতি। এই ভাবনাটাই বা তার মাথায় আসে না কেন?

কয়েকদিন পরের কথা।

সকাল সাতটা হবে। শীতের সকাল বলে তেমন আলো নেই এই পশ্চিমদিকের ফ্ল্যাটে।

হঠাৎ একটা শোরগোল শুনতে পেল ফজল। মনে হলো তাদের ফ্ল্যাটের সামনে। আর কুকুরদের যৌথ চিৎকার। সকালবেলা কী হলো?

বারান্দায় গিয়ে দেখে দুর্নীতি দমন অফিসের সামনে বেশ বড় একটা জটলা। আর লোকজনকে ঘিরে ওখানকার বেশ কিছু কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে। অন্যদিনের মতো তাদের চিৎকারে কোনো ঝাঁজ নেই। সুরটা করুণ।

সে দ্রুতপায়ে নেমে যায়।

গিয়ে দেখে সেই সাদা-কালো ছ্যাবলা কুকুরটা পড়ে আছে। মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে গাড়ি। সারা রাস্তা রক্তে রাঙা। তখনো পা একটু একটু নড়ছে।

 কে একজন বললো, পশু হাসপাতালে ফোন করা দরকার।

করপোরেশন অফিসে ফোন করতে হবে, বলে ফজল। ভিড়ের মধ্যে সে তাদের ভবনের প্রধান গার্ড আলিমকে দেখতে পায়।

বলে, আলিম, কর্পোরেশনের নম্বরটা নিয়ে এসো।

ভিড় আরো বাড়ছে। বাড়ছে কুকুরদের আহাজারি।

একটু পর আলিম আসে। বলে, আমি ফোন করে দিয়েছি স্যার। ওরা এখনি আসবে।

নির্বাচন হয়ে গেছে। শহরের রাস্তা ফাঁকা। পনেরো মিনিটের মধ্যে করপোরেশনের ট্রাক পৌঁছে গেল।

কুকুরটার খিঁচুনি নেই। কয়েকজন কর্মী কুকুরের দেহটা গাড়িতে উঠাল।

গাড়ি ছেড়ে দিতেই চারদিকে ঘিরে থাকা কুকুররা গাড়ির পেছন পেছন ছুটতে শুরু করে।

ফজলও একটু এগিয়ে যায়। শিল্পকলার গেট পার হতেই তার চোখে পড়ে, গ্রিলের মাঝ দিয়ে আট-দশটা কুকুর মুখ বাড়িয়ে আছে। সবার চাউনি কী করুণ।