লোকসাহিত্য-সৃষ্টি ও বাঙালি নারী : জসীমউদ্দীনের অবলোকন

সংকলন ও ভূমিকা : আবুল আহসান চৌধুরী

এক

‘সাহিত্য জনজীবনের বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গ লোকের আলেখ্য। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী নদীর তীরে তীরে, এদেশের উদার গগন তলে, অবারিত মাঠের কোলে যাহারা ঘর-বসতি করিয়া জীবনের কাহিনী রচনা করে, আমাদের সাহিত্য তাহাদেরই কথায় ভরপুর। কি আমরা হইতে চাহিয়াছি, কি আমরা হইতে পারিয়াছি, কি আমরা হইতে পারি নাই – যুগে যুগে এই কাহিনীই শুধু আমাদের সাহিত্যকে রূপ দিয়াছে’ – পঞ্চাশ বছর আগে (১৯৭৪) ঢাকার বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ‘বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’-এ মূল সভাপতির ভাষণে প্রসঙ্গক্রমে এই কথাগুলো বলেছিলেন কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)। তাঁর এই বক্তব্যে মূলত উদার-বিস্তৃত পল্লি­শাসিত লোকজীবনের সঙ্গে সাহিত্যের একটি গভীর সম্পর্কের কথা বিশেষ আবেগ ও মমতার সঙ্গে বিবৃত হয়েছে।

দুই

জসীমউদ্দীনের গ্রামমনস্কতা ও ঐতিহ্যভাবনার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। ব্রিটিশ শাসনকালে জাতীয় জাগরণের মুহূর্তে স্বদেশ-আবিষ্কার ও ঐতিহ্য-অন্বেষার এক প্রবল চেতনা বাঙালির জনচিত্তে লাগে। গ্রামীণ জীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতি সেই সূত্রে হয়ে ওঠে পাঙ্ক্তেয় ও শ্রদ্ধেয়। লোক-সংস্কৃতির চর্চা এক নতুন মাত্রা পায়। অবজ্ঞাত-অবহেলিত গ্রামের সাংস্কৃতিক সম্পদ শিক্ষিত বাঙালির মনোযোগ লাভ করে হয়ে ওঠে জাতীয় গৌরব-গর্বের ধন। রেভারেন্ড লালবিহারী দে (১৮২৪-১৮৯৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯), আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩), গুরুসদয় দত্ত

(১৮৮২-১৯৪১) – এঁদের প্রয়াসে বাংলার লোকসংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। জসীমউদ্দীন পূর্বসূরির এই পথ ধরে লোকসংস্কৃতি সংগ্রহের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং পাশাপাশি লোকজ উপকরণ নিয়ে সাহিত্যরচনায় প্রাণিত হন।
যে-জীবন অজ্ঞাত, অপাঙ্ক্তেয়, অলিখিত – সেই জীবনের আলেখ্য রচনায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।

তিন

লোকজ জীবনকে কেন্দ্র করে জসীমউদ্দীন লিখেছেন কবিতা-গান-উপন্যাস-নাটক। প্রসঙ্গ ও প্রকরণ উভয়তই তিনি ছিলেন লোকজীবনের অনুবর্তী এবং লোককবির স্বভাবাক্রান্ত। তাই লোকজীবনের রূপকার হিসেবে এই কবি ছিলেন স্বতন্ত্র ও মৌলিক। অভিন্ন নামের লেখকের সঙ্গে পার্থক্য-রচনার প্রয়োজনে দেশবাসী-প্রদত্ত যে ‘পল্লিকবি’ উপাধি তিনি গ্রহণ করেন, তা ছিল তাঁর যথার্থ পরিচিতি-জ্ঞাপক অভিধা।

বাংলা কবিতার হাজার বছরের গর্বিত উত্তরাধিকার বহন করেছেন জসীমউদ্দীন। নিজে গ্রামীণ পরিবেশে মানুষ, গ্রামীণ সংস্কৃতির আবহে লালিত এবং এই সংস্কৃতির প্রাণকল্লোলে প্রাণিত। যে-গ্রামীণ পরিবেশে তাঁর জন্ম-লালন-বর্ধন, সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি নিরন্তর একাত্ম বোধ করেছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামীণ মানুষের বহমান জীবনধারা, প্রেম ও তার অন্তরায় – টানাপোড়েনের কথা, লোকবাংলার স্নিগ্ধ নিসর্গের রূপ, উপেক্ষিত হয়নি লোকসমাজের ক্ষয় আর শোষণের চিত্রও।

প্রকৃতপক্ষে লৌকিক বাংলার বিস্তৃত জনজীবন ও বিশাল প্রেক্ষাপটের গ্রামীণ প্রকৃতিই তাঁর সাহিত্যকে প্রেরণা জুগিয়েছে। জসীমউদ্দীন গ্রামীণ মানুষের অলিখিত জীবনের রূপকার হতে চেয়েছেন। কোনো স্বপ্ন-কল্পনার আচ্ছন্নতা কিংবা রূপকথার অলীক মায়ার কাছে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেননি।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিতে বিভক্ত গ্রামীণ সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের অন্তরঙ্গ চালচিত্র জসীমউদ্দীনের কবিতায় মেলে।

কৃষক-জেলে-মাঝি-জোলা-বেদে-বৈরাগী-বেণে, নানা বৃত্তির ও সংস্কৃতির মানুষ এখানে এসে ভিড় করেছে। এইসব গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনের আনন্দ-বিষাদের নানা রূপ চিত্রিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।

নানা অভাব-অভিযোগ দারিদ্র্য-দুঃখের ভেতরেও গ্রামীণ জীবনে ‘অনন্ত আনন্দধারা’ বহমান। স্নিগ্ধ অনুভূতি, পারিবারিক প্রীতিময়তা, সামাজিক বন্ধন শত সংকটেও অক্ষুণ্ন থাকে। গ্রামীণ বাংলার সুখী গৃহকোণের ছবি প্রায়ই উঁকি দিয়েছে তাঁর কবিতায়। আবার এর বিপরীর চিত্রও দুর্লভ নয় – সামন্ত-শোষণ, জোতদার-মহাজনের জুলুম, মাতবর-সমাজপতির দুঃসহ নিগ্রহ গ্রামের নিরীহ-অসহায়-সরল মানুষকে চিরকাল পর্যুদস্ত-ম্রিয়মাণ করে রাখে। এর ফলে গ্রামীণ জীবনে নেমে আসে ক্ষয়। রোগে-শোকে জর্জরিত পল্লিবাসীকে নিত্য মোকাবিলা করতে হয় ‘নীরব’ দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরকে। এই যে বিষণ্ন ব্যথিত গ্রাম – ছিন্নমূল কৃষকের দুর্বিষহ জীবন, – জসীমউদ্দীনের কবিতা ও গানে উঠে এসেছে।

চার

কবিকে তাঁর জীবনচরিতে পাওয়া যায় না – এই মহাজন-বাক্যের বিপরীতে বলা যায়, জসীমউদ্দীনের জীবনের সঙ্গে তাঁর কাব্যের একটি নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে – তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতা ও অন্তরঙ্গ অবলোকনের যোগফলই তাঁর সাহিত্য। জীবনের উপান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন এক বোধ থেকে লিখেছিলেন ‘ঐকতান’ কবিতাটি। তাতে তাঁর সংশয় জেগেছিল, তাঁর কবিতায় বৈচিত্র্য থাকলেও তা ‘সর্বত্রগামী’ হতে পারেনি। তাই তিনি ‘কৃষাণের জীবনের শরিক’ মৃত্তিকা-সংলগ্ন এক অনাগত কবির আবির্ভাব কামনা করেছিলেন। লোকজীবনের রূপকার জসীমউদ্দীনকে রবীন্দ্রনাথের আকাক্সিক্ষত সেই কবি হিসেবে হয়তো চিহ্নিত করা চলে।

পাঁচ

বাংলার লোকঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রেরণা তিনি লাভ করেছিলেন লোকজীবনের সঙ্গে গভীর ও আত্মিক সম্পৃক্ততার কারণেই। তাই তাঁর মনোযোগ কেড়েছিল বাংলার জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, বাউল, রাখালি গান আর লোকগল্প। এসব গান ও গল্প তিনি বাংলার গ্রামীণ জনপদ থেকে সংগ্রহই শুধু করেননি, তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রচয়িতা হিসেবে তার সার্থক পুনর্নির্মাণও করেছেন। লোকজ সংগীত-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে তাঁর অনুরাগ ও শ্রমের ফসল জারীগান (১৯৬৮), মুর্শিদী গান (১৯৭৭), রাখালী গান (১৯৯৮), বাউল (১৯৯৯) – এইসব গ্রন্থ। বাঙ্গালীর হাসির গল্প (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড : ১৯৬০, ১৯৬৪) সংকলন করে তিনি লোকগল্পের এক ব্যতিক্রমী সম্ভারকে পাঠকের সমুখে তুলে ধরেছেন। এ-ছাড়াও আলোচনা করেছেন বাংলার লোকসাংস্কৃতিক সম্পদ লোকনাট্য, যাত্রা, লোকছড়া ও পাঁচালি, নকশিকাঁথা, আলপনা, মরমি লোকসাধক লালন ফকির, লোককবি পাগলা কানাই – নানা বিষয় নিয়ে। এর থেকে সহজেই বোঝা যায়, জসীমউদ্দীনের মন-মননে লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতি কী গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিদেশ-ভ্রমণ নিয়ে লেখা বইতেও – যেমন, চলে মুসাফির (১৯৫৭) বা হলদে পরীর দেশে (১৯৬৫)-তে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে বাংলার লোকসংস্কৃতির অনুরাগগাঢ় কথা। এ ক্ষেত্রে তাঁর মূল ঋণ ড. দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে।

ছয়

বাংলার লোকসংস্কৃতিচর্চার ইতিহাসে জসীমউদ্দীনের ভূমিকা ও অবদানের কথা অনেকটাই অজ্ঞাত ও উপেক্ষিত। এক্ষেত্রে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদা তিনি পেয়েছেন এ-কথা বলা চলে না। এর সম্ভাব্য দুটি কারণ নির্দেশ করা যায় : তাঁর অসামান্য কবিখ্যাতির কারণে লোকসংস্কৃতিচর্চার বিষয়টি চাপা পড়ে গেছে এবং যাঁরা বাংলা লোকসংস্কৃতির চর্চা নিয়ে আলোচনা-গবেষণা করেছেন তাঁদের অজ্ঞতা বা গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থতাও এর আর-এক কারণ হতে পারে। অবশ্য এ-বিষয়ে একমাত্র জারীগান ছাড়া অন্যসব বইই তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত। জসীমউদ্‌দীনের প্রবন্ধসমূহ নামে দু-খণ্ডে (১৯৯০, ২০০১) তাঁর অগ্রন্থিত রচনাসমূহ প্রকাশ পায়, সেও তাঁর জীবনান্তের পরই। এই দু-খণ্ডে তাঁর ফোকলোবিষয়ক রচনাও কিছু শামিল হয়। তবে দেশভাগের আগে ও পরে দুই বাংলার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আরও অনেক লোকসংস্কৃতি-সংক্রান্ত লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এমন কিছু রচনার সন্ধান আমরা লাভ করেছি – এরই একটির নাম ‘বাঙ্লার লোক-সাহিত্যে মহিলা কবিদের দান’।

সাত

তিরিশের দশকে কল্লোল-কালিকলমের লেখকদের সঙ্গে জসীমউদ্দীনের বেশ সখ্য-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, এঁদেরই একজন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬) – জসীমউদ্দীনের সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গি ও তাঁর ব্যক্তি-পরিচিতি, উভয়ই যে গ্রামীণ প্রভাবপুষ্ট, সেই বৈশিষ্ট্য নির্ভুল ধরা পড়েছে অচিন্ত্যকুমারের লেখায় : ‘একেবারে সাদামাটা আত্মভোলা ছেলে এই জসীমউদ্দীন। চুলে চিরুণি নেই, জামায় বোতাম নেই, বেশবাসে বিন্যাস নেই। হয়তো বা অভাবের চেয়েও ঔদাসীন্যই বেশি। সরল-শ্যামলের প্রতিমূর্তি যে গ্রাম তারই পরিবেশ তাঁর ব্যক্তিত্বে তাঁর উপস্থিতিতে’ (কল্লোল যুগ, সপ্তম প্রকাশ, কলকাতা, আশ্বিন ১৩৯৫; পৃ ১০৪)। তবে তাঁর লোকসংস্কৃতি প্রসঙ্গের প্রবন্ধে-নিবন্ধে এই অবিন্যস্ত বা অগোছালোভাব একেবারেই নেই – সেখানে তথ্যোপকরণের যোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ ও প্রামাণিক সিদ্ধান্তের সন্ধান মেলে। ‘বাঙ্লার লোক-সাহিত্যে মহিলা কবিদের দান’, এই রচনাটি ভাব-ভাষা-বিশ্লেষণ-মূল্যায়নে ঋদ্ধ, দীর্ঘ ৮৪ বছর পর তা সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টিপাতের সুযোগ মিললো কালি ও কলম পত্রিকার সৌজন্যে। লেখকের মূল বানান অক্ষুণ্ন রেখে লেখাটি মুদ্রিত হলো।

আট

মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) ছিলেন মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। পরে আরও কেউ কেউ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও পত্রিকা-পরিচালনার রাশ ছিল আকরম খাঁর হাতেই। উচ্চমানের মাসিক পত্রিকা হিসেবে মোহাম্মদী বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল।

কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাস-নাটিকা-প্রবন্ধ-আলোচনা-সম্পাদকীয় ভাষ্যসহ মাসিক পত্রিকার প্রচলিত অন্যান্য বিভাগও এখানে ছিল। লোকসংস্কৃতিবিষয়ক রচনা ও প্রচলিত-প্রাচীন লোকসংগীত-সংগ্রহও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো বিশেষ গুরুত্বসহকারে। জসীমউদ্দীন তখন কবি হিসেবে সুপরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত – গদ্যরচনাতেও বেশ দড় –

লোকসংস্কৃতির উপকরণ সংগ্রহ ও চর্চায় গভীর নিষ্ঠায় নিমগ্ন। এমন সময়েই তাঁর ‘বাঙ্লায় লোক-সাহিত্যে মহিলা কবিদের দান’ প্রবন্ধটি মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার ১৩৪৭-এর কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশ পায়।

বিষয়-বৈচিত্র্যে প্রবন্ধটি স্বতন্ত্র মূল্য ও মূল্যায়ন দাবি করে। বাংলার সমাজে-সংসারে নারীর ভূমিকা নির্ধারিত – নানা আদেশ-নিষেধে তার জীবন সংকুচিত – প্রত্যাশাহীন অন্ধকারে সে-জীবন বৃত্তাবদ্ধ। তবুও নারী যে সৃজনশীল, শিল্পরচনায় স্বচ্ছন্দ, আত্মপ্রকাশে আগ্রহী – তার প্রমাণ মেলে হাতের নানা শৈল্পিক কর্মে, কণ্ঠের সুরে, অলিখিত ছন্দের মৌখিক প্রকাশে – এসব সৃজনকলা জন্ম নেয় পারিবারিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতার আবেশে – স্নেনে-বিষাদে-প্রেমে-বিরহে-আনন্দে-বিচ্ছেদে নারীর সৃষ্টি প্রাণ পায়, মূক হয় মুখর – খিড়কি থেকে যে-আলো জ¦লে ওঠে তা পৌঁছে যায় সিংহদরোজায় – অবশেষে বোধি জন্ম নেয় – সৃষ্টিই নারীর মুক্তি।

নয়

লোকসাহিত্যের ভুবনে নারী এসেছে তিনভাবে : বিষয় হিসেবে, রচক হিসেবে এবং পরিবেশক হিসেবে। জসীমউদ্দীনের এই প্রবন্ধে নারীর তিন ভূমিকাই নজর করা যায়। এই রচনায় তিনি মূলত ছেলেভুলানো ছড়া এবং বিয়ের কনের ছড়া ও বিয়ের গান নিয়ে আলোচনা করেছেন – বিদেশি ভাষার ছড়ার তুলনা টেনে প্রসঙ্গকে প্রাঞ্জল করেছেন। ছেলেভুলানো ছড়ায় মেলে শিশুমনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস, অপরপক্ষে বিয়ের গান ও ছড়ায় রচিত হয়েছে বিরহ-বিধুর আবহ। মায়ের মনোজগৎ ও
শিশু-মনস্তত্ত্ব, বিয়ের কনে-বিদায়ে গার্হস্থ্য-জীবনের বিচ্ছেদ-বেদনার রূপ, হতশ্রী পল্লি­জীবনের অস্পষ্ট ছবি – এই আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। নারীকবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ প্রসঙ্গে লেখকের প্রশ্ন ও যুক্তি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। ৮৪ বছর আগে পত্রিকায় প্রকাশিত কবি জসীমউদ্দীনের অগ্রন্থিত এই প্রবন্ধটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। বিষয়-বিশ্লেষণের নৈপুণ্য, আনুষঙ্গিক পর্যালোচনার সঠিক প্রেক্ষাপট-নির্ধারণ এবং মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণের অভিনবত্ব লক্ষণীয় – বিবরণধর্মী হলেও এই প্রবন্ধটি বাংলার লোকসংস্কৃতিচর্চার মধ্যপর্বের একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে।

বাঙ্লার লোক-সাহিত্যে মহিলা কবিদের দান

জসীম উদ্দীন এম. এ.

বাঙালী মায়ের মুখেই আমরা প্রথম বাঙলা ভাষা শিখিয়াছি। কিন্তু বাঙলা সাহিত্যের দিকে যদি আমরা তাকাই তবে দেখিতে পাই, বাঙলার মায়ের জাতির স্থান সেখানে বড়ই নগণ্য। দু-চারজন মহিলা সাহিত্যিক যাঁহারা বাঙলা সাহিত্যের আসরে নিজদিগকে প্রসিদ্ধ করিয়া লইয়াছেন তাঁহাদের লেখায় সেই নারীজাতির মনের মরমখানি উদ্‌ঘাটিত হইয়া উঠে না। পুরুষ সাহিত্যিকদের দৃষ্টি লইয়াই তাঁহারা জগৎকে দেখিয়াছেন। সেই জন্য তাঁহাদের রচিত সাহিত্যে তেমন কোন অভিনবত্ব ফুটিয়া উঠে নাই। পুরুষ তাহার কাব্যে উপন্যাসে নাটকে নারীকে যে রহস্যময়ীরূপে রূপায়িত করিয়া বিশ্বের স্তবের ও ধ্যানের সামগ্রী করিয়া তুলিয়াছেন, নারী সাহিত্যিকের লেখনীতেও আমরা পুরুষেরা তেমনই এক রহস্যময় রূপের সন্ধান করিয়াছিলাম। আমরা আশা করিয়াছিলাম, পুরুষের দৃষ্টিতে যে নারী রহস্যময়ী, নারীর দৃষ্টিতে তাহার বাস্তব রূপ কেমন, মহিলা সাহিত্যিকের লেখায় তাহার সন্ধান পাইব। কিন্তু শিক্ষিত বঙ্গসাহিত্যের আসরে এ পর্য্যন্ত কোন মহিলা লেখিকাই আমাদের সে আশা পূরণ করিতে পারেন নাই।

অধিকাংশ বিদেশী লেখিকার লেখায়ও আমরা এই অভাব দেখিতে পাই। সেদিনকার নোবেল-প্রাইজ-প্রাপ্ত পার্ল বাকের লেখার নানা দিক দিয়া প্রশংসা করা যায় কিন্তু তাঁহার লেখনীতেও নারীজাতির মর্ম্মটি উদ্ঘাটিত হয় নাই। তাঁহার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস মঙ্গলময়ী বসুমতীতেও আমরা দেখিতে পাই, একটি মূক রহস্যময়ী নারীকে লইয়া পুরুষের গুঞ্জরণ-স্তব। এখানে পুরুষের কথা লেখিকা যতটা লিখিয়াছেন নারীর কথা ততটা লেখেন নাই।

এই কারণে নারীজাতির মনের মরমটি উদ্ঘাটিত করিতে হইলে বর্ত্তমান বঙ্গসাহিত্যের বাজারের কোলাহল হইতে আমাদিগকে বহুদূর যাইতে হইবে – সুদূর গ্রামের শান্ত-শীতল ছায়া-ঘেরা পল্লীর কৃষাণ কুটীরগুলিতে ঘুরিতে হইবে।

কথা হইতে পারে, আমাদের ভদ্র-সাহিত্যে যেরূপ মহিলা লেখিকারা পুরুষ লেখকদের অনুসরণ করিয়াছেন, পল্লী-সাহিত্যেও ত এই রূপই হইতে পারে। সে-কথার উত্তরে আমরা বলিব, পল্লীর মহিলা কবিরা পুরুষদের অনুসরণ বড় বেশী করেন নাই। এ দেশে পর্দ্দা-প্রথা থাকার দরুণ পুরুষের আনন্দ-মহলে নারীদের আগমন যেমন বিরল তেমনই নারীর আনন্দনিকেতনেও পুরুষের আবির্ভাব ক্বচিৎ দেখা যায়।

পল্লী-সঙ্গীতগুলি এইরূপ আনন্দ-উৎসবসমূহ অবলম্বন করিয়া রচিত হয় বলিয়া মেয়েদের রচিত গানগুলিতে পুরুষদের প্রভাব খুবই কম দেখা যায়।

মেয়েদের রচিত পল্লী-সাহিত্যের আলোচনা করিবার পূর্ব্বে আমরা পল্লী-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য লইয়া গোটা দুই কথা বলিব। ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহহরপধরর পল্লী-সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধের লেখক বলিয়াছেন, ‘আপনা হইতে কোন প্রকারের শিক্ষাবিধানের সাহায্য না লইয়া আপন মনে মানুষ যে গান বা সাহিত্য রচনা করে তাহাকে লোক-সঙ্গীত বা লোক-সাহিত্য বলা যায়।’ এই ভাবে কবিতার আলোচনা করিতে গেলে দেখা যায় মানুষ প্রথমে এক লাইনের সঙ্গে আর এক লাইনের মিল দিয়া কবিতা রচনা করিতে পারে নাই। প্রথমে তাহার কথা এক লাইনেই সমাপ্ত হইত। অপর লাইনটি ধীরে ধীরে আসিয়া পূর্ব্ব লাইনের সঙ্গে কথার মিল বাঁধিয়া যুক্ত হইয়াছে। এই ভাবে পয়ার, ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দের সৃষ্টি হইল। এই দিক দিয়া দেখিতে গেলে, এক লাইনের কবিতাগুলিতে বাঙলা ভাষার প্রথম কবিতা রচনার ধারাটী পাওয়া যায়। মেয়েদের রচিত যে সব পল্লী-সাহিত্যের নিদর্শন আমরা পাইয়াছি তাহার অধিকাংশ গানেই এরূপ এক লাইনে সমাপ্ত পদের সন্ধান পাওয়া যায়। সুতরাং মেয়েদের রচিত পল্লী-সাহিত্যের রচনা-রীতিতে সাহিত্য রচনার এই প্রাচীনতম নিদর্শনটী সহজেই চোখে পড়ে।

আমাদের দেশের পল্লী-সাহিত্যকে এ পর্য্যন্ত বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কেহই সংগ্রহ করেন নাই । পল্লী সংগ্রহ-সাহিত্য বলিয়া যাহা আজ সাহিত্যিক মহলে আদৃত হইতেছে তাহার অকৃত্রিমতার বিষয়ে প্রশ্ন হইতে পারে। এই কারণে মহিলা কবিদের রচিত পল্লী-সাহিত্যের আলোচনা করিতে অপরের সংগ্রহের উপর নির্ভর করিতে পারি নাই। মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর রচিত রামায়ণখানাকে পল্লী-সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলিয়া অনেকেই মনে করেন। এই কাব্যখানা বাবু চন্দ্রকুমার দে ময়মনসিংহ হইতে সংগ্রহ করিয়াছেন। ভূমিকায় ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেন লিখিয়াছেন, ময়মনসিংহের প্রায় সর্ব্বত্র চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গীত হইয়া থাকে। কিন্তু দুঃখের সহিত জানাইতেছি, আট দশ বৎসর ময়মনসিংহের বহু গ্রাম ঘুরিয়াও আমি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ গায়কের এক-জনেরও সন্ধান করিতে পারি নাই। পরিশেষে চন্দ্রকুমার বাবুর বাড়ীতে যাইয়া তাঁহাকে অনুরোধ করি। তিনিও আমাকে চন্দ্রাবতীর রামায়ণের কোন সন্ধান দিতে পারেন নাই। এই সব কারণে আমরা চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে পল্লী-সাহিত্যে মহিলা কবির দান বলিয়া স্বীকার করিব না। এ বিষয়ে স্বতন্ত্র আলোচনার ইচ্ছা রহিল।

ডাঃ দীনেশচন্দ্র সেন তাঁহার বঙ্গ-সাহিত্যের ইতিহাসে লিখিয়াছেন, ‘প্রবাদ-বাক্য, ছড়া ও রূপকথার ভিতর দিয়া ভদ্র সংস্কৃত সাহিত্যের অন্তরালে বঙ্গ-সাহিত্যের যে আসনখানি ধীরে ধীরে রচিত হইতেছিল, মুসলমান বাদশাহের দরবারে তাহার কৌলিন্য হইল।’ বঙ্গ-সাহিত্য রাজদরবারে আদৃত হইল। এখন হইতে ভদ্রলোকের সাহিত্য এক পথ দিয়া চলিল, কিন্তু গ্রামের সেই ছড়া, প্রবাদ-বাক্য ও রূপকথার সাহিত্য আপনার সহজ গতি-পথে আপনিই চলিতে লাগিল। এই সব প্রবাদ-বাক্য, ছড়া ও রূপকথার অধিকাংশই অন্তঃপুরবাসিনী মহিলাদের রচনা, তাহার নিদর্শন এই সকলের ভিতরেই পাওয়া যায়। বহুপ্রচলিত খনার বচনগুলিতেও বাঙলাদেশ একজন মহিলা প্রতিভাকে স্বীকার করিয়া লইয়াছে।

বাঙলাদেশের ছড়াগুলির অধিকাংশই যে মেয়েদের রচিত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। এই ছড়াগুলি শিশুদিগকে আনন্দ দিবার জন্য রচিত। শিশুর জগতে মাতৃজাতির আনাগোনা যতটা অধিক পুরুষজাতির ততটা নয়। পুরুষেরা বাহিরের কাজকর্ম্ম লইয়া বাহিরে কাটায়। মেয়েরা বাড়ীর নানা গৃহকর্ম্মের মধ্যেও শিশুদের তত্ত্বাবধান করে। এই কারণে শিশুদের মুখে সুন্দর ছড়া-কাটা কথা পুরিয়া দিবার জন্য মায়েরা কবি হইয়া উঠেন। বাঙ্গালী শিশু মায়ের কোলে বসিয়াই মাতৃজাতির রচিত এই ছড়াগুলির ভিতর দিয়া সর্ব্ব-প্রথম বঙ্গ-সাহিত্যের সহিত পরিচিত হয়। এই ছড়াগুলির বিষয়ে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ, শিল্পাচার্য্য অবনীন্দ্রনাথ প্রভৃতি নানা প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন। শ্রদ্ধেয় যোগীন্দ্রনাথ সরকার মহাশয় তাঁহার ছেলে-ভুলান ছড়া পুস্তকেও অনেকগুলি ছড়ার সংগ্রহ প্রকাশ করিয়াছেন। সেই জন্য আমি কেবল মোটামুটি কয়েকটি কথা বলিয়াই ছড়া-সাহিত্যের আলোচনা শেষ করিব।

কোন কিছু মুখস্ত করিয়া রাখার ক্ষমতা বাড়ানোর কাজে এই ছড়াগুলি যে শিশুশিক্ষায় কত উপকারী তাহা যে-কোন শিক্ষাবিদ্ স্বীকার করিবেন। প্রথমে শিশুরা কথা বলিতে পারে না; কিন্তু ছড়ার নৃত্যদোদুল ছন্দ অনুভব করিতে পারে। মা তখন নিজেই নিজের জন্য ছড়া রচনা করেন :

                     হাত ঘুরালে মওয়া দিব

এত মওয়া কোথায় পাব।

    শিশু এখনও হাঁটিতে শেখে নাই। মা তাকে কোলের উপর নাচাইতে নাচাইতে ছড়া রচনা করে :

জোলা নাচে জুলনী নাচে নাচে জোলার নাল

         সব চরকি উইঠ্যা বলে আমরা নাচব কাল।

অথবা,

          নাচেরে মাল, চন্দনী কপাল

          ঘৃত মধু খায়া তোমার টোবা টোবা গাল।

    মা বিছানায় শুইয়া শিশুকে পায়ের গোড়ালীর উপর বসাইয়া শূন্যে উঠায়, তার পর খোকা আর মা দুইজনে মিলিয়া ছড়া বলে :

“ঝিজি সই।”

“তোর পুত কই?”

“আম গাছে।”

“কি কাজ করে?”

“পিঁড়ি চাছে।”

“কার পিঁড়ি?”

“ছোট বৌ’র পিঁড়ি।”

“ছোট বৌ কো?”

“ঘাটে গেছে।”

“ঘাট কো?”

“ডাহু খাইছে।”

“ডাহু কো?”

“বনে গেছে।”

“বন কো?”

“পুইড়া গেছে।”

“ছাই কো?”

“ধোপায় নিছে।”

“ধোপা কো?”

“হাটে গেছে।”

“হাট কো?”

“ভাইঙ্গা গেছে।”

“বুড়িলো বুড়ি?”

“কি লো।”

“তইলা পাইলাগুলি সরালো?”

“ক্যা লো।”

“তাল গাছটা পইল?”

“ঢিপ্‌পুস” –

ছড়ার শেষের দিকে ঢিপ্পুস শব্দটা উচ্চারণ করিতে করিতেই মা উপর হইতে শূন্য পা দুখানা মাটীতে হঠাৎ ফেলিয়া দিলেন। খোকা বিছানার উপর পড়িয়া খিল্‌খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। এই ছড়াটীর মধ্যে সুন্দর নাটকীয় সমাবেশ দেখিতে পাওয়া যায়। এই নাটকের অভিনেত্রী মা আর অভিনেতা তার খোকা শিশুটি। স্থান মায়ের শয্যা। বিদেশীয় ছড়া-সাহিত্যের মধ্যেও বহু ছড়ার মধ্যে এইরূপ নাটকীয় সমাবেশ দেখা যায় :

ÒWho will kill the cock Robin?Ó

“I”, said the sparrow,

“With my bow and arrow

I killed the cock Robin”.

“Who saw him die?”

“I”, said the fly,

“With my little eye

I saw him die.”

    পৃথিবীর যদি সব চাইতে অসাম্প্রদায়িক কোন জগৎ থাকে তবে সে এই শিশুর জগৎ। এরা সব যুগে সব দেশে যেন এক। এদের ভুলাইবার ছড়াগুলোও তাই অনেকখানি দেশ কালের অতীত। সেই জন্যই এক দেশের শিশু-সাহিত্যের সহিত অন্য দেশের শিশু-সাহিত্যের মিলটা সহজেই খুঁজিয়া পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ইংরাজী ছড়া-সাহিত্য হইতে আরও একটি ছড়া উদ্ধৃত করা যাইতে পারে :

This is the Maiden, all forlorn

That marked the cow with crumbled horn

That tossed the dog,

That worried the cat,

That killed the rat

That ate the malt

That lay in the house that Jack burnt.

এই ছড়াটির সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে

গেরস্ত ভাই, দাও ত আগুন

গড়ব কাস্তে, খাবে গাই, দিবে দুধ।

খাবে কুকুর, হবে তাজা, মারবে মোষ,

লব সিং, খুঁড়ব মাটি গড়ব ঘটি, তুলব জল।

ধুব ঠোঁট, তখন নেব চড়ুইর বোট।

এরূপ আরও অনেক ছড়া উদ্ধৃত করা যাইতে পারে। ছড়ার বিষয় আমার স্বতন্ত্র প্রবন্ধ বাহির হইবে বলিয়া এ বিষয় আর বিশদ আলোচনা করিতে চাহি না।

এই ছড়াগুলোর মধ্যে বাঙলার নারীজীবনের দুঃখ বেদনার কতকগুলি জীবন্ত প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। বাঙলা-দেশে নিতান্ত বালিকা বয়সেই মেয়েদিগকে বধূ সাজিয়া সুদূর স্বামীগৃহে যাইয়া ঘর-কন্না করিতে হয়। প্রতি গৃহের জননীই তার বালিকা কন্যাটিকে বরের দেশে পাঠাইয়া চোখের জল মোচন করেন। সেই বেদনাটি কয়েকটি ছড়ায় কেমন জীবন্ত হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে! হিন্দু মেয়েদের রচিত মাঘ-মণ্ডলের ব্রতকথা, হ্যাড়চা পূজার ও সূর্য্যপূজার ছড়া হইতে চয়ন করিয়া আমরা কয়েকটী ছড়া এখানে উদ্ধৃত করিব :

উলু উলু শিমূলের ফুল মুকুট মাথায় দিয়া

শিমূল ফুল তুলতে গেলাম তাইতে হ’ল বিয়া।

শিমূল ফুলের মত রাঙা টুকটুকে একটী মেয়ে শিমূল ফুল তুলিতে গিয়াছিল। হয়ত ভিন্-দেশী কোন ছেলে বা ছেলের বাপ তাকে দেখিয়া তার বিবাহের সম্বন্ধ করিয়া গিয়াছে। আজ মেয়েটীর বিবাহ হইবে। তাই মেয়েটী তার সঙ্গীদের সহিত জীবনের শেষ খেলা খেলিয়া লইতে চাহে –

“আয় লো খেলার সই খেলার সাজ নিয়া,

আর ত খেলব না খেলা পরের দেশে গিয়া।”

কিন্তু খেলা শেষ না হইতেই –

“ঢোল বাজে ঘুমুর ঘুমুর শানাই বাজে রয়া

পরের ছেলে নিতে এল ঢোল টোকর দিয়া।”

আত্মীয়স্বজনেরা ক্রীড়ানিরতা এই বালিকা মেয়েটিকে আনিয়া –

“আম কাঁটালের পিঁড়িখানি ঘি মউ মউ করে

তারির উপর বাপ ভাই কন্যে দান করে।”

এইভাবে মেয়েটির বিবাহ হইয়া গেল। বরের দেশে মেয়েটিকে বিদায় দিতে :

বাপ যায়রে নায়ে নায়ে খুড়ো যায়রে তড়ে

শিশু কালে হৈল বিয়া সদাই আগুন জ্বলে।

খুড়ী কান্দে জেঠী কান্দে সকল কান্দে পর

মা জননী কান্দে বেলার আড়াই প’র!

খুড়ীলো জেঠীলো মাকে নে’ যা ঘরে,

মায়ের কান্দনে আমার ডুলি পাক পাড়ে।

বাঙলার নারীজীবনের অনেক দুঃখবেদনার কাহিনী এই ছড়াগুলির মধ্যে বড়ই মর্ম্মস্পর্শীভাবে অঙ্কিত হইয়া আছে। ব্রত-কথার ছড়াগুলি প্রায় অধিকাংশই সংগৃহীত হইয়াছে বলিয়া আমরা উদ্ধৃত করিলাম না।

স্বর্গীয় দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় তাঁহার বহু গ্রন্থে রূপকথা সাহিত্যে মেয়েদের দানের অজস্র প্রশংসা করিয়াছেন।

রূপকথাগুলি মেয়ে ও পুরুষ উভয়েরই রচনায় ঘোরাঘুরি করিয়া সমৃদ্ধিলাভ করিয়াছে। ব্যবসায়ী পুরুষ-গায়েনদের হাতে পড়িয়া ইহারা বিশেষভাবে রূপান্তরিত হইয়াছে। সেই জন্য কোন্ রূপকথাটী মেয়েদের রচিত আর কোন্টী পুরুষদের তাহা সম্যক নির্ণয় করিবার উপায় নাই। তাহা হইলেও রূপকথা-সাহিত্যে বঙ্গমহিলাদের অজস্র দানের কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। ভ্রমণকারী বেদেদের কণ্ঠে ভারতবর্ষীয় রূপকথা একদিন সুদূর ইউরোপে প্রবেশ করিয়াছিল। ম্যাক্ডোনাল্ড সাহেব তাঁহার সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন, ‘Indian folktales exercised very great influence in shaping the literature of the middle ages of Europe’ ফেরদৌসী বলেন, ÔSankhal, the king of Kanuj, sent 10000 male and female lauris recruited from different parts of Northern India, who could play upon the lute, to the Persian king Behramgorar in A. D. 420 at his request.’

এই লৌরিরা সমস্ত ইয়োরোপ পরিভ্রমণ করে এবং বেদে নামে পরিচিত হয়। এই বেদে দল হাঙ্গারী দেশে ১৪৭০ খৃষ্টাব্দে শেষ বাসস্থান নির্ম্মাণ করে। ইহাদের ভাষায় হিন্দি এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষার ছাপ পড়িয়াছে। (দীনেশচন্দ্র সেনের Folk Literature of Bengal)

ম্যাকডোনাল্ড সাহেব যে এদেশের গ্রাম্য গাথার প্রশংসা করিয়াছেন তাহার অর্দ্ধেকখানি মহিলাদের প্রাপ্য। গ্রামের বিবাহগুলিতে মেয়েরা গান গাহিয়া আনন্দ উৎসব করিয়া থাকে। এই সব গানের আসরে পুরুষদের আগমন নিষিদ্ধ। আর বিবাহ-ব্যাপার লইয়া পুরুষ কবিদের মধ্যে কোন প্রকারের গান গাহিবার রীতি নাই বলিয়া বিবাহের গানগুলিতে যে পুরুষ রচয়িতাদের বিশেষ কোন ছাপ পড়ে নাই সে কতকটা জোর করিয়া বলা যাইতে পারে।

বিবাহের গানগুলির পদ প্রায় অধিকাংশ স্থলেই এক লাইনে শেষ হইয়াছে। এক লাইনের সঙ্গে আরেক লাইন আসিয়া মিল বন্ধনে আবদ্ধ হয় নাই। সেই জন্য মনে হয় এ গানগুলির রচনারীতি সব গ্রাম্য গানের চাইতে প্রাচীন। কুচবিহার, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার মেয়েলী গানগুলি অপেক্ষাকৃত উন্নত ধরণের। সেখানে প্রত্যেকটি ভাব দুই লাইনের কথার মিল-বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছে।

এ বাড়ী হেতে সে বাড়ী যেতে ঘাটায় ছিপছিপ পানি

গাবরুর ভিজিল্ জামাজোড়া কন্নার ভিজিল শাড়ীরে।

(কুচবিহারের মেয়েলী গান)

কিন্তু অন্যান্য জেলার গানগুলি প্রায়ই পূর্ব্বোক্ত ধরণের। এই গানগুলির অপূর্ব্ব উপমা ও শব্দালঙ্কারের ছড়াছড়ি নাই। গানের রচয়িত্রী মনের কথাটিকে সাজাইয়া গুছাইয়া সুন্দর করিয়াও বলিতে পারে নাই। বোবার ইঙ্গিতের মত এই গানের ভাষা বড়ই অস্পষ্ট! কিন্তু তবু তাহা অন্তরকে স্পর্শ করে। সে বোধ হয় এই কারণে যে, আমাদের মার্জ্জিত সাহিত্যের উপমা অলঙ্কারের বালাই লইয়া লেখিকাকে কসরৎ করিতে হয় নাই। মনে যে কথাটী উদিত হইয়াছে রচয়িত্রী তাহা সরল মনে অকপটে ব্যক্ত করিয়াছে। সেই কথাগুলি কোন ছাপাখানার ললাটে অঙ্কিত হইয়া সাহিত্যের আসরে আদর পাইবার স্পর্দ্ধা রাখে নাই। গ্রাম্য রসপিপাসুদের রসপিপাসার তৃপ্তি যদি তাহারা দিতে পারিয়াছে তবেই মহাকাল তাহাদিগকে আপন বক্ষে ধারণ করিয়া রাখিয়াছে, নতুবা অনন্ত বিস্মৃতির গর্ভে সেই কথাগুলি বিলীন হইয়া গিয়াছে! এজন্য কেহ কোন দিন কোন ক্ষোভ করে নাই। কিন্তু কালের কষ্টিপাথরের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া যেগুলি রহিয়া গিয়াছে তাহারা গভীর আন্তরিকতার গুণে মনকে বড়ই মুগ্ধ করিয়া তোলে।

এই গানগুলির রচয়িত্রিগণ লেখাপড়া শিখিয়া মনের তেমন বিকাশ লাভ করিতে পারে নাই। যে কথা তাহারা বলিয়াছে, আকারে ইঙ্গিতে বলিয়াছে সেই জন্য যেটুকু তাহারা বলিতে পারে নাই সেটুকু পাঠককে তাহার মনের কল্পনা দিয়া গাঁথিয়া লইতে হইবে। এই ক্ষমতা যাহাদের নাই তাহারা এই গানগুলি পড়িয়া তেমন আনন্দ পাইবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটা বিবাহের গানের উল্লেখ করা যায়। বালিকা মেয়েটিকে বরের দেশে পাঠাইয়া মায়ের সকল অন্তর কান্নায় ভরিয়া উঠিতেছে –

আগে যদি জানতাম রে ময়না

তোরে নিবে পরেরে সুন্দর ময়নামতি রে।

পাটার চন্দন পাটায় না থুইয়া

তোরে লইতাম কোলে লো সুন্দর ময়নামতি রে।

মা যদি আগে জানিত তার সুন্দর ময়নামতিকে ভিন্দেশী এক বর আসিয়া লইয়া যাইবে, তবে মা আরও বেশী করিয়া তার মেয়েটিকে আদর করিত। গৃহে এতদিন মেয়েকে যে আদর সে করিয়াছে সে ত’ আদরই হয় নাই। আগে জানিলে মা কোন দিন চন্দন ঘসিয়া অঙ্গে মাখিত না। পাটার চন্দন পাটায় পড়িয়া থাকিত। চন্দনের মত শুভ্র শীতল তার বালিকা মেয়েটিকে কোলে করিয়া মা কোল জুড়াইত। এই গানের পরবর্ত্তী লাইন দুটিতে আছে :

আধেক গাঙ্গে ঝড়ি বৃষ্টি

          আধেক গাঙ্গে বিয়ারে সুন্দর ময়নামতি রে।

ময়নারে যে নিয়া গেল

          চিলের ছোও দিয়ারে সুন্দর ময়নামতি রে।

আধেক গাঙ্গে আজ ঝড় তুফান বহিতেছে – ময়নার বাপের বাড়ীতে আজ দশমী দিবসের ক্রন্দন, কিন্তু আধেক গাঙ্গে আজ বিবাহের উৎসব হইতেছে – ময়নার শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা আজ নববর ও নববধূকে লইয়া আনন্দ উৎসব করিতেছে। চিল যেমন করিয়া ছো মারিয়া কোন দ্রব্য লইয়া যায় তেমনি বরের দেশের লোকেরা আসিয়া ময়নাকে লইয়া গিয়াছে। চিলের ছো কথাটী আধুনিক সাহিত্যের রসপিপাসুর হয়ত মনে ধরিবে না। কিন্তু যে অখ্যাত পল্লী-মেয়েটি এই গানের রচয়িত্রী সে মলয় সমীরণ অথবা চঞ্চল বিজলীর কথা জানে না। তাহার গৃহপালিত মুরগী বা হাঁসের বুক হইতে ছানাগুলি চিলে ছো মারিয়া লইয়া যায়, সে নিজের চক্ষে তাহা দেখিয়াছে। বরের দেশের লোকেরা নিষ্ঠুরের মত তার কোল খালি করিয়া শিশু মেয়েটিকে লইয়া গিয়াছে। চিলের উপমা না দিলে এই কথাটিকে সে সম্যক-রূপে প্রকাশ করিতে পারিত না। এই গানের পরবর্ত্তী লাইনগুলি এইরূপ :

ময়নার বাপে কান্দন কান্দে চালের বাতা ছোটে

ময়নার মায়ে কান্দন কান্দে গাছের পাতা ঝরে লো

               সুন্দর ময়নামতি রে।

এখানেও আকাশের শাওন মেঘ ময়নার বাপের কান্দনের সঙ্গে ঝরিল না, ময়নার মায়ের কণ্ঠ হইতে মণির মালা খসিয়া পড়িল না – গরীব মানুষ ময়নার বাপ। খড়ের ঘরে সে থাকে। ময়নার জন্য সর্বদাই তার মন অন্যমনস্ক থাকে। ঘরের চালের বাখারীর বন্ধন খসিয়া পড়িতেছে, সেদিক তাহার খেয়াল নাই।

আরও একটা মেয়েলী ছড়া উদ্ধৃত করি :

     ওপারকার লঙ্কা গাছটি রাঙ্গা টুক্টুক্ করে

     গুণবতী ভাই, আমার মন কেমন করে।

এখানে গুণবতী ভাই শুনিয়াই হয়ত আধুনিক সাহিত্যিক

কথাটিকে সংশোধন করিয়া গুণবান্ ভাই লিখিতে চাহিবেন। কিন্তু গুণবতী ভাই বলিতে আমরা যে প্রকাশভঙ্গীটির সঙ্গে পরিচিত হই, গুণবান্ ভাই বলিলে তারা একেবারে নষ্ট হইয়া যাইবে।

এই কথাটি একটী মেয়ে তাহার ভাইকে বলিতেছে। গুণবতী রূপবতী এই সব বিশেষণের সঙ্গেই সে নিত্যপরিচিত। ভাইকে ডাক দিতে যাইয়া যখন সে গুণবতী ভাই বলিতেছে, সেই ডাকের সঙ্গে তার সমস্ত মেয়েলী অন্তর উৎসারিত হইয়া উঠিতেছে।

প্রকাশকাল : মাসিক মোহাম্মদী, ১৪শ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, কার্ত্তিক, ১৩৪৭ সাল।